নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হিংসা মুক্ত, ভালবাসা সিক্ত পৃথিবী চাই..

দূর্বাক সাহা

ভাল-মন্দ দু'ই বিদ্যমান। আমি হয়তো ভাল নাও হতে পারি; তবে ব্যতিক্রম।

দূর্বাক সাহা › বিস্তারিত পোস্টঃ

।।জীবনের জন্য টাকা, আর টাকার জন্য জীবন।।

১৩ ই মে, ২০১২ রাত ৮:৩১

জীবনের জন্য অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। টাকা ছাড়া কি আমাদের চলে? কিন্তু যে জীবনের জন্য টাকার এ প্রয়োজন তা যদি হয় টাকায় উৎসর্গীত তো কেমন হয়?



জীবন জীবিকার নানা প্রয়োজনেই আমাদের সকল চিন্তা নিবিষ্ট থাকে। চাকুরি কিবা ব্যবসায়; মানসিক বা কায়িক শ্রম, যে কোন ভাবে আমাদের চাই জীবন চালানোর উপকরণ 'টাকা'। নইলে যে আর চলে না। টাকাই জীবন; টাকাই মরণ।



টাকার অভাবে ক্ষুধার্ত 'সুলতান' এর প্রায় অসাড় দেহ পার্কের পাশে পড়ে থাকে, পারুল বেচে দেয় তার কলিজার তার ছেড়া আদরের ধন একমাত্র সন্তান জাহিদকে। বাঁচার তাগদে সুজনা তার অমূল্য স্বতীত্ব আহত করে, আবুল চাচা কালুর দোকানের বাকী শোধে ব্যর্থ হয়ে লোক সমক্ষ্যে যাচ্ছতাই কথা শুনেও মুখ বুজে ফিরে। হেলেনার হাতে বইয়ের পাঁজার পরিবর্তে ইটের পাঁজা, আর মনু মাঘের বাঘডাকা শীতে ঠকঠক করে কাঁপার পরিবর্তে খালি গায়ে ঢালাই কারখানায় ঘর্মাক্ত হয়।



সুমু খালা একমাত্র ছেলের পড়ালেখার খরচ চালাতে মেসে মেসে ঝিয়ের কাজ করে রাত করে ঘরে ফেরে, আর হালিমা ও সুরঞ্জনারা সকাল ৭ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত গার্মেন্টস এ সেলাই মেশিন চালিয়ে কিবা তাতে সহযোগিতা করে ক্লান্ত শরীরে পায়ে হেটে দু'মাইল দূরের বাসায় ফিরে খুতপিয়াস নিবারণে একমুঠো ভাত আর সেদ্ধ আলুর জোগাড়ে ব্যস্ত থাকে অর্ধরাত অবধি। বয়সের ভারে ন্যূজ ভয়াল পদ্মরে রোশের শিকার তারা মিয়া দুর্বল দৃষ্টি নিয়েও রিক্সার প্যাডেল ঘুরায়, আর পিতৃ পরিচয় শুন্য ৬ বছরের কানন ছোট বোন দোলন কে নিয়ে স্টেডিয়ামের পাশে ভিক্ষা চাইতে এসে 'টাকাওয়ালা' পথচারীদের নির্দয় পিটুনিতে আহত হয়। চোখের জলে বুক ভাসানো আর গগণ বিদারী কান্না খুব কম লোকের মন কাড়তে পারে। তবে এমন অবস্থা যে সাবার তা নয়; এর ব্যতিক্রম ও আছে।



হাসান সাহেব মস্ত বড় অফিসার। মোটা অংকের টাকা বেতনে চাকুরী করেন। বিদেশী কোম্পানি। দিনে রাতে প্রায়ই ব্যাস্ত থাকতে হয়। ঘর সংসার করার সময় টুকু ম্যানেজ করতেও হিমশিম খান। এক সময় একান্ত প্রয়োজন হলেও এখন আর উনাকে চাকুরীর উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় না। ঢাকার এলিট এলাকায় বেশ বড় বাড়ি করেছেন; বাড়ি ভাড়ায়ই মোটামুটি চলে যায়। তার পরও আরো কিছু দরকার; তাছাড়া অনেকে টাকার পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরতে ঘুরতে চোখে শর্সেফুল দেখলেও টাকায় উনাকে ছাড়ছে না। এভাবেই বছর যুগ পার হয়ে চলছে।



