নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অন্ধ্র প্রদেশ থেকে আগত তেলুগু একটা পরিবার- স্বামী স্ত্রী দুজনেই বেশ সেটেলড। এই পরিবারে বাবা লোকটির নাম ইন্টারেস্টিং। রজনীকান্ত। সিনেমার নায়কের নামে নাম রেখেছিলেন কিনা এই প্রশ্ন রজনীকান্তের বাবাকে জিজ্ঞেস করার কোনো উপায় নাই আসলে। রজনীকান্ত একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ। রজনীকান্তের স্ত্রী পদ্মা- একজন মাইক্রোবায়োলজিস্ট। ফলে আঁচ করা যায় একটা গোছানো ছিমছাম পরিবার। চারদিকে হাইজিনের সুস্পষ্ট ছাপ দেখতে পাবো- যদি রজনীকান্তের ঘরে আমাদের প্রবেশের অনুমতি মেলে আর কি। এই চমৎকার দম্পতির ঘরে ২০০৬ সালের ২৯-ই মে গুকেশের জন্ম। ডম্মারাজু অংশটি বাবার নামের থেকে নেওয়া।
গুকেশ যখন বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে যায়, ১৯ সালের আলাপ- তার আগের সময়টায় গুকেশ বিশ্বের বিভিন্ন অনূর্ধ্ব টুর্নামেন্ট জেতে, বিশেষত এশিয়ান স্কুল টুর্নামেন্টগুলো। তখনই তাঁর ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করি। কন্সট্যান্ট টুর্নামেন্ট রাশের ভেতর থাকার কারণে গুকেশের আইএম রেজাল্ট চলে আসে বেশ দ্রুত। সালটা ২০১৭।
কোভিডের বিরাট একটা প্যারা চলে আসলো। দাবার টুর্নামেন্টগুলি তখন সব অনলাইনে। বিরাট বিরাট প্রাইজমানি। র্যাপিড বা ব্লিটজ টুর্নামেন্ট ইউটিউবে টিউন ইন করে বসলে সবার আগে চোখে পড়তো ভারতীয় ছেলেপিলেদের সংবাদ। গুকেশ তখনও ঐ অর্থে স্টার না। প্রজ্ঞানন্দ, নিহাল সারিন, অর্জুন এরিগেইসি- এদের ভিড়ে গুকেশকে ঠিকঠাক ধরতে না পারা গেলেও মাঝেমধ্যে চমকপ্রদ কিছু খবর পেতাম।
যেমনঃ ২০২১ সালে জুলিয়াস বায়ার চেস ট্যুরের সেকেন্ড র্যাপিড ইভেন্ট জেতে গুকেশ ডি। ১৯ খেলায় ১৪ পয়েন্ট পেয়ে ২০ জনের ভেতর চ্যাম্পিয়ন হয় সে।
বছর ঘুরে ২২ সাল। চারদিকে প্রচুর দাবার টুর্নামেন্ট। একেক জায়গায় জিতছেন একেকজন। এরকম ইন্টারনাশনাল টুর্নামেন্ট জিতলে এক ধরনের পয়েন্ট জমা হয়। এই প্রসঙ্গে পরে আসবো হয়তো। সেই বছর সবার চোখ ছিলো ৪৪ তম অলিম্পিয়াডের দিকে। ভারতের বেশ কয়েকটি টিম গিয়েছিলো সেখানে। স্পেসিফিক গুকেশের স্কোর যদি বলতে হয়- তাহলে আমার মতো আপনিও অবাক হবেন।
গুকেশ ১১ খেলায় ৯ পয়েন্ট তো পেয়েছিলোই, সেই সাথে হারিয়েছিল আমেরিকার ১ নাম্বার দাবাড়ু ফাবিয়ানো কারুয়ানাকে। এই রেজাল্টের জন্য গুকেশ বোর্ড প্রাইজসহ গোল্ড মেডাল পায়। সম্মিলিতভাবে টিম রেজাল্ট তৃতীয় র্যাংকিং-এ।
