নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হইচই, হট্টগোল এড়িয়ে চুপচাপ, নিরিবিলিতে লুকিয়ে থাকতে ভাল লাগে।

রিম সাবরিনা জাহান সরকার

যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/

রিম সাবরিনা জাহান সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

সোনারঙা ক্রীট আর নীলমুকুট শ্বেতপায়রা সান্তরিনি

২২ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:৫৯

এক মনে জপছি, একটি করল্লা, একটি করল্লা...। হোটেলের নাম আক্টি করালী (Akti Corali)। এই নাম আমার মনে থাকবে না। তাই করল্লা দিয়ে মনে রাখার চেষ্টা করছি। মনে রাখার জন্যে আমাকে নানান ফন্দিফিকির করতে হয়। স্মরণশক্তি নিম্নমানের। একটা উদাহরণ দিলে ভালো। ভিসা সংক্রান্ত কাজে মিউনিখের এক অফিসে গিয়েছি। ভিসা অফিসার কি একটা ফর্ম পূরণ করতে করতে টুকটাক প্রশ্ন করছে। জিজ্ঞেস করলো, ছেলের নাম কি। মুহুর্তেই মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো। হতভম্ব আমি বিস্ফোরিত চোখে কোলে বসা ছেলের দিকে তাকালাম। নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না। খালি মনে হচ্ছে, কুরআনের আয়াতের সাথে কি যেন একটা সম্পর্ক আছে। খুব অসহায় ভঙ্গীতে চোখ পিটপিট করছি। প্রত্যুত্তরে নয় মাসের শিশুপুত্রের ঠোঁটের কোনা বেয়ে বড় এক ফোঁটা লালা গড়িয়ে স্লো মোশনে টুপ্ করে আমার হাতের উপরে পড়লো। পিন পতন নীরবতা ভেঙে সেই টুপ্ শব্দেই হোক, আর ভিসা অফিসারের গলা খাঁকরিতেই হোক, নিমিষেই নাম মনে পড়ে গেলো। তাফসীর, তাফসীর! ইউরেকা, ইউরেকা! এক রকম বেঁচে গেলাম সে যাত্রায়। সুতরাং, সেই আমি যে ভিনদেশী এক সড়াইখানার নাম মনে রাখার জন্যে করল্লা-চিচিঙ্গার সাহায্য নেবো, এটাই স্বাভাবিক।

যাই হোক, আক্টি করালী পৌঁছে হেরাক্লিওন বিমানবন্দর থেকে ভাড়া করা গাড়িটা ছেড়ে দিলাম। গাড়ি থেকে বেরোতেই মন ভালো হয়ে গেলো। রোদ ঝলমলে সোনালী সকাল। সাদা রঙের হোটেল লাগোয়া সুবিশাল সমুদ্র তার নীল রঙ দিয়ে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে চাইছে। দেখার মত দৃশ্য। ছোট কিন্তু বিখ্যাত এই গ্রিক শহরের পুরোটাই আসলে একটা দ্বীপ। নাম ক্রীট। গ্রীসের সবচেয়ে বড় দ্বীপ। হেরাক্লিওন তার রাজধানী। হেরাক্লিওনের ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে মজার একটা তথ্য খুঁজে পেলাম। এই দ্বীপশহরের প্রতিষ্ঠাতা কোনো গ্রীক শাসক নয়, বরং আবু হাফস উমর নামের এক পরাজিত মুসলিম সৈনিক যাকে তৎকালীন স্পেনের আন্দালুসিয়া থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিলো। পরাজয় ব্যাপারটা তাহলে একেবারে খারাপ না। হারের শেষ যেখানে, জিতের শুরু সেখানেই। উমর সাহেব তো দেখা যায় বেশ কামিয়াবী লোক ছিলেন।



