![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অশরীরী হাতটা ঠেসে ধরেছে। প্রথম দিন মনে হয়েছিল ঠেসে ধরে মেরে ফেলতে চায়। ছটফট করছিলাম। হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে যাবে শরীর থেকে এমন অনুভূতি। ভূত। সেটা কি নিশুর ভূত, না কি সে রাতে নিশু তার স্বামিকে কথায় কথায় বলেছিল আমার কথা, আর সে-ই লোকটার আত্মা প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে চেপে বসেছিল আমার বুকে। ভূত, এখন চেনা ভূত। আসে বন্ধু হয়ে । পিঠে চাপ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ঘুমের মধ্যে তাকে খুঁজি, একেকদিন হয়রান হয়ে খুঁজি। নিশুকে না পেলে ভূতকে খুঁজি। ঐ তো সে—ছিপছিপে তরুণী শরীর, এখনও কুমারী লাগে। আমাদের বাড়িতেই থাকছে ও—ধ্বক করে ওঠে বুক!
মস্ত খোলা উঠোনের একধারে অন্ধকার বাঁশবন। গা ছমছম করে ওঠে। দোতলার বারান্দার কোনায় একটি মাত্র আলো, আর সে জেগে আছে। বাড়িটা কি আমাদের, অচেনা লাগে; কিন্তু মা… আমি… এখানেই থাকি!—অন্ধকার ঘরগুলোতে আমার পরিবারের অস্তিত্ব লেগে আছে, আমাদেরই…, তা-ই তো মনে হয়! এতো রাতে কিছু একটা টেনে এনেছে তাকে বাইরে। ঘরে কি গরম অথবা তার ভাবনায় হোঁচট খেয়ে বাচ্চাটা জেগে উঠেছে! আমার নাগালেই সে—আহ্, কাছেই সে আমার! রোমাঞ্চে অভিভূত বোধ করি। আলোর কাছে এসে দাঁড়ায় সে একবার। স্পষ্ট দেখি, বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াবার চেষ্টা করে, কিন্তু তার দরকার হয় না—সেটি ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়ির সারিসারি অন্ধকার ঘরগুলোর দু-একটি নিশ্চুপ জেগে আছে এখনও। কতক্ষণ পায়চারী করছিল সে? এই এক রতি স্বপ্নসুখ ঘুমকে গভীর করে তোলে, ঠেলে বেলা দুপুর পার করিয়ে দেয়।
দূরের একটা দেশে তাকে খুঁজি। সেখানে কীভাবে গেলাম আমি। অল্প কারো কারো চেনা হয়ে উঠেছি এলাকায়। সে কি জানে আমার উপস্থিতি এখানে। দূরে থেকে, কোনো উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে—যেখানে আমি থাকি, দূরের রাস্তা থেকে ওদের বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে থাকি। সরু মাটির রাস্তা ধরে অবেলায় তাদের বাড়ির কাছে চলে যাই। তীক্ষ্ম চোখ রাখি ও বাড়ির দরজায় জানালায়। বাগানের আনাচে কানাচে কার অস্তিত্ব অনুভব করি। বুকে শূন্যতার দোলা খাই। একদিন বোধহয় দেখেছিলাম রিক্সায়, আর সেও আমাকে। কত মাস ধরে খুঁজছি? ব্যর্থতা ক্রমশঃ চেপে ধরে, বুকে বসে যায়। আরেকটা রাত, আরেকটা ঘুম, আরেকটি সাক্ষাতের অভীপ্সায় নির্জীব একটা বছর ঘুরে যাচ্ছে। ঘুম ভাঙলে আয়নায় নিজেকে দেখে হতাশা বোধ করি, নির্বোধ একটা জন্তুর মতো লাগে ।
মাত্র একটি বছর। এক বছর পড়েই যেন যৌবনটা কালকে অতীতের চোখে দেখি। ঠোঁটের কোণায় দুঃখ লেগে আছে। নিজেকে দেখি। দুঃখগুলো হাসির মতো প্রসারিত হয়—মনে পড়ে, প্রথম পরিচয়েই আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়েছিলাম ভূতটার ঘাড়ে। আহ্, তখন ছিল আমার দিন। দুর্বার দিনগুলি। ঘটনাটা খুলে বলি।
