নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রবাহূত

রবাহূত › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার শৈশব এবং জাদুর শহর

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:২১

খুব বেশি দিন আগে নয়, ঢাকা তখনও একটি সুন্দর শহর।
বড় বড় রেইন ট্রি ঘেরা ছায়াময় একটি শহর। মুড়ির টিন বাস গুলো তখনো চলছিলো। টেম্পু নামক বিভীষিকা তখনো পথে নামেনি। আমার বেশ মনে আছে আমাদের ধান্মন্ডীর বাসার ছাদ থেকে আমরা বাস গুনতাম, আর আট নম্বর রোডের উপর দিয়ে কয়টা গাড়ি আসতো যেত কমবেশি তাও জানতাম। বাসার সামনেই বিশাল মাঠ, প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিলো না আজকের মত। কি বিশাল লাগতো। উলটো দিকে ছিলও শায়লা আপাদের বাসা, টিভিতে নাটক করতেন, আমার বড় ভাইএর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। আমরা থাকতাম আজকে যেখানে ওরিয়েন্টাল রিয়েল এস্টেটের আকাশচুম্বী এপার্টমেন্টটা দুর্বিনীত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে সেখানটাতে, বিশাল সবুজ লন, ছিমছাম তিনতলা একটা বাসা। আমরা নির্ভীক ঢুকে যেতাম মাঠে, কখনো লেকের ধারে বেড়াতে যেতাম, অত জৌলুশ ছিলও না লেকটার তখন কিন্তু ছিল মায়া, একটা কাঠের সাঁকো ছিল, ছোট্ট দ্বীপটাতে যাওয়ার জন্য, নিলচে কাঠের ক্রস ক্রস, ঠিক গাঁয়ের সলাজ ষোড়শীর মতন।
গাঁয়ের সেই ছোট্ট সলাজ ষোড়শীটিকে শহরে এনে তার কালি তোলা কাজল তুলে মাস্কারা, টাস্কারা লাগালে, কচি কলাপাতা ডুরে শাড়িটি পাল্টে টপ স্কারট পরালে যেমন টি হবে, ঠিক তেমনটি লাগে এখন, সেই ছায়া ছায়া লেইকটি দেখলে। বড় নির্মম! কি ভয়াবহ !! ক্রমশ এ শহর কিম্ভূতকিমাকার হচ্ছে।
খুব মনে আছে, বিকেলে ছাদে উঠলে দেখতাম আজস্র টিয়ে পাখি, ঘুরছে আর ঘুরছে। আর ছিলও কৃষ্ণচূড়া গাছ শহরটা জুড়ে। কি সুন্দর লালচে কমলা, কোমল মায়া! ঝিরি ঝিরি পাতা, কি অদ্ভুত শব্দ হত। দূর থেকে ক্রেইন দেখতে পেতাম, সংসদ ভবনের কাজ চলছে। কি বিশাল হলদে রঙের, আর তখন খুব মজার একটা গাড়ি চলত, ঠিক ক্রেইনের মত হলুদ রঙের, ছাদ খোলা, শুনেছিলাম সেগুল নাকি অস্ট্রেলিয়ান্ গাড়ি। আমার খুব ভাল লাগতো। আর ভালো লাগতো বিশাল ট্রাক গুলো, কি সুন্দর ছবি ওয়ালা, সামনে একটা কাঠি দিয়ে ঘুরাত, ঘুরাত ঘুরাত হঠাত, খটাং শব্দে চালু হত, এঞ্জিন। একটা ছবি থাকতো এক পেশীবহুল লোক সমগ্র পৃথিবীটাকে তাঁর ঘাড়ে তুলে রেখেছেন। ভাবতাম কবে বড় হব আর এই লোকটার মত হব, শক্ত পোক্ত, গাট্টা গোটটা। খুব ইচ্ছে হত অমন হই। কেউ জিজ্ঞেস করতো যদি “ বাবু তুমি কি হতে চাও, বাবার মত ডাক্তার?” আমি বলতাম “মুক্তি যোদ্ধা” আসলে বলতে চাইতাম “মুষ্টিযোদ্ধা”, ক্লে এর মত, মহাম্মদ আলী ক্লে, আশৈশব আমার হিরো। খুব মনে আছে ল্যারি হোমসের সাথে খেলাটা যেদিন টিভিতে দেখিয়েছিল, সেদিন বাসায় মটরশুঁটি দিয়ে কই মাছ রান্না হয়েছিলো, আর মোহাম্মদ আলির হেরে যাওয়া ভাবলে এখনো বুকটা টন টন করে। আজ এত বছর পরেও। সেদিন ঢাকা শহর টাই ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো। কই গেল সেই দিন গুলি! মোহাম্মদ আলিকে বাংলাদেশ সম্মানজনক নাগরিকত্ব দিয়েছিলো। আর কক্সবাজারে এক টুকরো জমি। কে জানে কোন ভুমি দস্যুর করাল গ্রাসে গেছে সে জমি?
আর দেশে হিরো ছিলও ফুটবলার সালাহ উদ্দিন। তখন কারুর সাথে নতুন বন্ধু হলেই বলতাম “তুমি আবাহনী? না মহামেডান?”, আমি চিরকাল আবাহনীর দলে। বুঝি বা না বুঝি উত্তেজনাটা ছিলও খুব। আমি ছিলাম বরিস বেকার, আমার বোন ছিল জন ম্যাকেন্র, আমরা ছিলাম দুপক্ষ, আমার সিক্স মিলিওন ডলার ম্যান তো ওর বাইওনিক ওমেন, ওর রুনা লাইলা তো আমার সাবিনা ইয়াসমিন, কোন ছাড় নেই, আবার এক মুহূর্তও তাকে ছাড়া চলতো না আমার। স্কুল থেকে ফিরলেই আমরা রং রং খেলতাম, এক বিচিত্র খেলা! বাসার চৌখুপি মোজাইক মেঝেতে, বেশিটাই ছিল সাদা, দূরে দূরে কিছু নীল, হলদে মোজাইক ছিল, একটা থেকে আরেকটায় দৌড়ে যেতাম, আর ছুয়ে দিলেই চোর হতাম। বলাই বাহুল্য এ খেলাটি, তাঁরি আবিষ্কার, যেমন বাসা বাসা খেললে অবধারিতও ভাবে আমাকেই চাকর হতে হত, আর তাঁর সৃষ্টিশীল খ্যাপানোর শিকার হতে হত। বাবার কাছে যেতাম বিচার দিতে, সুন্দর বিচার করতেন, বলতেন হ্যাঁ বাসায় তো একটা কাজের লোকও লাগে, কি আর করা, ততাস্থু! কিন্তু ব্যডমিন্টন কিংবা ফ্রিসবি খেলার সময়, হারিয়ে নিতাম প্রতিশোধ, হায় আজ যদি পেতাম সব হারিয়েও তোকেই চাইতাম।


কখন বাসার পুলিশ কিংবা বড়দের ফাঁকি দিয়ে মোড়ের কনফেকশনারিতে যেতাম, কোন ভয় ছিল না শহরে,কত আর বড় তখন মেরিগোল্ড কিন্ডারগার্টেনে কেজি ওয়ান এ পড়ি। সবচেয়ে প্রিয় ছিল মিল্ক ভিটা চকলেট মিল্ক, আহা কি স্বাদ। এত্ত ভালো লাগতো যার আর পর নেই। আর আইস্ক্রিম ওয়ালার ঘ্নটির শব্দ, অমন মধুর ধ্বনি কমই ছিল। তখন সব এত আনায়েসেই পেতাম না। ভালো আইস্ক্রিম খেতে যেতে হত নিউ মার্কেটে, নভেলটি আইস্ক্রিম, কী সুন্দর ছিল, কাঁচ দিয়ে ঘেরা, ছোট্ট একটু দোতলাও ছিল, আইস্ক্রিম কাপ ভরা স্কুপটা দিত। আহা অমন ভালো জিনিশ, কদাচ জুটত। সে যুগে ছোটদের আইস্ক্রিম খাওয়া মানেই “হুম্ম ঠান্ডা লাগবে, টন্সিল ফুল্বে”।বায়না করার মত সুযোগ ছিল না তখন। নিউ মার্কেট ছিল যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মার্কেট, কী বিশাল। আর কী মজা! আমার নানা ছিলেন এই মার্কেট এর এঞ্জিনিয়ারিং টিম এর একজন, আর তাই ছোট্ট বেলা থেকেই বেশ একটা নিজের নিজের ভাব ছিল, সে অনেক আগে নানার দোকান টোকান ও ছিল, হাত বেহাত হওয়ার পরেও দু একজন তাঁর ভাড়াটিয়া ছিলেন, যেখানে প্রভুত খাতির যত্ন পেতাম, যার মুল একটা আকর্ষণ ছিল লাইটস এর “ক্রিম্- রোল”! এর সাথে আর কিসের তুলনা চলে, যারা খেয়েছেন তারাই জানেন। আর গেইটের বাইরে লোক গুলা বসে থাকতো বুঝি আমাদের জন্যই, ছোট ছোট, এরপ্লেইন, হ্যাজাক বাতি, গাড়ি, ভর্তি একমুঠো রঙ্গিন মৌরি, যেন এক মুঠো আনন্দ। আর ছিল “ম্যাচবক্স” এর গাড়ি, বাংলাদেশে আর পাওয়া যায় না। আমার দু খানা ছিল, সবুজ আর কালচে লাল। দু বোনের দেয়া, কোথায় হারিয়ে গেছে! কিন্তু এখনো রয়ে গেছে সে ভালো লাগা, সেই গর্বিত মালিকানার রেশ। আমাদের যুগে সবচেয়ে “হট টয়” ছিল জু সেট আর সোলজার সেট, নিখুঁত সুন্দর ছিল, এমন কি সিংহ কিংবা ষাঁড় এর প্রাইভেট পার্ট টুকুও নিখুঁত মোল্ডে বানানো থাকতো। সব হারিয়ে গেছে, হারিয়েই যায়, স্থান, কাল, পাত্র সবই বুঝি হারাবারি জন্য!
আমাদেরস বাসা থেকে নিউমার্কেট মনে হত বুঝি গাড়িতে উঠলাম আর নামলাম, এত্ত কাছে! কই ছিল এই ট্রাফিক আর কই ছিল এত্ত মানুষ! রিক্সা দিয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো লাগতো, সদ্য বানান করতে শিখা আমি বড় বড় সাইন বোর্ড আর দোকানের নামগুলা পড়তে পড়তে যেতাম হকার’স মার্কেটের লাগাতার দোকান! এ, বি, সি হোসিয়ারি না এ, বি সিদ্দিক হোসিয়ারি একটা দোকান ছিল, সে নামটা এখনো মনে আছে, হয়তো তার গ্রাফিক্স টার জন্যে। দুষ্টু ছেলেদের মনে থাকার কথা এখনো। নিয়ন সাইন গুলো খুব ভালো লাগতো, জ্বলত নিবত কি সুন্দর! আর সন্ধ্যা হলেই সব মোটা মুটি শুন শান, এত্ত হট্ট মেলা ছিল না শহর টা। অত আর্কিটেক্ট, অত আরবান ডিজাইনার ছিলনা তবু অনেক সুন্দর ছিল সব। বাড়ি ঘড় গুলো অনেক সুন্দর ছিল, খোলা জায়গা ছিল,অমন দশ ফুট বাই দশ ফুট মাপা হাসি চাপা কান্না ছিল না আমাদের অন্দর মহল। পথে ঘাটে ডর ভয় বলতে কিছুই ছিল না তেমন। তবে একটা ভয় ছিল, সে এক বীভৎস ভয়! আমার নানার বাসা ছিল আজিমপুরের অরফেনেজ রোডে, সেখান থেকেই এসছিল ভয়টা। আজিমপুর গোরস্থানে তখন একটা লোক এর আনাগোনা ছিল, কলিজা খোর্‌ “কইলজা খাওরা খালিলুল্লাহ” নামেই সব্বাই চিনতো, দুপুরে না ঘুমালে, রোদরে খেলতে চাইলে, মোক্ষম দাওয়াই ছিলও এই খালিলুল্লাহ, দীর্ঘদিন ছিল ভয়টা, বয়সকালে বেচারাকে চাক্ষুস দেখে মায়াই হয়েছিলো। বার দুয়েক তার দেখা পেয়েছিলাম। যাক সে ভয় আর নেই, দুপুরে না ঘুমালে বলবার কেউ নেই, ঘুমাবার সময়ও নেই। বাবা বলতেন, এখন ঘুমাও না একদিন ঘুমাতে চাইবে সময় পাবে না, আসলেই, দূর দৃষ্টি ছিল উনার, ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন সামনে কি দিন আসছে। হায় এখন বুঝি ছুটির দিনগুলোও কাটে এমন নির্ঘুম দুপুর।
আমার স্কুল ছিল কলাবাগান ফার্স্ট লেনে, কাজিনরা সে স্কুলে পড়ত আমাকেও ভর্তি করা হল, বেশ মনে আছে লাল সুটকেইস নিয়ে হাজির হয়েছিলাম স্কুলে, বন্ধুরা ছিল মামদুদ, মোহাম্মদ আলী, মিলন, দেবনাথ ওরা হারিয়ে গেছে বহুযুগ। মিলন কে পেয়েছিলাম ক্লাস নাইন এ সে আবারও হারিয়ে গেছে। আজ আর কাউকে পাব না, তবু মনে পরে। তখন স্কুলটির বেশ নাম ডাক হচছিল তখন। ছোট্ট এক চিলতে খেলার মাঠও ছিল, ছিল একটা বিশাল ঝাউ গাছ । বদ্ধ ঘর গুলোতে ইরেজার, বাচ্চাদের টিফিন, আর ঘাম ঘাম একটা গন্ধ আটকে থাকতো, এখনো গন্ধটা পাই, এমন কি আমার ছেলেদের ক্লাসে গেলেও সেই একই গন্ধ পাই। কি যে অদ্ভুত লাগে। কোন মানে নেই তবু ভালো লাগে। আর আমার ইমিডিয়েট বড় দুই বোন পড়ত শের-ই-বাংলা গার্লস স্কুলে। কোন একদিন, হয়তো দিন দুএক আমি স্কুলে আসিনি স্কুল যে বন্ধ জানা ছিলনা, গাড়ী আমাকে স্কুলের গেইটে নামিয়ে বোনদের নিয়ে ওদের স্কুলে চলে গেছে, আমি গেইট খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি ওমা স্কুল বন্ধ! এখন! কি আর করা আমি বাসায় ফেরার পথ ধরলাম, কেজি ওয়ান পড়ুয়া আমি মিরপুর রোড পার হয়ে বাসায় ফিরলাম বীর বেশে, বেশ ভাব্লাম,সবাই বাহবা দিবে উল্টো কিনা বকাই জুটল, কেন স্কুলেই অপেক্ষা করলাম না। শুধু বাবাই বলেছিলেন “গুড”! ভাবা যায়! আর এখন তো মিরপুর রোড পার হতে দামড়া আমারই ভয় করে। সাধে কি আর “নিরাপদ সড়ক চাই”- আন্দোলন করতে হয় নায়ক কে।
শহরটা আজ ভয়ের শহরে পরিণত হয়েছে। অ্যারো টিভি সিরিয়ালে যেমন বলতো “ ইউ ফেইল্ড স্টারলিং সিটি”, বলেই একটা অ্যারো ছুড়ে দিত, এখন শহরের হয়েছে এই অবস্থা। ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত যেমন লিখেছলেন “রেতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকাতায় আছি” ঠিক সে রকম, দিনে ট্রাফিক রাতে ছিন্তাই, শুধু নয় তাই শুধু নয় তাই, গুম খুন আর রাহাজানি, সাথে পুলিসি হয়রানি... এর আর শেষ নেই। এক সময় ঢাকা ছিল “সিটি অফ মস্ক” এখন হয়েছে “সিটি অফ আগলি বিল্ডিংস”, দায়টা আমিও এড়াতে পারিনা একজন স্থপতি হিশাবে, তবে আপ্রান চেষ্টা করছি,তবে কোন মনিটরিং বডি না থাকলে যা হবার তাই হচ্ছে, যে যা খুশী বানাচ্ছে। গণচীন ঘোষণা দিয়েছে “নো মোর বিজার আরকিটেকচার”, আমাদের বোধোদয় কবে হবে কে জানে। আদৌ কি হবে? কিভাবে হবে আমরা মধ্যবিত্তরা পলায়নপর, যারা এক জেনারেশন আগে দেশ ত্যাগ করে্ননি তারা এই জেনারেশন দেশ ত্যাগ করছেন। যারা এখনো কিছু করে উঠতে পারেন নি তারা ভাবছেন এ দেশের কি হবে! এ শহর এ দেশ, সবার কাছে একটা প্ল্যাট ফর্ম, কে কখন কোন গাড়ীটা ধরবেন সে চিন্তায় অস্থির! একটা প্ল্যাট ফর্মের ভালো মন্দে কার কি এসে যায়, যে ঢাকা থেকে চিটাগং যাবে ভৈরবের ভালো মন্দে তার কি কাজ। গ্লোবাল হওয়া দূরে থাকুক, নিজের ঘরের বাইরে, নিজের পরিজনদের বাইরেই আমরা চিন্তা করতে পারিনা। এ সত্যি! গভীর সত্যি, এড়ানোর উপায় নেই! পালানোর পথ নেই!!

