নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দুঃখ ভরা পথচলা মোর, হাটছি দিবারাএ

রাফসান বড়ুয়া

আমি মানুষ তাই সকলেই ঠকায়

রাফসান বড়ুয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবরের নেমপ্লেট ( Name plate of graveyard)

১৮ ই জুলাই, ২০১৩ সকাল ৯:৩৭



ভ্যাপসা বাতাস। মাটির নিচে ঘুমাতে ঘুমাতে ক্লান্ত। একসময় আড়মোড় ভাঙতেই হলো। মৃত্যুর পর কতদিন গেছে নিশ্চিত হওয়া দরকার। কিন্তু হাতে ঘড়ি নেই।

কবরের ভিতর সময় গোনার কেউ নেই। এখানকার নিয়ম অন্যরকম । তবে নিয়ম কানুন পৃথিবীর চেয়ে শিথিল।

গা ঝাড়া দিয়ে বের হয়ে আসলাম এপিটাফের পাথর ঘেষে। অবাক হয়ে দেখলাম আমার গায়ে যেন টিশার্ট আর বঙ্গবাজারের সেই প্যান্টটা। প্যান্টটাতে একটু ধুলো কাদা লেগে আছে। গেট দিয়ে আজিমপুরের পাকা রাস্তা দিয়ে আগেও অনেকবার চলেছি। এই উঁচু কৃষ্ণচূড়া, শিমুল গাছের নিচে হাটতে হাটতে বাড়ি ফেরা আমার খুব প্রিয় ছিল। হাটতে হাটতে নির্জনে কবিতার ভাবনা সঞ্চিত হতো, কত গল্পের প্লট এসেছে পথ চলতে চলতে।

"অপিনিহিতি" ছদ্মনামে পত্রিকায় ছাপানো হতো। অনলাইনেও একই নামে সবাই চিনে যেত। আমার প্রতিভা যে অন্যদের চেয়ে কিঞ্চিত বেশী সেটা টের পাই যখন পত্রিকায় শত শত পাঠক চিঠি লিখতো। আর সেখানে দেশের সবচেয়ে নামী লেখকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়তো। স্বাধীনতা নিয়ে বিশাল ঐতিহাসিক গল্প লিখেছিলাম - গবেষণালব্ধ জ্ঞান আর ভাষাশৈলীতে আমার খুব সুনাম হয়েছিল। "অপিনিহিতি"র গল্প জাতীয় গল্প উৎসবে পাঠ হয়েছিল। বই হিসাবে প্রকাশ হলে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পাওয়া অসম্ভব ছিল না।

আমার গল্পগুলো বেশ বড় হতো। গুনে গুনে ১০০টা গল্প হয়েছিল। একটা বই ছাপানোর কাজও শুরু করেছিলাম। ইচ্ছে ছিল সবাইকে চমকে দিয়ে ছদ্মনামের রহস্যটা জানিয়ে দেয়া হবে,"অপিনিহিতি" মানে আমি সালাউদ্দীন ঝন্টু ছাড়া কেউ না।

কিন্তু মৃত্যুটা হয়েছিল খুব আচমকা। কর্মস্থলে ফেরার পথে বাস দুর্ঘটনা। এরকম মৃত্যুতে কার কী আসে যায়। মৃত্যুর পর আমাকে ঘিরে কোন শোকের মাতম ছিল না। পত্রিকায় সর্বমোট নিহতদের সংখ্যা ছাপানো হয়েছিল। আমার জানাজায় কোন বিখ্যাত কেউ আসেনি। পত্রিকায় নাম ছাপা হয়নি। অথচ অপিনিহিতি মারা গেলে শুনলে নিশ্চিতভাবেই এটা পেপারে হেডলাইন হতো । আমার সঙ্গে আমারই ছদ্মনামের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমি হেরে গিয়েছিলাম।

আমাকে মনে রাখার মতো আপন শুধু দু'জন - স্ত্রী মিলি আর সন্তান অর্ক । ভাইয়েরা অনেক আগেই আলাদা। বাবা মা বেঁচে নেই।

