নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হইচই, হট্টগোল এড়িয়ে চুপচাপ, নিরিবিলিতে লুকিয়ে থাকতে ভাল লাগে।

রিম সাবরিনা জাহান সরকার

যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/

রিম সাবরিনা জাহান সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

গার্মিশে ঘ্যাও ম্যাও (অখন্ড)

২৯ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৩:০৪


১.
পড়াশোনায় বিকট অ্যাালার্জি। তাই জায়গাটা সম্পর্কে কোনরকম গুগলীয় বাটি চালান না দিয়ে, মানে পড়াশোনা না করেই বাকিদের পিছু পিছু চলে এসেছি নিশ্চিন্তে। জড়ভরত আর কাকে বলে। তার উপর আছে কুখ্যাত পরজীবী স্বভাব। আসার আগে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে ভুলে গেছি। দুইটা আধুলি আর দশ ইউরোর খান তিনেক নোট ছাড়া পকেট গড়ের মাঠ। এই তথ্য ছেলের বাবাকে জানানোর পর সে রীতিমত বিরক্ত, ‘এই তোমার এক স্বভাব, সব ভুলে যাও। জানোই তো, অনেক জায়গায় ডেবিট কার্ড নেয় না এরা’। কথাটা শেষ হল ভ্রুকুটি দিয়ে। ধূর্ত আমি অবশ্য রাগলাম না। পিঁপড়া কখনো অ্যাফিডের উপর রাগ করে না।

তবে কোন কিছুর খোঁজখবর না নিয়ে এসে লাভ হয়েছে। যা দেখি, লাগে ভালো। দুই বন্ধু পরিবার মিলে বেড়াতে এসেছি। মিউনিখ থেকে একশো কিলোমিটারের মত দূরে গার্মিশ-পার্টেনকির্শেন। চোস্ত এক বাভারিয়ান শহরতলী। ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি বিভাগের মত জার্মানিও অনেকগুলি ভাগে ভাগ করা। বাভারিয়া বা বায়ার্ন তেমনই একটা রাজ্য, মিউনিখ যার রাজধানী। বলে রাখি, বাভারিয়ানরা মাঝে মাঝে ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’-এর আদলে ‘স্বাধীন বাভারিয়া দেশ চাই’ ধুয়া তোলে। যদিও তাদের এই ধুয়া হালে পানি পায় না কখনই।

গার্মিশ অঞ্চল স্কি রিসোর্ট হিসেবে বিখ্যাত। একবার শীকালীন অলিম্পিকও হয়েছিল এখানে। দুর্দান্ত মাঝ জুনের ইউরোপীয় ফুটি ফাটা গরমে এমন ঠান্ডা ঠান্ডা জায়গায় আসতে পেরে আরাম লাগছে। পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটছি। সঙ্গী টিপটিপ বৃষ্টি। সামান্য এগিয়ে লাল শামিয়ানা তোলা ঘোড়ার গাড়ি চোখে পড়ল। এখানকার পর্যটন আকর্ষন। হুড়মুড়িয়ে তাতে চেপে বসলাম। নইলে সাথের দুই শিশু পর্যটক ঘ্যাও ম্যাও জুড়ে দিতে পারে। টাট্টু ঘোড়া থাকতে নবাব পুত্রদের তো আর হাঁটিয়ে নিতে পারি না।

এদের ভেতর বড়ে নবাব হল চার বছরের তাফসু মিয়া। তার স্বভাবে কুংফু কুংফু ভাব আছে। বয়সে ছোট কাউকে পেলেই সে কুংফুর প্যাঁচ কষে ঘাড় মটকে দিতে যায়। আর ছোটে নবাবের নাম নূর। বয়স গুনতে গিয়ে আংগুল তিনে এসে থেমে যায়। তার নামের আগে আবার একটা সম্ভ্রান্ত ‘সৈয়দ’ আছে। তবে একটু পর পর আলাজিহ্ববা কাঁপিয়ে ‘ভ্যাক কান্না’ নামের সিগনেচার কান্নাটা যখন সে শুরু করে, তখন তার সৈয়দ বংশীয় ইজ্জতের একেবারে ভরাডুবি ঘটে যায়।

আজকে পার্টনাখক্লাম বলে জায়গাটা দেখতে যাবো সবাই। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে উত্তাল জলধারা ফেনা তুলে সুতীব্র গতিতে ছুটে চলে গেছে। ভাল বাংলায় যাকে বলে গিরিসঙ্কট। ইতস্তত করছি। স্থূল রকমের উচ্চতাভীতি আছে। গিরিসঙ্কট দেখতে গিয়ে নিজেই কোন সঙ্কটে পড়ি আল্লাহ মালুম। বৃষ্টিটাও জেঁকে বসেছে। তাই পথের পাশেই বনেদী চেহারার রেস্তোরাটায় আশ্রয় নিলাম। ঠিক হল প্রথমে ছেলেদের বাবারা ঘুরে আসবে। আর অবধারিতভাবে আমরা, মায়েরা ছানা আগলে রেস্তোরার মাছি মারবো।

এদিকে নূর আর তাফসুকে শান্ত বসিয়ে রাখা দায়। একজন তানসেন হয়ে হেড়ে গলায় গান ধরে তো আরেকজন জাকির হোসেনীয় তালে তবলা ঠোকে টেবিলে। পরিষ্কার দেখতে পেলাম, কাঠখোট্টা জার্মান বুড়োদের আড়চোখে বিরক্তির ঝিলিক। আমরাও চটজলদি ভুরু কুঁচকে কপট বিরক্তি টেনে তাদের সাথে যোগ দিলাম। ভাবখানা এমন যে, এই ত্যাঁদোড় শিশুদের আমরা চিনি না। এরা কারা? বাবা-মা এদের এটিকেট-সহবত কিছু শেখায় নি নাকি?