গ্রামে এসেছি একাকী। বর্গাদারদের কাছে টাকা তুলতে। সাতদিন থাকতে থাকতে হলো। ভাল লাগছিল। আরেকটা দিন থাকা যেত, কিন্তু শেষ মুহূর্তে হঠাৎ কোনো ঝামেলা হতে পারে, ভিতর থেকে কে যেন টান দিল। ব্যস্ত হয়ে উঠলাম মনে মনে। সকালে সময় মতো নৌকার ঘাটে পৌঁছতে না পারলে, দিনে দিনে আর ঢাকা ফেরা হবে না। ৫ কিলো হেঁটে গিয়ে সকাল ৮:০০ টার নৌকাই ধরতে হবে।
সন্ধ্যা হয়েছে খুব বেশিক্ষণ হয়নি। বাইরের দরজাও বন্ধ দেখে অবাক লাগল। পাড়া-গাঁয়ের শীতের রাত, খেয়াল করে দেখলাম পুরো পাড়াটাই অন্ধকার— ঘুম নেমে এসেছে ঘরে ঘরে। চিৎকার করে ডেকে তুলতে হলো চাচীকে। উঠে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে দিলেন, নিঃশব্দে খেয়ে নিলাম। উনি ঘরের দরজা লাগাতেই পুরো বাড়িতে আবার আমি একা।
ঝিমঝিম নির্জনতা। রাতগুলো ভালই কাটছে এখানে। বিজলিবাতি লেগেছে। বাথরুমে বরেন্দ্র প্রকল্পের সাপ্লাই এর পানির সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা রয়েছে । বারান্দায় বসে ইচ্ছে করে চ্যাট করতে পারি মুঠোফোন থেকে বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু খুব ঠাণ্ডা। মাটির ঘরে নেটওয়র্ক পাওয়া যায় না, কিন্তু বলতে গেলে লোডশেডিং এর বালাই নেই। কবিতার খাতা আছে, নিশুর জন্য চিঠি লিখতে পারি, সুনীলের একটা ঢাউস উপন্যাস এনেছি সঙ্গে—নূন্যতম সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দেশেরই একটা প্রত্যন্ত গ্রামে বসে আছি একদম টের পাই না। কাল ফিরতে হলে সকাল ৮ টার মধ্যে নন্দ’র ঘাটে পৌঁছাতে হবে। নৌকা মিস করলে নদী পেরিয়ে হাঁটতে হবে আরও ঊনিশ কিলো। অথবা হঠাৎ কোনো রিক্সা-ভ্যান পাওয়া গেলেও যেতে পারে।শীতের মরশুম খাল-বিল সব শুকিয়ে এসেছে, সারাদিনে একটা মাত্র ইঞ্জিনের নৌকা এখানে ওখানে চড়াই ঠেলে যাওয়া-আসা করে শহরের পথে। এতটা লম্বা রাস্তা হাঁটার ঝুঁকি কিছুতেই ঝুঁকি নেওয়া যাবে না, রাতটা আনন্দের সাথে জেগে কাটানোর পরিকল্পনা নিলাম।
পূবের ঘরটা বেশ বড়। দুই প্রান্তে দু’টি চৌকি পাতা। মাঝখানে মস্ত একটা কাঠের বাক্স, অসময়ে লেপ-তোশক তুলে রাখা হয় এখানে। একটা ভারী চেয়ার পাতা রয়েছে—ওখানে বসে বই পড়া যায়, আলোর কাছে। খাবার পানি, হালকা জলখাবার বাক্সের উপর, ফোন চার্জ করা যায়—ব্যাস্, আর কী চাই। ধবধবে সাদা লেপ, নির্জন ঘর—বিজলির আলোকে জোছনার মতো লাগে। স্নিগ্ধ এক নিঃসঙ্গতা জড়িয়ে ধরে মন । পাশের বাড়ির টিনের চালের নিচে কাঁথিতে ছোট ছোট বাক্সগুলো থেকে এক সাথে ফড়ফড় করে ওঠে কতকগুলো কবুতর। শান্তি লাগে। মনে হয় জীবনে আর কিছু করার নেই। এবার ঘুমিয়ে পড়তে পারলেই হয়। টাকাগুলো, আর ছড়ানো দু’একটি কাপড় ব্যাগে গুছিয়ে নিলাম। ছোটোখাটো হ্যাণ্ডব্যাগ, খোলা পড়ে রইল সিথানের পাশে। খাতাটা বের করে কবিতার লেখার চেষ্টা করি, খুব ভাল একটি লেখা তৈরি হয়। ঘষে ঘষে অনেকক্ষণ ধরে সেটাকে প্রায় নিঃখুঁত করে তুলি। শেষটা দেখে ফুরফুরে হয়ে ওঠে মন।