আমাদের, মানে তাফসু মিয়া, তার বাবা রুমি মিয়া আর আমার সাথে সফরসঙ্গী হিসেবে আছে আরো একটি পরিবার। বন্ধু আদিবা-আকরাম আর তাদের জাপানী পুতুলের মত দেখতে ছোট্ট আমালিয়া। আরো আছেন আদিবার বাবা-মা। আঙ্কেল-আন্টি রসিক মানুষ। বিশেষ করে বাহার আঙ্কেলের মাথার বাহারী টুপি আর ধোপদুরস্ত পোশাক দেখে তার নামকরণের সার্থকতা আন্দাজ করা যায়। বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে তার মনের তারুণ্যটাও বাড়ছে তেমন গতিতে। আর যত মানুষ তত মজা। আর প্রবাসী বাঙ্গালীরা সাধারনত একা-বোকা কোথাও ঘুরতে যায় না পারতপক্ষে। এই সু্যোগে প্রবাসী বাঙ্গালীর ব্যাপারে একটা গোপন তথ্য ফাঁস করে দেই? ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে বলছি; প্রবাসী বাঙ্গালী- এ এক অদ্ভুত চিড়িয়া। দেশে থাকলে বয়স পঁচিশ-তিরিশের যে যুবকটা গাবতলী থেকে হানিফ বাস নিয়ে, সদরঘাট থেকে লঞ্চ-স্টীমারে চড়ে কিংবা কমলাপুরের শোভন ক্লাসের টিকিট কেটে বিনা নোটিশে কাজে-অকাজে কেন্দুয়া-ভেড়ামারা, ছাগলনাইয়া যেকোনো জায়গায় চলে যেতে পারে, সেই একই যুবক বিদেশের মাটিতে এসে মুড়ি হতে চায়। আর এক মুঠো মুড়ি মানেই মোয়া হবার দুষ্টু বুদ্ধি। তাই নিজের বা নিজের পরিবারের সাথে অন্তত দু-চারটে বন্ধু-বান্ধব বা আস্ত দুয়েকটি পরিবার জোড়া লাগিয়ে খৈয়ের মুড়ির মোয়া হয়ে তবেই বাঙ্গালীর সন্তান "চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া" এক বিদেশ থেকে আরেক বিদেশের দিকে রওনা দেয়। এবারের মোয়া বাঁধার পুরোটা ফন্দিই আকরাম আর রুমির। তবে স্বীকার করছি, এই ধরনের বেড়ানোর স্বাদ আসলেই মোয়ার মতই মিষ্টি আর কুড়মুড়ে। আগামী কয়েকটা দিন গ্রীসের দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে এই আট সদস্যের মোয়ারুপী মুড়িবাহিনীর বেশ আনন্দেই কাটবে মনে হচ্ছে।

হোটেলের অভ্যর্থনায় বসে থাকা মোটাসোটা হাসি-খুশি ম্যানেজার আগ্রহের সাথে আমাদেরকে চাবি বুঝিয়ে দিল। আর পইপই করে বলল, আমরা যেন হোটেলে শুয়ে-বসে না থেকে আশপাশটা ঘুরে টুরে দেখি। তারপর চাবির সাথে আশপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলোর এক গুচ্ছ বিজ্ঞাপন হাতে ধরিয়ে দিল। এই লোক কেমন করে বুঝল যে আমরা আজকে কোথাও ঘুরতে যাবো না? বরং, সামনের সৈকতে অলস কুমীরের মত হা করে শুয়ে বসে থাকব আর রোদ পোহাবো? বাঙ্গালকে কি এতো সহজে বইয়ের মত পড়ে ফেলা যায়? ঘোড়েল রাজনীতির এক অসীম গুটিবাজির দেশ- বাংলাদেশের মানুষ আমরা। পত্রিকার কড়চার মত আমাদের মন পড়ে ফেললে তো মুশকিল, খুব মুশকিল।

