নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হইচই, হট্টগোল এড়িয়ে চুপচাপ, নিরিবিলিতে লুকিয়ে থাকতে ভাল লাগে।

রিম সাবরিনা জাহান সরকার

যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/

রিম সাবরিনা জাহান সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

পিংপং পইং (অখন্ড)

২১ শে আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৪:১৬


১.
প্রিং করে লাফিয়ে খাঁচার কাছে চলে এলাম। তুলার বলের মত প্রাণীগুলো কি চমৎকার দেখতে। পুরু পশমে চোখ ঢেকে গেছে তাদের। বহু কষ্টে ছোট ছোট হাতে পশম সরিয়ে ঘাস খেতে ব্যস্ত। আমিও ব্যস্তসমস্ত হয়ে সাদা-কালো-বাদামীতে ছোপানো গিনিপিগদের মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছি।

‘এদিকে একটু শুনে যাও তো।‘

চমকে তাকালাম। ডানে বামে ভিড় নেই তেমন। তাহলে কে বললো কথাটা? নাহ্ ভুল শুনেছি।

‘কি, কানে খাটো নাকি? নাকি না শোনার ভান করছো?’।

এবার ভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। হচ্ছেটা কি? এদিকে নধর সাইজের একটা গিনিপিগ খাঁচা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কৌতূহলী হয়ে সেদিকে এগোলাম।

‘হ্যাঁ, আমিই ডাকছি। দু’টো কচি ঘাস ছিড়ে এনে দিতে পারো? এদের দেয়া অখাদ্য খেয়ে অরুচি ধরে গেছে। পশুখাদ্য না ছাই। ধুর্..।‘

কথা ফুরোবার আগেই দেখি বাচ্চা একটা ছেলে এক মুঠ তাজা ঘাস এনে খাঁচার ফোঁকর গলে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

‘দেখলে, কি রকম চটপটে ছেলে। তোমার মত আলসের ডিপো নয়’। বলেই সে ঘাস চিবোতে ডুবে গেল।

বিস্ফোরিত চোখে বলেই ফেললাম, ‘তুমি কথা বলছো কিভাবে? আমিই বা বুঝছি কি করে?’।
লেজহীন ছয় ইঞ্চি প্রানীটা ভীষন অনিচ্ছায় জবাব ছুড়লো, ‘সবার সাথে বলি না। তোমাকে দেখে মনে হল, হয়তো বুঝতে পারবে। তাই বলেছি। এখন দেখছি তুমি বোকার হদ্দ। যাও, যাও, সক্কাল সক্কাল আর সময় নষ্ট করো না‘।

ভাল রকমের ভ্যাবাচেকা খেয়ে সরে পড়লাম সেখান থেকে। কোথাও গড়মিল হচ্ছে। খুব ভোরে উঠেছি। ঘুম কম হলে লোকে ভুলভাল শোনে। তেমন কিছু একটা হবেও বা। দূরে বাপ-ছেলে হেলে দুলে এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা। কথা বলা গিনিপিগ আর তার ঘাস-কাহিনী মাথা থেকে ঝেড়ে দু’জনের দলটাকে ধরতে পা চালালাম।

মিউনিখ ছাড়িয়ে সামান্য দূরেই এই বিশাল পইং পার্ক। আর পইং নামটাও এক্কেবারে যুতসই। নানান বয়সী শিশুরা পিংপং বলের মত লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে একেবারে কাঁপিয়ে রেখেছে পুরো পার্কটা। বাবা-মায়ের হাত ধরে তারা সবাই পশুপাখি দেখতে এসেছে। মাঠের পর মাঠ সবুজের মাঝে ছেড়ে রাখা প্রানীদের স্বাধীন ঘুরে বেড়াতে দেখে তাক লেগে যাচ্ছে তাদের। তবে নামে ওয়াইল্ড পার্ক হলেও কোন বুনো প্রানী নজরে আসছে না। আর তড়তড়িয়ে যে এগোবো, তিড়িং বিড়িং শিশুর পাল ঠেলে হাঁটা-চলাই মুশকিল।

