নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটা সময়ে দাবার বিশ্বটা কনভিন্সিংলি নিয়ন্ত্রণ করতো রাশিয়া৷ যত চ্যাম্পিয়নশীপ হয়- সেসব তারাই জিতে। অংশগ্রহণ করতো অনেকেই, কিন্ত মুকুটটা চলে যাইতো রাশিয়ার কাছে। বটভিনিক, তাল, পেট্রোসিয়ান, স্মিসলভ, স্প্যাসকি, কারপভ, কাসপারভ, ক্রামনিক- এরা বিভিন্ন সময়ে ছিলো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন।
এখন এইসব কথাগুলা বলতেসি একটা বিশেষ কারণে। সেই বিশেষ কারণে যাওয়ার আগে আরো কিছু জিনিস বলে রাখা ভালো৷
দাবাটা সেই সময়ে ছিলো একটা রাজনৈতিক খেলা। এছাড়া আর কিছু না। সোভিয়েত স্কুল অফ চেস- এখান থেকেই প্লেয়াররা বের হইতো, চ্যাম্পিয়নশীপ হইলে কলকাঠি নাড়ার বিষয়টা উপর মহলই করতো৷ এছাড়া অভিযোগ উঠেছিলো- রাশিয়ান প্লেয়াররা নিজেদের মধ্যে খেলা পড়লে দ্রুত ড্র করে ফেলতো ইচ্ছে করেই যাতে করে খেলাটা রাশিয়ানদের মধ্যেই থাকে৷ এই অভিযোগটা করেছিলো জনৈক রবার্ট জেমস ফিশার নামের এক ভদ্রলোক৷ তিনি ১৯৬২ সালে 'স্পোর্টস ইলাসট্রেটেড' নামক এক ম্যাগাজিনকে পাঁচজন রাশিয়ান প্লেয়ারদের নামে অভিযোগ করে একটা আর্টিকেল দেন৷ তারা নিজেদের মধ্যে পাতানো ম্যাচ খেলতো যেন কোনো 'নন-রাশিয়ান' প্রাইজ/টাইটেল না পায়! ববি ফিশার টুর্নামেন্ট খেলবেন না বলে ঘোষণা দেন।
যাইহোক, এরপর যথাক্রমে অনেক চড়াই-উৎরাই। রবার্ট জেমস ফিশার যাবতীয় সকল রিকোয়ার্মেন্ট খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করেন। তিনি তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন রাশিয়ান বরিস স্প্যাসকির বিরুদ্ধে খেলবেন। জানা যায়, বরিস স্প্যাসকিকে উপর মহল থেকে রাজনৈতিকভাবে চাপ দেয়া হচ্ছিলো- চ্যাম্পিয়নশীপের টাইটেল কোনোভাবেই যেন রবার্ট জেমস ফিশার নামের ননরাশিয়ানের কাছে যায়। আবার এদিকে ফিশারও তার দেশে ব্যাপক জনপ্রিয় তখন৷ একদম তুঙ্গে৷ আর হবেই-বা না কেন? বিগত ৬০/৭০ বছরে কোনো আমেরিকান চ্যাম্পিয়ন নাই। গলিতে গলিতে তখন ফিশারের ক্রেজ। মেয়েরা পাগল তার জন্য, যেমন করে আমাদের দেশে সালমান শাহর জন্যে পাগল। বলা যায়- ফিশার তখন আমেরিকান সালমান শাহ।
জোক্স এপার্ট, এইরকম একটা ইতিহাস গড়বার কারণে ফিশার নিজেও কিছু দায়িত্ববোধ ফিল করেন। সেইসাথে, রাজনৈতিকভাবেও কিছু ইঙ্গিত পান- তাকে জিততে হবে। তাও আবার রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে, যারা কিনা বংশ পরম্পরায় চ্যাম্পিয়নশীপ জিতে আসতেছে! ফাইন। কিন্তু ফিশারের মাথায় তখন আসলে অন্য চিন্তা।