এই সুযোগে দু’জন তাদের ভজন থামিয়ে টেবিলের তল দিয়ে পালিয়ে গেল। মিনিট খানেক পর আরামদায়ক নীরবতা কানে বাজতেই দেখি দেয়ালের তাকে বসানো মোমবাতিগুলো উল্টে পুরো রেস্তোরা পুড়িয়ে ফেলার বন্দোবস্ত করছে তারা। রে রে করে ছুটে গিয়ে বাকি মোমবাতি সব ফুঁ মেরে নিভিয়ে দিলাম। জিজ্ঞাসু ওয়েটার এগিয়ে আসতেই অজুহাত দেখালাম, ‘মাফ করবেন, আগুন লাগিয়ে দেয়া এদের বা হাতের খেল।‘ আন্তরিক চেহারার লোকটা সহাস্যে বলল, ‘আরে, বাচ্চাকাচ্চারা একটু প্যারা দেবেই, ব্যাপার না’। তবুও লজ্জায় সংকুচিত হলাম। এদের হুপহাপ লংকান্ড দেখলে স্বয়ং হনুমানও লজ্জা পাবেন। আমরা তো কোন ছাড়!

খানিক বাদে ধোঁয়া ওঠা আলুর স্যুপ চলে এল। জার্মান খাবার এর থেকে আর জার্মানতর হতে পারে না। এই বস্তু খেলে মনে হবে, কিসের আলু ভর্তা আর কিসের আলু ভাজি! আর আলু তো আলু। সাথে মিহি কুঁচি কাঁচা মরিচ আর এক চিপ লেবু হলে মুগ মুসুরের ডালকেও কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে বাংলার ঘরে ঘরে এই স্যুপ মহামারী আকারে ছড়িয়ে যেতে পারে অবলীলায়। যাহোক, দুই স্বৈরাচারীর যথেচ্ছা চ্যাঁচামেচি আর হুটোপুটির মাঝে বহু কসরত করে বেহেশতি খানাটা নামিয়ে দিলাম। আফসোস, বাচ্চারা বেহেশতি স্বাদের মর্ম বুঝলো না। স্যুপ না যেন জোর করে যুদ্ধবন্দীদের জন্যে রাঁধা ঘ্যাট খাওয়াচ্ছি তাদের। জবরদস্তির ফল হিসেবে উগড়ে দিতে দিতে কোন রকমে ঢোক গিলে কাজ সারলো।

ছেলেদের বাবারা ফিরে আসল আধভেজা হয়ে। এবার আমরা যাব। নূরের ঘুম পাচ্ছে। সে বেঁচে গেল। তাকে হিংসে হচ্ছে। খুব চেষ্টা করলাম নিজের যাওয়াটাও এড়ানোর। নূরের মা মৌরি আপুর চাপাচাপিতে রাজি হতে হল। বেজার মুখে তাফসুকে হাতে ঝুলিয়ে রওনা দিলাম। অথবা, সেই আমাকেই হাতে ঝুলিয়ে রওনা দিল। কারন, একটু পরের দৃশ্যে দেখা গেল সে হাত ধরে আছে আর আমি অন্ধকার পাহাড়ি সুরঙ্গের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছি। অন্ধের যষ্ঠি! বাংলা ভাষা আসলে সব ভাষার বাপ।

জান হাতে নিয়ে ফিরে এলে জানতে চাওয়া হল, কেমন দেখলাম পার্টনাখক্লাম গিরিসংকট। মৌরি আপুর ঝটপট উত্তর, ‘উফ্, দারুন, তুরন্ত’। ওদিকে, আমি তখনো ঘুরন্ত মাথাটাকে বাগে আনতে পারছি না। উঁচুতে ওঠা অবধি পাঁচে দেয়া সিলিং পাখার মত বন্ বন্ ঘুরছে তো ঘুরছেই। একমাত্র লম্বা একটা ঘুমই এই বন্ বন্ থামাতে পারে।

কিন্তু ঘুম কি আর কপালে লেখা আছে? হোটেলে ফিরে এসেছি। ছানাগুলো চরম হই হুল্লোড় জুড়ে দিয়েছে। সামাল দিতে গিয়ে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে তাদের মায়েদের। ছানাদের বাবাদের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কিনে আনা খাবার খেয়ে দেয়ে ভোজবাজির মত শূন্যে মিলিয়ে গেছে। দুঃখে পড়ে মনে মনে বললাম, ‘হে খোদা, তোমার সিস্টেমে পরজন্ম বলে কিছু থাকলে একবার ছেলের বাবা হয়ে জন্মাতে চাইতাম। গা ভাসিয়ে কি চমৎকার দুলকি চালে জীবন কেটে যাচ্ছে এদের’।