মৃতদের নাকি মন থাকেনা। কিন্তু সাহিত্যিক বলেই আমার মন খারাপের অভ্যেসটা কাটেনি।



ঝন্টু তার বাসাটা চিনতে পারলো। বড় কড়ইগাছ। গেটে নেমপ্লেট "ক্ষণিকালয়"। বহুতলা বাসা। নিচের তলার গেট দিয়ে ঝন্টু ভেতরে ঢোকে। পাহারাদার বরাবরের মতো ঝিমোচ্ছে।পায়ের শব্দেও জাগে না। দোতলায় সে থাকতো। সিড়িগুলো বড় পরিচিত। সাদাসিমেন্টের রং করা হাতল। বড় বড় ঘাটের সিড়ি। দোতলায় উঠে দেখে দরজাটা হা করে খোলা। লোকজন এত ভুলো মন? ঢাকায় দরজা খোলা থাকলে যে কোন কিছু হতে পারে। মিলি বরাবরই এমন। কতবার যে তাকে ঝন্টু তাকে মানা করেছে। কাজ হয়নি। টিভি খোলা রেখে যায়। ট্যাপের পানি ঝর ঝর করে পড়তে থাকে।

উপর থেকে স্টেরিওর শব্দ আসে। ঝন্টু বুঝতে চেষ্টা করে সে কত দিন আগে সে মারা গেছে? কত মাস না বছর? একজন মৃত মানুষের জন্য মানুষ অন্তত: সৌজন্য হলেও শোক প্রকাশ করে। মৃতের বাড়িতে এত উচ্ছাস - খুব বেমানান। উচ্চগ্রামের ডিসকো গানে সে আহত হয়।

বাসাটা তিন রুমের। রুমগুলো ছোট। বিল্ডিং এ ঢুকতে ডান পাশের ফ্ল্যাট। দরজা দিয়ে ঢুকতেই করিডোর, সেটার শেষ মাথায় রান্নাঘর। প্রথমে ডান দিকে ড্রয়িং রুম। তারপর বাচ্চার থাকার ঘর আর শেষে নিজেদের বেডরুম। ড্রইং রূমে একটা নতুন সিডি প্লেয়ার। সেখানেই গান বাজে - চড়া বীটে।

পরের রুমে তার বাচ্চা ভিডিও গেমস খেলে। ঢিসুম ঢুসুম শব্দ হয়। সে তাকে ফিরেও দেখে না। রূমে পোস্টার ঝুলছে পাওয়ার রেঞ্জারদের। ঝন্টুর একটু বিরক্তই লাগে, তার বাচ্চাকে সে বেঁচে থাকতে সে কখনও এমন আজেবাজে জিনিস ধরতে দেয়নি।

সে "বাবা বাবা" বলে ডাকে, "অর্ক অর্ক" বলে ডাকে কিন্তু বাচ্চাটা তার কথার জবাব দেয় না। চিৎকার করে রেগে যায়। বাচ্চার হাত ধরতে চায়। কিন্তু বাচ্চাটা আনমনে খেলা চালিয়ে যায়। ঝন্টুর বুঝতে বাকি থাকে না, বাচ্চাটা তাকে দেখছেনা। তার কথা শুনছে না। সে অদৃশ্য! সে মৃত্যুর পরবর্তী বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে ধাক্কা খায়। দ্বিগুণ কষ্ট নিয়ে বাচ্চাকে নিরবে আদর করে বেরিয়ে আসে।

ঝন্টু মিলিকে ভালবাসতো। মিলিও তাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল। মিলিকে দেখার জন্য ছটফট করে সে। এমন সময় মিলির দরজা খুলে যায়। সে দেখতে পায় একটা অপরিচিত মানুষ বের হয়ে আসে। মৃত মানুষের মাথায় রক্ত চড়ে যায় না। সে কড়াগলায় ডাকে, "মিলি!!"। কিন্তু মিলিও তাকে দেখে না। মানুষটা তার সামনে মিলির হাত ধরে বলে, "ওগো, তোমায় না পেলে আমি অসম্পুর্ণ রয়ে যেতাম"। ঝন্টু এগিয়ে গেলে তারা তাকে পাত্তা দেয়না । মিলি তার সামনে হি হি করে হেসে ফেলে।

শোয়ার ঘরের ভিতর মিলি এবং ঝন্টুর একটা বিয়ের ছবি ছিল। ঝন্টু দেখতে পায় সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মিলি এবং লোকটার বড় ছবি সেখানে ঝোলানো। ছবির গলায় মালা পরানো। তার মানে মিলি কি ঝন্টুর মৃত্যুর পর মিলি লোকটাকে বিয়ে করেছে?

