নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“The oldest and strongest emotion of mankind is fear,
and the oldest and strongest kind of fear is fear of the unknown”
Supernatural Horror in Literature (1927);
H. P. Lovecraft (1890–1937)
(১)
ছোট ছোট হাত পা, এক রত্তি মুখ, যেন কুশী কুশী বিড়াল ছানা। আমাদের খুশি আর ধরে না। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি যতক্ষন না নোরা ধমকে উঠে। বাবাদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে হয় না, নজর লাগে। আমার ভারী রাগ হয়, যতসব কুসংস্কার! নোরা না থাকলেই আমি দেখতেই থাকি, নাক ডুবিয়ে গন্ধ নেই, এদিক সেদিক তাকিয়ে ছোট ছোট ঠোঁট গুলোতে চুম দেই, নোরা দেখলে সমূহ বিপদ আমি জানি এ কাজটা ঠিক না, কিন্তু কি করি এত মিষ্টি এক রত্তি এই ছেলেটা আমার !!
কিন্ত কান্না যখন শুরু করে, ও বাবা, এইটুকু শরীর থেকে এ আওয়াজ কিভাবে বের হয় বুঝি না! সাইরেনের মত। হাসিখুশি থাকে বেশীর ভাগ সময় কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কান্না জুড়ে। পেডিট্রেশিয়ানের সাথে কয়েকবার বসেছি কিছুই পাওয়া যায়নি। গ্রোথ ওয়েট খুব সুন্দর কোথাও কোন কমপ্লেইন নেই। শুধু মাঝে মাঝে কারণ ছাড়া এই এক কান্না। ভাবলাম ঘরের হিটার বুঝি ঘর যথেষ্ট গরম করে না, তাই বেবি কট ঘুরিয়ে হিটারটার কাছাকাছি নিয়ে এলাম। আর বলতে কি তার সেই চিল চ্যাচানি কান্না থেমে গেল। আমি আর নোরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি আসলে বেশী বাঁচলাম। ক্লাস, প্রজেক্ট, কাজে ঠাঁসা ব্যস্ত জীবনে রাতের ঘুমটা ব্যাঘাত ঘটলে খুব কষ্ট হয়। কফির পর কফি খেয়ে দিন পার করা কষ্টকর।
মাঝে মাঝে আমাদের ষোল তলার ছোট্ট এপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে আকাশ দেখি, ছোট ছানাটা আমার কোলে লেপ্টে থাকে কি যে এক অবাক করা একটা অনুভূতি হয়। আমাদের জানালা দিয়ে পিছের রাস্তাটা দেখা যায়। রাস্তা পেরুলে একটা স্কুল। ছোট ছোট বাচ্চারা খেলা করে, মাটিতে ধুম ধাম পরে যায়। আবার উঠে দৌড় দৌড়। ডিও কে এগুলো দেখাই, কি বুঝে কে জানে বু বু, গা গা জাতিও একটা সাউন্ড করে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে টুক করে একটা চুম খেয়ে দেই বু বু গা গা ঠোঁটে। জীবন সত্যি সুন্দর।
সাত মাস হল আজ, মে পাঁচ, আমি সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি, ছোট্ট একটা কেক নিয়ে, প্রতি মাসের পাঁচ তারিখ আমরা কেক কেটে যাচ্ছি, এটাই এক রকম উৎযাপন। আগে শুধু আমার আর নোরার ছিল এ উৎযাপন, এখন ডিও ও খুব মজা পায়, গত মাস থেকেই বুঝে গেছে, কিছু একটা “ফান” হচ্ছে, “দেই দেই” বলে তালি দেয়। কিন্তু আজকে ঘরে ফিরে আমি অবাক নোরা আমাদের ঘরটা কি সুন্দর করে সজিয়েছে। পুরো ইন্টেরিওর চেঞ্জ। বেবি কটটা জানালার কাছে থেকে সরিয়ে আগের জায়গায় নিয়ে এসেছে, জানালায় সুন্দর একটা পর্দা ঝুলিয়েছে, অনেক আগে কেনা ছিল কিন্তু ঝোলানো হয়নি, বিছানার হেড বোর্ডের উপর সুন্দর আমাদের একটা ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ ঝুলিয়েছে, আর ছোট ছোট এল ই ডি লাইট ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে ঘরটা সাজিয়েছে, দেখলাম কিছু ছোট ছোট গাছও এখানে সেখানে রেখেছে, মনেই হয় না আমাদের ঘর!
“কখন এসব করলে”? আমার বিস্ময় জিজ্ঞাসা।
“তুমি বের হবার সাথে সাথে আমিও বাবুকে নিয়ে বেরিয়ে গেছিলাম, পিছের গ্যালারিয়া থেকে সব কিনলাম, শুধু তাই না ফ্রিজ খুলে দেখ তোমার কেকের চেয়ে সুন্দর কেক নিয়ে এসেছি, ডিওর ছবি ওয়ালা।” গর্বিত কন্ঠে বলল নোরা।
“ওরে বাবা এত্ত কিছু করলে ওকে নিয়ে সব পারলে”?
“নাহ, নাইজেলা কে বলেছিলাম ও বেবি সিটিং করলো”।
“ও বাবা তাহলে অনেক টাকা নিয়েছে!”নাহ আমি সেধেছিলাম, নেয় নাই, উল্টো বলল যখন ও ফ্রি থাকে তখনই যেন ডাকি, ডিওর সাথে ও সময় কাটাবে, আর বলল কি কিউট বেবি। ও আসলেই অনেক ভালো।“
ভালো তো বটেই, তবে খিচুড়ি আর বিফ ভুনার লোভও আছে”।
নাইজেলা আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে ইষ্ট ইউরপিয়ান, সাধাসিধে ভালো মানুষ, আমাদের খিচুড়ি মাংস, হলে ও বাঁধা অতিথি। ঝাল এ হু হা করে আবার খুব পছন্দ করে। আমাদের এই স্টুডেন্ট ডর্মে, পৃথিবীর নানা দেশের নানা বর্ণ, নানা গোত্রের মানুষ রয়েছে। লম্বা বেটে, চিকন চওড়া, সাদা কালো, পিঙ্গল লাল, সব সব। বার্লিন আসলেই একটা কসমোপলিটন সিটি।
সন্ধ্যায় আমাদের পার্টি হল। আমরা আমরাই, তিনজনেরই এই ভরপুর দুনিয়া। ডিও কি বুঝলো কে জানে অনেক মজা পেল হামা দিয়ে হামা দিয়ে বেলুন ধরলো, একটু কেক আমি খাইয়ে দিয়েছি, নোরা দেখেনি। এসব বাইরের খাবার টাবার ও দেয় না বাচ্চাকে। অনেক ছবি তুল্লাম, নোরা এখন এগুলো ফেইস বুক আর ইন্সটাতে আপলোড দিচ্ছে। আর ডিও কাদার মত নরম একটা ওম ওম গোল্লা বল হয়ে আমার কোলে ঘুমিয়ে আছে। আমি প্রাণ ভরে ওর গন্ধ নেই। শিশুর গায়ের গন্ধের মত এমন মজা মজা গন্ধ আর কিছুতেই নেই। আমার ওকে বেশী আদর করতে নিলেই কেন যেন এক কান্না আসে। আমার এই ছিঁচ কাঁদুনে অভ্যাস নিয়ে নোরা কম ক্ষ্যাপায় না আমাকে! তাও সামলাতে কষ্ট হয় মাঝে মাঝে নিজেকে।
ওর বিছানায় আলতো করে শুইয়ে দেই, ছোট ছোট হাত গুলি মুঠি মুঠি করে আছে, ছোট ছোট ধার ধার নখ। আমি হাতটা একটু তুলে হালকা একটা কামড় দিয়ে, পাতলা কম্বলটা টেনে দিলাম, আর ওর প্রিয় একটা কুশন আছে লাল একটা লেডিবাগ, ঘুমের সময় এটা তার লাগেই, ওই কুশন দিয়ে ওকে হালকা চাপা দিয়ে, আমি বিছানায় চলে এলাম।
ঝলমলে শহরের ব্যস্ত সময় বুঝি হাওয়ায় উড়ে যায়, যেন হাওয়াই মিঠাই যেন “ডাস্ট ইন দ্য উইন্ড”, এক মুঠো ধুলো। এ প্রাচীন শহরের রোদে হাওয়া সময় কেটে যায় যেন ঘড়িরও আগে, বছর পেরিয়ে গেছে কবে, ডিও এখন আধো আধো কথা বলতে শিখেছে। কি মজার যে লাগে শুনতে আমি কাজ থেকে ফিরে একই কথা বার বার শুনি। আমার কান্ড দেখে নোরা হাসে। ডিও ও হাসে।
এর মাঝে এক রাতে আবার সেই কান্না আমি ধরমর করে বিছানায় উঠে বসি! ডিওর কাছে ছুটে যাই, নোরা পিছু পিছু আসে, কোলে নিয়ে দেখি ওর ছোট্ট বুকটা প্রচন্ড ভাবে উঠানামা করছে, আমি গালে মুখে চুমু দিতে থাকি পিঠে হাত বুলাতে থাকি, “কি হয়েছে বাবা? এই তো বাবা চলে আসছি কোন ভয় নেই, কোন ভয় নেই”। বলে ওকে ঠান্ডা করতে থাকি। কান্না আর থামছে না প্রচন্ড এক আতংক যেন ওকে পেয়ে বসেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যা বলছে আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু একটা কথাই বুঝলাম, “ভয় পাখি”।
(২)
ঘরে একটা প্যাডেস্টাল ল্যাম্প জ্বলছে তার ম্লান হলদে আলো ক্লোজেটের উপরটা একটু আলো আঁধার করে রেখেছে, আমি হাত দিয়ে দেখলাম উপরে পলিথিন বা এমন কিছু আছে কিনা যার ছায়া ওকে ভয় দেখাচ্ছে। নাহ কিচ্ছু নেই।
ওকে কোল থেকে নামিয়ে আমি চেক করছিলাম ক্লোজেটের উপরটা, ওকে বুঝানোর জন্য যে ওখানে কিছু নেই, সে সময় ও আমার ট্রাউজার দুই হাতে খামচে ধরে টানছিলো যেন আমি ওখান থেকে সরে যাই। আমি কোলে তুলে নিয়েও ওকে সামলাতে পারছিলাম না। প্রচন্ড এড্রিনাল রাশ গায়ের জোর বাড়িয়ে দিয়েছে ওর, হিস্টিরিয়া রোগীর মত করছে, শরীরটা উল্টাদিকে বাঁকা করে মাথাটা সমানে দুপাশে নাড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে। একসময় বড় বড় চোখ করে ও জানালার দিকে তাকিয়ে বল্ল, "es ist weg” তার স্বল্প শেখা জার্মানে বল্ল "চলে গেছে"। আমার ঘারে এখন লটকে আছে ডিও,,ন্যাতপ্যাতানি হয়ে ঝুলে আছে মাত্র। মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কী যে কষ্ট হচ্ছে আমার! কেন এমন ভয় পাচ্ছে?? আমি সারারাত বাচ্চাটাকে বুকে করে জেগে থাকলাম। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না।
পর পর দুইটা স্ট্রং ব্ল্যাক কফিও "ক্লান্তি আমার" ক্ষমা করতে পারলো না। লাল চোখ আর রুখুসুখে চুল বুঝিয়ে দেয় ঘুম হয়নি রাতে। আলতো করে ঘারে হাত রেখে আমার কলিগ ঈভ জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? ঈভ নামে দুনিয়াতে মনে হয় এই একজন লোকই আছে। অদ্ভূত এক চরিত্র একটা কালো ফেডোরা হ্যাট সব সময় মাথায়, যেন সুপার গ্লু দিয়ে আটকে রেখেছে। অফিসে প্রচলিত আছে রাতে ঘুমানোর সময়ও সে এই হ্যাট পরেই ঘুমায়।
খুব মায়া করে জিজ্ঞেস করে ঘুম হয়নি রাতে? আমার জন্য একটা কফি বানিয়ে এনে আমার পিছনে এস দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে ঈভ।?
