![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্বপ্নময় পথিক। দেখা, শোনা ও জানাগুলিকে ব্লগের পাতায় রেখে যেতে চাই।
১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ল, ১৯৯১ সালে ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। অনেকেই ভেবেছিল—এবার পৃথিবী বদলে যাবে। গণতন্ত্র, মুক্ত বাজার আর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিজয়ী হবে। কেউ কেউ বলেছিলেন—এটাই ইতিহাসের শেষ, মানব সভ্যতা পৌঁছে গেছে শান্তি ও সহযোগিতার নতুন যুগে। কিন্তু ইতিহাস থেমে যায়নি। বরং নতুন পথে হাঁটল। শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী যুগ আমাদের এনে দিল একদিকে অভূতপূর্ব সহযোগিতা, অন্যদিকে নতুন সংঘাত আর অপ্রত্যাশিত উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু।
দুই মেরু ভেঙে এক মেরু বিশ্ব
শীতল যুদ্ধের সময় পৃথিবী ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। কিন্তু সেটি শেষ হলে, যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে উঠে আসে। একে বলা হয়েছিল Unipolar Moment—এক মেরুর মুহূর্ত।
এই অবস্থার শুরুতে আশার আলোও দেখা গিয়েছিল:
- পূর্ব ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় গণতন্ত্রের বিস্তার
- জাতিসংঘ, নেটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও WTO-এর মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের শক্তি বৃদ্ধি
- বিশ্বায়নের অগ্রযাত্রা, যা অর্থনীতি ও সমাজকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করেছিল
মনে হচ্ছিল—এবার হয়তো সহযোগিতাই বিশ্ব রাজনীতির নিয়ম হয়ে উঠবে।
সহযোগিতার সময়: শান্তির প্রচেষ্টা ও বৈশ্বিক উদ্যোগ
১৯৯০-এর দশকে নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ চোখে পড়ে:
- জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন আফ্রিকা থেকে বলকান—সবখানে বিস্তৃত হয়
- নেটো নতুন রূপ নেয়, পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ এতে যোগ দেয়
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়ে ওঠে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট
- অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য ও জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক ঐকমত্য গড়ে ওঠে
এই সময়টা ছিল এক ধরনের আশাবাদের, যেখানে মনে হচ্ছিল—বিশ্বব্যাপী একসঙ্গে কাজ করে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব।
কিন্তু শান্তি আসেনি: নতুন সংঘাতের মুখোমুখি
তবে বাস্তবতা অন্য কথা বলল। শীতল যুদ্ধ শেষ হলেও সংঘাত থামল না, বরং নতুন রূপে ফিরে এল:
- জাতিগত সংঘাত: বালকান যুদ্ধ আর রুয়ান্ডার গণহত্যা প্রমাণ করল—জাতীয়তাবাদ ও পরিচয়ের রাজনীতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
- মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা: ১৯৯১ সালের গালফ যুদ্ধ একদিকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার উদাহরণ হলেও, অন্যদিকে অঞ্চলের অশান্তি অব্যাহত রাখল।
- ব্যর্থ রাষ্ট্র: সোমালিয়া, আফগানিস্তানসহ নানা দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ল, যার ফলে মানবিক বিপর্যয় আর বিদেশি হস্তক্ষেপ দেখা দিল।
- সন্ত্রাসবাদ: ২০০১ সালের ৯/১১ হামলা পুরো বিশ্বকে বদলে দিল। “War on Terror” হয়ে উঠল নতুন বৈশ্বিক যুদ্ধ।
ফলে ৯০-এর দশকের আশাবাদ দ্রুত ম্লান হয়ে গেল।
নতুন ফ্ল্যাশপয়েন্ট ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা
এই সময়ে পৃথিবী আরও কিছু নতুন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু দেখল:
- দক্ষিণ এশিয়া: ভারত-পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা
- মধ্যপ্রাচ্য: ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট, ইরাক যুদ্ধ, সিরিয়ার অশান্তি
- রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন: চেচনিয়া, জর্জিয়া আর ইউক্রেন—মস্কো প্রমাণ করে দিল যে তারা নীরব দর্শক হবে না
- চীনের উত্থান: দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর সামরিক আধুনিকীকরণের মাধ্যমে এশিয়ার শক্তির ভারসাম্য বদলাতে শুরু করল
সব মিলিয়ে স্পষ্ট হলো—সহযোগিতা সম্ভব হলেও, শক্তির রাজনীতি কখনো পুরোপুরি হারায়নি।
সহযোগিতা ও সংঘাত: একসাথে হাঁটা
শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী সময়কে বলা যায় এক অদ্ভুত বৈপরীত্য:
- একদিকে বিশ্ব আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সংযুক্ত
- অন্যদিকে সংঘাতের রূপ পাল্টেছে—ব্লকের লড়াই থেকে আঞ্চলিক যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, আর পরিচয়ভিত্তিক দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে
বিশ্বায়ন যেমন সুযোগ এনেছে, তেমনই নতুন ভঙ্গুরতাও তৈরি করেছে।
শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী যুগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ইতিহাস কখনো সরলরেখায় চলে না। এক সময়ের শান্তির স্বপ্ন ভেঙে যায় নতুন সংকটের ধাক্কায়। এটা আমাদের শেখায়—সহযোগিতা আর সংঘাত আলাদা নয়, বরং একই মুদ্রার দুই পিঠ। আর তাই বিশ্ব রাজনীতি আজও অনিশ্চিত, জটিল আর চমকপ্রদ।
©somewhere in net ltd.