২.
দু’টো আধুলি ফেলে অটোমেট মেশিনের বোতাম এন্তার টেপাটিপি করেও কাজ হলো না। টপ করে পয়সা গিলে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে রইলো দাঁড়িয়ে রইলো সেটা। হরিণের খাবার না কিনেই ফিরে এলাম। ছয় বছরের তাফসু মিয়া কিছুটা হতাশ হলেও পর মুহূর্তেই হরিণের বাগিয়ে দেয়া গলায় হাত বুলাতে মজে গেল। তার জন্যেই আজকের আসা।

চিত্তির বিত্তির রঙের হরিণগুলো কোন ফাঁকে বড়দের মনও রাঙিয়ে ফেলেছে। তেপান্তর সাইজের সুবিশাল মাঠের এখানে সেখানে জটলা করে ঘুরছে ছোট ছোট দল। দলের ছানাদের কেউ কেউ আবার বেড়াতে আসা শিশুদের কাছ থেকে খাবার খাচ্ছে চেটেপুটে। হাতে সুড়সুড়ি লেগে শিশুরা খিলখিল হেসে উঠছে। হরিণ শাবক আর মানব শিশুতে জমেছে জম্পেশ।

‘টুইট্...!‘। শিস দিয়ে কেউ যেন পিছু ডাকলো হঠাৎ।

‘কি, খিদে পেয়েছে?’। তাফসু মিয়াকে শুধালাম। সে মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে বয়সে বুড়ো এক হরিণের কান ধরে ঝুলতে লাগলো।

‘কি হলো, সিটি দিয়ে ডাকলাম। সাড়া দিচ্ছো না যে। আমার কান দুটো খুলে নিচ্ছে তো তোমার পাজি ছেলেটা। এভাবে মলে দিচ্ছে, বাবা গো। ওকে সরাও বলছি, উফ্’।

এখন আমার চোয়াল ঝুলে পড়ার পালা। রাগী চেহারার পালের গোদা টাইপ হরিণটা কথা বলছে নাকি? হতভম্ব ভঙ্গিতেই ছেলেকে ছুটিয়ে আনলাম।

‘বাঁচালে মা, বুড়ো বয়সে কান গেলে কি বিপদ, তাই না। তুমি বরং ওকে আমার শিং ধরে দাঁড়াতে বলো। দারুন একটা ছবি হবে‘।

‘নাহ্ মানে…’। কি যেন একটা বলতে মুখ খুলে আবার বেমালুম ভুলে গেলাম। ওদিকে, আপনা থেকেই আংগুলের টোকায় পটাপট ছবি উঠে গেল মুঠো ফোনে।

‘মা, তুমি আমার সাথেও একটা ছবি তোলো। বহুদিন এমন কাউকে পাই না। আমাদের সাথে যোগাযোগ কত সহজ। অথচ কেউ পাত্তা দেয় না। বিশ্বাসই করে না ব্যাপারটা‘।

প্রবল বেগে গাল চুলকাবো না এখান থেকে পালিয়ে যাবো, স্থির করতে না পেরে ছেলের বাবাকে আলপটকা বলে বসলাম, ‘ওনার সাথে একটা ছবি তুলে দেয়া যায়? মুরুব্বী যখন বলছেন এত করে’।

কথাগুলো মজা করে বলা ভেবে সানন্দে সে ক্লিক ক্লিক ছবি তুলে নিল।

বুড়ো হরিণ বাবাজীকে বিদায় জানিয়ে কেটে পড়লাম ঝটপট। বুড়োটা আবার বলে কি না, ফেরার পথে তার সাথে আড্ডা মেরে যেতে। দু’কদম সামনের অটোমেটটা নাকি কাজ করে ঠিকঠাক। সাথে করে যেন কিছু খাবার কিনে আসি।

