নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
আমার মা-খালারা ছয় বোন এক ভাই। একমাত্র মামা ছিলেন সবার বড়। মামার পর বড় খালাম্মা, তারপর আমার মায়ের জন্ম। কিন্তু সবার আগে বিয়ে হয়েছিল বড় খালাম্মার। তারপর আমার মায়ের। তারপর মামার। বড় খালুজান আমার বাবার চেয়ে বয়সে চার-পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ৬ ডিসেম্বর আমার বাবা ও ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি আমরা মা মারা যায়।
আমরা যখন খুব ছোট তখন নোয়া খালাম্মা মারা যায়। তার কয়েক বছর পর মামা মারা যান। কয়েক বছর আগে সেজো খালাম্মা ও খালুজান মারা যান। এখনো আমার তিন খালা জীবিত আছেন। বড় খালাম্মা, ছোটখালাম্মা ও কুটি খালাম্মা। বড় খালাম্মাও খুব অসুস্থ। গতকাল অমর একুশে বইমেলার মাঠে লাহু ভাই'র কাছে খালাম্মা ও খালুজানের অসুস্থতার খবর বিস্তারিত জেনেছিলাম। খালুজান যে তার কয়েক ঘণ্টা পরেই চলে যাবেন, এটা লাহু ভাই বা আমার কল্পনাতেও ছিল না। একটু আগে লাহু ভাই'র থেকে জানলাম খালুজান আর নেই! মৃত্যুকালে খালুজানের বয়স হয়েছিল প্রায় ৯০ বছর।
বড় খালুজান ছিলেন অত্যন্ত নিরীহ একজন মানুষ। খুব লাজুক ছিলেন। কোনো আসরে বড় খালুজানকে কখনো কথা বলতে দেখিনি। কিন্তু ছোটদের সাথে বড় খালুজানের খুব নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আমাদের খুব ভালোবাসতেন। খুব আদর করতেন। বড় খালুজানকে দেখতাম যে কোনো বিষয়ে আমার বাবার সঙ্গে পরামর্শ করেই তারপর সেই কাজে হাত দিতেন। কিন্তু সেই কাজের বিস্তারিত ফিরিস্তি সবসময় দিতে হতো বড় খালাম্মাকে। বড় খালাম্মা খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। আর খালুজান খুব লাজুক হওয়ায় সেভাবে কথা বলতে পারতেন না।
বড় খালাম্মা ও খালুজানের পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে। সবার বড় সন্তান আসমত ভাই। আসমত ভাই আমাদের গোটা বংশের সকল আত্মীয়কূলের মামাতো-খালাতো-ফুফাতো ভাইবোনদের সবার বড়। বয়সেও বড়, লম্বায়ও বড়। আমরা ডাকি মিয়াভাই। অন্যরা আসমত ভাইকে ছোটবেলায় খুব ভয় পেত। কিন্তু আমার ছিল সবার থেকে উল্টো স্বভাব। আসমত ভাই ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষক। আমার অ-আ-ক-খ হাতেখড়ি আসমত ভাইয়ের হাতে। যে কারণে আমার সাথে আসমত ভাই'র সবচেয়ে বেশি খাতির সেই ছোটবেলা থেকেই।
তখন আমাদের ভাইবোন সবাইকে আসমত ভাই পড়াতেন। পরে চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি নিয়ে চলে গেলে আসমত ভাই'র শিক্ষকতায় ইতি ঘটে। আসমত ভাইয়ের পরে মকবুল ভাইয়ের জন্ম। আমরা ডাকি মেজোভাই। তারপর হাওয়া বুজি। তারপর হেনা বুজি। তারপর লাহু ভাই। তারপর কায়সার। সবার ছোট হায়দার।
আসমত ভাই আর মকবুল ভাই'র বিয়ের ঘটনা কুব একটা মনে নাই। তবে হাওয়া বুজির বিয়ের ঘটনা খুব মনে আছে। সারাবিকাল আমরা খালাম্মাদের পুরান বাড়ির পেছনে ফাঁকা মাঠে গোল্লাছুট খেলেছিলাম। আর সেদিন আমরা ছোটরা সারা রাত জাগার পারমিশান পেয়েছিলাম। আমাদের বিনোদনের একটা ব্যাপার ছিল তখন বলেশ্বর নদে সাঁতার কেটে পাল্লা দেওয়া। সকালে একদফা, দুপুরে একদফা, সন্ধ্যায় খেলাধুলা শেষে একদফা। আর হাওয়া বুজির বিয়ের রাতেও আমরা বেশি আনন্দের জের হিসাবে বলেশ্বর নদে সাঁতার কেটে পাল্লা দিয়েছিলাম।
বড় খালুজানের ছিল ক্যাটস আই। যে কারণে লাহু ভাইদের কয়েকজনের ক্যাটস আই হয়েছে। সাধারণত প্রতি বছর শীতকালে লাহু ভাইদের বাড়িতে তারাবুনিয়ার হাটের দিন একবার আগুন লাগত। সেই আগুন গোটা হাটের মানুষ জড়ো হয়েও নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। কারণ, লাহু ভাইদের পুরান বাড়িতে ঘরগুলো ছিল গায়ে গায়ে। এক ঘরে আগুন লাগলে সিরিয়ালি সকল ঘর পুড়তো। কারণ পুরান বাড়ি থেকে বলেশ্বর নদ ছিল কিছুটা দূরে।
