নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“আব্বা আফনে এমন করুইন ক্যারে?” ভয়ে ভয়ে উম্মেহানি বাবা কে জিজ্ঞেস করে। বাবা লোক ভালো কিন্তু মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়ে যান!
“আমি আবার কি করি?” বাবা এংরাজ মিয়ার অবাক প্রশ্ন!
“এই যে মাইনসে কইলেই নাচুইন, গান গাইন! গান ভালা কিন্তু আপনের নাইচ দেইক্ষা সবাই হাসে ঠিসি করে, আমার শরম লাগে, আব্বা!”
“দুর বেডি, শরমের কি, আমি পারি; এই গেরামে কেউ পারে আর”! বলে গাওয়া শুরু করে “আই এম এ ডিস্কু ড্যান্সার, বিড়ি খাইলে হয় ক্যান্সার”, সাথে দুই পাক নাচ। উম্মেহানি বুঝে না কি করবে!তার ছোট ভাই নাকের সিকনি টানতে টানতে, ঘুন্সি কোমরে, দুলে দুলে নাচার ভঙ্গী করে হাত তালি দিতে থাকে। এংরাজ মিয়াও হাত তালি দিয়ে ছেলে কে উৎসাহ দেয়, “সাবও, আমরার আবু নাচেরে, আমার আব্বা নাচেরে” বলে বাচ্চাকে কাঁধে তুলে উঠান থেকে বাইরের দিকে পথ দেয়! পিছন থেকে বাচ্চাদের মা সুফিয়া চিকন গলায় বলতে থাকে “কই যাইন কই যাইন”, কে শোনে কার কথা, গান গাইতে গাইতে দেউড়ীর আড়ালে চলে যায় এংরাজ!
শেষ শীতের কোমল রোদ পরে থাকে উঠোন জুড়ে, উম্মহানি স্কুলের নীল জামা পরে, চৌকাঠে দাঁড়িয়ে, উদাস দৃষ্টি, তার বাবা লোক ভালো, কিন্তু তার তাল বিহীন উদ্ভট নাচে মানুষ আমোদিত হয়, বাজারে বা বিয়ে শাদিতে ডেকে নিয়ে যায় লোকে, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, এটা উম্মেহানির ভালো লাগে না। তার স্কুলের বন্ধুরাও হাসে। দুষ্টু বালকরা আকথা কুকথা শোনায়! উম্মেহানির খুব মন খারাপ হয়!
স্কুলের স্যার আপাদের বিচার দিলে তাঁরাও হাসেন, শুধু নাঈমা আপা তাকে আদর করে বুঝিয়েছিলেন কেউ যদি অনেক মানুষকে আনন্দ দেয় এর চেয়ে ভালো কাজ আর কি হতে পারে। উম্মেহানি সেটি বুঝলেও, তার বাবাকে নিয়ে অন্যরা হাসে এটা ভালো লাগে না! তার বাবার নাচটাই যা হাস্যকর, কিন্তু কি সুন্দর গান করেন, মাঝে মাঝে অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে শুনে বাবা উঠানে বসে গাইছেন, “পাখিরে তুই দূরে থাকলে কিছুই আমার ভালো লাগে না” গানটা শুনলেই পাখির জন্য চোখ কেমন ভিজে উঠে! কিশোরী মনে সদ্য জেগে উঠা কিছু অচেনা আবেগ তার বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠে! কই আর কেউ এমন গায়! ঈদের আগের রাত্রে ওর হাতে ওর মায়ের হাতে চুন-মেহেদি দিয়ে কি সুন্দর নকশা করে দেয়। আর তার আব্বার মত পাক্কন পিঠা কেউ বানাতে পারে! এত গুন তবুও লোকে হাসে তাই মন খারাপ হয় উম্মেহানির! অনেক মন খারাপ!!
চুল বাঁধতে বাঁধতে বাবার কথা ভাবছিল। স্কুলের সময় হয়ে এসছে প্রায়, ভাত ফোঁটার ঘ্রাণ আসে, “আউল্যা চাল”- এর গন্ধ আসে, সে বুঝে আজ ভাত না জাউভাত হচ্ছে। গরম জাউভাতে লাল চিনি, আহ কি স্বাদ! কিন্তু মা এমন করে! এত অল্প চিনি দেয় আরাম করে খাওয়া যায় না, কিপ্টার মত জমিয়ে জমিয়ে খায় শেষ দুয়েক লোকমা বেশী চিনি দিয়ে খায়। এত স্বাদ! জাউ ভাতের ঘ্রানে উম্মেহানির মনটা ভালো হয়ে যায়! একটা বাউরি বাতাস পিছের বাঁশ ঝারে ঝিরি ঝিরি শব্দ তুলে, রোদ যেন হেসে উঠে চারিদিকে! বসন্তের অচিন পাখে ডেকে উঠে কোন এক গহীনে!
এদিকে ছেলে কাঁধে আপন মনে গান গাইতে গাইতে, খাঁ খাঁ বন্ধে হাঁটা দেয় এংরাজ মিয়া। কাঁধে বাচ্চা খলখল করে হাসে। এংরাজ আরও আমুদে গলায় গান করে।
এসব কাজ দিয়ে কি সংসার চলে? যখন যে কাজ পায় তাই করে এংরাজ! আর এমন কোন কাজ বুঝি গ্রামে নেই যা সে করেনি। মাটি কাটা, রিকশা বাওয়া, আইস্ক্রিম এর ফেরীওয়ালা, কিছুদিন বাসের হেল্পারি তক করেছে। খেয়ালী মানুষ এক কাজে আঁটকে থাকার লোক না! সংসার চালাতে তাই সুফিয়ার যাচ্ছে তাই কষ্ট হয়! মাঝে মাঝে তাকেও কাজে কামে লাগতে হয়, সে মোটা কাজের মানুষ, ধামা ধামা ধান কুটে দেয় বড় গেরস্তদের বাড়ী।তাদের বউরা সব সোহাগী এসব কাজ কি আর পারে! বিয়ে শাদী বা ঈদে কিংবা মেয়েরা নায়র এলে, ঘামুর ঘামুর করে “গাইলে” চাল গুড়ি করে দেয়, পিঠে হয় তা দিয়ে, সাদা বকের মত ম্যারা পিঠা , চিতই কি কলা পিঠা! সুযোগ মত কাঠা খানেক সরাতে পারলে তার ঘরেও খান কতক পিঠা হয়, হলদী পিঠা নয়ত চ্যাপা পিঠা কাঁচা মরিচের ঝালে নাকের পানি চোখের পানি এক হয়! পাগলা লোকটা স্বাদ কইরা খায়, উম্মে হানিও খায়। সুফিয়া মোটা দাগের মানুষ, নিজের আপন মানুষ গুলারে স্বাদ কইরা ভালো মন্দ খাইতে দেখলে তার বুকে একটা কেমন জানি করে। নিজের জন্য একটাও রাখে না, “আসে, আসে আমার লাগিন আসে, তুমরা খাওসে”, নিজের মানুষটারে “বাইল” দেয়, মনে মনে কিরা কাটে, আল্লাহর কাছে মাফ চায় মিথ্যার বলবার জন্য! ”কুলের আবু” চালের আটার দলা চুষতে থাকে, মায়ের কাঁখে!