(২)
কখন বাসার পুলিশ কিংবা বড়দের ফাঁকি দিয়ে মোড়ের কনফেকশনারিতে যেতাম, কোন ভয় ছিল না শহরে,কত আর বড় তখন মেরিগোল্ড কিন্ডারগার্টেনে কেজি ওয়ান এ পড়ি। সবচেয়ে প্রিয় ছিল মিল্ক ভিটা চকলেট মিল্ক, আহা কি স্বাদ। এত্ত ভালো লাগতো যার আর পর নেই। আর আইস্ক্রিম ওয়ালার ঘ্নটির শব্দ, অমন মধুর ধ্বনি কমই ছিল। তখন সব এত আনায়েসেই পেতাম না। ভালো আইস্ক্রিম খেতে যেতে হত নিউ মার্কেটে, নভেলটি আইস্ক্রিম, কী সুন্দর ছিল, কাঁচ দিয়ে ঘেরা, ছোট্ট একটু দোতলাও ছিল, আইস্ক্রিম কাপ ভরা স্কুপটা দিত। আহা অমন ভালো জিনিশ, কদাচ জুটত। সে যুগে ছোটদের আইস্ক্রিম খাওয়া মানেই “হুম্ম ঠান্ডা লাগবে, টন্সিল ফুল্বে”।বায়না করার মত সুযোগ ছিল না তখন। নিউ মার্কেট ছিল যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মার্কেট, কী বিশাল। আর কী মজা! আমার নানা ছিলেন এই মার্কেট এর এঞ্জিনিয়ারিং টিম এর একজন, আর তাই ছোট্ট বেলা থেকেই বেশ একটা নিজের নিজের ভাব ছিল, সে অনেক আগে নানার দোকান টোকান ও ছিল, হাত বেহাত হওয়ার পরেও দু একজন তাঁর ভাড়াটিয়া ছিলেন, যেখানে প্রভুত খাতির যত্ন পেতাম, যার মুল একটা আকর্ষণ ছিল লাইটস এর “ক্রিম্- রোল”! এর সাথে আর কিসের তুলনা চলে, যারা খেয়েছেন তারাই জানেন। আর গেইটের বাইরে লোক গুলা বসে থাকতো বুঝি আমাদের জন্যই, ছোট ছোট, এরপ্লেইন, হ্যাজাক বাতি, গাড়ি, ভর্তি একমুঠো রঙ্গিন মৌরি, যেন এক মুঠো আনন্দ। আর ছিল “ম্যাচবক্স” এর গাড়ি, বাংলাদেশে আর পাওয়া যায় না। আমার দু খানা ছিল, সবুজ আর কালচে লাল। দু বোনের দেয়া, কোথায় হারিয়ে গেছে! কিন্তু এখনো রয়ে গেছে সে ভালো লাগা, সেই গর্বিত মালিকানার রেশ। আমাদের যুগে সবচেয়ে “হট টয়” ছিল জু সেট আর সোলজার সেট, নিখুঁত সুন্দর ছিল, এমন কি সিংহ কিংবা ষাঁড় এর প্রাইভেট পার্ট টুকুও নিখুঁত মোল্ডে বানানো থাকতো। সব হারিয়ে গেছে, হারিয়েই যায়, স্থান, কাল, পাত্র সবই বুঝি হারাবারি জন্য!
আমাদেরস বাসা থেকে নিউমার্কেট মনে হত বুঝি গাড়িতে উঠলাম আর নামলাম, এত্ত কাছে! কই ছিল এই ট্রাফিক আর কই ছিল এত্ত মানুষ! রিক্সা দিয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো লাগতো, সদ্য বানান করতে শিখা আমি বড় বড় সাইন বোর্ড আর দোকানের নামগুলা পড়তে পড়তে যেতাম হকার’স মার্কেটের লাগাতার দোকান! এ, বি, সি হোসিয়ারি না এ, বি সিদ্দিক হোসিয়ারি একটা দোকান ছিল, সে নামটা এখনো মনে আছে, হয়তো তার গ্রাফিক্স টার জন্যে। দুষ্টু ছেলেদের মনে থাকার কথা এখনো। নিয়ন সাইন গুলো খুব ভালো লাগতো, জ্বলত নিবত কি সুন্দর! আর সন্ধ্যা হলেই সব মোটা মুটি শুন শান, এত্ত হট্ট মেলা ছিল না শহর টা। অত আর্কিটেক্ট, অত আরবান ডিজাইনার ছিলনা তবু অনেক সুন্দর ছিল সব। বাড়ি ঘড় গুলো অনেক সুন্দর ছিল, খোলা জায়গা ছিল,অমন দশ ফুট বাই দশ ফুট মাপা হাসি চাপা কান্না ছিল না আমাদের অন্দর মহল। পথে ঘাটে ডর ভয় বলতে কিছুই ছিল না তেমন। তবে একটা ভয় ছিল, সে এক বীভৎস ভয়! আমার নানার বাসা ছিল আজিমপুরের অরফেনেজ রোডে, সেখান থেকেই এসছিল ভয়টা। আজিমপুর গোরস্থানে তখন একটা লোক এর আনাগোনা ছিল, কলিজা খোর্‌ “কইলজা খাওরা খালিলুল্লাহ” নামেই সব্বাই চিনতো, দুপুরে না ঘুমালে, রোদরে খেলতে চাইলে, মোক্ষম দাওয়াই ছিলও এই খালিলুল্লাহ, দীর্ঘদিন ছিল ভয়টা, বয়সকালে বেচারাকে চাক্ষুস দেখে মায়াই হয়েছিলো। বার দুয়েক তার দেখা পেয়েছিলাম। যাক সে ভয় আর নেই, দুপুরে না ঘুমালে বলবার কেউ নেই, ঘুমাবার সময়ও নেই। বাবা বলতেন, এখন ঘুমাও না একদিন ঘুমাতে চাইবে সময় পাবে না, আসলেই, দূর দৃষ্টি ছিল উনার, ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন সামনে কি দিন আসছে। হায় এখন বুঝি ছুটির দিনগুলোও কাটে এমন নির্ঘুম দুপুর।
আমার স্কুল ছিল কলাবাগান ফার্স্ট লেনে, কাজিনরা সে স্কুলে পড়ত আমাকেও ভর্তি করা হল, বেশ মনে আছে লাল সুটকেইস নিয়ে হাজির হয়েছিলাম স্কুলে, বন্ধুরা ছিল মামদুদ, মোহাম্মদ আলী, মিলন, দেবনাথ ওরা হারিয়ে গেছে বহুযুগ। মিলন কে পেয়েছিলাম ক্লাস নাইন এ সে আবারও হারিয়ে গেছে। আজ আর কাউকে পাব না, তবু মনে পরে। তখন স্কুলটির বেশ নাম ডাক হচছিল তখন। ছোট্ট এক চিলতে খেলার মাঠও ছিল, ছিল একটা বিশাল ঝাউ গাছ । বদ্ধ ঘর গুলোতে ইরেজার, বাচ্চাদের টিফিন, আর ঘাম ঘাম একটা গন্ধ আটকে থাকতো, এখনো গন্ধটা পাই, এমন কি আমার ছেলেদের ক্লাসে গেলেও সেই একই গন্ধ পাই। কি যে অদ্ভুত লাগে। কোন মানে নেই তবু ভালো লাগে। আর আমার ইমিডিয়েট বড় দুই বোন পড়ত শের-ই-বাংলা গার্লস স্কুলে। কোন একদিন, হয়তো দিন দুএক আমি স্কুলে আসিনি স্কুল যে বন্ধ জানা ছিলনা, গাড়ী আমাকে স্কুলের গেইটে নামিয়ে বোনদের নিয়ে ওদের স্কুলে চলে গেছে, আমি গেইট খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি ওমা স্কুল বন্ধ! এখন! কি আর করা আমি বাসায় ফেরার পথ ধরলাম, কেজি ওয়ান পড়ুয়া আমি মিরপুর রোড পার হয়ে বাসায় ফিরলাম বীর বেশে, বেশ ভাব্লাম,সবাই বাহবা দিবে উল্টো কিনা বকাই জুটল, কেন স্কুলেই অপেক্ষা করলাম না। শুধু বাবাই বলেছিলেন “গুড”! ভাবা যায়! আর এখন তো মিরপুর রোড পার হতে দামড়া আমারই ভয় করে। সাধে কি আর “নিরাপদ সড়ক চাই”- আন্দোলন করতে হয় নায়ক কে।
শহরটা আজ ভয়ের শহরে পরিণত হয়েছে। অ্যারো টিভি সিরিয়ালে যেমন বলতো “ ইউ ফেইল্ড স্টারলিং সিটি”, বলেই একটা অ্যারো ছুড়ে দিত, এখন শহরের হয়েছে এই অবস্থা। ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত যেমন লিখেছলেন “রেতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকাতায় আছি” ঠিক সে রকম, দিনে ট্রাফিক রাতে ছিন্তাই, শুধু নয় তাই শুধু নয় তাই, গুম খুন আর রাহাজানি, সাথে পুলিসি হয়রানি... এর আর শেষ নেই। এক সময় ঢাকা ছিল “সিটি অফ মস্ক” এখন হয়েছে “সিটি অফ আগলি বিল্ডিংস”, দায়টা আমিও এড়াতে পারিনা একজন স্থপতি হিশাবে, তবে আপ্রান চেষ্টা করছি,তবে কোন মনিটরিং বডি না থাকলে যা হবার তাই হচ্ছে, যে যা খুশী বানাচ্ছে। গণচীন ঘোষণা দিয়েছে “নো মোর বিজার আরকিটেকচার”, আমাদের বোধোদয় কবে হবে কে জানে। আদৌ কি হবে? কিভাবে হবে আমরা মধ্যবিত্তরা পলায়নপর, যারা এক জেনারেশন আগে দেশ ত্যাগ করে্ননি তারা এই জেনারেশন দেশ ত্যাগ করছেন। যারা এখনো কিছু করে উঠতে পারেন নি তারা ভাবছেন এ দেশের কি হবে! এ শহর এ দেশ, সবার কাছে একটা প্ল্যাট ফর্ম, কে কখন কোন গাড়ীটা ধরবেন সে চিন্তায় অস্থির! একটা প্ল্যাট ফর্মের ভালো মন্দে কার কি এসে যায়, যে ঢাকা থেকে চিটাগং যাবে ভৈরবের ভালো মন্দে তার কি কাজ। গ্লোবাল হওয়া দূরে থাকুক, নিজের ঘরের বাইরে, নিজের পরিজনদের বাইরেই আমরা চিন্তা করতে পারিনা। এ সত্যি! গভীর সত্যি, এড়ানোর উপায় নেই! পালানোর পথ নেই!!