না করবার উপায় নেই বেচারা শেষ কফিটা আমার জন্য বানিয়ে এনেছিলো। কফি শেষ কিন্তু মগটা তখনো গরম, দুইহাতে ধরে আমি উষ্ণতাটুকু নিজের মাঝে নিতে চাইছি। খুব ক্যামন একটা অবস্থায় পরেছি নিজেই বুঝে উঠতে পারছি না, ঈভকে কি বলব?।!
তাও রাতের ঘটনাটা ওকে বলি। চুপ করে সব শুনে। তারপর শান্ত কন্ঠে ও বলে “হি ক্যান সি থিংস, লাইক মি। আমি অবাক হই, "মানে?" ঈভ ওর হেইতি ইংরেজিতে বলতে থাকে, " ইউ নো আ'এম ভুডু প্রিস্ট আ ক্যান সি থিংস, গুড এন্ড ইভিল থিংস"। অফিসে শুনেছি ঈভ ভুডু টুডু জানে, আমি সিরিয়াসলি বিষয়টা নেইনি কখনো বরং মজা করতাম, ও কাছে আসলেই, জিমি হেন্ড্রিক্সের ভুডু চাইল্ড গাইতাম, ফান করতাম। এখন মনে হচ্ছে, ও হয়তো চাইলে হেল্প করতে পারে৷ দুনিয়ায় কত কিছুই না আছে আমাদের জানা শোনার বাইরে।
"ঈভ তুমি কি এর মাঝে একদিন বাসায় আসবে? আমাদের সাথে ডিনার করবে আর ডিওকে একটু দেখবে?"
"অবশ্যই তোমার বউ এর বিরিয়ানির কথা কি ভুলতে পারি। আমি আবশ্যই আসবো"।
আমি জানি একা মানুষ কি খায় না খায়, তাই আমাদের বাসায় ভালো মন্দ কিছু হলে মাঝে মাঝে ওর জন্য নিয়ে আসি।
ফ্রাইডে নাইটে সে আসবে, এমন ভাবে কথা ঠিক হল। আমি কোন মতে অফিসে দিনটা পার করলাম কাজ একটুও কিচ্ছু হল না। মাথায় খালি ঘুরছে, " হি ক্যান সি থিংস"... "ভয় পাখি"... "es ist weg"! সত্যি কি ডিও জ্বীন-ভূত দেখে? এও কি সম্ভব। জ্বীন-ভূত তো শুধু ভূত এফএম এই থাকে, এই কঠিন দুনিয়ায় বেচারারা পালানোর পথই পাবার কথা না। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও দুশ্চিন্তাটা যাচ্ছে না। ভয় পাখি যেন দূরে কোথাও ডানা ঝাপ্টাচ্ছে!
হ্যাপি গো লাকি সন্ধ্যা, আমরা আইস্ক্রিম খেলাম, ডিওর জন্য রং পেন্সিল কিনলাম। ও খুব খুশী! আমরাও বাসায় চলে এলাম। আমি আর ডাইনিং টেবিলে বসে ছবি আঁকছি, ওর বয়সের তুলনায় ওর আঁকার হাত অস্মভব ভালো, ওর মায়ের জিন থেকে এসছে, নোরা চারুকলায় পড়েছে, দেশে থাকতে বেশ কিছু গ্রুপ এক্সিবিশনও করেছে, এখানে বেচারা গ্রাফিক আর্টিস্ট হয়ে রং তুলি নিয়ে আর বসবার সময় পায় না। যা আঁকা আঁকি ওই ল্যাপটপেই।
আমি ডিও কে আঁকতে দিয়ে বেড রুম থেকে আমার ফোনটা আনতে গেলাম। এসে যা দেখলাম, সেটা আমি দেখবো ভাবি নাই একদম।
পুরো কাগজ জুড়ে অদ্ভুত এক কালো পাখি একে রেখেছে, লাল পুতির মত চোখ। বাচ্চাদের ছবি দেখতে যেমন মজার লাগে এটা মোটেও সেরকম নয়। অপার্থিব, অশুভ, নরকের অন্ধকারের মত কালো।
ওর বলতে হল না আমি বুঝে গেলাম ভয় পাখি।
আজকে রাতে আমরা তিনজন লিভিং রুমে শুলাম, আমাদের ঘরে না শুয়ে। ডিও ও ঘুমিয়ে গেল ওর ঘুমের সময়। এক দলা ময়দার কাই এর মত ঘুম, বাচ্চাটা আমার! নোরাও ঘুম। আমার শুধু ঘুম নাই চোখে। আমি নিশব্দে আমাদের বেড রুমে আসি, ঘরটা আতি পাঁতি করে খুঁজে দেখি কোন কিছু অস্বাভাবিক আছে কিনা। কোনো কিছুই আমার চোখে পড়ে না। চেয়ার এনে ক্লোজেটের উপরটা পরিস্কার করে ফেলব ঠিক করলাম। এত উঁচু বাসায় তেমন ধুলা বালি হয় না। তারপরও পাতলা একটা ধুলার স্তর থাকে। ডাস্টার দিয়ে সাবধানে ঝেড়ে ঝেড়ে কিনারে নিয়ে এলাম যেন ফ্লোরে না ফেলে হাতে রাখা ন্যাপকিনটায় ফেলতে পারি। নোরার আবার পরিষ্কারের বাতিকটা একটু বেশিই ধরা খেলে এই রাত্তিরেও বকা খাবো। ময়লা গুলি আস্তে আস্তে হাতে রাখা ন্যাপকিনটায় ফেলতে লাগলাম। প্রথমে খেয়াল করি নাই। তারপর হাতে দেখলাম খড়খড়ে ঘিয়ে রঙ্গের কি এক বস্তু ময়লার সাথে দেখা যাচ্ছে। অনেকটা ককুনের মত ঈষৎ বাঁকা বাঁকা, জালি জালি, গুটি পোকার ছেড়ে যাওয়ার খোসার মত তবে বেশ বড় বড় আর ধরলেই শন পাপড়ির মত গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। তারপরও খুব সাবধানে একটা জিপলগ স্যন্ডুইচ ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম কালকে অফিস গেলে ঈভকে দেখাবো। হয়ত কোনো পোকার ছেড়ে যাওয়া গুটিই হবে। কিন্তু মনটা শান্তি পাচ্ছে না।
(৩)
আমার রাত কাটে অসহ্য উদ্বেগে। প্যাডেস্টাল ল্যাম্পের ম্লান হলদে আলোতে ঘরের প্রতিটি কোণ আমি খুঁজে দেখি, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারি না। কিচ্ছু অস্বাভাবিক চোখে পড়ে না। নোরার নির্দিষ্ট নিস্তব্ধতা এবং ডিওর শান্ত ঘুমের মাঝে আমি আমার কৌতূহল এবং উদ্বেগ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি।
বিকেলের বেলা অফিস থেকে ফিরে ঈভ আমাদের বাসায় এসে পৌঁছেছে। তার সঙ্গের অদ্ভুত অন্ধকার হ্যাট এবং গম্ভীর মুখ। কিন্তু ঈভের জন্য প্রস্তুত করা বিরিয়ানির সুগন্ধ কিছুটা স্বস্তি এনে দেয়। ঈভ ধীরেসুস্থে খাবার খেয়ে গল্প করে।
“তোমার রাতের অবস্থা শুনে আমি সত্যিই দুঃখিত,” ঈভ বলে। “তোমার ছেলে যে ভয় পেয়েছে, সেটা আমাকে দেখতে হবে। আমি চেষ্টা করব কিছু সাহায্য করতে।”