এসব আনি দু’আনি সুখের সময় গুলিই তাদের বাঁচিয়ে রাখে।
মাঝে মাঝে স্বামীকে বুঝায় একটা “পারমেন্ট” কিছু করতে, “মিন্নত আলী চ্যারমেন” এর বাড়ীতে তার যাতায়াত আছে, তার বউ তারে আদর করে, এংরাজ রাজি থাকলে চেয়ারম্যান এর বউ এর কাছে সে তদবির করতে পারে। এংরাজ ভাব ধরে, “আরে রাখ তোর চ্যারমেন, এমুন চ্যারমেন আমার এই পহেডো, হেই পহেডো আসে, আমার লগে এসডু (এস ডি ও) সাহেবের খাতির আমার কামের লাগিন চ্যারমেন লাগে!”
সুফিয়া বুঝে না, স্বামীর দাপট দেখে খুশী হবে না বোকামি দেখে রাগ হবে! কথা বাড়ায় না দীর্ঘ শ্বাস চেপে উল্টা দিকে ফিরে আবুটারে বুকে টেনে নেয়, বাচ্চার ওম মায়ের মন খানিক শীতল করে। বাইরে রাত গভীর হয়, বাঁশ ঝারে কুক পক্ষী ডাকে! বাচ্চার ওমটা যেন বেশীই লাগে আবার জ্বর আসলো কিনা বার বার ঘাড়ে কপালে হাত দিয়ে পরখ করে। এংরাজ মিয়াঁরে আর ডাকে না, জানে সে নিশ্চিন্ত ঘুমে রাত পার করে দিবে।
মাস দুয়েক হল এই এক জ্বালা হয়েছে, আবুর দুইদিন পর পর ঘ্যানঘ্যানানি এক জ্বর হয়, দিনমান ক্যানক্যান করে মায়ের পিছে পিছে ঘুরে! “বাজারতে বড়ি আইন্যা খাওইলেই জ্বর সারে, আবার কয়েকদিন জাইতেই হেই জ্বর”, টাউনের ডাক্তার দেখানোর জন্য এংরাজের কাছে সুফিয়া কয়েকদিন ধরেই বলছে, এংরাজ জানে ডাক্তার মানেই নানান পরীক্ষা, ওষুধ-পথ্যি, ইত্যাদি তার কিছু টাকা পয়সা “ভাউ” করতে হবে, তাই একটু সময় নিচ্ছে, কিন্তু শান্তি পাচ্ছে না, আবু জানি কেমন “ত্যানায়া গেসে” আগের মত বাপের গানে আর উঠে উঠে হাত তালি দিয়ে নাচেনা, বসে বসেই তালি দেয় আর এক দাঁত তুলে হাসে! বাবার মুখে হাসি থাকলেও মনটা খারাপ থাকে, হাতে টাকা পয়সা না থাকলে পুরুষ মানুষের মন মেজাজ কি আর ঠিক থাকে! তার উপর ছেলেটার শরীর ভালো যাচ্ছে না, খুব অসহায় লাগে নিজেকে। মনে মনে ভাবে হায় এর চেয়ে কোকিল মা হতাম, কাকের ঘরে ডিম পেরে আসতাম এত মায়া থাকত না। অসহায় পিতা হওয়ার চেয়ে কোকিল মাতা হওয়া বুঝি ঢের ভালো! হাসি খুশী মানুষটার মুখে হাসি লেগে থাকলেও সে হাসি যেন কান্নার চেয়েও করুন!
তিন গ্রাম দূরে একটা বিয়ের দাওয়াত পায় আলটপকা! বাজারে মুর্শিদ মিয়ার চায়ের দোকানে বসেছিল সে হঠাৎ মুর্শিদ মিয়াই তারে বলে তার ভায়রা ভাই এর বোনের বিয়ে সামনে, এংরাজ সেখানে যাবে নাকি? ভাটি থেকে বর যাত্রী আসবে তারা রাতে থেকে পরদিন বউ নিয়ে যাবে, তাই রাতে একটু আমোদ ফুরতি দরকার, দুই চারজন রসিক মানুষ থাকা লাগে এ সব বিয়ে-শাদীতে, নাহলে বর যাত্রীদের সময় কাটে না। সময় না কাটলে এটা সেটা নিয়ে, এমন কি তরকারিতে মাংসের টুকরা বড় না পেয়াজের টুকরা বড়, এনিয়ে লেগে যায় ধুন্দুমার, দুই পক্ষ! তাই কন্যার বাবারা থাকেন বিশেষ চিন্তায়। এংরাজদের মত দুই চারজন ধরে নিয়ে আসে, গান টান গায় ফুরতি আমোদ করে, কেন না তাদের আবার এমন রেস্তের জোড় থাকে না বাউল কি গাতক এনে গান গাওয়াবে! সেই সব সস্তা গণ্ডার দিনে মানুষের হাতে এখনকার মত অত নগদ টাকা থাকত না কথায় কথায় লাখ টাকার ঝকমারি তখন ছিল না গাঁও-গেরামে। সিকি আনা পাই এর হিসাবে দিন কাটত! মালা শাড়ী, টিনের তোরঙ, আর জামাই এর ট্রানজিস্টার কি ঘড়ি কিনতেই কাঁত হয়ে যেতে হত কন্যার বাবাদের!
এক দিন এক রাত থাকা লাগবে, কন্যা বিদায় হলে ছুটি। আর টাকার যে অঙ্কে দফা হল, পুরোটা যদি পায়, ডাক্তার-বদ্যি দেখানো ছাড়াও আপেল কি কমলা কিনার মত একটু বিলাসিতা করতে পারবে সে! যদিও প্রায় সময়ই যা বায়না হয় তার সব টুকু পায় না। কারবার বাড়ী, মেয়ে বিদায় হলে সবাই এদিক সেদিক পড়ে থাকে হা হুতাশ করে, কার কাছে ধর্না দিবে! আর সেও আউলা মানুষ, সেও কন্যা বিদায়ের শোকে চোখ মুছতে মুছতে, কাঁদতে কাঁদতে বাড়ীর পথ ধরে!