মাত্র সাড়ে বারোটা বাজে। একটু পরেই রাতের আবহ বদলে যায়। থমথমে লাগে।বাথরুমটা ঘর থেকে একটু বেশিই দূরে, চারিদিকে ঘন অন্ধকার, আর মাঝরাত্তিরে নৈঃশব্দ ভারী হয়ে উঠলে যখন নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায় নিজেরই, কান দু'টো যেন উৎকর্ণ হয়ে ওঠে অন্য কিছুর অস্তিত্ব অনুসন্ধানে। যে নেই, যা নেই তাকেও যেন আবিষ্কার করে ফেলা যায় এমন পরিবেশ। কিন্তু কতবার এসেছি এই গ্রামে, প্রতিবারই এভাবে একাকী থাকতে হয়। কখনও ভয়ের কিছু ঘটেনি। কিন্তু ভয়ের প্রসঙ্গ জাগতেই তাকে দূরে ঠেলার একটা ব্যাপার চলে আসে মনে। বাথরুমটা একবার ঘুরে এসে শরীর মনের জড়তা ঝেড়ে ফেলি। শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। আলোটা জ্বলুক।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্বে মগজে সাড় ফিরে আসে। উপুড় হয়ে শুয়েছি, পিঠের উপর চাপ দিয়ে কেউ আমাকে বিছানার সাথে ঠেসে ধরে। আমি লড়াই করে উঠে বসবার চেষ্টা করি। এবার হ্যাণ্ডব্যাগটাও আমার ভাঁজ-করা বাম হাতের কনুইয়ের উপর উঠে পাথরের ভার নিয়ে চেপে বসে। কষ্ট পেয়ে ছটফট করে উঠি। ব্যাগটাকে কিছুতেই শরীরের উপর চেপে বসতে দেয়া যাবে না। যেন একটা শক্তির লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছি। আপ্রাণ চেষ্টা করেও নড়তে পারছি না। হাতটাকে ব্যাগের উপরে রাখতে যেই না একবার সক্ষম হলাম, অমনি শরীরেও সাড়-শক্তি ফিরে এল। নিজেকে আবিষ্কার করলাম ভয়ংকর চিৎকাররত অবস্থায়—‘কে তুই, কতবড় জ্বীন, আজ তোকে শেষ করে ফেলব’—দুই হাত তুলে আক্রোশে আস্ফালন করছি। হাজার বছরের সংস্কার, প্রথমে জ্বীনের কথায় মনে হয়েছিল। পরে জেনেছিলাম ‘বোবায় ধরেছিল,’ ইংরেজিতে যাকে বলে স্লিপিং প্যারালিসিস্।
নিশু মেয়েটি এমনিতে খুবই চমৎকার ছিল। হুট করে ছেড়ে চলে যাবে এমনটা ভাবা যায়নি। মেয়েটা চিঠি পেতে আর নিজেও লিখতে খুব ভালোবাসত। প্রচুর চিঠি আমি তাকে লিখতাম। গড়পড়তা প্রেমিক—‘মন ছাড়া আর কিছু নাই গো দেবার’ ঘরানার আমি। চাকরি-বাকরি নেই, সামান্য গ্রাজুয়েট, মাস্টার্স করছি। চার ভাই-বোন। বাবা একটা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকতা করতেন। কিছুদিন হলো রিটায়ারড। জমি-জমা আর বাবার পেনশনের টাকায় কোনোরকম সংসার চলে যায়। জানি না কেন বাবা-মা জানতে দেননি সেদিন আমাকে নিশুর বিয়ের কথা। যে রাতে আমি ভূতের সঙ্গে যুদ্ধ করছি সে রাতেই এনজিনিয়ার এক পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। শহুরে ফিরে জানলাম নিশু আজ শ্বশুরবাড়ি। আমার জীবনে বিরাট এক দাগ কাটল ঘটনাটা। কাউকে কিছু বলতে পারলাম না। মানসিক অসুস্থতা ভর করল। রাতে থেকে থেকেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠি। বাবা-মা ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন। মুড-অন জাতীয় ওষুধ-পত্র খেতে খেতে মোটা হতে শুরু করলাম। নিজেকে খুব অসহায় লাগে। কাজ-কর্মে উৎসাহ পাই না। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাই। আর ঘুমের মধ্যে নিশুকে খুঁজি। একদিন দেখেছিলাম কারও যেন বাড়ির ছাদে, বাচ্চা কোলে।
আরও একটা কথা, প্রায় রাতে আমাকে এখনও ভূতে ধরে। শরীর ঠেসে ধরে বিছানার সাথে।মাঝে মাঝে চুল ধরে টানে। রাতে একা ঘরে থাকতে ভয় ভয় লাগে। তবে আমি নিজেই এর একটা উপশম আবিষ্কার করে ফেলেছি। ভূত এসে শরীরে চাপ দিলেই একটু সাহস করে শরীর এলিয়ে দিলেই হল—ব্যাস! একদার ভীতিকর স্পর্শটাই এবার নির্ভরতা হয়ে ওঠে। শান্তির ঘুমে তলিয়ে যাই। আজ ভ্যালেণ্টাইন। আমি ভালো আছি, আবিষ্কারক হয়ে উঠেছি, এই কথাটা জানাতেই নিশুর কাছে লেখা আমার শেষ চিঠি এটি।
©somewhere in net ltd.