নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

।। ফেসবুক বনাম বই পড়া- কোনটায় আমাদের কতোটা আগ্রহ বা দায়।।

১৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ২:০২

বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক চালু হবার পর বই পড়ুয়াদের সম্পর্কে বাজারে একটা বদনাম এখন চালু হয়েছে। প্রথম কথা হল- বইয়ের পাঠক কি তাহলে কমে গেছে? বইয়ের পাঠক কমে গেলে সেক্ষেত্রে ফেসবুক কতোটা দায়ী? যারা সত্যিকারের পাঠক, তাদের মধ্যে ফেসবুক কতোটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে? নাকি ফেসবুক আসায় বইয়ের পাঠক আগের তুলনায় বেড়েছে? দ্বিতীয় কথা হল- জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের কবি লেখক সংখ্যাও বেড়েছে। সেই তুলনায় পাঠক কয়জন বাড়লো? প্রকাশকের সংখ্যাও বেড়েছে। বই প্রকাশের সংখ্যাও বেড়েছে? কিন্তু কোয়ালিটি বই কতোটা বাড়লো? নাকি বাজারে যা বই আকারে বাড়ছে, সেগুলো সব আবর্জনা? শুধু কাগজের শ্রাদ্ধ? তৃতীয় কথা হল- দেশীয় সংস্কৃতি বিকাশে বর্তমানের কবি লেখকরা কতোটা ভূমিকা পালন করছে? নাকি শাসক দলের আস্থাভাজন প্রকল্পের অনুসারী হয়ে বোগল বাজানো কবি লেখকরাই কেবল দেশীয় সংস্কৃতির লালনপালনকারী? অন্যরা সবাই ক অক্ষর মুর্খ্য? সংস্কৃতি চর্চার রাষ্ট্রীয় বাজেটে দেশের কবি লেখকরা শতকরা কত ভাগ পাচ্ছে? বাকী বাজেট কারা কিভাবে খরচ করছে? সর্বশেষ কথা হল- রাষ্ট্র দেশের কবি লেখকদের জন্য স্বাধীনতার পর এই ৪৩ বছরে কি কি দায়িত্ব নিল?
অনেকগুলো প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলোর জবাব কি কি হতে পারে বলে আপনি মনে করছেন? আমি আমার ভাবনাটা একটু বলি। ফেসবুক চালু হলেও দেশে পাঠক সংখ্যা বেড়েছে বলেই আমার ধারণা। নইলে প্রতি বছর এভাবে বই বিক্রি বাড়তো না। এভাবে কবি লেখক সংখ্যাও বাড়তো না। এভাবে প্রকাশকদের সংখ্যাও বাড়তো না। পাঠক সংখ্যা বেড়েছে বলেই কবি-লেখক-প্রকাশক সংখ্যা বেড়েছে। বইয়ের বিক্রিও বেড়েছে। বইয়ের প্রকাশ সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু আরেকটা গোপন বিষয়ও বই বিক্রির সঙ্গে জড়িত। বিক্রিত বই কয়টা কতটুকু পড়া হচ্ছে? আমি নিজেকেই যদি প্রথম আসামি বানাই, সেখানে দেখা যায় যে, গত বছরের বইমেলা থেকে কেনা বইগুলোর সব এখনো পড়া শেষ হয়নি। আবার কোনো কোনোটা দুই-তিনবারও পড়েছি। তার মানে বইগুলো কেনার সময় আরো সতর্ক হবার প্রয়োজন ছিল। যে বইগুলো আদৌ পড়া হবে না, সে বইগুলো অযথা বুকসেলফে জায়গা দখল করে বসে আছে। এরকম বইগুলো আমি কোনো লাইব্রেরিতে দিয়ে দেবার পক্ষপাতি। তাতে আমার সময়ও বাঁচে। বুকসেলফে নতুন কিছু বই রাখারও সুযোগ হয়।
বই পড়ার ক্ষেত্রে ফেসবুক আমার মতে অনেকটাই দায়ী। আমি নিজে দেখেছি, কোনো কোনো দিন অকাজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে অকারণে ঘোরাফেরা করাটা একটা নেশার মত। এতে খুব সময় নষ্ট হয়। আবার ফেসবুকে একটু ঢু না মারলে মনের ভেতর যেনো কেমন কেমন একটা চুলকানি। এই চুলকানি বই পড়ার যথেষ্ট বারোটা বাজিয়েছে। যে বইটি তিন দিনেই পড়া শেষ হয়ে যাবার কথা, সেটি শেষ করতে অনেক সময় সপ্তাহ লেগে যাচ্ছে। আবার কোনো কোনোটা হয়তো আর শেষ করাই হচ্ছে না। ফেসবুক এই জায়গায় যে ঝামেলাটা করছে, এজন্য মিস্টার মার্ক জুকারবার্গ মশাইয়ের বিরুদ্ধে আমরা আদালতে মামলা ঠুকতে পারি কিনা? সেই মামলায় যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা দিয়ে না হয় আরো কিছু পছন্দের বই কিনলাম। জনাব