নূর আর তাফসুকে ধরে বিছানায় পুড়তে চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা নাচাতে নাচাতে চরম উদাস চোখে তাদের মারামারিটা দেখছি। একটু আগে যেটা নিরীহ ক্যাট ফাইট হিসেবে শুরু হয়েছিল, সেটা এখন হিংস্র বুল ফাইট পর্যায়ে চলে গেছে। এক জন বুনো ষাড় সেজে মেঝেতে খুর ঘষে শিং বাগিয়ে ঢুঁ মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরেকজন ষাঁড় খেপাতে নাকের ডগায় ফ্লামিঙ্গো নাচ জুড়ে দিয়েছে। ফ্লামিঙ্গো বাবাজী ঢুঁয়ের আঘাতে ফর্দাফাই হবার অন্তিম মুহূর্তে পা বাড়িয়ে আলতো ল্যাং মেরে ষাঁড়টাকে উল্টে দিলাম। উল্টে গিয়ে ষাড়ত্ব হারিয়ে গগনবিদারী মাতমে এই আশি বর্গমিটারের ডুপ্লেক্সটা মাথায় তুলে ফেলল তাফসু মিয়া।

হাসির মত কান্নাও সংক্রামক। তবে হাউ মাউয়ের সাথে চ্যাও ভ্যাও যোগ করে কান্নাকাটির মত সাধারন ব্যাপারকে রীতিমত ক্লাসিক উচ্চাংগ সঙ্গীতের মর্যাদায় পৌঁছে দিল পেশাদার অপেরা শিল্পী সৈয়দ নূর। আলাজিহ্ববা কাঁপানো কান্নার ভেতরে আবার কঠিন অভিযোগও ভেসে এল, ‘তাফসু ভাইয়াকে ধাক্কা দিলে কেন, ও তো আমাকে জাস্ট একটু টোকা দিত। আমরা খেলছি, বোঝো না কেন, রিম?’ ছোট শিশুরা কেন যেন আমাকে আন্টি বা খালামনি না ডেকে সরাসরি নাম ধরে ডাকে। এই রহস্যের উত্তর মেলে না। হয়ত তারা ধরে নেয়, বুদ্ধিগত দিক থেকে আমি তাদের কাছাকাছি লোক। বড়দের সাথে তবু ভড়ং করে চালিয়ে দেই কোনোমতে, কিন্তু এদের কাছে ঠিক ধরা খেয়ে যাই। যাহোক, নূরের কথায় নিজের ছেলেকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার অপরাধে মনটা সামান্য খচখচিয়ে উঠলো। আত্মপক্ষ নিয়ে বললাম, ‘তাফসু তো বালিশের ওপর পড়েছে, ব্যথা পায় নি একটুও।

তর্কাতর্কির মাঝে নূরের মা এসে তাকে আলগোছে নির্বিকার তুলে নিয়ে গেল। পোলাপানের কুম্ভীরাশ্রু মায়েরা চেনে। দেখাদেখি সাহস পেয়ে মিনিট দুয়েকের চেষ্টায় আমিও আরেকজনকে বগলদাবা করে আটকে ফেললাম। সারাদিন প্রচুর ঘোরাঘুরি হয়েছে। এখন ছানাপোনা ঘুম পাড়িয়ে নিজেরা গা এলিয়ে দিতে পারলে বাঁচি, এমন অবস্থা।



২.
বিরিয়ানির স্বাদ খোলে বাসি হলে। গতকালের রয়ে যাওয়া সয়াসস থৈ থৈ ভিয়েতনামিজ কারিও দেখি তার স্বাদের ঝাঁপি মেলে ধরেছে। হালকা গরম করে বুভুক্ষের মত খাচ্ছি। ভোর ছয়টা। সবাই এখনো ঘুমের অতলে। নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। খেতে খেতে খেয়াল করলাম, নাক ডাকার একটা শ্রেনীবিভাগ আছে। বড়রা ডাকছে ফরফর্ ফরফর্। ছোটরা ফুরুৎ ফুরুৎ। হঠাৎ ছন্দপতন হল ম্যা ম্যা ভেড়ার ডাকে। এই ভেড়াকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। ছেলে উঠে গেছে। কারো স্বপ্নভংগ না করে তাকে আনতে রওনা দিলাম।

ছোট্ট ডুপ্লেক্সের খাটগুলোও দোতলা। একটা বোর্ডিং স্কুল বোর্ডিং স্কুল ভাব আছে। কেজি পনেরোর আধো ঘুমন্ত দুই ফুটি ভদ্রলোককে নামাতে ঘাম ছুটে গেল। এর মাঝে অস্ফুট বিড়বিড়, ‘মামা, খিদা’। গজগজ করে উঠলাম, ‘আ মর জ্বালা, মায়েরে কয় মামু!’ পাঁচ মিনিটের মাথায় নাস্তার যোগাড় দিয়ে থালা বাড়িয়ে দিতেই বিজাতীয় ভাষায় অভিযোগ শুরু হল, ‘পিসি কায়ান, পিসি কায়ান। তাফসু মিয়ার ব্যক্তিগত একটা ভাষা আছে। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও এখন বেশ পারি। ‘পিসি কায়ান, পিসি কায়ান’ মানে হল, ‘পাউরুটি খাবো না, পাউরুটি খাবো না’। উত্তরে ঠান্ডা গলায় হুমকি ছুড়লাম , ‘বাসি কায়া, মাসি কায়া’ (বাপের মাথা খাও, মায়ের মাথাটাও’)। ছেলে ভয় পেয়ে শক্ত মায়ের ভক্ত বনে সায় দিল, ‘কায়া কায়া’ (খাচ্ছি, খাচ্ছি)।