ঘরে শিক্ষিতা স্ত্রী - আর কত। একমাত্র সন্তান মোহনাকে ঘরে রেখে সময় কাটাতে তিনিও পাড়ি জমালেন চাকুরীতে। মাইনেও কম না। এবার দু'জনই ব্যাস্ত। কাকডাকা সকালে নাস্তা সেরে বেরোন দু'জনই। ফেরেন সন্ধ্যা বা রাতে। ক্রমান্বয়ে দু'জনেরই ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। আর উনাদের এই চরম ব্যস্ততার বলি হয় মোহনা'রা।



স্কুল থেকে ফিরেই বাবা-মা হীন ঘরে একাকী। কাজের মেয়ে স্কুল থেকে আসতেই গোসল সেরে খাবার জন্য তাকিদ দেয়। কখনো বা খায় কখনো খায় না। পড়ার টেবিলে মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যায়। মাঝে মাঝে টিভিতে কার্টুন বা অন্য কিছু; কখনো বা বিছানায়।



রাতের বেলায় যখন বাবা-মাকে পেল তখন তারা দিনান্তের কর্মক্লান্ত। ফুলের মত মুখটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসির ঝলক দেখানোর চেষ্টা করলেও ক্লান্ত শরীরে তা আর তেমন বোঝা যায় না। কখনো বা আদরের সন্তানের আদরের চুমুটিও তাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়ায়। শিশুর অবচেতন মন তা আঁচ করতে পারে। সবা জমা হয়ে থাকে তার হৃদয় পটে। দিনে দিনে বাবা-মায়ের অভাব প্রকট হয়ে উঠতে থাকে তার কাছে। কিন্ত উনাদের অফিসিয়াল আর সামাজিক কর্মব্যস্ততায় ফুরসত কোথায় এসব খেয়াল করার?



দিনের বড় অংশে কার্টুনের ফাঁকে ফাঁকে আরো কতকি! আর স্কুলে উপযুক্ত অনুপযুক্ত নানান বন্ধুত্ব। নিজের একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যত গড়ে দেবার জন্য বাবার যে ব্যস্ততা - তা সেই সন্তানকেই যে অন্ধাকারে অতল তলে ঠেলে দিচ্ছে তা দেখার সময় পাবেন কোথায় হাসান সাহেব? কিন্তু তিনি সময় না পেলেও অপছায়া যে উনার আদের দুলালকে গ্রাস করার সময় ঠিকই পায়।



দিন পেরিয়ে যায় মোহনা বড় হতে থাকে। আর বাবা-মায়ের অভাব আরো বেশী বড় হয়ে উঠতে থাকে।



হাসান সাহেব ব্যবসায়িক কাজে মাঝে মধ্যেই দেশের বাইরে থাকেন। আজ ফিরতে দেরী হবে। কি যেন ব্যস্ততায় মায়েরও ফিরতে বেশ দেরী। মোহনা একাকী আনমনা বসে। কলিং বেলের আওয়াজে সম্ভিত ফিরে পায় সে। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলতে দেখে মা এসেছে। খুশি হয় মোহনা। কিন্তু মা ক্লান্ত, মন মেজাজ ও ভাল নেই।



মা ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসতে বসতে হঠাৎই মোহনার প্রশ্ন -



- মা, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?

- কর।

- তুমি এক ঘন্টায় কত পাও, মা?

- তা দিয়ে তোমার কি হবে?

- না মা, খুব জানতে ইচ্চে করছে।

- দু'শ টাকা।

- ও, তাই। মাথা নিচু করে ক্ষীন গলায় জবাব দেয় মোহনা।





একান্ত অনিচ্ছায় কথাগুলো বলে মা কথা শেষ করতে চাইলেন। কিন্তু মোহান থামলো না। মায়ের সাথে কথা চালিয়ে যেতে থাকে সে -



- আমাকে একশ' টাকা দেবে?