ডিও ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ঈভ আস্তে করে তার ঘরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পর ঈভ বাইরে আসে, তার মুখে একটি চিন্তিত ভাব।
“আমি কিছু দেখতে পাই, আই ক্যান সি থিংস, তোমাদের ছেলেও আমার মত, ও দেখতে পায়, যা তোমরা দেখ না” ঈভ বলতে থাকে, “একটি অদ্ভুত কালো পাখি, যা তোমার ছেলের ভয় তৈরি করছে। এটি আসলে পুরনো অন্ধকার শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু তুমি আতঙ্কিত হয়ো, আতঙ্ক আমাদের হত্যা করে।”
আমার মাথার মধ্যে অজস্র প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, যার উত্তর না জানে ঈভ না জানি আমি। ঈভ আমাকে একটা আদ্ভুত দর্শন পুরনো তাবিজ দেয় এবং বলে, “এটা তোমার পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য। রাতে এই তাবিজটি শিশুর ঘরের দরজার পাশে রাখো। এতে আশা করি, ওর ভয় কমবে।”
রাত গভীর হয়। আমি সতর্কতার সাথে তাবিজটি ডিওর ঘরের দরজার পাশে রেখে, বিছানায় চলে যাই। রাতটা খুবই নিরব এবং শান্ত। পরদিন সকালে, আমি দেখে অবাক হয়ে যাই—ডিওর মুখে একটা শান্তির ছাপ। তার ভয় অদৃশ্য হয়ে গেছে।
আমি ঈভের সাথে যোগাযোগ করি। ঈভ এসে দেখে, ডিওর ঘর পুরোপুরি শান্ত এবং আনন্দময়।
“দেখো, পাখির ভয় চলে গেছে,” ঈভ হাসতে হাসতে বলে। “শক্তির পেছনে যে পাখিটি ছিল, তা এখন কেটে গেছে। কখনও কখনও আমরা জানি না যে আমাদের আশেপাশে অদৃশ্য শক্তি আমাদের প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু প্রেম এবং বিশ্বাস সবকিছু জয় করতে পারে।”
আমরা ঈভকে ধন্যবাদ জানাই এবং তাকে ভালোবাসা দিয়ে বিদায় জানাই।
রাতের অন্ধকারে আমার মনে কোনো শান্তি নেই। ঈভ চলে যাওয়ার পরও, আমি বারবার ক্লোজেটের দিকে তাকাই, যেখানে আমি কিছু অস্বাভাবিক জিনিস দেখতে পেয়েছিলাম। তাবিজটি ডিওর ঘরের দরজার পাশে রেখেছি, কিন্তু আমার মনে ভয় ঘনিয়ে আসছে।
রাত তিনটার দিকে, ডিওর কান্নার আওয়াজ শুনে আমি বিছানা থেকে উঠে যাই। এবার তার কান্না আগের থেকে অনেক বেশি তীব্র এবং ভীতিকর। আমি ডিওকে কোলে তুলে নিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তার কান্না থামছে না। তার শরীর কাঁপছে এবং চোখে অদ্ভুত এক ভয় দেখা যাচ্ছে।
একের পর এক সেকেন্ড পেরিয়ে গিয়ে রাতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ঘরের বাতি জ্বলছে না, ক্লোজেটের ওপরের ধুলার স্তর আরো পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, যেন কিছু স্যাঁতসেঁতে কিছু এখানে রয়েছে। আমি বুঝতে পারি, ভয় পাখির কালো ছায়া এখানে প্রকট, হয়তো এই অস্তিত্ব আমাদের কাজে বিরক্তে তাই তার উপ্সথিতির আঁধার কে সে আর গাঢ় করে দিয়েছে। ছেলেটা আমার বুকে তিরতির করে কেঁপে কেঁপে উঠছে। নোরা পুলিশ কে ফোন করতে চাইছে। পুলিশ কি আর এর সুরাহা করতে পারবে?!
পরের দিন, ঈভকে আবার বাসায় ডাকতে বাধ্য হই। ঈভ যখন আসে, তার মুখ খুব গম্ভীর দেখায়। সে ডিওর ঘরটিতে প্রবেশ করে এবং কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।
“আমি আগেই বলেছিলাম,” ঈভ বলে, “এ শক্তি সহজেই চলে যাবার নয়। এরা অনন্ত আঁধারের সব অশুভ শক্তি নিয়ে হাজির হয়। হয়তো লিলিথের শত-সহস্র সন্তানের কেউ কিংবা কে জানে সেই অপবিত্র আত্মা সয়ং এখানে হাজির কিনা, সেই ফলেন এঞ্জেল যার কথা লেখা আছে বুক অফ ইনআকে”। তার এসব কথা বার্তা শুধু ভীতি জাগায়, হরর মুভিতে এসব দেখেছি, ডেভিড সেল’টজার এর বই এ এসব পড়েছি। এ কখনো আমার জীবনে আসবে আমি ভাবিনি। একটা কথাই শুধু মনে আসে “হোয়াই মি”!
ঈভ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান শুরু করে। ঘরের বাতি বন্ধ করে দিয়ে, সে ঘরকে ধোঁয়া দিয়ে পূর্ণ করে দেয়। কিছু মন্ত্র পাঠ করে, ঈভ একটি অদ্ভুত কালো পাখির প্রতীক আঁকতে শুরু করে। পুতির মত লাল চোখ! এক অপার্থিব ঘৃণা নিয়ে বুঝি তাকিয়ে থাকে। ঈভের মন্ত্র পাঠের সময়, ঘরটি অদ্ভুতভাবে কেঁপে ওঠে। কিংবা আমার কাছেই শুধু এমন মনে হয়। এক ধরনের কালো মেঘ বুঝি ঘরের ভেতরে ভাসমান হয়ে ওঠে, জমাট বাঁধে আবার মিশে মিশে যায়। ডিওর কান্না আরো তীব্র হয়। আমি বুঝতে পারি, যে ভয়ংকর শক্তি এখানে মিশে আছে। নোরা পাশের ঘরে হিস্টিরিয়া রোগীর মত কাঁদছে। সে এসব বিশ্বাস করে না। ঈভের এই সব কান্ড কারখানা ও করতে দিতে চায়নি। আমি বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়েছি।
ঈভ অচেনা ভাষায়, গভীর-গম্ভীর সুরে কিছু পাঠ করে, ছোট বোতল থেকে হোলি ওয়াটার ছিটিয়ে দেয়। আর সব শেষে একটা খড়ের উপর চট দিয়ে বানানো একটা কুৎসিত দর্শন পুতুল বের করে ডিওর ক্রিবের নীচে বেঁধে দেয়।একটি প্রাচীন আর অদ্ভুত ঘোর লাগা চোখে দেখি সেই প্রায় স্বচ্ছ না দেখা মেঘের দল বুঝি সেই পুতুলটির ভিতর ঢুকে গেল। এর কোনো ব্যাখ্যা আমি জানি না, কিংবা এ আমি দেখিইনি, হয়তো এক অসহায় বাবার কল্পনা!