(৩)
প্রায়ই একটা ঘটনা ঘটত, বিকাল কি সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠলে বুঝতাম না, সকাল নাকি বিকাল। কতক্ষণ মাথাটা ভোম হয়ে থাকত। এমনই এক বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখি আকাশে কি মেঘ! কি মেঘ! কি মেঘ!! গহন দেয়া একেবারে, ভোর কি সন্ধ্যা বোঝার উপায় নাই।এমন আচ্ছন্ন চারিধার। আমাদের ঘরখানা ছিল দোতলার টানা বারান্দার শেষ মাথায়, ঘর থেকে বের হয়ে বামে গেলেই বারান্দা শেষ, দু-তিন ধাপ সিঁড়ি নামলেই গাড়ীবারান্দা, গোল থাম বেয়ে একদিকে উঠে এসেছে বাগান বিলাশের বিশাল ঝাড়, ফুল ছিল কিনা আজ মনে নেই কিন্তু মেঘ ছিল আকাশে অমন মন কেমন করা মেঘ আর দেখেছি কিনা জানিনা, দিনটির কথা কেনই বা মনে পরে জানি না, তবে এখনো অমন মেঘ জমলেই সেই বিকাল কি সন্ধ্যা আমার মনে আসবেই। মানব জীবনের এই ত এক আক্ষেপ কোন কিছুর বিনিময়েও পাওয়া যাবে না এক দন্ড, কি পল, কি মুহূর্ত!
আকাশটা কি বিশাল ছিল, সবসময় ভাবতাম, যদি রাস্তার শেষ মাথাটায় একদিন পৌছাই নিশ্চয়ই আকাশটাকে ধরতে পারব। কাব্যি করলে বলতে পারি সে আকাশটা আজো অধরাই থেকে গেল। আকাশ অধরা থাকলেই কি বহু পথের শেষ দেখেছি। বহু কানা গলি, গলি ঘুপছি ঘুরে, সেই বায়ান্ন গলি, তেপান্ন বাজার এর ঢাকা আজ মেগা সিটি, এতে আপ্লূত হবার বিশেষ কিছু নেই, এ শুধুই জনমিতির খেল, ভানুমতির খেল। বড় ঈমাম্বারা, চামেরি হাউস, রোজ গার্ডেন, বড় কাটরা, ছোট কাটরা এগুলই শুধু ঢাকা নয়, সবচেয়ে বড় যা ছিল তা ঢাকার প্রান, বুড়িগঙ্গা। অনেক শহর দেখেছি, দেশে কিংবা বাইরে শহর গুলো কমবেশি কোন না কোন নদীর ধারে, যে গুলো খুব সতস্ফূর্ত শহর, আপন মনে বেরে গেছে, ম্যানহাটন এর মত গ্রীড আয়রন প্যাটার্ন নয়,( আড়াআড়ি আর দীঘলে চৌখুপি রাস্তাই হচ্ছে গ্রীড আয়রন প্যাটার্ন) কেতাবি ভাষায় স্পন্টেনেওয়াস গ্রউথ যাদের, নদীর ধার ঘেঁষে ঘেঁষে শহর চলেছে নদীও চলেছে শহর বেড়েছে, নদী তো বাড়েনি কিন্তু বেড়েছে নদীর নাব্যতা, নদীর রূপ, নদীর উচ্ছল যৌবন কে ধরে রেখেছে, কোটি কোটি মুদ্রার বিনিময়ে হলেও কারন এ নদীই যে শহরের প্রাণ। প্যারিসের “ ল্য সিন”, বারলিনের “ দ্য স্প্রী” নিউ ইয়র্কের “হাডসন”, অ্যাস্টারডেমের “অ্যামস্টেল”, মস্কোর “ভ্লগা”, আগ্রার “যমুনা”, কত্ত শত নাম আসছে মনে কিন্তু হায় এমন করুণ হতশ্রী, হতযৌবন, নদ কোথাও কেউ দেখেনি, এমন নিকষ কাল জল, এত পঙ্কিল, এত অবহেলিত নদী দ্বিতীয়টি বুঝি এই পৃথিবীতে আর নেই। কিসের হেরিটেজ! কিসের ডিজিটাল!! কোন ভায়াগ্রাও কাজে দিবেনা আর! এ যৌবন গেছে চলে! কোন সঞ্জীবনী সুধাই বুঝি কাজ করবে না। এ ক্যামন ধারা মানুষ আমরা বুঝি না! শহর শুধু উত্তরেই যাচ্ছে, যেতে যেতে সেই ঠেকল কোথায় তুরাগে, নদী বাঁচলেই শহর বাঁচবে! এ সহজ উপপাদ্য। নদী বাঁচবে কিনা জানিনা, স্বপ্ন বেঁচে থাকবে কিনা জানিনা, স্মৃতিরা বেঁচে থাকবে, সেই মেঘ মেদুর বিকেলটির মত। কত জল জমা হয়ে ছিল, এ শহর টিকে নিয়ে, আজ কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক খাড়ির দেখা পেয়ে তোরে ফুরে বেরিয়ে আসছে সব জল। এ শহরের আমি কেউ নই তবু এ শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু, আমার হার জিত, আমার লড়াই, ফুট নোটে লিখা শেষ না হওয়া কবিতা, কান্না হাসির ফোঁড়ন, সব সব সব-কিছু, পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছু পিছু।
পায়ে পায়ে চলতে চলতে কখন যে এ শহর পৌঁছে গেছে খাদের কিনারে , কেউ বুঝেই উঠতে পারলাম না। নব্বই পর্যন্ত বেশ একটা শ্বাস প্রশ্বাস নেবার মত সচল ছিল। রিক্সা করে অনায়াসেই যে কোন কোথাও যাওয়া যেত, বেশ ফুর ফুরে মেজাজে। মানুষ ও ছিল ম্যানেজেব্ল নাম্বারে। তারপর কি যে হল, কেউ কিছু বুজবার আগেই একেবারে তলানিতে এসে ঠেক্লাম।কি অদ্ভুত!
টিয়া পাখি গুলো এখন কোন আকাশে ওড়ে? সেই মেঘময় আকাশ দেখে কোন বালক-মন কি আর অবাক হয়! আকাশটা কোথায় গেলে আগের মত অতটা খোলা পাব যেখানে পথের সাথে মিশে গেছে? দুর্বিনীত দালান সারির ফাঁক ফোঁকরে, কিংবা টেলিগ্রাফের তারে লটকে থাকে আদখানা আকাশ, মেঘ দল অলখেই চলে যায়। বালকের জানালায় মেঘ বুড়োরা আর ফেলেনা কোন ছায়া, রবীন্দ্র নাথ কি সান্টাক্লজ কাউকে খুঁজে দেখার মত জানালা। আমদের ঘ্নটার পর ঘনটা কেটে যেত আকাশ দেখতে দেখতে, যেদিন স্কুল থাকতো না তাও ভোরে উঠে যেতাম, সেই গাড়ী বারান্দাটার সিঁড়িতে বসে আকাশ দেখতাম, হাতের টুথব্রাসের পানি শুকিয়ে জেত,কি যে ভাবতাম অত! আবার একটা তাড়া খেলে পরে ঢুকতাম টয়লেটে। চারখনা মরডান ব্রেড চ্যাপটা প্লেটে দুধ ঢেলে চিনি ছড়িয়ে দিতাম আর ডিম পোচ কি ডিম সিদ্ধ এই ছিল নাস্তা মা নেই বাবুর্চি মালেক ভাই কি খায়ের ভাই তাদের কাছেই হেঁশেলের ভার, এটা খাব ওটা খাব না, কোন সুযোগই নেই। তখন বিমাতা ভয়ঙ্করী উপস্থিত নেই দৃশে, বাবা ব্যস্ত, পলিটিক্স বলে কথা! বড় ভাই, সূর্য সেন হল -বাসা যাওয়া আসা করেন, বড় দু বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, মেজ ভাই যা একটু শাসন বারন করতেন, আর আমরা চারজন বিশেষত ছোট তিনজন তো বেশ স্বাধীন ভাবেই বড় হয়েছি! অত তো বিগড়ে যাইনি। নিজের মত হেসে খেলে বেড়ে উঠছিলাম, এর মাঝে এক উটকো বিপদ এসে হাজির, এক প্রাইভেট টিউটর, জানিনা কেন স্যার এর নাম দিয়েছিলাম আমরা স্যারমুখী স্যার কেজানে কি মানে! আমাদের পড়ার ঘরটা ছিল দের তলায়, সিঁড়ির ল্যান্ডিঙ্গে লাগোয়া আট বাই দস!দেয়াল জোড়া আকা ছিল “দ্য রিটার্ন অফ দ্য সেইন্ট” এর টিং টিঙ্গে শরীরের ছবি। আমার কীর্তি! এ ঘর টাতে বড়রা কেউ ঢুকতেন না, আমরা সুশীল তিনজনা একে রেখেছি দেয়াল জুড়ে, যা খুসি তা। টিভি তখন অমোঘ নিয়তি! এখনকার মতই তবে সারাক্ষন তো চলত না আর হিন্দি ওয়ালাদেরও অত দঔরাত্ত ছিল না! সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান দেখে দেখে কত্ত দুষ্টু ছেলেরা পা হাত ভাঙ্গল। দ্য রুটস, বাইওনিক অমেন, জেমেনি ম্যান, বিজে অ্যান্ড দ্য বেয়ার, ডবল ডেকার,অয়ান্ডার অমেন, লস্ট ইন স্পেইস, স্টার ট্র্যাক, হাওয়াই ফাইভ ও, মরক অ্যান্ড মিন্ডি, দ্য অয়াল্টন্স, লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরী, হাউ দ্য ওয়েস্ট ওয়জ ওউন আর ছিল মুভি অফ দ্য উইক। লেট নাইটে হত ডালাস, বড়রা দেখত আমরা মাঝে সাঝে চুপ করে বসে থাকতাম, যেন প্যামেলার দুঃখ বুঝি কিংবা জে আর কি দারুন অভিনয় করছে? আর ছিল সলিড গোল্ড, অ্যান্ডি গিভ কি বী জিস গাইলে কথাই ছিল না! পাপেট শো! এখনো দেখতে রাজি! সেসাম স্ট্রিট !! আহা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, গানটা বুঝি আমাদের জন্যই লিখা! আমরা যারা মিড সেভেন্টিজ কি আরলি এইটটিজ আমার কেন যেন মনে হয় আমরা বুঝি সবই পেইয়েছির দলে! সেই ছোট্ট বেলার হিল্ম্যান রেডিওগ্রাম থেকে শুরু করে, এল পি, ক্যাসেট পেড়িয়ে টাচ জেনারেশন এ চলে এলাম, বাবার খটখটে টাইপ রাইটারে কত্ত ফিতা প্যাচিয়ে পি এ সাহেবের বকা খেয়ে এখন সারফেস প্রও তে মাউস পিষছি! ভাবলেই ক্যামন এক ব্যাথার মত সুখ জাগে, হারান লেত্তি হারানো লাট্টু,ফেলে আসা আলো ছায়া সময় গুলি, কোথায় যে যায়! ভাবি যদি রাস্তাটার শেষটায় যেদিন পউছাব, যেখানে আকাশটা এসে আলগোছে নেমে গেছে, মিশে গেছে ধুলবালিদের সাথে, সেদিন বুঝি জানতে পারব, সময় কোথায় যায়! ছোট্ট যে গেছে সবার আগে বুঝিবা হাত বাড়িয়ে আছে হারানো সময়গুলি নিয়ে!

(৪)
এ শহরে প্রথম এসে উঠেছিলাম এম পি হোস্টেলে, শেরে বাংলা নগর । (যদিও লিখা উচিৎ শের ই বাংলা, কিন্তু আমরা শেরে বাংলা নগরেই অভ্যস্ত তাই এভাবেই লিখছি)। তখনো অনেককেই সেকেন্ড ক্যাপিটাল বলতে শুনেছি। সে সময়কার স্মৃতি আজ খুব বেশি জমা নেই, শুধু মনে আছে এরোপ্লেন উড়ে গেলে দৌড়ে বারান্দায় আসতাম, বড় বোনরা একটু অপছন্দ করতো, একী কান্ড এরোপ্লেন দেখলেই এমন করতে হয়, যতসব মফস্বলই কান্ডকারখানা, কিন্তু এরোপ্লেনের শব্দ হলেই দৌড়ে টানা বারান্দাটায় আমার চলে আসা চাই চাই। নীল আকাশটার বুক চিরে সোনালী ডানায় উড়ে যেত সে হাওয়াই জাহাজ, আমি আবাক দেখতাম, বড় বড় চোখ করে। খুব বেশি দিন সেখানে ছিলাম না, খুব অল্পসময়ের মাঝেই আমার বাসা পেয়েগিয়েছিলাম, এখন যেখানে গণভবন ঠিক তার পিছনেই, সারি সারি লাল লাল দোতলা বাসা, বাসার নম্বর ছিল এস টি এম সি ফাইভ, লুই আই কানের ডিজাইন, সে হিশেবে আমি ভাগ্যবান, কানের ডিজাইন এর সাথে পরিচয় হয়ে গেল সে শৈশবেই। কোন বাউন্ডারি ওয়াল ছিল না, পোর্টিকো তে নামলেই বিশাল দরজা, খুললেই ডবল হাইট স্পেইসে প্রশস্ত সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে, বামদিকে ড্রইংরুম আর ডানদিকে বিশাল ডাইনিং হল, সে দিক দিয়ে গারাজ আর সারভেন্ট কোয়াটারে যাওয়ার দরজা, এন্ট্রি থেকে সিঁড়ি তে না উঠে সোজা গেলে লন, সবুজ দূর্বা ঘাসে ছাওয়া, এক রত্তিও মাটি দেখা যেত না ! সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই গাড়ীবারান্দার দিকে মুখ করে ডানে বাবার ঘর, আমি রাত্তিরে সেখানেই ঘুমাতাম, বামে বড় একটা ঘর, বোনদের সিঁড়ির পাশ দিয়ে প্যাসেজ গিয়ে একটা টানা বারান্দা, বারান্দা থেকে বাবার ঘরে ঢোকার আরেকটা দরজা, বাম পাশে আরও ঘর কি স্টোররুম কি কিছু ছিল আজ আর মনে নেই, বারান্দা থেকে লনটা দেখা যেত। তবে সবচেয়ে অবাক করে ছিল আমায় মামুলি এক “কলিং বেল” ছোট্ট কালো গোল্লামত, লালচে কমলা বাটন, চাপ দিলে বিকট “ক্রং” একটা শব্দ হয়, কেউ এসে দরজা খুলে দেয়। এ জিনিশ ইহ জন্মে দেখিনি, আমাদের কিশোরগঞ্জের বাসায় এ জিনিশ তো ছিল না! কেউ এলে টিনের গেইটে কড়া নাড়ত। বাহ! কি দারুন জিনিশ, টিপ্লেই “ক্রং”! আমি আর আমার ইমিডিয়েট বড় বোন ব্যাক ইয়ার্ড দিয়ে এসে ক্রং একটা চাপ দিয়েই দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে যেতাম, সে এক মজার খেলা! আরও একটা খেলা খেলতাম, “পান্তা বুড়ি পান্তা বুড়ি”, টিভিতে তখন দেখাত পান্তা বুড়ি। আজকের তারানা হালিম তখন সেখানে অভিনয় করতেন মনে আছে, সে খেলার কি যে নিয়ম কি বা ফলাফল আজ আর নেই মনে, তবে মনে আছে বেশিরভাগ সময় জেন্ডার ডেস্ক্রিমিনেশনের কারনে আমাকেই চোরটা সাজতে হত। আর ছিল লুকোচুরি খেলা বড়রা বের হয়ে গেলেই, শুরু হত প্রলয়ঙ্করী সে খেলা।
এ বাসাতেই আমার প্রথম অক্ষর পরিচয় হয়, আমার মেজ ভাই এর হাতে। বেশ মনে আছে একটা ফুটবল আর একটা বই নিয়ে এসেছিল ও, একটা করে অক্ষর শিখতাম আর ফুটবলে লাথি দিতাম, সে ছিল চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়, বাসা ভর্তি মেডাল, আর পানি খাওয়ার জাগ মানেই তার খেলার পুরস্কার, এপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন না হলে ব্রাদার্সে খেলার প্রায় সব ঠিক হয়ে গিয়েছিলো, হয়তো ও ভেবেছিলো ওর মতই আমি হব। খেলা ধুলা বিস্তর করেছি, তবে দাবা ছাড়া কোনটাতে আর চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠিনি, গলায় কখন মেডাল পরিনি, তাই আমার ছেলে যখন প্রথম মেডাল পেয়েছিল ওকে নিয়ে গেছিলাম, ওর জেঠুর কাছে, আমি পারিনি আমার ছেলে জেঠুকে খুশী করেছে ঠিকি। বাবাও খুব খেলতেন, ঢাকা কলেজ আর মেডিক্যাল কলেজের ফুটবল টিমে ছিলেন, টেনিস খেলতেন, আর বাসায় আমাদের সাথে তাস কি দাবা খেলতেন, এক হাতে বই হিচকক কি সমারসেট মম কি দাবার বই- একাই দাবা খেলছেন আর আমদের সাথে খেলছেন রাশান স্ক্রু কি স্পেইড ট্রাম্প, সে এক দৃশ্য বটে এমন মাল্টি টাস্কিং আর দেখিনি খুব বড়!
আমরা খুব সকালে হাটতে বেরুতাম, সোহরওয়ারদি হসপিটাল তখনো কমপ্লিট হয়নি ওদিকেই বেশি যেতাম, খোলা খোলা মাঠ ছিল হাটতে হাঁটতে কখনো কৃষি কলেজের কাছেও চলে যেতাম কোথায় যেন বড় একটা পুকুর ছিল,জায়গাটা খুব বেশি মনে নেই আর আজ। এ পাড়ায় সব হোমরা চোমরা লোকজনরাই থাকতেন, শান্ত নিরিবিলি একটা জায়গা, বিকালে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সাইকেল চালাত মজা করে, পুরো পাড়া জুড়ে, সন্ধ্যায় আজানের পর সব শুনশান, গাড়ীবারান্দার হলদে আলো অলস পরে থাকে, গোল গোল গারডেন লাইটের ডোম, নির্বাক চেয়ে থাকে ব্যাঙের ছাতার মত। আমারও রাজ্যের ঘুম চোখে জড়িয়ে আসতো। কয়েলের গন্ধ আর বাবার শুনতে থাকা নাজাকাত আলির তানে আরও তলিয়ে যেতাম গভীর ঘুমে। তখনো স্কুল শুরু হয়নি আমার সবে অক্ষর পরিচয় হয়েছে, কিন্তু তাতে কি বাঘ মার্কা সিকি দিয়ে যে একটা আইস্ক্রিম কেনা যায় সে হিসেব শিখে গেছি,দুপুরে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন শুনব আইস্ক্রিময়ালার টুন টুন। সনি আইস্ক্রিম,অই সিকি দিয়ে একটা অরেঞ্জ ললি পাওয়া যেত। এমনই একদিন একখানা সিকি কি আধুলি নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন আসবে আইস্ক্রিউওয়ালা এরই ফাঁকে পয়সাটা মুখে নিয়ে চুষছি, হঠাৎ সুরুত করে পয়সা খানা চলে গেল, বাবা সে কি ভয়! বরই কি তেতুলের বীচি খেলেই গাছ হয়, মাথা ফুঁড়ে বের হয়, আমার না জানি কি হয়! সাহস করে কাউকে বলতেও পারিনা সইতেও পারিনা, কি যে উৎকণ্ঠা! তবে কবে যে হজম হয়ে গেছিলো টের পাইনি। আর আজকাল কি বলব আমার এক ভাগ্নের মেয়ে, এক টাকার কয়েন খেয়ে ফেলায় কি কাণ্ড! স্কয়ার হস্পিটালে দৌড়া দৌড়ী, নগত হাজার চল্লিশের ধাক্কা! বলি, একটা টাকার জন্য একটু বেশি খরচ হয়ে গেল না! ভাগ্নে পাংসু মুখে হাসে! আর আমদের যুগে সিকি আধুলি খাওয়া কোন বেপারই ছিল না। হাত পা ছিলে একসা দুর্বা ঘাস দু হাতে ডলে লাগিয়ে দাও কি একটু গাঁদা পাতা চটকে লাগিয়ে দাও। কিসের কি! বাবা বড় ভাইকে ডাকতে বলেছেন, দৌড়ে তিনতলায় উঠলাম নামার পথে দেড়তলা থেকে পা ফস্কে গড়াতে গড়াতে একতলা, মুভির মত, বাবার কাছে গেলাম কাঁপতে কাঁপতে, মুখে টু শব্দ নেই। বাবা বললেন কিরে কাঁপছিস কেন না তাড়াতাড়ি নামলাম তাই। ওসব ছোট খাটো বিষয় পাত্তাই দিতাম না! অত সময় কোথায়? বাবা খুবই খানেওয়ালা লোক ছিলেন, সেবার ময়মনসিং না কোথা থেকে এক কেরোসিন টিন ভরা শিং মাছ এসেছে,জীয়ল মাছ, খলবল খলবল করছে, না আমি ক’দিন আগেই জানলাম লবণ দিলে নাকি শিং মাছ মরে যায়, এটাই সায়েন্স, ওমন সুযোগ আর কই পাই? ঢালও ঢালও লবণ ঢালও! কি বিস্ময় সব মাছ মরে শেষ! দুপুরে খাওয়ার সময় মালেক ভাই এর ডাক পরল, বাবা ঠিক বুঝে গেছেন, মাছ তাজা ছিল না, মালেক ভাই দিরুক্তি না করে আসামি আমায় হাজির করল!, আমার সরল স্বীকারোক্তি আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছি! বাবা অবশ্যি আর কিছু বলেন নি, কে জানে কি ভাবেছিলেন, এ ছেলে বড় হলে নিশ্চয়ই ... কে জানে সে কথা আর হয়নি জানা!
ছেলে বড় হয়ে কিছুই হয়নি, সবার কামিয়াব কাবিল হলে চলবে দুনিয়া? দুনিয়া চলবে দুনিয়ার নিয়মে আর বাংলা চলবে দুনিয়ার বাইরের নিয়মে। ঢাকা সহ সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টনই আজ বাণিজ্যিক কার্জক্রম , বেলা দেড়টা থেকে না, দিন মান, অহোরাত। যার এতটুকুন জায়গা খালি সেখানেই কর একটা দোকান, যেন একটি বাড়ি একটি দোকান, শেষ নেই এর। কি দোকান? আলু, পটল, আনাজ পাতি, নয়ত আর এম সি, নয়ত সিডি! চলেন তো পাঠক আজ দুটো ভালো বই কিনি আপনার বাড়ির আস পাস থেকে, অই তো বই এর দোকান, বেশ! গাইড বই, ইংলিশ মিডিয়ামের গাদা গুচ্ছের বই, এর ফাঁকে ফোঁকরে, দুই চারটে হুমায়ুন কি আনিসুল হক, আরে আরও আছেতো, নির্লজ্জ ছায়া কপি, এক সময় রেইল ষ্টেশনে কিছু বই পেতাম, শংকর কি নিমাই কি আশুতোষ পাতলা ফেলে ফেলে কাগজে চড়া কালির প্রচ্ছদ তারই এক প্রতিচ্ছবি যেন আজ সব খানে এমন কি জ্ঞানকোষও আজকাল ওসব বিক্রি করছে। কে কিনবে বই, মুজতবা আলী নমস্য লোক কবে বলে গেছেন বই সেও একখানা আছে ঘরে! বই পড়বার সময় কই? আর পাইরেটেড হউক আর যা হউক কিছুই আসে যায় না। মুরি মুড়কির এক দর! দোকান আর বাসা, বাসা আর অফিস, অফিস আর বাজার, ছুটির দিনে লোকারণ্য খোলা জায়গা গুলি, দম ফেলার জায়গা নেই, ধুলায় অন্ধকার। খাঁচা থেকে বের হয়ে কোন খাঁচায় ঢুকবে লোকগুলি বাচ্চা কাচ্চা সমেত? চিরিয়াখানা, ও বাবা! ডাকাত ওরা! প্রথম খাঁচার পূর্বসূরিরাও আমাদের নিয়ে হাসবে। পাশেই বোটানিক্যাল গার্ডেন, খুব সুন্দর জায়গা, ছায়াময়, সুন্দর শীতল দীঘি, বসবার জো নেই এটা্র খেথে হবে ওটা খেতে হবে না খেলেও বিপদ খেলেও বিপদ, আক্কেল সালামী দিতে দিতে পালাতে হবে। কোথায় একটু খোলা জায়গা পাই? ছেলে পুলেদের নিয়ে একটু বেশ একটা পিকনিক করবার মত! নাহ নেই! স্মার্ট প্রেমিক যুগলদের বিনিমাগনা সিনেমার ভয়ে লেকের ধারে যাওয়ার উপায় নেই! একটা শহরের নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্রিন থাকতে হয়, বাঁচার জন্যই, অ্যামাজনকে বলে পৃথিবীর ফুস ফুস, আর এই শহরের ফুস ফুস, কি অবাক কোথাও নেই যা ছিল পেশি বহুল লোকেদের টাগ অফ ওয়ারে ছিন্ন ভিন্ন কিংবা অদ্ভুত আরবান ডিজাইনারদের গিনিপিগ হয়ে মুখ থুবড়ে পরে আছে।