জুকারবার্গের বিরুদ্ধে লড়াই করার মত উকিল কোথায় পাবো? সেই উকিল ফি কত নিবে? ফি ছাড়া অ্যাডভ্যান্স কাজ করে দেবার মত উকিল কেউ আছে কিনা? তার ফি বা কত? আইনি লড়াই শেষে যা পাওয়া যাবে, তা উকিলের পাওনা মিটিয়ে অবশিষ্ট থাকবে তো? না থাকলে পকেটের পয়সা খরচ করে মিস্টার জুকারবার্গের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা ঠিক হবে কিনা? তবে, আমি যদি উপযুক্ত কোনো উকিল পাই, যিনি নিজ দায়িত্বে লড়াই করে আদালতকে এটাই বোঝাতে সক্ষম হবেন যে, আমার মক্কেলের এই ফেসবুকের কারণে এত ঘণ্টা বই পড়ায় নষ্ট হয়েছে। ঘণ্টা হিসেবে সেই সময়ের এত মিলিয়ন ডলার মূল্য। আর যদি সেই লড়াইয়ে আমার উকিল আমাকে জয়ী করতে পারে, আমি হলপ করে বলতে পারি, সেই টাকায় সারা বাংলাদেশে একটি আদর্শ পাঠাগার আমি চালু করব। যেখান থেকে যে কেউ পড়ার জন্য পছন্দের বইটি নিতে পারবে। কোনো ধরনের ফি ছাড়াই। কিন্তু তেমন উকিল এই জনমে মিলবে কিনা সন্দেহ।
বই পড়ায় ফেসবুক যে পরিমাণ অনিহা সৃষ্টি করেছে, তার জন্য মিস্টার জুকারবার্গের বিরুদ্ধে অন্তত কয়েক লাখ মামলা হবার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেই মামলার কোনো আলামত না দেখে আমরা বুঝতে পারি, পাল্লাটা বই পড়ার চেয়ে এখন ফেসবুকের দিকেই বেশি। ভবিষ্যতে হয়তো শোনা যাবে, পছন্দের বইয়ের চুম্বক অংশটুকু ফেসবুকেই পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত পাঠক সময় বাঁচাতে সেই অংশটুকু পড়ে নিচ্ছে। তাহলে ফেসবুকের মাধ্যমেও নতুন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করার একটা মত একটা সুযোগ কিন্তু আছে। সেক্ষেত্রে আমাদের যারা সচেতন পাঠক, তাদের কিছু বাড়তি দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে। কি সেই দায়িত্ব? আপনার পড়া কোনো ভালো একটি বইয়ের চুম্বক অংশটুকু আপনি ফেসবুকে অনেকটা বুক রিভিউ'র মত যদি আমাদের সামনে হাজির করেন, তাহলেও একটা পাঠক শ্রেণী তৈরি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর আপনার লেখা সেই বুক রিভিউটি পড়ে হয়তো অনেকের বইটা পড়ারও ইচ্ছে তৈরি হবে। আমি বলতে চাইছি, অন্তত আপনি সপ্তাহে বা পনের দিনে বা মাসে অন্তত একটি বইয়ের রিভিউ ফেসবুকে আপলোড করেন। আপনি একজন ফেসবুক ইউজার হলেও আপনি এভাবে একজন সত্যিকারের পাঠক তৈরি করতে নিরবে ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমি সময় পেলেই আমার পড়া বইয়ের উপর দু'চার কথা ফেসবুকে লিখি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল, সেই লেখাগুলো খুব কম সংখ্যক বন্ধুরাই পড়েন।
এই ফাঁকে ফেসবুকে লাইক আর পড়ার মধ্যে একটা আসল পার্থক্যের কথা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কোনো লেখার লাইক সংখ্যা দিয়ে আদৌ জানার উপায় নাই, কয়জন লেখাটি পড়েছেন? আর কয়জনের লেখাটি ভালো লেগেছে? আর কত জন লেখাটিতে লাইক না দিয়েও পড়ার কাজটি করেছেন? পড়ার কাজটি নিরবে ঘটলেই ভালো। তার সংগে লাইক আর কমেন্টসের ব্যাপারটা অনেকটাই গৌন। তবে লাইকের তুলনায় কমেন্টস অনেকটা মুখ্য। অন্তত পাঠকের এক ধরনের প্রতিক্রিয়া সেখানে প্রতিফলিত হয়। সেক্ষেত্রে আমি পাঠকের প্রতিক্রিয়াকেই প্রাধান্য দেব। যদি আপনি বিষয়টি পড়েন, তাহলে কিছু না কিছু লিখুন। আপনার মতামত অন্তত জানা যায় তাতে। হোক সে বিপক্ষের মত। তবু অন্তত ওই বিষয়ের উপর একটা নতুন চিন্তার প্রতিফলন তো পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো কমেন্টস না করে শুধু হাজার খানেক লাইক দেখে কিছুই বোঝার সাধ্য নাই। আমি দেখেছি, ফেসবুকে সিরিয়াস লেখার চেয়ে চটুল বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষন বেশি। অংশগ্রহনও বেশি। এই চিত্র দেখেই বোঝা যায়, এই ফেসবুক বই পাঠের উপর কেমন নেগেটিভ প্রভাব ফেলেছে। তাই ফেসবুক ইউজারগণ যাতে অন্তত কিছুটা পড়ার অভ্যাসও ধরে রাখে, সেজন্য আমাদের কাউকে না কাউকে তো কিছুটা বাড়তি দায়িত্ব পালন করতেই হবে। কে কে আছেন সেই দলে, আওয়াজ দিয়েন।
