নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হইচই, হট্টগোল এড়িয়ে চুপচাপ, নিরিবিলিতে লুকিয়ে থাকতে ভাল লাগে।

রিম সাবরিনা জাহান সরকার

যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/

রিম সাবরিনা জাহান সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

খাদ্যরস ২

২০ শে নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:৩৮


ইটালিয়ান বেকারির ভেতর-বাইর দু’জায়গাতেই ভিড়। লোকে দাঁড়িয়ে-বসে কফি গিলছে আর সমানে গাল-গপ মেরে চলছে। কোথায় দুপুরে ভরপেট খেয়ে দু’দন্ড ভাতঘুম দেবে গা এলিয়ে, তা না করে কি সব তিতিকুটে কফি উড়িয়ে সেই তো আবার কোমর বেঁধে কাজে লেগে যাবে। মাঝখানে এই যেটুকু বিরতি। কাজ পাগলদের এই ক্ষনিকের জটলায় আর হানা দিলাম না। কফি-কেকের হাতছানি ফিরিয়ে দিয়ে চুপচাপ ব্যাজার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি।
‘হেই বোনজরনো’! ইতিউতি চাইতে দেখি দোকানের মালিক হাতে ধরা সিগারেট এ্যাশট্রেতে বুজিয়ে দিয়ে আমাকেই ডাকছে। আসতে-যেতে এ বেকারিতে প্রায়ই ঢুঁ মারা হয়। মিষ্টি খাবারের প্রতি আমার মাছি স্বভাব তার খুব জানা। দু’একজন বাঁধা কাস্টমার ঠেলেঠুলে মাছি বেগমকে জায়গা করে দেয়া হল। ভনভনিয়ে উড়ে স্বচ্ছ কাঁচের ওপাশে দাঁড়ালাম। আজ দেখছি হরেক রকমের মন্ডামিঠাই সাজানো থরে থরে। পেটের গহীন থেকে চিকন স্বরে কে যেন চিঁ চিঁ বায়না ধরলো, ‘মিষ্টি খাবো, কিনে দাও, কিনে দাও...’। এমন মিহি আর দুর্বল স্বর বিবেক ছাড়া আর হবে? তবে সে তো শুনেছি হৃৎপিন্ডের এপাশ নাকি ওপাশে থাকে। পেটের ওদিকটায় সে গেল কি করে। যাহোক, বিবেকের ডাকে সাড়া না দিলেই নয়।
ডার্ক চকলেট কেকের গাঢ় বাদামি জেল্লা দেখে চোখ ফেরানো দায়। তার পাশেই সফেদ চিজ কেকের শুভ্র আমন্ত্রন। কিন্তু সব ছাপিয়ে নজর কেড়ে নিল এক থালা রঙ্গীন মাকারন। ক্রিম কুকিজের মতই দুই পাশ থেকে ক্রিমের পুর চেপে রেখেছে। কিন্তু কুকিজের মত রুক্ষ চেহারা নয়। বরং পেলব। আলমন্ড বাদামে গড়ানো মসৃন ত্বক। মৃদু আলো ঠিকরে চায়না পোরসেলিনের মত ঝিলিক দিচ্ছে গোক চাকতিগুলো। কোনোটা স্ট্রবেরি জ্যামে ঠাসা, কোনোটা ভ্যানিলা সসে টইটুম্বুর।
বেগুনি-নীল-আসমানি-সবুজ-কমলা রঙে মাকারনগুলো এক্কেবারে রংধনু উড়িয়ে দিয়েছে। যদিও জানি এ বাহার ফুড কেমিক্যালের কল্যানে, তবুও ঘোর লাগছে বড্ড। কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবো ভেবে না পেয়ে আঙুল তুলে এলোপাথাড়ি দেখিয়ে বললাম, ‘এটা, ওটা সেটা আর ঐযে ঐটা নেবো’।
দোকানি টপাটপ মাকারনগুলো কাগজের ঠোঙ্গায় তুলে দিতে দিতে শুধালো, ‘সাথে কফি নেবে না?’।
বললাম, ‘তোমার মাকারনের মিষ্টি খেয়েই তো চং হয়ে বসে থাকবো। ওতেই কফির কাজ দেবে’।
দুষ্টু চোখ টিপে দোকানি মাথা নাড়লো, ‘তা তুমি পারোও বাপু’।