ছানাপোনা খাইয়ে দাইয়ে সকাল সকাল আজকে বেরিয়ে পড়বো সবাই। যাবো Zugspitze-তে। জার্মানির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এটা। শব্দটাকে ‘সুগষ্পিৎজ্যে’ উচ্চারন করলে তেড়ে আসা যাবে না। ছাপোষা মুখ্য-সুখ্য লোক। মুজতবা আলি তো আর নই। তাই ভাঙ্গা কলমের কোপে গোটা সাতেক জার্মান শব্দকে খুন করলেও মাফ করে দিতে হবে। যাহোক, আজকে জার্মানমুলুকের নাকের ডগাটায় না চড়লে আর চলছেই না। কিন্তু বেয়ারা বাচ্চা কাচ্চার যন্ত্রনায় নাকের ডগা আমাদেরকে সর্দির ফ্যোঁৎ করে ঝেড়ে না ফেললেই হল।

যাচ্ছি মজারু একটা রেলগাড়িতে চেপে। এই রেলের চাকার দাঁত আছে। কগহুইল ট্রেন। পাহাড় কামড়ে কামড়ে ওপরে উঠছে। যাত্রাটা তাই আনুভূমিক না হয়ে কিছুটা উলম্ব হবে। মাটি ফুঁড়ে আকাশ বরাবর। এদিকে বাদাম খাওয়াকে কেন্দ্র করে তাফসু আর নূর ছোটখাট মারমারির প্রস্তুতি নিচ্ছে। নইলে কেমন একঘেয়ে হয়ে যায় না বেকার বসে থাকাটা? তাদেরকে ইচ্ছেমত মত দাঙ্গা করতে দিয়ে তাদের ঠোঙ্গা থেকেই নিরবে বাদাম সরিয়ে গালে পুড়ছি আমরা বড়রা।

কিন্তু বাদামের সাথে আইস্ক্রিমও খেতে ইচ্ছে করছে। সামনের আসনের বুড়োটার হাতের বাক্সে চার চারটে আইস্ক্রিম। কলার খোসা ছাড়ানোর মত করে একটার পর একটা খেয়ে উজাড় করে দিচ্ছে সে। সবাই মিলে হাইপোথিসিস দাঁড় করালাম, বুড়োর বউ মরেছে। সেই খুশিতে এই বেহিসাবী মিষ্টিমুখ। সাথে খুব খেয়াল করলাম, ছেলের বাবাদের চোখে সকাতর প্রতীক্ষা। কবে যে তাদেরও এমন সুদিন আসবে! তবে আশার কথা, শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। গরুদের আবার কই মাছের প্রান।

দাঁতাল রেলগাড়ি ছেড়ে দড়ি টানা কেবল কারে দুলছি। সাগরপিঠ থেকে প্রায় সাড়ে উনত্রিশশো মিটার উঁচুতে উঠে যাচ্ছি। এই গরমেও সেখানে তুষারের ছড়াছড়ি। তাই হালকা সোয়েটার, জ্যাকেট সাথে আছে। সাদা হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘের দেশে চলে এসেছি। কাঠির মাথায় মেঘ জড়িয়ে টুপ্ করে খেয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে স্বাদটা কেমন। সৌন্দর্য দেখলে লোকে তারিফ করে বা আবেগে পড়ে টান দিয়ে কবিতা টবিতাও লিখে ফেলে। আর হাড় হাভাতে কিছু লোক আছে যারা সৌন্দর্য খেতে চায়। আবেগী কবিতা ভুল করে উড়ে এসে হাতে পড়লেও এরা সেটাকে চার ভাঁজ করে চিবিয়ে গিলে বসে থাকবে। নিজেকে নিয়ে আর পারা গেল না। হতাশ মাথা নেড়ে পাশে তাকাতেই দেখি আমার দল কিছুটা ভারী হয়েছে। নূর আর তাফসু মিয়া এক গাল লালা নিয়ে লোলুপ চোখে মেঘের মাঝে আইসক্রিম খুঁজছে। ট্রেনের দুষ্টু বুড়োটা আমাদের চোখে ঘোর লাগিয়ে দিয়েছে আজকে।

আকাশ থেকে পাতালে নেমে এলাম। একটা চমৎকার নীল হ্রদ আছে। নাম Eibsee বা আইবসি। নদ-নদী, হ্রদকে এরা আদর করে সাগর ডাকে। হ্রদের জলে কেউ প্যাডেল মেরে নৌকা চালাচ্ছে। কেউ ওয়াটার বাসের যাত্রী হয়ে পুরো এলাকাটা চক্কর দিতে ব্যস্ত। আমরাও টিকেট কেটে তাতে চড়বো বলে পাড়ে দাড়িয়ে আছি। এদিকে আকাশ ঘোলা হয়ে আসছে। পাহাড়ে আবহাওয়া বদলায় খুব দ্রুত। তার চেয়েও দ্রুত মত বদলে ছোট্ট জাহাজটার ক্যাপ্টেন জানিয়ে দিয়ে গেলো, ‘ঝড় আসছে। আজকের মত পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলতে হচ্ছে’। কি আর করা, এদিক সেদিক এলোমেলো ঘুরে দাঁতাল রেলে চেপে রাস্তা মাপলাম।