লিখাটি শুরু করেছিলাম যে কারনে, কোন একদিন হাতির ঝিল দিয়ে গুলশানের দিকে যাচ্ছিলাম, নিকেতনের অবধারিত জ্যামে, ভয়ংকর নৌকোর স্কাল্পচারটার পাশে আটকে, সুন্দর শেষ বিকেল, আকাশে কনে দেখা লালচে রোদ, খুব ভাল্লাগছিল, হঠাৎ দেখি একটা ফুট ওভার ব্রিজ পেরিয়ে গেছে ব্যস্ত সড়ক, বেশ চওড়া সিঁড়ি আর খুব সুন্দর গ্রাফিক্স লাইনের এক র‍্যাম্প, বেশ, ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জদের কথা মাথায় রেখেছেন ডিজাইনার, ভাবতেই ভালো লাগে, দেখতে দেখতে চোখ নেমে এল নিচে যাকে বলে ডাউন টু দ্য আর্থ, চেয়ে দেখি র‍্যাম্পের শুরু ফুটপাতে কিন্তু ফুটপাত রাস্তা থেকে দেড় হাত উঁচু, হুইল চেয়ারে এসে একটা লোক র‍্যাম্পের গোঁড়ায় পৌঁছুবে কিভাবে? মেজাজ গেল খিচড়ে, কত্ত কত্ত টাকা খরচ হয়েছে এখানে , এ বিলাসিতার মানে কি? একই পয়েন্টে আপনি পউছাবেন একবার উপর দিয়ে, একবার নিচ দিয়ে তাই কি হয় নাকি? কার পকেট ভারি হল কেজানে? সেখান থেকেই অলস মাথায় এল কি সুন্দর একটা শহর ছিল ঢাকা! কলকাতা, ব্যাংকক আশির দশকেও লজ্জাবনত ছিল এই তিলোত্তমা নগর এর কাছে। হায় একটু যদি কেউ ভাবতো! আমি অবাক হই এক ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্রাফিক লুপের নক্সা করে আর বড় বড় কাগজে তা ছাপে, কেনও এমন হবে কেউ কি এ যন্ত্রণার দাওয়াই দেয়ার মত, আরবান স্কেলে কাজ করবার মত স্মার্ট নেই। তাহলে অত গুলি এঞ্জিনিয়ারিং স্কুল বন্ধ করে দেই, আমরা সবাই বুয়েটে কমার্স পড়ি। বাণিজ্যই সব! এ বানিজ্য বাতাসে সব ভেসে যাক, ভেসে গেছে অবিশ্যি এরই মাঝে। শহরের কানেক্টিভিটি লাগবে, কে বলবে, আপনি কমলাপুর কি মহাখালি নামলেন, তারপর? সবাই ঝাঁপিয়ে পর চলমান বাসে কেন এগুলি ট্রাফিক এক্সচেঞ্জ হাব হতে পারে না? পৃথিবীর প্রতিটি সিটিতে এমনই হয়, এমনটি হতে হয়!
কে শুনবে কার কথা... এখানে হাত দিও না, হাত দিও না গভীর অন্ধকারে...এ এক অদ্ভুত আঁধার! কেউ দেখবার নেই, বলবার নেই, বুঝবার নেই, নেই বুঝাবারও কেউ। আমার সে খোলা হাওয়ার শৈশব আমি কিভাবে দেই আমার অবুঝ বালকদের। ওরা তো দেখেনি কাকের বাসা পরে গেলে ক্যামন উতলা হয় সে জননী কাক! সেই ভাঙ্গা বাসায় হারানো ক্যাসেট কি হাতঘরি পাওয়ার বিস্ময় কি আর দিতে পারে এক্সবক্স আজ! ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে হাতের বিস্কুট সাহসী দাঁড়কাক। কসমস কি ডালিয়া ফুলে হলদে কালো প্রজাপতি দেখতে ক্যামন? বৃষ্টির পর গন্ধ ক্যামন সবুজ ঘাসের? ওরা পড়ে “কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে কোমল?” কিসের তরুলতা! আসে পাশে আতি পাতি করে খুঁজেও ওসব লতা পাতা দূরে থাক মুড়ানোর মত নটে শাঁকটিও খুঁজে পাব না। যত দূরে দূরে যাবে বন্ধু, একি যন্ত্রণা পাবে,একি ব্যাথা পুড়াবে তোমায়। তুমি বলবে “ এই খানে একটা অর্জুন গাছ ছিলনা?” উত্তর শুনবে “হ আসিলো কাইট্টা ফালাইসি”, কাট, ফেলো আর বানাও! ঘর বাড়ি দোকান বাজার। আলু বেচো, ছোলা বেচো আর পয়সা গুন! যে পয়সায় ভাবি আমরা কিনে নিতে পারি গোটা বিশ্ব! হায় কি বিস্ময়! নিউক্লিয়ার বোমা বুঝো, ভালোবাসা বুঝো না, বেঁচে থাকা বুঝো না!
যেদিন সব হবে বৃক্ষ নিপাত, নিঃশস্য হা হা কার চারিধারে, ছায়ারাও হারাবে পথ, কি হবে এই কাগুজে নোটে, কি হবে ধাতব মুদ্রায়! সুরম্য নগর, প্রশস্ত রাজপথ, চলমান জীবন থমকে দাঁড়াবে, মুখ থুবড়ে থাকবে পরে! এ আমার প্রতি তোমার অবহেলা! হে শহর! প্রানের শহর আমার! জাদুর শহর আমার!! এ লেখা তোমার তেষ্টার জল নয় জানি, নয় সঞ্জীবনই সুধা, অতটুকু বাড়বে না প্রবাহ প্রানের তোমার ধমনীতে, এ লিখা শুধুই আমার ভালোবাসা। মূল্যহীন এ প্রেম আমার খড় খুটোর মত উড়ে যাবে জানি! তবু আশায় বাঁধি বুক একদিন আসিবে বিস্ময়! আসবেই জানি!!
(৫)
মাঝে মাঝে খুব ঝড় জল হলে ছেলে বেলায় ফিরে যাই।
যদি খুব ভোরে বৃষ্টি হত, নিশ্চিত সেদিন বাসায় খিচুড়ি হত আর স্কুলে যাওয়া বাঞ্চাল! দিন মান তাস কি দাবা কি লুডু! আমাদের বাসাটি “মনোজদের অদ্ভুত বাড়ির” মতই ছিল খানিকটা। কত্ত লোকদের আনাগোনা আর কত্ত লোকেদের যে পাত পরত ইয়াত্তা নেই। তিন তলা বাসা ভর্তি লোকজন। আড়াই তলার গেস্ট্রুমে থাকতেন এক কাকা, বাবার মামাত ভাই, আর আমার সৎ এক মামা। বড় ভাইএর রুমে থাকতেন আমাদের এক ফুফাত ভাই। আরও দু চারজন থাকতেন গ্রাম সম্পর্কীয় আত্মীয়। মেঝ ভাই সদাই বন্ধু বৎসল দু চারজন ইয়ার দোস্ত তার থাকতোই, কোথায় যে খেত, কোথায় যে শুত, কে জানে? তাদের একজন কে দেখতে ঠিক আনন্দমেলার কমিকস “রোভার্সের রয়” এর রোভার্স এর মত ছিল। ঘার অবধি লম্বা চুল, সকাল হতেই হাতের দু আঙ্গুলে বুট ঝুলিয়ে যেতে দেখেছি খেলার মাঠে, কোন এক ক্লাবে খেলতেন তিনি। আরো আসতেন এক সময়ের হিট মুভির পরিচালক, তার গুঁফো মুখ, আর বুক খোলা শার্ট তাকে আমার চোখে চির যুবক করে রেখেছে! কত মামা চাচা, ভাই বেরাদর, আন্টি খালা, এখন তো বলে হ্যারিকেন দিয়ে খুঁজলেও দু চারটা অতিথি পাই না! এক জন আসতেন, “গুতুম মাছ”, কেন যে বেচারার এই নাম ছিল কে জানে। আরও আরও ছিল আনেকের কথা ভুলে গেছি, অনেকের কথা লজ্জায় লিখছি না, যাদের অনেক জ্বালিয়েছি, এই উসিলায় ক্ষমা চেয়ে নেই, অনেকেই নেই আজ। দিন আজ বদলে গেছে অনেক। কারুর সাথে আজকাল কারুর দেখা হয় না বড়। সে একটা সময় গেছে বটে! কি আনন্দ ছিল, এখনকার মত এত গ্লেমারাস না কিন্তু ফুর্তি ছিল ভরপুর। তবে সব কথার শেষ কথা আমাদের কাছে ছিল আমাদের বড় ভাই “শামিম” যাকে “শাইম ভাই” ডাকতাম, দ্রুত ডাকার কারনে শামিম হয়ে যেত শাইম। তাস খেলতে বসলে ওঁকে ট্রাম্প করতাম না। ব্রে খেল্লে রঙের ফোঁটা দিতাম না, যদি কখন বড়দের সাথে খেলার স্কোপ পেতাম! আমার চোখে মনে হত ইস শাইম ভাই কি লম্বা, হাত দিয়ে আয়রন কিঙ্গের আল্মিরার উপর থেকে জিনিষ নামিয়ে আনতে পারে। ইউনিভার্সিটির ছাত্র মানেই আমার চোখে এখনো এমনই ভাসে, হাল্কা পাতলা, লম্বা কোন এক যুবক! আমি ওঁর মত এমন মানুষ কমই দেখেছি। কি সৃষ্টিশীলতায়, কি ব্যাবহারে, কি ভাষায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময়ই তার নাটক বাংলা একাডেমির তালিকায় এসছিল, ছবি আঁকতেন ভালো, প্যান্টোমাইম করতেন, টিভিতে দেখেছিলাম তাঁর মূকাভিনয়। এমন কেউ নেই যে তাঁকে ভালোবাসতো না। যারা সবার ভালোবাসা পান তারা আল্লাহর ও প্রিয় পাত্র তাই তো তাকে অসময়েই আল্লাহ তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন, খুব অসময়েই! আসলে অসময় বলতে কিছু নেই, সময় হলে যেতেই হবে। সে অনেক হারিয়ে শিখলাম।
এমনই ভিড় ভাট্টায় বড় হয়েছি, কখন যে সময়গুলি আলগা বাঁধনে পেরিয়ে গেছে টের পাইনি অতটুকুও। জীবন সেতো পদ্মপাতার শিশির বিন্দু, মরুভূমির বুকে যেন বিষাদ সিন্ধু। বুঝে উঠার আগেই কোথায় এসে পৌঁছে গেছি, পিছনে কত টা পথ পেরিয়েছি, কতটা পথ আর আছে বাকী? সে এক অজানা অধ্যায়! সে কি এক বিপুল তৃষ্ণা, সে কি এক হাহাকার! এক অপার বিস্ময় এ জীবন! ক্যান্সাসের একটা গান “ডাস্ট ইন দ্য উইন্ড” যেটা স্করপিয়ন্স ও গেয়েছিল সে গানটিতে খুব সহজ কথায় জীবনকে ধরেছে...
“I close my eyes, only for a moment, and the moment's gone, All my dreams pass before my eyes, a curiosity,
Dust in the wind
All they are is dust in the wind
Same old song, just a drop of water in an endless sea All we do crumbles to the ground though we refuse to see
Dust in the wind
All we are is dust in the wind"
জীবন অতদূর এসে মনে হয়, হায় শুরু না হতেই বুঝি শেষের বাঁশি বাজার সময় চলে এল বলে! মনে হয় এইনা সে দিন স্কুল শুরু করলাম লাল সুটকেস নিয়ে। এই না সে দিন স্কুল পালিয়ে গেলাম লেকের ধারে, কলেজে উঠার উত্তেজনা এত সহসাই স্থিমিত হয়ে এল! কখন নিঃশব্দে সবার অলখে সময় যে চলে যায়, কেউ বুঝেও উঠতে পারি না। সময় কত ঘটনার, কত রটনার তাকে বোঝা দায়। ছোট বেলাকার ছোটো ছোটো ভুল, ছোটো ছোটো প্রাপ্তি, ছোটো ছোটো দুঃখ, ব্যাথা, কান্না, হাসি আজ এক বিশাল প্রাপ্তি। জীবন যেমনই হউক জীবন কিন্তু একটাই, তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বাঁচতে হবে, উপভোগ করতে হবে, ভোগ নয় , এর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। যদি কখনো বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতাম, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতাম, জানতাম রাত ভোর হবেই, আবার এক নতুন শুরু হবে, শুধরে নেয়ার কি ক্ষমা পাবার সুযোগ হয়তো আসবে। এমনই কত রাত কত দিন কত ছবি আঁকা হয়ে আছে, কিছু কিছু উজ্জল কিছু ধোঁয়াশা মাখা, কিছু ছিন্ন, কিছু প্রায় হারিয়ে যাওয়া। সেই ছবি গুলি না জোড়া দিলে একটা বেশ ছায়া ছবির মত লাগে, নিজের ছবিঘরের অন্ধকারে কখন আপনি চলে। অত ডিজিটাল না, বেশ ঘরঘরে পয়তিরিশ মিলিমিটারে প্রোজেক্টরটা চলছে। কিছু গান কি হারিয়ে যাওয়া সুর টুরও বেশ বাজে।
সে ছবিতে এ শহর টা ছিল জাদুর শহর! কি মেঘ, কি ঝকঝকে রোদ্দুর সবেতেই এ শহরটা ঝলমল করে হেসে উঠত। কৃষ্ণচূড়ার লাল তখন বুঝিবা আরও ছিল উজ্জল, রাস্তা গুলি ছিল অনেক ফাঁকা। তখন আমরা ধান্মন্ডির সরকারী বাসা ছেড়ে উঠে এসেছি, ইন্দিরা রোডে টি এন্ড টি এর পিছনে, স্কুল তখনো কলাবাগান, সেই কলা বাগান থেকে যদি রিক্সাওয়ালা কে বলতাম ইন্দিরা রোড লন্ডনির বাসা, রিকশা ওয়ালা ঠিক চিনে ফেলত। ভাবা যায়? ধান্মন্ডির খোলা হাওয়া, কিংবা শের এ বাংলা নগর এর লালচে ইটের কাব্য এখানে নেই, গলিটা তখনো কাঁচা, দু চারটে দালান পিছনে সারি সারি টিনের বাড়ী। গলি থেকে বের হয়ে একটু এগিয়ে ডানে গেলেই এক মাঠ লালচে এঁটেল মাটির, এবড়ো খেবড়ো মাঠটা পেরুলেই ফিরোজা রঙের গেইট ওয়ালা একটা বাসা, সিরামিক ইটের, ওটা টেলি সামাদ সাহেবের বাসা, তখন তিনি তুমুল জনপ্রিয়। বাসাটি হাতের ডানে রেখে বামের রাস্তা ধরে চলতে থাকলে একটা সুন্দর স্কুল ছিল বাগানঘেরা, দোলনা ছিল, সি-স ছিল আমরা তখন সি-স কে ঢেঁকিই বলতাম। রোজার সময় সেহেরি খাওয়ার পর সবাই ঘুমিয়ে পরলেই আমি আর শার্মীন ( ইমিডিএট বড় বোন) বেরিয়ে পরতাম সাথে থাকতো আমাদের গ্রামের এক মেয়ে, কত আর বড়, হয়তো উনিশ কি কুড়ি বছর তার। হাঁটতে বেরিয়ে যেতাম, টি এন্ড টির পিছন দিয়ে সোজা ফারমগেইটের দিকে রওয়ানা দিতাম এখন যেখানে কালিন্দী এপার্টমেন্টটা ঠিক সেখানে কিংবা রাস্তার উলটো দিকের বাড়ীটাতে বিশাল এক বকুল গাছ ছিলও ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এক বকুল গাছ! কি উঁচু! ফুলে ফুলে ভরে থাকতো আর ঝরা ফুলে সাদা হয়ে থাকতো রাস্তা আমার পকেট কি শার্টের কোচর ভরে সে ফুল নিয়ে আসতাম, বোনের পরনে থাকতো ফ্রক তাই তার কুড়ানো ফুলই বেশি থাকতো। বাসায় ফিরে বারান্দায় বসে আমরা মালা গাঁথতাম, সূঁচটা আমি হাতে পেতাম না শলার ঝাড়ুর কাঁঠি দিয়ে মালা গাঁথার টেকনিকটা আমাদের গাঁয়ের মেয়েটাই শিখিয়ে ছিল। তার নাম ছিল যামিনি। দীর্ঘদিন আমাদের সাথেই ছিল, কাজের মেয়ে কখনই ভাবিনি, বেশ আপনার জন হয়েই ছিল আমৃত্যু, বহু বছর পর কঠিন ক্যান্সারে কাঠির মত হয়ে গিয়েছিলো সে, আমি গ্রামে এসছি শুনে, লাঠি ভর করে ঠিক হাজির হয়ে ছিল,সেই তিনজনার একজন। সেই তিনজনার মাঝে দু’জনাই আজ নেই। ভাবলেই মনটা হু হু করে উঠে। এত সহজ অনায়েস এ চলে যাওয়া! এতই কিঞ্চিৎ আমাদের এ জীবন! যে বিরাট শিশু খেলিছে এ বিশ্ব লয়ে সেই জানেন এত কেন মায়া! হারাবো জেনেও কেন সব কিছু ধরে রাখবার এ উদগ্র বাসনা? এ উত্তর জানি একদিন পাবো নিশ্চয়ই।
যখন ভাবি, অবাক হই কি নিরাপদ ছিল এ শহর একদিন। শিশু বান্ধব, ভয় নেই ডর নেই কোন। কোথায় কোথায় চলে যেতাম আমরা! সে এক অদ্ভুত সময় ছিল সুন্দর! এ বাসাটা ভাড়া নেবার আগে আমি আর বাবা দেখতে এসছিলাম, সাড়ে তিলতলা দালানের দোতলা বিশাল ফ্ল্যাট, পাঁচ-ছ খানা শোবার কামড়া, বিশাল গ্রিল দেয়া টানা বারান্দা। বারান্দার শেষ মাথায় সারভেন্ট কোয়াটার যেখানে, সেখানে কেন যেন উপর দিকে গ্রিলটা এক্টুকুন ফাঁকা। সে দেখে আমি বলি বাবা এইদিক দিয়ে তো চোর আসবে,বাবা হেসে বললেন চোর আসার আগে তুমিই এদিক দিয়ে পালাবে। কি অবাক কান্ড ঠিক তাই হল! কোন এক রবিবার, তখনো রবিবার ছুটি ছিল, দুপুরের খাবার পর সবাই যখন বিছানায় একটু গড়িয়ে নিচ্ছে সে ই ফাঁকে ওই ফাঁক গলে আমি বেরিয়ে এলাম, প্রায়ই এটা করতাম, পাশে ছিল রুমিদের বাসা, আমি ক্লাস ওয়ান আর ও তখন ক্লাস ফাইভে কিন্তু খুবই বন্ধু ছিলাম আমরা,ওই রুমিদের বাসায় চলে আসতাম, কত গল্প যে হত আর ওদের বাসায় ছিল লেডিবারডের বই, কি সুন্দর আলাদিন, কি বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট বানান করে করে পড়তাম, কি যে সুন্দর ছিল ইলাস্ট্রেশন গুলি, এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে! সে রবিবারটি আমার ছিল না! ছুটির দিন, বিমাতা উনার বাবার বাড়ী গেছেন যা কালে ভদ্রে যেতেন, যা হউক গেছেন, বাবার ডাক পরল শোবার জন্য, আমি নেই! সদর দরজা বন্ধ, কেউ খুলেনি আটকায়ও নি। খোঁজ খোঁজ,কই গেলো পাজিটা! প্রথমেই রুমিদের বাসা রোঁদ হল, কিন্তু দুই বন্ধু তখন, ওদের বিল্ডিঙের এক সাইডে বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে বসে রাজ্যের গপ্পো করছি, বাসার লোকরা এসে ফিরে গেল, বাবা খুঁজতে খুঁজতে নাকি ফারমগেইট চলে গেছেন, বোনেরা কান্না জুড়ে দিয়েছে!এদিকে আমি নিশ্চিন্তে গল্প করছি!আমার তো জানবার কোন উপায় কি কারণ কোনটাই নেই। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ বাসার কাজের লোক আমাদের ওখানে উঁকি দিলো আর আমাকে পেয়ে গেলো। ভয়ে ভয়ে মুখ চুন করে বাসায় এলাম, বাবা অবাক করে বললেন কোন দিক দিয়ে বেরিয়েছিলে, আমি বারান্দায় নিয়ে ফাঁকাটা দেখালাম, বাবা মুচকি হেসে কানটা একটু মুচড়ে দিলেন, “যাও শুতে”, আমি শুতে গেলাম সুরসুর করে, এদিকে টিভিতে টারজান শুরু হয়ে গেছে মন উশখুশ করছে, “বাবা যাই?” বই পড়তে পড়তে গম্ভীর উত্তর “না, চোখ বনধ কর”।আধেক খোলা চোখে দেখি বাবা পড়ছেন, বিশাল টেরডাক্টাইলের ছবিওয়ালা এক বই,দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড, বহু বছর পর যা আমার অনেক প্রিয় হয়েছিলো। মনে আছে শেষ মেশ বহু কষ্টে ছুটকারা পেয়েছিলাম। জনি ওয়জ মুলারের সেই টারজান জাদুর মত এখনো আমাকে টানে। সেই থেকে হুট হাট বের হওয়া বন্ধ হল, বিকালে ছাদে উঠতাম বাড়ীওয়ালার ছেলেদের সাথে একটু মাঝে মধ্যে টেবিল টেনিস খেলতাম, আর তখনি শুরু হল ঘুড়ী উড়াবার নেশা, সে অমোঘ নেশা এখনো কাটেনি, ছেলেদের দোহাই দিয়ে দিব্বি এখনো উড়িয়ে যাচ্ছি ঘুড়ী। বৃষ্টি হলে মনে হত ইস যদি আমার প্লাস্টিকের একটা ঘুড়ী থাকতো! প্রায়ই ভাবতাম বড় হলে একটা ঘুড়ী উড়াবার যন্তর বানাবো, আর সব ঘুড়ী কেটে সাফ করে দিবো। মনে আছে পাঞ্জা কি হাতুরি মার্কা সুতা কিনে মাঞ্জা দিতাম, আমাদের বাসায় তখন ছিল ইস্রাইল নামে বাবুর্চি সেই উস্তাদ, সেই সব করত, কি কি যোগার যন্তর যে করত, উলট কমল, গজ ইত্যাদি অনেক অনুপান আজ মনেও নেই, বাবা কুড়ি টাকা দিয়েছিলেন, ডজন খানেক ঘুড়ী আর মাঞ্জা টাঞ্জা দেয়ার পরও বেশ কিছু টাকা রয়ে গিয়েছিলো, ফারমগেইটে গিয়ে “সুহানি” খেয়েছিলাম, দু জনে মিলে। তখন ফারমগেইটের মার্কেটটা বেশ খোলা মেলা লাগতো আর অনেক দোকানেই সবুজ কমলা নেশেস্তার হালুয়া বিক্রি করতো, আমার দেখতে বেশ লাগতো! সেই ইস্রাইলের কাছেই ঘুড়ী উড়ানোর যত প্যাঁচ পয়জার, আর ঘুড়ী বানানো শিখেছিলাম! শুধু তাই ই নয়, বড়দের জীবনের অনেক পাঠই সে আমাকে দিয়েছিল, সেই অবুঝ বয়সেই, আমি খেলাধুলা আর পড়াশুনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতাম তাই ওই কথার মানে কিংবা প্রভাব এতুকুও আমাকে স্পর্শ করেনি। আজ আমি যখন পিতা আমাদের ছেলেদের ড্রাইভার কি আমার অফিসের পিওনদের সাথে কোন সংশ্রবে আসলে আমি সাবধান থাকি, যে পাঠ আরও পরে হলেও চলবে তা তার এখনি জানবার দরকার নেই, দরকারে আমিই বলব! এখনকার পাঠ্য পুস্তকের এই আজানা জিনিশ নিয়ে উতসুক তৈরি করা, আমার কাছে পাগল কে সাঁকো নাড়াতে নিষেধ করার মতই লাগে! অঁরি দ্য ভেরের ব্লু লেগুনে সেই দুজনা কিন্তু জীবনের পাঠ আপনি আপনি শিখে নিয়েছে। না দরকার পরল কোন ইস্রাইলের না কোন অপরিপক্ক পাঠ্য পুস্তকের। এ তো অমোঘ নিয়তি, গাছের পাতা যেমন আসে, কলিরা যেমন ফুল হয়ে উঠে সহজ আনায়েসে, এ ও তেমনি।
ঘুড়ীর নেশা ছাড়া আর এক নেশায় তখন আমায় পেয়ে বসেছে, টেবিল টেনিসের নেশা। আমি ছোট তাই বাড়ীওয়ালার ছেলেরা সবসময় আমায় খেলায় নিতে চাইত না, তাতে কি? আমি দিন মান খেলতাম কখন পিং পং বল হাত দিয়ে মেরে মেরে কখন নেভিয়া মিল্কের প্লাস্টিক কন্টেইনার দিয়ে, যেটার আদল অনেকটা টেবিল টেনিসের ব্যাটের মতই ছিল। আমার তখন ব্যাট ছিল না প্রথম ব্যাট কিনি ক্লাস সেভেন এ পঁচাশি টাকা দিয়ে, ডাইরি তে লিখেছিলাম, রনপলেঙ্কের এক খানা ছোটো নীল নোট বুক ছিল আমার, লিখেছিলাম “আজ আমার একটা স্বপ্ন পুরন হল” আহা কি সহজ স্বপ্ন, এই স্বপ্ন গুলো নিয়েই এ জীবনটা বেশ কাটিয়ে দিলাম। একখানা কবিতা ছিল “চয়নিকা” পুস্তকে, “শীতের শেষে গিয়েছিলাম বাদাম তলির মেলা, একটি মোটে পয়সা দিয়ে কাটিয়ে দিলাম বেলা”, এ জীবনের সহজিয়া দর্শন! আমি এ দর্শনেই বিশ্বাসী, ছোটো ছোটো এ স্বপ্ন গুলিই আমাদের জীবন কে ভরিয়ে তোলে, হাজার রঙ্গে সাজিয়ে তোলে, আর বড় স্বপ্ন পূরণে সাহস যোগায়। এ নেশাটিও আমার এখনো রয়ে গেছে নিজের বাসা তাই ডিজাইন করবার সময় বিশাল এক ফাঁকা জায়গা রেখেছি, ছেলে দুটো একটু খেলাটা শিখলেই পেতে ফেলব টেবিল! আর ওই বাসাতে আরেকটা নেশা ধরিয়ে ছিলেন আমার বড় ভাই! উনিও নেশাগ্রস্থ! তা যাক সেবার পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় হই, আমি জীবনে এক বারই কোন পরিক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলাম,(কোন পরিক্ষাতেই আমি প্রথম হইনি জীবনে!), সে উপলক্ষে শাইম ভাই তিনটে বই দিয়েছিলেন, সুন্দর হাতের লিখায় লিখেছিলেন, “অনেক বড় ‘হ”! কত আর বড় হতে পারলাম! বই গুলি ছিল “কিন্ডার গার্টেনের জীবনী”, “জিনহুয়া” আর একখানার নাম মনে নেই কি যে সুন্দর ছবি ওয়ালা চাইনিজ বই গুলা ছিল!জখের ধনের মত আঁকড়ে রেখেছিলাম, কিন্তু এত ওলট পালট ওয়ালা জীবনে আনেক কিছুর সাথে সেগুলোও কই হারিয়ে গেছে! মানুষই হারিয়ে যায় আর এত সামান্য বই! যাক সে নেশায় আমি আজো আচ্ছন্ন, জীবনে কত কিছুর আলোতে যে বই পড়েছি রাত গভীরে। কত রাত যে ভোর করেছি আর এখনো করছি তার গুনা গুন্তি নেই! সে বই গুলি ছিল যেন এক একটা স্বপ্ন! চাইনিজ আর রাশান আর মুক্তধারার বই!
দুটি বেড়াল ছানা, চুক আর গেক, তোর কি সূর্য আছে, জাদুর পেন্সিল, সিংহ আর ইঁদুর, আরও আরও অজস্র। প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো! এ লেখাটি দেখলেই মনটা আনচান করে উঠে এখনো! মুক্তধারার ছিল খাজা খোর রাজা, এক যে ছিল সাদা ঘোড়া, পুপুর মুমু, শেষ হবে না লিখে, আর ছিল রুস দেশের উপকথা, সব বই এর রাজা! “সিবকা বুরকা জাদু কি ল্যাড়কা সামনে এসে দাঁড়া”...সে কি ভুলবার! কি ইলাস্ট্রেশন আর ছিল ছোটো সাইজের আনন্দ মেলা, কারুর মনে আছে কিনা জানিনা, তবে আমার কাছে এক খানা কপি এখনো আছে! তার একটা কবিতা এই ফাঁকে লিখছি,”এই সেরেছে হারিয়ে গেছে পড়ার বই আর অঙ্ক খাতা ,খাটের পরে রেখেছিলাম খুঁজতে গিয়ে ঘুরায় মাথা”, অনেক শব্দ হারিয়ে গেছে কিন্তু ছবিটা হারায়নি! এই হারনো কি খুঁজে পাওয়া এ ও এক অদ্ভুত নেশা। অনেকেই আজ বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা আমি ক্লাস থ্রি তেই রবিবাবুর “গ্লপগুচ্ছ” পড়ে ফেলেছিলাম, আর আনন্দমেলার প্রথম যে পূজা বার্ষিকীটি হাতে পেয়েছিলাম সেখানে ছিল শীর্ষেন্দুর “গোঁসাই বাগানের ভুত”, আশা পূর্ণার “গজ উকিলের হত্যা রহস্য”, শৈলেন্দ্রর “টোরা আর বাদসা”; সত্যজিতের “ প্রোফেসর শঙ্কু” ; সুনিলের “ডুঙ্গা”। কমিকস ছিল শরদিন্দু বাবুর! ওই বয়সে এত্ত আনন্দ আর কেউ পেয়েছে কিনা কে জানে! এর কিছুদিন পরেই পড়েছিলাম, “ইস্পাত”, নিকলাই অস্ত্রভস্কির, নিজেকে পাভেল ক্রচাগিনই ভেবে গেলাম সারা জীবন, আর তনিয়া আমার প্রথম ক্রাশ। সেই লালচে গাল নিয়ে লেকের ধারে বই পড়া তনিয়া আর পাভেল ক্রচাগিনের সেই একশন, “ আপার কাট, একটা মোক্ষম আপার কাট”, কোথায় পাভেল? এ তো আমি! এই আমি কখন পাভেল; কি কখন কিশোর পাশা, এই যাপিত জীবন নেহাতই মন্দ নয় কখন কখন!
এ কিস্তি শেষ করবার আগে আমাদের ইন্দিরা রোডের বাড়িওয়ালীর দু চারটি কথা না বললেই নয়। যে হেতু তারা লন্ডনি তাদের কেতা ছিল ভিন্ন, ছেলে মেয়ে দুটি গ্রিন হেরাল্ডে পরত বেশ ইংরিজিতে কথা বারতা কইত, আন্টিও তাই অপচেস্টা করতেন তবে অতটা তো পারতেন না ভালও, শুধু বলতেন “দিস গুলি নিয়ে যাও, দ্যাট গুলি আন” বলে আমাদের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়াতেন, সেইপ্রথম ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়া! আর তাঁদের মেয়ে ছিল, আমার বোনের সাথে একি ক্লাসে পরত ওর নামও ছিল সারমিন আমরা ডাকতাম “উতাসা” মানে উপরের তলার সারমিন। কোথায় তারা, নেই আজ কোন খবরে। তবুঅ,মাঝে মাঝে কানে বাজে “দিস গুলি নিয়ে যাও, দ্যাট গুলি আন”। নাহে এ যাপিত জীবন নেহাতই মন্দ নয় একদম!


