নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যা মনে আসে তাই লিখি।

স্বর্ণবন্ধন

একজন শখের লেখক। তাই সাহিত্যগত কোন ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

স্বর্ণবন্ধন › বিস্তারিত পোস্টঃ

চাঁদের বুড়ি

৩০ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:২৫

বুতু সোনা! বুতু সোনা! ওইদিকে যেয়োনা বলছি! কথা শোন!
নয়ন আর রেণুর এই আদরের দুই বছর বয়সী কন্যাকে থামাতে বাবা মার চকিত চিৎকার পড়শীদের কানে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এই বয়সটাই এমন, সব কিছু দেখতে মন চায়, নাড়তে মন চায়, কামড়িয়ে খেতেও মন চায়! এতো দুরন্ত চড়কির মতো ঘোরে আর ঘোরে, চোখের সামান্য আড়াল হলেই সাক্ষাৎ বিপদ! মফস্বল শহরের বুকে নয়নের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাসাটা বেশ বড়, পুরানো ইটের হাড় বের করা কয়েকটা ঘর, বড় উঠোন আর তার পিছনে কিছুটা জায়গা ঘন জঙ্গলের মতো, বেখাপ্পা ভাবে পুরাণের চরিত্রের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দ আসে ভর সন্ধ্যায়, শিউরে উঠে বাসার মানুষ, কাঁপে ঘন গাছ গুলোর পাতা! বুতু সোনার দাদু বেঁচে থাকতে বলতেন, ওইখানে নাকি ন্যাওলা আর ন্যাওলী নামের ভূত বাস করে, তবে ওরা পারিবারিক ভূত, কখনো কারো ক্ষতি করেনা, একটু আধটু ভয় দেখিয়ে মজা নেয় আর কি! বুতু সোনার বাবা অবশ্য রেণুকে বলেছে, ঐসব বোগাস কথা! নানান রকমের পাখি সন্ধ্যায়া বুড়ো ফজলি আমের গাছটাতে থাকতে আসে, তারই শব্দ! যার শব্দই হোক, উৎস নিশ্চিত না হলে ভয়টা সহজে যায়না! অবশ্য এখন এই উপকথার ভুতদের কাজে লাগানো হয় বুতু সোনাকে ভয় দেখানোর জন্য। মানব শিশুকে তো সবই শেখাতে হয়, কিসে ভয় কিসে নির্ভয় হতে হয় তাকে শিখতে হয়। দুই বছর আগের ঘোর আষাঢ়ে এই মিষ্টি বাবুটার জন্ম, পৃথিবী তখন কাঁদায় মাখামাখি, নয়ন রেণুর ঘরেও নতুন বাচ্চার কান্না, মিলেমিশে একাকার! নয়ন আর রেণুর সম্পর্কটাও কেমন হালকা হয়ে আসছিল, তাদের মাঝে যোগসূত্রের মতো কোঁকড়া চুলের বড় মায়াবী চোখের বাচ্চাটা এসেছিল সে আষাড়ে। এখন নয়ন আর তেমন বাসার বাইরে যায়না, বন্ধুদের ক্যারামের আসর, বটতলার বিড়ি টানা বিকালে তাকে পাওয়া যায়না, একটা মায়ায় আটকে গিয়েছে, বাচ্চাটাকে না দেখলে কষ্ট লাগে তার, বুকে মোচড় দেয়! রেণু রান্নাঘরের ফোঁকর দিয়ে তাকায়, একটা অর্বাচীন খুশি অজান্তে নাচে চোখে মুখে।
আদর করে ডাকতে ডাকতে বাচ্চারা যে কতো অদ্ভুত নাম পায়, বুতু ডাকতে ডাকতে যেমন নাম হয়েছে বুতু সোনা! অবশ্য তার মা একটা ভালো নাম দিয়ে জন্ম নিবন্ধন করিয়েছে। রেণুর চাঁদ দেখার খুব শখ। কিছু মানুষ থাকে যারা অকারণে চাঁদকে ভালোবাসে। মাঘী পূর্নিমার রাতে এদের মাথা আউলায়ে যায়, পাগলের মতো সারারাত জ্যোৎস্নায় হাঁটাহাঁটি করে! বাচ্চারা যা দেখে তাই শিখে! রেণুর বাচ্চাটার ও এই বয়সে চাঁদের রাতে কান্নার রোল শুরু হয়, সে চাঁদের বুড়ি না দেখলে ঘুমায় না! নয়ন মজা কর বলে বুতু সোনার নাম বদলিয়ে চাঁদের বুড়ি রাখতে হবে!