আমার তো খেয়ে কাজ নেই। তাছাড়া, সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অথচ কাউকে বলতেও পারছি না। নির্ঘাৎ পাগল ঠাউরে বসবে তাহলে।

৩.
মোটা মোটা কাঠ জুড়ে দিয়ে মাচা বাঁধা হয়েছে। তাতেই উঠে ছেলেবুড়ো উৎসুক কি যেন দেখছে। হাতের গেঁড়ো থেকে ছেলেটাও ফসকে গিয়ে তাদের দলে ভিড়লো। ছেলেমানুষি কৌতূহল দমাতে না পেরে আমিও পিছু নিলাম। লোকের ভারে মচমচিয়ে দুলে উঠল কাঠের মাচা। কিন্তু কই, তারকাটায় ঘেরা জায়গাটায় ঘন গাছের সারি ছাড়া কিছুই যে দেখছি না। যাকে দেখতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে মাচায় ওঠা, সে দিব্যি ডালপালার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে রইল। হতাশ হয়ে নেমে পড়তে হল।

পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছি, অমনি ছেলেটা তারস্বরে চ্যাঁচাতে লাগলো, ‘ঐ যে, ঐ যে। মা, দেখো কত্ত বড় কুকুর’। তার দৃষ্টি অনুসরন করে ওয়েরউলফ সাইজের ইয়া বড় এক শিয়াল দেখতে পেলাম দূরে। আরামসে রোদ পোহাচ্ছে শুয়ে।

‘না, বাবা, ওটা শিয়াল মামা। দেখো না ওর লেজটা কত্ত ফুলো ফুলো। কুকুর তো দেখতে আরেক রকম’।

ছেলেকে বুঝ দিয়ে কুলিয়ে ওঠার আগেই গমগমে স্বর ভেসে আসলো, ‘মা-ছেলে মিলে খুব জ্বালাচ্ছো দেখছি। শান্তিতে বইটাও পড়তে দেবে না‘।

সজোরে মলাট বন্ধের শব্দে ইতি উতি চাইলাম। আর আচমকাই লোমশ শিয়ালটা অত বড় শরীর দুলিয়ে ঠিক সামনে এসে হাজির।

বেড়ার ওপাশ থেকে তিরিক্ষে মেজাজে সে অভিযোগ ঠুকে দিল, ‘শিয়াল মানেই মামা, আর তার ফুলো ফুলো লেজ? ব্যস্, আর বলার মত আর কিছু পেলে না। এই শিক্ষা দাও ছেলেপেলেকে? কেন, ‘শিয়াল পন্ডিত’ বললে কি হয় শুনি?’।

কড়া কথাগুলো শুনে একেবারে মিইয়ে গেলাম। এভাবে তো ভাবি নি।
‘দিন-রাত বই নিয়ে পড়ে থাকি, জানো সে কথা? আর তুমি ক’টা পড়েছো এ’মাসে বলো তো দেখি?’।

এ মাসে কি, এ বছরেই তো বই টই ওসব ছুঁই নি। পড়ার ভেতর পড়ি কেবল খটোমটো রিসার্চ পেপার। মিন মিন করে সে কথাই বলতে গিয়ে চোখ আটকে গেল পন্ডিত মশাইয়ের বিশাল থাবায়। এক তাড়া সবুজ পাতা জুড়ে দিয়ে গাছের বাকলের মলাটে বন্দী করা হয়েছে। বাহ্, বইয়ের কি নমুনা। অজান্তেই একটা শেয়াল মার্কা খ্যাক্ খ্যাক্ হাসি হেসে ফেললাম। ‘ওহ্, এই তোমার বই? এগুলোই চিবোয় সারাদিন শুয়ে বসে?’।