ঝন্টুর বুকটা খান খান হয়ে যায়। নিজ স্ত্রীকে অন্যকারো পাশে কে সহ্য করতে পারে? অপমানে চোখ ভরে আসে। কিন্তু মৃত মানুষের চোখে কান্না থাকে না।

মিলি যদি বিয়েই করে তবে অন্য কোথাও উঠলো না কেন? অবশ্য মিলি কী করে জানবে মৃত হলেও স্বামীরা ফিরে এসে দেখতে পারে।

আবার এও মনে হতে থাকে, তার স্ত্রী কেন তাকে সারাজীবন মনে রাখতে যাবে? মিলির স্বামী মৃত আর জীবন তো আর থেমে থাকে না। হতে পারে মাঝখানে অনেক সময় কেটে গেছে। এখন বরং তার স্ত্রীর মঙ্গল চাওয়াই যুক্তিসঙ্গত।

ঝন্টু পা টেনে পায়ে নেমে এল রাস্তায়। তার মনে হতে লাগলো, কেন সে ছদ্মনামে লিখতে গিয়েছে। এখন তার এতসব সাহিত্যকর্ম কোনটাতেই তার নাম থাকবে না। তার স্ত্রী সন্তান কেউই তাকে মনে রাখেনি । সে আজ নামহীন মানুষ - প্রকৃতপক্ষেই একজন অদৃশ্য মানুষ।

৩.

ঝন্টু কবরে ঘুমিয়ে পড়তে যাবে । অনেক মনোকষ্ট। কী লাভ এমন পৃথিবী দেখতে চাওয়া যেখানে তার একটি বিন্দু স্মৃতি অবশিষ্ট নেই। মানুষ কত লোকের নাম বংশ পরম্পরায় মনে রাখে, তার কিছুই থাকবেনা।

কবরের কিছু দুরে গোর খোদকদের জন্য একটা লম্বা লোহার বেঞ্চি পাতা ছিল। উপরে রেইনট্রি গাছ, সান্ধ্যপাখীরা বাড়ি ফিরে কিচির মিচির করছে। সন্ধা নেমে আসছে। সে গিয়ে সেখানে বসে সাতপাঁচ ভাবছে এমন সময় একটা লোক তাকে দেখে কাছে ডাকলো।

ঝাকড়া চুল, মুখ ভর্তি উস্কুখুস্কু দাড়িতে যেন বনমানুষ। বেশী লম্বা বলে কুঁজো লাগছে। লোকটা তার মতই আরেক মৃত। ঝন্টুকে শুধু মৃতরাই দেখে আর লোকটাও তার ডাকের জবাবও শুনতে পায়। লোকটা কথা বলতে বলতে তার পাশে ঝপ করে বসে পড়ে।

:"ভাই,কেমন চলছে? বাড়ি থেকে ফিরছেন মনে হয়"

:"জ্বী, আপনি?", ঝন্টু আলাপে যোগ দেয়।

:"এই তো আমিও অনেক অনেক বছর এখানে। আপনি সম্ভবত: তেমন একটা বের হন না"

তারপর ঝন্টুর মুখে চেয়ে বলতে থাকে,

"আপনাকে দেখে বিধ্বস্ত লাগছে। কোন সমস্যা নাতো?"

মৃতদের হারানোর কিছু নেই। তাই তারা মিথ্যা বলে না। ঝন্টু খুব আন্তরিক হয়ে বলেই ফেলে তার সমস্যাটা

:"আমি সালাউদ্দীন ঝন্টু, দেশের বিখ্যাত লেখক ও সাহিত্যিক। প্রায় ১০০ টির মত বিশাল গল্প লিখেছি। হয়তো সংখ্যাটা খুব বড় না, কিন্তু এক একটি গল্প অনেক পরিশ্রমে গড়া। আমার গল্প পত্রিকায় ছাপা হলে পত্রিকার কাটতি বেড়ে যায়। আমাকে সবাই বলতো মানবিক সম্পর্কের গল্পকার। ভাইবোন, বাবা মা, বাপ-মেয়ে, ইত্যাদি মানবিক সম্পর্ক নিয়ে আমার গদ্য হাজার হাজার পাঠককে চোখের পানি ঝরিয়েছে।"