মুর্শিদের ভায়রারে সে চিনে হাবিলদার মানুষ,আইনের লোক বলে কথা! বেয়াই বেয়াই ডাকে, টাকা পয়সা পাওয়া যাবে নিশ্চিত! সেই খুশিতে লেরো বিস্কুট না খেয়ে আজ সে পাউরুটি কিনে, অর্ধেক ছিঁড়ে জামার পকেটে ঢুকায় আর অর্ধেক চায়ে চুবিয়ে খেয়ে উঠে পড়ে তাড়াতাড়ি। সে দৃশ্য মুর্শিদ মিয়ার নজর এড়ায় না, কিন্তু কিছু বলে না, অন্য সময় এই অর্ধেক পাউরুটি নিয়ে খানিক হয়ত তামাশা করত, কিন্তু সেও জানে এংরাজের ছেলের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, আর বাকীতে কেনা পাউরুটির আধখানা যে আজ সেই রোগা ছেলের জন্যই সবার আড়ালে পকেটে পুড়ল এংরাজ, এটা সে ঠিকই বুঝে! বুঝে দেখেই ভায়রাকে এংরাজের ব্যাপারে সুপারিশ করে বায়নাটা সে যোগার করে দিয়েছে।
ঘরে ফিরে দেখে আবু না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে, সুফিয়া চৌকির কোনায় বাচ্চার শিথানে বসা, আর কেরসিন কুপির আলোতে উম্মে হানি ঘ্যান ঘ্যান করে পড়ছে। এংরাজ কে দেখে সুফিয়া বলে “আর দিরং কইর না, আবুর আইজ জ্বর উসসিন, কাউলহা পারলে কাউলহাই, টাউনের ডাক্তার এর ধারো নেওন দরহার। আমার আবুর কিসু হইলে আমি বাস্তাম না গো উম্মে হানির বাপ, আমি বাস্তাম না!”
ধমক দেয় এংরাজ “এইতা কইস না, আমরার আবুর কিসু অইত না, কাউলাহা ফারতাম না, কাউলহা একাটা বায়না আসে, রাইত থাহন লাগবু, পরে হেনথে টাহা লয়া আয়া, ফরসু দিন টাউনো যায়াম, সব ফাইনাল, হাত টাহা নাই হেইডা তুই তো জানসই”।
সুফিয়ার সাফ কথা পারলে কালকেই যেতে হবে,অর মন কু ডাকছে, ভালো লাগছে না, এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা উচিৎ না, আবুর বুকের ভিতর কেমন ঘড় ঘড় করে। আর শ্বাস টানে যেন “উপড়ি ব্যারাম” আছে, এমন করে! হায় চাইলেই কি সব হয়, ধার কর্য করেও যে ওরা ডাক্তার দেখাবে সেই উপায়ও নাই, যেখানে যতটুকু সম্ভব ছিল সব জায়গায়ই ঠেকায় বেঠেকায় ধার নেয়া হয়ে গেছে, এদের আসলে ধারের এক ফের আছে, এর কাছ থেকে নিয়ে ওরে দেয় আর নিজে কিছু রাখে, আবার ওর কাছ থেকে নিয়ে তারে দেয়, এভাবেই দেনাটা বাড়তেই থাকে!
আলতো করে বাচ্চার নরম গালে হাত রাখে এংরাজ, এভাবেই সব পিতা তার রুগ্ন পুত্রের গালে হাত রাখে! আস্তে আস্তে ডাকে, “আব্বা আব্বা উড, দ্যাহ কিতা আনছি” রুগ্ন, শরীরে অশক্ত পেঁপের ডাটার মত ঘাড় তুলে বাপের দিকে চায়, হাসার একটা চেষ্টা করে, বাবা কে দেখে! বাবা ম্যাজিসিয়ানের মত হাত ঘুড়িয়ে পকেট থেকে আদ্ধেক পাঁউরুটি খানা বের করে, আবু খুশী হয়, এক দাঁত তুলে হাসার চেষ্টা করে দুর্বল হাত তুলে রুটিটা নেয়, মুখে দেয় না, হাতে নিয়ে শুয়ে থাকে খানিক! উম্মে হানি হামা দিয়ে আবুর কাছে আসে, খানিক কাঁচা শুদ্ধ ভাষায় বলে, “আমি কেয়ে পেলব” বলে কেড়ে নেয়ার ভঙ্গী করে, আবু কি জানি কি বুঝে দুই হাতে রুটিটা জোড়ে চেপে ধরে কামড় দেয় এক দাঁত ওয়ালা মাড়ি দিয়েই। বাচ্চার কান্ড দেখে সবাই হেসে উঠে!