দশাসই শিয়ালটা এবার আহত গলায় বললো, ‘গাছের পাতায় ইতিহাস লেখা থাকে জানো? বরফ যুগ থেকে পাথুরে যুগ, কত কাহিনী। এই পৃথিবীর সব রহস্য লেখা পাতায় পাতায় আর তার শিরায়, উপশিরায়। তোমাদের কাগুজে বইয়ে যেমনটা লেখা থাকে। ইদানীং নিজেরাও সেগুলো আর পড়ো না। আর কাউকে পড়তে দেখলেও জ্বলুনি। আর বিরক্ত না করে কেটে পড়ো তো মানে মানে’।

আমাদেরকে আর এক রত্তি পাত্তা দিল না শিয়াল পন্ডিত। ভালো একটা খোড়ল খুঁজে নিয়ে তাতে কুন্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর খুব মনোযোগ দিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলো।

৪.
রেইনট্রির মত আকাশছোঁয়া গাছে ছেয়ে আছে পইং পার্ক। তাদের ফুল-ফল-শিকড়-বাকড়ের বিবরন খুব যত্ন করে লেখা আছে কাঠের ফলকে। তার মানে, পইং একই সাথে একটা বোটানিকাল গার্ডেনও বটে। আর গাছগাছালি মানেই পাখপাখালির আশ্রম। কিচিরমিচির কোলাহলে চারপাশটা ভীষণ রকমের জীবন্ত। সবুজের ফাঁকে ঝিরিঝিরি দখিনা হাওয়া উড়ে ঘুরে মন মাতিয়ে রাখছে। এই সুযোগে পা’দুটো জিরিয়ে নিই খানিকটা। আর দেরি না করে পথের ধারের বেঞ্চিটা দখল করে নিলাম।

তারকাটার ওধারে বনবিড়ালের পরিবার গাদাগাদি করে ঘুমাচ্ছে। দিনে দুপুরের এ অবধি আর কোনো প্রানীকে অমন ঘুমাতে দেখি নি। বাবা-মা-ছানাপোনা সব এক সাথে মোয়া বেঁধেছে। ঘড়ঘড় নাক ডাকার শব্দও মিলছে। তবে ঝোলানো সাইনবোর্ডটা কেমন সন্দেহ হল। তাতে বড় বড় হরফ লেখা, ‘বনমোরগ’। অথচ উঁকিঝুঁকি মেরেও বনমোরগের ঝুঁটি মিললো না। বনবিড়ালের দল আবার মোরগ-পোলাও দিয়ে লাঞ্চ সেরে ভাত ঘুমটা দেয় নি তো?

যাক গে, প্রানীজগতের খাদ্যচক্র নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সাথের থলে থেকে চিপ্স্-বিস্কুট-কফি বের করে ছোটখাট পিকনিকের আয়োজনে লেগে গেলাম।

‘মাফ করবেন, একটু আস্তে কথা বলা যায় কি? আমার মিসেস ঘুমাচ্ছে কিনা। বেচারার মাইগ্রেনের সমস্যা। ঘুমটা হলে ভাল হত‘। কথাগুলো খুব সহবতের সাথে বললেন বিড়াল পরিবারের বিনয়ী কর্তাবাবু।

কচর মচর শব্দে বিস্কুট কামড়ানোতে আলাব্বু দিতে হল। এত করে যখন বলছেন ভদ্রলোক। নিঃশব্দে কোল্ড কফি গিলে নিয়ে দ্রুত পাততাড়ি গোটালাম। মিস্টার ম্যাঁও ততক্ষনে বাকিদের পাশে ফিরে গিয়ে নাক ডাকা জুড়ে দিয়েছেন। এদের সবার ভরপেট এক দিকে গড়িয়ে পড়েছে। মাইগ্রেন না কচু। পেটের ভেতর বন মোরগগুলো ঘচ্ঘচ্ করেছে নির্ঘাৎ।

