নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/
পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩
৪.
আজকে যাব মালচাসিনে। শুনেছি গার্দা হ্রদের পুব পাড়ের মালচাসিনে এক কালে ছিল ঘটনাবিহীন ঘুম ঘুম নিরুপদ্রব জেলেপল্লী। কালের পরিক্রমায় সাধারন জেলে পাড়া থেকে তার প্রমোশন হয়েছে। কারন আর কিছুই না-পর্যটন। গার্দা হ্রদের সবচেয়ে উঁচু চূড়া মন্টে বাল্ডোর রাজত্ব সেখানে। মন্টে বাল্ডো মানে দাঁড়ায় টেকো পর্বত। চূড়ার মাথায় নাকি মুকুট হয়ে বসে আছে প্রাচীন এক দূর্গ। তো, এই টেকো রাজার মুকুট দর্শন আজকের দিনের প্রধান আকর্ষন।
বাসের জন্যে সবাই অপেক্ষায় আছি। বাসের দেখা নেই। ব্রিটিশ এক বুড়ো-বুড়ি অনেক্ষন প্রতীক্ষায় থেকে রনে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে গেল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও আমরা হাল ছাড়লাম না। বরং স্কটিশ সেনাপতি রবার্ট ব্রুসের মাকড়শা হয়ে স্টপেজের পাশের পাঁচিলের ধারে ঝিমোতে থাকলাম। এই বাসটা এলো না তো কি হয়েছে? পরেরটা নিশ্চয়ই আসবে। সময় কাটানোর জন্যে হাদী ভাই নানান ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত। আমাদেরকে জনে জনে জিজ্ঞেস করছেন, ’বড় হয়ে কি হতে চাই?’ দলের দুই শিশু সদস্য বাদে বাকিরা যে সব বড় হতে হতে প্রায় বুড়ো হবার পথে, তাদেরকেই কিনা এই প্রশ্ন! তবে যেমন প্রশ্ন, তেমনই উত্তর। দারুন সুরেলা কন্ঠের মৌরি আপু বলল, সে গায়িকা হতে চায়। হতে চাওয়ার আবার কি আছে আমরা ঠিক বুঝলাম না। কারন, এত চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারা লোক তো ইতোমধ্যেই গায়িকা হয়ে বসে আছেন। ওনার বলা উচিত,’নায়িকা হতে চাই। বাংলা সিনেমার চাকভুম চাকভুম নায়িকা।‘ আর এদিকে আমি উদাস ভঙ্গিতে বললাম, ‘তিন বাচ্চার মা হতে চাই’। একটা তো আছেই। আরো গোটা দুই থাকলে জমতো বেশ। মায়ের আরেক কাঠি সরেস দুই ফুটি ছেলে পাশ থেকে যোগ করে বসল, সে ভাইয়া হতে চায়। তার মুখে দুষ্টু হাসি। এহেন বে-আক্কেল চাওয়া-পাওয়ার বহর দেখে ছেলের বাপের আক্কেলগুড়ুম। আরো কতগুলি নতুন লোকের স্থান সংকুলানের জন্যে উচ্চ ভাড়ার একটা ভাল বাসার দুশ্চিন্তায় স্ত্রী-পুত্রের প্রতি ভালবাসা উবে গিয়ে শরৎচন্দ্রের স্কেপিস্ট নায়কদের মত ‘তাহার মুখ দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়াই যেন নিমেষে ছাই হইয়া নিভিয়া গেল।‘ রুমির আমচু চেহারা দেখে আমরা হেসে লুটিয়ে পড়লাম।
বাস আসছে না। চিন্তার ব্যাপার। কিন্তু তার থেকেও চিন্তার বিষয়, খিদে পাওয়া শুরু হয়েছে। তার প্রমান-বড় হয়ে কি হতে চাই থেকে প্রসঙ্গ পাল্টে আলোচনাটা খাদ্য বিষয়ক হয়ে গেছে এক ফাঁকে। খাদ্যের নাম ডিমের বিরিয়ানি। এক ডজন সেদ্ধ ডিম, এক কেজি চাল, গোটা দুই নধর আলু, গরম মশলা আর আধা লিটার দুধ হলেই হবে। সাথে প্রচুর বেরেশতা করা পেয়াজ। হাত নেড়ে, মাথা দুলিয়ে এমনভাবে রেসিপি