বলেশ্বর থেকে ধামা, বালতি, হাড়ি-পাতিল, ড্রাম দিয়ে আনা পানি দিয়ে বিশাল আগুনের সেই লেলিহান কারো পক্ষেই নেভানোর সুযোগ হতো না। সবাই চেষ্টা করতেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যেত সন্ধ্যায় আগুন লাগলে সারারাত আগুন জ্বলে সকাল বা পরদিন দুপুরে সকল ঘর পোড়া শেষ হলে আগুন অটোমেটিক নিভে যেত। কিন্তু ফি বছর সবাই আবার গায়ে গায়ে ঘর তুলতো।
শেষ পর্যন্ত এই আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য লাহু ভাইদের পুরান বাড়ি থেকে সবাই একে একে বলেশ্বর নদের তীরে নতুন করে বাড়ি তুলতে শুরু করলো। এখন তাই ছোটবেলার সেই বড় বাড়িটা কেবল স্মৃতি। হাটের দিন বলেশ্বরের ওপারে আগুন লাগা মানেই হল শিকদার বাড়িতে আগুন লাগা। আর সেই আগুনে সবার ঘরই সিরিয়ালি পুড়তো। একটা ঘরকেও বাঁচানো যেত না। পরবর্তী সময়ে নদীর দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ি করার পর প্রতি বছর আগুন লাগার সেই ঐতিহ্য ধীরে ধীরে একসময় বন্ধ হয়ে যায়।
বড় খালুজানকে কখনো আমাদের বাড়িতে রাত কাটাতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। অন্যরা সবাই থাকলেও খালুজান রাতের খাবার খেয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়িতে চলে যেতেন। তখন বলেশ্বর নদের ওপার যেতে দুই বার খেয়া পাড়াতে হতো। তুবও তিনি চলে যেতেন। আমরা জিজ্ঞেস করলে বলতেন, নিজের বিছানা ছাড়া খালুজানের নাকি ভালো ঘুম হতো না। তাই একটু কষ্ট হলেও শীতের রাতেও খালুজান বাড়িতে চলে যেতেন।
খালুজান যখন একা একা হাঁটতেন, তখন গুণগুণ করে গান গাইতেন। কাছাকাছি কাউকে দেখলেই সেই গানের ভলিউম ছেড়ে গলা থেকে ধীরে ধীরে লো হতো। একদম কাছাকাছি গেলে গানও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেত। খালুজানকে আমি কখনো মুখ গম্ভীর দেখিনি। সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। সবসময় দিল খুলে হাসতেন খালুজান। বড় খালাম্মাও খুব হাসতে পারেন। হাসলে খালুজানের চোখ একেবারে গর্তে ঢুকে যেত। আর মুখের রেখাগুলো আরো সুস্পষ্ট হতো। হাসি যখন বন্ধ হতো মুখের রেখাগুলোও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেত।
মনে হতো খালুজান এক আশ্চার্য জাদু জানতেন। খালুজানের সেই আশ্চার্য জাদুর রহস্য ছোটবেলায় আমরা কেউ বুঝতাম না। তখন খালুজানের মুখ টিপে আমি সেই মিলিয়ে যাওয়া রেখাগুলো খুব খুঁজতাম। তখন খালুজান আমাকে খুশি করতে আরো বেশি করতে হাসতেন। যখনই খালুজানের কোলে উঠে মুখের রেখা স্পর্শ করতে যাইতাম, হাসি বন্ধ করে রেখাগুলো আশ্চার্য জাদুর কৌশলে লুকিয়ে ফেলতেন।
খালুজান চলে যাওয়ায় আজ যেন এক নিমিষে ছোটবেলার অসংখ্য সেইসব স্মৃতি দলবেধে হুড়মুড় করে সব মনে পড়ছে। অন্যলোকে খালুজানের আত্মা চিরশান্তিতে থাকুক। এই কামনা করি।
--------------------
৩ ফেব্রুযারি ২০১৮
শনিবার
২| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৮:৫৫
তারেক_মাহমুদ বলেছেন: যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন খালুজান।
৩| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৯:২৯
খায়রুল আহসান বলেছেন: আপনার বড় খালুজানের কথা পড়ে মনের মধ্যে তার জন্য একটা অসম্ভব রকমের ভাল লাগার জন্ম হলো। আল্লাহ রাব্বুল 'আ-লামীন তাঁকে জান্নাত নসীব করুন!
৪| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১১:০৬
রাজীব নুর বলেছেন: তাদের একটা ছবি লেখার সাথে দিতেন।
৫| ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১:২৯
আরাফ পাটোয়ারী বলেছেন: হাসিখুশি উজ্জ্বল মানুষ গুলো যেন একেকটা নক্ষত্র এরা চলে গেলে আসলেই অনেক কষ্ট লাগে
আল্লাহ খালুজানকে জান্নাত নসিব করেন আমিন
৬| ০৬ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:৪০
অনন্য দায়িত্বশীল আমি বলেছেন: আপনার লেখা বরবরই সুন্দর হয়।
©somewhere in net ltd.
১| ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ৮:৩৩
সৈয়দ ইসলাম বলেছেন: দয়াল আপনার খালুজানকে স্বর্গবাসীর কাতারবন্দি করুন।