স্বাধীনতার সময় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। এখন এই ৪৩ বছরে তা বেড়ে দ্বিগুনেরও বেশি। সাধারণত ৩৫ বছরে কোনো একটি দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুন হবার ব্যাপার প্রচলিত। সেই হিসেবে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কবি-লেখক-প্রকাশকের সংখ্যা বেড়েছে। বই প্রকাশের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় কোয়ালিটি বই প্রকাশের সংখ্যা কিন্তু বাড়েনি বলেই আমার মনে হয়। কোয়ালিটি বই প্রকাশ করা বলতে আমি বুঝি, যেমন ধরুন, ভারত ভাগের পর দেশভাগ নিয়ে অনেক ভালো ভালো বই লেখা হয়েছে। সে তুলনায় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অনেক বই লেখা হলেও এখনো কোনো কোয়ালিটি বই কিন্তু উল্লেখ করার মত নেই। এত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করেও স্বাধীনতার উপর কোয়ালিটি বই কোনটা কোনটা? আমরা কিন্তু জানি না। এই সংখ্যাটি বাড়লো না কেন? এই দায় কিন্তু আমাদের যারা সিনিয়র কবি-লেখক তাদের ঘাড়েই বর্তায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতার উপর তেমন কোনো বই লেখা হল না কেন? অন্তত মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস টুকু রাষ্ট্রীয়ভাবে কেন পাঠকের হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা হল না? পাঠ্যবইয়ে কেন সঠিক ইতিহাসটুকু স্থান পেল না? ইতিহাস কেন ইচ্ছাকৃত ভাবে পাল্টে দিয়ে মিথ্যা দিয়ে পূরণ করতে হবে? তাহলে জাতীয়ভাবে আমরা কোন ইতিহাস লালন পালন করছি? এই দায় কিন্তু রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। আমাদের বিগত শাসকরা এড়াতে পারে না। বর্তমান শাসকরা যদি এই উদ্যোগ গ্রহন না করে, তারাও কিন্তু এড়াতে পারে না। আর কোয়ালিটি বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের আরো দায়িত্ববান হবার যে দায় রয়েছে, তারাও সেই দায় অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারে না। এই ব্যর্থতার দায় কমবেশি সবার ঘাড়েই কিছু কিছু পড়ে। তবু যদি আমরা সেই ভুলগুলো বুঝতে পেরে এখন থেকে অন্তত বছরে দশটি কোয়ালিটি বই প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহন করি, সেটুকুর জন্য প্রকাশকদের জন্য আমার অন্তর থেকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা থাকবে। আপনারা হাজার হাজার বই না ছাপিয়ে অন্তত আমাদের বছরে দশটি কোয়ালিটি বইয়ের সন্ধান দিন। আমরা না হয় এই ফেসবুকের যুগে ওইটুকু পড়েই শান্তিতে থাকি। নইলে আমরা আর কত কাগজের শ্রাদ্ধ করব?
