নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

...

পুলহ

পুলহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ "আবার কিম্ভূতকিমাকার"

১৬ ই মে, ২০২১ দুপুর ১:১৮

মেয়েটাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম কার্জন হলের সামনে। আমাকে দেখা মাত্র নীল চুড়িভর্তি হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।

একটু অবাকই হয়েছিলাম। মেয়েটাকে আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তারপরো দৃষ্টি আকর্ষণ যেহেতু করেছে, কাছে গিয়ে শুনে আসা উচিত। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে রাস্তা পার হলাম। একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম সাথে বন্ধুবান্ধব কেউ নেই ভেবে। ওরা থাকলে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে দুষ্টামি শুরু করতো......

ধবধবে সাদা কামিজের ওপর গাঢ় নীল ওড়না পরে ছিলো মেয়েটা। জামার গায়ে বোধহয় হালকা রুপালি সুতোর কাজ...... সব মিলে তাঁকে আকাশ আকাশ লাগছিলো সেদিন। নাকি সমুদ্র ! ঠিক জানি না। সমুদ্রই হবে বোধহয়। হাতের নীল চুড়িগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতই দোল খাচ্ছিলো...... প্রথম পরিচয়েই একটা মেয়ের দিকে এরকম অভদ্রের মত তাকিয়ে থাকা যায় না জেনেও আমি নজর সরিয়ে নিতে পারলাম না। মেয়েটার চোখ কি অদ্ভুত ! সম্ভবত ওড়না আর চুড়ির সাথে মিল করে নীল রঙের লেন্স পড়েছে। সে অবশ্য আমার বেকায়দা অবস্থা দেখে প্রশ্রয়ের হাসি হাসলো। তারপর পাথুরে ঝিরির মত কলকল শব্দ তুলে জিজ্ঞেস করেছিলো-

"আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আমি একটা গানের কথা ভুলে গেছি, একটু মনে করিয়ে দেবেন আমাকে?"

আশ্চর্য তো! পাগল-টাগল নাকি! চেনা নেই, জানা নেই একটা ছেলের কাছে কি সব বকছে ! আমি বিভ্রান্তের মত উনাকে বললাম- "কিছু মনে করবেন না, আমি কি আপনাকে চিনি?"

"কেন, না চিনলে কি উপকার করা যায় না?"- সে খুব সুন্দর করে হাসলো।

"গানের কথা জানতে হলে গুগলে সার্চ দিলেই তো পারেন......"

"আমি স্মার্টফোন ব্যবহার করি না যে !"

ভালো পাগলের পাল্লায় পড়লাম তো! দেখে তো সুস্থই মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। ভদ্রঘরের। কিন্তু কথাবার্তা এমন অগোছালো কেন?!

"আচ্ছা বলেন, কোন গানের লিরিক জানতে চান?"

মেয়েটা বড় করে দম নিলো, তারপর লাজুক লাজুক চোখে মাথাটাকে হালকা নাড়িয়ে গাইতে শুরু করলো-

"আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম......"


আমি চমকে উঠলাম, এটা খুব প্রিয় একটা গান আমার। আর মেয়েটা নিচু গলায় এতো সুন্দর করে গাইছিলো ! মুহূর্তের জন্য আমার কাছে মনে হলো- এই মেয়ের কন্ঠে শুধু গান নয়, বাঁশির সুর কিংবা হাওয়াই গিটারের মেলোডি সব একাকার হয়ে মিশে আছে।

আমি উনাকে পরের লাইন জানিয়ে দেই। সে সাগরের মত পূর্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জোয়ারের গাঢ় উচ্ছ্বাসে বললো- "ধন্যবাদ!"
***
ইদানিং ক্লাস শেষ হবার পর আর আড্ডাবাজি করতে ইচ্ছা করে না। বাসায় পারিবারিক একটা সমস্যা চলছে। আমার ছোটবোনটা গত কয়েকদিন আগে হারিয়ে গেছে বাসা থেকে। আজ নিয়ে পাঁচ দিন হয়ে গেলো কোনো খোঁজ পাচ্ছি না ওর। তাছাড়া হেলেনের- (আমার ছোটবোনের নাম)- বয়সও খুব একটা বেশি না। এই মার্চে এগারোতে পড়বে। তবে সব থেকে আশংকার কথা- আমার ছোটবোনটা মানসিক প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না। এ জন্যই ওকে নিয়ে আমাদের এতো দুশ্চিন্তা। এসব কারণেই বন্ধু-বান্ধবের স্ফুর্তি, হৈ চৈ ভালো লাগে না আজকাল। ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র বাসায় চলে আসি, আগের মত ক্যাম্পাসে আর থাকা হয় না......