সহাস্যে তাকে 'আদিও’ ঠুকে ইটালিয়ান কায়দায় বিদায় জানিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। দোকানিও বেরিয়েছে পিছু পিছু। আধ খাওয়া বিড়িটা কার কাছ থেকে ধরিয়ে ফক ফক ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত হয়ে গেল সে।
সামনেই বাস স্টপ। খালি বেঞ্চি দখলে নিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। সেই রেনেসাঁ যুগে কোন এক ইটালিয়ান শেফ ফ্রেঞ্চদের প্রথম এই বস্তু বানিয়ে খাইয়েছিল। অতি ক্রিয়েটিভ ফরাসিরা রেসিপিতে নানা রকম অদল-বদল এনে ম্যাকারনকে এমনই নিজেদের করে নিল যে জিনিসটার নামই দাঁড়িয়ে গেল ফ্রেঞ্চ ম্যাকারন। ইটালিয়ান আবিষ্কারের ফ্রেঞ্চ নাম নিয়ে অবশ্য এ শর্মার মাথাব্যাথা নেই। বরং গালের ভেতর চকলেট ফ্লেভারের ম্যাকারনটাকে বাগে আনার চেষ্টায় আছি। মুচমুচে শব্দে ভেঙ্গে কেমন হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মিলিয়ে যাচ্ছে সেটা। তৃপ্তি মিলছে না কিছুতেই। পেটের ভেতর বিবেক বাবা আরো কতগুলো ফ্রেঞ্চ ম্যাকারনের জন্যে হাঁ করে অপেক্ষা করছে।
ঠোঙ্গার মুখখানা আবার খুলতেই এবার বেগুনি আভা ছড়িয়ে উঁকি দিল ব্লুবেরি মাকারন। টপ করে তাকে ধরে মুখে পাঠিয়ে দিলাম। টক-মিষ্টি মিশেলের একটা কড়া স্বাদ যেন জোরসে ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। সটান সোজা হয়ে বসে মুঠোয় ধরা প্যাকেট হাতড়াতে লাগলাম। জাদুর টুপি থেকে যেমন একের পর এক খরগোশ বেরোতে থাকে, ভচকানো ঠোঙ্গা থেকে তেমনি বেরোতে লাগলো ঝলমলে সব জাদুর মিঠাই।
কমলা ক্রিমের অরেঞ্জ স্বাদের মাকারনের মচমচে পিঠে কামড় বসিয়েই দুই আঙ্গুলে স্ট্যান্ড বাই পজিশনে রেখেছি লেমন জ্যামে ঠাসা হালকা সবুজ আরেক পিস। এর মাঝে শরিক জুটে গেছে একজন। বাস স্টপে মায়ের হাত ধরে দাঁড়ানো হাফপ্যান্ট পরা বছর দুয়েকের এক জেন্টেলম্যান। মুখ থেকে ললিপপ সরিয়ে জুলজুল করে সে এদিকেই তাকাচ্ছে। ফুলো ফুলো গাল বেয়ে হালকা লালার স্রোতও নামছে দেখি। তাকে আড়চোখে ভেংচি কেটে সল্টেড ক্যারামেল স্বাদের নোনা-মিঠা শেষ ম্যাকারনটা অবলীলায় মুখে চালান দিয়ে দিলাম। কচর-মচর নির্মম শব্দে বেচারা কেঁদে উঠলো, ভ্যাঁআআ...। বাচ্চার মা এদিকে নজর দেবার আগেই চট্ জলদি আরেক দিকে রাস্তা মাপলাম।
আজকের দুপুরটা এত মিষ্টি! এলোমেলো হেঁটে নদীর পাড়ে চলে যেতে মন চাইছে। কিন্তু উপায় নেই। ছেলেটাকে কিন্ডারপার্টেন থেকে তুলতে হবে সময়মত। সুতরাং সেদিক বরাবর গতি বদলাতে হল।
‘মা, কি খেয়েছো বল তো? তোমার গা থেকে কেক-বিস্কুটের ঘ্রান আসছে কেন?’।
জেরার মুখে স্বীকার করতে হল রেস্তোরাঁয় নুডুলস থেকে বেকারির মাকারন অবধি। সব শুনে শোকে বিমূঢ় ছেলের এমন এক কাঁদো কাঁদো চেহারা হল, যে পেটের ভেতর রীতিমত বিবেকের দংশন টের পেলাম।