(৬)
ধান্মন্ডী বাসার তিন তলাতে ছিল আমাদের গেস্ট্রুম। বেশ বড় খোলামেলা, দুটো স্প্রিঙ্গওয়ালা, খাট বেশ বড় সেক্রেটারি টেবিল, খান দুএক চেয়ার। সে রুমের মোটামুটি পার্মানেন্ট একজন গেস্ট আমার এক সৎ মামা, আর প্রায় সময়ই আসতেন আমদের এক কাকা, বাবার মামাত ভাই। তা দুই বিয়ান ওই ঘরেই ঘুমাতেন, আর দিনমান ঘর ফাঁকা পরে থাকত। কোন এক মিষ্টি ভোরে আমি হানা দেই ওই ঘরে সঙ্গে কেউ একজন ছিল ঠিক মনে নেই, ঘর ফাঁকা, কেউ নেই, কি এক দুষ্টু বুদ্ধি এল মাথায়, টেবিলে উঠে, কোমরের বেল্ট খুলে বাঁধলাম ফ্যানের পাখায়, ভাবলাম এবার সুইচ অন করলে বুঝি বেশ বন বন করে ঘুরবো, যেই চিন্তা সেই কাজ, বেশ কষে বেল্টটা বেঁধে সাথে যে ছিল তাকে বললাম সুইচ টিপতে কিন্তু বিঁধি বাম টেবিল ছাড়িয়ে পা শুন্যে আসতেই পপাৎ ধরণীতল, কপাল গুনে হাড়হাড্ডি কিছু ভাঙ্গেনি।
সে রুমের আরেক ভয়াবহ স্মৃতি আছে, যে কাকার কথা বললাম উনি বাবার মামাত ভাই,বাবার নানা এলাহি নেওয়াজ খান ছিলেন নেত্রকোনার বিখ্যাত উকিল, একনামে সবাই চেনে সম্ভবত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্রথম মুস্লিম গ্র্যাজুয়েট উকিল। সেই মন্টু কাকাকে একবার কি নাজেহাল হতে হয়ে ছিল ভাব্লে এখনো লজ্জা পাই, তবে ভাগ্য ভালো শার্মীনের (আমার ইমিডিয়েট বড় বোন) সাথে কাকার শেষ দেখায় সে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলো, আমি যেহেতু ওর চ্যালা হয়ে অপারেশন এ ছিলাম আমি অটো ক্ষমা পেয়েগেছি নিশ্চিত, না হলে এই ফাঁকে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। একদিন আমি আর শার্মীন সকাল সকাল গেস্ট রুমে গেলাম কিছু একটা খুঁজতে কেউ নেই ঘরে, হঠাত শুনি লাগোয়া বাথ্রুমে পানি পরার শব্দ, মুহূর্তে দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল, দিলাম আমরা বাইরে থেকে ছিটকিনি আটকে, প্ল্যানিং ছিল কিছুক্ষণ আটকে রাখার কিন্তু এর মাঝে নিচ থেকে ডাক আসায় আমরা চলে এলাম আর বেমালুম ভুলে গেলাম আর এদিকে কাকা, “ছুটির ঘনটা”। কাকার ট্রেইন মিস। পরে উদ্ধার পেয়ে তার সে কি রাগ দোষ পরল তার বেয়ানের উপর আমরা বেমালুম চেপে গেলাম সব।
বেচারা আমার সৎ মামা! আমার বিমাতা ভয়ঙ্করীর ভাইদের মাঝে একমাত্র ভালো মানুষ এবং ফানি! একদিন এসে আমাদের বলছে তোমরা “মামা বাবা বাবা মামা” গানটা শুনছো? আমরা তো কিছুই বুঝি না ও বাবা এ কেমন গান। অবশেষে উদ্ধার হল এটা বনিঅ্যামের “বাহামা মামা” যাক বাবা উদ্ধার হল। সেই মিড এইটিস, বনিঅ্যাম, অ্যাবার বিশাল ক্রেইজ, যেখানেই যাই সেখানেই তাদের সিগনেচার টিউনগুলি কানে বাজে, বি জিস, অলিভিয়া নিউটন জন, আর পরে লরা ব্রানিগান সুপার হিট সব গান, এখনকার মত শুধু হিন্দি গান হিট করে তা না, ইংরেজি গান ও আম জনতার কাতারে ছিল। হিন্দি গান তখনো ছিল, সেই সময় হিট ছিল “আপ জেইসা কয়ি” কিংবা কুরবানি কুরবানি এইসব আর স্ম্যাশ হিট ছিল “ম্যারে আনাগানেমে”, বড়দের ভাষায় এ গান টা খুবি অশ্লীল ছিল, ভাবলে অবাক লাগে আজ কালকার লিরিক্সের তুলনায় এ নেহাতি দুগ্ধ পোস্য। গানের কথা উঠলেই আমার বাবার কথা মনে পরে যায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে অন্য ছবি।
খুব সক্কালবেলা ঘুম ঘুম চোখ মেলে দেখতাম, বাবা উঠে গেছেন, জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে আলোর রেখাগুলি ঘরে ঢুকছে, লাইনগুলিতে অজস্র ধুলি, কি সুক্ষ বালিকণাগুলি উড়ছে, ভাবতাম বুঝি শুধু আমিই এসব দেখতে পাই, অপলক নয়নে দেখতাম, এরি মাঝে হিল্ম্যান রেডিও তে বাবা চালু করে দিতেন বিনাকা গীতমালা, আমিন সায়ানির সুমধুর কন্ঠ, যাকে অনুকরণ করেই আমাদের প্রথম হিট আরজে নাজমুল হুসাইন তার “হাঁ ভাই” সিগনেচার আইটেম দিয়ে বাংলাদেসের মানুষের প্রিয় হয়ে আছেন। বিনাকা গীতমালা যেন প্রতিটি ভোরের সঙ্গী, কি সব গান, আর অবধারিত ভাবে শেষ হত কে এল সায়গলের গান দিয়ে, বাবাও গাইতেন গুন গুন করে, শেষ গানটা তখন মোটেও ভালো লাগতো না, এখন সেই সায়গলের গানে খুজে ফিরি সেই মায়াময় দিনগুলি। আমার প্রথম যে গানটি প্রিয় হয়েছিল সেটি “ তান ডোলে মেরে মান ডোলে” হেমন্ত কুমারএর হিট কম্পোজিশন, আর বাংলার মাঝে “ও বাক বাক বাকুম বাকুম পায়রা” সেটি ছিল অনুরোধের আসরের গান, খুব সম্ভব ছবিটিও এ দেশে মুক্তি পেয়েছিল। সেই থেকেই দুই সন্ধ্যাই আমার প্রিয়। বাবা অস্মভব গান পাগল ছিলেন, মায়ের গানের খাতায় বাবার হাতে লিখা অনেক গানের কথা লিখা আছে। আমার কাকার কাছে শুনেছি ঢাকা মেডিকেলে পড়বার সময় বেহালারো নাকি তালিম নিয়ে ছিলেন। ঝিম ধরা কোন কোন দুপুরে বাবা বাসায় থাকলে বাবার চুল টানতে টানতে কত কিছু শুনতে হত, কখন রবি শঙ্কর, কখন বাড়ে গোলআম আলি কি চাইকভস্কি তখন কি আর বুঝতাম খালি ঘুম পেত। অনেক কাল পরে বাবা যখন কালচারাল মিনিস্টার নিজ উদ্যোগে নিয়ে এসেছিলেন উস্তাদ সালামাত আলি আর নাজাকাত আলি সাহেব কে, আমাদের বাসায়ও গেয়ে গেছেন তারা, এখন পর্যন্ত এত তৈরি গলা খুব কম লোকেরই আছে, তাদের উত্তরসুরীরা এখনো রাজ করছে হিন্দি উর্দু সঙ্গীত জগত। মা ও নাকি ব্যানজো বাজাতেন চাবি টিপা ব্যানজো, আর হারমনিকায় বাজাতেন সে অমর সঙ্গীত “ হায় আপনা দিল...” যে গানটির হারমনিকার প্রিলিউডটী আজ এত কাল পরেও সবার প্রিয় হয়ে আছে। মাজ্রুর সুলতানপুরির লিখা শচীন কর্তার সুর আর হেমন্তের গাওয়া কি গান! এই সব শুনে শুনে কানটা তৈরি হয়েছে এখন কিভাবে হাল আমলের হট্টগোল মরমে পষিবে! কি যে জ্বালা! খুব মনে পরে বাবা সেভেন ও ক্লক ব্লেইড দিয়ে সেইভ করছেন, আর হিল্ম্যান রেডিওতে বাজছে গান। সে রেডিও ছিল বড় বিস্ময়! বড় বড় গোল গোল নব, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টিউন করতে হত, আর একটা লাল কাঁটা ছিল যেটা শব্দের উঠা নামায় নড়ত, আমি দীর্ঘ দিন ভাবতাম ভিতরে বুঝি ছোট ছোট মানুষ থাকে তারা সব কায়দা কৌশল করে গায় টায় কথা টথা বলে। ছোটছোট ট্রানজিস্টার আর রেজিস্ট্যান্ট গুলি ছিল পরম বিস্ময়! কি আনন্দময়ী না ছিল পৃথিবী! রেডিওর কি সে কি মহিমা! মাঝে মাঝে আকাশবাণীর সুরটা মনে বাজে, কি গম্ভীর আর গভীর! কম্পোজার ছিলেন অয়াল্টার কফম্যান একজন চেক ইহুদী, কিভাবে হিন্দুস্তানি সঙ্গীত এভাবে এডপ্ট করলেন, কে জানে!
টিভি তখনও ঘরে ঘরে ঢুকেনি, সে সময়। বেতার তখন যেন কিন্নরী, আবিষ্ট মোহিত সকলেই। প্রতিটি বেলাই যেন জড়িয়ে ছিল সুখ, দুঃখ হাসি কান্নার সাথে। কিশোরগঞ্জ তখন ছোট্ট লাজুক মহুকুমা শহর, জেলা শহরের তকমা লাগেনি। জল হাওয়া ভালো। মানুষজন সংস্কৃতিমনা। বেশ কোমল বেতস লতার মত এক শহর। এ শহরেই আমার জন্ম। ভোর গুলি তখন ছিল লতা গুল্মের গন্ধের মতই নরম আর স্নেহরসে ভেজা। নীল টলটলে টুথ ব্রাশে পেস্ট লাগানোর আগেই শুরু হয়ে যেত রেডিও, বাবা বেরিয়ে গেলেই চলে যেত বোনেদের দখলে। বেলা বাড়লেই একে একে সব্বাই স্কুল কি কলেজে যেতে থাকতো, কারুর ফ্রক কি জামা, কারুর কামিজ পাজামা, কারুর টাইট পনি টেইল তো কারুর আলসে বেণী। একটা ছবি প্রায়ই চোখে ভাসে আমার, মেজদি বাসার গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কলেজে, অজানুলম্বিত বেণী পিছন থেকে দেখা যাচ্ছে, আধভাঙ্গা লালচে ধুসর পথ। কাঁচা রোদ ফেলছে ছায়া সজনে গাছের চিরল চিরল পাতার। ডালে ফোঁড়ন দেবার শব্দ আসছে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে,পাঁচ ফোঁড়নের গন্ধে মৌ মৌ চারিদিক। কাঁঠাল গাছটার সবুজ কচি পাতা চকচকে বিস্ময় নিয়ে যেন তাকিয়ে, ছোট্ট আমি বড় বোনের হাতে বানান খয়েরি রঙের প্যান্ট পরা, মেজদির চলে যাওয়া দেখে কাঁঠাল গাছটার পাশ দিয়ে দৌড়ে ভিতরের বারান্দায় চলে আসি।
মাতৃহীন পুর পরিবারের দেখভাল করবার বোঝা আপ্পার ( আমরা বড় বোন কে আপ্পা বলি) কাঁধে, আগে থেকেই সে গিন্নী বিন্নি মানুষ, সব ঠিক সামলে নিচ্ছে, এই যে এক গাদা লোকের বিশাল সংসার অতটুকুন বয়সে ঠিক লাগাম টেনে রেখেছে, আজ বুঝি কতটুকুই বা বয়স ছিল তার ওই সময়ে, মাতৃ রুপে ঠিকই আবির্ভূত হয়ে গেছে, হাতে অভয় মুদ্রা নিয়ে। মেজ ভাই বাজার করে নিয়ে এসছে , বাচাল কাজের মেয়ে সবুজ শাড়ি পরে বলছে “কিতা আনছও? কি দিয়া ঠেমাইতাম?” ঘরে মিল্লাত ফ্যান চলছে ঘুঁই ঘুঁই করে, চক চকে কালমেঝেতে গোল গোল দাগ কেটে ঘর মুচ্ছে কেউ, রেডিওতে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম, “ উড়োজাহাজ মার্কা আলকাতরা...” কিংবা গ্যাকোটাচ গ্যাকোটাচ ...তিন চার পাঁচ মিনিট গোসল করুন চুল্কানি হবে শেষ, টাচ টাচ টাচ গ্যাকোটাচ “ আর প্রতিটি বিজ্ঞাপনের ফাঁকে একটা টুরুটুট জাতিও শব্দ হত, আমার খুব মজা লাগতো এখন আর সেই চল নেই। গীতালি কি চিত্রগীতিতে প্রিয় গান বাজলে দৌড়ে এসে গান টা বাড়িয়ে দিত আপ্পা, কোমড়ে শাড়ি গুঁজে, ফর্সা মুখ উনুনের আঁচে লালচে হয়ে আছে, কুছড়ো চুল গুলো কপালে লেপ্টে আছে, কি যে ভালো লাগতো। ভিতরের উঠানে রোদ আরও বাড়ত , কলতলা শুকিয়ে ঠনঠন করতো, মাড় দিয়ে মেলা শাড়ি শুকিয়ে খড় খড়ে হয়ে থাকতো, রেডিও তে খুরশিদ আলম গাইছেন “ আজকে না হয় ভালো বাস আর কোন দিন নয়, ওই প্রেমের দরজা খোলো না কাল কি হবে জানি না”। পলেস্তরা বিহীন বাউন্ডারি ওয়ালে শ্যওলা পরে আছে ভেল্ভেটের মত, গাঢ় শ্যাওলা সবুজ, সাপের মই (গিরগিটি) যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায় খানিক হলদে সোনালী রঙ্গ ঝড়িয়ে, গোল গোল চোখে কি জানি খুঁজে, একটা পা তুলে খানিক থমকে থাকে, তারপর তির তির করে কোথায় চলে যায়, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের শালারা আসত আমার সাথে খেলতে, বাড়ি বানাবেন বলে একগাদা কাঠ কিনে জমিয়ে রেখছিলেন বাবা সেখানে আমরা তিনজনা খেলতাম, “সুমন, রাজন, মোহন”, কি সে খেলা আজ আর মনে নেই। ক্লান্তি হীন বেতার বেজে চলেছে তখনও। একসময় বাবা ফিরতেন চেম্বার থেকে খেয়ে দেয়ে বাবার চুল টানতে থাকতাম, বাবা শুয়ে শুয়ে পড়তেন, দাবা কি কোন কঠিন ইংরিজি বই, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতো। জানালা দিয়ে দেখতাম ঘন নীল আকাশ, কিছু নিম্বাস মেঘ চলিষ্ণু, পাক খাওয়া নিরলস চিলেদের দল। ঠিক দুপুর বেলা ভুতে মারে ঢিল... কি যেন একটা গান গাইত বড়রা তাই অইসব নিদাঘ দুপুর গুলি কি যেন এক ভয় হয়ে ছোট্ট বুকে থম বেরে থাকতো। চিলেতে ভয় ছিল, প্যাঁচাতে ভয় ছিল, কাবুলি ওয়ালার ভয় ছিল, আর কত শত ভয় তখন, ওঁত পেতে থাকতো। চারটে ছিল খেলতে যাওয়ার সময়, বড় একগ্লাস দুধ খেয়ে, আইরিন, শার্মীন চুল টাইট বেণী বেঁধে খেলতে যেত, আমিও তাদের পিছু পিছু, সব খেলাতেই দুধভাত। কোন একদিন বোধকরি আমার হাল্কা গা গরম ছিল তাই হয়তো খেলতে যেতে দিবে না আপ্পা আমি বসে আছি বারান্দার টেবিল্টার উপর একটু পর পর জিজ্ঞেস করছি আপ্পা চারটা বেজেছে? বার বার একি উত্তর “না ভাই”।একসময় সন্ধ্যাই হয়ে গেল। সে দিন আর চারটেই বাজল না। আমার সরল প্রশ্ন “ আপ্পা আজকে চারটা বাজবে না?” এবারো একি উত্তর “না ভাই”। কি সরল যাপিত জীবন! সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে যেতাম, রাতের স্মৃতি তাই কিছুই নেই, তবু মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙলে শুনতাম, লং প্লে কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ার এ বাজছে “তীর ভাঙ্গা ঢেউ, নিড় ভাঙ্গা ঝড়, তারি মাঝে প্রেম যেন গড়ে খেলাঘর” মান্না দে গাইছেন।
সেই ঘুম চোখে অস্ফুট কিছু গান, ভোরের নরম রোদে হারানো কিছু সুর, সংসারের বুননে জড়িয়ে ছিল রেডিও জড়ির ঝালরের মত, ফ্রিলের লেইসের মত, ঝলমলে। আরও পরে আমার মা’র সোনার সংসার যখন ছড়িয়ে ছত্রখান, আমরা ছোট তিনজন কম্পমান বিমাতা ভয়ঙ্করীর নাহক তরাসে, সে সময় ও একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম এই রেডিও। হিল্ম্যান তখন হারিয়ে গেছে কোথায়? তত দিনে সেই টিভি, যা শেরে বাংলা নগরের বাসায় এসেছিল কত শত প্রিয় প্রোগ্রাম দেখে আমাদের খুব কাছের কেউ হয়ে গেছিল, তা দখলে নিয়ে গেছেন তিনি, যে ঘরে আমাদের ঢোকা বারণ। তাই শামীম ভাই তার রেডিওটি আমাদের দিয়ে দিয়েছিলেন। বুদ্ধ প্যাগডার ডিজাইনে, কমলা ঘিয়ে রঙের, চূড়টা ঘোরালে টিউন হত। আমরা ঢাকা ঘুরে আবার কিশোরগঞ্জ ব্যাক করেছি, ঢাকার বাসায় থাকে, মেজ ভাই আর ফুলদি (তিন নম্বর বোন), বড় দু বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বড় ভাই ভাবি কে নিয়ে থাকেন শঙ্কর। আমরা ছোট তিনজনা, বিমাতা আর বিমাত্রেও ছোট এক ভাই সহ কিশোরগঞ্জ চলে এসছি। বাবা ঢাকা-কিশোরগঞ্জ, ঢাকা-কিশোরগঞ্জ করছেন। রাজনীতির তখন টাল মাটাল অবস্থা, জিয়াউর রাহমানের মৃত্যুর পর বিশ্ব-বেহায়ার খপ্পরে দেশ ( যদিও এখন তিনি বেহায়া লিস্টির অনেক নিচে চলে এসছেন)। বাবা যেহেতু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তার ছুটছুটির শেষ নেই। আমার মনে আছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর একদিন পর বাবা চিটাগং সার্কিট হাউজ ভিসিটে যান, আমাকে ও সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন, দেখছিলাম গুলিতে গুলিতে ঝাঁজরা দেয়াল, একটা পোষ্টার ছিল তখন “ছেলে হউক মেয়ে হউক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট”, পোষ্টার টি তখনও ঝুলছে অজস্র গর্ত বুলেটের। মুহূর্তে একটি দেশ ব্যাক গিয়ারে চলে এল। এরশাদ কে ইতিহাস তাই আজ আস্তা কুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছে। রাজনৈতিক বাতাবরণেই বড় হয়েছি কিন্তু কোনদিন এর কলুষতা আমাদের স্পর্শ করেনি, বরং দেখেছি আমার বাবাকে কিভাবে অর্থ ও ক্ষমতার লোভের উর্ধে উঠে দেশ ও দশের জন্য করতে। এরশাদের কোন টোপই পাত্তা পায়নি বাবার কাছে, কাজী জাফর কিংবা আনোয়ার জাহিদরা কত দলে ভিড়ানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু ফলাফল শূন্য। কত দেখলাম, ত্যাগী নেতা বরিশালের সিরাজুল হক মন্টু কাকা আর বাবা শাজাহান পুর বাসার পিছনে দারোগা সাহেবের বাসায় আত্মগোপনে আছেন, থানা থেকে পুলিস আগেই খবর দিয়ে গেছে, রাত্রে রেইড হবে স্যার আপনারা কেউ আজ বাসায় থেকেন না। গল্ডব্লাডারের পেইন নিয়ে সারা রাত লুকিয়ে থাকতেন। এসব আজ মূল্যহীন। বিচারহীন এ সমাজে ,কলুষিত রাজনীতি। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির কীট কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, দেশটাকে। হয়তো প্রাসঙ্গিক নয় তবুও কথা গুলি চলে এল, কোন কিছুই রাজনীতি, অর্থনীতি আর ধর্মের বাইরে নয়। ফিরে যাই প্রসঙ্গ রেডিও তে আবার।
ধান্মন্ডির বাসায় একটা প্যানাসনিক টু ইন ওয়ান ছিল ফুলদির, টার্ন টেবিলটার দখল ছিল মেজভাইয়ের, শামীম ভাই এর রেডিওটাই আমরা শুনতাম। তিনটা বাজলেই ছোট তিনজন রেডিওতে টিউন করতাম ওয়ার্ল্ড মিউজিক। তখন মনে হত শুরু হত বিটফেনের সিম্ফনি ফাইভ দিয়ে, ট্যা ট্যা ট্যা ট্যা...মাথায় ঢুকে আছে একদম। কত শত গান ভুল ভাল লিরিক্সে গাইতাম, আমার খুব প্রিয় ছিল ইয়েসটার ডে ওয়ান্স মোর, মনে হয় শনিবার হত, ঠিক খেয়াল নেই। কারপেন্টার্সের ইয়েসটার ডে ওয়ান্স মোর এর ইন্সট্রুমেন্টাল দিয়ে শুরু হত এই সেগমেন্ট। রাইনস্টোন কাউ বয়, রেইন ড্রপ কিপ্স ফলিন অন মা হেড, আই লাভ ইউ মোর দ্যান আই ক্যান সে, কিংবা নেইল ইয়াং এর হার্ট অফ গোল্ড, কত শত গান। কত শত গায়ক। কি অধীর অপেক্ষা। সহজ লভ্য এ সময়ে এর স্বাদ আস্বাদন করা সহজ কম্ম নয়।
সেই রেডিও আজ “উপহাস যেন করিতেছে মনে ছিপি পরা দাঁত তুলি”, সবার কানে হেডফোন অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে প্রগলভ কোন বালিকা নয়ত কোন অর্বাচীন বালক, বয়স তাদের যাই হউক তাদের বালখিল্য কথকতা বড় পীড়াদায়ক, ব্যতিক্রম বড় দুর্লভ। বানিজ্য বাতাসে ভেসে যাচ্ছে সব। রেপিটেডলি একি গান বাজাতেই থাকে, কার স্টেরিওতে মাঝে মাঝে একটু শুনে নেই, বুঝে নেই চলমান সময়টাকে। বড় বিপন্ন বোধ করি। সামনে কি দিন আসছে কে জানে? কে লিখবে গান আর কেই বা করবে সুর। কে লিখবে অমন “আমি আজ আকাশের মত একেলা, কোমল মেঘের ভাবনায়, বরষার এই রাত ঘিরেছে ব্যাথায়, আমি আজ আকাশের মত একেলা, একেলা, একেলা”। কি কবিতার মত সুন্দর গান। বড় বিষণ্ণ বোধ করি, আজকের এই দেউলিয়া পনা দেখে, তবু আশায় বাঁধি বুক, কেউ কেউ তো লিখে “ তোমার জন্য নিলচে তারার একটু খানি আলো…” আবার রুপে রসে রঙে ভরে উঠবে চারিদিক। সুন্দর সুরে বাঁধা পয়ার আমাদের আনারি গলায় গুন গুন বাজবে। কোন অবুঝ বালকের মুখে হাসি ছড়িয়ে দিবে রেডিওতে বাজা মিষ্টি কোন গান!