হোটেলে বোঁচকা-বুঁচকি নামিয়ে একটু জিড়িয়ে নিতে নিতে সকাল গড়িয়ে দুপুর। খিদেও পেয়েছে যারপরনাই। আর দেরি না করে আমরা, মুড়িবাহিনী হোটেল করল্লার সিড়ি ভেঙে হুড়মুড় করে গড়াতে গড়াতে খাদ্যসন্ধানে বেড়িয়ে গেলাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই রেস্তোরা চোখে পড়ল। পুরানো আসবাব, ধুলো পড়া তৈজসপত্র আর প্রাচীন লতানো গাছে সাজানো রেস্তোরাটাকে দেখে বেশ পছন্দ হল। কিন্তু লোকজন কই? না আছে খেতে আসা অতিথি, না কোনো ওয়েটার। কোথাও কেউ নেই অবস্থা। ডাকাডাকি করতে হেলেদুলে যে বেরিয়ে এলো, সে মনুষ্য প্রজাতির কেউ নয়। বরং রেস্তোরার এঁটো-কাঁটা খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে যাওয়া ভাম আকৃতির এক হুলো বিড়াল। ভুরু থাকলে বিড়াল বাবা দিবানিদ্রা ভাঙ্গানোর অপরাধে তার বিরক্তির মাত্রাটা ভুরু কুঁচকে আমাদের জানিয়ে দিতে পারতেন। অবশেষে হোঁতকা ঢাউস বিড়ালটার পিছু পিছু বেড়িয়ে এল রেস্তোরার ওয়েটার। আমাদের দেখে সে খুশি হয়েছে না বেজার সেটা ঠিক বোঝা গেল না। তবে সে ভেতরে গিয়ে মেন্যু নিয়ে আসার সময়ে মৃদুলয়ে বাজতে থাকা গ্রীক গানের শব্দটা বাড়িয়ে দিয়ে এসেছে। গানের বাজনায় আর সুরে আরবদেশীয় প্রভাব প্রচ্ছন্ন। কিন্তু সেই গান বোধহয় আমাদের বাহার আঙ্কেলের পছন্দ হল না। উনি ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলেন, তাদের কাছে ''বাচপান কে দিন ভুলানা দেনা", এই গানটা আছে কিনা। উত্তরে ভদ্রলোক খুব বিভ্রান্তি নিয়ে তাকালো। কিন্তু বিভ্রান্তু কাটিয়ে ওঠার কোনো সুযোগ সে পেলো না। তার আগেই কাঠের টেবিলে তাল ঠুকে আঙ্কেল গান ধরেছেন, ''বাচপান কে দিন ভুলানা দেনা, আজ হাসি, কাল রুলানা দেনা…ও ও ও ও...''। বিজাতীয় সঙ্গীতের এই বিপুল বেগ দেখে ওয়েটার সাহেব কোনমতে ঘাড় কাত করে জানালো সে ভেতরে গিয়ে দেখবে এই গান তার সংগ্রহে আছে কিনা।

এদিকে বিড়ালটা আমাদের দিকে সতর্কভাবে তাকিয়ে আছে। তাকে সঙ্গ দেবার জন্যে কোত্থেকে আরেক বিড়াল এসে জুটেছে। আমরা মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার দিতে দিতে সব মিলিয়ে আরো চার-পাঁচটা বিভিন্ন রঙের নাদুস নুদুস থলথলে চেহারার বিড়াল চলে আসল। এদের নিশ্চয়ই টেলিপ্যাথি ধরনের কিছু একটা অতি বিড়ালীয় ক্ষমতা আছে। নইলে বাকিদেরকে খবর দিল কে? নাকি এরা রেস্তোরা ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহার করে একজন আরেকজনকে ইন্সট্যান্ট মেসেজ দিয়ে দিয়েছে? কত কিছুই তো হতে পারে। শেক্সপিয়ার বলে গেছেন, দেয়ার আর মেনি থিঙ্কস বিটুইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ। এ জগত বড় রহস্যময়। যাহোক, অচেনা চেহারার কিছু ধোঁয়া ওঠা খাবার চলে এসেছে। ক্ষুধার্ত আমরা তা-ই আগ্রহ নিয়ে প্লেটে তুলে নিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে বিড়াল বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালানো শুরু করল। মুড়িবাহিনী বনাম বিড়ালবাহিনী। হামলার ধরন দেখে মনে হল, বিড়াল তো নয়, যেন দস্যু বনহুর আর দস্যুরানী ফুলন দেবীর দল। ধনীর আহার কেড়ে তারা তা দুস্থ, আর্ত-পীড়িত বিড়ালসমাজে বিলিয়ে বেড়াবে। রীতিমত অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। ওয়েটারকে অভিযোগ করা হল। সে বিড়ালের সুবিশাল দলটাকে একটা রাম ঝাড়ি দিয়ে তাড়া করতে উদ্যত হল। ঝাড়ি পর্যন্তই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাড়া না করে হঠাৎ করে উদাস হয়ে রেস্তোরার রান্নাঘরের দিকে রওনা দিল। সাথে সাথে আমরা রেস্তোরার ভাও বুঝে ফেললাম। বুঝে গেলাম যে, সুসজ্জিত এই রেস্তোরার নিয়ম-কানুন আমাদের ঢাকার নীলক্ষেতের তেহারীর দোকানের থেকে খুব একটা সুবিধার নয়। সেখানে বিড়ালের সাথে কুকুরেরও অবাধ আসা-যাওয়া। আর এখানে তো শুধু বিড়ালমাত্র। অভিযোগে কোনো লাভ হবে না। তাই হাই-হুই, হুশ-হাশ শব্দে বিড়াল তাড়াতে তাড়াতে কোনমতে খাওয়া দাওয়া সারলাম। আমি অবশ্য পুরো ব্যাপারটা মনে মনে খুব উপভোগ করলাম। বিড়াল আমার প্রিয় প্রানী। এদের সান্নিধ্য ভালো লাগে। তাই পায়ের কাছে বসা বাদামী লোম, সবুজ চোখ একটা ভামলু বিড়ালকে এক টুকরা ভাজা মাছ দিয়ে আমার খাদ্যপর্বের সঙ্গী করে নিলাম। সেও কৃতজ্ঞতায় পড়ে ফোলা ফোলা লেজটা আমার পায়ে বুলিয়ে দিতে থাকল। এই মিথ্যা পৃথিবীর সত্যি ভালবাসার উপকরণগুলো খুব সস্তা, সাদামাটা। কিন্তু বিনিময়ে পাওয়া প্রাপ্তিটুকু খুব দামী আর দুর্লভ। আপাতত, এই অমানবিক বিড়ালীয় ভালবাসায় আমি মুগ্ধ।



হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল। ম্যানেজারের শংকা সত্য প্রমাণ করে আমরা সেদিন হোটেল ছেড়ে কোথাও নড়লাম না। বরং, সৈকতের বালুতে পা ডুবিয়ে বসে থাকলাম। ঢেউয়ের তালে পা ভেজালাম। দূরে ছবির মত গাঢ় সবুজ পাহাড়ের সারিতে হারিয়ে গেলাম। সেই সাথে উপরি পাওনা হিসেবে রোমাঞ্চপ্রিয় কিছু পর্যটকের প্যারা গ্লাইডিং আর ওয়াটার সার্ফিং উপভোগ করে চমৎকার এক সোনারঙা বিকাল আর সন্ধ্যা কাটিয়ে দিলাম।



পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম বাসের খোঁজে। স্থানীয় পর্যটন বাস। সারা শহর এমাথা ওমাথা ঘুরবে আমাদের নিয়ে। সঙ্গে ছানা পোনা থাকায় খুব বেশি জায়গায় আমরা নামবো না। তবে নসোস (Knossos) প্রাসাদে নামার ইচ্ছে আছে। বলা হয়ে থাকে, ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হচ্ছে মিনোয়ান সভ্যতা। যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই নসোস প্রাসাদকে ঘেরা ক্রীট নগরী। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। সিড়ি দিয়ে উঠে গেছে বহুতল দালান। সময়ের গহ্বরে হারিয়ে গেছে এককালের জৌলুস, দম্ভ। এখন শুধু দাঁড়িয়ে তার ভগ্নাংশ। প্রচুর পর্যটক এসেছে। তাদের একটা বড় অংশ জাপান থেকে আসা। বিশাল দলের দলনেতার হাতে জাপানী পতাকা দেখে বোঝা যায় সহজেই। দলের সবার বয়স হিসেব করলে গড় দাঁড়াবে ষাটের কাছাকাছি। সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের অতি কর্মময় জীবনের ''কারোশি'' নামের প্রবল চাপের কাছে নতি স্বীকার না করা মানুষ এরা। কারোশি হচ্ছে সেদেশের অমানুষিক কাজের চাপে হৃতযন্ত্র বন্ধ হয়ে মৃত্যুর একটা সমাজস্বীকৃত নাম। হায় রে সভ্যতা! সেই সভ্যতার বহুতল শিখরে বাস করে কারোশি নামের সাড়াশি। সাবাস, সাবাস। যাহোক, সভ্য হবার জীবনযুদ্ধে জয়ী মানুষগুলোর চোখ মুখ দারুন উৎফুল্ল। অবসর জীবনের এই আনন্দময় অধ্যায় তাদের নির্ঘাত ভালো লাগছে।