৫.
পাশাপাশি তিন হুতুম সাইজের প্যাঁচা বসে ধ্যান করছে। ভাবলাম, ডাকাডাকি করে কাজ কি। হয়তো এনাদেরও মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। পাশ কাটিয়ে চলে যাই বরং। তা-ই যাচ্ছিলাম। অমনি রোঁ ফুলিয়ে মধ্যের জন চোস্ত জার্মানে খেঁকিয়ে উঠলো, ‘হাল্ট্! থামো!’। ধমক শুনে রোম খাড়িয়ে গেল প্রায়। বুজে রাখা চোখ দু’টো আস্তে আস্তে আয়েশ করে খুলল রাশভারী প্যাঁচাটা। কি আবার বিপদে পড়তে যাচ্ছি ভেবে কাঁচুমাচু দাঁড়ালাম।

‘এ্যাই, একটা কথার জবাব দিয়ে যাও দেখি নি। ফ্রাউ মার্কেল গদি ছাড়লে এই জার্মান দেশটার কি গতি হবে বলে তোমার মনে হয়?’।

আমি বাপু রাজনীতির ডানেও নেই, বামেও নেই। তার উপরে প্রবাসী বাঙ্গাল। তাই খুব সাবধানে বললাম, ‘কি আবার হবে, মার্কেল গেলেও তোমাদের দেশ যে সার্কেলে চলছিল, সে সার্কেলেই চলবে’। তারপর ‘আচ্ছা চলি, তাড়া আছে’ বলে সটকে পড়লাম।
পেছন থেকে বলতে শুনলাম, ‘দেখলে মধ্যমপন্থী সুবিধাবাদীটা কেমন পালিয়ে গেল। যাচ্চেলে...‘।

যাহ্, ছেলেটাও এই ফাঁকে পালিয়ে কদ্দূর এগিয়ে গেছে। তাকে ধরতে ঈগলের ডেরা অবধি হাজির হলাম এক দৌড়ে।

পাজিটাকে বাগে পুরে হাঁ করে হাঁপাচ্ছি। কানে এল, ‘আরি বাপস্, তুমি তো দেখি ভালোই দৌড়াতে পারো। এদের হেড অফিসে গিয়ে এক ছুটে আমার হয়ে একটা আর্জি জানিয়ে আসবে?’।
পাশ ফিরে দেখি, হ্লুদ ঠোঁটের রাজকীয় চেহারার ঈগলটা আমাকেই বলছে কথাগুলো। কপালের ঘাম মুছে শুধালাম, ‘কি আর্জি, ঝেড়ে কাশো‘।

‘কাশাকাশির আবার কি আছে। দেখতেই তো পাচ্ছো, প্যাঁচাদের খাঁচায় ওরা তিন-তিনজন। চিলের বাসায় দু’জন। প্লাস নতুন ফোঁটা ছানা। এর কই এদিকে, আমার সাথে তো কাউকে দিল না এখনো। কেমন বিচার বলো তো?’। কেশর ফুলিয়ে বেচারা খাঁচার এ মাথা ওমাথা গজগজ করতে লাগলো।

আহা, এমন রাজপুত্র চেহারার ঈগলের একটা গতি তো করতেই হয়। ফিরতি পথে হেড অফিসে একটা কমপ্লেন লেটার ঠুকে দিয়ে যাবো বলে কথা দিলাম। ঈগল রাজকন্যার এসে পৌঁছানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

৬.
‘রোদে কেমন ঘামছো। ইশ্, নিচে এসে ছায়ায় বসে কথা বল না’। বাদামী ভালুকটার ধরন-ধারন সুবিধের ঠেকছে না।
‘তোমার ছানাটাও দেখছি কচি একেবারে। ওকেও আনো। খুব গল্প হবে‘।

মায়েদের রাডারে দুষ্ট লোকেরা ঠিক ধরা পড়ে যায়। পেটমোটা ভালুকটার মতলব বুঝে গেলাম। কায়দা করে ভুলিয়ে ভালিয়ে কাছে নিয়ে ঘাড় মটকে দেবে পটাং। তারপর মা-ছেলে ভালুক পরিবারের ভুরিভোজ হয়ে যাবো। তারপর পড়ন্ত বিকালে গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে ঘাউক্ ঢেকুর তুলবে এরা।

