নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

...

পুলহ

পুলহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বড়দের জন্য রূপকথা

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ৯:৫২

[ বড় হয়ে যাওয়ার পর আর রূপকথার গল্প শোনা হয় না। ক'দিন থেকেই খুব রূপকথা শুনতে ইচ্ছা হচ্ছিলো কেন জানি, তাই নিজেই লিখে ফেললাম গল্প ! জানি না, আদৌ এটা রূপকথা হয়েছে কি না, তবে লিখে আনন্দ পেয়েছি।

হ্যাপি রিডিং]
-----------------
আমার প্রেমিকা এলিসিয়া ধীরে ধীরে কুৎসিত এক পোকায় পরিণত হচ্ছিলো। এটুকু পড়েই দয়া করে কেউ ভাববেন না গল্পটা ফ্রানৎস কাফকার "মেটামরফোসিস" গল্পের নকল। ঐ গল্পের সাথে এলিসিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই, ছিলো না কখনো...

সম্ভবত এলিসিয়ার ওপর কোনো এক ভয়ংকর অভিশাপ ভর করেছে। আগামী গ্রীষ্মের পরের গ্রীষ্মেই ভেবে রেখেছিলাম বিয়ে করবো আমরা। বিয়েতে এক হাজার একটি আরবীয় উট, এক হাজার একটি মধ্য এশিয়ান ভেড়া আর কয়কশ'ত টন দক্ষিণ আমেরিকার সবজি রাখা হয়েছিলো ভোজসভার প্রস্তুতি স্বরূপ। আশপাশের মোট পাঁচটি রাজ্য আর গলিক পাহাড়ের দৈত্যদের দাওয়াত দেয়ার আয়োজন চলছিলো, তার মধ্যেই এ ভয়াবহ দুঃসংবাদ। আমার প্রাণপ্রিয় প্রেমিকা তাঁর লোহিত পূর্ণিমার কমলা-আভা-চাঁদের-মত রূপ হারাতে বসলো এক বিষণ্ণ শীতের সন্ধ্যায়। তাঁর আয়নার মত নখগুলো পালটে যেতে লেগেছিলো তেলাপোকার পিঠের পোতানো পাখার মত, অথচ এই নখ মসৃণ করতে এলিসিয়া ব্যবহার করতো আন্দামান সাগর থেকে তুলে আনা মুক্তো। পরিযায়ী প্রজাপতির রঙে আঁকা যে চোখদু'টো আমাকে পাগল করে তুলতো সবসময়, সেই চোখের দৃষ্টি হয়ে পড়লো কেমন গাঢ় কুয়াশামাখা ঘোলাটে....

আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ওদিকে এলিসিয়া রাতদিন কান্না করতো; এজন্য নয় যে ওর চোখ ধাঁধানো রূপ হারিয়ে যেতে বসেছে। বরং সে কাঁদতো আমাকে হারিয়ে ফেলবার ভয়ে। একদিন কাঁদতে কাঁদতেই বললো- "তোমাকে বোধহয় আর পাওয়া হলো না রাজপুত্র, আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না ! "

এমনই পরিপ্রেক্ষিতে রাজসভার উজির সাহেবের সাথে একদিন পরামর্শ করতে বসলাম। উজির সাহেব বয়োবৃদ্ধ, অভিজ্ঞ মানুষ। আমাকে তাঁর স্বভাবসুলভ শ্লেষাজড়িত গলায় জানালেন- গলিক পাহাড়ের ওপারে, একচোখ দৈত্যদের রাজ্য পার হয়েও নাকি গভীর বনের ভেতর এক এতিম মেয়ে বাস করে। লোকজন মেয়েটাকে বলে ডাইনী, কিন্তু উজির সাহেব নাকি ব্যক্তিগত আগ্রহে একদিন তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। উজিরের ভাষ্য অনুযায়ী- "মেয়েটা ডাইনী নয়, কিন্তু খুব জ্ঞানী। সারাদিন পড়াশোনা আর লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জাদুবিদ্যা থেকে শুরু করে মহাকাশবিজ্ঞান, ইতিহাস থেকে শুরু করে খাদ্যবিদ্যা- এ সবই মেয়েটার হাতের মুঠোয়। প্রচুর পুরাতন পুঁথি, আর দলিল দস্তাবেজে ঠাসা তাঁর ছোট্ট কুঁড়েঘর...."

