নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/
হোটেলের নাম আক্টি করালী (Akti Corali)। এই নাম আমার মনে থাকবে না। মনে রাখার জন্যে আমাকে নানান ফন্দিফিকির করতে হয়। তাই এক মনে জপছি, একটি করল্লা, একটি করল্লা...। স্মরণশক্তি নিম্নমানের। একটা উদাহরণ দিলে মনে হয় ভালো। ভিসা সংক্রান্ত কাজে মিউনিখের এক অফিসে গিয়েছি। ভিসা অফিসার কি একটা ফর্ম পূরণ করতে করতে টুকটাক প্রশ্ন করছে। জিজ্ঞেস করলো, ছেলের নাম কি। মুহুর্তেই মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো। হতভম্ব আমি বিস্ফোরিত চোখে কোলে বসা ছেলের দিকে তাকালাম। নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না। খালি মনে হচ্ছে, কুরআনের আয়াতের সাথে কি যেন একটা সম্পর্ক আছে। খুব অসহায় ভঙ্গীতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছি আর চোখ পিটপিট করছি। প্রত্যুত্তরে নয় মাসের শিশুপুত্রের ঠোঁটের কোনা বেয়ে বড় এক ফোঁটা লালা গড়িয়ে স্লো মোশনে টুপ্ করে আমার হাতের উপরে পড়লো। পিন পতন নীরবতা ভেঙে সেই টুপ্ শব্দেই হোক, আর ভিসা অফিসারের গলা খাঁকরিতেই হোক, নিমিষেই নাম মনে পড়ে গেলো। তাফসীর, তাফসীর! ইউরেকা, ইউরেকা! এক রকম বেঁচে গেলাম সে যাত্রায়। সেই আমি যে ভিনদেশী এক সড়াইখানার নাম মনে রাখার জন্যে আলু-পটল-করল্লার সাহায্য নেবো, এটাই স্বাভাবিক।
যাই হোক, আক্টি করালী পৌঁছে হেরাক্লিওন বিমানবন্দর থেকে ভাড়া করা গাড়িটা ছেড়ে দিলাম। গাড়ি থেকে বেরোতেই মন ভালো হয়ে গেলো। রোদ ঝলমলে সোনালী সকাল। সাদা রঙের হোটেল লাগোয়া সুবিশাল সমুদ্র তার নীল রঙ দিয়ে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে চাইছে। দেখার মত দৃশ্য। ছোট কিন্তু বিখ্যাত এই গ্রিক শহরের পুরোটাই আসলে একটা দ্বীপ। নাম ক্রীট। গ্রীসের সবচেয়ে বড় দ্বীপ। হেরাক্লিওন তার রাজধানী। হেরাক্লিওনের ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে মজার একটা তথ্য খুঁজে পেলাম। এই দ্বীপশহরের প্রতিষ্ঠাতা কোনো গ্রীক শাসক নয়, বরং আবু হাফস উমর নামের এক পরাজিত মুসলিম সৈনিক যাকে স্পেনের আন্দালুসিয়া থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিলো। পরাজয় ব্যাপারটা তাহলে একেবারে খারাপ না। হারের শেষ যেখানে, জিতের শুরু সেখানেই। উমর সাহেব তো দেখা যায় বেশ কামিয়াবী লোক ছিলেন দেখা যায়।
যাহোক, আমাদের সাথে সফরসঙ্গী হিসেবে আছে আরো একটি পরিবার। আদিবা-আকরাম আর তাদের জাপানী পুতুলের মত দেখতে ছোট্ট আমালিয়া। আরো আছেন আদিবার বাবা-মা। আঙ্কেল-আন্টি রসিক মানুষ। আর যত মানুষ তত মজা। প্রবাসী বাঙ্গালীরা একা-বোকা কোথাও ঘুরতে যায় না পারতপক্ষে। তাদের স্বভাব মুড়ির মত। এক মুঠো মুড়ি মানেই মোয়া হবার প্রবণতা। তাই নিজের সাথে অন্তত দু-চারটে বন্ধু-বান্ধব কিংবা ভাগ্য আরো ভালো হলে আস্ত একটি-দুইটি পরিবার জোড়া লাগিয়ে গুড়-মুড়ির মোয়া হয়ে তবেই বাঙ্গালীর সন্তান "চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া" এক বিদেশ থেকে আরেক বিদেশ ভ্রমনে রওনা দেয়। তবে এই ধরনের বেড়ানোর স্বাদ আসলে মোয়ার মতই মিষ্টি আর কুড়মুড়ে। আগামী কয়েকটা দিন গ্রীসের দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে এই আট সদস্যের মোয়ারুপী মুড়িবাহিনীর বেশ আনন্দেই কাটবে মনে হচ্ছে।