“এটি শুধু শুরু,” ঈভ বলে, “এখনও ভয় পাখির সম্পূর্ণ শক্তি সরিয়ে ফেলতে পারিনি। এটি একটি পুরনো অনুশোচনা, যা মেনে নেয়া খুবই কঠিন। আমি কিছু সাহায্য করতে পারব, আমাকে প্রতিদিন এ রিচুয়াল করে যেতে হবে তবে কিছু জিনিসের সাথে আপনাদের নিজেই মোকাবিলা করতে হবে ভালোবাসা হচ্ছে সেই শক্তি যা ভয়কে পরাজিত করতে পারে।” বলে দমকে দমকে কেশে উঠলো ঈভ, ওর কালো চৌকো মুখে একটা বেদনাক্লিষ্ট হাসি ফুটে উঠলো। “ জানোতো আমার বাবা ভুডু প্রিস্ট ছিলেন হেইতিতে, তাঁর কাছেই সব শেখা আমার, বাবা বলে গেছেন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাকে লড়তে, যদিও এতে আমার চাপ হয় ভীষন, অসুস্থ্য হয়ে যেতে পারি, চিরনিদ্রাও পেয়ে বসতে পারে, কিন্তু আমাকে থামলে চলবে না।“
গাঢ় কালো কফি আর ব্রাউনি খেয়ে ঈভ যখন চলে গেলো, আমাদের এই ছোট্ট বাসাটি আর দশটি বাসার মতই মনে হল। টিভিতে শিশুতোষ গান, বাতাসে নোরার তৈরী ডিনারের সুঘ্রাণ, জীবন বুঝি ফেরে পেল চের চেনা ছন্দ।
(৪)
রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় অদ্ভুত এক কড়ড়কট, কড়ড়কট শব্দে। জেগে উঠি আতঙ্কে। দেখি ডানা ঝাপ্টায় এক বিশাল অন্ধকার আমার জানালায়। অন্ধকার চোখ সয়ে এলে দেখি পুতির মত লাল চোখ, এ জগতের সমস্ত ঘৃণা যেন সে দৃষ্টিতে, এক অদ্ভুত কালো পাখি জানালার বাইরে ভাসছে, এস বসছে জানালার সিলে, ক্ষুরদার চঞ্চুতে জানালায় সেই অদ্ভুত শব্দে, সেই কড়ড়কট, কড়ড়কট শব্দে বুঝি আমাকে কোন ঈঙ্গিত দিতে চায়। আবার ঊড়ে যায়, আবার ফিরে আসে। আমি কিছু দেখি না, আমি কিছু বুঝি না। পাশে নোরা শুয়ে, ডিওর ক্রিবে ডিও শুয়ে, আমি ভুত গ্রস্তের মত জানালার দিকে এগিয়ে যাই। যেন আমাকে ডাকছে।
আমি জানালার কাছে চলে আসি। সেই অশুভ অন্যভুবনের অস্তিত্ব আর আমার মাঝে শুধু একটি কাঁচের ফারাক মাত্র। বাইরের অস্পষ্ট আলোতে দেখি সে ভয়ংকরকে। এমন আঁধার আমি দেখিনি আগে, তীব্র নখে, ঠোঁটে কি প্রচন্ড শক্তির প্রকাশ, ডানা গুলি যখন খুলে মনে হয় যেন পৃথিবীর শেষ সীমাটুকুও বুঝি আড়াল করে দেয় অশুভ কালো ছায়ায়। আমি জানালা খুলে দাঁড়াই নিথর, রাতের হাওয়া আমার নাকে মুখে ঝাঁপটা দেয়। আমি রাগে ক্ষোভে ঘৃণায়, হ্যাঁ একজন অসহায় বাবা আর কিবা করতে পারে, হাত দিয়ে পাখিটিকে ধরতে চাই, যেন হাতের নাগালে পেলে টেনে ছিঁড়ে ফেলবো শয়তানটাকে। কিছুই হাতে ঠেকে না ধোঁয়ার মত, হাওয়ার মত যেন গলে যায় আমার বজ্রমুষ্টি থেকে। আমি তাল সাম্লাতে পারি না, হাওয়ায় আমার শরীরটা ভেসে যায়। হাত দিয়ে ধরতে চাই কিছু, শুন্যতা ছাড়া আর কিচ্ছু হাতে থেকে না।
প্রচণ্ড একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। হৃদপিণ্ডটা যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সব শুন শান। শুধু নোরা আর ডিওর নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সব নিশ্চুপ।
সিদ্ধান্ত নেই, একটি নতুন বাসায় চলে যাব। আমাদের জীবন এখন ভয়ের একটি অদৃশ্য চিহ্নে ভরে গেছে। আমাদের বাসার প্রতিটি কোণায় সেই অন্ধকার শক্তির ছায়া অনুভূত হয়। আর নয়! এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি এক সময়।
ঘুম যখন ভাঙ্গে, সে জানালা দিয়েই দেখি রোদ এসে সব চিন্তার কালো ছায়া দূর করে দেয়। মনেই হয় না আমাদের জীবনে এমন কিছু ঘটছে। যে জানালায় আঁধার জমে রাতে সে জানালায় আলো ছটিয়ে দেয় জীবন। এই চিরায়ত সত্য!
ডিও তখনো ঘুমে, ওর ঘুম ঘুম গরম গালে নাক ডুবিয়ে ওর গন্ধটা টেনে নেই বুকের ভিতর। মন বলে উঠে আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই বাপ। ডিওর গন্ধটা বুক পকেটে ঢুকিয়ে, নোরাকে গুড বাই চুম দিয়ে বেরিয়ে যা্ই, কোনো মতে রেডি হয়ে ছুটি, ট্রেইন ধরতে, অফিসটা যেন লেইট না হয়।
ফোনটা এলো সাড়ে এগারোটায়। নোরা কি বলছে আমি প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, একদমই না। প্রচণ্ড ফোঁপাচ্ছে আর এর ফাঁকে ফাঁকে কি বলছে, বুঝতে পারছি না। বহু কষ্টে যা বুঝলাম তা শুনে আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। বিশ্বাস করতে পারছি না নোরা যা বলল।
ডিও নাকি বাসায় নাই। ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কি ভাবে সম্ভব একটা আড়াই তিন বছরের বাচ্চা ঘর থেকে, কিভাবে নাই হবে? আমি সাইন আউট করে বাসার দিকে দৌড়ালাম, ঈভকেও বলার কথা মাথায় আসলো না।
আমি বাসায় পৌঁছে দেখি পুলিশ এস গেছে। তাদের রুটিন কাজ তারা করে গেলো। নোরা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সোফায়। এই প্রথম তাকে আমি একা পেলাম। আমি আস্তে করে দুই হাঁটু মাটিতে রেখে ওর সামনে বসলাম। হাত দুটি আমার হাতে নিলাম। ও আর পারলো না নিজেকে ধরে রাখতে। আমার ভিতর কি চলছে কাকে বলবো, কি করে বুঝাবো? নিজে শক্ত হয়ে স্বান্তনা দিতে লাগলাম নোরা কে। আমি প্রাণপণ শক্তি দিয়ে নিজেকে ধরে রেখে ও কে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে একটু বলতো, কি ঘটেছিলো”।
কান্না আর কষ্টের প্রচন্ড একটা দমকের ফাঁকে ফাঁকে যা উদ্ধার করতে পারলাম তা মোটামুটি এই রকম। নোরা ডিওকে বেডরুমে রেখে ডাইনিং টেবিলে ওর ল্যাপটপে কাজ করছিলো। কাজের প্রেশার থাকায় ও খুবই ইনভল্বড হয়ে কাজ করছিলো। ঘন্টা খানেক পার হবার পর ওর খেয়াল হল অনেকক্ষণ ধরে বাচ্চার কোনো সাড়া শব্দ নাই, ও ঘরে গেল ডিও নেই , বাথরুম দরজা খোলা কেউ নেই সেখানে। আমাদের ছোট্ট এপার্ট্মেন্ট কোথাও লুকাবে এমন কোনো স্কোপ নাই। আতি পাতি করে খুঁজে না পেয়ে হাউজ মাস্টারকে কল করে, সিসি টিভি ফুটেজ দেখে যদি বের হয়ে যায় একা একা। না কোথাও বাচ্চাটার একটা ছায়ায় দেখা গেলো না। যেন একদম হাওয়ায় উবে গেলো। এর মাঝে আমাকে কল করেছে, পুলিশকে কল করেছে।
সম্ভব অসম্ভব কোন জায়গা বাদ রাখিনি খুঁজতে, ফ্রিজের ভিতর , ওয়াশিং মেশিন কিচ্ছু বাদ দেইনি। কোথাও নেই কোত্থাও নেই। এ কিভাবে সম্ভব! কি করবো আমরা এখন? এই ছোট্ট বাসা, এই বিশাল শহর, এই বিপুলা পৃথিবী সব যেন শুন্য অর্থহীন এখন আমাদের কাছে। এক নিঃশেষ আঁধার গাঢ় থেকে হচ্ছে গাঢ়তর। এক মুঠো, এক রত্তি একটা মানুষ যেন আমাদের প্রাণ ভ্রমরা ছিলো। কই খুঁজবো কার কাছে যাবো?!