একই বছরের শেষের দিকে রেটিংয়ে গুকেশ ২৭০০ ক্রস করে, এখানেও একটা রেকর্ড আছে। বয়েসের হিসেব করলে তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ূ হিসেবে ২৭০০ ক্রস।
একই সময় এইমচেস র্যাপিড টুর্নামেন্টে ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারায় গুকেশ।
**
বাবা একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, মা নার্স। ওয়েনঝু’র উপকূলবর্তী শহরে বেড়ে ওঠেন দিং লিরেন। কখনো ভাবেননি চাইনিজ ইতিহাসের সবচে শক্তিশালী খেলোয়াড় হয়ে উঠবেন। তরুণ বয়স থেকেই রেখেছেন মেধার স্বাক্ষর। জিতেছেন দুইটি ওয়ার্ল্ড ইয়োথ টাইটেল এবং চায়নার সবচেয়ে সম্মানজনক জুনিয়র প্রতিযোগিতা। পিকিং ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনাও শেষ করেছেন।
ছাত্র থাকাকালীন দিং লিরেন ভালো ছিলেন অংকে। বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনোর পর বুঝতে পারেন তিনি আসলে ভালোবেসেছিলেন সাহিত্যই। রেমন্ড কার্ভারের লেখা পছন্দ, পড়েছেন হারুকি মুরাকামিও।
ইয়ান নেপোমনিয়াশির সাথে দিং লিরেন যখন প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামেন- তাঁর বডি জেশ্চার দেখে কোনোভাবেই তাঁর আত্মবিশ্বাসের মাত্রা পরিমাপ করা সম্ভবপর হয়নি। কিন্তু খেলায় ছিলেন ডেডলি। গেম ৬-এ তাঁর বিজয় দাবার ইতিহাসে রচিত হয়ে গেছে অত্যন্ত কাব্যিকভাবে। শেষমেশ টাইব্রেকারের Rg6-চালে হতভম্ব হয়নি, এমন বান্দা খুব কম পাওয়া যাবে। দিং লিরেন কথায় নয়, বোর্ডে প্রমাণ করেছেন কেন আল্টিমেট চ্যাম্পিয়ন হওয়া তিনি ডিজার্ভ করেন।
**
পার্সি বিশী শেলী'র একটা কবিতা আছে- 'হাইম টু ইন্টেলেকচুয়াল বিউটি', কবি বলছেন:
Love, Hope, and Self-esteem, like clouds depart
And come, for some uncertain moments lent.
Man were immortal and omnipotent,
Didst thou, unknown and awful as thou art,
Keep with thy glorious train firm state within his heart.
Thou messenger of sympathies,
That wax and wane in lovers' eyes;
Thou, that to human thought art nourishment,
Like darkness to a dying flame!
Depart not as thy shadow came,
Depart not—lest the grave should be,
Like life and fear, a dark reality.