অপরাধ শুধরে নেবার আশায় তাকে জবর অফার সাধা হল, ‘আইসক্রিম চলবে? নদীর পাড়ে বসে?’।
পাঁচ মিনিটের মাথায় মোড়ের আইসক্রিমের দোকানে পৌঁছে গেলাম দু’জন। সাইনবোর্ডে নাম লেখা ‘দোমোরি’। দোমোরিকে দোকান বললে ভুল হবে। রোমানিয়ান এক দম্পতির ছোট্ট আইসক্রিম পার্লার আর পাতিসেরি এটা। নিজেরাই অর্গানিক আইসক্রিম, কেক আর চকোলেট বানায়। কফির স্বাদও সমান দুর্দান্ত।
আমরা পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অপরূপ চেহারার অল্পবয়সি মেয়েটা আইসক্রিম বারের পেছন থেকে হাসিমুখে হাত নাড়লো। আজকের তার হাজবেন্ডকে দেখছি না। তবে রোমানিয়ার লোকদের নারী ভাগ্য বেজায় ভাল। এরা প্রত্যেকে অপ্সরা পর্যায়ের সুন্দরী। আমাদের দোমোরিকন্যা শুধু অপ্সরা হয়েই ক্ষান্ত দেয় নি। তার হাতের আইসক্রিমের স্বাদ এই মিউনিখ শহরের আর কোথাও মিলবে না।
‘কি খবর, কি নেবে আজকে?’
ছেলের ঘ্যাও ম্যাও শুরু হয়ে গেল, ‘আমি চকলেট। ওয়াফেল কোনে দুইটা বড় বড় গোল্লা দিতে হবে কিন্তু’।
‘আর আমি নেবো জাফরান ফ্লেভার’। আসলামই যখন, আইসক্রিম না খেয়েই বা যাই কি করে। সামনের দিন কয়েক না হয় ঘাসপাতা আর সালাদ খেয়ে পুষিয়ে দেবো। মনকে একটা আধা সত্য ভুংচুং দিলাম আপাতত।
পায়ে পায়ে নদীর পাড়ে পৌঁছে গেলাম। ইজার নদী। মিউনিখের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে বহুদূর। বাঁধানো ঘাটের সিড়িতে আরাম করে বসলাম অলস কতগুলো হাঁসের পাশে। আইসক্রিমে তাদের আগ্রহ নেই। নিরাসক্ত হাঁসের পালের পাশে আমরা দু’জন চুর হয়ে আইসক্রিম খেতে লাগলাম চরম আসক্তের মত।
দুপুর পেরিয়ে বিকালের আলো নরম হয়ে জাফরান আইসক্রিমের সোনালি বরফদানা চুইয়ে পড়ছে। সেই ফাঁকে পেস্তা বাদামের অগুনতি কুঁচি উঁকি দিচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে। দারচিনি, লবঙ্গ আর এলাচের হালকা মিষ্টি গন্ধ নদীর ঠান্ডা বাতাসে মিলে একাকার। ক্ষীর, পায়েস, দই আর রসমালাই-সব স্বাদের যেন এক মিশেল এই বিচিত্র রোমানিয়ান জাফরান কুলফি। এ বাদশাহী জিনিস ঘাটের পাড়ে পাথুরে সিড়িতে বসে খাওয়া সাজে না। নিদেনপক্ষে একটা আরাম কেদারা হলে মন্দ হত না।
এই রেসিপি দোমোরিকন্যা কোথায় পেয়েছে কে জানে। একবার জানতে গিয়ে জবাবে একগাল রহস্যময় হাসি মিলেছে। এটা তার ট্রেড সিক্রেট। বলতে নারাজ। আমিও কি আর ঘাটাবার লোক। ঘর থেকে দু’পা ফেলে দু’কড়ি দিলেই তো হাতে এসে ধরা দিচ্ছে এ মহার্ঘ্য।
হাঁসেরা উড়ে গেছে। ছেলের ডবল চকলেট আইসক্রিম ফুরিয়েছে। হাতের জাফরান কুলফিও কখন হাপিশ, খেয়ালই নেই। উঠে দাঁড়ালাম আমরা। বাড়ি যেতে হবে।
মেঘের চাদরে সূর্য ঢেকে গেছে টুপ করে। অপূর্ব লাল-কমলা আভা আকাশজুড়ে। হিম হিম জাফরানী এক সন্ধ্যা নেমে আসছে এই ভিনদেশী শহরে। (চলবে)
-ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার, মিউনিখ, জার্মানি।