মানব সভ্যতার প্রাচীন নগরের ভগ্নাংশে আমার তেমন আগ্রহ নেই। তাই পড়ে থাকা ঘটিবাটি, ভাঙ্গা প্রাচীর আর চল্টা উঠে যাওয়া মূর্তি আমার মনযোগ কাড়তে পারলো না। প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের উল্টো দিকে নীল আকাশের নীচে শ্যামল পাহাড়ের সারি। সেদিকে কারো তেমন ভ্রূক্ষেপ নেই। সবাই ব্যস্ত। যন্ত্রের চোখে চোখ। হাতে মুঠোফোন আর সেলফি স্টিক নামের একালের ঠুনকো ক্ষ্যাপামি। যন্ত্রের কোঠরে একের পর এক বন্দী হতে থাকে সেকালের ধুলো পড়া ইতিহাস। আমি জোড় করে চোখ সরিয়ে অবহেলায় একলা দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের দিকে তাকালাম। আজকের ঝকঝকে দালানই আগামীর ভগ্নাংশ। মাঝের ফারাকটুকু শুধুই সময়ের। সেখানে এই পাহাড় তার অহংকার নিয়ে ঠিকই টিকে থাকবে সময়ের তুরুপের তাসকে ইস্কাপনের টেক্কা দিয়ে। এইসব সাতপাঁচ ভাবছি, এমন সময় বাস ধরার তাড়ায় সম্বিত ফিরে পেলাম।



পরের দিন সান্তরিনি। সারাদিনের জন্যে ব্যাগ গুছিয়ে বের হলাম। হোটেলের সামনে থেকে বাস ধরে হেরাক্লিয়নের ফেরিঘাটে পৌঁছে গেলাম সকাল সকাল। অতিকায় ফেরি। তার বিশাল হা-এর মাঝে অসংখ্য গাড়িঘোড়া আর পিলপিল মানুষ- সব অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমরা টিকেট দেখে সিট খুঁজে বসে গেলাম যে যার জায়গায়। এই ফেরি আমাদের নিয়ে যাবে সান্তরিনির আথিনিয়স বন্দরে। সান্তরিনি কথাটা এসেছে Saint Irene নামের পুরানো এক ক্যাথিড্রালের নাম থেকে। কালকের প্ররিক্রমায় লোকমুখে সেটা হয়ে গেছে সান্তরিনি। অপভ্রংশ আর কি। আমাদের পুরান ঢাকার গ্র্যান্ড এরিয়া যেমন গেন্ডারিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘড়ি ধরে সময় মত ফেরি ছাড়ল। পাঁচ মিনিটের মাথায় বুঝতে পারলাম, অবস্থা বেগতিক। ফেরি দুলছে। হালকা দুলুনি আকার নিয়েছে উথাল পাথাল ঝাঁকুনিতে। মনে হচ্ছে উত্তাল ঢেউয়ের চূড়ায় আমরা কাগজের নৌকায় করে ভাসছি। দুঃস্বপ্ন দুঃস্বপ্ন লাগছে। এইরকম পরিস্তিতিতে আমার মা সাথে থাকলে ব্যাপারটা একটা আলাদা মাত্রা পেত। সে অতিরিক্ত ভয় পেয়ে যেত আর উচ্চস্বরে আওড়াতে থাকত, ''লা ইলাহা ইন্না আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোওয়ালিমিন"। এই বিপদে বসের কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া উপায় কি? মুশকিল হচ্ছে, ভয় একটা সংক্রামক বিষয়। তার ভয় আমার মাঝেও ঢুকে যেত। আমরা ভয় পেতে পছন্দ করি। আমরা মা-মেয়ে মিলে সযত্নে সেই ভয় বাকি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতাম আর কিছুক্ষনের মাথায় ইয়া নফসি ইয়া নফসি অবস্থা বানিয়ে ফেলতাম। আপাতত লোকজনের অবস্থা এমনিতেই ইয়া নফসি। মনে মনে আল্লাহর নাম জপতে জপতে আর ঝাঁকি সামলে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। সামনে বাচ্চাদের খেলার জন্যে ছোট একটা কোনা আছে। তাফসীর আর তার বাবা আছে সেখানে। এক পা আগাই তো ঝাকুনি খেয়ে তিন পা পিছিয়ে যাচ্ছি। এই কেয়ামতি অবস্থার মাঝে কানে ভেসে আসল বাহার আঙ্কেলের গলা। উনি গাচ্ছেন, "বাচপান কে দিন ভুলানা দেনা,, আজ হাসি, কাল রুলানা দেনা... "। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, গানের তালে পা দোলাচ্ছেন আর হাত দিয়ে হাঁটুর উপর তাল ঠুকছেন। মুখে অপার্থিব হাসি। পাশে বসা আন্টি ফ্যাকাসে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে আছেন। বিপদের মাঝেও এই অদ্ভুত বৈপরীত্যে মজা পেলাম। সামনে এগোতেই দেখলাম তাফসীর আর আমালিয়া কিচিরমিচির শব্দ তুলে মনের আনন্দে খেলছে। সাগরের উত্তাল দুলুনি তাদের স্পর্শ করতে পারে নি। যেমন পারে নি বাহার আঙ্কেলকে। বয়সের প্রান্তিক মেরুতে অবস্থান করা মানুষের ভেতর বোধহয় ভীতি ব্যাপারটা কম কাজ করে। আর মাঝের জায়গাটুকু পাড়ি দেয়া আমরা বাস করি জীবনের প্রতি এক ধরনের আতংক আর অনিশ্চয়তাকে সাথে করে। এও এক আশ্চর্য বৈপরীত্য। আড়াই ঘন্টার জায়গায় তিন ঘন্টা লাগিয়ে এক সামুদ্রিক পুলসিরাত পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমরা সান্তরিনি পৌঁছালাম।