একটু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঝন্টু বলতে থাকে,

"মহা পরিতাপের বিষয়, এত বিশাল পরিশ্রমী কাজের সব "অপিনিহিতি" ছদ্মনামে। যখনই পরিকল্পনা করছি যে বই বের করবো, আর মোড়ক উন্মোচনে এই রহস্যটা প্রকাশ করে সাহিত্যমহলে আলোড়ন তুলবো, ঠিক তখনই আচমকা মৃত্যু এসে বুকে টেনে নিল। "

তারপর আবার বললো,

"এখন "অপিনিহিতি" ছদ্মনাম যে সালাউদ্দীন ঝন্টু" সেটা প্রচার করার কোন উপায় জানেন?"

:"হুম", লোকটা চিন্তা করে বললো,"কথা শুনে বোঝা যায় আপনি নতুন এখানে। আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে মৃত হলে বাস্তব পৃথিবীর কোন কিছু বদলে ফেলার ক্ষমতা কারো থাকে না"।

তারপর একটু আশা দিতে শুরু করলো,

"..তবে আপনার কৃতিত্ব নিয়ে মৃতদের কাছে গল্প করতে পারেন । গল্প করতে ভালও লাগবে। কারণ মৃত আত্মাদের নিজেদের মধ্যে খুব মিল । জীবিতদের ভাষা অনেক, নানান কালচার, পোষাক আর বৈষম্য নানান রকম । আর এখানে সবাই সবার কথা বুঝতে পারে, যেখানে ইচ্ছে সেখানে যেতে পারে, যে কারো বন্ধু হতে পারে যখন তখন। মৃতদের জায়গাটা দারুন"।

এসব সান্ত্বনায় ঝন্টুকে অপরিবর্তিত দেখে উস্কুখুস্কু লোকটা বললো, "আগামীকাল ভোরে চলুন মৃতদের রাজ্যগুলো বেড়াতে যাই - মনটা ভাল লাগবে। আজই যেতাম, তবে অন্য জায়গায় যেতে হচ্ছে। বলে ঝাকড়া লোকটা তাড়াহুড়ো করে চলে গেল।

ঝন্টু সমাধীর অন্ধকারে শুয়ে থেকে বার বার তার বোকামীর কথা মনে করছিল। তার ছদ্মনামের খ্যাতিটা ভুলতে পারছিল না। তার পুত্রের পরিবর্তন নিয়ে কিছু করার নেই কিন্তু তার পিতার জন্য দেয়ালে তার অন্তত: একটি ছবি প্রত্যাশিত ছিল। মিলির কথা ভাবতে গিয়ে সে কবরের ঝুরঝুরে মাটির দিকে চেয়ে থাকলো।

৪.

পরদিন ভোরে সেই ঝাকড়া চুলের লোকটা তাকে নিয়ে একটা দারুণ নৈসর্গিক পরিবেশে বেড়াতে এলো। ফুর ফুরে বাতাসে দারুণ লাগছিল। জায়গাটা পৃথিবীর মানচিত্রে কোথায় তা তার মাথায় ঢুকছিল না।

ঢোকার কারণ নেই কারণ ঝন্টু হাইস্কুলে ভুগোলে কাঁচা ছিল। সে ফেল করতে করতে বেঁচে গেছে। উস্কুখুস্কু লোকটা একটা মরুভূমি পার হয়ে সুউচ্চ পর্বতের উপর নিয়ে এল। দুর দিগন্তের পাহাড়গুলো সবুজ পাইন গাছে ছেয়ে আছে। আর পাহাড়ের চারদিকে গভীর। পাহাড়টা নিশ্চিতভাবেই হিমালয়ের চেয়ে উঁচু। নিচে কিছুই দেখা যায় না। উপরে ঝক ঝকে রোদ। ঝন্টু পশ্চিম মুখী হয়ে সাত পাঁচ ভাবছিল।

ঝাকড়া মাথার লোকটা বললো, এদিনে নয়, পুব দিকে এসে দেখুন। লোকটা তাকে দেখার জন্য তার হাতে একটা বড় দুরবীন তুলে দিল।