(৭)
আমার কাছে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কেই মনে হয় যেন এক একটা গদ্য বিশেষ, ঠিক গদ্য না গল্প সমগ্র। বেশ সাস্থ্যবান গোটা গোটা হরফে লিখা। কারোটা বেশ ঝলমলে, কারোটা বেশ বেদনা বিধুর কারোরটা বেশ রগরগে স্পাই থ্রিলার। একসময় জীবন অনেক বেশী সচল ছিল নানা জায়গায় যাতায়াত হত নানা শ্রেণী পেশার বিচিত্রতর লোকদের দেখতে পেতাম, বুঝতে পেতাম, চির কৌতুহলি মন অনেক অবান্তর প্রশ্ন করে জেনে নিতাম তাদের জীবন জিবিকা, হাসি কান্না। মার্জিনে মন্তব্যের মত মনের খাতায় এঁকে রাখতাম কত গল্প।
এইযে যে লোকটি ঝুলছে বাদুড় ঝোলা বাসের ফুট বোর্ডে , কিংবা দাঁড়িয়ে মুড়িমাখা খাচ্ছে বিস্তর, হয়ত তারা অফিস ফেরত পিয়ন কি সামান্য কেরানী, অফিসে জোড় ধমক খায় সাহেব কি বাবুর, কম্পমান ত্রস্ত এ লোকটিই বাড়ি ফিরে, ঘেমো জামা খুলেই বাড়ীর কর্তা, অবসরে মেয়ের অ্যালজাব্রা কসে দেন। মাস শেষে বাড়ী ভাড়া বাড়ানোর নাহক আবদারে বাড়িওয়ালাকে দাবড়ে দেন বেশ। ঈদে চান্দে বাড়ি গেলে সেই গাঁয়েরই এক জন কেউকেটে বনে যান।সালিস দরবার করেন। বেশ তখন একটা ব্যক্তিত্বও চলে আসে চোখে মুখে, এখন যাকে বেশ অকিঞ্চিৎকর মনে হচ্ছে, সে-ই কোথাও দায়িত্ববান স্বামী, স্নেহময় পিতা, নির্ভরযোগ্য ভাই। এ জীবনের এক অপূর্ব সুন্দর ছবি। এই যে দুঁদে পুলিশ অফিসার দাবড়ে বেড়াচ্ছেন এঁকে তাঁকে, সেই হয়তো রাত্তিরে কোঁকড়া চুল বালিকাটিকে ছাড়া ঘুমাতেই পারেন না, স্নেহময় বাবা। এমনি প্রায়ই ভাবি জীবনে কত মানুষের সাথে আমাদের যোগসূত্র ঘটে আবার হারিয়ে যায়। এক এক সময় মনে হত এঁকে ছাড়া বুঝি চলবেই না এক মুহূর্ত, আজ সে ঘটনার ঘনঘটায়, কোথায় ছিটকে গেছে। জীবন কত ঘটনার কত রটনার তাকে বোঝা দায়। এই অসহায় শহর আমার আগলে রাখছে কত সহস্র দিবস রজনীর গল্প, যার কাছে আরব্য রজনীর গল্পও বুঝি ম্লান।
আমাকে গল্প সব সময় বড় বেশি টানে। গল্প কিচ্ছা গীত আমি বিস্তর শুনেছি। গাজি কালু চম্পাবতী, বেহুলা লখিন্দর আরও অনেক, আজ আর মনেও নেই। আমাদের বাসায় যে কাজের লোকটি শেষ মেষ ছিল সে ছিল এইসব কিচ্ছার ডিপো। কত অলস দুপুরে, কিংবা ঘুম ঘুম সন্ধ্যায় কত যে গল্প শুনেছি। লোকজ এই সাহিত্যের এই বিশাল ভান্ডার এর খোঁজ আমি তার কাছেই প্রথম পাই, যা আমার শিশু মনকে আন্দোলিত করেছিলো সেই সময়তেই। উদার খোলা আকাশ, ধুধু নিঃসঙ্গ মাঠ, আমার মন কেমন করে উঠত। ডাকঘর লিখার পর রবীন্দ্রনাথ দিন দুয়েক ছাদে মাদুর পেতে একাকি থাকতেন, এক বিষণ্ণতা তাঁকে গ্রাস করেছিলো, সেই দই ওয়ালার হাঁক, অমলের জানলার গরাদ ধরে ডাকা “দই ওয়ালা ও দই ওয়ালা...” কি যেন এক বিষণ্ণ মাধুর্য আচ্ছন্ন করে রাখে। আমার শৈশব এখন মনে হয় তেমনি বিষণ্ণ মধুর। চোখে ভাসে বিশাল ধু ধু চষা খেত, অপেক্ষায় বর্ষণের, ফালগুণ চৈত্রের বাউরি বাতাস সব এলোমেলো করে দিচ্ছে, দূরে রেইন্ট্রি গাছের ঝুপ্পুস ছায়া, আমার একাকি ঘুড়ি উড়ছে, কমলা কিংবা বেগুনী, দূরে রিক্সা দিয়ে আইস্ক্রিম ওয়ালা আইস্ক্রিম ফেরি করছে তার রিকশায় লাগানো চোঙ্গা মাইকে গান বাজছে...”মনটা যদি খোলা যেত, সিন্ধুকেরি মত দেখাইতে পারিতাম তোমায় ভালো বাসি কত...” সেই খাঁ খাঁ রোদ জ্বলা নিদাঘ দুপুরে মনটা হু হু করে উঠত, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যার জন্য। কত কি কল্পনা করতাম, কত দৈত্য দানো, ভুত প্রেতকে হারিয়ে পোঁছে যেতাম পাতাল পুরি। অজস্র বই ছিল আমাদের রূপকথার, কি ছোটদের রাশান বই কি যে আপুরুপ, তাই কল্পনার রসদের অভাব হত না। আর তার সাথে এই খোলা খোলা দিন গুলি। আমরা আমার ক্লাস টু কি থ্রীতে কিশোরগঞ্জ ফিরে আসি, তবে কিশোরগঞ্জ বাসা ভাড়া নেয়ার আগে এক দেড় কি দুই মাস আমাদের গ্রামে কাটিয়ে ছিলাম, এমনিতেও প্রতিবার ফাইনাল পরীক্ষার পর আমাদের গ্রামে যাবার একটা নিয়ম ছিলই, তবে সেবার যেমন হল এমনটি আর হয়নি। এমন বাঁধন হারা ভাবনাহীন উচ্ছল সময় বড় বিরল এই যাপিত জীবনে। হয়তো এ কোন জাদুর শহরের গল্প নয়, একান্তই আমার শৈশবের কথকতা, কিছু উচ্ছল দিন রোদ গন্ধ মাখা, কিছু খাপ ছাড়া মানুষের আনাগোনা, কিন্তু এই দূর থেকে বড় মুল্যবান বড় আদরের আজ। এমন গল্প কম বেশি সবারই একই, তাও স্মৃতির পাতা থেকে যেন মলিন হয়ে হারিয়ে না যায়, তাই সেই রোদ হাওয়া, সবুজ কি ঝুম বৃষ্টিকে বোতল বন্দী করার এই চেষ্টা।
কিশোরগঞ্জে থাকতে যাবার আগে যতবার যেতাম, বাবা রেলের সেলুন পেতেন। সে যে কি রাজসিক ব্যাপার, কি বলব আর। ইয়া পুরু গদির বিছানা, তুলতুলিকা বালিশ, চামড়ার গদি আটা বিশাল সব চেয়ার, রিচ উডেন ফিনিশড ইন্টেরিওর, চকচকে ভার্নিস। উর্দি পরা বয় বেয়ারা! সে এক দারুন জমাটি ব্যাপার। আর খয়াওয়াটাও ছিল তেমনি, পুরু কাটলেট কি চপ যেন এখনো স্বাদ পাই। রাতের চিটাগং মেইলের সাথে জুড়ে দিত সেই বগি, আমরা ছুটতাম, ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক, আর খুব মজা পেতাম এই চাঁদটা এখন যেমন তখনও আমাদের সাথে সাথে খুব ছুট্ত। আমি আর শারমিন চাঁদ দেখতে থাকতাম একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম, কখন কখন ভৈরব ব্রিজ পার হওয়ার সময় সজাগ থাকলে অবাক বিস্ময়ে দেখতাম কি গম্ভীর বিষণ্ণ সে পারাপার, চাঁদের প্রতিবিম্ব ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছে, কোথাও কেউ নেই, কি যে এক হাহাকার বালক মনে হত! এখনো তার রেশ রয়ে আছে, স্মৃতি এক অচিনব্যাধি, নিরারোগ্য! ঘুমিয়ে থাকে, ঘুমিয়ে থাকে সহসা ঘাই মেরে উঠে শুল বেদনা যেন! হারানোর ব্যথা বড় করুন! কি প্রিয়জন, কি ব্যবহার্য কি পরিধান বড় করুণ! হারানো সময় বুঝি তেমনি, কখন উঁকি দিয়ে যায়, মুহূর্তে তেড়ে ফুড়ে আসে হটকা বানের মত, খাড়িতে যেমন! কত কথা, কত স্বাদ, কত ঘ্রান। বাক্সের পুরনো চিঠির মত। ট্রেন কোন ষ্টেশনে থামলে, ঘুম জেত ভেঙে, খানিকক্ষণ ভম্বল হয়ে থাকতাম, কোথায় আছি? কি হচ্ছে বুজতাম নাহ। নাকে আসত ফস করে কারো ম্যাচ জ্বালানোর ঝাঁঝালো গন্ধ, খানিক পর পোড়া তামাকের, সহসা ছিলা মিষ্টি কমলার গন্ধ। হাজার শব্দ, বাক্য ফেরিওয়ালার হাঁক, কুলিদের ডাক সব মিলিয়ে এক গভীর শব্দবহুল বিহব্লতায় বিবস থাকতাম খানিক তারপর ক্রমশ শব্দরা হত শ্রূত, পেত আকার, পেত রূপ। এখনো রেলের ষ্টেশন গুলিতে সেই একই গন্ধ একই জমাট শব্দরা হাজির হয়। সময় শুধু হারিয়ে গেছে, কত চেনা মুখ প্রিয় মুখ হারিয়ে যায়। কখন কখন এমন হয় কিছু মানুষের সাথে দেখা হওয়ার পর, মনে হয় এই মানুষটির সাথে বুঝি আর কখন দেখা হবে না, আর মুখমুখি বসে গল্প হবে না! যার সাথে কখন কেটেছে সময় অপরিমেয়, অর্বুদ শব্দের হয়েছে বিনিময়, আজ জীবনের কোথাও সে নেই। এই জীবন, এই নাতিদীরঘ জিবনে কত সহস্র মানুষের আসা যাওয়ায় মুখরিত, সে এক বিশাল আনন্দ যজ্ঞ। জীবন নেহাত মন্দ নয় জানি, হয়তো আমার হারানোর পাল্লাটাই ভারি তাই বুঝি মন আমার শুধু হারানো দিন গুলির ভুল্ভুলাইয়াতেই ঘুরে ফিরে মরে। দুরের মেঘ, চলতি গাড়ী থেকে ভেসে আসা সুর, রোদ হাওয়ার হারানো গন্ধ বার বার আমায় নিয়ে চলে সেই রূপকথার দিনগুলিতে, হায় আজ সে সময় গুলি আমার কাছে রূপকথার দিনই হয়ে গেছে!