হোটেলের অভ্যর্থনায় বসে থাকা হাসি-খুশি চেহারার মোটাসোটা ম্যানেজার আগ্রহের সাথে আমাদেরকে চাবি বুঝিয়ে দিল। আর পইপই করে বলল, আমরা যেন হোটেলে শুয়ে-বসে না থেকে আশপাশটা ঘুরে টুরে দেখি। তারপর চাবির সাথে দর্শনীয় জায়গাগুলোর এক গুচ্ছ বিজ্ঞাপন হাতে ধরিয়ে দিল। এই লোক কেমন করে বুঝল যে আমরা আজকে কোথাও ঘুরতে যাবো না, বরং, সামনের সমুদ্র সৈকতে কুমীরের মত হা করে অলস শুয়ে বসে থাকব আর রোদ পোহাবো? বাঙ্গালকে কি এতো সহজে বইয়ের মত পড়ে ফেলা যায়?
হোটেলে বোঁচকা-বুঁচকি নামিয়ে একটু জিড়িয়ে নিতে নিতে সকাল গড়িয়ে দুপুর। খিদেও পেয়েছে যারপরনাই। আর দেরি না করে আমরা, মুড়িবাহিনী হোটেলের সিড়ি ভেঙে হুড়মুড় করে গড়াতে গড়াতে খাদ্যসন্ধানে বেড়িয়ে গেলাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই রেস্তোরা চোখে পড়ল। পুরানো আসবাব, তৈজসপত্র আর বাহারী লতানো গাছে সাজানো রেস্তোরাটাকে দেখে বেশ পছন্দ হল। কিন্তু লোকজন কই? না আছে খেতে আসা অতিথি, না কোনো ওয়েটার। কোথাও কেউ নেই অবস্থা। ডাকাডাকি করতে হেলেদুলে যে বেরিয়ে এলো, সে মনুষ্য প্রজাতির কেউ নয়। বরং রেস্তোরার এঁটো-কাঁটা খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে যাওয়া ভাম আকৃতির এক হুলো বিড়াল। বিড়ালের ভুরু থাকলে ভুরু কুঁচকে বিড়াল সাহেব তার দিবানিদ্রা ভাঙ্গানোর অপরাধে বিরক্তির মাত্রাটা আমাদেরকে জানিয়ে দিতেন। সৌভাগ্যক্রমে হোঁতকা ঢাউস বিড়ালটার পিছু পিছু বেড়িয়ে এল রেস্তোরার ওয়েটার। আমাদের দেখে সে খুশি হয়েছে না বেজার সেটা ঠিক বোঝা গেল না। তবে সে ভেতরে গিয়ে মেন্যু নিয়ে আসার সময়ে বাজতে থাকা গ্রীক গানের শব্দটা বাড়িয়ে দিয়ে এসেছে। গানের বাদ্যযন্ত্রে আর সুরে আরবদেশীয় প্রভাব প্রচ্ছন্ন। সেই গান বোধহয় আদিবার বাবা, আমাদের বাহার আঙ্কেলের পছন্দ হল না। উনি ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলেন, তাদের কাছে ''বাচপান কে দিন ভুলানা দেনা", এই গানটা আছি কিনা। উত্তরে ওয়েটার মিয়া খুব বিভ্রান্তি নিয়ে তাকালো। কিন্তু বিভ্রান্তু কাটিয়ে ওঠার কোনও সুযোগ সে পেলো না। তার আগেই কাঠের টেবিলে তাল ঠুকে আঙ্কেল গান ধরেছেন, ''বাচপান কে দিন ভুলানা দেনা, আজ হাছি কাল রুলানা দেনা…ও ও ও ও...। বিজাতীয় সঙ্গীতের এই বিপুল বেগ দেখে ওয়েটার কোনোমতে ঘাড় কাত করে জানালো সে ভেতরে গিয়ে দেখবে এই গান তার সংগ্রহে আছে কিনা।