কখনো পাহাড়ভেদী সুরঙ্গ, কখনো বনের গহীন। ট্রেন ছুটে যাচ্ছে মাঝারি ঝাঁকুনি তুলে। এক আধটা হরিনও দেখলাম নাকি? লোকালয়ের কাছে আসতেই জীবন্ত হয়ে উঠল ছবির মত লাল টালির সারি সারি বাড়ি। ফুলের থোকায় উপচে পড়ছে বারান্দা আর আঙ্গিনা। ঠিক যেন বাভারিয়ান রূপকথায় সেজেছে গ্রামগুলো। বিশাল ঘন্টা গলায় ঝুলিয়ে পাহাড়ি গরু বিশাল তেপান্তরের মাঠে অলস জাবর কাটছে। ভেড়ার পাল উলের বল সেজে গ্যাঁট হয়ে বসেছে এখানে সেখানে। কাছেই ঘুরছে জাঁদরেল জার্মান শেফার্ড। মালিকের হয়ে সতর্ক চোখে রাখছে দলটার উপর। কি নিস্তরঙ্গ জীবনের ছবি। এই প্রথম বুঝতে পারলাম, শহুরে হট্টগোল ফেলে কত দূরে চলে এসেছি।


৩.
হুড়মুড়িয়ে দুইয়ের ঘাড়ে পাড়া দিয়ে তিন নম্বর দিনটা চলে এল। শহুরে যান্ত্রিকতা আমাদের গেলার অপেক্ষায় হাঁ করে পথ চেয়ে বসে আছে। আজকে দুপুরেই ফেরত যাব। ঘোরাঘুরির জন্যে হাতে সময় কম। অল্প সময়কে টেনে চুইংগামের মত লম্বার করার ধান্দায় গতি কমিয়ে শামুক হয়ে গিয়েছি। এই মুহূর্তে জুতার তলি ঘষটে বিরক্তিকর শব্দ তুলে গা ছাড়াভাবে হাঁটছি। কাছেপিঠে বেঞ্চি দেখলে মোক্ষম একটা গড়ানিও দিয়ে ফেলতে পারি।

পার্কটা বিশাল। গার্মিশের একেবারে পেটের ভেতর। সবুজে ঘেরা সমান্তরাল এক ভিন্ন জগত। ভিড়ভাট্টার খুব কাছে থেকেও বহু দূরে। কে বলবে বেড়ার ওপাশেই চক্কর বক্কর হাওয়াই শার্ট চাপানো পর্যটকের দল হই হই করে বেড়াচ্ছে। দূরে বসার একটা জায়গা দেখলাম। কিন্তু বাঁধ সেধেছে তাফসু মিয়া। অভিভূতের মত লাল সাদা গোল্ডফিশের মিছিল দেখছে গোল পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে। পুকুরটা গোলও না, পুকুরও না। আয়তাকার চৌবাচ্চা। কিন্তু গোল পুকুর বলতে ভাল লাগে কেন যেন।

ছেলেকে তার বাবার জিম্মায় রেখে বসার জায়গা বরাবর এগোলাম। ছোট্ট পুরানো এ্যাম্ফিথিয়েটার। আহামরি কিছু না। এই পোড়ো এ্যাম্ফিথিয়েটারে বাস করে মমো নামের অদ্ভূত ছোট্ট মেয়ে। শতেক তালির মলিন জামা পড়ে সে এলোমেলো ঘুরে বেড়ায় । কেউ জানে না কোথায় তার বাবা-মা। তার সঙ্গী শুধু কাসিওপিয়া নামের এক কাছিম। কুরপার্ক নামের এই পার্কটা আসলে জার্মান লেখক মিখাইল-এন্ডে’র বিখ্যাত শিশুতোষ বই ‘মমো’র আদলে সাজানো।

এ্যাম্ফিথিয়েটারের সিড়িতে পরিকল্পনামাফিক গড়ানিটা দিয়ে দুই পা হাঁটতেই দেখি কাসিওপিয়া নিঃশব্দে ঘাপটি মেরে আছে। কিন্তু শান্ত কচ্ছপটার শান্তি বরবাদ করে দিল আমাদের ছানাপোনা। একজন কংক্রিট নাক ধরে যথেচ্ছা দোল খেল। আরেকজন তার পিঠে সওয়ার হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালালো।

মমো’র গল্পটা অল্প করে বলেই ফেলি। হঠাৎ শহরে ভিন জগতের একদল ধূসর মানব এসে বলে, ‘এ্যাই বেয়াক্কেল মানুষ, তোমরা দেখি গড়িয়ে, ঘুমিয়ে আর আড্ডা দিয়ে প্রচুর সময় নষ্ট কর। তার চেয়ে আমাদের এই নতুন ব্যাংকে সময় জমা দিয়ে যাও না। সুদে-আসলে ফেরত পাবে।‘ সুদের লোভে লোকে আসল সময়টুকু জমা দিয়ে আসল। এখন অলস সময় নেই কারো হাতে। কিন্তু জীবন হয়ে গেল গল্প-আড্ডা-ঘুমহীন একঘেয়ে, ম্যারম্যারে। তখন ছোট্ট মমো ধূসর মানবের সাথে লড়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সময়-ব্যাঙ্কের কুঠুরি ভেঙ্গে ফেলে। সবাই যার যার চুরি যাওয়া সময় বুঝে পেল। শুকিয়ে যাওয়া হলদেটে জীবন আবার গল্প-আড্ডায়-গানে সবুজ হয়ে উঠল।