বলছি যেন এখনই জলপাই গাছের পাতা কুড়িয়ে পথের ধারে লাকড়ির চুলা পেতে ডিমের বিরিয়ানি রাঁধতে বসে যাব। সবাই যখন কাল্পনিক ডিমের বিরিয়ানির অস্তিত্ব মেনে নিয়ে তার মৌ মৌ ঘ্রানের হ্যালুসিনেশনে ভাসছি, ঠিক তখনই আমাদের ভেতর বাস্তববাদী একজনের মাথায় দারুন বুদ্ধি খেলে গেল। বাসের অপেক্ষায় আর হাঁ করে না থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেই না কেন। ঘুরতে এসে এত হ্যাঁপা সয় না। কল্পনার বুদবুদ সূঁচের খোঁচায় নাই করে দিয়ে সবাই তাতে সায় দিলাম।
ট্যাক্সি মিলল। পাহাড়ি উঁচু নিচু ঢালু পথে দুর্ধর্ষ ইটালিয়ান চালক তার পংক্ষীরাজটা ফর্মূলা ওয়ানের মাইকেল শ্যুমাখারের মত উড়িয়ে দশ মিনিটের মাথায় আমাদের মন্টে বাল্ডোতে নিয়ে এল। মাথার ওপর মাঝ দুপুরের অবারিত আকাশ। তাতে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ নিরুদ্দেশের ভেলা ভাসিয়েছে। নীল আকাশের নিচে আমরাও বেরিয়েছি আজকে নিরুদ্দেশ হব বলে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে অনেকখানি উঠলে পরে পাহাড় চূড়ায় দেখা মিলবে স্কালিজার দূর্গের। ইটালিয়ান উচ্চারনে কাস্তেলো স্কালিজিরো (Castello Scaligero)। দূর্গের ভেতরে আছে গার্দা লেকের ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরটা। দেখার খুব শখ। অনেক পুরানো জিনিসের বিশাল সংগ্রহ। এক ঢিলে দুই পাখি হয়ে যাবে।
সিড়ি কাটা পাথুরে পথ। বাচ্চারা লাফিয়ে লাফিয়ে ডিঙ্গোচ্ছে। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। আমি কাশি বিরতি নিয়ে খাবি খেতে খেতে আধ মাতালের মত টালমাটাল গতিতে দলটার পিছু পিছু চলছি। দুই পাশে নাম না জানা বুনো ফল থোক বেঁধে ঝুলছে। রঙ্গীন ফলের হাতছানিতে নিষিদ্ধ মাদকতা।
অবশেষে পায়ে হাঁটার ক্লান্তি ভুলিয়ে পাহাড় চূড়ায় শ্বেত পাথরে গড়া মধ্যযুগীয় স্কালিজার দূর্গ উঁকি দিল। তেরশ শতকের গড়িমা তার ম্লান তো হয়ই নি, বরং প্রাচীন আভিজাত্য ঠিকরে পড়ছে সূর্যের প্রখর আলোয়। তের আর চৌদ্দ শতকে ডেল্লা স্কালা পরিবার শাসন করেছে ভারোনে অঞ্চলটা। তাদেরই নামে নাম এই স্কালিজার দূর্গ প্রাসাদের। আস্তে আস্তে এগোলাম প্রবেশদ্বার বরাবর। টিকেট কাটতে হবে। দূর্গের একটা একত্রিশ মিটার উঁচু মিনার আছে। সেখান থেকে নিচে তাকালে কি যে অসাধারন লাগবে, ভাবতেই শিহরন জাগছে।
কিন্তু কপালের নাম গোপাল প্রমান করে দিয়ে টিকেট বাক্সের লোক জানালো আজকে চব্বিশে ডিসেম্বর বেলা দুইটার পর থেকে দূর্গের ঝাঁপি বন্ধ দর্শনার্থীদের জন্যে। হাতঘড়িতে বাজে এখন দুপুর দেড়টা। ভেতরে আর ঢোকা যাবে না এত দেরিতে। কিন্তু যদি চাই, এই আধা ঘন্টায় দূর্গের সামনের উঠোনে ঘুরে আসতে পারি। কি আর করা! অগত্যা নাই মামার বদলে কানা মামাকেই মামা ডাকলাম। উঠানের মাঠে গিয়ে দেখি, এই বা কম কোথায়। এই চূড়া থেকে পুরো মালচাসিনে দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট বাড়িঘর পাহাড়ের পায়ের কাছে মাদুর বিছিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঠিক যেন ছিড়ে যাওয়া পুঁতির মালার মতন। স্কালিজারের ভেতরটা ঘুরে দেখতে না পাবার আফসোস কমে এল। প্রকৃতির অপরূপ দম্ভের কাছে মানুষের জোড়া দেয়া পাথুরে স্তম্ভের আস্ফালন চিরকালই তুচ্ছ ঠেকে।