বুতুর জন্মদিনের পরের দিন, সকালটা তখন মেঘে মেঘে মুখ কালো করে আছে, অর্ধেক প্যান্ট কাঁদায় মাখিয়ে, এক আগন্তুক এলো বাসায়। প্রথমে নয়ন চিনতে পারলোনা কিছুক্ষণ, যদিও মুখের গড়ন চেনা চেনা লাগছিল। স্বপন দাদা এসেছে, সেই বছর দশেক আগে ওইপারে চলে গিয়েছিল পরিবারের সাথে। এতোদিন পর দেখে আবেগের আতিশয্যে আশেপাশের মানুষ ও বুঝে গেলো কেউ এসেছে! স্বপন দাদা বদলে গিয়েছে, কথায় অদ্ভুত টান, দন্ত্য স এর উচ্চারণটাও পাল্টে গিয়েছে। স্বপন দত্ত নয়নের কাকাতো ভাই, এতোকাল পর এসেছে, খোঁজ খবর নিয়েই এসেছে! বুতু সোনার জন্য অনেক খেলনা এনেছে, ছোট ছোট প্লাস্টিকের গাড়ি, একটা মেমসাহেব ডল আর একটা আস্ত রাবারের সাপ! এটা দেখে আঁতকে উঠে রেণু! স্বপন হেসে বলে, বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকে সাহসী করতে হয়, এগুলো দেখে অভ্যাস থাকলে পড়ে আর ভীতু হবেনা! তাই না মা বুতু! পিচ্চি দের পৃথিবীর সকল কিছুতেই আগ্রহের শেষ নেই, এমনকি ওরা প্রথমে আগুন ধরেও তার স্বাদ দেখতে যায়! এই খেলনাটাই বুতুর সবথেকে বেশি পছন্দ হলো, কতো কিছু করা যায়, রাবারের সাপটাকে শরীরে জড়ানো যায়, দেয়ালে আছড়ানো যায়, অস্ত্রের মতো ঘোরানো যায়! এক খেলনার এতো ব্যবহার কার না পছন্দ হবে! শুধু রেণুর মন কালো হিসহিসে রাবারের লম্বা শরীর দেখে ভয়ে কেঁপে উঠে, এরকম খেলনা কে বানায় আর কে কেনে? তাদের আক্কেল পছন্দ নাই! স্বপন দাদা চলে যাওয়া মাত্রই রেণু এটা পুড়িয়ে দিবে।
স্বপন দত্ত অতিরিক্ত বেশি কথা বলে, কথায় কথায় উজির মারে নাজির মারে! সারাদিন বকবক শুনে মাথা ধরে যাচ্ছে রেণুর, কোথাকার কোন গাভাস্কার কি করলো, নেহেরূ কার বাড়ি গেলো, এসব আর কতোক্ষণ শোনা যায়! অবশ্য এসব শোনাতে আসেওনি স্বপন দত্ত, সে শুধু পুরাতন সম্পর্কটা একটু ঝালিয়ে নিতে চায়! হুট করে তো আর দেনদরবারে বসা যায়না।
সব অপেক্ষারই শেষ হয় একদিন। আসার দিন দশেক পর, সকাল সেদিন মেঘশূন্য, নয়ন বুতুকে নিয়ে বারান্দায় বসা, স্বপন কথাটা পাড়লো! ন্যায্য কথা তার! তার বাবার সম্পত্তি আছে এই বাসার জায়গার ভিতর, নয়নেরা শত্রু সম্পত্তি আইনে ভোগ দখল করছে এখন। এতোদিন দরকার ছিল না, কিন্তু এখন হাতটান, সেগুলোর হিসাব লাগবে! নাহ, নয়নের কাছে থেকে কেড়ে নিবেনা, কিন্তু নয়ন তাকে সম্পত্তির মূল্য দিক! পুরোটা আসল দামে না হোক কিছু তো দিক! হাজার হোক এটা তো স্বপ্ননের উত্তরাধিকার! সম্পত্তি ভাগাভাগির কথা শুনে শান্ত থাকতে পেরেছে এমন মানুষ কয় জন আছে! তার উপর এতো এখন অন্য দেশের নাগরিক, এ দেশে এর কিসের উত্তরধিকার? এইজন্যই বলে ওই দেশে যেয়ে সব বাটপার হয়! নয়ন মিনিট দুয়েক চুপ করে থেকে একটু ভেবে বলে-‘দাদা, আসছো তো পাসপোর্ট নিয়ে! আবার উত্তরাধিকারের হিসাব কর! পুলিশে জানালে কি হবে বুঝতেছ?’ হুম, স্বপন সব জেনে বুঝেই এসেছে, সে একটু সাহায্য আরা সহানুভূতি আশা করেছিল, এতোটা কৃতঘ্নতা না! শাস্ত্রে আছে কৃতঘ্ন কখনো বন্ধু হতে পারেনা। আর শত্রুর সাথে কি করতে হয় সে জানে। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে নেয়। ‘কোথায় চললেন দাদা? দুপুরের খাবার খাবেন না?’- বলে উঠে রেণু। উত্তর দেয়না স্বপন দত্ত। অপমানে ঘাড় টনটন করছে। শেষবারের মতো বারান্দার সামনে এসে বলে-‘মোসলেম আলীর সাথে কথা হয়েছে, উনার কাগজে সই দিলে উনিই বের করে নিবে সব!’ নয়নের আর মেজাজ ঠিক থাকেনা, এতো সাহস, হুমকি দিচ্ছে! হাতের পাশে রাখা চেলা কাঠটা তুলে এগোয়! দেরী করেনা স্বপন, প্রায় দৌড়ে বের হয়ে যায় উঠোনের সামনের সদর দরজা দিয়ে! যেতে যেতে বলে-‘অভিশাপ দিচ্ছি, অভিশাপ! পরের ধনে সুখের ঘর নিপাত হোক!’ অভিশাপের কথা বাতাসে ভাসে, প্রতিধ্বনিত হয়, পড়শীরা কান পেতে শোনে!
কয়দিন হলো রাতের আকাশে ক্রমবর্ধিষ্ণু চাঁদের সাথে মেঘের খেলা চলছে! খুব অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। দিনে বৃষ্টি আর রাতে আলোছায়ার খেলা। রেণু আর নয়ন পায়চারি করছে উঠোনে, কথা বলছে স্বপ্ননের ঝামেলাটা নিয়ে। বুতু সোনাকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছে তাড়াতাড়ি, সারাদিন ক্লান্ত ছিল, এখন জেগে থাকলে চাঁদের বুড়ি দেখার বায়না করবে। নয়ন রেণুকে আলতো করে জড়িয়ে বলে, ভয় না পেতে, সে খবরাখবর নিয়েছে, কোন কিছুই করতে পারবেনা স্বপন! আর আইনতই এটা তাদেরই প্রাপ্য, স্বপনের নয়!
হঠাত অস্ফুট মা ডাক শুনে বারান্দার দিকে তাকায় দুইজন। কখন ঘুম ভেঙ্গে গুটি গুটি পায়ে বারান্দায় এসে দাড়িয়েছে বুতু সোনা! চাঁদের বুড়ি দেখার জন্য হাত বাড়িয়ে আছে! ‘এসো মা মণি! চলে এসো!’-আহ্লাদে বলে উঠে রেণু। বাচ্চাটা পা বাড়ায়। আরে ঐটা কি আসছে উঠোনের মাঝে দিয়ে, কালো দড়ির মতো শরীর, হিসহিস করে এগিয়ে আসছে! একপাশে বাবা মা দাঁড়িয়ে আরেকপাশে বুতু সোনা! বৃষ্টির পানি জমেছে পিছনের জংগলে, শুকনোয় উঠে এসেছে একটা সাপ। ধরণী অন্তরীক্ষ প্রবল আতংকে চেঁচিয়ে উঠে, চিৎকার করে উঠে নয়ন-‘বুতু মা! এসোনা বলছি! দাঁড়াও! দাঁড়াও! বুতুসোনা ভয় পায়না, সামনের খেলনাটা তারা খেলনাটার চেয়েও সুন্দর, মাথায় গরুর খুরের মতো জ্বলজ্বলে সাদা দাগ, তার ওটা চাই চাই ই চাই! হাত পা দুটোই বাড়ীয়ে দেয় সে! মুহুর্তের মধ্যে সাপটার ছোবল আর গগনবিদারী চিৎকারে বুড়ো আমগাছে জেগে উঠে সবকটা অচেনা পাখি!
..........................................
পড়শিরা তারপর থেকে এখনো ফিসফাস করে অভিশাপ! অভিশাপ!
কেউ কেউ অবশ্য বলে আহারে! পোড়াকপাল!

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:০৫

নেওয়াজ আলি বলেছেন: সুন্দর লিখনী।

০৮ ই মে, ২০২০ রাত ১২:৪১

স্বর্ণবন্ধন বলেছেন: ধন্যবাদ

২| ৩০ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:০২

রাজীব নুর বলেছেন: গল্পে আকর্ষন করার মতো উপাদান কম।

০৮ ই মে, ২০২০ রাত ১২:৪২

স্বর্ণবন্ধন বলেছেন: আসলে সময়ের অভাবে হয়তো বাধুনিটা আসে নাই। ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.