সেবার যখন আমাদের গ্রামের বাড়ি যাই, পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, তখনও বিদ্যুতের বিলাসিতা গ্রামে পৌঁছোয়নি। ঝুপ্পুস অন্ধকার, ছায়া আবছায়া শীতের সন্ধ্যা! কুপী কি হ্যারিকেনের লালচে আলো আর মানুষদের, আসবাবদের অপার্থিব লম্বা ছায়ায় ছিল মিশে কুয়াসার এক রাশ রহস্য। ঘুম ঘুম চোখে কেমন একটা দুরু দুরু ভয় কেঁপে কেঁপে উঠেছিলো মনে আছে এখনো খুব। যদিও পরদিনের ভোরের হাওয়ায় সব কোথায় উড়ে গেল। দিন মান ক্লান্তিহীন ছুটোছুটি, আর দিন মান সব বিস্ময়ের সন্ধানে আমি যারপর নাই আপ্লূত, পৃথিবীর পাঠশালার আনকোরা ছাত্রটি যেন। কত কিছু চিনছি, জানছি তার শেষ নেই। সেবার আমার কাকার সাথে শুধু আমরা শুধু ছোট তিনজন এশ্ছিলাম, কাকা আমাদের মজলিশি লোক, শাসনে বিশ্বাসী নয়, আর কাকিমার প্রশ্রয়ের তো শেষ নেই, আমার এই বড় বোন দুটিতো ইয়ার বন্ধু, আর সমস্ত অন্যায় আব্দারের জায়গা ছিল আমার তিন নম্বর চাচাতো বোনটি, গুলতির গুলতি বানাও, বাঁশের কঞ্চির লাঠি বানাও, অসময়ে ধরা মাছ রেঁধে দাও, শেষ নেই। যা হবার তাই হল, পায়ের চামড়া ফেটে ফুটি ফাটা হয়ে গেলো, রোদরে পুরে ঝাঁই কালো হয়ে গেলাম, গায়ে চিমসে গন্ধ নিয়ে দিনমান ছুটি, দুপুরে ঠান্ডা জলে চোখ লাল না হওয়া পর্যন্ত দাপাদাপি করে বেরাই। চোখ লাল হলে মন্ত্র পরি “আমার চোখ লাল না, কাউয়ার চোখ লাল”,এক এক দিন বোনরা ধরে গরম জলে ঝামা দিয়ে ঘসে গায়ের ছাল চামড়া তুলে দিত। দিন মান রুটিনে বাঁধা নেই কোন তবে কম বেশি একটা কাজ রোজই করতাম আমরা বিকেলে হাঁটতে যাওয়া, দল বেঁধে আমাদের সব্বাই আর দুই চার জন পারাপ্রতিবেশি খেলার সাথি সহ বিশাল এক দল। লাইন ধরে ন্যাড়া খেতের আল ধরে চলতাম, শীতের বিকেলের দীর্ঘ ছায়ারা দীর্ঘতর হত, সুন্দর দীঘল ছায়া। লালচে মায়ায় কি যে এক কোমল আলো হত তখন, কে জানে দেখার চোখই বুঝি বদলে গেছে এখন। সে মায়ার খেলায় হয়ত কোথাও কোন বালক মন আনচান করে উঠে, সে তো আমি আর নই, অন্য কোথাও অন্য কেউ।


মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:৩৩

এ কে এম রেজাউল করিম বলেছেন:
এই লিখাটি বেশ বড়, আবার আসবো পড়তে।
আমারও বাল্য জীবনে ১৯৭৩ সালে ঢাকা এসেছিলাম, থাকতাম শুক্রাবাদে, ধানমন্ডী ৩২ নং সড়ক দিয়ে মীরপুর রোডের পূর্ব পাশে।
প্রবন্ধে বংবন্ধুর বাড়ীর দক্ষীন পার্শে অবস্থিত ধানমন্ডী লেকের সেই মায়াময় পরিবেশের বর্ণনা খুজতে ছিলাম।
বংবন্ধুর বাড়ীর দক্ষীন পার্শের ৩২ নং সড়ক দিয়ে পশ্চিম দিকে হেটে গেলে হাতের বামে থকত একটি ব্রিজ লেকের দক্ষীন দিকে যাওয়ার জন্যে। এ ব্রিজের পূর্ব ও দক্ষীন পাড়ে ছিল দুটি ঠেস মূলের গাছ। ঠিক যেন লেকের ভিতরে অনেকগুলো মুল ছরিয়ে দিয়ে যেন ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমি ক্লাশ নাইনে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তাম লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি বয়েজ হাই স্কুলে। আমাদের উদ্ভীদ বিজ্ঞানে এই গাছের পরিচিতি ও বর্ণনা ছিল।
এ প্রবন্ধে বংবন্ধুর বাড়ি, ৩২ নং সড়ক, বিকাল বেলার ধানমন্ডী লেকে বিভিন্ন জনের বরশী দিয়ে সেই মাছ ধরার বর্ণনা, লেকের পাড়ে ছোট্ট ছোট্ট সেই ফুল বাগানের পরিবেশ, লেকের সেই মায়াময় পরিবেশ আরেকটু বিস্তারিত খুজবো আবার এসে পড়ে, দেখি পাই কিনা।

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:৪১

রবাহূত বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই। লিখাটা পড়বার জন্য। আমি লিখেছি ৮২, ৮৩ সালের কথা, আমি কে জি ১ এ পড়তাম, তাই ৩২ নম্বর যাওয়া হত না একা। তবে সে গাছটি তখনো ছিল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.