"আপনি একদিন মেয়েটার সাথে গিয়ে দেখা করেন। সে সম্ভবত তাঁর অর্জিত জ্ঞান থেকে আপনাকে কোনো একটা সমাধান বাতলে দিতে পারবে"- উজির সাহেব আমাকে পরামর্শ দিলেন।

আমি এমন একটা সমাধানের জন্যই মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম। আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ঘোড়া ছোটালাম। সাথে সৈন্যরা যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু আমি বাঁধা দেই ওদেরকে। আমার সমস্যা আমার নিজেকেই সমাধান করতে হবে। তাছাড়া গলিক পাহাড় অনেক দূরের পথ, আমার নিজস্ব ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অন্য কাউকে কষ্ট দেয়াটা বরাবরই নীতিবিরুদ্ধ ছিলো আমার, তা যতই রাজপুত্র, বিশাল রাজ্যের উত্তরাধিকার হই না কেন !

যাই হোক- রওনা দেয়ার পর সাত দিন সাত রাত ধরে আমার ঘোড়াটি চললো। পথে শুধু রাতে ঘুমানো আর ঘোড়াকে সামান্য বিশ্রাম দেয়ার জন্য থামতাম, এছাড়া আর থামাথামির কোনো প্রয়োজন বোধ করি নি। দৈত্যদের রাজ্য পার হয়ে আসতেও কোনো অসুবিধা হয় নি তেমন। এরা শান্তিপ্রিয়, না ঘাটালে মানুষের সাথে বিবাদে জড়ায় না। বরং এক দৈত্যর কাছ থেকে বড় ধরণের সহযোগিতা পেয়েছিলাম, সে আমাকে পারুল এর কুটির খুঁজতে বেশ সাহায্য করলো।

পারুল ঐ জ্ঞানী বা ডাইনী মেয়েটার নাম। আমি তাঁর কুটিরের বাইরে দাঁড়িয়ে শব্দ করছিলাম উপস্থিতি জানান দিতে। মেয়েটা সাথে সাথেই দরজা খুলে বাইরে চলে এলো, যেনো অপেক্ষা করছিলো কারো জন্য। আমার কেন জানি খুব পরিচিত মনে হচ্ছিলো মেয়েটাকে, কিন্তু কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারলাম না ! একটা দস্তরখান বিছিয়ে দিতে দিতে বললো সে- "আপাতত এর ওপরই বসতে হবে ছোটরাজ। ওহ, আপনাকে অভিবাদন জানাতে ভুলে গেছি, নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।" -বলে কাছে এসে আমার পা স্পর্শ করে।

আমি সময় নষ্ট না করে পারুলকে আমার সমস্যার কথা জানালাম। সে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলো প্রথমে, তারপর নীচু গলায় বললো- "আপনার প্রেমিকা, মহামান্য রাজকুমারী এক কঠিন অভিশাপে পরেছে। তবে চিন্তার কিছু নেই। এ শাপ থেকে তাঁর সহজেই মুক্তি সম্ভব।"

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলাম। পারুল শান্ত গলায় বলে চললো- "আপনাকে এক ভিন্ন জগতে যেতে হবে ছোটরাজ। ঐ জগতে রূপকথা নামের একটা মেয়ের দেখা পাবেন আপনি। তাঁর সাথে ভালোবাসার অভিনয় করবেন। রূপকথাই আপনাকে বাতলে দেবে রাজকুমারীর শাপমুক্তির পথ..."

কারো সাথে ভালোবাসার মত স্পর্শকাতর একটা বিষয়ে অভিনয় করাটা কি ঠিক ?! আমার মনের ভেতরটা খচখচ করছিলো, পারুল হয়তো আমার মনের অনুভূতি আন্দাজ করে থাকবে। আমাকে আরেকটু বিপদে ফেলার জন্য বললো- "আপনার ভালোবাসাটা যে মিথ্যা, এটা যেনো রূপকথা কোনোভাবেই বুঝতে না পারে। তাহলে কিন্তু বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, আপনার উদ্দেশ্য সফল না-ও হতে পারে।"

আমি কিছুটা ইতস্তত করে বললাম- "এতে ঐ রূপকথা মেয়েটার কোনো বিপদ হবে না তো?"
"হবে। রূপকথা মারা যাবে আপনাকে সমাধান বাতলে দিয়ে !"