স্বাধীনতার পর এই ৪৩ বছরে রাষ্ট্র আমাদের কবি লেখকদের কতোটা দায়িত্ব নিল? আদৌ কি নিল কিছু? নাকি কেবল দলীয় কবি লেখকদের কিছু হিল্লে হবার নামে চলছে এক সংস্কৃতি চর্চার মহা উৎসব? বাংলাদেশের গত ৪৩ বছরের সংস্কৃতি চর্চার দিকে তাকালে দুই শ্রেণীর মোটা দাগের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অস্তিত্ব খুব ভালো ভাবেই টের পাওয়া যায়। কেউ কেউ জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী। আর কেউ কেউ আওয়ামী বুদ্ধিজীবী। এর বাইরে যে দুর্বল শ্রেণী, সেটা অনেকটা ধজভংগ টাইপের বুদ্ধিজীবী। এছাড়া মিডিয়াবাজ নামক একটি নতুন বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর উৎপাত সাম্প্রতিক সময়ে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। এদের বাইরে যারা কবি লেখক, তাদের কোনো শ্রেণী ক্যাগরিতে ভাগ করাও হয় না। তাদের কণ্ঠস্বরকে বিবেচনায়ও ধরা হয় না। অথচ, এই অশ্রেণীভুক্ত কবি লেখকদের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে আমাদের আগামী দিনের বিভূতিভূষণ। আমাদের আগামী দিনের জীবনানন্দ। আমাদের আগামী দিনের এক একজন আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, আরজ আলী মাতুব্বর। হয়তো এই অশ্রেণীভুক্ত কবি লেখকদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক একজন গোর্কি, ট্যাগোর, অ্যাডগার অ্যালান পো, ইবসেন, গ্যাটে বা গালিব। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, আমাদের বিদ্যমান সংস্কৃতি চর্চায় এই অশ্রেণীভুক্ত কবি লেখকদের আবিস্কার করার কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ব্যক্তি উদ্যোগে এখনো গড়ে ওঠে নি। রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত আমাদের কবি লেখকদের জন্য কোনো সত্যিকারের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমন কি বছর বছর সংস্কৃতি চর্চার নামে বাজেটে যে বিপুল অংকের টাকা বরাদ্দ করা হয়, তা কোথায় কিভাবে ব্যয় হচ্ছে, কারা সেই টাকা পাচ্ছে, কেন পাচ্ছে, কি কারণে পাচ্ছে, এসবের কোনো যুক্তি সঙ্গত পরিমাপ যেমন নেই বা গড়ে ওঠে নি। তেমনি যারা এই বাজেটের টাকা হাতে পাচ্ছেন, তারাও সেই কাজটি যেভাবে করার কথা, সেভাবে করছে বলে আমার মনে হয় না। এই কাজটি যথাযথভাবে করা হলে, তার একটা চেহারা আমরা দিব্য চোখে দেখতে পারতাম। বাজেটে সংস্কৃতি চর্চার নামে যা ব্যয় হচ্ছে, তার বেশিরভাগই অপচয়। বছর শেষে যেটুকু সাফল্য দাবি করা হচ্ছে, তার আদৌ কোনো প্রভাব কি আমাদের বেড়ে ওঠা সমাজে কোনো ভূমিকা পালন করছে? রাষ্ট্রীয় এই বাজেটের তুলনায় বরং কর্পোরেট যুগের বিরক্তিকর বিজ্ঞাপনই কেবল আমাদের সমাজের গোড়ায় গোড়ায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদেশি সংস্কৃতির মাতাল হাওয়া ঢুকিয়ে দেবার ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল বলা চলে। তাহলে স্বাভাবিক প্রশ্ন হল, বাজেটের টাকা কারা পেল? তারা সেই টাকা নিয়ে করলটা কি? সেই টাকার কাজ কোথায়? আর রাষ্ট্র সেই কাজের জবাবদিহিতা চায় না কেন?
একটি জাতি গঠনে দেশের কবি লেখকদের ভূমিকাকে কখনোই অস্বীকার করার সুযোগ নাই। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা দাবি করে, আমাদের কবি লেখকরা মৃত্যুর পর এখন কিছু কিছু সম্মান পাচ্ছেন। আর জীবদ্দশায় তারা নানান কিসিমের কষ্টভোগ করছেন। তখন রাষ্ট্র এক ইঞ্চিও এগিয়ে আসে না। ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয়। যে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে কবি লেখকদের লালন পালন করা হয় না, সেই দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশ কতদূর অগ্রসর হতে পারে? আদৌ পারে কিনা? সেটা নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখার বিষয়।