ঝন্টু অবাক হয়ে দেখলো এক অবিশ্বাস্য বিরাট টাওয়ারের মতো অট্টালিকা। কত তলা? ১০০০, ৫০০০? ১০,০০০ - আরও বেশী। অট্টালিকাটার শুরু পাহাড়ের একদম গভীরে। তল দেখা যায় না। আর প্রতিটি তলা বিশাল সুবিস্তৃত। একপাশ থাকে অন্যপাশে দেখতে মাথা ঘুরে যায়। আশ্চর্য হয়ে দেখলো কোন ইটকাঠ নয়, মানুষের উপর মানুষ দাঁড়িয়ে। ঝন্টু মুখ ফুটে উচ্ছাস নিয়ে বললো,

:"কী অবাক কান্ড! এত বড় একটা স্থাপত্যকলা পৃথিবীতে কোথাও কেউ নাম শুনেনি, জানেনি।"

লোকটা ঠান্ডা গলায় বললো, দেখুন তো একটু নিচের ছাদে ঐ লোকটাকে চিনতে পারেন কিনা?

ঝন্টু আইপিসে দেখে অনেক মানুষের ভীড়ে একজন বেশ পরিচিত। একটা লোক ঘষা কাঁচ নিয়ে আকাশ দেখছে। মুখে অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি তবুও চিনতে অসুবিধে হয়না। সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,

"গ্যালিলিও!!..এখানে যে। আরে তার উপর তলায় আরেকজন চেনা লাগে, আপেল হাতে, সম্ভবত: নিউটন"।

মানুষটা বেশ মজা পায়,

"বাহ আপনি দেখছি ভালই মনে রেখেছেন। স্কুলে নিশ্চয়ই ভালই ফল করতেন। কিন্তু অসংখ্যা লোক একই ছাদে - পাশে চেয়ে দেখুন গ্যালিলিওকে কাঁচ ঘষে দিচ্ছে একজন অনেক পরিশ্রম করে। আরও দেখুন একজন ঢালাই লোহা দিয়ে সুদক্ষভাবে চোঙ বানিয়ে দিচ্ছে ..গ্যালিলিওকে। আরও দেখুন গ্যালিলিওর মা বসে আছে, তার ছেলে না খেলে অসুস্থ হবে, এই অভ্যেসটা মৃত্যুর পরও তার কাটে নি। তারপর গ্যালিলিওকে নিয়ে লিখছে লেখক উপর তলায়। এতসব না হলে গ্যালিলিওর কাহিনী জানতেন কি করে?

গ্যালিলিওকে ঘিরে তার সহযোগী, প্রচারক এবং খাদ্য যোগানদানকারী যে মানুষগুলো তাদের কাউকে কি চিনতে পারেন?"

ঝন্টু মাথা নাড়ে, "না"।

এত লোক গিজ গিজ করেছে - অথছ তাদের ভেতর সে পরিচিত পায়না কাউকেই।

একটা সেতু চোখে পড়লো। এটা দিয়ে লোকজন টাওয়ার থেকে পাহাড়ে আসা যাওয়া করে ।

:"দেখুন এক বন্ধু সেতু বেয়ে এদিকে আসছে"।

ঝন্টু দেখে আগন্তুক লোকটার একটি চোখ অন্ধ, হাতে লাঠি। মাথায় চুল কম। চেহারা গম্ভীর। উনি কি দার্শনিক? ঝন্টু এবার হাত বাড়িয়ে বললো , "আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে খুশী হলাম"। লোকটা তাকে অবাক করে বললো, "আপনি বাংলা সাহিত্যের ঝন্টু, ঠিক বলিনি! আপনি বাংলা ভাষার অঞ্চলের গৌরব। আমাদের খুব গর্ব হয় আপনার লেখা নিয়ে, যদিও আমি বাংলা ভাষার লোক না"।

তার পিছন পিছন বাংলা ভাষার অঞ্চলের একজন এসেছিল। ঝন্টু ভেবেছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হবে। কিন্তু না, সে তাকে চেনে না। বাঙালী লোকটা এসে বললো,

:"এখানে স্বাগতম, বাঙালী কাউকে দেখে খুব ভাললাগলো।আমি আপনার মতই। আমার নিজেরও কোন বই ছাপা হয়নি। কিন্তু খুব সময় নিয়ে কবিতা লিখতাম বেঁচে থাকতে।"

লোকটা তার নাম বলতে দেখে মনে হলো নিজের গুনগান করবে। ঝন্টু কৌতুহলে বললো,

:"তা আপনি কি অবদান রেখেছেন"?

