নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

দুঃখে যার জীবন গড়া!

১১ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:০৫

মৃত্যু সংবাদ শুনতে শুনতে ঘুম ভাঙায় আজকে সারাদিন কোনো কাজই করতে পারিনি। মনটা সত্যি একদম ভালো নেই। জীবনের অনেক ঘটনার ফ্লাশব্যাক সারাদিন কেবল একটার পর একটা স্লাইডশো'র মত মনে পড়েছে। বিশেষ করে বড় বুজি'র জীবনের অনেক ঘটনা। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাস। বন্ধু নির্মাতা কবি টোকন ঠাকুরের একটি ধারাবাহিক নাটক 'ভুলগুলি ফুলগুলি' (রংস অ্যান্ড রোজেস) এর শ্যুটিংয়ের কাজে আমি তখন ঝিনাইদহে। সেদিনও আজকের মত মুঠোফোনে খবর আসলো- বড় দুলাভাই মারা গেছেন। সেদিনও আমি যেতে পারিনি।

বড় দুলাভাই মারা যাবার পর থেকে বড় বুজি আমাদের বাড়িতেই থাকেন। বুজি'র দুই ছেলে এক মেয়ে। দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলেটি আজ মারা গেছে। বয়স ৩৫ বছর। এখনো বিয়ে করেনি। ঢাকার টঙ্গিতে একটা কাপড়ের দোকানে চাকরি করতো। চলতি বছর ওর শরীরে একটা বড় ধরনের অপারেশান করা হয়েছিল। শরীরের কোমর থেকে পায়ের জয়েন্টে যে বাটি, ওটা অপারেশান করে চেইঞ্জ করতে হয়েছে। শরীরে তীব্র ক্যালসিয়াম, আয়রন ও পটাশিয়ামের ঘাটতির কারণে ধীরে ধীরে কোমরের বাটিতে ক্ষয় শুরু হয়।

পাশাপাশি এই বয়সে কাপড়ের দোকানের চাকরি করায় সারাদিনে ওর শারিরিক মুভমেন্ট স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম হতো। ফলে শরীরের এই ক্ষয়ের কারণে কোমরের বাটি বদল একসময় জরুরি হয়ে পড়েছিল। ডাক্তারদের পরামর্শে অনেক টাকা খরচ করে শরীরে বিকল্প বাটি লাগানো হলো। তখন থেকে ও ধীরে ধীরে ডেভেলপ করছিল। গত মাস থেকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে একটু একটু হাঁটতে পারত।

বড় বুজি'র বড় ছেলেটি মোংলা বন্দরে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। বিয়ে করেছে। দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। ওর পরিবারও আমাদের বাড়িতে থাকে। বড় বুজি'র একমাত্র মেয়েটি সবার ছোট। ওর বিয়ে হয়েছে। এক কন্যার মা। কিন্তু খুশির খবর হলো ও এখন আবার পড়াশুনা কনটিনিউ করছে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বড় বুজি'র জীবনটা সেই ছোটবেলা থেকেই এক জটিল সমীকরণের সাথে কেমন ঘুরপাক খেল! বড় দুলাভাই ছিলেন অনেকটা আমার মত বাউল টাইপ। কাউকে না বলে বাড়ি থেকে হারিয়ে যেতেন। কোনো চিঠিপত্র পর্যন্ত দিতেন না। ছয় মাস বা এক বছর পর এসে হাজির হতেন। সঙ্গে থাকতো এই সময়ে উপার্জিত আয়ে বড় বুজিকে খুশি করার মত শাড়িচুড়ি। আবার খুব নরমাল কিছুদিন কাটিয়ে দুলাভাই আবার হারিয়ে যেতেন।

বড় দুলাভাই তাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। কিন্তু তার এ ধরনের বাউলগিরির কারণে নিজের বাড়ির সম্পত্তি ভাগাভাগিতে ভাইবোনদের কাছে অনেক ঠকতে হয়েছে। তারপর হুট করে বড় দুলাভাই মারা যাওয়ায় বড় বুজি'র পক্ষে ওই বাড়িতে বসবাস করাটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। এমনতি বড় দুলাভাই'র এমন আচরণের কারণে বুজি বছরের প্রায় নয় মাস আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করেছে আমাদের বাড়িতে থেকেই।

