নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইচ্ছামানুষ রনি

ইচ্ছামানুষ রনি

আমি চাই মানুষ বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু।

ইচ্ছামানুষ রনি › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন নিরাপদ স্যার।

২৬ শে জুন, ২০১৩ রাত ১০:০২

প্রথম দেখাটা ঠিক কবে তা মনে পড়ছে না। একটা দশ-বারো বছরের ছেলে একজন শিক্ষকের সাথে প্রথম দেখার দিন-তারিখ মনে রেখে দেবে, ব্যাপারটার শেষে বিষ্ময়বোধক চিহ্ন থাকবেই। মানুষকে দেখেছি কারো সাথে প্রেম হয়ে গেলেই কেবল র‍্যি-কল করে প্রথম দেখার দিন বের করে। প্রেম তো আর না, ছিলো ভীষণ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। সেই জায়গাটা হতে গতকাল সকালে অতনুর ফোনে দু:সংবাদটা পাওয়ার পর থেকে বের করার চেষ্টা করছি, ঠিক কবে স্যারকে প্রথম দেখেছিলাম। সিক্স-সেভেনে? ঠিক মনে পড়ে না। তবে তারিখ-মাস বের করতে না পারলেও এটা নিশ্চিত সময়টা আনুমানিক ১২-১৩ বছর তো হবেই। প্রথম দেখার দিন-তারিখ মনে করতে না পারলেও শেষ দেখার সময়টা অক্ষরে-অক্ষরে মনে আছে। অবশ্য এটাও একটা দুই মেগাপিক্সেল ক্যামেরায় ছবি তোলায় ছবিটার সাথে তারিখটা থেকে যাওয়ার কারণে। ঠিক আট মাস আগে। ২৬ অক্টোবর, ২০১২। শেষ বিকেলে। দু'দিন ফোন করে বাড়িতে আসতে বলার পর আধঘন্টার জন্য বাড়িতে এসেছিলেন স্যার। তখনই এই ছবিটা তোলা হয় খানিকটা জোরপূর্বক ভাবে, স্যার চলে যাওয়ার একটু আগে রূপলের নোকিয়া ৬২৮৮ এর দুই মেগাপিক্সেল ক্যামেরায়। সেই শেষ স্মৃতি। স্যারের সাথে তোলা প্রথম এবং শেষ ছবি। স্যার গতকাল ভোর বেলায় মারা গেছেন আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে।



