![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। পরমত-সহিষ্ণু, শালীন ও ধর্ম-পরায়ণ।
শ্রদ্ধাভাজনেষু ইউসুফ আল-কারদাবি
السلام عليكم ورحمة الله و بركاته
১। সম্প্রতি আপনার ওয়েবসাইটে একটি খোলা চিঠি চোখে পড়ে, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বরাবর লেখা। উদ্দেশ্য, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ-এর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ফাঁসির দণ্ড মওকুফের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ কামনা। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে নিই, যতদূর জানি, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে আপনার জানাশোনা অপ্রতুল নয়। আপনি সরাসরি ভ্রমণের মাধ্যমেই তা অর্জন করেছেন। এবং আপনি হালফিল খোঁজখবরও রাখেন। বর্তমান চিঠি তারই লক্ষণ।
২। কিন্তু এ চিঠিটাকে অনেকটাই অবিবেচনাপ্রসূত বললেও অত্যুক্তি হবো না। কারণ, আপনি একপেশেভাবে আয়াত ও হাদিস দিয়ে আপনার প্রার্থিত বিষয়ে জোর দিতে চেয়েছেন। যারা আপনাকে তথ্য সরবারহ করে বা করেছে, তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশে ৭১ ও তৎকালে সংগঠিত অপরাধের ফিরিস্তিটা জেনে নিন। তখন আপনার কাছে মধ্য দুপুরের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, চিঠিটা কতটা কাঁচা বুদ্ধির! একাই সঙ্গে এই সব আয়াত ও হাদিসের অডিয়েন্স কারা হতে পারে, কারা-ই বা এর লক্ষ্য, তাও স্পষ্ট হবে।
৩। হ্যাঁ, যে কোনো মৃত্যুই বেদনা জাগায়, এমন কি তা দণ্ড হিসাবেও হলেও। এ সূত্রেই আমাদের বাংলা ভাষার প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, “দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা যবে কাঁদে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার”। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত মানুষদের জন্য বিচারপ্রার্থী ও বিচারকদের কোনো করুণা জাগছে না, তা না। কিন্তু তা শ্রদ্ধামিশ্রিত নয়, বরং ঘৃণামিশ্রিত। কারণ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে লড়াইকালে তাদের যে অপরাধ ও অবস্থান, তা তাদের এ-দণ্ডকে একান্তভাবে অনিবার্য করে তোলে।
৪। যতদুর জানা যায়, আপনি অশীতিপর হলেও ধর্মবিষয়ে তুলনারহিত পণ্ডিত। আপনার সামনে কতিপয় প্রশ্নের উত্থাপন করতে চাই। আর তা হল, ইসলামদরদি হিসাবে, মানবদরদি হিসাবে দ-প্রাপ্ত নিজামীর পক্ষে আপনার অবস্থান। এর পেছনে আপনার অবশ্যই কোনো যুক্তি আছে। কিন্তু ৭১ সালে যখন নারকীয় তাণ্ডবের ভেতর দিয়ে পুরো একটি জাতি রুদ্ধশ্বাসে দিন গুজরান করছিল, তখন আপনাদের মতো পণ্ডিত ও ধার্মিকদের মানবতাবোধ কোথায় ছিল এবং এখনই-বা কোথায়?
৫। ঘটনাটা ঘটেছে ১৯৭১ সালে, প্রায় চার দশক আগে। সে সময়ে যে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে, তার সাক্ষী পাকিস্তানের হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টসহ আরো একাধিক উর্দু বইপত্র। বাংলা বা ইংরেজি ভাষার কথা না-ই তোলা হল। যারা এর সঙ্গে জড়িত, যাদের প্রত্যক্ষ মদদে তা সম্পন্ন হতে পেরেছিল, এ দীর্ঘ সময়ে তাদের বোধোদয় হয় নি কেন? ইসলামের মতো একটি মহৎ ধর্মের লেবেল ব্যবহার করেও ধর্মের উদারতা অনুসারে আপন অপরাধ স্বীকারের পথে ওরা যায় নি কেন? অথচ আপনি কী সরলভাবেই না তাদেরই পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিলেন!