বড় দুলাভাই'র শোক কাটিয়ে ওঠার পর মেয়েটাকে বিয়ে দিলেন। বড় ছেলেকে বিয়ে করালেন। এই সময়ে দুই ছেলে আয় রোজগার করছিল বলে দিনে দিনে বুজি'র কষ্ট অনেক কমতে শুরু করেছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আবার ছোট ছেলেটা এভাবে ভুগতে ভুগতে যুদ্ধ জয় শেষে তীরে এসে মারা গেল! বড় বুজি'র এই কষ্টটার কথা মনে পড়লে সত্যি বুকের ভেতরটা ভেঙেচুড়ে আসে!

বড় ছেলেটার বয়স তখন পাঁচ ছয় মাস। দুলাভাই ওভাবে কোথায় যেন উধাউ। ছেলে কোলে নিয়ে বড় বুজি গেলেন হারিয়ে। আমাদের বাড়িতে সেই খবর আসার পর, বাবা আত্মীয়স্বজন অনেককে নিয়ে রঘুনাথপুর রওনা হলেন। তারপর তিনদিন পর্যন্ত চারদিকে মানুষ লাগিয়ে অনুসন্ধান চললো বড় বুজি'র। আমার বাবা ততক্ষণে বড় বুজি'র শ্বশুর সাহেবকে থানায় আটকে রেখেছেন। নিজের আদরের বড় মেয়েকে না পেলে কোনো আপোষ হবে না। বাবা নিজেও বাড়িতে আসছেন না। থানায় বসে ছিলেন। যাতে পুলিশকে ম্যানেজ করে পালিয়ে যেতে না পারে।

তৃতীয় দিন দুপুরে আমার বড় ফুফুর বাড়িতে বড় বুজি পৌঁছেছেন। কোলে ছোট্ট ছেলে। আর নিজের শরীর শুকিয়ে কাঠ। শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে পথ হারিয়ে আসতেই বুজি'র এত দেরি। ততক্ষণে উভয় পরিবার অনেকটা সাংঘর্ষিক অবস্থায় মুখোমুখি! আমাদের স্কুলে যাওয়াও ওই ঘটনায় বন্ধ। বড় বুজিকে পাওয়া গেছে এই খবর রাষ্ট্র হবার পর, বাবা আর বড় বুজি'র শ্বশুর সাহেব থানা থেকে সরাসরি আমাদের বাড়িতে আসলেন। বাবা মিটিং করে সবকিছু আবার নরমাল করলেন।

তারপরা থেকে দুলাভাই বাড়িতে গিয়ে বড় বুজিকে না পেলে সাহস করে আমাদের বাড়িতে আসতেন বটে। কিন্তু বাবার মুখোমুখি হতেন দুই তিন দিন বেড়ানোর পর। বাবাও ব্যাপার বুঝে খুব একটা বকাঝকা করতেন না। বরং বুঝিয়ে বড় বুজিকে সঙ্গে দিতেন। দেখা যেত ছয় সাত মাস আবার কোনো ঝামেলা নাই। হঠাৎ আবার বড় দুলাভাই কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে যেতেন। আর বড় বুজি আমাদের বাড়িতে চলে আসতেন।

হাটের দিন বুজি কারো কাছে খবর পাঠাতেন। যাতে মাঝি গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। বাবা কাদের মাঝিকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ করেছিলেন বড় বুজিকে এভাবে আনা-নেওয়ার জন্য। দেখা যেত বছরের তিন মাসের বেশি কখনোই বড় বুজি'র শ্বশুর বাড়িতে বসবাস করা হতো না। এভাবে এক দুঃখের সাগর পাড়ি দিতে দিতে বড় বুজি'র জীবনটা যখন কাটছিল, ঠিক তখন বড় দুলাভাই মারা গেল।