স্যারের সাথে সেন্ট জোসেপসের বেশিরভাগ ছাত্রেরই শত শত স্মৃতি। আমি নিশ্চিত, আমাদের স্কুল ব্যাচটার সবাইকে যদি বলা হয় স্কুলের একজন স্যারের নাম বলো, সবাই প্রথম নামটা বলবে 'নিরাপদ দাশ'। হ্যা, আরেকটা নাম হয়তো কয়েক পার্সেন্ট আসবে। নেগেটিভ কারণে। আরেকজন ছিলেন। নাম বললে পোষ্টটা নোংরা হবে তাই এড়িয়ে গেলাম। স্যার বলতেও ঘৃণা হয় আমার। তাই 'আরেকজন' বললাম। তার বাড়ির সামনে দিয়ে কখনো গেলে পাশের ড্রেনে থুথু ফেলে যাই আমি। ফুসফুসে এত থুতু জমা যে সারা জীবনেও শেষ হবে না। খুনি। তার মানষিক অত্যাচারে প্রিয় বন্ধু দীপু গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলো। বছর দশেক আগের ঘটনাটা অনেকে ভুলে গেলেও আমার ব্রেনে এখনও বেশ টাটকা। সে যাই হোক, অপ্রাসঙ্গিক কথাটা লিখলাম একটা কারণে। সেটায় একটু পরে আসছি। স্যারের কিছু কথা লিখি। স্কুলের পাশে স্যারের একটা ব্যাচ ছিলো। অনেকেই যেত। যাওয়ার কয়েকটা কারণ ছিলো। তখন আমাদের স্ট্যাম্প-স্টিকার সংগ্রহের ব্যাপক নেশা। কিছু ছেলেরা বাবা-মার সাথে এসে স্যারের ব্যাচে ভর্তি হতো। তারপর কয়েকমাস পড়ার পর স্যারের বেতন না দিয়ে ছেড়ে দিতো। ওই টাকায় স্ট্যাম্প-স্টিকারের শ্রাদ্ধ চলতো। ব্যাপারটা ওপেন সিক্রেট ছিলো। কিন্তু স্যার কোনোদিন কারো কাছে টাকা চাননি। আরেকটা কারণ ছিলো। ১০ টা থেকে স্কুল শুরু হলেও স্যারের ব্যাচ শেষ হতো ৯ টায়। ক্রিকেট খেলার জন্য ঘন্টা খানেক সময় মিলে যেত। আমার ভর্তি হওয়ার মূল কারণ ছিলো এটাই। ক্রিকেটের উপর তখন হেরোইন-ইয়াবা থেকেও বেশি নেশা। গিয়ে দেখি ভয়াভহ অবস্থা। একই ব্যাচে, ক্লাস থ্রি-ফোর, মেট্রিক-ইন্টার, অনার্স-মাস্টার্স এবং বিসিএস এর ছাত্র-ছাত্রী। স্যার একটা টেবিলের কোনায় বসে যার যে সমস্যা সমাধান করে দিচ্ছেন। অনার্সের ছাত্রের ম্যাথ সমাধান করে দিয়েই ইংলিশে মাস্টার্সের ইংরেজি। বিসিএসের সাধারণ জ্ঞান। শুনতে খুবই উইয়ার্ড শোনালেও কথাগুলো ডাহা সত্য। সেন্ট জোসেপসের প্রায় প্রত্যেকের কাছেই ব্যাপারগুলো সুপরিচিত।



স্যারের কিছু কথা বলি। স্যার একসাথে দুই হাতে লিখতে পারতেন। আমি শুনেছি কেউ কেউ এটা পারে কিন্তু বাস্তবে শুধুমাত্র একজনকেই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেটা স্যার। ইংরেজি-হিন্দি-উর্দু-সংস্কৃত এবং ফরাসি ভাষা জানতেন। একবার বলেছিলেন, ইচ্ছে ছিলো দেশ ছাড়লে ফ্রান্সে যাবেন। হয়নি।



স্যার অবিবাহিত ছিলেন। স্কুল লাইফে এসব অনেক গুজব প্রচলিত ছিলো। একবার শুনেছিলাম স্যার স্যাকা খেয়ে বিয়ে করেননি। তবে সবচেয়ে প্রচলিত ছিলো স্যারের প্রেমিকা হঠাৎ মারা যাওয়ায় স্যার আর বিয়ে করেননি। মাঝে মাঝে বন্ধু মহলে আলোচিত হতো ব্যাপারটা, স্যার এত টাকা দিয়ে কী করবেন, কাকে দেবেন, এসব। কিন্তু স্যারকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি কখনো। সে সাহস ছিলো না তখনও।



স্যারের দু'টো জামা ছিলো। আরেকটা পুরানো রংচটা ব্যাগ। অল্টারনেট করে দু'টো জামা পড়তেন। খুব সাদামাটা চেকচেক জামা। ওই দু'টো নষ্ট হলে আর দু'টো। মাসের পর মাস স্যারকে ওই দু'টো ড্রেসে দেখতাম। ভোরবেলা রওনা দিয়ে কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে স্কুলে আসতেন স্যার। একবার এক অনার্স পড়ুয়া ভাই, নাম সম্ভবত সবুজ ছিলো, সবুজ ভাই, জিজ্ঞাসা করে বসলেন, 'স্যার এতো টাকা দিয়ে কী করবেন? রিকশাওয়ালাকেও তিন টাকা দেন না। স্যার, 'হ্যোপ্ִ, পড়তে যা' বলে কিউরিসিটির ইতি টেনে দিয়েছিলেন।