বাসায় ফিরে আজও শুনলাম হেলেনের নাকি কোন খবর পাওয়া যায় নি। ইশ, মনটাই খারাপ হয়ে গেলো কথাটা শুনে! বেচারি না জানি কোথায় কোথায় ঘুরছে ! এখনো খারাপ কোনো লোকের পাল্লায় পড়ে না থাকলে সেটা আমাদের সৌভাগ্যই বলতে হবে। কিন্তু আমাদেরই বা আর কি করার আছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া থেকে শুরু করে জিডি করা, এলাকাজুড়ে মাইকিং এসবই করা হয়ে গিয়েছে। আমি আর বাবা মিলে হাসপাতালের মর্গে মর্গেও ঘুরেছি। কিন্তু কোন খোঁজ পাই নি হেলেনের। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আরেকবার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখবো নাকি? ঢাকার আশেপাশে আর কোন হাসপাতাল কি বাকি আছে?

মা ঘরদুয়ার সব অন্ধকার করে শুয়েছিলো। আমি আর উনাকে না বিরক্ত না করে নিজের ঘরের দিকে রওনা হলাম।
***
পরদিনও ক্লাশ শেষ হবার পর বাসায় ফেরার পথে আমি মেয়েটাকে দেখলাম- ঠিক একই জায়গায়, একই রকমভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আজ অবশ্য শাড়ি পরে এসেছে। ইদানিং ঐ রাস্তাটায় মেট্রোরেলের কাজ চলছে পুরোদমে। গেরুয়া ধুলোধোঁয়ায় জায়গাটা প্রায় সময়েই আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এতোকিছুর মাঝেও মেয়েটাকে আশ্চর্য রকম অমলিন লাগছিলো। আমি হাসিমুখে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম......

"ভালো আছেন? আজ কোন গানের লিরিক ভুলেছেন?"

"ওহ আপনি। ভালোই হয়েছে আপনি এসেছেন ! আজও তাহলে একটা উপকার করে যান......"

আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা তাঁর খোপার রজনীগন্ধার মালাটা খুলে দিলো।
"ফুলে আমার এলার্জি হয়। কিন্তু আবার ফেলে দিতেও মায়া লাগছে। আপনি এটাকে একটু নিয়ে যাবেন সাথে করে ! বাসায় যত্ন করে রাখবেন ......"

এই মেয়ের কিম্ভুতকিমাকার আচরণে অবাক হওয়াও ভুলে যাচ্ছি আমি। অপ্রস্তুতভাবে দু'হাতের আজলা ভরে তাঁর দেয়া মালাটা নিলাম। মেয়েটা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো- "বৃষ্টি আসবে বোধহয়। আজ যাই, পরে কথা হবে......"

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে রিকশায় উঠে টিএসসির দিকে চলে গেলো। মনটা একটু খারাপই হলো আমার। একদিনের পরিচয়ে কারো ওপর কোনো অধিকার জন্মায় না, কিন্তু তাঁর কিম্ভুতকিমাকার আচরণ দিয়ে সে বোধহয় অল্প সময়েই একটা দাবী তৈরি করে ফেলেছিলো। চেতনে না হলেও অবচেতনে। এ কারণেই বোধহয় তাঁকে টিএসসির দিকে চলে যেতে দেখে কেমন একটা অভিমান এসে জড়ো হলো। অদ্ভুত মেয়েটা আরেকটু গল্প করলে কি এমন হতো !

একবার মনে হচ্ছিলো- দু'হাতের মুঠোয় থাকা রজনীগন্ধার মালাটাকে রাস্তায় ফেলে দেই। তারপরই আবার তাঁর সমুদ্রের মত চোখ, বাতাসের শিসের মত কন্ঠ আর পবিত্র হাসিটুকু স্মরণে আসাতে আমার অভিমান বাষ্প হয়ে উড়ে গেছিলো যদিও। এটা ঠিক- এমন আজব মেয়ে কখনো দেখি নি জীবনে !