অথচ আমাদের এখানে এখনো মেধাস্বত্ব বা কপিরাইটের চেয়ে পাইরেসি অনেক শক্তিশালী। আমরা কবি লেখকদের কপিরাইট দিতে যেমন ব্যর্থ। ঠিক পাইরেসি দমন করতে তারচেয়েও বেশি ব্যর্থ। আমাদের শিল্পীরা মেধাস্বত্ব ঠিকমত পায় না। আমাদের কবি লেখকরা কপিরাইট টুকু পায় না। অথচ আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর ৪৩ বছরে প্রকাশনা জগতে অনেকটা বিপ্লব ঘটে গেছে। নতুন নতুন ছাপার মেশিন এসেছে। ভালো কাগজ এসেছে। উন্নত মানের বাইন্ডিং হচ্ছে। কিন্তু সেই লেখক না খেয়ে ধুকে ধুকে মরছে। আর প্রকাশকরা ব্যবসার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সাইড বিজনেস খুলছেন। শুধু বই বিক্রিতে তাদের প্রকাশনা টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তাই তারা কাপড় বিক্রি করছেন। ফ্যাশন হাউজ দিচ্ছেন। কফিহাউজ দিচ্ছেন। আর কিছু না হোক অন্তত নানান ঋতুতে নানান নামে বই উৎসব করে বই বিক্রি বাড়িয়ে ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু যে কাজটিতে আসলে প্রকাশকদের মনযোগী হবার কথা, সেখানে তারা আদৌ কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
আমাদের প্রকাশনা জগতে বিপ্লব ঘটে গেলেও আমাদের এখানে ভালো এডিটর নাই। একটি ভালো বই প্রকাশের প্রথম শর্ত হল- একজন ভালো এডিটর। একজন ভালো এডিটর লেখককে দিয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়টি লিখিয়ে নিয়ে, অত্যন্ত সুন্দর ভাবে সেটি পাঠক আকৃষ্ট করার মত টেকসই পদ্ধতিতে উপস্থাপন করবেন যাতে, বইটি পড়ায় পাঠকের আগ্রহটি অন্তত পাঠের শেষ পর্যন্ত থাকে। দুঃখের বিষয়, আমাদের এডিটর তো একদম নেই। এমন কি অনেক প্রকাশকের প্রুভরিডার পর্যন্ত নাই। হাজার হাজার বানান ভুলে ভরা বই, হাজার হাজার কপি প্রকাশ পাচ্ছে। বানান ভুলে ভরা বই, সে আমার নিজের লেখা হলেও, সেটি পড়তে আমার খুব বিরক্তি লাগে। বই প্রকাশ পেল কিন্তু হাজার হাজার বানান ভুল। তাহলে সেই প্রকাশনার মান নিয়ে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করা যায়। এখন আমাদের প্রকাশকরা যদি এই বিষয়ে যত্নবান না হন, তারা যদি এডিটর নিয়োগ দান না করেন, তারা যদি বইটির যথাযথ দায়িত্ব পালন না করেই সেটি দায়সারাভাবে বাজারে আনেন, সেই বই কতটুকু বা পাঠকের নজর কাড়তে পারে?
আরেকটি বিষয় হল বইয়ের দাম। ইদানিং আমার নিজেরও মনে হয়, বইয়ের দাম অনেক বেশি। যে দাম দিয়ে আমি বইটা কিনব, পড়ার পর অন্তত সেটুকু আত্মতৃপ্তি যদি উঠে না আসে, তাহলে আমার পয়সা কেন এভাবে জলে দেব? আমার সময় বা কেন নষ্ট করব? কাগজের দাম, বাইন্ডিং, প্লেট, ছাপা, নানান অযুহাতে বইয়ের দাম বাড়ানোর কথা শুনি। কিন্তু বইটি পড়ার পর যা আমার লাভ হবার কথা, সেটুকু লাভ যদি না হয়, তাহলে তো টাকাই জলে গেল। আর এভাবে একজন পাঠক যখন বারবার ঠকে যায়, তখন বই কেনায় তো তার নিরুৎসাহিত হবার কথা। আমাদের প্রকাশকদের বই প্রকাশে আরো যত্নবান হবার পাশাপাশি আরো প্রফেশনাল হওয়াটা খুব জরুরী। প্রতিটা বই প্রকাশের আগে এডিটর দিয়ে সেটির একটা ভালো এডিট খুব জরুরী। বানান নির্ভুল হওয়া জরুরী। বইয়ের দাম আরো কম হওয়া জরুরী। অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়, কম মুনাফা, দিয়ে বিক্রি বাড়িয়ে, মুনাফা বাড়ানো পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরী। বেশি লাভ, কম বিক্রি, বেশি মুনাফার চেয়ে, কম লাভ, বেশি বিক্রি, বেশি মুনাফা থিউরি বেশি কার্যকর হবে, যদি আমাদের প্রকাশকগণ প্রকাশনায় এই প্রফেশনালিজমটুকু অন্তত কষ্টকর হলেও একটা পর্যায়ে উন্নীত করতে পারে। নইলে বইয়ের দোকানের জায়গায় বছর শেষে আরো কিছু ফ্যাশন হাউজ ঢুকে যাবে। বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে বই হয়তো গুদামে চলে যাবে। তখন আর যা হোক, পোকার লাভ হলেও দু'চারজন যারা বই পোকা, তাদের বড্ড অসুবিধা হবে বৈকি।