আঁধার ঘন হয় আরও, নৈশব্দ জমাট বাঁধে আরও, পোকাদের কোরাস আর রাত জাগা পাখিদের ডাকে! নিঃশব্দ শুয়ে থাকে সুফিয়া ঘুম আসে না চোখে। থেকে থেকে ছেলের ঘাড় কপাল পরখ করে। এংরাজ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! কি দীর্ঘদিন সামনে ভাবে সে! কিভাবে আরও একটা দিন পার হবে সে ভাবছে! আবুর নেতপেতানি শরীর তার কাছে ভালো ঠেকে না। সংসারটা ঘুনে খাওয়া ফাঁপা বাঁশের মত, বাইরে যেমন তেমন ভিতরটায় কিসস্যু নাই। মা’র মন উতলা হয়ে ভাবছে কিচ্ছু কী ঘরে নেই বেচবার মত। তার নাক ফুল, দুল জোড়া সব আগেই গেছে, বাপের দেয়া আর কিছু নেই। কাপড় জামা ন্যাতাকেনি কিচ্ছু নেই বেচবার মত! বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে, “আহারে আমার সোনা, আমার বাপ ধন, পারি তো এই কইলজাডা দিয়া দেই, আল্লাহ্ আমার আব্বারে ভালো কইরা দেও, আমার সোনারে ভালো কইরা দেও”। সেই শৈশবে মক্তবে পড়া ভুল উচ্চারনে মুখস্ত করা সুরা পড়তে থাকে নিঃশব্দে, সামান্য সমর্থ যতটুকু আছে তা দিয়েই মসজিদে সিন্নি মানত করে। কি আর করতে পারে অসহায় মা এক সে! পারে তো নিজের হাড়-মাস দিয়েও বুকের ধনরে ভালো করে! বিশুষ্ক স্তনে নিজের প্রতিটি রক্ত বিন্দুর বিনিময়ে সে দুগ্ধ চায়, শিশুর ক্যানক্যানানি খুদা সে নিজের সব কিছুর বিনিময়ে হলেও মিটাতে চায়। পাক ঘরের পাল্লায় একটা মাকড়সা সে দেখছিল একবার, পাতলা চোষ কাগজের ঠোঙ্গার মত ডিম নিয়ে নিয়ে ঘুরছিল। দিন দুয়েক পরে দেখে ডিম থেকে বির বির করে ছোট ছোট বাচ্চা বেরুচ্ছে আর মা শুষ্ক খড়ের মত মরে পরে আছে, সে নিজেকে মাকড়সা মা’র মত ভাবে, ভাবে “আহা মাহড়ি মায়ের মত যুদি পারতাম, আমার যাদুর লাগিন কইলজা বাইট্টা দিয়ালতাম”! সে জানে জীবন এত সরল না, মহত্তম মৃত্যু পেতে হলেও দীর্ঘ জীবন উজানে বেয়ে চলতে হয়, চাইলেও যায় না পাওয়া! তবু এই দুনিয়াদারীতে এই শিশুর খানিক চাঞ্চল্যই তার বেঁচে থাকার এক মাত্র আনন্দ, বাকী সব এক ঘেয়ে নিয়ম! দাম্পত্য, সংসার, দায়িত্ব সব সব সব এক নিয়ম, এক অভ্যাস। দার্শনিক জটিলতা সে বুঝবার মানুষ নয়, জীবনের অনেক কিছু না বুঝেও তাদের জীবন চলে যায়, এক সময় নিঃশব্দে তারাও চলে যায়, কোথাও আঁচড় এর চিহ্নটুকুও থাকে না! তবু সে “মা”! দুনিয়ার মায়েদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই, তাদের ভাষার কোন পার্থক্য নেই!
ক্লান্ত রাত ফিকে হতে থাকে, সুফিয়া নির্ঘুম দীর্ঘ রাত পার করতে থাকে। নিজেকে প্রবোধ দেয়, মাঝে একটা দিন শুধু তারপর টাউনের ডাক্তার সাব দেখলেই সব ঠিক হয়ে যাবে! আশায় বুক বাঁধতে মন চায় তার!
সকাল সকাল বের হয়ে পড়ে এংরাজ, বাচ্চার জ্বর ছিল না সকালে। বাড়াবাড়ীকিছু হলে বউকে বলে গেছে পাশের ঘরের মনার বাপরে দিয়ে তাকে খবর পাঠাতে, মনার বাপ হাবিলদার সাবের বাড়ী চিনে! আর চিন্তার কিছু নাই, “আল্লাহ্ মালিক এই কয়ডা টাহা আবুর উসিলায় ব্যবস্থা কইরা দিসে, তিনিই সব ঠিক কইরা দিবেন”! সাদা আলখাল্লার মত পাঞ্জাবী পড়ে লম্বা লম্বা “কাইকে” হাঁটা দেয় এংরাজ! উম্মে হানি দরজায় দাঁড়িয়ে তার আব্বারে দেখে, তার এই বোকা সরল বাবাটার জন্য কষ্ট হয় খুব হঠাৎ করে!
বিয়ে বাড়ী, গরিবানা মত হলেও কিছু ঠাট-বাট আছে! দুই দোস্ত মুর্শিদ আর এংরাজ ভীরের মাঝে দেখতে থাকে রংতামাশা! কলা গাছ দিয়ে গেইট বানানো হয়েছে, তাতে রঙ্গিন কাগজের ঝালর, আর তিনকোণা নিশান লাগানো। উঠান জুড়ে সুতলির মাঝে নীল, লাল, বেগুনী, হলুদ নিশান লাগানো। বেলা উঠে গেছে,বউ ঝিরা “পুলা-ভাত” রাঁধছে, উঠানের দুই মুখী চুলায়! আতপ চালের ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে! নিঃশব্দে ঢোঁক গিলে এংরাজ, আহারে উম্মে হানিরে আগে সব খানে নিয়ে যাওয়া যেত, দুইটা ভালো মন্দ খেতে পারত এখন তো বড়ই হয়ে গেছে, বাপের সাথে কি আর এখানে সেখানে যেতে পারবে?! আজকে সাথে থাকলে বাপ-বেটিতে ভালো মন্দ খেতে পারত!
সময় গড়ায় বিয়ে বাড়ী জমে উঠে আরও! মেয়েলি গুঞ্জন, পুরুষালি হাঁকডাক, বাচ্চাদের “উমালি” সব মিলে এক জমাট ব্যাপার! মাঝে মাঝে চিকন সুরে দুয়েক জন একটু গীত ধরে, আবার চপল হাসি ঠাট্টায় হারিয়ে যায় সে সুর! এংরাজ মিয়া বাংলা ঘরের সামনে পাতা চেয়ার গুলোর একটায় এসে বসে। বর যাত্রী আসলে আর এখানে বসবার উপায় থাকবে না, খান কতক চেয়ার মুরুব্বিদের জন্য আর ভিতরে দস্তরখানা বিছানো, লাল সাদা থানে তৈরি, এখানেই খাওয়া ঘুম হবে বর যাত্রীদের।
সকালে খালি একটু মুড়ি মুখে দিয়ে বের হয়েছিল এংরাজ, ভেবেছিল কারবার বাড়ীতে কিছু না হলেও চা-বিস্কুট তো দিবে, সেটিও এখন পর্যন্ত জুটেনি! দোস্ত মুর্শিদ মিয়াঁ “সুহি” মানুষ সকালে ভরপেট খেয়ে চুলে চপচপে তেল দিয়ে সাদা “তবন” পড়ে এসেছে তাকে বেশ জাঁদরেল দেখাচ্ছে, বিয়ে বাড়ীর অতিথ বলে কথা! সে কি আর এংরাজ মিয়ার খুত-পিয়াস বুঝবে। একবারে ভাবে দোস্তরে বলি চল বাজার থেকে চা খায়া আসি, আবার ভাবে থাক দেখি না, কিছু না কিছু তো দিতেই পারে! ভাবতে না ভাবতেই হাবিলদারের পিছু পিছু তার মেয়ে ঢুকে একটা খুঞ্চা থালায় খান কতক চালের নাড়ু নিয়ে আসে ,সাথে চা। দিনটা ভালোই যাবে, ভাবে সে!