এইজিয়ান সাগরে জেগে থাকা গ্রীক দ্বীপ সান্তরিনির ইতিহাস শুধুই অগ্ন্যুৎপাতের আর ধ্বংসের। বহুবারের ঘটে যাওয়া অগ্ন্যুৎপাত এই দ্বীপটাকে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আকার দিয়েছে। যেন বাঁকানো এক ধারালো কাস্তে। দ্বীপময় ছড়ানো লাল, সাদা, কালো পাথরের নুড়ি। তারই মাঝে শ্বেত পায়রারঙা সারি সারি বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে নীল গম্বুজের মুকুট মাথায় নিয়ে। সাগরের ঝাঁকুনি আর এমন কি প্রবল; এই সৌন্দর্য্যের বিভ্রম তার চেয়েও জোরে ঝাঁকি দিয়ে গেল আমাদের। মনে হল যেন গল্প-সিনেমার পর্দা থেকে উঠে আসা কোনো দৃশ্যপট। আবার ভয়ও লাগলো, এই বুঝি বলিউডি কোনো সিনেমার শ্যুটিংয়ের অজুহাতে কিম্ভূত নাচের দল সাদা বাড়িগুলোর পেছন থেকে ধেই ধেই করে বেরিয়ে আসবে। পরে জানতে পেরেছি, ঘটনা আসলেও সেরকমই ঘটেছিল। একই সময় কাছে পিঠের আরেক দ্বীপে বলিউডের সালমান খান আর ক্যাটরিনা কাইফ এসে এক দফা নাচানাচি করে গেছে। সিনেমার নাম নাকি টাইগার জিন্দা হ্যায়, আর গানের নাম স্যোয়াগ সে সোওগাত। কি যে বাঁচা বেঁচে গেছি, সেই ধিতাং ধিতাং শ্যুটিংয়ের ভেতর পড়ি নি। টাইগার কেন, বিল্লি জিন্দা হলেও আমার কোনো আগ্রহ কাজ করত না। এর চেয়ে টিএসসির মোড়ে নাটকের শ্যুটিং হলে রিক্সা থামিয়ে আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। বিচিত্র মানসিকতা।



সারাদিন ঘুরে ফিরে চোখের ক্যামেরায় পলকের শাটার ফেলে অনেক ছবি তুলে ফেললাম। মুঠোফোন আর ক্যামেরার ছবিও হারিয়ে যায়। কিন্তু মনের ক্যামেরা এক আজব বস্তু। এর ভেতরের ছবি কালের স্রোতে ধুলো পড়ে হয়ে ঝাপসা হয়ে আসে, কিন্তু এক ফুঁয়ে আবার স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে। ফিরতি পথের ফেরি ধরতে পা বাড়ালাম। আমাদের হতাশ করে ফেরি বন্দরে ভিড়ল ঘন্টা তিনেক পরে। ততক্ষনে আমরা, অলস হাঁটাহাঁটি করে, পড়ন্ত বিকালের দিকে উদাস তাকিয়ে থেকে প্রায় একঘেয়ে হয়ে উঠেছি। মজার ব্যাপার, আমাদের সাথে থাকা কনিষ্ঠ দুই সদস্যের কোন ক্লান্তি নেই এই অপেক্ষায়। তাদের একজন, তাফসীর মিয়া দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। যেন অদৃশ্য কোন প্রজাপতির পেছন হন্যে হয়ে ছুটছে। ছেলের খেয়াল রাখতে গিয়ে তার বাবার ঘাম ছুটে যাচ্ছে। আরেকজন, আমালিয়া তার নানা-নানুর কোল থেকে বাবা-মার কাঁধে অসংখ্যবার ফেরি পারাপার করে দিব্যি সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। আচ্ছা, শিশুদের ব্যাটারি কি লিথিয়ামের তৈরি? চার্জ আর ফুরাতে চায় না।