তারপর থেকে বড় বুজি আমাদের বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ছেলেমেয়েরা আমাদের বাড়িতে থেকেই স্কুলে গেছে। পড়াশুনায় উচ্চশিক্ষা কারো হয়নি এমন টানাপোড়ন জীবনযুদ্ধের কারণেই। মেয়েটা খুব ভালো ছাত্রী। কিন্তু ওই এলাকার ছেলেদের উৎপাতে বুজি বললেন- ভালো ছেলে পেলেই বিয়ে দিয়ে দেবেন। সেভাবে একসময় মেয়েটার বিয়েও দেওয়া হয়। এখন আবার পড়াশুনা করছে জেনে আমি খুশি।

কিন্তু বড় বুজি'র জীবনটার কথা যখনই আমি ভাবি, কেবল অনেক কষ্টের একটা জীবনই আমার নজরে আসে। তারপর মানুষের সময়-অসময়ের ব্যবহার, সেইসব ব্যবহার থেকে পাওয়া কাউকে না বলা অনেক বুক ফাটানো জমানো ক্ষোভ। মাঝে মাঝে সময় পেলে আমাকে পেটের সব কথা খুলে বলেন বড় বুজি। আমিও মনযোগ দিয়ে শুনি কিন্তু সেই কষ্টে কতটুকুবা আর ভাগ বসাতে পারি! তারমধ্যে আজকে ছোট ছেলেটা মরে গেল।

দুঃখ কষ্টকে জয় করার মত একটা মানসিক জোর তো অন্তত থাকা চাই। কিন্তু বড় বুজি'র সেই জোর কোথায়? কেমন চোখের সামনে বুড়িয়ে গেছেন! মানুষের জীবনটা কেমন এক রহস্যময় জটিল ধাঁধাঁর মত। সেই রহস্যের একপিঠে হয়তো সুখ আর অপরপিঠে দুঃখ। কিন্তু কারো জীবনে দুঃখের নদীটা এত বড় যে, সেই বাস্তবতা কলমে তুলে আনা প্রায় অসম্ভব!

সকাল থেকে কিছুতেই স্থির হতে পারছি না। মনটা এক কঠিন বিষাদে দুঃখের অতলে ভরে আছে! কারো কারো জীবনে শুধু কষ্ট দিয়ে কষ্ট লেখা। সেই কষ্টে কেবল রাশি রাশি দুঃখ। সেই দুঃখের যেন কোনো শেষ নেই! কুয়াশামোড়া সেই দুঃখের কথা মনে পড়লেই খারাপ লাগাটা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু কাউকে মনের এই অবস্থার কথা বলতে পারছি না...

-----------------------------
১০ নভেম্বর ২০১৭

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:১৭

চাঁদগাজী বলেছেন:



আপনার বোনের কষ্টের কথায় চোখে পানি এলো; আপনি বাউন্ডুলেগিরি কমায়ে উনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেন।

২| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:০৭

মিথী_মারজান বলেছেন: ইন্নানিল্লাহি ওয়া ইনা ইলাইহি রাজিউন।
খুব খারাপ লাগছে।
আল্লাহ্ আপনাদের সবাইকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার তৌফিক দান করুক।
আপনার বড় বুজিকে জড়িয়ে ধরে রাখতে ইচ্ছা করছে আমার।

৩| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৩:১৭

ওমেরা বলেছেন: দুনিয়াটা মানুষের জন্য একটা পরিক্ষা। আল্লাহ কোন মানুষকে বিপদ আপদ দিয়ে পরিক্ষা করেন কাউকে আবার ধন জন দিয়ে পরিক্ষা করেন।

আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন, আপনাদের প্রতি রহম করুন । আমীন।

৪| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:২৫

করুণাধারা বলেছেন: প্রার্থনা করি আপনার বুজী যেন শোক সামলে উঠতে পারেন- বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটাতে পারেন।

৫| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:২৬

রাজীব নুর বলেছেন: মানুষের জীবনে খারাপ সময় আসে, তখনও শান্ত থাকা উচিত।
কারন খারাপ সময় দীর্ঘ দিন থাকে না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.