![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যুক্তি আর পাল্টা যুক্তির কাটাকুটিতে জন্ম হোক বিশুদ্ধ স্বপ্নের !
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বিছানায় একা শুয়ে আছি। ঘরে আর কেউ নেই। ঘরটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার হয়ে আছে। দরজা চাপানো। এখানে ওখানে টিনের চালার ফুটো দিয়ে পাটকাঠির মত সোজা কিছু আলো এসে ঘরে ঢুকছে। বাইরে মুরগীগুলো তারস্বরে ডাকাডাকি করছে।
অনেকটা ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি দাদি কাঁথা মুড়ি দিয়ে কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
মা চুলার ছাই ফেলে এসে উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিলো। দৌড়ে মার কাছে গেলাম।
‘মা, বাবা আসে নাই।’
আমার ছটফটানি ভাব দেখে মা মুখ টিপে হাসল। ‘এখনো তো আসে নাই।’
মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। মা বলল, ‘যা দাঁত মেজে তাড়াতাড়ি গোসল করে আয়। তোর বাবা এক্ষুণি চলে আসবে।’
‘জবা কই মা।’
‘দেখ কোনখানে।’
জবা জামতলায় দাঁড়িয়ে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছিলো। হাতইকান্দি সড়ক জামতলা থেকে অনেকখানি দেখা যায়। বাড়িতে আসার সময় বাবাকে এখান থেকেই দেখতে পাবার কথা। পাশের বাড়ির বুলবুল তার তিন বছরের ছোট বোন দিবার হাত ধরে জবার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনের গায়ে ঈদের নতুন জামা। দু’জনের সিথি করা চুলে তেল চুপচুপ করছে। দিবার ঠোটে আবার লিপস্টিক, কপালে একটা জরির নীল টিপ। পাউডার মেখে দুজনেরই মুখ গলা সাদা হয়ে আছে।
আমি বলল, ‘বুলবুল, এইটা তোর ঈদের জামা?’
‘হু।’
‘সুন্দর হয় নাই।’
বুলবুল মুখ ভোঁতা করে বলল, ‘তোর ঈদের জামা কই? দেখি তোরটা কেমন সুন্দর।’
‘আমার ঈদের জামা তোর জামার চেয়েও সুন্দর। বাবা ঢাকা থেকে আনতাছে। লাল জামা। ঢাকার জামা অনেক সুন্দর। তাই না জবা?’
জবা দাঁতের উপর আঙ্গুল ঘষা বাদ দিয়ে পিচিক করে থুথু ফেলল। মুখ ঝাপ্টা দিয়ে বলল, ‘তোরে না কতবার বলছি আমারে জবা আফা ডাকবি। আমি তোর বড় না?’ জবা ইদানিং বড় বড় ভাব ধরছে। বয়সে আমার চেয়ে মাত্র অল্প একটু বড়। কিন্তু সব সময় তাকে ভাব নিতে হবে না জানি সে কত বড়।
জবার সম্মতিটা এখন আমার খুব দরকার। আমি বললাম, ‘আমাদের জামা বুলবুলদের জামার চেয়েও সুন্দর, তাই না জবা আফা?’
জবা আবার পিচিক করে থুথু ফেলল। বুলবুলকে বলল, ‘হু। আমাদের জামা অনেক সুন্দর। আমার বাবা ঢাকার হাট থেকে কিনছে। তোর বাবা কি ঢাকার হাট চিনে? ঢাকার হাটে গেছে কোন দিন?’
