নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/
গির্জার ভেতরে শীত শীত করছে। অথচ রোদে ভেসে যাচ্ছে বাইরেটা। না চাইতেও ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ চলে যাচ্ছে দরজার দিকে। পাদ্রির খুক খুক গলা পরিষ্কারের ধরন দেখে মনে হচ্ছে সামনে ভীষন লম্বা বাইবেল পাঠ আছে। কিসের ভেতর এসে যে ফেঁসে গেলাম! না এসেই বা উপায় কি। সাত কূলে ইনগ্রিডের কেউ নেই। তাই ল্যাব ঝেঁটিয়ে সবাই চলে এসেছি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের বেঢপ মাইক্রোবাসে চেপে।
ইনগ্রিড আমাদের হেল্মহোল্টজ সেন্টারে কাজ করত। গবেষক। ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিল। কেমোথেরাপির কোপে পড়ে মাঝে মাঝেই আসত না অনেকটা সময়। ব্যাপারটা নিয়মের মত হয়ে গিয়েছিল। আলাদা করে আর তার থাকা বা থাকা চোখে পড়তো না। তবে দেয়ালে টাঙ্গানো ইনগ্রিডের আঁকা ছবিগুলো মনে করিয়ে দিত তার কথা। রক্তের লোহিত কনিকা কিংবা নিউরনের ছবি এমন মুন্সিয়ানা আঁকা যে বিমূর্ত কলাচিত্র বলে ভুল হবে হঠাৎ তাকালে। মনে মনে ইনগ্রিডের শিল্পীমনের তারিফ না করে পারতাম না।
তারপর একদিন ইনগ্রিড নিজেই ছবি হয়ে গেল টপ্ করে মরে গিয়ে। তাতে অবশ্য হাউকাউ পড়ে গেল না কারো মাঝে। আমরা শুকনো মুখে করিডোরে দাঁড়িয়ে পাড় জার্মান কায়দায় পাঁচ মিনিট আহা উহু করে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। জীবনের উৎসবে লোকের যত আগ্রহ, মৃত্যুতে ততটাই অনীহা।
কিন্তু মুশকিল বেঁধে গেল যখন জানলাম, ইনগ্রিডের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় লোক মিলছে না। আত্মীয় বলতে এক বোন আছে তার, বার্লিন নাকি বন-এ থাকে। বয়সের ভারে তার মিউনিখ অবধি আসার জো নেই। স্বামীও নেই, উনি গেছেন আরো আগেই। আবার ছেলেপুলেও নেই যে সৎকারের ভার নেবে। তাই ঘুরে ফিরে শেষ দায়িত্বটুকু কাজ বর্তালো এই আমাদের ওপরে।
ল্যাবে জরুরী এক্সপেরিমেন্ট ছিল। সব লাটে উঠিয়ে রেখে এসেছি। বাকিদেরও একই অবস্থা। উশখুশ করছি আমরা। খুব এক প্রস্থ হাঁচি কাশি চুকিয়ে পাদ্রি তার বাৎচিত শুরু করেছে। অত্যন্ত উঁচু দরের জার্মান আমার এলেমের বাইরে বলে বোঝার চেষ্টা করছি না। পাশে দাঁড়ানো ক্যাথরিন গলার শালটা চেয়ে নিয়ে মাথায় দিয়েছে ঘোমটার মত করে। ক্যাথরিন আর আমি একই ল্যাবে পিএইচডি করি তখন।
পেছন থেকে আরেক ল্যাবের শেন জ্যো নামের চাইনিজ ছেলেটা জানতে চাইছে, তারও কি মাথায় কাপড় টাপড় কিছু দিতে হবে নাকি। ঠান্ডা গলায় শুনিয়ে দিয়েছি, ‘না, শুধু মাথার ভেতরের ঘিলুটুকু সামলে রাখলেই চলবে আপাতত’। শেন জ্যো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবারো জানতে চাইলো, একটা ফোন করা যাবে নাকি। সে চীনে তার বাবাকে ফোন লাগাবে। চীনের চেং দু অঞ্চলের এক অজ পাড়াগাঁয়ের মোড়ল তার বাপ। চোলাই মদ খাবার বদ অভ্যাস আছে। শেন জ্যোর ভয় হয়, চোলাই মদের মাত্রা ছাড়ানো মিথানল গিলে তার বাবা একদিন পটল তুলে ফেলবে। ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলে সে ঝুপ করে গির্জার বেঞ্চে বসে পড়ে সত্যি সত্যি চীনে ফোনে লাগিয়ে চ্যাং চোং করে কি সব বলা শুরু করল। মৃত্যুর ক্ষমতাই আলাদা। সুযোগ পেলেই মনের শংকার ডঙ্কা ঢং ঢং পিটিয়ে ছাড়ে।