আমার দমটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাসার ভিতর মনে হয় এতটুকু অক্সিজেনও আর নেই। আমি নোরার কাছে গেলাম, দেখি ও ডিওর একটা জামায় মুখ ঢেকে সোফায় হাত পা ছেড়ে বসে আছে। আমি ওকে বলি, “ চল নিচে গিয়ে একটু হেঁটে আসি আর আশ পাশটাও দেখে আসি। ও হাতের ইশারায় মানা করলো। আমি নিঃশব্দে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে কোরিডোরে এলাম। লিফটের কল বাটনে চাপ দিয়ে লিফটের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
হঠাৎ মনে হল লিফটের শ্যাফটের ভিতর থেকে বুঝি ডিওর গলা পাচ্ছি। বাবা, বাবা বলে ডাকছে। শ্যাফটের ভিতর থেকে শব্দটা আসছে। প্রথমে ভাবলাম মনের ভুল। কিন্তু ডাকটা আসছেই। নাহ ভুল না। লিফটের কার আসতেই আমি লিফটে ঢুকে গেলাম, নীচে নেমে হাউজ মাস্টার এর কাছ থেকে চাবি নিয়ে লিফট পিট, শ্যাফট চেক করতে হবে। কোনো না কোনো ভাবে ডিও হয়তো লিফটের শ্যাফটে আটকে গেছে বা পড়ে গেছে। লিফট পিটে শক এবজভার থাকে প্রায় তিন সাড়ে তিন ফিট ক্লিয়ারেন্স থাকে একটা বাচ্চা সেখানে সহযে বসে থাকতে পারবে। লিফটের বাটন টিপলাম। দরজা আটকে গেলো কিন্তু লিফট তো নিচে নামছে না। আমি অস্থির ভাবে বাটন চেপে ধরে থাকলাম। অন্য সব কল যেন না আসে। কিন্তু লিফট নড়ছেই না। হঠাৎ মনে হল লিফট ওয়ালের স্টেইনলেস স্টিলের প্যানেলের গ্রুভের চুল চেরা গ্যাপ দিয়ে বুঝি ডিওর ডাক আসছে। “বাবা, বাবা, আমি এখানে, আমি এখানে”। আমি গ্যাপে কান চেপে ধরি। হ্যাঁ এই তো আমি স্পষ্ট ডিও কে শুন্তে পাচ্ছি। আমি গ্যাপে চোখ রেখে দেখার চেষ্টা করলাম , মাথা শুস্থ্যা থাকলে বুঝতে পারতাম কি অদ্ভুত কাজ করছি। এই সুক্ষ ফাঁকা দিয়ে কিচ্ছু দেখা যাবার উপায় নেই। তবু মনে হল আমি যেন কিছু দেখতে পাচ্ছি। আমি পাগলের মত সেই গ্রুভের ভিতর আমার নখ ঢুকিয়ে প্যানেল খুলতে চাইলাম। পিচ্ছিল, নিষ্ঠুর , ঠান্ডা প্যানেলে, এতটুকু আঁচড়ও কাটতে পারলাম না। পকেট থেকে চাবি বের করলাম, সেখানে তিন ফলার সুইস আর্মি নাইফ থাকে । নাইফ বললে বেশী বলা হয়, নেইল ক্লিপ, ফাইল আর ছোট একটা চাকু। আমি সেটা সেই ফাঁকে ঢুকিয়ে প্যানেল খুলবার চেষ্টা করতে লাগলাম।
হঠাৎ কি হল লিফটটা প্রচন্ড গতিতে নীচে নামতে লাগলো। নামা বললে ভুল হবে মনে হল যেন দড়ি ছিড়ে নীচে পড়ে যেতে লাগলো । আমি নিজেকে ফ্লোরের সাথে মিশিয়ে দিলাম মাথা নীচু করে দুই হাতে ঘাড় চেপে ধরলাম। এটাই নিয়ম বলে জানি। লিফট ছিঁড়ে গেলে মেঝেতে শুয়ে মাঠা নীচে রেখে ঘাড় ধরে রাখতে হয়। এত বিপদের মাঝেও বেঁচে থাকার তাড়না থেকেই বুঝি আমার রিফ্লেল্কস একশান এগুলো ক্রিয়ে নিলো। এক সময় প্রচন্ড জোড়ে লিফট আছড়ে পড়লো। আর আমার শেষ আশাটুকুও পিষ্টে গেল।
স্থির চারিদিক। টুং শব্দে লিফটের দড়জা খুলে গেলো। সেকি আমি এখনো দেখি লিফট আমার ফ্লোরেই আটকে আছে। তাহলে কি ঘটলো। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে লাগলাম। বুকে ক্ষীন আশা ডিও হয়তো এখনো বেঁচে হয়তো লিফট পিটে আঁটকে আছে। আমি দ্রুত নামছি। আমার হার্টটা এত দ্রুত চলছে, আমি নিজের কানে সে শব্দ যেন পাচ্ছি। ষোল তলা থেকে বেজমেন্টে নামা খুব সোজা কথা না। কিন্তু কোনও কিছুই আমার কাছে এখন কোনও বাঁধা নয়। পাগলের মত নামছি। নামছি না আসলে সিঁড়ির ধাপের মাথাতে স্নিকারের তলাটা ছুঁয়ে স্লাইড করছি। আমি পড়লে পড়ি, মরলে মরি। আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে শুনতে পাচ্ছি আমার বাচ্চাটার “বাবা-বাবা” চিৎকার। আমার শরীর যেন আমার বসে নেই, বুকে বিশাল এক কান্নার স্রোত ফুলে ফেঁপে উঠছে, আমি কাঁদতে পারবো না, আমাকে পড়ে গেলে চলবে না। প্রতিটি ল্যান্ডিং এ দেখছি নাম্বার গুলি কমছে, লেভেলে সিক্স, লেভেল ফাইভ, লেভেল ফোর। এই আর মাত্র কয়টা ফ্লোর। আমার মন বলছে আমি ডিওকে পাবো। আমার ভালোবাসা সব অশুভ শক্তিকে ভেঙ্গে চুড়ে আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবে।
চোখ তুলে লেভেল এর মার্কিংটা দেখি, একি! আবার লেভেল ফাইভ কেন? ভুল করেছি, নাম্বারে? আরো স্পিডে নামতে থাকি, এ্কি! এবার ফ্লোর সিক্স! আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ব্রেইনে সুগার বা অক্সিজেন কমে গেছে, হ্যালুসেনেট করছি। এবার আরো সাবধান কিন্তু আশ্চর্য লেভেল বেড়েই যাচ্ছে, আমি যত নামছি তত যেন উঠছি। লেভেল সিক্স, সেভেন, এইট, নাইন, টেইন, আমি নামছি আর নামছি কিংবা উঠছি আর উঠছি। যেন এক অন্তহীন এ যাত্রা, আমার এত টুকু শক্তি আর নাই, পা কাঁপছে থর থর করে, হাঁটুর জোড়া যেন খুলে আসছে, আমি ধপ করে বসে পড়লাম সিঁড়িতে, যেন একতাল মাটির উপরে বসলাম, অসম্ভব ঠান্ডা আর ঠিক যেন কাদামাটি। ঠান্ডাটা আমার জিন্স ভেদ করে হাড়ে, মাংসে তীব্র কামড় বসাচ্ছে। আর বসবার সময় কনুই দুটি পিছে দিয়ে নিজেকে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। কনুই দুটি যেন একতাল মাটিতে দেবে যেতে লাগলো। বহু বহু যুগ আগে আমার দাদা বাড়িতে নতুন কাটা পুকুরের মাটিতে বসতে গিয়ে এমন মনে হয়েছিলো, মাটিটা দেখতে শক্ত কিন্তু আসলে শক্ত নয় দেবে যাচ্ছিলো হাতের চাপে, পায়ের চাপে। ঠিক সেই একটা অনুভুতি। আমি যেন ডেবে যাচ্ছি। এতক্ষনে টের পেলাম পা গুলোও সিঁড়িতে দেবে যাচ্ছে। সিঁড়িও যেন কাদা মাটির। তীব্র আঁশটে, সোঁদা মাটির গন্ধ, যেন হাজার বছরের কোন কবরের পঁচা মাটি।
আমার চারিদিকে সব রং যেন ধুয়ে যাচ্ছে, সিঁড়ি ঘরে টিপিক্যাল নীল ফায়ার ডোর থেকে রং ধুয়ে দজুয়ে, গলে গলে ফ্যাকাশে কালচে রঙ ধরছে। সিঁড়ি গুলো ততক্ষনে পিচ্ছিল খাড়া ঢাল মাত্রে পরিণত হয়েছে, কোন রেলিং নেই, নীচে শুধু ঢেউ এর মত কাদা মাটি আর মাটি শেষ নেই। সেলুনের দুই সাড়ি আয়নায় প্রতিবিম্ব গুলো যেমন অসীমে ছড়িয়ে যেত ঠিক তেমন। একটা ঢেউ এর মত দুলছে , পায়ের উপরে ধাক্কাটা স্পষ্ট টের পাচ্ছি। দেয়াল গুলো সব চেপে আসছে তাল তাল মাটিতে আমি ডুবে যাচ্ছি। এর মাঝে বিশাল এক পাখির ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ পাচ্ছি আমি স্পষ্ট মাটিতে ডুবে যেতে যেতে শ্বাস নেয়ার জন্য উপরে তাকালাম। দেখি উপরটা যেন বাতি ঘরের মত কোন উঁচুতে উঠে গেছে আর সেই, সেই অসীম শুন্য থেকে এক বিশাল পাখি, যেন ছায়ার মত আসছে, ভয় পাখি। তীব্র লাল পুঁতির মত চোখ এক অপার্থীব দৃষ্টিতে স্থির নিশ্চিত চাহনি আমাকে বিবশ করে দিচ্ছে। আমি ডুবে যাই, ডুবে যাই। বাঁচার অসীম কাকুতি নিয়ে কাদা মাটির ভিতর থেকে আমার হাতটা বাইরে বের করে দেই। যদি কেউ ধরে।
একটা শক্ত হাত চেপে ধরে আমার হাত।
(৫)
একটা অদ্ভুত শূন্যতা ঘরটা জুড়ে। এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে, ছাড়া জিন্স-জ্যাকেট; খোলা আধ-খোলা নানা সাইজের বই। জানালায় ভারী পর্দা, পৃথিবী থেকে এ ঘরকে সম্পুর্ন বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। বদ্ধ বাতাসে আটকে আছে গন্ধ-কাঠি, কড়া তামাক আর কফির গন্ধ। ঘরের একটা মাত্র কাঠের ক্লোজেটের পাল্লা জোরা ফুল সাইজ আয়নায় আলো ছায়া মেশানো এক প্রতিবিম্ব। নিষ্পল তাকিয়ে আছে নগ্ন গাত্র এক সুদেহী পুরুষ। খালি গায়ে প্রতিটি পেশী স্পষ্ট আর শরীর জুড়ে অজস্র আঁকি বুঁকি। ঘরের মাঝেও ফেডোরা হ্যাট দেখে চেনা যায় কে এই পুরুষ!