ততক্ষণে ঘুমে আমার চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসছে। আরেকজনের জীবনের বিনিময়ে আমার এলিসিয়াকে উদ্ধার করতে হবে?! আমি চিৎকার করে সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে বলতে চাইলাম- "ঐ জগতের মেয়েটার যেনো কিছু না হয়, বরং আমার জীবনের বিনিময়ে এলিসিয়া সুস্থ হয়ে উঠুক", কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না।

শুধু দেখলাম পারুল ওর মাথাভর্তি চুল নিয়ে আমার উপর ঝুঁকে এলো। তারপর ফিসফিস করে বললো- "রাজকুমারী এলিসিয়া খুব ভাগ্যবান। এমন নিখাদ আর সুন্দর ভালোবাসা পেয়েছেন জীবনে !"
***
রূপকথার সাথে আজ আমার সম্পর্কের প্রায় এক বছর পূর্ণ হতে চললো...

ওরও বাবা-মা নেই। অনেকে ছোটবেলায় নাকি মারা গেছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় হলে থেকে পড়াশোনা করছে মেয়েটা। আশ্চর্য রকমের এক সরলতা ছিলো ওর মধ্যে। আর আমার জন্য গভীর টান। আমি পৃথিবীতে আসার পর থেকেই আবিষ্কার করেছি, রূপকথা আমাকে ভালোবাসে পাগলের মত। যেনো আমি অন্য কোন জগত থেকে, কোনো দুর্বোধ্য যাদুমন্ত্রের বলে এই শহরে এসে পড়ি নি হঠাৎ! যেনো অনন্তকাল থেকে এ শহরেই ছিলাম।

আমার মাঝে মাঝে খুব কৌতূহল হতো। আমি জিজ্ঞেস করতে চাইতাম মেয়েটাকে- সে এতো আগে থেকে আমাকে চেনে কিভাবে? ! আমি তো এই জগত, এই দেশে এলাম কেবল সেদিন, তার আগে তো আমার অস্তিত্ব ছিলো সাদা পাহাড়ের পাদদেশের বিশাল সেফ্রি রাজ্যে।

পারুল আমাকে বলেছিলো- রূপকথা নিজে থেকেই নাকি সমস্যার সমাধান বাতলে দেবে। আমি খুব সচেতন থাকতাম সবসময়, রূপকথা এমন কোনো কথা বলে কি না, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে এলিসিয়ার শাপমুক্তির রহস্য। এটা ঠিক- মেয়েটার মাথায় একটু পাগলামি ছিলো, সে প্রায়ই উদ্ভট উদ্ভট কথা বলতো। একদিন টিএসসির কুকুরগুলোকে পাউরুটি খাওয়াতে খাওয়াতে বলেছিলো- "কখনো কখনো এক মিনিট, এক শতাব্দীর সমান বড় মনে হয়। তাই না !"

আমি চমকে উঠলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা ! রূপকথা যেনো আমাকে আশ্বস্ত করতে চাইছে- সময় নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। কারণ এখানকার এক বছর তোমার জগতের এক সেকেন্ডের সমান !

কেনো জানি আবার সেদিনই রাতে ঘুমানোর পর এলিসিয়াকে স্বপ্নে দেখলাম। ও যখন সুস্থ ছিলো, তখন আমরা প্রায়ই দক্ষিণের গম ক্ষেতে যেতাম। ঘোড়া দূরে বেঁধে রেখে হাত ধরাধরি করে হাটতাম দু'জন। দেখলাম আমার এলিসিয়া অনেক, অ-নে-ক দূরে, ক্ষেতের মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি খুব চেষ্টা করছি তাঁর কাছে পৌছুতে, কিন্তু পারছি না। এতো দূর থেকেও এলিসিয়ার হাসিতে বলকান পাহাড়ের পাদদেশে জন্মানো শীতের গোলাপের মত ঠোঁট, এবং একই সাথে গালে জমে থাকা শিশিরের ফোঁটার মত জলটুকুও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ঘুম ভাঙ্গার পর মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। আমি বিষণ্ণ চারদেয়ালের ভেতর থেকে রূপকথাকে ফোন দিলাম তখনই-

"একটু আসবে দেখা করতে? আমার খারাপ লাগছে খুব।"

তখন বাজে ভোর সাতটা। রূপকথা আমার ফোন পেয়ে বিন্দুমাত্র দেরি করলো না। হুড়মুড় করে এসে হাজির হলো কার্জন হলে। ওখানকার গেটটাও তখন ভালোমত খোলে নি। সকালের প্রথম আলোয় আমি আর রূপকথা দোয়েল চত্বর হয়ে, মোকাররম ভবনের সামনে দিয়ে শহীদ মিনারের দিকে হেঁটে বেড়ালাম অনেকক্ষণ.... একসময় ও নরম গলায় বললো- "বুড়িগঙ্গার ওপারেই খুব সুন্দর সরিষা খেত করেছে। অত বড় এলাকা জুড়ে না, কিন্তু তারপরো দেখতে অনেক ভালো । যাবা ওখানে ?!"

