![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অনুগল্প: অন্তরালে
লেখা :মোহসিনা বেগম
.
১।
চাঁদের আলোটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হচ্ছে। হ্যারিকেনের আলোটা কমিয়ে দিল সখিনা। নৌকা চলছে ধীরে ধীরে। সামনে বসে জমির মিয়া বৈঠা বাইছে। পেছনে বসে তাঁর চৌদ্দ বছরের মেয়ে সখিনা হাল ধরে আছে। সেই সাত বছর বয়স থেকেই নৌকা বাইতে পারে সখিনা,একজন পাকা মাঝির মতোই দক্ষ হাতে নৌকা সামলাতে পারে সে। ঝড়ের সময়ও তাঁর নৌকা ডুবতে গিয়েও ভেসে থাকে।
.
জমির মিয়ার তিন মেয়ে বড়টা সতের বছর , সখিনা মেঝ আর ছোটটা ৮ বছরের। ছেলে নাই বলে জমির মিয়ার একসময় খুব আফসোস ছিল । কিন্তু এখন আর নাই। সখিনা ছেলেদের চেয়ে কোন অংশেই কম না। বাজারের সওদা করা, সবজি বেচা থেকে শুরু করে মাছ ধরা পর্যন্ত একটা ছেলের মতোই অনায়াসে করে ফেলে সে। এমনকি গাছ থেকে নারিকেল , সুপারি, আম, জাম পেরে আনে। পড়ালেখায়ও খুব ভাল ছিল। কিন্তু গরিবের মেয়ে ফাইভ পাশ করেছে এটাই ঢের! বাপের সাথে খাটলে সংসারে কাজে লাগবে। বড়লোকের মেয়েদের মতো চুল বেণী করে, পরিপাটি জামা পড়ে স্কুলে যাওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই । তাইতো বাপের সব কাজে আগে আগে চলে সে। আজকে মাগরিবের পরপরই ঘাটে গিয়ে নৌকায় জমে থাকা পানিটুকু সেচে রেখে এসেছে। বাড়ি গিয়ে বাপের সাথে এক মুঠো খেয়েই বেড়িয়ে এসেছে দুই জনে মাছ ধরতে।
.
আকাশে চাঁদটা বেশ আলো ছড়াচ্ছে। জমির জোরে জোরে বৈঠা চালিয়ে নদীর মাঝ বরাবর এসে থেমে যায়। ধীরে ধীরে জাল ফেলে সে। সখিনা হাতের বৈঠাটা রেখে তাকে সাহায্য করে। আজকে অনেক মাছ উঠতেছে। খুশি খুশি মনে জমির বলে ওঠে,
- আইজকা মনে হয় কপালডা ভাল রে মা... খুব মাছ ধরা পড়তাছে। কাইলকা হাট থেকে তোরে এক জোড়া নুপূর কিন্না দিমু।
নুপূর পড়া অনেক দিনের শখ সখিনার । বাপকে কয়েকবার বলেছেও সে কিন্তু সংসারের অতি প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করতেই রোজগারের সব ফুরিয়ে যায় , বাড়তি একটা টাকাও থাকে না।
-- আইচ্ছা বাবা।
অন্যদিন হলে এ নিয়ে সখিনার কথা শেষ হতো না। অথচ আজকে সে কোন কথাই বলছে না! জমির মিয়া ঠিক বুঝলো না, আজকে মেয়ের মন নাকি শরীর কোনটা খারাপ? ঘাট থেকে এ পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি মেয়ে, অন্যদিন কথার খৈ ফুটতো।
--- তোর কী কিছু হইছে মা?
-- না বাবা , কিছু না তো!
-- তাইলে চুপচাপ যে?