হাবিলদার সাব যথেষ্ট খাতির যত্ন করে, বর যাত্রী আসার আগ পর্যন্ত, “দোস্তাইনও” আইসা পান খাওয়ায়া গেসে, নিজেকে বেশ সম্মানিত মনে করে সে। শিল্পী হিসেবে, তার ভাষায় “শু-ম্যান” মানে কিনা “শো-ম্যান” হিসাবে খানিক শ্লাঘা সে অনুভব করে! ভাবে, আজকে সে নাচ গান ফুর্তি ফারতা করে দেখেই না, খানিক সম্মান পায়, না হলে এমন গরীব গুরবা লোক কারো মেমানি চল্লিশার খয়রাতি খিচুড়ি-মিডুরি ছাড়া আর কি পেত?
বর যাত্রী আসে, নওশা সাদা রুমাল চেপে বসে থাকে, শালা শালিরা নানান আমোদ করতে থাকে। শরবত বলে নুন গোলা পানি খাইয়ে দেয়া, জুতা চুরি করা, শিলুক সন্ধান করা, মাঝে মাঝে এংরাজ মিয়াও তাদের সাথে সামিল হয়ে দু একটা ঠিসি ঠাট্টা করে, নিজেকে জাহির করতে থাকে নাহলে সে আসর জমাতে পারবে না!
এসব হুল্লোড়ে মনে হয় জীবন বুঝি খুব বেগবান, জীবন বুঝি খুব আনন্দময়!জীবন বুঝি অঢেল। সময় কেটে যেতে থাকে, নানা আনুষ্ঠানিকতা একে একে শেষ হতে থাকে! খাবার সময় এংরাজের বার বার তার বাড়ীর কথা মনে পড়ছিল, আবুর দুর্বল ঢুলু ঢুলু চোখ থেকে থেকে মনে আসছিল, বিশেষ আনন্দ নিয়ে খেতে পারলো না সে। মুর্শিদ চাপাচাপি করলেও উঠে পড়ে সে তাড়াতাড়ি। খানিক আড়ালে গিয়ে একটা বিড়ি ধরায়, খুব অদ্ভুত একটা দুঃখ বোধ তাকে পেয়ে বসেছে আজকে। সব কেমন অর্থহীন মনে হচ্ছে, এত আয়োজন এত কোলাহল, বুঝি এর কোন মানে নেই!
সন্ধ্যা ঘনায়ে আসে, সোঁ সাঁ করে হ্যাজাক বাতি জ্বলতে শুরু করেছে, এখানে সেখানে মানুষ জটলা করে গল্প গুজব করছে , উৎসাহী মেয়েরা বর কনেকে ঘিরে জটলা করছে। প্রাচীন কিছু জ্যামিতিক নকশা মুখে বৃদ্ধা তাদের হারানো সময় গুলো নিয়ে আদি রসাত্নক হাসি ঠাট্টা করছে। মুরুব্বিরা গম্ভীর হয়ে নানা কাজে দরকার অদরকারে ঘর বার করছেন। খোলা উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে এংরাজ মিয়া । মনে মনে ভাবে তার দেহটাই এখানে, মন পরে আছে ঘরে, কুপির ম্লান কমলা আলোয়, রোগা ছেলেটার পাণ্ডর মুখ, বড় বড় চোখ বার বার মনে পড়ছে। নিজেকে সে প্রবোধ দেয়, না আসলে তো টাকা পেতাম না। ওষুধ পথ্যর টাকা লাগবে না?
এক সময় তার ডাক পরে বাংলা ঘরে!
আবু সারাদিন আজ ঘ্যান ঘ্যান করছে, আব্বা আব্বা করে ওর বাবাকে খুঁজছে খালি, সুফিয়া ত্যক্ত বিরক্ত! বিকেলের দিকে কেমন যেন ল্যাক পেকে হয়ে গেল আবু। ডাকলে চোখ মেলে, ঢুলু ঢুলু, সুফিয়ার বুকটা ছ্যাত করে উঠে, আর সাথে জ্বর, হু হু করে তাপ বাড়তে থাকে, যেন “আগুনের লুক্কা”, জল পট্টি দিতে দিতে মেয়েকে পাঠায় মনার বাপরে ডাকতে, আর মনে মুখে যত বিষ ঝাড়তে থাকে এংরাজের উপর! নিজের পরনের কাপড়, শখের কোন জিনিষ, বা আমোদ আহ্লাদের কোন কিছুই সে চায়নি জীবনে, তাই বলে এইভাবে বাচ্চার জীবন নিয়েও ছিনি মিনি খেলবে এংরাজ?! ক্রুদ্ধ বিড়ালের মত জ্বলছে তার চোখ। মেঘলা আকাশ, অন্ধকার হয়ে আসছে, ঘরে আরও জমাট বেঁধে আছে সে আঁধার। কাঁথা বালিশের চেল চিটে গন্ধ, ঘরময় ভরে ঘুরছে, অসুখের গন্ধ ঘরময় ঘুরছে, এর ফাঁকে ফাঁকে মা’র শঙ্কিত মন খুঁজছে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা নিয়ে কোন মৃত্যুর গন্ধ আছে কিনা আসে পাশে।
মনার বাবা মনাকে নিয়ে উপস্থিত, ভাবগতিক সুবিধার না এটা বুঝতে তার মুহূর্ত লাগে মাত্র। এখনই টাউনে না নিলে রাতটা টিকবে না বুঝেই সুফিয়াদের তাড়া দেয় বেরুতে, বাজার থেকে রিক্সা নিয়ে টাউনে যাবে তারা, আর মনা যাবে বাপের সাইকেল নিয়ে এংরাজ মিয়ার কাছে, যত তাড়াতাড়ি পারে, তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসবে মনা!
আন্ধকারে রিক্সা ছুটছে, শাড়ী দিয়ে ঘেরা রিক্সা, মা মেয়ে আর আবু ভিতরে আর মনার বাপ রিকশা ওয়ালার সিটে সামনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে রিকশায় চড়েছে। রিকশা ওয়ালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চালাচ্ছে। সাঁঝ বেলাতেই মনে হচ্ছে যেন রাত্তির হয়ে গেছে, আসে পাশে কিচ্ছু নাই, একটা রিকশা কি সাইকেল বা গরুর গাড়ী, কিচ্ছু নাই মনে হয় সারা পৃথিবীতে এই পাঁচটি প্রাণীই বুঝি জীবিত, আর এই পথ বুঝি পৃথিবীর বুক চিড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে, যেখানে শেষ বলতে কোন শব্দ নেই, শুধুই বুঝি চলা, আর রিকশার মরিচা পরা চাকার এক ঘেয়ে ক্যাচঁ কোঁচ শব্দ। মাঝে মাঝে আবু কেঁপে কেঁপে উঠছে এতটুকুই বুঝে জীবনের স্পন্দন! সুফিয়া প্রস্তর মূর্তির মত বসে আছে দেখে মনে হয় কত যুগ যেন সে বসেই আছে, এই ঘেরা টোপের রিকশায়, কতকাল যেন ছুটে চলছে। মা’য়েদের এই বসে থাকা,এই ছুটে চলা, আসলে বোধকরি এক অন্তহীন ঘটনা!