ঈভ একাকী এবং আচ্ছন্ন। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আয়নার গভীরে তার শরীরের প্রতিটি পেশীতে, গ্রন্থিতে, কোষে কোষে কিছু একটা খুঁজছে, ব্যাকুল হয়ে। আর কিছুই না সে খুঁজছে তার পিতাকে বা যে কোনও পিতৃ পুরুষকে। সেই প্রাচীন অচেনা সময় থেকে যারা যুঝে গেছে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে কোনও জয় পরাজয় নেই। কোনও পক্ষই হেরে নিশ্চিহ্ন হয় না। এ এক নিরন্তর টিকে থাকার লড়াই।
স্রষ্টা অভিশপ্ত আত্মাকে দিয়েছেন অসীম ক্ষমতা আবার তাঁর প্রিয় সৃষ্টিকেও দিয়েছেন সেই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবার অমীত শক্তি। তাই জয় নয় নিশ্চিত, নয় পরাজয়ও। আর ঈভ জানে তার প্রয়োজনে ঠিক তার বাবা বা তার বাবা বা তারও বাবা ঠিক তাকে সাড়া দিবেই দিবে। তাকে বলে দিবে কি করতে হবে, কিভাবেই বা অলঙ্ঘনীয় সময়ের কোনকের শীর্ষ বিন্দু পেরিয়ে সে যেতে পারবে ছায়া সময়ে। যেই অন্যপারে রয়েছে বিপ্রতীপ মায়া সময়। প্রতিটি অস্ত্বিতের ছায়া।
নিবিষ্ট হয়ে প্রাচীন সে মন্ত্রোচ্চারণে মগ্ন ঈভ। একটু আগেই সে সংবাদ পেয়েছে। ডিওর নাই হয়ে যাবার সংবাদটা সে পেয়েছে একটা টেক্সট ম্যাসেজে, অসহায় পরিবারটা তার কাছে ভরসা খুঁজছে। ঈভ তার সমস্ত জাগতিক চিন্তাকে সরিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পিতৃপুরুষদের ডাকছে। সুদূর সময়ের ওপারে অন্ধকার আচ্ছন্ন আফ্রিকায় তার পিতৃপুরুষরাই ছিলেন তারা, যারা বুক চিতিয়ে লড়ে গেছে অভিশপ্ত, পতিত আত্মাদের বিরুদ্ধে।
দক্ষিন আফ্রিকা থেকে কঙ্গো, সেনেগাল সেখান থেকে হেইতি, তাদের পিতৃপুরুষদের রক্তের ধারা ছড়িয়ে পড়েছে। এখন সারা বিশ্বে, ছড়িয়ে গেছে। সেই প্রাচীন বিদ্যা পুরুষানুক্রমে তারা বয়ে চলে এসেছে। তারা অনুভবে অস্তিত্বে নিজেদের মাঝে নিজেদের উপস্থিতি ঠিক বুঝতে পারে। তারা যেন একাই অনেক কিংবা অনেকে মিলে একক। এ বিদ্যা সাধারন মানুষদের বিজ্ঞান বা অভিজ্ঞতার বাইরে। তারা এই স্থুল দেহের বাইরেই যেন আরো বেশী করে এক।
মানুষ এই মহাবিশ্বের অপার রহস্যেরই বা কতটুকু উদ্ধার করতে পেরেছে? একটা ভুল ধারনা মানুষদের মাঝে আছে, মানুষ তাদের নিউরনের খুব সামান্য অংশই ব্যবহার করে। যদি পুরোটা ব্যবহার করতো তাহলে তারা জানতে পারতো মানুষের কি অসীম ক্ষমতা। কথাটা শুধু একটা প্রচলিত গুজব মাত্র। মানুষের দেহের বাইরের মানুষটাই বরং আরো বেশি বিশাল, তার বিচরণ কিংবা ক্ষমতা সমন্ধেই মানুষের ধারণা নেই। যারা এই রক্ত মাংশর দেহের বাইরে নিজেকে নিতে পারে তারাই হতে পারে এই সামগ্রিক স্বত্বার অংশ। এই সুক্ষ শরীরে তারা অনায়াসে পাড়ি দেয় সময় কোণকের উল্টোদিকে, ছায়া পৃথিবীতে। সে পৃথিবী এই পৃথিবীর যেন অনুলিপি কিংবা উল্টোটা। এ এক প্রপঞ্চ-মায়া। হাজার বছরের পুঞ্জিভুত জ্ঞান এই স্বল্প সময়ে অনুধাবন করবার মত সময় এবং মন সংযোগ আজ বিরল। ঈভেদের সংখ্যা আজ খুব বেশী নেই।
এক সময়,আঁধার আরো গাঢ় হয়, আয়নায় যেন অন্ধকার এক তরলে পরিণত হয়। ছায়ারা সব হারিয়ে যায়। আলকাতরা তরল আয়নায় ঢেউ জাগে, পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন। পানির ঢেউ গুলি যেমন দূরে সরে যায় এই ঢেউ গুলি যেন উলটো আচরণ করে। ঢেউ গুলি ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। সামান্য পাতলা এক আয়নায় গভীর এক ঘুর্নী তৈরী হয়, ঈভ হাত বাড়ায় স্পর্শ করে সে তরল অন্ধকার। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে আরেকটি হাত তার হাতটিকে স্পর্শ করেছে। গভীর আস্থায় নিজেকে সে হাতের উপর সমর্পণ করে। তারপর সব ছিটকে যায়, এ ঘর, এ ব্যস্ত শহর, এ বিশ্ব এবং এই সময়ও।
ঈভ নিজেকে আবিষ্কার করে অন্তহীন এক চারণ ভুমিতে। বাদামী ঘাস সিংহের কেশোরের মত দুলছে। নিঃসঙ্গ বাউবাব গাছ দাঁড়িয়ে আছে সুঠাম। উজ্বল উচ্ছল রোদ আর মিষ্টি বাতাস। বাতাসে অচেনা গন্ধ। পোড়ানো পাতার গন্ধ যদি আটকে থাকে ভারি কাঁথা কম্বলে তেমন একটা গন্ধ। কেন যেন ঈভের মনে হল এ সব তার চেনা। সে ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিকটা দেখতে চাইলেই চোখে পড়ে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বোনা মোটা কাপড় কোমরে গোঁজা, যার এক প্রান্ত কোমর থেকে আড়াআড়ি বাম কাঁধ ঘুরিয়ে আবার কোমরে গোঁজা। একটা মোটা দড়ি কোমোরে সেখান থেকে ঝুলছে বড় একটা ছুড়ি রঙিন পুঁতির খাপে ঢোকানো। আর একই রকম হাজার রঙ্গের পুঁতির একটা টুপি ঢেকে রেখেছা পাকা কোঁকড়া চুল গুলি। অবিন্যস্ত কিন্তু নাতিদীর্ঘ দাড়ি-গোঁফের ফাঁক দিয়ে ঝকঝকে দাঁতের প্রশন্ন হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। ঈভের দিকে।
“স্বাগতম, প্র-পৌত্র”! ঈভের পিতার সাথে তার গভীর মিল চেহারার। একই ধাঁচের চৌকো মুখ আর সেই প্রশন্ন হাসি! “সময় বড্ড কম আমার প্র-পৌত্র, যে মায়া তোমাকে এখানে নিয়ে এসছে, যে শিশুটির মংগলের জন্য তোমার এই ভ্রমন, তা সফল হোউক, যদিও দুরূহ, তবু শুভ শক্তির কাছে, ভালোবাসার কাছে কবে কোথায় কে জয় পেয়েছে বল”।
ঈভ এতক্ষনে ধাতস্ত হয়। জড়িয়ে ধরে সে বৃদ্ধকে। ঈভ বুঝতে পারে সে বৃদ্ধ তার পকেটে ভারী কিছু ধুকিয়ে দিচ্ছেন। সেই প্রাচীন গন্ধটা সে পায় আর পায় অন্তহীন এক সাহস। সে বুঝে , বোধের বাইরে কিছু তার পিতৃপুরুষের শরীর থেকে তার শরীরে চলে এসছে। জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা। অভিজ্ঞতা আর সাহস! সব বুঝি একে একে শরীর থেকে শরীরে মিশে যাচ্ছে। এমনকি শরীরটুকুও মিশে গেছে। ঈভের আলিঙ্গনে আর কেউ নেই। ঈভ একা দাঁড়িয়ে তার অদ্ভুত শুন্য ঘরে, যেখানে ভারী পর্দা ঘরটিকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে পৃথিবী থেকে। ঘরটির বদ্ধ বাতাসে আটকে আছে গন্ধ-কাঠি, কড়া তামাক আর কফির গন্ধ, এর সাথে যোগ হল পোড়ানো পাতার প্রাচীন এক গন্ধ।
ঈভ আর দেরী করে না, শার্ট আর কোটটা গায়ে চাপিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়। অবশ্যই তার সেই অন্ধকার গম্ভীর ফেডোরা হ্যাটটা নিতে ভুলে না।
(৬)
যে হাতটা আমার হাতটাকে ধরে নিশ্চিত ডুবে যাবার হাত থেকে টেনে তোলে সে হাতটা আর কারুর নয়, সে হাতটা ঈভের। পরে ঈভের কাছ থেকে জেনেছিলাম, ও আমাকে সিঁড়িতে খুঁজে পায়, প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে ছিলাম, একটা হাত শুন্যে তুলে। আমার সাথে যা ঘটেছে তা বলবার মত অবস্থা আমার আর ছিলো না। ঈভকে পেয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ওর দুহাত ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিলাম। জানি না কেন ঈভকেই মনে হল আমার এক মাত্র ভরসা!