ততক্ষণে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। আমি দরদাম না করেই সামনের একটা রিকসায় উঠে বসলাম। রিকশা চলতে শুরু করার পর হাতের মুঠ খুলে অবাক হয়ে দেখি- সেখানে রজনীগন্ধার চিহ্ন মাত্র নেই। বরং রজনীগন্ধার মালা পালটে গেছে একজোড়া ক্রিমরঙা গোলাপে !

বর্ষা নেমেছে মুষলধারে। সামনে থেকে রিকশাওয়ালা মামা চিৎকার করছে পর্দা লাগবে নাকি, অথচ আমার কোনো বিকার নেই। আমি হতভম্ব হয়ে হাতের মুঠোয় গোলাপ নিয়ে বসে আছি। পিচঢালা পথ থেকে আসা সোদা গন্ধ, ফুটপাথে দাঁড়ানো গাছের গা থেকে আসা ভেজা কাঠের ঘ্রাণ আর গোলাপের সুবাস মিলেমিশে কেমন একটা অদ্ভুত আবাহের জন্ম দিয়েছে ততক্ষণে। আমার কাছে মনে হলো- এই কিম্ভুতকিমাকার মেয়েটা সাধারণ কোনো মেয়ে নয়। জাদুর শহরের কোনো বিস্মৃত জাদুকর সে। কোনো এক দূর রূপকথার গল্প থেকে উঠে এসেছে......

কেন জানি আমার একটু অস্থির অস্থির লাগতে থাকে !
***
আজো হেলেনের কোনো খবর পাওয়া যায় নি। ইদানিং আর বাসায় থাকতে ভালো লাগে না। আম্মু সারাক্ষণই কান্নাকাটি করে। আব্বুও অফিস থেকে ফিরে গুম হয়ে বসে থাকে নিজের ঘরে। আমি ফেসবুক স্ক্রল করি, বইখাতা নড়াচড়া করি কিংবা লাইট নিভিয়ে শুয়ে থাকি চুপচাপ- কোনোকিছুতেই মন বসাতে পারি না। হেলেনের মুখটা শুধু ঘুরে ফিরে মনে হয় ! গুমোট গুমোট লাগে আমার......

এমন দমবন্ধ ভাব কাটাতেই সেদিন সন্ধ্যার পর একটু হাঁটতে বের হয়েছিলাম। হাতিরঝিলের ঐদিকে এ সময়টাতে লাইট এন্ড সাউন্ড শো হয়। বেশ ভালো লাগে দেখতে। ওখানেই সেদিন আবারো কিম্ভূতকিমাকারকে দেখলাম। একগাদা উৎসুক জনতার মধ্যমণি হয়ে ভায়োলিন বাজাচ্ছিলো। পরনে তাঁর পশ্চিমা দেশের আদলে কালো একটা ওয়েস্ট-কোট, ভেতরে সবুজ এক টপস। ফুলহাতা শার্টের কবজির কাছটাতে ছড়ানো কুচি। হঠাৎ দেখে মনে হয় অসংখ্য সবুজ প্রজাপতি বুঝি বসে আছে তাঁর হাতের কাছটায়। মেয়েটা কি এরকম রাস্তায় রাস্তায় ভায়োলিন বাজিয়ে বেড়ায় নাকি! আশ্চর্য তো !

আমি অন্য সবার মতই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওর ভায়োলিন বাজানো শুনছিলাম। খুব পরিচিত লাগছিলো সুরটা, কিন্তু ঠিক ধরতে পারছিলাম না। ভায়োলিন বাজানো শেষ হবার পর কিম্ভূতকিমাকার আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আমি দেখি সে জামার সাথে ম্যচিং করে চোখের লেন্স পালটে ফেলেছে। সবুজ চোখে ওকে দেখতে লাগছে জলকন্যাদের মত......

অন্যরা সরে যাবার পর সে আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। কোমল গলায় বললো- "হেলেনকে পান নি এখনো !"