মা এবার অনেকটা অধৈর্য হয়ে যান। রাগে তার চোখ মুখ লাল। একেবারে ঝাঁঝাঁলো কন্ঠ মায়ের -



- এ জন্যই কি তুমি এই প্রশ্ন করেছিলে? ব্যপারটা যদি এই হয় যে তুমি আজে বাজে খেলনা কেনা বা ইত্যাকার কাজের জন্য পয়সা চাচ্ছিলে - তো সোজা তোমার ঘরে চলে যাও। ঘুমোও গিয়ে। একটু ভাবো গিয়ে আমি কি তোমার এই পাগলামো করার জন্য এতো কষ্ট করে টাকা ইনকাম করছি? এক অদ্ভুত মেয়েতো তুমি!



ছোট্ট মোহনা একটুও দেরী না করে সোজা নিজের শোবার ঘরে চলে যায়। ঘরের লাইট বন্ধ করে দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।



মা তখনো ক্রুদ্ধ। 'এমন ছোট্ট মেয়ে শুধু কিনা ক'টা টাকার জন্য এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করল?



কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেলে মা শান্ত হন। একটু ভাবেন একমাত্র সন্তানের প্রতি তার হঠাৎ করা আচরণের কথা। ভাবেন, কিছু একটা কেনার জন্য হয়তো বাস্তবেই এই একশ টাকার ওর দরকার ছিল। আরো ভাবেন, ও তো এমনটি সচারাচর করে না।



ইত্যাকার নানা ভাবনায় মাও আনমনা হয়ে যান। নিজের ভুল অনুভব করে অনুতপ্ত হন; নিজেকে তিরস্কার করতে থাকেন। এভাবে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চলে যান মেয়ের শোবার ঘরের দিকে। দরজা খুলে মোহনাকে লক্ষ্য করে -



- মোহনা, ঘুমিয়ে গেছ?

- না মা। আমি জেগে।

- আসলে আমার এমনিতে অফিসের নানা ঝামেলায় ভাল লাগছিলো না। তোমাকে আজ একটু বেশীই বকেছি, না?

- না, মা। ঠিক আছে।

- এই নাও তোমার একশ' টাকা।



টাকা পেয়ে খুশি হয় মোহনা। মায়ের টাকা পাবার পর এতদিনে টিফিন না খেয়ে অল্প অল্প করে নিজের জমানো টাকা গুলোও বের করে মায়ের সামনেই। মা দেখলো তার কাছে আগেই টাকা ছিল। এটা মায়ের রাগকে আবারও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ছোট্ট মোহনার সেদিকে মন নেই। টাকাগুলো গুনে নিয়ে মায়ের দিকে হাসি মুখে তাকায় সে। মা তাতে আরো রেগে যান।



- তোমার যদি টাকা থেকে থাকে তো আবার চেয়েছিলে কেন?

- না মা, আমার কাছে যতটা দরকার তা আমার কাছে ছিল না তাই। কিন্তু এখন আমার সেটা হয়েছে।



মা অনেকটা অবাক হয়ে যান। নির্বাক চেয়ে থাকেন মেয়ের দিকে। বলতে থাকে মোহন -



- মা, আমার কাছে এখন দু'শ টাকা হয়েছে। এবার আমি তোমার এক ঘন্টা কিনতে পারবো। আজ দয়া করে একটু আগে ঘরে আসবে? তোমাকে নিয়ে রাতের খাবারটা একসাথে খাবো?



অশ্রু থামাতে পারলেন না মা। আবেগে জড়িয়ে ধরলেন মোহনাকে। এতো দিনে শিশুর মনে লুকিয়ে থাকা অভাব আঁচ করতে পারলেন। যে সন্তানের জন্য এতো টাকা পয়সা তা যে আসলেই তার কাজে লাগছে না তা অনুভব করতে থাকলেন। ভাবলেন আসলে জীবনের জন্য টাকা, টাকার জন্য জীবন নয়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.