ফিরতি পথে টিকেটের লোকটা জানতে চাইল, আমরা একা একা অচেনা পথে নামতে পারবো তো? আগের পথে গেলে গাড়ি মিলবে না, তাই। চাইলে সে আমাদের সাথে যেতে পারে। তারও গন্তব্য একই দিকে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। ছানাপোনা হাতে ঝুলিয়ে চললাম জাতে আলজেরিয়ান লোকটার দেখানো পথ ধরে। কত সহজেই না অন্ধ বিশ্বাসে ভিনদেশের অচেনা লোকের পিছু নিলাম। পৃথিবীর পথে একবার বেরিয়ে পড়লে বোধহয় মানুষের ওপর বিশ্বাস জন্মানোটা খুব সহজাত একটা ব্যাপারে দাঁড়ায়। ফুলেল বুনো পথ মাড়িয়ে নিরুদ্দেশ থেকে উদ্দেশের হদিসে চলতে লাগলাম নিশ্চিন্তে। (চলবে)
০৭.০৪.২০১৯
০৯ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:৪৭
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, ব্যস্ততার ফাঁকে পড়ে আবার মন্তব্য করেও গেছেন বলে।
২| ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৮:০২
পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: সুন্দর বর্ণনা! ত্রয়োদশ শতকের স্কালিজা দুর্গ এবং চতুর্দশ শতকের আভিজাত্যের প্রতীক ডেল্লা স্কার্লা বর্ণনা শুনেই আলাদা রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। মধ্যযুগীয় ভাস্কর্যের অন্যতম প্রতীক, তাকে চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা সত্যিই অসাধারণ। ++
অফুরান শুভেচ্ছা জানবেন।
০৯ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:৪৮
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আপনিও কৃতজ্ঞতা জানবেন অফুরান। আপনার উৎসাহ আমার ভীষন কাজে দেয়।
৩| ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৮:১৬
মলাসইলমুইনা বলেছেন: শান্ত হ্রদের স্নিগ্ধ শহরের ভ্রমণ বর্ণনাও এই পর্বে সুন্দর ও শান্ত স্নিগ্ধ হয়েছে । স্কালিজার দূর্গ প্রাসাদ পরে কি আর দেখা হলো পরের দিন বা তার পরের দিন ? ভ্রমণকে ভ্রমর গুঞ্জনের মতো আনন্দদায়িনী করে বলতে পারছেন আপনি যেটা সবাই পারে না ।আমেরিকার পঞ্চাশটা স্টেটের মধ্যে প্রায় সব ঘুরেও আমি যে একটাও ভ্রমণ কাহিনী লিখতে পারলাম না সেটার মূল কাহিনীও সেটা।কিন্তু আপনি খুব সহজেই রসে টইটুম্বুর করে ভ্রমণকাহিনী বলতে পারছেন আপনার প্রথম লেখাগুলো থেকেই।লেখায় ভালো লাগা।ভালো থাকার শুভেচ্ছা ।
০৯ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:৫৬