মমোর গল্পটা নূরের বই পোকা বাবা আমাদের হাদি ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা। তাফসুর বাবাকে বলতে গেলাম, ‘এ জন্যেই তো আমি গড়িয়ে চলি, অলস ঘুমিয়ে থাকি, অনর্থক আড্ডা দেই। সময় নষ্ট করাটাও জরুরী, বুঝলেন?’ বেখাপ্পা উত্তর আসল, ‘ফিরে গিয়ে বাজারের লিস্টে ডিম লিখতে হবে কিন্তু। ঘরে মাত্র দুইটা ডিম।‘ বেড়াতে এসেও নিউরনে বাজারের লিস্টি! হতাশ কাঁধ ঝুলিয়ে ক্যাসিওপিয়ার পিঠ থেকে ছেলেকে নামাতে গেলাম। এই ছেলে মায়ের মত হয়েছে। আগোছালো আর হাবাগোবা। তবে বলা যায় না, কোন অতি সংসারী বাঙালি কালোকেশী কি জার্মান স্বর্ণকেশীর পাল্লায় পড়ে তাকেও অদূর ভবিষত্যে বাজারের লিস্টে আধ ডজন ডিম যোগ করতে হতে পারে। সবই তকদির!

সবুজ ফেলে শহরের ভিড়ে ঢুঁকে পড়েছি আবার। অল্প বয়সীরা হয় তুমুল কেনাকাটায় ব্যস্ত, নয় ছবি তুলতে মগ্ন। বুড়োরা কৌতূহলী চোখে তা-ই দেখছে ছড়ানো ছিটানো রেস্তোরাগুলোতে আসন গেঁড়ে বসে। তাদের টেবিলে স্বাস্থ্যকর সালাদের বাটি আর অস্বাস্থ্যকর বিয়ারের বোতল। আঙ্গুলের ফাঁকে ধূমায়িত দামী সিগারেট। আরো সৌখিন হলে হাভানা চুরুট। বিয়ার-বিড়ির প্রতি ভালবাসা না থাকলেও সময় নষ্ট করার এই জাঁকালো আয়োজন দেখতে বেশ লাগছে।

এরকম চমৎকার জায়গায় হারিয়ে গেলে মন্দ হত না। তবে হারানোর পাঁয়তারা না করাই ভাল। তখন দেখা যাবে পারিবারিক চাকরিটা থেকে ছেলের বাবা আমাকে ছাটাই করে দিয়েছে। একটু আগে তার মাথার ভেতর ঢুকেছিলাম। দেখি সেখানে চাপা গজগজ চলছে। কেই একজন নাকি তার কলিজা চিবিয়ে খাচ্ছে। গত সপ্তাহে দামী হেডফোন হারিয়েছে, এ সপ্তহে ভালো ছাতাটা। এখানে এসে প্রথম দিনেই দশ ইউরোর টিকেটও। চিজ বটে!‘ এইখানে গরম কান নিয়ে আস্তে করে তার মাথা থেকে বেরিয়ে এলাম। অভিযোগ সব ক’টাই সত্য। তবে ছেলে হারিয়ে ফেলি নি যে এ পর্যন্ত, এটাই বড় কথা।



৪.
আজকের আবহাওয়া একেবারে নিখুঁত। নীল আকাশের পুরোটা জুড়ে সোনা কুঁচি রোদ্দুর। সাদা মেঘ পাহাড়ের কোলে কুন্ডুলী পাকিয়ে অলস ঘুমে ব্যস্ত। বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার কোন তাড়া নেই তাদের ক্যালেন্ডারে। পাহাড়ের আচঁলে বিছানো অপরূপ গার্মিশ শহরতলীর কোবাল্ট পাথরের পথ ধরে ভিড়ের সাথে মিশে গিয়ে আমাদের ছোট্ট দলটা হাঁটছে। এখানে সেখানে কবুতরের উৎসুক আনাগোনা। ছানাপোনাররা কবুতর ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে স্বভাবসুলভ উঁচু লয়ের ভ্যাক কান্না কিংবা নিচু লয়ের ফ্যাঁচ কান্না মারফত হতাশা জানান দিতে ভুলছে না। এই দুই দিনে এদের ঘ্যাও ম্যাও সয়ে এসেছে। আজকে তাই হাউ কাউ কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না।

গার্মিশ নাকি জার্মানির গয়া-কাশী। এটা অবশ্য মৌরি আপুর কথা। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে লোকে নাকি খুব আসে এখানে। কথাটা দেখলাম মিথ্যে না। প্রচুর ষাটোর্ধ পক্ককেশ বুড়োবুড়ি মনে বেজায় আনন্দ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পথের ধারের বেঞ্চিগুলো সব তাদের দখলে। হাতে কফির কাগজের কাপ, আইস্ক্রিম কিংবা এক টুকরো কেক। এই খেয়ে তো স্বাস্থ্যের উন্নতি হবার কথা না। কিন্তু খাক না একটু। জীবন কয় দিনের। কাকভূষন্ডী হয়ে কেয়ামত অবধি বেঁচে থাকার চেয়ে দুনিয়াটার রঙ-রূপ-রস দেখে আর পেট পুরে কেকটা, কফিটা খেয়ে শান্তিতে পটল তোলা হাজার গুনে ভালো। নিজেও তাই করবো ঠিক করেছি।