মানুষের অবাক হওয়ারও বোধহয় একটা সীমা আছে। আমি অনেক আগেই সে সীমা অতিক্রম করে এসেছি দেখে কিম্ভূতকিমাকারের কথায় আর অবাক হলাম না। শুধু 'না' বোধক মাথা নাড়লাম। মেয়েটা হাসিমুখেই শান্ত গলায় বললো- "যান, বাসায় চলে যান ! অনেক রাত হয়েছে !"
"আপনি যাবেন না?"
"হু"
"আজ নিয়ে তিনদিন আপনার সাথে দেখা হলো, কিন্তু এখনো আপনার পরিচয় জানি না......"
"আমি জলকন্যা। অনেকে মারমেইডও বলে ! পৃথিবীর নানা দেশের নানা সংস্কৃতিতে আমাদের এক এক নামে ডাকা হয় আসলে !"
আমি নীচু গলায় বললাম- "আপনি কি আমার সাথে ফাজলামি করছেন ! প্লিজ করবেন না। এই মুহূর্তে দুষ্টামি করার মত মানসিক অবস্থা নেই আমার......" তারপর একটু চুপ থেকে আবার বললাম- "এম্নিতেই পারিবারিক নানা ঝামেলা, নানা সমস্যায় খুব এলোমেলা হয়ে আছি......"

এবারও কিম্ভুতকিমাকার কিছু বললো না। আগের মতই হালকা করে, অথচ আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলো একটু।
***
পরদিন অবশ্য শুক্রবার ছিলো। ভার্সিটি বন্ধ। তবুও আমি কিম্ভূতকিমাকারের সাথে দেখা করার জন্য ক্যাম্পাসে গেলাম। মনে একটা ক্ষীণ আশা- আজো বুঝি তাঁকে দেখতে পাওয়া যাবে।

আমার অনুমান ভুল প্রমান হয়েছিলো যদিও। অনেকক্ষণ কার্জন হলের ঐ পাশটায় দাঁড়িয়ে রইলাম একা একা। কেউ এলো না। বন্ধের দিন দেখে ভার্সিটি এলাকাও খালি । প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর ক্লান্ত পায়ে বাড়ির পথ ধরেছিলাম, তখনি আসলে প্রথম সন্দেহটা হলো আমার। মনে হলো- কিম্ভুতকিমাকার বলতে বোধহয় বাস্তবে কেউ নেই। পুরোটাই আসলে আমার কল্পনা......

অবশ্য ভিন্ন সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য বাসায়। ফেরার পর দেখলাম- সেদিনের গোলাপদু'টো যেখানে রেখেছি, টেবিলে তার পাশেই একটা ছোট্ট কাগজ পড়ে আছে। কাগজের রংটাও গোলাপের পাপড়ির মত। সেখানে সবুজ কালিতে লেখা-

"আজ সন্ধ্যা সাতটায়। উত্তরা সাত নাম্বার সেক্টর, কাবাব ফ্যাক্টরির সামনে থাকবো আমি।
চলে আসবেন প্লিজ।
ইতি,
কিম্ভূতকিমাকার"
***
এম্নিতেই মনটন ভীষণ খারাপ। কোনোভাবেই হেলেনের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর সন্ধ্যায় অদ্ভুত মেয়েটার সাথে দেখা করতে গিয়ে একটা ধোঁকা খেলাম। সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত আমি কাবাব ফ্যাক্টরিতে বসে ছিলাম। মাঝে মাঝে বাইরে এসে আশেপাশে, রাস্তায় উঁকি মেরে গিয়েছি। কিন্তু কাউকে পাই নি। কিম্ভূতকিমাকার কেউ আসে নি আমার সাথে দেখা করতে......