মনা তার বাপের সাইকেল পেয়ে আহ্লাদিত, ঘটনার গুরুত্ব বুঝবার বয়স তার হয়নি এখনো, যে সাইকেল সচরাচর ধরার অনুমতি সে পায় না, আর আজ সেই মহার্ঘ বাহন তার বাবা সেধে চালাতে বললেন, এই আনন্দ সে কোথায় রাখবে? গায়ের পথে এবাড়ী ওবাড়ী বন্ধুদের একটু না দেখালে বুঝি তার আর চলছিলো না। সময় তার কাছে বিশেষ কিছু নয়! গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে ব্যাটা যাচ্ছে, “চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়্ ঢাকা শহর দেখমু আজ দুইজনে ঘুইরা ঘুইরা” “দুইজন” আর অচেনা “ ঢাকা শহর” তাকে শিহরিত করে তুলে।
বাংলা ঘরে ফরাশ পাতা মাঝখানে খানিক জায়গা ফাঁকা রেখে সবাই গোল হয়ে বসেছে। পালঙ্কে বসে আছে নওশার বাবা আর অন্য মুরুব্বিরা। এংরাজ প্রথমে একটা কিচ্ছা শুরু করে। ইঁদুর আর গেরস্তের কিচ্ছা, ইঁদুর কি মন্ত্র পড়ে তা সে গায়েনদের মত মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলতে থাকে, “কুড কুডা কুট, ঝুর ঝুরা ঝুর ইয়া ধাপ্পা”। “ মানে হইলো এই মন্ত্র পইড়া উন্দুর জুদু লহিন্দরের লুহার বাসর ঘরও কামড় দিতারে জুত্তে, বাসর ঘরও হইয়া যাইবু কুড কুডা কুট, ঝুর ঝুরা ঝুর, ঝুর ঝুরা বুঝুইন? সব ঝুর ঝুরা হয়া যাইবু”! তার অংগ ভঙ্গী আর বলার ধরনে আমোদ হয়, হাসাহাসি শুরু হয় ঘরে, সেও উৎসাহ পেয়ে গল্প আগে বাড়াতে থাকে। এর মাঝে কেউ কেউ আবার আওয়াজ দেয় এংরাজ মিয়া ড্যান্স দেও। ড্যান্স দেও!
মনা যখন এই বাড়ীতে এসে পৌঁছে আমোদ তখন তুঙ্গে, পাঞ্জাবিটা গিট্টু মেরে কোমরে বেঁধে এংরাজ নাচছে তার সেই বিখ্যাত গান গেয়ে, “ আই এম এ ডিস্কো ড্যান্সার, টেট টেট টেডেও”, নিজেই আবার মুখে বাজনা দিচ্ছে। লোক জন আহা উহু করে মজা নিচ্ছে। এর ফাঁকে মনার মুখ মুহূর্তে চোখে পড়ে, আর সে যেন সম্বিৎ ফিরে পায়, তার জীবন, তার অসুস্থ্য শিশু, অভাব ক্লিষ্ট সংসার ঝাঁপিয়ে তার সামনে এসে পড়ে!
ক্ষণিকের জন্য থেমে যায় তার গান! লোকেরা বিরক্ত হয়! কেউ ধমকে উঠে। সে আবার সুরে ফিরে তালে ফিরে, লয়ে ফিরে, কিন্তু শরীর মেলে না, তার বেতাল আঁকা বাঁকা নাচ মানুষ কে আরও মজা দেয়। কোন মতে গান শেষ করে, একটু সময় চেয়ে বাইরে মনার কাছে আসে। মনাই আগ বাড়িয়ে বলে, “কাহা ভালাই তো নাচ্ছ”, এংরাজ বুঝে না কি বলে এই ছেলে, নিশ্চয়ই বাড়ীর কোন খবর নিয়ে এসেছে সে। সে উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করে মনাকে, “আবুর কি খবর, তোরে ক্যাডা পাডাইসে, আবুর মায়ে”? মনার মন কি আর সেদিকে, বিয়ে বাড়ীর জৌলুস দেখছে, লাল, নীল কাগজের নিশান, হ্যাজাকের ঝকঝকে আলো, ভালো মন্দ খাবার এর গন্ধ। উঠতি বয়স মনার তার কাছে জীবন মানেই আনন্দ! এর উল্টোটা নিয়ে সে মোটেও ভাবতে পারে না। ঘাড় ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখছে সব, এংরাজের প্রশ্ন তার কান পর্যন্ত পৌঁছায়ইনি। এংরাজ কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দেয়, মনা যেন ফিরে আসে। “কাহা আবুরে হাসপাতাল লয়া গেসে, আব্বা আর কাহি, আফনেরে চালায়া টাউন যাইতে কইসে, আমার সাইহেল লয়া আফনে যাইন, আমি হাইট্টা বাইত জায়াঙ্গা, চালায়া করুইন”।
মনার এ বাড়িতে আসা, এংরাজের বাইরে আসা, এসব দেখে দুয়েক জন বাংলা ঘরের আসর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, হঠাৎ তাদের আমোদে বাঁধা পড়ায় তারা মোটেও সুখী নন। মুর্শিদ সব শুনে হায় হায় করে উঠে, এংরাজ মিয়াঁরে তাড়া দেয় শহরে যাবার জন্য, নিজের পকেট থেকে দু’শ টাকা বের করে এংরাজের পকেটে গুঁজে দেয়। এসব গোলযোগ শুনে “হাবিলদার সাব” বাড়ির ভিতর থেকে বাইরে আসে, এংরাজ কে এক পুলিশি ধমক লাগায়, এসব নাটক বাদ দিয়া ভিতরে যেতে বলে। বর যাত্রীরা হই হই করে উঠে, “ হ মিয়া চল, চল, তুমার ড্যান্স দেহি”! মুর্শিদ, হাবিলদারকে বুঝাতে গিয়ে উল্টো দু’কথা শুনে, এখানে হাবিলদারের ইজ্জতের প্রশ্ন, তার বাড়িতে এসে, তার ঠিক করা লোক এভাবে অনুষ্ঠান “পণ্ডল” করলে আর ইজ্জত থাকবো? বাচ্চার মা আছে সাথে, আর এংরাজ মিয়া কি ডাক্তার, সব শেষ কইরা শেষ রাইতে যাউক, বাচ্চা কি আর মইরা যাচ্ছে নাকি।
এংরাজ মিয়া জোড় হাতে দাঁড়িয়ে থাকে, সমাজে যারা সবাইকে আনন্দ বিলিয়ে যায় তাদের দুঃখ কোনদিন অন্যকে স্পর্শ করে না, সার্কাসের সং এর মত লাগছে নিজেকে এংরাজের, যাদের রঙ চঙ্গে দুনিয়া দেখতে মানুষ অভ্যস্ত তাদের যেন কোন দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, মুক্তি নেই। সবাই ঠেলতে ঠেলতে তাকে আসরে নিয়ে আসে ফের, দুয়েকজন সহানুভূতিশীল লোক বলে “আইচ্ছা মিয়া দুয়েকটা গীত শুনাইয়া চালায়া যাইবানে”, বলে সহজ সমাধান করতে চাইলেও, হাবিলদার রাজি না, তার ইজ্জতের কাছে কোন কিছুর দাম নাই একদমই। বেমক্কা এক জেদ চাপে এংরাজের, বুক ভরা কান্না তার চাপা পরে যায় আহত অহং এর কাছে, "সে কেমন বাপ! সে কেমন পুরুষ! এর চেয়ে না মরদ, হিজলা হইলেও ভালো হইত, কোন পুলাপান থাক্তু না, কোন ব্যাডায় তারে এমন কইরা, জুড় কইরা গাওনা গাওইত পারত না”! চোখ জ্বালা করে উঠে, সে সব দুঃখ-কান্না ধামা চাপা দিয়ে গীত ধরে।