আরেকটা ব্যাপার বেশ প্রচলিত ছিলো। স্যার ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। অ্যাথিস্ট। কোনো পূজা-পার্বণে নাকি স্যারকে দেখা যায়নি। এসব নিয়ে অনেক রহস্য ছিলো। ২৬ অক্টোবর বাসায় ডেকে স্যারকে জেরার মধ্যে ফেলি। সেই ছোট্টটি না থাকাতে প্রশ্ন করতে আর দ্বিধা হয়নি।



স্যারকে প্রথমে বলেছিলাম, 'স্যার, আমাদের একটা জেনারেশনের কাছে আপনি স্রেফ হিরো (স্যার হেসে দিলেন); অথচ এত বছর পরেও আমরা বন্ধুরা আড্ডায় আপনার অমিমাংসিত রহস্যের সমাধান করি গুজব দিয়ে। আজকে কিছু প্রশ্নের উত্তর না দিলে আপনাকে যেতে দিচ্ছি না।' তার কিছুদিন আগে স্যারের হার্টে রিং বসানো হয়েছে। বললাম, 'স্যার আপনি আজকাল চলে গেলে সারা জীবনটাই কিছু অমিমাংসিত রহস্য নিয়ে পার করতে হবে।' 'স্যারের সাথে এ কিভাবে কথা বলা' বলে পাশ থেকে মা একটা মৃদু ধমক দিলো। স্যার ইতস্তত: করে হলেও বলে ফেললেন, 'আচ্ছা বল':



কোট করে মনে নেই। তবে প্রশ্ন আর উত্তরগুলো মোটামুটি তুলে দিলাম:



: স্যার, বিয়ে করেননি ক্যানো? আমরা শুনেছি আপনার অ্যাফেয়ার ছিলো, তারপর একটা দূর্ঘটনা.…



: ভুল জানিস। একান্নবর্তী পরিবার ছিলো। ভাইদের বিয়ে হতে হতে অনেক বয়েস হয়ে যায়। আমি ছোট ছিলাম। একটা সময় বিয়ের কথা উঠেছিলো, কিন্তু তার কিছুদিন আগে চাকরিটা ছেড়ে দেই। আর করা হয়ে ওঠেনি।



: তার মানে আপনার অ্যাফেয়ার ছিলো না?



: না।



: কখনো কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়নি?



(মা ঝাড়ি মারে। থেমে যাই। এ প্রসঙ্গের যতি পড়ে এখানেই)



: স্যার, এই যে ৭০ বছর পার করে ফেলেছেন, কারো জন্য আফসোস হয়না? এই সময়টা তো কেউ পাশে থাকতো।



: না। মানুষ তো অল্প বয়সেও মারা যায়, নাকি? সেটা ধরে নিয়েছি।



: স্যার, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন?



: করি।



: আমরা শুনেছি আপনি অ্যাথিস্ট। লুকাইয়েন না স্যার, প্লিজ। কিউরিসিটি। এটা কেউকে বলবো না।



: এককালে কম্যুইনিস্ট ভুত ছিলো ঘাড়ে। কিন্তু অ্যাথিস্ট ছিলাম না কোনোকালেই। অনেক বিদ্বান লোককে মসজিদে-মন্দিরে মাথা ঠুকতে দেখেছি। বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ এখনও বিশ্বাসী। বেশিরভাগ মানুষ তো আর ভুল না।



: এতো টাকা কী করলেন? সম্পদ কাকে দিয়ে যাবেন?



: টাকা পয়সার একটা বিরাট অংশ চলে গেলো চিকিৎসায়। বাকিটাও চলে যাবে হয়তো।



: স্যার, হার্টে একটা রিং পরাতে কত টাকা লাগতে পারে তা জানি। কথা অন্যদিকে যাচ্ছে। আপনি কি মাত্র ৪-৫ লাখ টাকা ইনকাম করেছেন জীবনে? রিকশাও চড়তেন না!