-- এমনেই
জমিরও আর কিছু বলে না। পানি থেকে জাল তুলতে থাকে । কিন্তু এবার খুব ভারী লাগছে জালটা , কিছুতেই টেনে তোলা যাচ্ছে না। তিন ব্যাটারির লাইটটা মেরে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলো জমিরের মুখ! একটা লাশ আটকে আছে জালে! ২৫-২৬ বছরের এক যুবক। জমির অস্ফুট চিৎকার দিয়ে ওঠে।
- হায় আল্লা, এইডা কে? আহারে কোন মার বুক খালি হইছে রে... এমন জোয়ান পোলাডা পানিতে পইরা তো মরার কতা না! নিশ্চই কেউ মাইরা পানিতে ফালাইয়া দিছে । আহারে! কেডা করলো এমন শয়তানি কামডা? মার বুকের ধন কাইড়া নিলো। দেখ সখিনা দেখ...
-- তুমি আবার ধইরো না বাজান। গাঙ্গের মরা গাঙ্গেই থাক। শেষে আবার পুলিশি ঝামেলা হইবো।
.
২।
লাইটের আলো লাশটার উপর পড়তেই সখিনা চিনে ফেলেছিলো। যে শয়তানটাকে সে মাগরিবের সময় শেষ করেছিল সেটাই ভাসতে ভাসতে এসে তাদের জালেই আটকা পড়লো? সাপ মারার মতোই ছেলেটাকে মেরেছিলো সে। একটুও অনুশোচনা হয়নি । সাপ মারলে অনুশোচনা হবার কথাও নয়। স্বাভাবিকভাবেই বাড়িতে গিয়ে ভাত খেয়ে বাপের সাথে নৌকায় এসেছিলো সে। এখন তাঁর বাপের কথাগুলো শুনে একটু খারাপ লাগলো। আবার পরক্ষণেই মনে হলো " এই রকম অমানুষের দুনিয়াতে থাকার কোন অধিকার নাই, যারা অন্তরাল পেলেই নারী ধর্ষণ করতে চায়" ।
.
মাগরিবের সময় সখিনা নৌকা ঠিক আছে কিনা দেখতে এসেছিলো । মাঝখানে বাঁশের চালির উপর বসে নৌকায় জমে থাকা পানিটুকু নদীতে ফেলছিলো যখন তখন হালকা আঁধার নেমেছে। ছমির শেখের বড় ছেলেটা পেছন থেকে এসেই সখিনাকে শুইয়ে বুকের উপর বসলো। সখিনাও যে সে মেয়ে নয় ! জ্যান্ত গোখরাকেও সে লেজ ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলে। আমাবস্যা রাতেও একা পথ চলতে তাঁর ভয় হয় না। আট ইঞ্চির ছুরিটা বসিয়ে দিলো বুকের মাঝ বরাবর । ছেলেটা ছিটকে গিয়ে পড়লো সোজা নদীর পানিতে। অন্তরালে ঘটাতে এসেছিলো এক ঘটনা ঘটে গেলো অন্যটা। সখিনা ধীরে ধীরে অমানুষটাকে তলিয়ে যেতে দেখলো কিন্তু তাঁর একটুও খারাপ লাগলো না। পরে অবশ্য মনটা খারাপ হয়েছিলো , কেউ যদি জানতে পারে...? অন্তরালের ঘটনা অন্তরালেই থাকুক । কাউকে জানানো যাবে না। রক্তে লাল হওয়া প্রিয় ছুরিটাকে নদীর পানিতে ধুয়ে নিয়ে এসেছিলো সে। অভাবের মাঝেও নিজের নিরাপত্তার জন্য এক বছরে আশি টাকা জমিয়ে এটা কিনেছে সে । খাপও আছে, জামার নীচে লুকিয়ে রাখে সবসময় । কেউই জানে না এটার কথা। একটা একটা করে সব অমানুষ, এই ছুরি দিয়েই নদীতে ফেলে দিবে সে।
-- বাজান, চলো আইজকা যাই, ম্যালা মাছ পাইছি।
- কিন্তু লাশটা?
-- থাক।
বলে হেসে দিয়ে বৈঠা বইতে লাগলো সখিনা। মেয়ের সে হাসির রহস্য বুঝতে পারলো না জমির। চলতে শুরু করলো নৌকা।
©somewhere in net ltd.