রাষ্ট্রীয়ভাবে কোয়ালিটি বই প্রকাশের উপর আরো জোর প্রদান খুব জরুরী। প্রকাশকদেরও আরো প্রফেশনাল ওয়েতে বই প্রকাশে উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবী। পাশাপাশি, কবি লেখকদের যথাযথ মেধাস্বত্ব প্রদানের বিষয়টি নিয়মিত চর্চার মধ্যে আনাটা খুব জরুরী। বছরে শুধু হাতে গোনা কয়েকজন কবি লেখক প্রকাশক থেকে টাকা পাবেন, আর বাকীরা সবাই জালের কাঠি, এটা হতে পারে না। তাহলে তাদের বই প্রকাশ কেন করলেন? বই প্রকাশ যখন করলেন, তখন সেই বই বিক্রি করার জন্য যথাযথ উদ্যোগটি কিন্তু প্রকাশকেরই নেবার কথা। তা না নিয়ে ব্যবসার পুঁজি ওঠাতে সাইড বিজনেস চালুর উদ্যোগ কিন্তু এক ধরনের ফটকাবাজি। তাহলে আপনার আসলে প্রকাশক হবার কথা নয়। আপনি ভুল করে এই লাইনে ব্যবসা করতে এসেছেন। এখন ব্যবসা লোকসান দেখে আপনার ভেতরের মুখোশ বের করছেন সাইড ব্যবসা করে। আমাদের তো হাজার হাজার প্রকাশক দরকার নাই। আমাদের কোয়ালিটি প্রকাশক দরকার। সারা দেশে এমন কি সারা বিশ্বে যার বই প্রচার করার মত নেটওয়ার্ক আছে, তাদেরই প্রকাশনায় থাকা উচিত। আপনি বই প্রকাশ করলেন, আর ফেব্রুয়ারি মাসের পর সেই অবিক্রিত বইগুলো বাংলাবাজার গুদামে পরে থাকল, আর বছর শেষে আপনি লেখকের ঘাড়ে সেই দায় চাপাতে পারেন না। আপনি সারা দেশে সেই বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারেন নি। তাই বই বিক্রি হয় নি। আমাদের এখন বইয়ের প্রকাশকদের চেয়ে কবি লেখকদের ঘাড়েই বই বিক্রির দায়টা চাপানোর একটা প্রবনতা লক্ষ্য করছি। এটা সম্পূর্ণ ভুল। একজন স্বনামধন্য কবি বা লেখকের বই আপনি যেভাবে প্রচার করছেন, একই ভাবে না হোক, অন্তত যদি ন্যূনতম একটি প্রচারও সেই অপরিচিত কবি লেখকের বইটি পায়, আর সেটি যদি দেশের সর্বত্র পাওয়া যায়, অথবা সারা বিশ্বে সেই বই পৌঁছে দেবার মত নেটওয়ার্ক প্রকাশকের থাকে, তাহলে ওই বইটিও খরচ ওঠানোর মতই বিক্রি হবে। কিন্তু বইটি কতটুকু কোয়ালিটি বই নাকি বিজ্ঞাপন সর্বস্ব আশ্চার্য মলম, সেটিও একটা বড় প্রশ্ন। আমাদের রাষ্ট্র আমাদের কোয়ালিটি বই প্রদানে এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তেমনি আমাদের প্রকাশকরাও কোয়ালিটি বই প্রকাশে তেমন উৎসাহ দেখায়নি। মাঝখান থেকে ওই অশ্রেণীভুক্ত কবি লেখকদের ঘাড়ে সব দায় চাপানো হচ্ছে। এ যেনো একুশ শতকের আরেক মহা নিয়তি।
আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, নীতি নির্ধারকগণ, আমাদের প্রকাশকগণ এবং অবশ্যই আমাদের কবি লেখকগণ যতক্ষণ না এ নিয়ে সোচ্চার না হবেন, ততদিন এই নিয়ে সত্যিকারভাবে কোনো আশার আলো দেখতে পাই না। পাশাপাশি একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমাদেরও অনেক দায়িত্ব আছে। আমরা খামাখা ফেসবুকে সময় নষ্ট না করে অন্তত চব্বিশ ঘণ্টার যদি মাত্র এক ঘণ্টাও বই পড়ায় অভ্যস্থ হই, তাহলে আমাদের বছরে যে পরিমাণ সামাজিক দায়িত্ব পালন করা হবে, তার চেয়েও বেশি আমরা নিজেদের প্রতি সচেতন হব, নিজেদের সময় জ্ঞান সম্পর্কে সচেতন হতে পারব। এমন কি কিছু ভালো বই পড়ায় অন্তত সময় খরচ করব। এক হাজার বছর বই না পড়ে বাঁচার চেয়ে মাত্র মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ভালো ভালো কয়েকটি বই পড়ার পর মরে যাওয়া অনেক ভালো। আমরা কোনটি করব, সেই সিদ্ধান্ত কিন্তু আমাদেরই নিতে হবে। সো, সাধু সাবধান।।