এদিকে বিড়ালটা আমাদের দিকে সতর্কভাবে তাকিয়ে আছে। তাকে সঙ্গ দেবার জন্যে কোত্থেকে আরেক বিড়াল এসে জুটেছে। আমরা মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার দিতে দিতে সব মিলিয়ে আরো চার-পাঁচটা বিভিন্ন রঙের নাদুস নুদুস থলথলে চেহারার বিড়াল চলে আসল। এদের নিশ্চয়ই টেলিপ্যাথি ধরনের কিছু একটা অতি বিড়ালীয় ক্ষমতা আছে। নইলে বাকিদেরকে খবর দিল কে? নাকি এরা রেস্তোরা ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহার করে একজন আরেকজনকে ইন্সট্যান্ট মেসেজ দিয়ে দিয়েছে? কত কিছুই তো হতে পারে। শেক্সপিয়ার বলে গেছেন, দেয়ার আর মেনি থিঙ্কস বিটুইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ। এ জগত বড় রহস্যময়। যাহোক, অবশেষে অচেনা চেহারার কিছু খাবার চলে এসেছে। ক্ষুধার্ত আমরা তা-ই আগ্রহ নিয়ে প্লেটে তুলে নিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে বিড়াল বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালানো শুরু করল। মুড়িবাহিনী বনাম বিড়ালবাহিনী। হামলার ধরন দেখে মনে হল, বিড়াল তো নয়, যেন দস্যু বনহুর আর দস্যুরানী ফুলন দেবীর দল। ধনীর আহার কেড়ে তারা তা দুস্থ, আর্ত-পীড়িত বিড়ালসমাজে বিলিয়ে বেড়াবে। রীতিমত অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। ওয়েটারকে অভিযোগ করা হল। সে বিড়ালের সুবিশাল দলটাকে একটা রাম ঝাড়ি দিয়ে তাড়া করতে উদ্যত হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাড়া না করে হঠাৎ করে উদাস হয়ে রেস্তোরার রান্নাঘরের দিকে রওনা দিল। সাথে সাথে আমরা রেস্তোরার ভাও বুঝে ফেললাম। বুঝে গেলাম যে, সুসজ্জিত এই রেস্তোরার নিয়ম-কানুন আমাদের বাংলাদেশের নীলক্ষেতের তেহারীর দোকানের থেকে খুব একটা উন্নত না। সেখানে বিড়ালের সাথে কুকুরেরও অবাধ আসা-যাওয়া। আর এখানে তো শুধু বিড়ালমাত্র। অভিযোগে কোনো লাভ হবে না। তাই হাই-হুই, হুশ-হাশ শব্দে বিড়াল তাড়াতে তাড়াতে কোনমতে খাদ্য পর্ব সারলাম।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল। ম্যানেজারের শংকা সত্য করে আমরা সেদিন হোটেল ছেড়ে কোথাও নড়লাম না। বরং, সৈকতের বালুতে পা ডুবিয়ে বসে থাকলাম। ঢেউয়ের পানিতে পা ভেজালাম। দূরে ছবির মত গাঢ় সবুজ পাহাড়ের সারি দেখে মুগ্ধ হলাম। সেই সাথে বোনাস হিসেবে রোমাঞ্চপ্রিয় কিছু পর্যটকের প্যারা গ্লাইডিং আর ওয়াটার সার্ফিং উপভোগ করে চমৎকার বিকাল আর সন্ধ্যা কাটিয়ে দিলাম।
(চলবে)
১৯ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১:২২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: সেরকম মজা পেলাম হাহা ..।
২| ১৮ ই জুন, ২০১৮ রাত ৯:৪৪
আজমান আন্দালিব বলেছেন: চমৎকার লেগেছে। বর্ণনাশৈলী অসাধারণ। চলুক, সাথে আছি।
১৯ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১:২৫
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: উৎসাহের জন্যে ধন্যবাদ!