বুলবুলের মুখ আরও ভোঁতা হয়ে গেলো। বুলবুলের ভোঁতা মুখ দেখে আমার কষ্ট অনেকখানি কমে গেলো। দেখ এখন কেমন লাগে। কে বলছে তোকে এই ভোর সকালে ঈদের জামা পরে সবাইকে ঘুরেঘুরে দেখাতে। জবাকে আমার দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো বোন মনে হলো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে আমি তাকে সব সময় জবা আফা ডাকব।
সাবিনা বেগম পড়েছে ভালো বিপদে। ঈদের দিন। ঘরে দুইটা ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। এদিকে দুধ চিনি সেমাই মসল্লা ঈদের বাজার কিছুই নাই। প্রতিবার জবার বাবা সকাল সকাল চলে আসে। কেনাকাটা যা করার সাথে নিয়ে আসে। এবারের মত তো কখনো এত বেলা হয় না। পলাশকে একবার পাঠিয়ে দেবে নাকি শফিকের দোকানে। ঈদের দিনও বাকি আনতে কেমন দেখায়। অবশ্য জবার বাবা এসে সব শোধ করে দিবে। তার চেয়ে কিছু টাকা ধার করে পলাশকে বাজারে পাঠানো ভালো। বেশী দরকারি জিনিসগুলো কিনে আনুক।
বুলবুলের বাবা দিবাকে কোলে নিয়ে উঠানে বসে ছিল। জবার বাবা এখনো আসে নি শুনে বলল, ‘চিন্তা কইরেন না ভাবী। ঈদের বাজার। মনে হয় জামে পরছে।’ কিছু টাকা ধার চাইতেই বুলবুলের বাবা দিয়ে দিলো। বুলবুলের মা প্লেট ভর্তি করে দিলো সেমাই আর পিঠা। সাবিনা বেগম অনেক বার না না করল। ‘আপনাদের আমরা কিছুই দিতে পারতেছি না। আবার টাকাও ধার নিতাছি, প্লেট ভরে সেমাই-পিঠাও নিতাছি। এইটা কেমন দেখায়?’ বুলবুলের মা ছি ছি করে অনেকটা জোর করেই প্লেটটা সাবিনা বেগমের হাতে ধরিয়ে দিলো। ঈদের দিনে আবার এত হিসাব নিকাশ কিসের? সাবিনা বেগমের কেবলই লজ্জিতভাবে মনে হতে লাগলো, জবার বাবা আসলে সে প্লেট ভর্তি করে সেমাই সাথে এনে টাকা ফেরত দিয়ে যাবে।
জলচৌকিতে বসে দাদী কচুর লতা বাছছিলো। মাকে বলল, ‘আরিফ কখন আসবে বৌমা।’ সে কি করে জানবে কখন আসবে। মোবাইল থাকলে না হয় জানা যেত। মা চুলায় শুকনা পাতা লাকড়ি দিতে দিতে বলল, ‘ঈদে রাস্তায় যখন এত জাম হয় তখন এক দু’দিন আগে রওনা দিলেই হয়।’ রিকশাওয়ালাদের জন্য অবশ্য ঈদের আগে আগেই ইনকামের ভালো সুযোগ। ঈদের আগের দিনগুলোতে ভীড় থাকে বেশী। মানুষের মন থাকে ফুরফুরা। কেউ কেউ নিজ ইচ্ছায় দশ টাকার ভাড়া বিশ টাকা দেয়। যারা নিজ ইচ্ছায় দেয় না তাদের কাছে ঈদের কথা বললেই বাড়ায়া দেয়।
বাড়িতে বাড়িতে ঈদগায় যাবার তোরজোর শুরু হয়ে গেলো। এ ওকে ডাকে তো ও একে ধমকায়। সারা সকাল ঝিম মেরে বসে থেকে এখন সবার একসাথে তাড়াহুড়া শুরু হয়ে গেছে। বুলবুলের বাবা একবার বেড়ার ওপাশ থেকে মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘জবার বাবা আসে নাই ভাবী।’ বুলবুলের মা রান্না করছিলো। মার না উত্তর শুনে সেখান থেকেই বলল, ‘চিন্তা কইরো না ভাবী। বেলা তো খুব বেশী হয় নাই। ঈদের আগের রাতে রওনা দিছে। রাস্তায় মনে হয় গাড়িটাড়ি নষ্ট হইছে। এর জন্য দেরী হইতাছে।’ সাবিনা বেগম কি দুশ্চিন্তা করতে চায়। দুশ্চিন্তা আপনিই এসে ভর করে মনে। একসাথে ঈদগায় যাবার জন্য বুলবুল আমাকে ডাকতে এসে দেখে আমি পুরানো জামা পরে বসে আছি। তাই দেখে সে খবিসের মত খিক খিক করে হাসতে লাগলো। আমি ঈদগায় গেলাম চোখ মুছতে মুছতে।