এই কবিতাটা সবচে বেশি আরো একবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে আমার কাছে।
চ্যাম্পিয়ন হবার পর দিং লিরেনকে খুব কম টুর্নামেন্টেই খেলতে দেখা গেছে। সব খোলস ছেড়েছুড়ে টুর্নামেন্টে ফিরে আসলেও জয়ের দেখা পেয়েছেন খুব কম। এমনকি- দিং লিরেন সম্ভবত একমাত্র 'উইক' ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন, যে কিনা চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ শুরুর আগেই হারিয়েছেন শীর্ষ দশের অবস্থান! অন্যদিকে গুকেশ টপ ফাইভের ভেতর ওঠানামা করেছেন। রেটিং এবং র্যাংকিং গ্যাপ দাবায় খুবই প্রভাব ফেলে- যেহেতু একমাত্র এটা দিয়েই কে কতটা শক্তিশালী, তা বোঝা যায়।
দিং লিরেন অলরেডি চ্যাম্পিয়ন হয়ে বসে থাকার কারণে তাঁর জার্নিটা আমার লেখায় বেশি একটা উঠে আসবেনা। র্যাদার গুকেশ-কে নিয়েই কথা বলা যাক।
চ্যাম্পিয়নকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে স্থান পেতে হলে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট জিতে ভালো স্কোর করা লাগে। আবার ওয়ার্ল্ড কাপের জয়ী প্রথম তিনজন সরাসরি ক্যান্ডিডেটসে কোয়ালিফাই করেন। ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড কাপ জেতে ম্যাগনাস, কিন্তু সে তো ক্যান্ডিডেটস খেলবে না, কারণ সে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই করবে না! ফলে, ওয়ার্ল্ড কাপে সেকেন্ড হওয়া ভারতীয় প্রজ্ঞানন্দ এবং পাঞ্চব্যাগ নিজাত আবাসভ ক্যান্ডিডেটসে খেলার সুযোগ পায়।
প্রজ্ঞানন্দ হয়ে ওঠে ইনস্ট্যান্ট সেনসেশান। গুকেশের বয়েসের আশেপাশেই প্রজ্ঞা। চেন্নাইতে জন্ম। বেড়ে ওঠা সেখানেই। ওয়ার্ল্ড কাপে রানার আপ হওয়ার পর এয়ারপোর্টে লাইন ধরে যায় তার আগমনে। সরকারের তরফ থেকে ৫ কোটি টাকা এবং গাড়ি পায় প্রজ্ঞার পরিবার। মোটামুটি ইন্ডিয়ান মিডিয়ায় সেট হয়ে গেছে- প্রজ্ঞানন্দ ক্যান্ডিডেটস জিতবে এবং ইভেনচুয়ালি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হবে।
ডিসেম্বর ২০২৩-এ খবর আসে গুকেশ ফিদে সার্কিটে সর্বোচ্চ স্কোর করার কারণে সেও ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট খেলতে পারবে। এখানেও একটা ছোট ঘটনা ছিলো। ফিদে সার্কিট অনুযায়ী সর্বোচ্চ স্কোর মূলত ফাবিয়ানো কারুয়ানার, কিন্তু সে অলরেডি ওয়ার্ল্ড কাপে থার্ড হওয়ায় সেখান থেকে সরাসরি কোয়ালিফাই করার কারণে দ্বিতীয় স্কোরার হিসেবে গুকেশ চান্স পায়।
....ওয়েট, ওয়েট
কাহিনী এখানেও আছে।
এইযে গুকেশ ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে চান্স পেলো- ইতিহাসে তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ূ হিসেবে তাঁর নাম তালিকায় উঠে গেলো। প্রথমজন- ববি ফিশার, দ্বিতীয়জন ম্যাগনাস কার্লসেন।
**
গুকেশ ক্যান্ডিডেটসেও ফেভারিট ছিলো না। ম্যাগনাস কার্লসেন টুর্নামেন্ট শুরুর আগে একটা র্যাংকিং করেছিলেন- কার পারফরম্যান্স কেমন হবে এবং সেই অনুযায়ী ঐ দাবাড়ুর বিষয়ে তাঁর অবস্থান কী- এমন।
গুকেশের বিষয়ে ম্যাগনাসের অবস্থান ছিলোঃ "Will do poorly"
ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট ২০২৪-এ মোট ভারতীয় ছিলো ৩ জন। ৩ জনই দারুণ পারফরম্যান্স করেছেন। শুরুর দিকে টানা দুটি গেম জিতে ভিদিত গুজরাতি সাড়া জাগিয়েছিলেন। প্রজ্ঞার খেলাও মোর অর লেস গুড। শেষ রাউন্ডের জমজমাট ক্যালকুলেশনে নয় পয়েন্ট পেয়ে কেস-ক্লোজ করে হোটেলে ফেরে গুকেশ ডি।
স্টেজ মোটামুটি সেট। ইটস গুকেশ ভার্সেস দিং লিরেন। খেলা সিঙ্গাপুরে। টাইটেল স্পন্সর গুগল।
**
বাকি ঘটনা মোটামুটি সবাই জানি। প্রথম রাউন্ডে উদ্বোধন করতে আসেন স্যার ডেমিস হ্যাসাবিস- কেমিস্ট্রি নোবেল লরিয়েট। সাদা ঘুঁটি নিয়ে গুকেশ, কালো ঘুঁটি নিয়ে ফ্রেঞ্চ ডিফেন্স খেলেন দিং লিরেন।
প্রথম রাউন্ডে হেরে যায় গুকেশ। ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের আগেরকার ম্যাচগুলোতে 'ফ্রেঞ্চ ডিফেন্স' খেলা হয়েছে খুবই কম। ফলে দিং-এর এমন এপ্রোচে সারপ্রাইজড হয়েছিলেন দাবা জানে ও বোঝে এমন প্রায় সবাই।
প্রেস কনফারেন্সে দিং বলেন- "Well, of course I feel very good—I haven't won a single classical game for a long time and I managed to do that!"