আমরা সদরঘাটে এসে নৌকা পার হলাম। তারপর রিকশা। কুয়াশা কেটে কেটে রোদ উঠে গেছিলো ততক্ষণে, আমার মনে হলো- সূর্যের আলো যেনো সরিষা ফুল থেকে রঙ ধার করতে চাইছে। আসলেও ক্ষেতটা খুব একটা বড় জায়গা জুড়ে না, কিন্তু একপাশের মেঠোপথ, পশ্চিমে গ্রামের সীমারেখা আর দূরে বনভূমির অস্পষ্ট ছায়া মিলেমিশে জায়গাটাকে গভীর প্রশান্তি দান করেছে। মানুষের মনের ওপর প্রকৃতির বোধহয় কোনো একটা প্রভাব আছে। আমার মনের বিষণ্ন ভাবটুকু এখানে এসে কেটে যেতে বসেছিলো। আমি রূপকথাকে ধন্যবাদ জানালাম সেজন্য। শুনি সে বিড়বিড় করে কবিতা আবৃত্তি করছে-

"আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:
পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার..."

তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো- "এটা আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা, তোমাকে এতোদিন বলি নি। কিন্তু আজ কেন জানি মনে হলো- ছেলেটাকে আর বেশিদিন কাছে পাবো না, একবার অন্তত নিয়ে যাওয়া দরকার।"- রূপকথা মিষ্টি করে হাসে।

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। রূপকথা শান্ত গলায় বললো- "আমার সবসময়েই কেন জানি মনে হতো, আমি খুব বেশিদিন বাঁচবো না। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকেই এই অনুভূতিটা হতো। টিএনএজ বয়সে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম এই আশংকার সাথে যুদ্ধ করতে করতে। তারপর কিভাবে কিভাবে যেনো ভার্সিটিতে উঠে তোমার সাথে পরিচয় হলো। জানো, তখনই আমার সেই আশংকাটা আনন্দে পালটে গেছিলো ! আমি সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জীবনকে দেখতে শিখলাম। অনুভব করলাম- মানুষের জীবনকে সময় দিয়ে মাপতে হয় না কখনো, বরং মাপতে হয় অনুভূতির গভীরতা দিয়ে। যে মানুষের জীবনে অনুভবের গভীরতা যত বেশি, তাঁর জীবন তত সার্থক ...

তুমি আমার জীবনে সেই অনুভবের গভীরতা এনে দিয়েছিলে। আমি তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছি, অল্প সময়ের জন্য হলেও তোমার সাথে কাটিয়েছি অপূর্ব কিছু সময়। বিধাতার কাছে এর বেশি কিছু আর চাইবার নেই..."

ওর কথা শুনে কেমন একটা সুক্ষ্ম অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে আমার মনে। আমি অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করি রূপকথাকে আসল সত্যটা জানাবার, কিন্তু মেয়েটা আমাকে সে সুযোগ দিলো না। একদমই অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললো- "চলো আজ যাই। পরে নাহয় আবার আসবো কোনোদিন ...."
***
(শেষ কথা)
রূপকথার সেই ইচ্ছা অবশ্য আর পূরণ হয় নি কখনো। সেদিন ফেরার পথেই সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরে। ওর কপালে হাত দিয়ে দেখেছিলাম- উথাল পাথাল জ্বর উঠেছে। জ্বরের ঘোরে সে প্রলাপ বকতে আরম্ভ করলো, কিন্তু আমি অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করলাম রূপকথার কন্ঠ দিয়ে পারুল কথা বলছে যেনো ! আমি মাথা ঝুঁকিয়ে ঐ কথাগুলো শোনার চেষ্টা করতে থাকি-

"ছোটরাজ, আপনি আমার খুব বড় একটা উপকার করেছিলেন একদিন। বৃথিকার রাজ্যে ছিলো আমার ঘর। দস্যুদের আক্রমণে বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আমি পালিয়ে আসতে থেকেছিলাম একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আপনাদের রাজ্যের সুনাম ছিলো বেশ অনেকদূর পর্যন্ত, তবে রাজ্যের সীমানায় ঢোকার আগেই, গভীর বনে আমি আরেক ডাকাতদলের হাতে পরলাম। আপনি সৌভাগ্যক্রমে তখন সেখানে ছিলেন। শিকারের কালোবাজার বন্ধে পাঁচজন সৈন্যের এক ছোট দল নিয়ে তদারক করছিলেন বনের সার্বিক নিরাপত্তাটুকু। সংখ্যায় ডাকাতেরা অনেক বেশি থাকা সত্বেও আপনি সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে উদ্ধার করলেন। বেঁচে গেলো আমার মান-ইজ্জত-সম্ভ্রম....