: রণি, রিকশায় না চড়ার কারণটা একেবারেই ভিন্ন ছিলো। তোর কি মনে হয় তিন টাকা খরচ করা আমার সাধ্যের বাইরে ছিলো? সারাদিন খাটুনি ছিলো না। ওই ঘামটা দরকার ছিলো। ৭০ বছরে সবাই আমার মত দাপায় বেড়াতে পারে না। এর পিছনে ওই পায়ে হাঁটা।



: কিন্তু স্যার, টাকা পয়সার কথা বলতেছি।



: যে ভাগনে দেখাশোনা করে ওকে জমি কিনে দিয়েছি। তা নিয়েও কত গন্ডগোল, কত অসন্তোষ!



: স্যার, মনে হয়নি স্কুল টিচার হওয়া থেকে বেশি কিছু ডিজার্ভ করতেন?



: আমার সময়ে স্কুল টিচার হওয়ার স্বপ্ন দেখাটাই অনেক ছিলো। আর এই খুলনার রাস্তায় হাঁটার সময় মাঝে মাঝে কেউ রিকশা থেকে নেমে পা ছোঁয়, জড়ায় ধরে। কথা বলে জানি ও আমার ছাত্র ছিলো। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার। দেশে-বিদেশে এক একজন বিরাট জব করে। যাকে দেখে একটা বড় প্রতিষ্ঠানের সবাই সালাম ঠোকে। সে রাস্তা ঘাটে আমার পা ধরে টানছে, এই মর্যাদা আর কোথাও আছে? আমি তৃপ্ত। একেক মানুষের একেক জিনিসের লোভ থাকে। আমার ছিলো সম্মানের লোভ। সেটা পেয়েছি।

স্যার যাওয়ার জন্য তাড়া দেয়। অনেক জমে থাকা প্রশ্ন বাদ দিয়ে শেষ প্রশ্নটা করি।



: স্যার, দীপুর মৃত্যুর কারণটা জানেন।



: কোনটা? ওই যে ফিজিক্স। ওকে দুইবার ইচ্ছে করে ৩২ দেওয়ায়।



: রণি, একেক মানুষ একেক রকম। এর থেকেও নিচু মানষিকতার লোক আছে।



: স্যার, একটা খুনিকে ডিফেন্ড করতে চাইছেন?



: ডিফেন্ড করলাম কোথায়। কিন্তু খুনি বলার জন্য প্রমান লাগে, তাই না?



: স্যার, দীপু যদি একটা চিরকূট রেখে যেত, ওকে আমি জেলের ঘানি টানাতাম। সরল সোজা ছিলো। এসব ওর মাথায় আসেনি। আমি হলে চিরকূট রেখে যেতাম।



: হা হা। দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল। তোর ছোটটা পড়াশুনা করে?



: না স্যার। ফাঁকিবাজ। আম গাছে কি আঙুর হয়? স্যার, আপনার সাথে একটা ছবি তুলি?



: অন্ধকারে উঠবে?



: যা ওঠে।



ওটাই শেষ স্মৃতি হয়ে আছে। আমাদের প্রজন্মের সেন্ট জোসেপস এর সম্ভবত শেষ স্মৃতি হয়ে ছিলেন স্যার। হারিয়ে গেলেন। গতকাল সকালে অতনুর ফোনের পর থেকে মাথা আর কাজ করেনি। আজ এখন ভাবছি, জীবনে তো কত শত স্যার এসেছে। আর কারো জন্যে এই খারাপ লাগাটা তৈরি হয়নি আমার। সবার জন্য হয়ও না। মাঝ রাস্তায় রিকশা থামিয়ে সালাম করার স্যার সকলে হতে পারেন না।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জুন, ২০১৩ রাত ১০:৩৩

খেয়া ঘাট বলেছেন: কথোপকথনটা দারুন লেগেছে। একজন মহান শিক্ষক।
যেখানেই থাকুন স্যার ভালো থাকুন।

২| ২৬ শে জুন, ২০১৩ রাত ১১:১২

ইরফান আহমেদ বর্ষণ বলেছেন: :( :( :(

৩| ২৬ শে জুন, ২০১৩ রাত ১১:৩৫

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: ভালো লাগা ও কষ্ট , একইসাথে +++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.