:"হাটটিমাটিমটিম" নামে একটা ছড়া আমি আমার দৌহিত্রর জন্য রচনা করি। আজ ঘরে ঘরে সবাই সেই ছড়াটা জানে। শত বছর ধরে এই একটি ছড়া সব শিশুদের মন কেড়ে নেয়। আশ্চর্য হয়ে বললাম, "তা, আপনি কেন আপনার নামটা বলে দিলেন না?"।

এমন সময় আরও কয়েকজন এসে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছে।লোকটা বললো, "হা হা হা। এতক্ষণ যে অন্ধ লোকটির সঙ্গে কথা বললেন উনি কে জানেন? উনি ৪০০০ বছর আগে ভাষার লিখিত রূপ, মানে অক্ষর আবিষ্কার করেছিলেন। তারও কিন্তু তারও কোন নাম নেই। সেই অক্ষর আবিস্কর্তার নাম যদি ইতিহাসে না থাকলে চলে আমার তো নাম বলতে লজ্জাই হবেই "।

অক্ষর ওয়ালা তখন মিষ্টি হেসে বললেন, "ভাই, এত বড় একটা সৌধ বানানোর কাজ আমাদের সবার। আমি যে প্যাপিরাসের নামের নলখাগড়ার কাগজে অক্ষর লিখেছিলাম, তার উদ্ভাবক কে অনেক খুজেই পাইনি"?

আমি চুপ করে তখন শুনছিলাম। "টাওয়ারের ওপরে বালু দিয়ে আঁক কষছিল একজন, তাকে দেখিয়ে অক্ষরওয়ালা বললো, ঐ দেখুন আরেকজন, লোকটি কিন্তু আপনাদের দেশী, যদিও দেশ তৈরী হবার আগে উনার জন্ম। লোকটা মারা গেছে ৪০০ খ্রীষ্টপুর্বে। দারুন রসিক লোক। তাকেও মনে হয়না কেউ চেনে, সে বন্ধুদের হিসাবের সুবিধার জন্য একটা চিহ্ন ব্যবহার করে নাম শূণ্য। তার এত ব্যবহার, কিন্তু কোন বইতে তার নাম নেই। এই শূণ্য থাকায় আজকে শত শত গনিতবিদদের কাজ হচ্ছে, ব্যাংক কলকারখানা হিসাব রাখছে"।

এই টাওয়ারটা মৌমাছির চাকের মতো - উপরের তলার লোকগুলো জটিলতর কাজ করছে কিন্তু নিচের তলার অবদান ছাড়া তারা অচল"।

এবার উস্কুখুস্কু লোকটা বললো, "অনেকের নাম থাকে ইতিহাসে কিন্তু ভুল থাকে। যেমন শেক্সপিয়ার বলে কাউকে পাবেন না। ঐটা কাল্পণিক। ঝন্টু বললো "মানে?"। সেই লোক বললো, "তাকিয়ে দেখুন কত শত ইংরেজ সাহিত্যিক বই লিখছে। এই লেখকদের পরিচিয় কারো জানা নেই । তাদের কেউ একজন শেক্সপিয়ার নামে লিখেছিল অথবা অনেকে মিলে। কিন্তু সেটা নিয়ে মৃতদের জগতে কারও অভিমান নেই"।

তাকে অভিনন্দন জানাতে সেতু বেয়ে উঠে এল অনেক নাম না জানা নারী পুরুষ।

একেবারে নিচ তলা থেকে একজন ঝন্টুকে শুভেচ্ছা জানাতে এল। বললো, "শুনেছি আপনি অল্প কিছুদিন আগে এসেছেন। কেমন আছে আপনার দেশের লোকজন?"।

আমার চোখে কৌতুহল দেখে উস্কুখুস্কু চুলের লোকটা বললো, " বাস, গাড়ি রিক্সা, রেলে..এরকম যানবাহনে খুব অভ্যস্ত সবাই, চাকা ছাড়া পৃথিবী অচল। এই ভদ্রলোক চাকার আবিষ্কারক অথচ তার নামও ইতিহাসে অনুপস্থিত"।