নামায পরার সময়ও মন খুব খারাপ লাগল। সব সময় বাবার সাথে ঈদের নামাজে আসি। আজ এসেছি একা। সাথে অবশ্য বুলবুল আর বুলবুলের বাবা আছে। বুলবুল কত সুন্দর তার বাবার পাশে বসেছে। একবার মনে হলে, আমি ঈদগায় রওনা দেবার পর হয়ত বাবা বাড়ি এসেছে। এসেই ঈদগায় চলে এসেছে। আমি মাথা উঁচু করে ঈদগার এমাথা থেকে ওমাথা দেখতে লাগলাম। সবার মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। ঈদগায় ঢোকার গেটটা পরেছে পেছনে। ইস যদি ঘুরে বসা যেত। আমি কিছুক্ষণ পর পর ঘাড় ঘুরিয়ে গেটের দিকে তাকাতে লাগলাম। নামায পড়ার সময় খুব ছটফট লাগছিলো। বাবা কি বাড়ি এসেছে? কি রংগের জামা এনেছে? সাথে খাবার জিনিস কি কি এনেছে? জবা মনে হয় একাই সব খেয়ে ফেলছে। জবাটা যা খবিস। মোনাজাত শেষ হওয়া মাত্র দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি এলাম। এসে দেখে বাড়িতে হইচই পরে গেছে। উঠান ভর্তি লোক। মা বারান্দায় বসে কাঁদছে। জবা কাছেই দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে আর ফোফাচ্ছে। দাদী টিনের বেড়ায় হেলান দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। কে একজন খবর এনেছে টাংগাইলের কাছে বাস এক্সিডেন্ট করেছে। লোক মারা গেছে অনেক। কী কষ্টে আমার বুকটা ফেটে আসতে চাইলো। আমিও হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম।
হঠাৎ বাহির-বাড়িতে ভীষণ আনন্দমুখর হইহুল্লোড় শুরু হলো। আমি আর জবা দৌড়ে গেলাম। দেখি বাবা দুই হাতে দুইটা বড় ব্যাগ হাতে হাসতে হাসতে আসছে। আমরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম।
ছেলে মেয়ে দুটাকে দেখে আরিফ মিয়ার ক্লান্ত দেহে ফুরফুরা হাওয়া বইতে লাগলো। শেষ রাতের দিকে টাংগাইলের কাছে একটা বাস এক্সিডেন্ট করেছে। ট্রাক বাস মুখোমুখি সংঘর্ষ। বাস গিয়ে পরেছে খাদে। বাস টেনে তোলার জন্য ক্রেন এসেছে। রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। আহারে! ঈদের দিন কতগুলা মানুষ মারা গেলো। হয়তো তার মতই তারা বাড়ি যাচ্ছিলো। আহারে! কত পরিবারে আজ ঈদ চোখের পানিতে ভেসে যাবে। রাস্তায় ভীষন জ্যাম। প্রায় এক মাইল লম্বা গাড়ির লাইন। আরিফ মিয়া বাস থেকে নেমে প্রায় ঘন্টাখানেক হেঁটে জ্যাম পার হয়েছে। এক সময় দেখে নামাযের সময় হয়ে গেছে। অন্য আরও ঘরমুখো মানুষের সাথে আরিফ মিয়াও রাস্তার কাছেই এক ঈদগায় নামায পরে নেয়। যেখানে তার ভোর সকালে বাড়ি আসার কথা, এই জ্যামের কারণে ফিরতে ফিরতে সেখানে দুপুর হয়ে গেলো। ঈদের দিন অর্ধেক শেষ। আরিফ মিয়ার সংসারে ঈদ শুরু হবে দুপুর থেকে। তাও ভালো। তারা অর্ধেক ঈদ করতে পারছে। আরিফ মিয়া যে বাসে ছিলো সেটাও তো এক্সিডেন্ট করতে পারতো। না হয় যে বাসটা এক্সিডেন্ট করেছে সেও তো ঐ বাসে থাকতে পারতো।
জবা আর আমি গলা ফাটা চিৎকার করতে করতে এক দৌড়ে বাবার কাছে গেলাম। পাগলের মত লাফাতে লাফাতে দু’জনে বাবার দুই হাত শক্ত করে ধরলাম। দুই হাতে বানরের মত ঝুলতে থাকা আমাদের দুই ভাইবোনকে সাথে নিয়ে বাবা বাড়িতে ঢুকল! পেছন পেছন হৈ হৈ করতে করতে ঢুকল আশেপাশের বাড়ির এক গাদা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে!
©somewhere in net ltd.