ঢাকা
১৮ নভেম্বর ২০১৪

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ২:১৬

(একজন নিশাদ) বলেছেন: বিরাট ব্যাপারস্যাপার

২| ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ২:৫৮

সামসুন নাহার বলেছেন: আপনার লেখাটা পড়ে ভালো লেগেছে। আর কিছু ১. প্রকাশনার জন্য বা কবি সাহিত্যিকদের জন্যও যে বাজেট আছে সেটা আজ জানলাম। এতদিন কেন জানিনি বলে আমি নিজেকে বোকা মনে করছি না, কারণ যদি সত্যিই বাজেটের টাকা কবি লেখকরা পেত তাহলে জানতাম। ২. ফেসবুকে বইয়ের রিভিউ দিয়ে নতুন পাঠক/পাঠিকা পাওয়া যাবে কথাটা ৮০% ঠিক। ৩. আমাদের দেশে প্রকাশক হলেন তারা যাদের একটা প্রিন্টিং প্রেস আ্ছে। আমার জানা ৫টা প্রেস কে কাছ থেকে দেখেছি যাদের না আছে প্রুফরিডার, না আছে এডিটর। নিজেরাই সব। তারাও বই প্রকাশ করে। অবশ্য তা শুধু বইমেলাতেই কিছু কপি বিক্রি হয়। বাকীটা গুদামে। ৪. একটা ভালো বই লিখে নাম করলেই যে তার সব বই পাঠকতৃপ্ত হবে তা নয়। তাই নতুনদেরও সুযোগ দেয়া দরকার প্রকাশকদের। সেজন্য প্রকাশকের দরকার একজন ভাল প্রুফরিডার।
সব মিলিয়ে হ-য-ব-র-ল। কোন সরকার কি এই দিকে নজর দেয় আদৌ। না একেবারেই না।

একটা ভালো বই একটা খারাপ মনকে ভালো করে দিতে পারে। আমি বিশ্বাস করি।

৩| ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৮

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন +
শুভেচ্ছা ।

৪| ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:০২

অন্ধবিন্দু বলেছেন:
হুম... কথাগুলো প্রায়ই শুনতে পাই কিন্তু কাজ দেখতে পাচ্ছি না ...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.