মন্তব্য ১২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:১১

রিফাত হোসেন বলেছেন: আইসক্রিম ভাল লাগে। avocado ice চেষ্টা করতে পারেন। খারাপ লাগবে না।

২০ শে নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৩

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: খুঁজে পেলে আলবত ট্রাই করে দেখবো। দারুন হবে মনে হচ্ছে।

২| ২০ শে নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:১৪

সোনাগাজী বলেছেন:



আপনি কি একাডেমিকভাবে রিসার্চে আছেন, নাকি কোন ফার্মাসিউটিক্যাল থেকে?

২০ শে নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৩

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: স্যার, সালাম। ঠিক ফার্মা নয়, এখন আছি একটা ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশনে। নতুন গবেষণারত ড্রাগ বা ভ্যাক্সিন নিয়ে পেশেন্টের ওপর কাজ করছে, এমন ফার্মা আর হাসপাতালের সাথে জরিত। এদের গবেষণা তথ্য উপাত্ত আমরা বিশ্লেষণ করে দেই। আর আমার কাজ বড় বড় খতিয়ান বা রিপোর্ট লিখে দেয়া সেই ফকাফলের উপর। যেগুলো এফ ডি এ বা আর কোনো সংস্থা পড়ে যাচাই করে দেখবে যে নিতুন ওষুধটা বাজারে ছাড়ার ছাড়পত্র দেয়া যায় কিনা।

৩| ২০ শে নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৩২

সোনাগাজী বলেছেন:



ভালো

২০ শে নভেম্বর, ২০২২ রাত ৮:০৪

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আপনিও ভাল থাকবেন আর নিজের যত্ন নেবেন।

৪| ২০ শে নভেম্বর, ২০২২ রাত ১০:০২

শায়মা বলেছেন: কি মজা!

আইসক্রিম ম্যাকারন!!! :)

২০ শে নভেম্বর, ২০২২ রাত ১১:০৩

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: প্রিয় শায়মা আপুকে লেখাটা পড়ার জন্যে ধন্যবাদ।

৫| ২১ শে নভেম্বর, ২০২২ রাত ১২:৪৭

মোহাম্মদ গোফরান বলেছেন: বিরিয়ানী কেমন লাগে খেতে?

২১ শে নভেম্বর, ২০২২ রাত ১:১৮

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: রাতের খাবার খেলুম মাত্রই। এর মাঝে আবার কি মনে করিয়ে দিলেন ভাই। এক প্লেট কাচ্চি খেতে সাধ হচ্ছে বড়।

৬| ২১ শে নভেম্বর, ২০২২ সকাল ৭:৫৩

সোহানী বলেছেন: আমি হলাম গিয়ে আইসক্রিমের পাগল। আইসক্রিম দেশে বা বিদেশে চোকে পড়লেই হলো................।

এখন একটু চেক দিয়েছি। বয়স বাড়ছে, আর কত।

ম্যাকরন ভালোই লাগে কিন্তু এখানে এতো এতো দাম তাই নিজেই একবার ট্রাই করেছি। বেশ ভালোই হয়েছে। বাসায় যেহেতু শুধু ক্রিম ছিল তাই ভ্যানিলাটা বানিয়েছি। তুমি মাথায় ঢুকিয়েছো তাই আবার বানাবো :P।ি আর মিউনিখে গেলে দোকানের ঠিকানাটা মতো হাজির হবো নিশ্চয়।

২১ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:৪৬

রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: কি ছবি দেখালেন আপু। নিজেকে ধরে রাখা দায় এখন। মিউনিখের দাওয়াত তো রইলোই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.