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: শুভেচ্ছা আপনাকেও। হ্যাঁট হ্যাট করলে ভেড়ার পাল এগোয়। তাগাদা দিলে আমার লেখা এগোয়। একাজটার জন্যে ধন্যবাদ জানালে কম হয়ে যাবে। পঞ্চাশ পড়গণা না পারলেও পাঁচটাকে নিয়ে লিখে ফেলুন। নইলে অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে কিন্তু। আমার ২০১৫'র দিকে ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়া হয়েছিল। সেটা নিয়েও লেখার ইচ্ছে রাখি। যদিও বুড়ো মগজে কোনে এতদিনের স্মৃতিতে ধূলো পড়ে গেছে।
আর আমি কিন্তু টাটা কোম্পানির লোক নই। সূচিত্রা সেনের আদি বাড়ির লোক।
৪| ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৮:৩৪
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: আরেহ দারুন দারুন সব সিরিজ উৎসব চলছে!!!
নাহ! আসলেই দারুন কিছূ মিস হচ্ছিল!!
ভ্রমনের সাথে জীবন বোধের এমন রসময় মিশেল!
এমন প্রাণময় বর্ণনা- যেন দলের একজন হয়েই ঘুরে এলাম
++++++++++
০৯ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১:০০
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: সালাম জানবেন। বরাবরের মত লজ্জায় ফেলে দিলেন। সাথে লেখার টুকটাক ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিলে দারুন হত। আমি কিছু সমালোচনা পাবার জন্যে মুখিয়ে থাকি। আশা করি তেমন কিছু পাব সামনে। আগাম ধন্যবাদ।
৫| ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ৯:১৭
রাজীব নুর বলেছেন: চিন্তা করেছি শেষ বয়স টা ঘুরে বেড়াবো।
০৯ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১:০৫
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: এখনই নয় কেন। বাঙ্গালির শেষ বয়সটা খুব সহজে গ্রাস করে নেয় ডায়বেটিস, বাতের ব্যথা, রক্তচাপ ইত্যাদি গুরুতর অসুখ আর ছেলে-মেয়ের বিবাহ সংক্রান্ত দায়িত্ব। তাই 'ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া শিশিরবিন্দু' দেখার এখনই তো আদর্শ সময়!
৬| ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ২:১৫
করুণাধারা বলেছেন: দারুন হাত আছে আপনার লেখায়!
সাথেই আছি সব সময়।।।
০৯ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১:১০
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: প্রবাসের অদ্ভূত চক্রাকার জীবনের ফাঁকে সপ্তাহান্তের রাতগুলোতে নির্ঘুম জেগে লেখা কথাগুলো কাছে-দূরের আর কাউকে ছুঁতে পেরেছে জানতে পারলে এক ধরনের নিখাদ ভাল লাগা কাজ করে। এর তুলনা মূল্যে মাপা যায় না। অজস্র ধন্যবাদ।
৭| ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১২:৪৩
আখেনাটেন বলেছেন: চমৎকার।
ভ্রমণে গেলে কিছু মানুষকে বিশ্বাস করতেই হয়।
১৩ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৩:৩৬
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: কথা সত্য ব্বলেছেন। ধন্যবাদ!
©somewhere in net ltd.
১| ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ ভোর ৪:০৬
ল বলেছেন: ছোট ছোট বাড়িঘর পাহাড়ের পায়ের কাছে মাদুর বিছিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।- সুন্দর ও সাবলীল বর্ণনা।