পাজি ভালুকটাকে ভেংচি কেটে পলকা বাঁশের সাঁকো থেকে নেমে পড়লাম। লোকের ভারে সাঁকো উল্টে গেলে ভুরিভোজ, গনভোজ কোনোটাই ঠেকানো যাবে না আজকে।

এক আকাশ কড়া রোদ্দুরে নরম কাশ ফুল হয়ে ভাসছে বোহেমিয়ান মেঘ। এক আধটা সফেদ সারস ডানা মেলে মেঘ ছুঁয়ে আসতে চাইছে যেন। আর সবুজ মাঠে দলছুট এক পাল ঘোড়াদের এলোমেলো ছোটাছুটি। প্যাঁচানো সিড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া ছোট্ট ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে টুকরো ছবিগুলো দেখছি আর মুর্হুমুর্হু হারিয়ে যাচ্ছি যেন। আদি-অন্ত দিগন্ত তো হারিয়ে যাবার জন্যেই।

ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে এসে আস্তাবলের ওদিকেই এগোলাম। টাট্টু ঘোড়াও আছে দেখছি। পনিটেইল দুলিয়ে দুলকি চালে চড়ে বেড়াচ্ছে তারা। খানিক দূরেই রামছাগলের খামার। তবে টাট্টুদের তুলনায় তাদের পাত্তা কম। খানিকটা মায়ায় পড়ে মাঝারি সাইজের বাদামী ছাগলটার দিকে এগিয়ে গেলাম।

আর সাথে সাথেই অভিযোগ, ‘বামন ঘোড়ার ঝাউবন মার্কা লেজ দেখতে লোকে হামলে পড়ছে। আর এই দেখো, কত্ত বড় দাড়ি রেখেছি। সারাক্ষন আঁচড়ে রাখি আর কি তার বাহার। কিন্তু কেউ তো আসছেই না দেখতে। তোমরা মানুষরা সব বর্নবাদী...’।

বর্নবাদের অপবাদ মাথায় নিতে চাইলাম না। তার বদলে হাত বাড়িয়ে রামছাগলের মাথায় আলতো চাপড়ে দিলাম। দেখাদেখি আরো ক’জন এগিয়ে এল। বাচ্চাকাচ্চারা ছাগলের মস্ত শিং ধরে ছবি তোলার বায়না ধরলো। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল তার চারপাশে। বরং টাট্টু ঘোড়ার দলটা এখন সরু চোখে তাকাচ্ছে এদিকে।

৭.
যাহোক, চতুর চেহারার রাকুন আর বেজায় রাগী বাইসন দেখে ভোঁদরের আস্তানায় এলাম। খুশি হবার বদলে সে দাঁত খিঁচিয়ে উঠলো, ‘দেখছো না মাছ ধরছি। লাঞ্চের পরে এসো। তখন বাৎচিত হবেখন’। বলেই সুড়ুৎ করে জলে ঝাঁপিয়ে গোল্ডফিশের ঝাঁক তাড়া করতে লেগে গেল সে। আমরা একটুও না নড়ে দাঁত কেলিয়ে তার কাজকারবার দেখতে লাগলাম।

হঠাৎ নিঃশব্দে ঘাড়ের কাছে এসে দাঁড়ালো কে যেন। ঘুরে তাকাতেই পেখম মেলে চোখ ধাঁধিয়ে দিল ময়ূরকন্ঠী ময়ূরটা। এত কাছে থেকে ময়ূর দেখছি এই প্রথম। নীল-সবুজের পরতে পরতে বনেদী আভিজাত্য। পেখম গুটিয়ে ময়ূরটা এবার এক পা দু’পা করে ধীর লয়ে এগোতে লাগলো। মন্ত্রমুগ্ধ আমরাও তার পিছু নিলাম চুপচাপ। এখন সে হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালা সেজে আমাদের কোনো খাদ-টাদে ফেলে না দিলে হয়।