ঈভ বন্ধুর মত ভাই এর মত আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। জানি না একটা সাহস, একটা ভরসা যেন আমার মাঝে সঞ্চিত হল। ঈভ বলল “আমাদের অনেক কাজ। তোমাকে শক্ত হতে হবে। আমি ঈশ্বরের দেয়া সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করবো ডিওকে পেতে। জেনো আমি একা নই আরো অনেকে রয়েছেন আমাদের সাথে” । তার কথার রহস্য বুঝবার ভাববার অবস্থানে আমি নেই। আমি ওর পিছে পিছে আমাদের ফ্ল্যাটটিতে ঢুকি। নিশ্চুপ একটা বাড়ি। নোরা এখনো সেই একই ভঙ্গিমায় পরে আছে যেন মুর্ছা গেছে।
আমরা নিঃশব্দে আমাদের শোবার ঘরটাতে ঢুকি। সব একই আছে, ডিওর খেলনা, বই, আঁকার খাতা রঙ পেন্সিল ঘরময় ছড়ানো। গন্ধটুকুও আমি পাচ্ছি। শুধু সে নেই। ঈভ ঘরে ঢুকে সব খুটিয়ে দেখে, তারপর ঘরের ঠিক মাঝখানটাতে দাঁড়ায়। মনে হয় যেন সে সমাহিত, সম্মোহিত। কার সাথে যেন নিমগ্ন হয়ে কথা বলছে।
একটু পরে সে ঘরের মাঝ খানটায় ছড়িয়ে থাকা জিনিষ গুলো পরিষ্কার করে আর তার সঙ্গে আনা রঙের কৌটো দিয়ে একটা বৃত্ত আঁকে। তারপর অদ্ভুত সব নকশা আঁকে জীবিনেও এমন কোনো আর্ট ফর্ম আমার চোখে পড়েনি। তারপর সে আমাকে বলল, এখন সে তার কাজ শুরু করবে আমি চাইলে থাকতে পারি, তবে ভয় পেলা চলবে না , ভয়ংকর সব ইলিউশান হতে পারে। সময়ের অন্য স্রোত থেকে ডিওকে সে আনবার চেষ্টা করবে, সে জানে না আর কোথাও কখন এমন কিছু হয়েছে কিনা? এতে কোন বড় স্যাক্রিফাইজ করতে হলে সে তাও করবে।
আমি অতশত না ভেবে শুধু ঈভের পাশে থাকবো সে ভেবে আমি বললাম আমি এ ঘরেই থাকব। আর টুকটাক কিছু প্রস্তুতি করতে করতে বিকেল প্রায় গড়িয়ে গেলো। ঈভ জানে আমাদের খাবার বানানোর কোনও মন মানসিকতা নেই, তাই এক ফাঁকে ঈভ নিচে নেমে পিৎজা আর ফ্রাইজ নিয়ে এসেছে। খাবার কি আর আমাদের গলা দিয়ে নামবে, নোরা দাঁতে কুটোটি পর্যন্ত কাটলো না। ঈভ বলল আমাদের কে খেতে হবে গায়ে বল আনতে হবে, তাহলেই মনে বল আসবে। এসব জানি হাবি জাবি বলছে শুধ খাওয়াবার জন্য। আমি কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিলাম। কি খেলাম কিছুই বুঝি স্বাদ পেলাম না। ঘাস পাতার মত খেয়ে নিলাম।
বাইরে তখন আলো মরে গেছে। তবুও ঈভ ভারি একটা চাদর দিয়ে ঘরের এক মাত্র জানালাটা ঢেকে দিয়েছে যেন ঘরটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার হয়ে যায়। ঈভের পরামর্শে নোরাকে নাইজেলার ফ্ল্যাটে দিয়ে এলাম। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ এবং অন্ধকার।
ফস করে ঈভ একটা মোমবাতি জ্বালাল। এ আলো কতটুকু আর আঁধার দূর করতে পারবে?! সংশয় আর আশা নিয়ে আমি চাইলাম ঈভের দিকে। এ এক অন্য ঈভ, এই ঈভকে আমি চিনি না। তার দৃষ্টি, তার ঠোঁটের রেখায় অন্য কেউ যেন এসেছে অচেনা কেউ। শুরু হল অদ্ভুত এক সমাপ্তির।
(৭) অদ্ভুত সমাপ্তি
“Time past and time future
What might have been and what has been
Point to one end, which is always present.” -T.S. Eliot
সময় এ পৃথিবীর সব চেয়ে রহস্যময় মাত্রা। সাধারন চিন্তা চেতনায় কিংবা বস্তু চিন্তা দিয়ে একে মানুষ অতিক্রম করতে পারে না। সময় হল অস্তিত্ব এবং ঘটনার নিরবিচ্ছিন্ন চলমান স্রোত। যা অতীত থেকে বর্তমানকে আড়াল করে, ভবিষ্যতের গর্ভে চলমান ঘটনা গুলোকে রাখে দৃশ্যত অপরিবর্তনীয় এবং ধারাবাহিক।
আজকে যা বর্তমান, কাল হবে অতীত আর গতকাল তাই ছিলো ভবিষ্যত। সব আসলে এক অদ্ভুত স্রোত, আমাদের নিরন্তর সন্তরণ শুধু আগামীর দিকে। এর মাঝেও আছে কেউ বা কারা, উলটো স্রোতের সাঁতার তাঁদের জানা। যাদের কাছে রয়েছে সেই দরজার ওপাশে যাবার চাবি। সে মায়া, সে প্রপঞ্চ আড়াল তুলে দেয় মুহুর্তের জন্য, একাকার স্রোতে ভেসে যায় অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত।
সন্ধ্যা ঘনায়ে আসে। দিন বিলীন হতে থাকে রাত্রির গর্ভে। রাত মেলতে থাকে তার পাখা। বার্লিন শহরের, এক উঁচু দালানের, ষোল তলার, ছোট্ট একটি এপার্ট্ম্যান্টে বদ্ধ ঘরে, ঘোর লাগা সন্ধ্যায় জ্বলছে অদ্ভুত আলো। গোলাপী সে মোমেদের আলোয় দুই যুবা পুরুষের দীর্ঘ ছায়া পড়ে দেয়ালের নানা কোণে এবং তলে। এক অসহায় পিতা, নতজানু, স্তব্ধ। আর এক যোদ্ধা আবর্তনরত সে নকশা কাটা বৃত্তকে ঘিরে। মুখে অচেনা ভাষার স্ত্রোত, অচেনা সুরে ঢেউ জাগায় সময়ের বহমান স্রোতে। আর অচেনা কি গুঁড় আহুতি দেয় সে আগুনে। মুহুর্তে আগুন লেলিহান শিখায় জ্বলে উঠে।
নকশার পরিধি ঘিরে পাঁচটি মোম, আর মাঝখানে আরেক খানা কালো রঙের এবং খাটো মোম। সেবার আহুতি দেবার পর দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেলো সে মোম। অদ্ভুত এক ছায়া ঘনায় ঠিক মাঝখানে। প্রথমে মনে হয় বুঝি মোমের সুতোর পুড়ে যাওয়া কালো ধোঁয়া। ধোঁয়াটা জমাট বাঁধে ধীরে ধীরে। একটা অবয়ব হতে হতে আবার মিলিয়ে যায়।
ঈভের গতি বাড়ে, নগ্ন গাত্রে আঁকিবুঁকি ভরা বুক পেট বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। তার পরনে একটা কালো প্যান্ট মাত্র, তার পকেট থেকে একটা খড়ের মুর্তি সে বের করে। সে বৃত্তের মাঝখানে সেই অদ্ভুত এবং কুৎসিত দর্শন মুর্তিটিকে বসায়। কালো এলো মেলো ধোঁয়া গুলো বুঝি এলোমেলো ঘুরে ঘুরে একটা অবলম্বন পায়। জমাট বাঁধতে থাকে । ঘরটা ভরে যায় বিচ্ছিরি গন্ধে।
কাগজকে মুঠো পাকিয়ে ছেড়ে দিলে যেমন নিজ থেকে খানিকটা ভাঁজ খুলে খুলে উঠে। সেই মুর্তিটা মনে হল খুব অল্প অল্প ভাঁজ খুলে উঠে আসছে। ধোয়া গুলি কুন্ডুলি পাঁকিয়ে পাঁকিয়ে বড় করে তুলছে সে ছায়া মুর্তি। বৃত্তটা বুঝি পঁচা পাঁকে ভরা, থিক থিকে ঘিনঘিনে এক নর্দমা। পাপের পঙ্কিল এক দহ যেন সহসা সে ঘরে জেগে উঠে। আর সেই বীভৎস ছায়া মুর্তি যেন সে নর্দমা থেকে উঠে আসতে থাকে , মুর্তিমান হতে থাকে। এক বীভৎস আকৃতির মাথা চুলের মত কিছু মোটা দড়ির মত মাথায় ঝুলে আছে, অক্ষি গোলোকে অপার্থিব অন্ধকার। সে অন্ধকার অক্ষিগোলোকের ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসছে অজস্র সাদা শুককীট কিলবিল করছে, সে মুর্তির গা বেয়ে নেমে আসছে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছে। চক্ষুহীন কিলবিলে পোকারা ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঈভ চিৎকার করে বলে, “ভয় পেও না বন্ধু। এ সব মিথ্যা, এসব কিচ্ছু না, সব মায়া”।
পিতা নিরুত্তর, তার দুই হাঁটু যেন মেঝেতে গেঁথে গেছে। সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে। এমন বীভৎস কিছু সে দেখবে জীবনে সে ভাবেনি। এর মাঝে পোকা গুলো কখন যেন মাছিতে পরিণত হয়েছে, ঘরময় উড়ছে, বিশ্রী শব্দ তুলে নাকে মুখে ঢুকে যেতে চাইছে। এর মাঝেও ঈভ শান্ত এবং অবিচল। সেই অবয়ব ঈভের দিকে ঘুরে ঘুরে ঈভকে অনুসরন করছে। মুর্তিটি এখন যেন এক বলশালী পুরুষের আকৃতি নিচ্ছে, পেশী গুলো যেনো সাপের মত পিচ্ছিল, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, একটা আরেকটার উপর যেন শঙ্খ লাগা সাপের মত উঠে যাচ্ছে, কিলবিল করছে, গা থেকে পিচ্ছিল সবুজ আঠার মত তরল বেঁয়ে বেঁয়ে পড়ছে। আর ঈভ যেন ক্ষ্যাপা সিংহ।