আমি বিষণ্ণ এবং কিছুটা অপমানিত অবস্থায় উত্তরা লেকের পাড় ধরে ধরে হাটছিলাম। লেক ছুঁয়ে আসা শহুরে ভেজা বাতাস স্ট্রিট লাইটের সফেদ আলো খেয়ে ওম ওম হয়ে আছে। কিম্ভূতকিমাকারের ধোঁকা নাকি এই উদাসী বাতাস আমাকে আনমনা করে তুলেছিলো- ঠিক জানি না, তবে হঠাৎই কার এক আচমকা আলিঙ্গনে আমার ঘোর ভাঙ্গলো। আমি দেখলাম- হেলেন যেনো কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। কোনো শব্দ না করে কাঁদছিলো অবিরাম।

আমি হতবাক হয়ে আমার হারিয়ে যাওয়া, প্রতিবন্ধী বোনটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর হাটু ভেঙ্গে বসে আদরের পর আদরে ভরিয়ে তুললাম ওর সারা মুখখানা। হেলেনের পেছন পেছন একজন মধ্যবয়স্ক, লুঙ্গিপরা লোক এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ যাবতই। এতোক্ষণ তাঁকে লক্ষ্য করি নি। সংবিত ফিরে পাবার পর খেয়াল করলাম। উনিই পুরো বৃত্তান্ত জানালেন আমাকে......

ভদ্রলোকের নাম- হেলাল মিয়া। তাঁর একটা ভ্রাম্যমান ফুচকার দোকান আছে। পাঁচ/ছয়দিন আগে তিনি নাকি তাঁর ফুচকা কার্ট নিয়ে এয়ারপোর্ট স্টেশনের বাইরে বিক্রিবাটা করছিলেন। ওখান থেকেই হেলেনকে আবিষ্কার করেন। হেলেন কিভাবে কিভাবে এয়ারপোর্ট চলে গেলো- সেটা অবশ্য ভদ্রলোকের অজানা। এতোদিন আমার ছোটবোন দক্ষিণখান বস্তিতে হেলাল মিয়ার পরিবারের সাথেই ছিলো।

"আমরা তো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম......"

আমার এই কথা শুনে হেলাল মিয়া হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো- "আমরা গরীব মানুষ ভাইজান। পেপার পত্রিকার কাগজ দিয়া বাড়িতে চুলা জ্বালাই। খবরের চেয়ে ভাত আমগো কাছে জরুরি বেশি। এছাড়া পড়ালেহাও তো জানি না......কেমনে বুঝমু আপনেরা 'এডবেটাইজ' দিছেন !"

আমি কাঁদতে কাঁদতে বহু ব্যবহারে জীর্ণ এক সংলাপের পুনরাবৃত্তি ঘটালাম। হেলাল সাহেবকে বললাম- "আপনার এ উপকারের ঋণ আমরা কোনোদিনও শোধ করতে পারবো না ভাই !"

দুই প্লেট ফুচকা খেয়ে হেলাল মিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম দু'জনে। সিএনজিতে হেলেনকে শক্ত করে জড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার কাছে মনে হলো- কিম্ভূতকিমাকার বোধহয় জানতো- আজ কাবাব ফ্যাক্টরির উলটো দিকে, উত্তরা লেকের এ জায়গাটাতে হেলাল মিয়া আমার বোনকে সাথে নিয়ে ফুচকা বেচতে আসবে। এ জন্যই টেবিলে চিরকুট পৌঁছে দিয়েছিলো-
"আজ সন্ধ্যা সাতটায়। উত্তরা সাত নাম্বার সেক্টর, কাবাব ফ্যাক্টরির সামনে থাকবো আমি।
চলে আসবেন প্লিজ।
ইতি,
কিম্ভূতকিমাকার"
***
[উপসংহার]
অদ্ভুত ঐ মেয়ের সাথে সেই হাতিরঝিলেই ছিলো আমার শেষ দেখা। এরপর কত খুঁজেছি তাঁকে ! কার্জন হলের উলটো পাশের রাস্তায়, রামপুরা-বেগুনবাড়ি রোডে কিংবা এয়ারপোর্ট পার হয়ে সে-ই আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত ...... কোথাও পাই নি আর। যেনো সত্যি সত্যি জলকন্যার রূপকথা থেকে উঠে এই জাদুর শহরে এসেছিলো একদিন। তারপর নিজের হাসি, সুর আর রহস্য ছড়িয়ে দিয়ে আবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে......