বরিস স্প্যাসকির সাথে তার টোটাল পাঁচটা খেলা হইসে জীবনে৷ এর মধ্যে ফিশার একটাও জিতে নাই। স্প্যাসকি জিতছেন তিনটা, বাকি দুইটা হইছে ড্র৷ এই রেশিও নিয়ে তিনি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলবেন। বুঝেন৷
কিন্তু কাহিনী অন্য জায়গায়। ফিশার তখন বিশ্বে এক নাম্বার রেটেড প্লেয়ার, ১৯৭২ সালের ফিদে হিসাব অনুযায়ী ফিশারের রেটিং তখন ২৭৮৫ আর স্প্যাসকির ২৬৬০। অর্থাৎ, ফিশারের রেটিং স্প্যাসকির চেয়ে ১২৫ পয়েন্ট বেশি।
উক্ত টুর্নামেন্টের প্রাইজমানি ছিল কত জানেন? ১ লাখ ৩৮ হাজার ডলার৷ যিনি জিতবেন- উনি পাবেন ৭৮১২৫ ডলার, আর বাকিটা লুজারের। পাঁচ ম্যাচের রেশিওতে ফিশার একটাও জিতেন নাই, কিন্তু চ্যাম্পিয়নশীপের ম্যাচ খেলা হবে টোটাল ২৪ টা৷ ফিশার দাবি করে বসলেন টাকার পরিমাণ বাড়াইতে হবে৷ ব্রডকাস্টিং থেকে যত টাকা আসবে তার ৩০ শতাংশ এবং বক্স অফিসের ৩০ শতাংশ- এই মোট ৬০ শতাংশও দিতে হবে। অর্গানাইজারদের মাথায় হাত, এত এক্সট্রা টাকা, কীভাবে কী?
ডিমান্ড মিলে নাই, ফিশার সিম্পলি বলে দিলেন- তিনি খেলবেন না। চলে গেলে কোথায় যেন৷ পরে হেনরি কিসিঞ্জার তাকে ফোন দিলেন সরাসরি, বললেনঃ বাবারে, আমেরিকার জন্য খেলাটা খেলো। তোমাকে দরকার আমাদের।
মিনহোয়াইল একজন ব্যবসায়ী টাইকুন টাকা ঢাললেন। কিন্তু ১ জুলাইয়ের ওপেনিং সিরিমনিতে ফিশার উপস্থিত হতে পারলেন না৷ সারাবিশ্বে দাবানলের মত ছড়ায় গেলোঃ ফিশার কি আদৌ খেলবে?
১৯৭২ সাল। চ্যাম্পিয়নশীপের খেলা শুরু৷ ফিশার বনাম স্প্যাসকি। ফিশার কালো ঘুটি নিয়ে খেললেন নিমজো-ইন্ডিয়ান ডিফেন্স। খেলা ভালোই চলছিলো৷ ২৯ তম চালে গিয়ে ফিশার এমন একটা ব্লান্ডার করলেন- যেটা আসলে একজন মাঝারি সাইজের দাবাড়ুও কোনোদিন করবে না। খেলায় হেরে গেলেন ফিশার৷
২ নং খেলায় ফিশার উপস্থিত হননি। তার সেই পুরোনো 'নাটক'৷ তথাকথিত 'ডিমান্ড' ফুলফিল হয় নাই, তাই তিনি আসবেন না। খেলার ফলাফল স্প্যাসকির পক্ষে চলে গেলো। ফিশারের পয়েন্ট শূণ্য, স্প্যাসকির ২! যেটা যেকোনো টুর্নামেন্টের জন্য অত্যন্ত ডিসাইসিভ। ফিশার ক্লেইম করলেন- ক্যামেরার সাউন্ডের শব্দ তার কানে যায়৷ তিনি বিরক্ত হন, তাই খেলবেন না। হলরুমের পেছনে একটা টেনিস রুম আছে, ঐখানে যদি বোর্ড সাজানো যায়- তবে তিনি খেলবেন। নাইলে আপনারা থাকেন আপনাদের চ্যাম্পিয়নশীপ নিয়ে, উনার লাগবে না এতকিছু৷
স্প্যাসকি নিতান্ত ভদ্রলোক। তিনি ফিশারের কথা শুনলেন। এবং রাজি হলেন ব্যাকরুমে খেলতে৷ আবার ফিশার কালো ঘুঁটি৷ মডার্ন বেনোনি ক্লাসিকাল মেইন লাইন ভ্যারিয়েশন খেললেন ফিশার৷ খেলাটা দেখে মনে হবে এন্টিপজিশনাল, এবং সকল নিয়ম নীতির ব্যতিক্রম। কিন্তু ফিশার আসলে মানুষটাই এরকম, সকল প্রাকৃতিক নীতির বাইরে তিনি৷ ৪১ চালে ফিশার জিতে গেলেন!