সূর্যটা মাথার উপর ঝুলছে। ঠিক দুপুর। কিছু পেটে পড়লে মন্দ হত না। সব কিছু ছাপিয়ে খালি মনে হচ্ছে আহা, একটু ভাত খাওয়া যেত। জানা গেল, মৌরি আপুর কাছে নাকি ভাল জাতের ভারতীয় রেস্তোরার খোঁজ আছে। অতএব, তার পিছু পিছু চললাম সবাই। শহুরে হট্টগোল পেছনে ফেলে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছি। এলোপাথাড়ি অনেক হেঁটে পৌঁছালাম সেখানে। রেস্তোরা ঠিক রেস্তোরার মত না। লোকজনের কোলাহল নেই। তার বদলে পাহাড়ি ঝরনার একটা সরু ধারা স্রোত হয়ে বয়ে যাচ্ছে কলকল রবে। নূর আর তাফসু মিয়াও কল্ধ্বনি তুলে সেদিকে ছুটল। তারা যে হারে নুড়ি পাথর ছুড়ছে, তাতে আর এক ঘন্টার ভেতরেই জলের বুকে চর জেগে উঠবে। কোন সন্দেহ নেই।

অবাক করে দিয়ে স্নিগ্ধ চেহারার বছর পঞ্চাশকের এক জার্মান ভদ্রমহিলা এলেন খাবারের মেন্যু নিয়ে। তার আপ্যায়নের ব্যস্ততা আর চেহারার অদ্ভূত স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ আমরা ধরেই নিলাম ভদ্রমহিলার ভদ্রলোকটা নির্ঘাৎ ভারতীয়। এই রেস্তোরা পারিবারিক ব্যবসা। জামাই-বউ মিলে চালান। এইখানে হাদি ভাই তার কল্পনার দোয়াত উল্টে অদৃশ্য কালিতে এক কাহিনী ফেঁদে বসলেন। নান-পরোটা আর ভাতের অর্ডার দিয়ে আমরা গালে হাত দিয়ে তার কেচ্ছা শুনতে লাগলাম।

তরুন বয়সে বিরাট কোন এক হতাশা কাটাতে এই মহিলা পাড়ি জমান ভারতে। উদ্দেশ্য, হতাশা থেকে মুক্তি। সেখানে কোলকাতা গঙ্গার পাড়ে এক বাবার তার হঠাৎ দেখা। দুঃখের কাহিনি শুনে বাবা তাকে ডেরায় নিয়ে প্রচুর দীক্ষা টিক্ষা দিয়ে বলেন, ‘যাহ্ মা, এবার দেশে ফিরে গিয়ে বাবার নামে একটা ভাতের হোটেল দে। ভাতের হোটেলেই তোর মোক্ষ। তবে যাবার আগে ভারতবর্ষটা ঘুরে দেখে যাবি কিন্তু।‘ তারপর জার্মান তরুনী বাবার কথা মত কলাকাতা থেকে কৈলাস, বৃন্দাবন থেকে বেনারস সমস্তটা চষে বেড়াল। ঘুরতে ঘুরতে পাঞ্জাবি এক ভাল মানুষের সাথে তার দেখা। তার সাত পাঁকে গেঁড়ো বেঁধে দুইজনে জার্মানি এসে ভাতের হোটেল খুলে বসল। অরবিন্দর, গোবিন্দর চেহারার বিশাল মোঁচওয়ালা লোকগুলো সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটু পর পর, এরা আসলে এদেরই ছেলে। ‘বোঝো নাই ব্যাপারটা?’, হাদি ভাই আয়নাবাজি কায়দায় দুর্দান্ত গল্পটার ইতি টানলো।

থালা উপচানো বাটার নান চলে আসলে গল্পটা মিলিয়ে নেয়ার কৌতূহলে ভদ্রমহিলাকে একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, ‘তা, ইন্ডিয়া কেমন লেগেছে আপনার?’ উত্তর আসল, ‘অ্যাঁ? ইন্ডিয়া তো যাই নি কোন দিন। ইটালি আর ইস্ট ইউরোপ বাদে আর কোথাও যাই না তেমন। ইন্ডিয়া তো বহুৎ দূর। আর কি গরম রে বাবা। একা মানুষ আমি অদ্দূর যাবো কি করতে?‘ এবার বোঝা গেল ব্যাপারটা। হাদি ভাই দারুন এক গুল মেরে প্রায় পাড় পেয়ে যাচ্ছিলেন।

মেঘে মেঘে বেলা ঘনিয়ে আসলো। ট্রেন ধরতে ছুটলাম। তার আগে হোটেল থেকে স্যুটকেস তুলে নিতে ভুললাম না। কেয়ার টেকার ধরনের লোকটা উল্কি আঁকা হাত নেড়ে হাসিমুখে বিদায় দিল। ইন্টারনেটে হোটেলের রিভিউতে এই লোকের নামে অনেক গালমন্দ করা আছে। কিন্তু কই, তাকে তো মন্দ লোক মনে হয় নি এক কয় দিনে। আমরা ইচ্ছেমত জ্বালিয়েছি আর সে সাধ্যমত সাহায্য করেছে। তবে রান্নাঘরের চুলা জ্বলছিল না দেখে তাকে ডেকে আনা হয়েছিল। তখন চুলা আর ডেকচি-পাতিলের চৌদ্দগুষ্ঠিকে সে যে গালিটা দিয়েছিল সেটা লেখার বাইরে।