এদিকে গির্জায় দাঁড়িয়ে সামান্য অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তিটা হাত নিয়ে। না চাইতেও হাতদুটো মোনাজাত ধরে ফেলতে চাইছে। বাকিরা দু’পাশে হাত রেখে এ্যাটেনশন। শেষ মেষ সংকোচটা ঝেড়ে আনুবীক্ষনিক একটা মোনাজাত ধরে সুরা আউড়ে গেলাম বাকিটা সময়।
আধা ঘন্টা পর গির্জার আলো আঁধারি থেকে বেরিয়ে চোখ ঝলসে গেল মাঝ দুপুরের কড়া রোদে। এখানেই শেষ না। বরং কবরস্থান বরাবর আমাদের যাত্রার শুরু। মিছিলটা নিঃশব্দে এগোলো বসন্তের একটা দুটো কচি পাতাকে সাক্ষী রেখে। পায়ে পায়ে যান্ত্রিক চলছি আর ভাবছি, কি অদ্ভূত মানবজীবন। ঠুশ্ করে এক সময় ফুরিয়ে যায়। অথচ শীত শেষে যদি আবার বসন্ত দিয়ে জীবন শুরু করা যেতে যদি। আহা! এমন একটা বৃক্ষজীবন হলে মন্দ হত না।
গির্জার এক লোক ত্রিশূলের মত কি যেন একটা ধরে রেখে হাঁটছে দলের সবার সামনে। তার জমকালো আলখাল্লা আর মাথার পাগড়ীটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। এই প্রথম এদেশে কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আসা। কোথায় ভেবে রেখেছিলাম একবার না একবার এদের কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবো। আর ভাগ্যে ছিল ফিউনারেল!
আমাদের দলটা কেন যেন মাঝপথে থামলো। সামনের ক’জন একটা কফিন উঠিয়ে নিলো ছোট্ট একটা বেদির মতন জায়গা থেকে। মেহগনি রঙা কাঠের কফিন সোনালি রোদে শেষবারের মত ঝিকিয়ে উঠছে। নিজের অজান্তেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল ইনগ্রিডের জন্যে।
চমৎকার বাগানটা দেখে কে বলবে এটা গোরস্থান। বারোমাসি কয়েক ধরনের ফুলের রাজত্বে গেল শীতের কোন ছাপ নেই। আরো কতগুলো মৌসুমী ফুল তার কুঁড়ি মেলতে ব্যস্ত। পাখিদের কিচির মিচিরে চারিদিক জীবন্ত, উচ্ছল। ইনগ্রিডকে আমরা তার মাঝে যত্ন করে নামিয়ে দিলাম।
মুঠোয় মুঠোয় মাটি পড়লো মেহগনি কফিনে। তফাতে দাঁড়িয়ে সম্মোহিতের মত দেখলাম। জীবন-মৃত্যুর মাঝে আসলে মাত্র এক হাইফেন ফারাক। তবুও আরেকটা দীর্ঘশ্বাস জোর করে বেরিয়ে যেতে চাইলে তাকে খামচে ধরে রেখে দিলাম। ফিরে গিয়ে কাজে মন বসাতে হবে। চোয়াল শক্ত করে তাই পা বাড়ালাম ফিরতি পথে।
মিউনিখ, জার্মানি
২১.০৩.২০
২২ শে মার্চ, ২০২০ রাত ২:১২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: ধন্যবাদ, নেওয়াজ ভাই। সুস্থ থাকবেন।
২| ২১ শে মার্চ, ২০২০ সকাল ৯:১৫
রাজীব নুর বলেছেন: সহজ সরল সুন্দর।
২২ শে মার্চ, ২০২০ রাত ২:১৩
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: বরাবরের মতই অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি লেখা পড়লে ভাল লাগে।
৩| ২১ শে মার্চ, ২০২০ সকাল ১০:৫০
ইসিয়াক বলেছেন: সাবলীল বর্ণনায় ভালো লাগা।
ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
সতর্ক থাকুন
শুভকামনা।
২২ শে মার্চ, ২০২০ রাত ২:১২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আপনিও সুস্থ থাকুন। এটাই বড় চাওয়া।
৪| ২১ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ১:০১
আসোয়াদ লোদি বলেছেন: আহা বেচারা ইনগ্রিড!