৩| ১৯ শে জুন, ২০১৮ রাত ১২:৪৪
ক্ষুদ্র খাদেম বলেছেন: ভালো লাগলো
১৯ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১:২৬
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: ধন্যবাদ। ধন্যবাদ।
৪| ১৯ শে জুন, ২০১৮ সকাল ১১:৫২
রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর।
১৯ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১:২৭
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: ধন্যবাদ
৫| ২৬ শে জুন, ২০১৮ ভোর ৪:০৫
খনাই বলেছেন: বাঙালিকে কি খোলা বইয়ের মতো কেউ কোনোদিন পড়তে পারে ? এই দেখুন না আপনার ভ্রমণ কাহিনীর প্রথম পর্ব বাদ রেখেই কদিন আগেই দ্বিতীয় পর্ব পরে ফেললাম ! খেয়ালই করিনি যে প্রথম পর্বটা আপনি লিখেছেন ! বিড়াল বাহিনীর কাজ কারবার দেখে কিন্তু হাজার মাইল দূরের সাগর বেলার এই দ্বীপ শহরকেও দেশ দেশ মনে হলো ! এই দ্বীপের সুইসাইড রেটতো খুব হাই হবার কথা ! এই অসহ্য সুন্দর নীল সাগর ছুতে সময় নষ্ট না করেই সবুজপাহাড় থেকে কেউ লাফ দিয়ে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়না (জাস্ট কিডিং, কিন্তু সীমানা ছাড়ানো সুন্দর দ্বীপ দুটো) ? খুবই সুন্দরকৃত | গ্রীকমিথোলজির সেই হেলেনিক সুন্দরের ছোয়া আজও আছে শ্বেত এই দ্বীপ শহরে | সেই সুন্দরগুলো আপনার বর্ণনায় র ফটোতেও পাখনা মেলেছে উড়ে বেড়াল মনে হয় | খুব সুন্দর | এই লেখাগুলো আরো লিখবেন প্লিজ |
২৭ শে জুন, ২০১৮ ভোর ৫:১২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: উড়ে বেড়াল কথাটা দারুন বলেছেন। আসলে লেখাটা একবারে শেষ করে অখন্ড আকারে পোস্ট করলে ভালো হত, কিন্তু ধৈর্য্যে কুলায় নি। মজার মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ!
৬| ২২ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:৫৬
উদাসী স্বপ্ন বলেছেন: জার্মান ঘোরার লোভ হচ্ছে। যদিও বেশ কবার গেছি কিন্তু ঘুরে দেখা হয়নি। ১ সপ্তাহের ভিজিটে গেলে স্বল্প খরচে কি কি দেখা যায় একটু বলেন তো। আমি সাগর বন জঙ্গল সবুজ মাঠ এসব পছন্দ করি। দালান কোঠা খুব একটা পছন্দ নয়।
একটু সাজেশন বা পোস্ট পেলে উপকৃত হতাম
©somewhere in net ltd.
১| ১৮ ই জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৩
ভুয়া মফিজ বলেছেন: হা হা হা। আমার স্মরণশক্তিও আপনার মতোই। একটা ঘটনা বলি, এস এস সি পরীক্ষায় আমার কেমিস্ট্রিতে লেটার মার্কস ছিল। তো নটরড্যাম কলেজে ভর্তি পরীক্ষার ভাইভাতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, পরমানুর সংজ্ঞা। বলতে পারি নাই। টিচার আশ্চর্য হয়ে বললেন, তুমি না কেমিস্ট্রিতে লেটার মার্কস পেয়েছো!!!!
এমন লুক দিলেন যেন, উনার সামনে শতাব্দীর সেরা নকলবাজকে দেখছেন!!
সেই লজ্জার কথা আজও ভুলতে পারি না।
লেখাটা চমৎকার লাগালো, সাথে থাকলাম।