ট্রেন ছুটে চলছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাচ্চারা গলা সপ্তমে চড়িয়ে দিয়েছে। এই ফরয কাজটা না করলে চলেই না তাদের। জানালার বাইরে তাকালাম। পাহাড়ের সবুজ ঘোলাটে হয়ে আসছে। গার্মিশের সাথে আমাদের দূরত্ব বাড়ছে। কিন্তু ঘ্যাও ম্যাও আঠার মত গায়ে লেগে রয়েছে। রাগ করতে গিয়ে ফিক্ করে হেসে ফেললাম সবাই। কারন, এই ঘ্যাও ম্যাওয়ের দল হই-হুল্লোড় দিয়ে জীবনটা যেভাবে মাতিয়ে রাখে, সেখানে হাজার গার্মিশও তুচ্ছ।
২৮.০৭.২০১৯
মিউনিখ, জার্মানি
বি.দ্র. প্রথম ছবিটি গুগল থেকে সংগৃহীত

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৫

মা.হাসান বলেছেন: কোথায় যেন গতকাল পড়েছি মনে হলো? B:-)
হাদি ভাই ভালোই গুল মারতে পারেন তো।
গতকালই ভালো লেগেছিল, অখন্ড পেয়ে আরো ভালো লাগলো।

৩০ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ১২:৪৮

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: ধন্যবাদ হাসান ভাই। আমাদের হাদি ভাই এক জিনিস বটে। এমন চরিত্র আশেপাশে থাকে গল্প তৈরি হতে সময় লাগে না। আপনি ভাল থাকবেন।

২| ৩০ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ১২:২৫

ক্লে ডল বলেছেন: আপনার গার্মিশ ভ্রমণ আর ঘ্যাও ম্যাও এর কাজকর্মের কাহিনী, দারুণ উপভোগ করলাম!! :)

৩০ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ১২:৪৯

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: ঘ্যাও ম্যাও কাহিনী ভাল লেগেছে জেনে ভীষন খুশি হলাম। আনন্দ ভাগ করে নিলে খুব বাড়ে দেখছি।

৩| ৩০ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ২:০০

আনমোনা বলেছেন: ঘ্যাও ম্যাও দের হই-চইের চাইতে মধুর শব্দ আর নেই।

৩১ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ২:৪৬

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: বলুন, "অম্ল-মধুর"। হাহাহা...।

৪| ০১ লা আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৫:৫৬

অন্তরা রহমান বলেছেন: অসহ্য সুন্দর লাগলো ছবিগুলা। আর দুই ছোটে নবাবের কান্ডতে মজা পেলাম। :D

০৩ রা আগস্ট, ২০১৯ রাত ৩:৫২

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: প্রিয় অন্তরা আপু, অনেক ধন্যবাদ এমন অসহ্য সুন্দর মন্তব্যের জন্যে। আর আপনি দেখতে দারুন সুন্দরী, এই ফাঁকে কথাটা বলে পালিয়ে গেলাম।

৫| ০২ রা আগস্ট, ২০১৯ দুপুর ১২:০৭

জাহিদ অনিক বলেছেন:
প্রথম পর্ব পড়েছিলাম ফেসবুক গ্রুপে
দ্বিতীয় পর্ব পড়েছি প্রথম আলো অনলাইন কপিতে-
৩য় ও শেষ অর্থাৎ গার্মিশে ঘ্যাও ম্যাও (অখন্ড)

এখানে পড়লাম!

চমৎকার, আপনার বর্ণনায় ডিটেইলস ও হাস্যরসের উপস্থিতি পাঠককে ধরে রাখে। ছবিগুলোরও দারুন টিপ!

শুভেচ্ছা নিন

০৩ রা আগস্ট, ২০১৯ ভোর ৪:০১

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: একটা এলেবেলে লেখাও সার্থকতা পায় যখন এমন উৎসুক, মননশীল পাঠক সেটা খুঁজে খুঁজে ঠিক পড়ে ফেলে।
আপনার কবিতা পড়ছি টুকটাক। এই ক্ষমতাটা ধরে রাখবেন।

৬| ০৩ রা আগস্ট, ২০১৯ দুপুর ১:৫৫

অন্তরা রহমান বলেছেন: ইয়াল্লাআআআ আপু, কি যে বলেন না। :-/ এসব হলো হাজার পাঁচেকের বিউটি পার্লারের ঘষামাজা আর হাজার বিশেকের ফটোগ্রাফারের ফলাফল। আমি আসলে একদম সাদামাটা একজন মানুষ। :)

৭| ১৬ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১১:০৫

নাসির ইয়ামান বলেছেন: বেশ ভালো!

১৮ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১:৪১

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাল লাগা জানিয়ে যাবার জন্যে।

৮| ১৬ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১১:০৫

নাসির ইয়ামান বলেছেন: বেশ ভালো!

৯| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ৩:০৭

সোনালী ডানার চিল বলেছেন: আপনার লেখা পড়তে পড়তে আর এক সৈয়দের কথা মনে হলো;
সৈয়দ মুজতবা আলী। কাকতলীয় নয়, হাস্যরস- বৈঠকি বর্ণনার সাথে
একবসায় লেখাটি পড়ে ফেললাম!!
শুভকামনা রইল....

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ২:৩০

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: বাহ্, পড়ে ফেললেন একবসায়! ধন্যবাদ , ধন্যবাদ !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.