একসময় অপেক্ষায় ভিড় হয়ে ওঠা যাত্রীদের ভিড় ঠেলে ফেরিতে ওঠা হল। শেষবারের মত ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকালাম। গোধূলি সাঁঝের কমলা পড়ন্ত রোদ নেমে এসেছে পাহাড়ের গা ঘেঁষে। মায়াকাড়া সৌন্দ্যর্য। সৌন্দর্য্যকে বিদায় বলা কঠিন। তবুও মনে মনে টুক করে বিদায় জানালাম। এক সময় সুন্দর বলতে বাংলাদেশকেই বুঝতাম। আর এখন মনে হয়, স্রষ্টার যত্নে গড়া পুরো পৃথিবীটাই অপার্থিব সুন্দর। হোক তা দেশ, কিংবা দেশের বাইরে দেশ।

বি.দ্র. ছবির কৃতজ্ঞতায় জাপানী পুতুলের মাতা, আদিবা
২১.০৬.১৮
ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার
মিউনিখ, জার্মানি

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ২:৫২

কাওসার চৌধুরী বলেছেন: শুভেচ্ছা নেবেন। অনেক দিন পর একটা চমৎকার ভ্রমণ কাহিনী পড়লাম। বেশ ভাল লেগেছে। পোস্ট লাইক B-) দিলাম

২২ শে জুন, ২০১৮ রাত ৮:৫৭

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগছে। ধন্যবাদ!!

২| ২২ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪১

রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার।
অত্যন্ত মনোরম।

২২ শে জুন, ২০১৮ রাত ৮:৫৮

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ!!

৩| ২৩ শে জুন, ২০১৮ ভোর ৪:৪৬

খনাই বলেছেন: শ্বেত পাথরে গড়া গ্রিক ভাস্কর্যগুলো বা প্রাসাদগুলোর মতোই চমৎকার হয়েছে আপনার লেখা ক্রীট আর সান্তোরিনি দ্বীপের ভ্রমণ কাহিনী ।খুব সুন্দর বর্ণনায় মন ভরলো । আমি খুবই ঘরকুনো এক মানুষ Iথাকি মায়াবী একটা লেক আর পাহাড়ের পাশে যেন কোনো এক স্বর্গের কাছাকাছি I কিন্তু তবুও শেষ ফটোটা দেখে দেখে আমারও সোনারঙা ক্রীট বা নীলমুকুট শ্বেতপায়রা সান্তরিনির নীল সাগরটা ছুঁতে ইচ্ছে করলো I আপনার বর্ণনাতে নিজের পেছনের কিছু জিনিসও এসে পড়লো -হা কোথায় আমার সেই রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর পড়ার দিনগুলো ! ভ্রমণ থেকে ফেরার পথে পৃথিবীর সৌন্দর্য ভাবতে গিয়ে আপনার মন উদাস হলো কি না জানিনা আমার কিন্তু দস্যু বনহুর পড়ার দিনগুলো মনে হয়ে মন খারাপ হলো আপনার এই সোনারঙা ক্রীট আর নীলমুকুট শ্বেতপায়রা সান্তরিনি ভ্রমণ পড়ে । খুব সুন্দর। Danke vielmals।

২৩ শে জুন, ২০১৮ দুপুর ২:০২

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আপনার কথাগুলো মন ছুঁয়ে গেল। কথাগুলো মুক্তোর মত সফেদ। ভালো থাকবেন।

৪| ২৪ শে জুন, ২০১৮ রাত ২:৫৩

আনাতোলিয়া বলেছেন: অপূর্ব কথন
আনন্দময় ভ্রমন।

২৪ শে জুন, ২০১৮ রাত ৩:০৫

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আর আপনি যে আমার লেখা পড়েছেন, তাতে আমি ভ্রমনের চেয়েও বেশি আনন্দ পেয়েছি। অশেষ কৃতজ্ঞতা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.