অবশ্য শুধু আমাকে উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হলেন না, তিনদিন তিনরাত হাঁটার পর আমি তখন কপর্দকশূণ্য, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর। আপনি নিজের খাবারের ভাগ থেকে অনেকটা অংশ আলাদা করে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেদিন। বয়স কম আমার তখন, সেই অল্প বয়সেই বুঝলাম- এ রাজ্যের প্রশংসা কেন পশ্চিমে লোহিত সাগর, পূবে হিমালয় ছাড়িয়েও অনেকদূর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। হয়তো মন জয়ের পাশাপাশি হৃদয়টাও জয় করে নিয়েছিলেন সেদিনই...

বিশ্বাস করুন ছোটরাজ, আমি অনেক চেষ্টা করেছি আপনার পৌরুষত্ব, আপনার মহানুভবতার তীব্র অভিকর্ষ থেকে বেরিয়ে আসাতে। কিন্তু পারি নি। সময় যত গড়িয়েছে, আপনার প্রতি ভালোবাসা তত বেড়েছেই আমার। এক পর্যায়ে আমি বোধহয় হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে পরলাম, তা না হলে রাজকন্যা এলিসিয়াকে জাদু করার মত জঘণ্য একটা কাজ করার পরিকল্পনা আঁটলাম কিভাবে ! আমাকে ক্ষমা করবেন ছোটরাজ, আপনার এবং রাজকন্যা এলিসিয়ার যাবতীয় ভোগান্তির মূলে আসলে আমিই। মন্ত্র পড়ে আমিই ওনাকে রূপান্তর ঘটিয়ে দিচ্ছিলাম কুৎসিত কোনো পতঙ্গে। ভাবলাম- এর সমাধানের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিশ্চই আসবেন আপনি আমার কাছে। তারপর আপনাকে অন্য জগতে পাঠিয়ে আপনার সাথে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও প্রেমিকা হয়ে যাবো...."

এসব কথা শুনে আমার আসলে রাগ হওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু রূপকথার যে অবস্থা, তাতে সত্যিকার অর্থে রাগ করার ফুসরত পেলাম না। আমার তখন একমাত্র চিন্তা কিভাবে ওকে কোনো একটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়। রূপকথা অবশ্য বলেই চলেছে- "আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আমার মন্ত্র ফিরিয়ে নিচ্ছি। রাজকন্যা এলিসিয়া সুস্থ হয়ে যাবেন খুব দ্রুত, বিপরীতে মারা যাবো আমি ! ছোটরাজ, আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন তো, না !"

আমি বুঝতে পারলাম, এ কথার সাথে সাথেই পারুল অথবা রূপকথা আবার আমাকে ফিরিয়ে নিতে চলেছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে আমার। আশাপাশে মানুষের কোলাহল, রিকশার চাকা-চেইন-বেলের টুনটুন আওয়াজ, চায়ের দোকানে মানুষের ব্যস্ততা- এগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে দ্রুত। রূপকথার পাখির পালকের মত শরীরটাও মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আবার, এবং শেষবারের মত পারুলের গলা শুনতে পেলাম-

"আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন তো, না !"
***
পারুল কিংবা রূপকথা সত্যিই ওদের (?!) কথা রেখেছিলো। এলিসিয়া ভালো হয়ে গেছিলো তার অল্প কিছুদিন বাদেই। আবার ফিরে এলো ওর লোহিত পূর্ণিমার কমলা-আভা-চাঁদের-মত রূপ। তাঁর আয়নার মত নখগুলো আরো চকচকে আর মসৃণ করে তুলতে শুরু করলো আন্দামান সাগর থেকে তুলে আনা মুক্তো। পরিযায়ী প্রজাপতির রঙে দু'চোখ এঁকে আর ঠোঁটে মিশিয়ে বলকান উপত্যকার গোলাপের রঙ সে আমার হাত ধরে হাটতে বের হতো কখনো উত্তরের বনে, নয়তো দখিনের গমক্ষেতের ওদিকটায়। গাঢ় গলায় বলতো- "আমার এই সৌন্দর্য একদিন ম্লান হয়ে যাবে নিশ্চই, শুধু ম্লান হবে না তোমার প্রতি আমার প্রেম, রাজপুত্র !"