না, তার বদলে সে আমাদের খোলা মাঠে নিয়ে এল। খেলার সরঞ্জামের অভাব নেই সেখানে। কাঠের রেলগাড়ি থেকে শুরু করে বাঁশের কুঁড়েঘর-কি নেই। এক পাল শিশুকিশোরেরা দৌড়ঝাঁপে গরম করে রেখেছে পুরো এলাকা। আর তারই মাঝে অলস হেঁটে বেড়াচ্ছে অগুনতি ময়ূর। মূল আকর্ষন যে তারাই, তা কি আর বলে দিতে হয়। এক এক জন পেখম মেলছে আর ছেলেবুড়ো আনন্দে হই হই করে উঠছে।

‘নিয়ম করা আছে। সিরিয়াল ধরে আমরা কলিগরা পাঁচ মিনিট পর পর পেখম মেলি। বিজনেস স্ট্র্যাটেজি, বুঝলে। নইলে এই করোনাকালে দর্শক ধরে রাখা মুশকিল। তার উপরে আজকে আবার বৃষ্টির ফোরকাস্ট আছে‘। বলেই চিন্তিত মুখে ঘোলাটে হয়ে আসা আকাশের দিকে চাইলো সাথের ময়ূরটা।

বৃষ্টি আসে আসুক। পইং পার্ক আর তার বাসিন্দাদেরকে আমাদের খুব ভাল লেগে গেছে। রোদের শেষ ঝিলিকটা মেঘের আড়ালে লুকানোর আগ পর্যন্ত আমরা রয়ে গেলাম সেখানে। পিংপং বলের মতই গড়িয়ে বেড়াতে লাগলাম ইচ্ছেমত। তারপর টিপটিপ বৃষ্টির হাত ধরে ফিরে চললাম বাড়ির পথে।

বুড়ো দাদু হরিণটা বিদায় জানাতে এগিয়ে এল। ‘ছাওপাও নিয়ে আবার এসো কিন্তু’। জবাবে ফিক্ করে হেসে বললাম, ‘তদ্দিন জ্যান্ত থেকো কিন্তু’। বুড়োটা মাথা দুলিয়ে হাসছে। নাহ্ এমন যাদুর জগতে আসতে যে আবার হবেই।

























মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ১২:৫০

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর পোষ্ট। ছবি গুলো অতি মনোরম।

২২ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ১:০৪

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: রাজীব ভাই, আমার ব্লগে আপনার উপস্থিতি আমাকে বরাবরই আনন্দ দেয়। আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন। নতুন আরেকটা লেখায় হাত দিয়েছি। দেখি কি দাঁড়ায় শেষ অবধি।
ভাল থাকবেন।

২| ২২ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ২:৩৭

চাঁদগাজী বলেছেন:



আপনার লেখার ষ্টাইল এখনো সুন্দর; করোনায় আপনার কনফারেন্সের কি অবস্হা?

২২ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ৩:৩৩

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: স্যার, প্রথমেই ধন্যবাদ। দ্বিতীয়ত, কনফারেন্স সামনের মাসে একটা আছে। তবে যেভাবে করোনা কেস বাড়ছে এদিকে, তাতে সেটা কেঁচে যাবার সমূহ আশংকা আছে। তবে স্মৃতির কোঠরে কিছু মিছু রয়ে গেছে। জোড়াতালি দিয়ে আরো গোটা দুই লেখে বের করে ফেলা যাবে। আলসেমিটা তাড়াতে পারলেই হাত দেবো।
আপনি ভাল থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।

৩| ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১০:১৬

সাদীদ তনয় বলেছেন: পিংপং নামে একটা জার্মান মুভি আছে। ২০০৬ সালে রিলিজ হয়েছিল।

১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ২:৫৮

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আশ্চর্য ব্যাপার হল, মুভি বা বড় দৈর্ঘ্যের কিছুতে মন দেয়ার মত ক্ষমতা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে গিয়েছি। তবে তথ্যটার জন্যে ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.