আমি অবশ্য এখনো আশা ছাড়ি নি। মাসে দুইশ' টাকা দিয়ে ম্যাজিক শেখার একটা কোর্সে ভর্তি হয়েছি। আমার কেন জানি মনে হয়- আবার কোনো এক ঝুম বর্ষার দিনে, নদী, সাগর অথবা ঝর্ণার থৈ থৈ জল থেকে মেয়েটা এই শহরের বুকে উঠে আসবে। হালকা রুপোলি সুতোর কাজওয়ালা গাংচিলের ডানার মত শুভ্র কামিজ আর গাঢ় নীল ওড়নায় তাঁকে লাগবে আকাশের মত। নাকি সমুদ্র ! সমুদ্রই হবে বোধহয়। হাত তুলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার সময় নীল চুড়িগুলো জোয়ারের ঢেউয়ের মত দোল খাবে তাঁর...... সম্ভবত আবার কোনো গানের লিরিক ভুলে গেছে !

ততদিনে আমি ম্যাজিক দেখানোয় পাকা হয়ে উঠবো। চোখের নিমিষে তাঁর দেয়া গোলাপ দু'টোকে পালটে ফেলবো রজনীগন্ধায়, একদিন তাঁর দেয়া মালাটুকু যেমন পালটে গেছিলো গোলাপে !

ভায়োলিন বাজানোটাও শিখে ফেলেছি। যখন খুব বেশি মনে পড়ে কিম্ভূতকিমাকারের কথা, তখন তাঁর শোনা সে-ই হাতিরঝিলের অপূর্ব সুরটাকে বাজিয়ে তোলার চেষ্টা করি তারে-

"পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরনে মুক্তোর সুখ
তেমনি তোমার নিবিড় ছোঁয়া
ভিতরের এই বন্দরে

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে !"


আমার ভালোলাগা, আমার মায়া আর কিম্ভূতকিমাকারের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ ভায়োলিনের হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়; কিছু বোঝার আগেই চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে মাটিতে।

আমার ইচ্ছা হয়- চিরটাকাল যদি এই চোখের জলেই আমি আগলে আগলে রাখতে পারতাম তাঁকে ! শুনেছি মারমেইড নাকি সাগরে থাকে। এক জীবনের জন্য না হয় আমার নয়নজলেই ডুবে ডুবে থাকতো সে !

"কার মুখ?- আমলকী শাখার পিছনে
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো, আহা,
সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।

তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র’বে না আর, র’বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ
সেই মুখ আর আমি র’বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।"

***
(সমাপ্ত)

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই মে, ২০২১ দুপুর ১:৫৯

রাজীব নুর বলেছেন: সহজ সরল সুন্দর গল্প।

১৭ ই মে, ২০২১ সকাল ১১:৪৪

পুলহ বলেছেন: ধন্যবাদ !

২| ১৭ ই মে, ২০২১ রাত ১:০৪

নীল আকাশ বলেছেন: গল্প খুব ভালো লেগেছে।
কবিতা বা গানগুলি কি আপনার লেখা? শেষেরটা দারুন লাগলো।

১৭ ই মে, ২০২১ সকাল ১১:৪৬

পুলহ বলেছেন: পাঠ ও মন্তব্যে কৃতজ্ঞতা জানবেন। একটা কবিতাও আমার লেখা না। শেষের দু'টো যথাক্রমে রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ আর জীবনানন্দ দাশের.।

৩| ১৭ ই মে, ২০২১ সকাল ১১:৪৯

নীল আকাশ বলেছেন: লেখা্য কারও কিছু শেয়ার করলে সেটা উল্লেখ করে দেয়াই উত্তম। কপিরাইট আইন।
ধন্যবাদ আপনাকে।

৪| ১৭ ই মে, ২০২১ রাত ৮:২৫

মনিরা সুলতানা বলেছেন: কী আশ্চর্য ঘোরলাগা গল্প !! অনেক অনেক ভালোলাগা।

২০ শে মে, ২০২১ বিকাল ৪:৩৩

পুলহ বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ আপু। শুভকামনা জানবেন!

৫| ১৮ ই মে, ২০২১ বিকাল ৫:৪৯

ইসিয়াক বলেছেন: গল্পটা আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত একটানে পড়েছি। আপনার লেখায় জাদু আছে।

খুব ভালো লাগলো।

শুভেচ্ছা রইলো।

২০ শে মে, ২০২১ বিকাল ৪:৩৪

পুলহ বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ । শুভকামনা জানবেন !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.