ওদিকে আমি হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম। আমার রূপকথার সাথে সে----ই সরিষা খেত, সে-ই ঝলমলে সকালে ঘুরে বেড়ানোর কথা মনে পরে যেতো হঠাৎ। মনে পরতো দুঃখিনী পারুলের শ্যামলা শ্যামলা, চিকন-সাদামাটা মুখ। পারুলের কুটিরে গিয়েছিলাম আমি এ জগতে ফিরে আসার পর, কাউকে পাই নি ওখানে। শুধু কয়েকমু'ঠো ছাই পরে ছিলো। সম্ভবত মন্ত্র ফিরিয়ে নেয়ার ফলে ও পুড়ে ছাই হয়ে গেছিলো নিমিষে। আমি উজির সাহেবকে বলে সেই ছাই সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করলাম। এখনো সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে যাই ওখানে....

বাদামী-হলুদ গম ক্ষেতের ওপর বিকেলের আলো ম্লান হয়ে আসে। দূর বনের হৃদয় থেকে ডাকতে শুরু করে চেনা-অচেনা ঘরফেরা পাখির দল। আমার কেন জানি মনে হয়- সূর্যের আলো গমের মলিনতা থেকে বিষণ্ণতা ধার করতে চাইছে, একদিন রূপকথার সে--ই সরিষা ফুল থেকে যেমন রঙ ধার করতে চেয়েছিলো পৃথিবীতে। কেন জানি অসম্ভব মন খারাপ লাগতে থাকে আমার, ভালোবাসার মানুষটাকে পাশে পেয়েও কিসের এক হাহাকারে হৃদয়-মন পূর্ণ হয়। আমি এক হাতে এলিসিয়াকে ধরে, অন্য হাতে চোখ মুছতে মুছতে আবৃত্তি করি-

"আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:
পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক।"
***

( সমাপ্ত )
গল্পঃ বড়দের জন্য রূপকথা

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:৩৩

রাজীব নুর বলেছেন: সহজ সরল সুন্দর গল্প।

২| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:৫৬

ইসিয়াক বলেছেন: পারুল, রাজপুত্র আর এলিসিয়া চরিত্রগুলো দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। গল্প শেষে পারুলের জন্য মন কেমন করে।
ভালোবাসা তো এমনই হয়।

মানুষের জীবন সময় দিয়ে মাপতে হয় না কখনও মাপতে হয় অনুভূতির গভীরতা দিয়ে। যে মানুষের জীবনে অনুভবের গভীরতা যত বেশি তার জীবন তত সার্থক।
রূপকথার গল্পে ভালো লাগা জানবেন।
শুভ কামনা।

১৪ ই মে, ২০২২ বিকাল ৪:৪৫

পুলহ বলেছেন: ধন্যবাদ। আপনিও শুভকামনা জানবেন


৩| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৮:২৭

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আপনার গল্প বলার ঢঙ, ভাষার প্রাঞ্জলতা, উপমার ব্যবহার - সব মিলিয়ে এক মোহাচ্ছন্নতা কাজ করে গল্প পড়ার সময়ে। গল্পটাকে বেশ এক্সপেরিমেন্টাল মনে হয়েছে এবং এই এক্সপেরিমেন্টে আপনি সফলও। মুভি সিকোয়েন্সের সাথে তুলনা করলে মনে হবে, বিভিন্ন সিকোয়েন্সে অনেক ফিউশন সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন, গল্পটি রূপকথা বা কাল্পনিক, স্থানকালপাত্র হলো অজানা পৃথিবীর কোনো প্রাচীন জনপদ বা রাজ্য; অথচ হঠাৎ সেখানে রিকশার টুংটাং শোনা যায়; রাজপুত্র পড়ালেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে; রূপকথাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তারা মোবাইল ফোন ইউজ করে। আবার বুড়িগঙ্গার ধারে যায়, দোয়েল চত্বর, টিএসসিতে যায়। মুভি বানানো হলে এগুলো কীভাবে করা হতো তা ভাবছিলাম :)

ফিউশন সৃষ্টিতে অসাধারণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। পড়তে যেয়ে থামতে হয় নি।

অনেক অনেক শুভ কামনা রইল পুলহ ভাই।

১৪ ই মে, ২০২২ বিকাল ৪:৪৫

পুলহ বলেছেন: :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.