বাস্তবিক বটে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর যে কয়টা টুর্নামেন্টে দিং লিরেন অংশ নিয়েছেন, তাঁর প্রায় সবকয়টিতে পারফরম্যান্স ছিলো বাজে। প্রথম রাউন্ডে এরকম জয় স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।
দ্বিতীয় রাউন্ড ড্র। আস্তে আস্তে প্রেশার বিল্ডের ন্যারেটিভটা খেয়াল করেন প্রিয় পাঠক।
তৃতীয় রাউন্ডে আবার সাদা ঘুঁটি গুকেশের। চমৎকার একটা জয়, মাত্র ৩৭ চালেই।
পরের টানা সাত রাউন্ড ড্র। দুজনের স্কোরই সমান।
একাদশ রাউন্ডের খেলায় গুকেশ কীভাবে কীভাবে যেন ২৯ চালের মাথায় জয় নিশ্চিত করে ফেলে। গেমটা আক্ষরিক অর্থেই বেশ জটিল ছিলো। সমানসংখ্যক ভুল দুজনেরই, কিন্তু আল্টিমেট লিড চলে আসে গুকেশের কাছে।
দ্বাদশ রাউন্ডের খেলায় সাদা ঘুঁটি নিয়ে এবার দিং লিরেনের জয়!
"In one of his best-ever games, Ding played with computer-like accuracy"
ত্রয়োদশ রাউন্ডের খেলা ড্র।
চতুর্দশ রাউন্ডের খেলা ম্যাথমেটিক্যালি ড্র-ই ছিলো, কিন্তু শেষের দিকে এসে এমন একটা ব্লান্ডার করে বসে দিং লিরেন- যে ব্লান্ডার থেকে ফেরত আসার সকল পথ ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। খেলাটি এতখানিই ড্র যে- একটা লাইভ স্ট্রীমে আনন্দ বলছিলেনঃ
"It would be a draw 99.73% with 0.27% reserved for uncertainty in life."
**
মানুষ-মাত্রই বেদনার সুচতুর ড্রয়িং। প্রতিটি রেখার তীব্রতাই এখানেই সুন্দর, শাশ্বত ও সার্বজনীন। ফলে, আনন্দের বর্ণিত ০.২৭% অনিশ্চয়তার ভেতরেও সম্ভাবনা বের হয়ে আসতে পারে- আপনি যতই এটাকে 'দুর্ঘটনা' কিংবা 'কপাল' বলে উড়িয়ে দেন না কেন, ৬৪ ঘরের গণিতে আমি এটাকে এচিভমেন্ট হিসেবেই দেখতে চাইবো।
ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হওয়া একটা ভীষণ প্রেশারের কাজ। গুকেশ ম্যানেজড টু ডু দ্যাট।
অভিনন্দন, চ্যাম্পিয়ন!
©somewhere in net ltd.
১| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪০
রাজীব নুর বলেছেন: দারুন।