২২ শে মার্চ, ২০২০ রাত ২:১৪
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: কিন্তু এটাই যে জীবন।
৫| ২১ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৮:৪৫
আহমেদ জী এস বলেছেন: রিম সাবরিনা জাহান সরকার,
আপনার লেখা পড়তে পড়তে সিনেমায় দেখা ঐ জাতীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ছবি চোখে ভাসছিলো। কি পবিত্রতার একটা আমেজ মাখানো সবখানে। প্রধান পাদরীর ভরাট গলায় বাইবেল থেকে মৃতের প্রতি শেষ বিদায়বাণী নিবেদন, মেহেদী রঙা কাঠের কফিন, কালো পোশাকে আবৃত মৌন শবযাত্রী, সবটা মিলিয়ে সৌম্য-শান্ত একটা ছবি। মৃত্যুকে তখন মহীয়ান বলে মনে হয়।
আমাদের হয় উল্টোটা। কেমন যেন ভয় ধরানো একটা আবহ ভেসে বেড়ায় মৃতকে কবরস্থ করার সময়টাকে ঘিরে!
যদিও "রিম সাবরিনা" ব্রান্ডেড লেখা তবুও রসটুকু ডিঙিয়ে সবটার ভেতরে কোথায় যেন একটা পেলব কোমল কিছু আছে!
"শীত শেষে আবার বসন্ত দিয়ে যদি শুরু করা যেত জীবনটা" এখানে এসে মনে হলো আসলেই - মরিতে চাহিনা আমি এই সুন্দর ভূবনে..........
২২ শে মার্চ, ২০২০ রাত ২:১৫
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: ধন্যবাদ আহমেদ ভাই। অস্থির সময়টায় কলমের ভেতর স্বস্তি খুঁজি। আর তো কিছু করার নেই মনকে সামলে রাখতে।
সুস্থ থাকবেন।
৬| ২২ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৩:০০
শের শায়রী বলেছেন: এত সুন্দর লেখেন! ভালো লাগছে ধর্মের বিভেদ টুকু কাটিয়ে আপনার মোনাজাত করা। আর মজা পাইছি শেনের মাথায় কাপড় দেবার ভাবনা থেকে।
ভালো থাকুন। লিখে যান আমাদের জন্য, শুভ কামনা।
২২ শে মার্চ, ২০২০ বিকাল ৪:৪২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: শের ভাই, ধন্যবাদ। আপনিও কলম নিয়ে সাথে থাকুন। সুস্থ থাকবেন, এই দোয়া করি।
৭| ২৫ শে মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৫
মনিরা সুলতানা বলেছেন: জীবন-মৃত্যুর মাঝে আসলে মাত্র এক হাইফেন ফারাক।
২৬ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৩:৫২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: কেমন একটা বিচ্ছিরি বাস্তবতা।
©somewhere in net ltd.
১| ২১ শে মার্চ, ২০২০ সকাল ৮:৫২
নেওয়াজ আলি বলেছেন: চমৎকার উপস্থাপন । পাঠে মুগ্ধ হলাম।