২৪ টা ম্যাচের এই খেলাটা একটা নাটকীয় খেলা। সেরা সেরা চিত্রনাট্যকাররাও এই গেমের স্ক্রিপ্ট এত থ্রিলিংভাবে লিখতে পারবে না! শুরুতে দুইটা ম্যাচ ডাউন ছিলেন ফিশার, ফাইনাল রেজাল্টে দেখা গেলো ফিশার চ্যাম্পিয়নশীপ জিতেছেন ১২.৫-৮.৫ পয়েন্টে! খেলা শেষে নিউইয়র্কে ফিরলেন, তিনি তখন ইন্সট্যান্ট সেলিব্রেটি৷ কোটিকোটি টাকার বিভিন্ন অফার তার পায়ের কাছে৷ একদিন 'ফিশার ডে'ও পালন করা হইলো৷
সময় গড়ায়৷ পরবর্তী চ্যাম্পিয়নশীপও আগায় আসলো। যা ভাবসেন- ঠিক তাই৷ ফিশার খেলতে রাজি হইলো না বিভিন্ন কারণে। তার অনুপস্থিতিতে আনাতোলি কারপভ নামক জনৈক রাশিয়ানকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হইলো। প্রশ্ন উঠলো- যদি সত্যিই ফিশার খেলতেন তবে কি তিনি তার টাইটেল ধরে রাখতে পারতেন? এই ইমাজিনেশনটা আপনার উপর ছেড়ে দিচ্ছি একটা ছোট্ট তথ্য যোগ করে৷ ১৯৯২ সালে বরিস স্প্যাসকি আর ফিশারের একটা রিম্যাচ হয়৷ সেটাতে অত্যন্ত সফলভাবে 'দাবার আইনস্টাইন' রবার্ট জেমস ফিশার-ই জেতেন।
যাইহোক, রাজনৈতিক একটা প্রেক্ষাপটে ছিলাম৷ কত কথা হইলো! খানিক আগেই 'এয়ারথিং মাস্টার্স' নামে দেড় মিলিয়ন ডলারের একটা টুর্নামেন্ট শেষ হইলো৷ ফাইনালিস্ট ছিলেন আজারবাইজানের তিমুর রাজাবভ এবং আর্মেনিয়ার লেভন আরোনিয়ান৷
আজারবাইজান বনাম আর্মেনিয়ার 'নাগার্নো কারাবাখ' কনফ্লিক্টের কথা তো কমবেশি সবাই জানেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা রাজনৈতিক ইস্যু এটা৷ দুই দেশের মধ্যে দফায় দফায় যুদ্ধও হইলো৷ ভাগ্যের পরিহাসে- দাবায় এত বড় একটা প্রাইজমানির ইভেন্টেও ফাইনালিস্ট দুইজন উক্ত দুটি দেশের! খেলার রেজাল্ট অবশ্য আজারবাইজানের পক্ষেই, মানে আজারবাইজানী প্লেয়ার তিমুর রাজাবভ জিতেছেন আর্মেনিয়ার লেভন আরোনিয়ানের বিপক্ষে৷
পুরোপুরি না হোক, এই ফলাফলের একটা নির্দিষ্ট পরোক্ষ প্রভাব তো অবশ্যই আছে! এটা অবশ্য টোটাল 'নাগার্নো কারাবাখ'র উপর কতখানি প্রভাব ফেলবে তা জানি না৷ কিন্তু রাজনৈতিক ইগো সম্ভবত একটু বাড়ায়/কমায় দিলো।
দাবাটা ঠিক ততখানি পলিটিকাল, যতখানি আমাদের ইমাজিনেশন এটাকে পলিটিকালি ভাবায়।
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:১৯
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: দাবা বুদ্ধিমান দের খেলা।