নামে এংরাজ হলেও, সে ইংরেজি জানে না, সে জানে না ইংরেজিতে একটা কথা আছে “শো মাস্ট গো অন”। একথা ব্রড ওয়ের থিয়েটার এর নামী অভিনেতার জন্য যেমন প্রযোজ্য তেমনই এই অন্ধকার এঁদো পাড়াগাঁয়ের হ্যাজাক জ্বালানো মঞ্চের কুশীলবদের জন্যও সত্য! শিল্পীর শিল্পই তার শ্রোতা, দর্শক বা সমজদারদের জন্য সব, এই ফ্রেমেই বাঁধা পরে থাকে তাঁদের জীবন। ক্লান্তির ক্ষমা নেই, প্রয়োজনের ক্ষমা নেই, শুধু মৃত্যুই বুঝি ফুরসৎ দিতে পারে অথবা সব ছেড়ে ছুঁড়ে পালিয়ে গেলেই বুঝি মুক্তি মিলে শো ম্যানদের, এংরাজের ভাষায় “শু ম্যান”! সে শিল্প বুঝে না, সে দর্শন বুঝে না, তার গান তার নাচ, তার কিচ্ছা, সব তো এইসব লোকদের আনন্দের জন্য, না হয় এর বিনিময়ে টাকা নেয়, তাই বলে এভাবে বানরের মত, তাকে "খেইল" দেখাতে হবে, “তার কইলজার টুকরা কই পইড়া রইলো”, আর সে কই?! নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে সে গাইতে থাকে। কিন্তু কান্না এলে গান গাওয়া যায় না, তার ভাঙ্গা গলা শুনে, আচানক মুর্শিদ মিয়া ধমকে উঠে, “যাও মিয়া কলেত্তে মুখ-হাত ধুয়া আউ, তোমার কান্দন শুনতে অতলা ট্যাহা দিসি”। মজলিসের লোকেরা চুপ হয়ে থাকে, খানিক লজ্জা বা সমবেদনা বুঝি জাগ্রত হয়, কিন্তু চশমখোর হাবিলদার বা তার দোস্ত মুর্শিদ মিয়া কি আর ছাড়ে, তাদের ডরে কেউ কথা বলে না। নওশার বাপ কথা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যান, ঝামেলা এড়াতে আর কিছু বলেন না!
দোস্ত মুর্শিদের চোখ পাল্টি তারে আরও কষ্ট দেয়। আসলেই তো, সে কে? “কিসের দোস্ত, হাবিলদার তো, সাব মানুষ তারে সম্মান করতে হইব আগে”। চোখ মুছতে মুছতে এংরাজ কলের পারের দিকে যায়, এদিকে একটু ভিড় কম, খানিক অন্ধকার। কল পারের পাশেই কলার বাগ, বাড়ির ভিতর থেকে দেউড়ীর বেড়া, গাছপালা, ঘর বাড়ি, এসবের ফাঁক ফোঁকর গলে কিছু আলো লম্বা লম্বা হয়ে এসে এখানে পড়ছে। এই আলো আঁধারিতে একটা খচ মচ শব্দ শুনে জল চোখে সামনে থাকায় এংরাজ। মনা দাঁড়িয়ে আছে তার সাইকেল নিয়ে। “এই ফাজিল ছ্যাড়ারে জ্যান ফেরেস্তার লাহান লাগে”। “কাহা,বাড়ির পিসের জঙ্গলা দিয়া, সাইহেল লয়া বাইর হয়া যাও, কেউ টের পাওনের আগেই, মুর্শিদ কাহাই এই বুদ্ধি দিসে, পরেরটা পরে হইবু”।
অন্ধকারে চোখ বুজে প্যাডেল মারছে এংরাজ। আকাশ জুড়ে একটা পাণ্ডুর মুখ আর দুইটা বড় বড় চোখ তার অপেক্ষায় তখনো জেগে, প্রাণ পণ চোখ মেলে রাখতে চায়, তার পাগলা বাবাটার মুখটা দেখবার জন্য, থেকে থেকে অচেনা এক ঘুম তার চোখে নেমে আসতে থাকে, সে দুর থেকে তার বাবার গান শুনতে থাকে। আর এংরাজ মিয়া শুনতে থাকে, মনার গলা দূর থেকে ভেসে আসছে। মনা গাইছে,” ভেঙ্গেছে পিঞ্জর, মেলেছে ডানা, উড়েছে পাখি, পথ অজানা, নীরেরই ঠিকানা পাবে কিনা পাখি সে নিজেও জানে না”।
চোখে জল আর বুকে আশা নিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে এংরাজ চলতে থাকে। মনার গান তাকে বুঝিয়ে দেয়, শো-ম্যানদের শো কখন থামে না! তার নাম এংরাজ হলেও সে ইংরাজি জানে না, জানলে এখন বলত, "শো মাস্ট গো অন"।
দূরে এক জোড়া ক্লান্ত চোখ তখন বুঝি জেগে আছে আকাশ জুড়ে।
পরিভাষাঃ
ঠিসি করেঃ ঠাট্টা করে, আউল্যা চালঃ আতপ চাল; গাইলঃ উদখুল, কাঠের তৈরি বালি ঘড়ির মত দেখতে পাত্র বিশেষ যেখানে পিঠার চাল গুড়ি করা হয়; ভাউঃ গুছানো, বন্দোবস্ত করা; বাস্তাম নাঃ বাঁচব না; পুলা-ভাতঃ পোলাও; মিডুরিঃ ক্ষীরের মত পাতলা এক ধরনের মিষ্টি, গুড়, চাল দিয়ে বানানো হয়। বাইলঃ মিথ্যা; উমালিঃ দুষ্টুমি; হিজলাঃ হিজড়া; মাহরিঃ মেয়ে মাকড়সা; পণ্ডলঃ পণ্ড।
২| ২১ শে জুলাই, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:০৯
চাঁদগাজী বলেছেন:
ভালো প্লট বানায়েছেন; লেখার ষ্টাইলটা তেমন পছন্দ হয়নি; অনেক লম্বা করে ফেলেছেন।
২১ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৯:৫৩
রবাহূত বলেছেন: চাঁদ্গাজী ভাই ধন্যবাদ! বিপদ হল কি এখন মানুষ আর গল্প লিখে না, রিপোর্ট লিখে ছোট ছোট লেখা, কোন ভাষার ব্যবহার নাই, বাক্য নিয়ে খেলা নাই, ছন্দ নাই! আমি দুঃখিত আমার ভাষা আপনাকে স্পর্শ করতে পারেনি, কিন্তু আমার লেখা আপনি শব্দ করে যদি পড়েন একটু একটা ছন্দ পাবেন, তখন আর দীর্ঘ মনে হবে না! ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়বার জন্য!