৬। আমাদের মতো সাধারণ জনতার মতে, ইসলামি সংগঠনগুলোর প্রতি আপনাদের মতো গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের অন্ধ ও শর্তহীন পক্ষপাতিত্ব এদের স্পর্ধাকে বাড়িয়ে তোলে। কোনোভাবেই এরা আত্মসমালোচনার বাস্তব পথে এগুতে চায় না। অবশ্য বর্তমানের আইসিসের ব্যাপারে আপনার অবস্থান বেশ কঠোর এবং স্পষ্ট। এটি লেখার পেছনে আপনার বর্তমান এ অবস্থানটাই নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু শাইখ, ৭১-এ ঠিক আইসিসের মতো যারা অপরাধ করেছিল, তাদের প্রতি আপনার এই বর্তমান পক্ষপাতিত্ব স্ববিরোধিতা হয়ে গেল না?
৭। বহু পূূর্বে ঘটে যাওয়া একটি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আরব বসন্তের সূতিকাগার তিউনিসিয়ার নেতা রাশেদ গান্নুশি নিজেদের দায় স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এতে তারা ছোট হয়ে যায় নি। তার পরিচালিত আল-নাহদার আচরণও অনেক সংযত। বসন্তের দ্বিতীয় ভূমি মিশর কিন্তু সংযমের পরিচয় দিতে পারে নি। সত্য বটে, ক্ষমতা নিয়ে নানা রকম গুটি চালাচালি হয়। কিন্তু তখন আবেগ ও অপরিপক্বতা-ই মূলত বিপদ ডেকে আনে। মিশরের সেই ক্রান্তিলগ্নে আপনি মুরসির লোকদের পক্ষে নানা বিবৃতি দিয়েছেন। আপনার বিবৃতি পিরামিডে কোনো প্রতিধ্বনি তোলে নি। বাংলার শ্যামলভূমি ও জলবাতাসও আপনার গায়ে-পড়ে মোড়লিপনার বক্তব্য গ্রাহ্য করার কথা নয়।
৮। ইসলামি আওয়াজ তুলে একে পার্টি ক্ষমতায় আসে অত্যন্ত সন্তর্পণে। কিন্তু তারা বাহ্যিকতার চেয়ে আত্মনির্মাণ ও বাস্তবতার প্রতি বিশেষভাবে নিবেদিত ছিল। অন্যদিকে, একে পার্টির অতীত জামায়াতের মতো কলুষিত নয়, অথচ একে পার্টির বর্তমান প্রধান এরদোগান এখন কলুষদের পক্ষেই সাফাই গাইছেন। দুর্ভাগ্য হলো, মুসলিম সমাজের নেতৃবৃন্দ তুলনামূলক অধিক হঠকারী। আর তাই এরা বাস্তবতাকে প্রায়ই এড়িয়ে যান অবহেলায় এবং অবলীলায়। নানা বিষয়ে এরদোগান হঠকারী ও গোয়ার্তমির আচরণ শুরু করলে, এর চাপ নিতে তারই নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী অস্বীকার করে বসেন এবং এখন পদত্যাগেও তিনি প্রস্তুত। তাহলে বাংলার মানুষজন তার একপেশে বক্তব্য সহ্য করবে কেন?
৯। অতীত থেকে বর্তমানের ইসলামের ইতিহাস ঘাটলে এটা জোরালোভাবেই প্রমাণিত হয় যে, কোনো ইসলামি দলই আত্মসমালোচনার দায়ভার নিতে চায় না। তথাকথিত জ্ঞানের কুতুবমিনাররাও এই গরু-রোগে আক্রান্ত! আর তাই পথে পথে নানা অমোচনীয় রক্তের দাগ। এই রক্তের প্রতি, দাগের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়, এমন আচরণ কোনো দায়ীর পক্ষেই শোভা পায় না।
১০। শেষকথা হল, মিশরে আপনার রাজনৈতিক মূল্যমান খুব সামান্য। সে সময়ের ইতিহাস অন্তত তাই বলে। বাংলার রাজনীতিতেও তথৈবচ। আসলে শুধু ধর্মপাড়ার চর্চা ও অনুশীলন দিয়ে জগৎ কাবু করা যায় না। এর জন্য বিস্তৃত পরিসরের চর্চা ও অনুশীলনের প্রয়োজন। যখন আপনার বা আপনার মতো মানুষের অপরিহার্যতা তৈরি হবে অন্তত পার্থিব অর্থে, তখনই মাত্র আপনার বা সমমনাদের উপদেশ ও কথা অন্যরা মানতে বাধ্য বা উদ্বুদ্ধ হবে। সকলের শুভ বুদ্ধি ও কল্যাণের পথ উন্মুক্ত হোক- এই কামনায় আজ এখানেই ইতি।
©somewhere in net ltd.