ঝন্টু দেখতে পায় এভাবে অনেক লোক নাম পরিচয় ছাড়া কাজ করে যাচ্ছে। কেউ কেউ নাম বলতে অনিচ্ছুক। তার নিজের কষ্টটা কেটে গিয়ে লজ্জা লাগতে শুরু করেছিল। সে বাঙালীদের অংশে একটা দুরবীন দিয়ে দেখতে থাকে। কত শত সাহিত্যিক, কবি,জ্যোতির্বিজ্ঞানী, চাষী, বাউল, সাধক, গায়কগায়িকা অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। লালন, হাসন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ছাড়া অন্যদের নাম তার জানা নেই। দুরবীনে দেখতে পায় ভারত, আরব,গ্রীস,ইউরোপ..সর্বত্র শত শত লোক অবিরত কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিমহুর্তে সেই কাজের ফসল হিসাবে থেকে টাওয়ারটা বড় আর সমৃদ্ধ হচ্ছে।

সবাই নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে ব্যস্ত। এভাবে সারাদিনে অনেক আবিস্কারক,লেখক, দার্শনিক, কবির সঙ্গে তার পরিচয় । রোদ হেলে পড়লে সবাইকে বিদায় জানিয়ে ঝন্টু ফিরে আসছিল। আর আসার সময় প্রত্যেকে সেই উস্কুখুস্কু লোকটাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল।

চাকা আবিস্কারক ঝন্টুর দিকে তাকিয়ে বললো, "আমরা এত কিছু আবিষ্কার করেছি, রচনা করেছি অথচ কোনটাই সম্ভব হতোনা উনি যদি আগুন আবিষ্কার না করতেন"।

ঝন্টু চমকে উঠল। সে ভাবলো, আরে, এতবার সবার পরিচয় জেনেছেন অথচ উস্কুখুস্কু লোকটার পরিচয়টাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। সে দেখলো ঝাঁকড়া চুলো লোকটা মাথা নিচু করে বিনয়াবনত। যেন তার পরিচয়টা না শোনালেই তিনি খুশী হতেন।

ঝন্টু বিস্ময়কে গলায় ধরে রেখে একজনকে জিজ্ঞেস করলো, "তার মানে উনি কি সেই প্রমিথিউস? যে বিধাতার কাছ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিল, তারপর সেই আগুন মানুষকে দিয়েছিল?"।

একজন মহিলা বিখ্যাত নামহীন গ্রীক কবি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, "না, তা কেন? প্রমিথিউস তো নিছক কল্পনা। মানুষকে কোন বিধাতাই হাতে আগুন তুলে দেয়নি। ইতিহাসে হারিয়ে গেছে উনার নাম। প্রমিথিউসের কল্পিত চেহারাটাই আগুনের কৃতিত্ব পেয়েছে। উনার নামটা কেউই জানতে পারেনি"।

৫.

সমাধীতে ফিরে আসার সময় আগুনের আবিষ্কর্তা ঝন্টুকে এগিয়ে দিলেন। ঝন্টুকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার অসম্ভব সুন্দর গল্পের জন্য ধন্যবাদ জানালেন। বললেন,"এই সুবিশাল টাওয়ারটা মানবজাতির গর্ব। এর তারও কোন নাম নেই। আমার আগুনে স্ফুলিংগ হয়তো তার শুরু কিন্তু সেই আগুনকে বাঁচিয়ে রেখেছে হাজার লক্ষ তলার অসংখ্য নাম জানা না জানা মানুষেরা। এজন্য আমরা সবাই টাওয়ারটাকে ডাকি সভ্যতা"। এরপর আগুনের আবিষ্কারক উঠে দাঁড়ায়, "ঝন্টু, আজকে আর নয়, অন্যত্র যেতে হবে"। ঝন্টু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো।

ততক্ষণে সমাধীর পাশে আরো কয়েকজন মৃত লোক এসে বসেছে । তাদের একজন বললো, "এই আগুনগুরু মৃতদের মন ভাল করতে এত ব্যস্ত থাকেন! অথচ আগুন আবিষ্কার করার সময় সেই আদিম জঙ্গলে সঞ্চিত শুকনো কাঠের স্তুপে ভুল করে আগুন ধরে যায়, আর তার গোত্রের সবাইকে সে চিরতরে হারিয়ে ফেলে। তার চোখের সামনে পড়েছিল বিভৎস ভাবে দগ্ধ জনক এবং জননী"







Collected and renamed

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.