৩| ২১ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৮:০৩
রাজীব নুর বলেছেন: হ্যাজাকবাতি তো সন্ধার পরই জ্বালাতে হয়।
মুর্শিদ মিয়ার চায়ের দোকানে একদিন যাবো।
এংরাজ মানে কি?
সব মিলিয়ে ভালো।
২১ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৯:৫০
রবাহূত বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই রাজীব। হ্যাজাক বাতির একটা ফেস্টিভ এপিরিয়ান্স আছে, সেটাই বলতে চেয়েছি। এংরাজ মিয়া কুচকুচে কালো, তাই তার দাদা ব্যাঙ্গ করে ইংরেজ রেখেছিল, ক্রমেই তা এংরাজ হয়ে গেলো!
৪| ২১ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ১১:১১
মা.হাসান বলেছেন: বহুদিন পরে ব্লগে আপনাকে দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগলো । সম্ভবত গতকাল একটা পোস্ট দিয়েছিলেন মনে হলো, কিন্তু গতকালকে ব্লগে সেভাবে ঢুকতে পারিনি, ব্যস্ততা ছিল। অনুমান করছি ব্লগে সরকারিভাবে ব্লক থাকায় অনেকের মতো আপনিও ব্লগে ঢুকতে পারেননি। যারা দেশে থেকে ব্লগ ব্যবহার করছেন, প্রায় সবাইই ভিপিএন বা টর ব্যবহার করে ঢুকছেন।
রাজ্জাকের একটা সিনেমা ছিল নাম জোকার। মানুষের জীবনে যারা আনন্দ বিলিয়ে বেড়ায় তাদের জীবনের কষ্ট নিয়ে সিনেমা টা হয়েছিল। শিল্পী ব্রডওয়ের হোক বা বটতলার, সবাই মানুষ। এদের জীবনে যত কষ্ট আসুক না কেন আসলেই শো মাস্ট গো অন । গতকালকের পেপারে সম্ভবত এসেছে, একজন কমেডিয়ান কমেডি শো করা অবস্থায় মারা যাওয়ার পর দর্শকরা ভেবেছিলেন এটাও একটা ভাঁড়ামি।
ভাষা -কাহিনী সবকিছু মিলে আমার কাছে এ লেখাটা অনন্য মনে হয়েছে। চৌষট্টি চৌখুপির মতো আরোএকটা কাহিনী উপহার দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
২৩ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ২:১৪
রবাহূত বলেছেন: হাসান ভাই সালাম ও ধন্যবাদ! আপনাদের উৎসাহ অনেক সাহস দেয়! লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে খুব ভালো লাগলো! খুব ভালো থাকেন ভাই!
৫| ২২ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ১:১২
সেলিম আনোয়ার বলেছেন: পরোটা পড়া সম্ভব হলো না পড়ে কমেন্ট করবো। দিনের দীর্ঘ তম পোষ্ট।
২৩ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ২:১৫
রবাহূত বলেছেন: দুঃখিত কষ্ট দিলাম।
৬| ২২ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৩:৪৮
আনমোনা বলেছেন: অসাধারন।
২৩ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ২:১৫
রবাহূত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, উৎসাহ পেলাম!
৭| ২২ শে জুলাই, ২০১৯ সকাল ৮:৫০
রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই রাজীব। হ্যাজাক বাতির একটা ফেস্টিভ এপিরিয়ান্স আছে, সেটাই বলতে চেয়েছি। এংরাজ মিয়া কুচকুচে কালো, তাই তার দাদা ব্যাঙ্গ করে ইংরেজ রেখেছিল, ক্রমেই তা এংরাজ হয়ে গেলো!
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আমার মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার জন্য।
২৩ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ২:১৬
রবাহূত বলেছেন: কষ্ট করে প্রশ্ন করবেন আর উত্তর দিব না?
৮| ২২ শে জুলাই, ২০১৯ সকাল ১০:০৬
সাাজ্জাাদ বলেছেন: ভাই চমৎকার লিখেছেন।
অসাধারন।
শো মাস্ট গো অন।
২৩ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ২:১৬
রবাহূত বলেছেন: সাজ্জাদ ভাই অনেক ধন্যবাদ!
৯| ২৬ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ২:২০
ঠাকুরমাহমুদ বলেছেন: ব্লগে বড় গল্প অনেকদিন পড়িনা কারণ বড়গল্প গুলো বোরিং হয়, আপনার গল্প বোরিং লাগেনি, ভালো লেগেছে। ধনবাদ।
২৭ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৪:৩৮
রবাহূত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাই!
©somewhere in net ltd.
১| ২১ শে জুলাই, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২১
রাজীব নুর বলেছেন: আওয়াজ দিয়ে জানান দিয়ে গেলাম। পরে পড়বো।