“এ শয়তান এ বৃত্তের বাইরে আসতে পারবে না, আমাকে বৃত্তের ভিতর যেতে হবে আমার আত্মাকে মুক্ত করতে হবে, যেন সে সময় শঙ্কু পেরিয়ে যেতে পারে ওপারে, তুমি ভয় পেয় না। আমার দেহ জাগ্রত থাকবে এবং লড়ে যাবে, আমার দেহ হয়তো ধারণ করেব আমার কোন এক পিতৃপুরুষের কোনও পবিত্র আত্মা। তারা আড়াল পেরুতে পারে না। তাই আমাকেই যেতে হবে।“ চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে এ কথা গুলি বলছিলো ঈভ। কোনও কথা ডিওর বাবার কানে ঢুকছিলো কিনা কে জানে। সে নিশ্চল একটা পাথর এর মুর্তির মত নতজানু হয়ে আছে, হয়তো পার্থণা করছে, মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে।
ঈভ একটু থমকে দাঁড়ালো, দেয়ালে ঈভের অনেক গুলো ছায়া, এক এক আকৃতির, সব যেন এক এক আলাদা স্বত্বা। সব ছায়া গুলো মুহুর্তে এক হয়ে যেন ঈভের দেহের সাথে মিশে গেল। ঈভ লাফিয়ে বৃত্তের ভিতর ঢুকে গেলো, সে ঈভ যেন এক ভিন্ন কেউ।হাতে বোনা মোটা কাপড় তার কোমরে গোঁজা, যার এক প্রান্ত কোমর থেকে আড়াআড়ি বাম কাঁধ ঘুরিয়ে আবার কোমরে গোঁজা। একটা মোটা দড়ি কোমরে সেখান থেকে ঝুলছে বড় একটা ছুড়ি রঙিন পুঁতির খাপে ঢোকানো। আর একই রকম হাজার রঙ্গের পুঁতির একটা টুপি ঢেকে রেখেছা কোঁকড়া চুল গুলি। মুহুর্তে খাপ থেকে সে ছোড়া খানা তুলে দুই হাত উপরে তুলে প্রচন্ড বেগে নামিয়ে আনে ছায়া মুর্তির মাথা বরাবর। দুই ভাগ হয়ে যায় সে ছায়া মুর্তি। তাল তাল ময়লা কাদা যেনো খসে পড়ছে কিলবিল করে পোকা গুলি খসে পড়ছে। ছায়া মুর্তির বক্ষ গহবর থেকে যেন দীর্ঘ এক চঞ্চু বেরিয়ে আসছে আকাশের দিকে উত্থিত হয়ে। দীর্ঘ কর্কশ এক শব্দ আতংক ছড়িয়ে দেয় আরো। সে ঘরের ছাদ যেন এক ঝঞ্জা বিক্ষুদ্ধ প্রাচীন আকাশে পরিণত হয়েছে, মেঘে মেঘে ঘিরে রেখেছে চারিদিক। আকাশের বুক চিরে নীল অগ্নি শিখা এ মাথা থেকে ও মাথা চলে যায়। ছায়া মুর্তির বুক চিরে বেরিয়ে আসে, আকাশ আড়াল করে, অন্ধকার দুই ডানা বিস্তৃত করে দাঁড়ায় তার স্থির লাল চোখ নিয়ে । ভয় পাখি।
সেই ঈভ কিংবা ঈভের দেহধারী স্বত্বা। ভয় কিংবা আতংক নিয়ে চিৎকার করে উঠে,” ইমপুন্দুলু”, “বজ্রপাখি যাদুকরী বজ্রপাখি।“ ডিওর ভাষায় “ভয় পাখি”। বজ্রপাখির কোনও দুর্বলতা নেই এবং এটি গুলি, ছুরি, ডুবানো বা বিষ দিয়ে মারা যায় না। একমাত্র উপায় শুধু অগ্নি। ইমপুন্দুলুকে ধ্বংস করাতে পারে লেলিহান অগ্নিশিখা।
নরকের অন্ধকার থেকে জন্ম নেওয়া যে কোনও ইমপুন্দুলু একটি অপ্রতিরোধ্য দানব। যদি একে পরিপক্ক হতে দেওয়া হয়, তবে এমন আধাঁর ছড়াবে এ পাখি যেন সূর্যকেও গিলে খেয়ে নিবে সে অন্ধকার। বরফের অন্ধকারে ছেয়ে ফেলবে চারিধার, এবং পৃথিবীর সব জীবনকে চেপে ধরবে। অভিশপ্ত আত্মাকে যেন ভয়ে সবে প্রভু মানে। আলোর হবে অবশান নিশ্চিত সেইদেইন।
মুহূর্তের মাঝে যেন আবার এস যায় ঈভ সেই বৃত্তের বাইরে, তার কাঁধে একটা কিছু ক্যানভাসে মোড়া। সে দৃশ্য সেই স্থির লাল চোখে দেখে ভয় পাখি। তারপর তীব্র এক গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে ডানা ঝাপ্টে উঠে যায় উঁচুতে, ওই উঁচুতে প্রাচীন মেঘেদের কাছে। তারপর নেমে আসতে থাকে বিশাল রক পাখীর আকৃতি নিয়ে। ইমপুন্দুলু তার অবয়ব বদলাতে পারে। প্রাচীন রূপকথার রক পাখী আর কেউ না এই ইমপুন্দুলু, আফ্রিকার অন্ধকারে যাদুকর সামানদের লোভ এবং কুট ক্ষমতার নৃশংস প্রতিযোগিতার শয়তানীর ফসল এই ইম্পুন্দুলু। যার কোনও দুর্বলতা নেই এবং এটি গুলি, ছুরি, ডুবানো বা বিষ দিয়ে মারা যায় না। ইমপুন্দুলুকে ধ্বংস করাতে পারে লেলিহান আগ্নি শিখা।
সে নেমে আসছে তীর বেগে, তার তীক্ষ্ণ চঞ্চু বিদীর্ণ করে দিবে ঈভের বুক। ছিন্ন বিচ্ছিন হয়ে যাবে আর মুহুর্ত মাত্র। ঈভ তার কাঁধে রাখা ক্যানভাসে মোড়া কিছু একটা ছুড়ে দিলো ডিওর বাবার দিকে । সে দুহাতে আকড়ে ধরে। মনে হয় যেন একটা শিশু দেহ। প্রানহীন নাকি প্রান স্পন্দন আছে ক্ষীন সে বোঝে না। সে অবাক চোখে দেখে ঈভ তার প্যান্টের পকেট থেকে কালো কালো গুঁড়ো কিছু একটা তার নিজের গায়ে ছড়িয়ে দেয়, সারা গা যেন ঢেকে যায়। ভয় পাখির অব্যার্থ নিষ্ঠুর ঠোঁট নেমে আসে ঈভের বুক বরাবর। ঈভ সমস্ত শক্তি দিয়ে সে পাখিটিকে জড়িয়ে ধরে। পাখি এবং সে একটা মোমের উপর পড়ে যায়। মুহুর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে দুটি অবয়ব। গান পাউডার এর গন্ধ, চামড়া পোড়ার গন্ধ আর ফড় ফড় করে পাখির পালক পোড়ার অপার্থিব শব্দে চারিদিকে এক নারকীয় আবহ তৈরী হয়।
অসহায় পিতা দুহাতে জড়িয়ে ধরে তার পুত্রকে। অজ্ঞান হবার আগে সে শুনতে পায় ঈভ বলছে তার শেষ কথা। “ Für Dio bleibt eine schöne Welt”।
(৮)
আমার জ্ঞান ফিরে অনেক মানুষের কোলাহলে। সারা গা পানিতে ভিঝে সপ সপ করছে। আমার সাধের শোবার ঘর এক দগ্ধ কংকাল ছাড়া আর কিছুই না এখন। ফলস সিলিং পুড়ে কংক্রিটের ছাদ বেরিয়ে এসছে, চারিদিক কালো কালিতে সয়লাব, ঘরের মাঝখানে পুড়ে ছাই হয়ে আছে ঈভের দেহ। চেনা যায় না। আমার অসাড় হাতে তখনো ডিওকে ধরে রেখেছি। নোরা আমার সামনে এস বসে, দুহাতে নিথর ডিওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। হু হু করে কান্না আসতে চায় আমার। নোরা নিশব্দে কেঁপে কেঁপে কাদঁছে। নোরার কোলের দুই পাশে ডিওর হাত দুইটি ঝুলে আছে নিশপ্রাণ।
আমার মনে পড়ে, ঈভের বলা শেষ বাক্যটি। “Für Dio bleibt eine schöne Welt” যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় , “ডিওর জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী রয়ে গেছে”। ঈভের এই স্যাক্রিফাইস কি তবে মিথ্যা হবে!
যদি মিথ্যাই হবে তবে কেন সে সুন্দর পৃথিবীর কথা বলল। আমি প্রচন্ড ক্ষোভে নোরার কোল থেকে ডিওকে ছিনিয়ে নেই দু হাতে তুলে ঝাঁকুনি দিতে থাকি। হঠাৎ মনে হল একটু যেন কেঁপে উঠলো, নাকি আমার মনের ভুল। আমি হতাশ হয়ে মাটিতে বসে পড়ি। নোরা দুহাতে ডিওকে আবার জড়িয়ে ধরে যেন মায়ের ওমে ওকে জাগাতে চাইছে।
আমি দুহাতে মাথা ঢেকে মাটিতে বসে পড়ি আর তখনই আমার হাঁটুর নিচে দেখি একটা ফেডোরা হ্যাট। গম্ভীর এবং অন্ধকার একটা মুখ চোখে ভেসে উঠে। চৌক মুখে একটা হাসি। মুখ তুলে দেখি নোরা হাসছে। ডিও হাত বাড়িয়ে আছে আমার দিকে।
ডিসেম্বর ২০/২০২৫
২১ শে জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ২:৫৮
রবাহূত বলেছেন: এত বড় লেখা ধৈর্য্য নিয়ে পড়েছেন আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২১ শে জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ২:৫৪
এইচ এন নার্গিস বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন ।