নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

...

পুলহ

পুলহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ "অপরাজিতা"

১৪ ই মে, ২০২২ বিকাল ৪:৪৮

** গল্পের সকল চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক।
-----------------------------------------------
বাবার মৃত্যুর পর থেকেই রিক্তার সাথে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছিলো, কিন্তু ও আমাকে একদম ছেড়ে চলে গেলো আমার চাকরি হয়ে যাওয়ার পর। অবশ্য এটাকে চাকরি না বলে দেহব্যবসা বলাটাই শ্রেয়। পরিবারের দেনা শোধ করার জন্য বাধ্য হয়েই আমি আমার নিজের যৌবন বিক্রি করেছিলাম।

রিক্তা জানতো আমাকে অন্য নারীদের সাথে সময় কাটাতে হবে। বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা পাবো আমি। যদিও এসব কথা আমিই ওকে জানিয়েছিলাম কেননা ওর আর আমার চার বছরের সম্পর্কে লুকোছাপার কোনো ব্যাপার ছিলো না। আমাদের সব কথাই আমরা একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করতাম, মুহূর্তের জন্যও কেউ কারো সাথে প্রতারণা করতে পারে- এমন চিন্তা মাথায় আসে নি কখনো- এতোটাই পরিষ্কার ছিলো ওর আর আমার সম্পর্ক। তাই নতুন চাকরির খবরটা আমার মুখ থেকে শোনার পর অবাক হওয়ার বদলে কেঁদে ফেলেছিলো সে। অবাক হয় নি কারণ সত্য যত কঠিনই হোক না কেন, ওর কাছ থেকে গোপন করে ওকে ধোঁকা দেবো না আমি- এমন বিশ্বাস ওর আগে থেকেই ছিলো। আর কেঁদে ফেলার কারণটা হলো- ভালোবাসার মানুষকে বাধ্য হয়ে এমন এক কঠিন পরিণতি বেছে নিতে হয়েছে- সেটা ভেবে !

অন্য কোনো উপায় যে আমার ছিলো না- এটা রিক্তাও জানতো। মা ক্যান্সারের রোগী সে-ই আগে থেকে। বাবা বহু কষ্টে ধারদেনা করে মা'র চিকিৎসার খরচ টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। আমি পড়াশোনা শেষ করে বাবাকে কিছুটা স্বস্তি দিবো- এমনই হয়তো ছিলো প্রত্যাশা। কিন্তু আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগে আগে বাবা কভিড আক্রান্ত হলেন। আইসিইউতে ছিলেন টানা দশ দিন। ঐ সময় আরো ধার করতে হলো আমাদের। সব মিলে স্রেফ এক মাসের ব্যবধানে দেনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ালো পনেরো লাখেরও উপরে। কিন্তু এতো চেষ্টা করেও বাবাকে বাঁচাতে পারলাম না কোনোভাবে। শ্রাবণের এক ঝমঝম সন্ধ্যায় পিতার লাশ সঙ্গে নিয়ে এম্বুলেন্সে বসে ছিলাম। এতিম হওয়ার শোক, কিংবা শৈশবে বাবার সাথে কাটানো স্নেহময় মুহূর্তের কথা স্মরণ করে চোখে পানি আসার বদলে মস্তিষ্ক অংক কষতে লাগলোঃ দাফন-কাফনের জন্য মোট কত টাকা খরচ হতে পারে? আচ্ছা, মৃতদেহ গোসল দেয়ারও একটা খরচ আছে, নাকি? তার পরিমাণটুকুই বা কি? বৃষ্টির পানি দিয়ে কি বাবার দেহটুকু ধুয়ে দেওয়া যাবে না ?!

পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে দয়ামায়া এখনো আছে। পাওনাদারেরা সেই মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাদের পরিবারকে সময় দিলেন। টানা তিন মাস কেউই আমাদের দেনা পরিশোধের জন্য চাপাচাপি করেন নি, কিন্তু সবকিছুরই একটা মাত্রা তো থাকে ! ওনারাও বা কতই অপেক্ষা করবেন ! এই তিনটা মাস আমি হন্য হয়ে চাকরি খুঁজেছি বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে। দিনের পর দিন পল্টন, মতিঝিল কিংবা উত্তরার অফিসপাড়ায় রিক্তার কিনে দেয়া ফরমাল শার্ট, প্যান্ট আর টাই পরে ইন্টারভিউ দিতে গেছি অফিস-পিয়ন থেকে শুরু করে অফিস-এক্সিকিউটিভ পর্যন্ত পদে, কিন্তু চাকরি হয় নি ! এক একটা ব্যর্থ দিনের শেষে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মনে যখন ক্যাম্পাসে ফিরতাম, রিক্তা ঠিক আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকতো কার্জন হলের সামনে। আমাকে নিয়ে রিকশা করে করে ঘুরতো। পুরান ঢাকা খুব পছন্দের জায়গা ছিলো আমার। টানা নব্বইটা দিন ওখানকার এমন কোনো গলি নেই, যে জায়গায় রিক্তা আমাকে নিয়ে যায় নি ! অন্ধকার হয়ে আসার পর সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিতো নীরবে। হাতে প্রতিদিন একশ' টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলতো- "রিকশা করে বাসায় চলে যেও। সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে !"

সেই দুঃসহ দিনগুলোর অবসান হয়েছিলো পাবনার রূপপুরে বিদেশীদের জন্য কিছুটা আনন্দের উৎস হতে পেরে, যদিও অবসান না বলে সেটাকে আরেক দুঃস্বপ্নের শুরুও বলা যেতে পারে। ওখানে চাকরির সংস্থান কিভাবে হলো- সেটা এ গল্পের সাথে অপ্রাসঙ্গিক, শুধু এটুকু বলতে পারি- যেহেতু ঐ এলাকার বিদেশী নাগরিকদের সঙ্গ দেয়াই ছিলো আমাদের কাজ, তাই শিক্ষিত ছেলেমেয়ের চাহিদা ছিলো বেশি, যেহেতু কাজটা ছিলো অভিজাত এক শ্রেণীর মনোরঞ্জন। ছয়জন যুবক, আর অজ্ঞাত সংখ্যক তরুণীদের সমন্বয়ে এক জটিল নেটওয়ার্ক সেখানে দেহব্যবসা শুরু করলো। রূপপুরে, পদ্মানদীর পাশেই নির্মানাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অসংখ্য রুশ নাগরিক চাকরি করতো। বেলারুশিয়ান আর ভারতীয় নাগরিকও ছিলো, তবে আমি যে কয়জন তরুণীকে কাস্টমার হিসেবে পেয়েছি, তাঁরা সবাই ছিলেন রাশিয়ান। এদেরই মধ্যে থেকে এলিনা নামের একজন রুশ যুবতীর সাথে আমার বেশ বন্ধুত্বও গড়ে উঠলো একসময়। ওকে আমি রিক্তার গল্প বলতাম, যদিও ততদিনে রিক্তা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ঢাকা থেকে রুপপুর চলে আসার পরও কিছুদিন যোগাযোগ ছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে আমিই যোগাযোগ কমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকি দ্রুত। বুঝতে পারছিলাম- রিক্তা প্রচন্ড রকমের মানসিক টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। না পারছে পছন্দের মানুষটাকে ফেলে দিতে, না পারছে গ্রহণ করতে মন থেকে। অবশ্য কোন মানুষই বা মেনে নেবে প্রিয়জনের এমন পরিণতি ! আমি হলেও কি নিতাম ! তারচেয়ে যে সম্পর্কের কোন ভবিষ্যত নেই, সেটাকে শেষ করে দেয়টাই কি শ্রেয় নয় ! আমি আমার আগের মোবাইলের সিম পালটে ফেলি, যেনো চেষ্টা করেও আর মেয়েটা আমার সাথে যোগাযোগ করতে না পারে...

ধীরে ধীরে ঋণ শোধের চাপও আমার কিছুটা কমে এলো, কারণ অভিজাত শ্রেণীর মনোরঞ্জনের উৎস হওয়ার দরুণ আমাদের উপার্জন একেবারে খারাপ ছিলো না। মাসিক বেতনের পাশাপাশি কাস্টমারদের কাছ থেকে মোটা অংকের বকশিশ পাওয়া যেতো। অবশ্য এটাও ঠিক- সবাই যে শুধু শারীরিক আনন্দ উপভোগ করতে চাইতেন এমন নয়, এলিনার মত কেউ কেউ আক্ষরিক অর্থেই নিজ দেশ, পরিবার-পরিজন থেকে দূরে এসে একজন সত্যিকারের বন্ধু খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। আমি সম্ভবত ওর সেই শূণ্যস্থানটুকু পূরণ করলাম। স্রেফ যৌনমিলনের মাধ্যমে সময় উপভোগের বাইরেও সে আমাকে নিয়ে এদিক ওদিক চলে যেতো প্রায়ই। ঘুরে বেড়াতো। আমি অল্পদিনেই বুঝে গেছিলাম- মেয়েটা ভ্রমণের পোকা। বিশেষত বাংলাদেশের প্রান্তিক গ্রামগুলো ওর খুব পছন্দের জায়গা ছিলো। সুযোগ পেলেই আমাকে নিয়ে কোন এক অজপাড়াগাঁয় চলে যেতো....

বিদেশীরা চূড়ান্ত রকমের প্রফেশনাল হয়। আর্থিক বিনিময় ছাড়া সেবার কথা চিন্তাও করতে পারে না ওরা, তাই আমি যখন এলিনাকে নিয়ে ঘোরাঘুরির বিনিময় হিসেবে, কিংবা সপ্তাহান্তের বিকেলগুলো উপহারের প্রতিদানস্বরূপ ওর কাছ থেকে পয়সা নিতে অস্বীকৃতি জানালাম- তখন সে এতো অবাক হয়েছিলো যে বলার নয় ! সম্ভবত তখন থেকেই আমার প্রতি ওর একটা সুক্ষ্ম কৃতজ্ঞতাবোধের জন্ম নিতে থাকে , যা ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছিলো বন্ধুত্বে। একটা পর্যায়ে তো অবস্থা এমন হলো- এলিনা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত গল্পগুলোও ভাগ করে নিচ্ছিলো আমার সাথে। এমন সব গল্প, যা এর আগে সে আর কাউকে বলে নি...

রাশিয়ান মেয়েরা এম্নিতেই অত্যাধিক সুন্দরী হয়, এলিনা ছিলো তাঁদের মধ্যেও সুন্দরতম। বাঙালি মেয়েদের চোখ সাধারণত বিদেশীদের তুলনায় বেশি আকর্ষনীয়, কিন্তু এলিনার চোখদু'টোও ছিলো দারুণ। ঘন পল্লব, সবুজ পিউপিল আর নারকেল-শ্বাসের মত সাদা সে চোখের টলটলে দৃষ্টি কেন জানি দূর, বহু-দূ-র এক দ্বীপদেশের কথা মনে করিয়ে দিতো। মনে হতো- যেনো অচিন কোনো সমুদ্রপাড়ে এক নির্জন, বিষণ্ণ নারকেল গাছ ছায়া ফেলে আছে। ওর মোমের মত মসৃণ শরীরের প্রতিটা বাঁক ছিলো খুঁতহীন, মেলোডিয়াস কন্ঠ সেই নিখুঁত শরীরের ব্যাপারে আরো আগ্রহী করে তুলতো অনেককে- একজন পুরুষ হিসেবে এ আমি বাজি ধরে বলতে পারি।

আমার অনুমান যে সত্যি, তাঁর প্রমাণ আমি পেয়েছিলাম এলিনার গল্প থেকেই। ওর জীবনের সে কাহিনী মেয়েটা আমার সাথে ভাগ করে নিয়েছিলো। সত্য বলতে ঐ ঘটনাগুলো শোনার আগ পর্যন্ত আমার নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুর্ভাগা মনে হতো, কিন্তু এলিনার গল্প শুনে শুনে আমার সেই ভুলটুকু ভাঙ্গলো। আমি জানতে পারলাম- মেয়েটা ছেলেবেলা থেকেই ভাগ্যের কি নির্মম পরিণতির শিকার...

এলিনার জন্ম হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে। শৈশব পার হয়ে কৈশোর পেরুনোর আগেই সে তাঁর নিজের বাবার কাছে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছিলো। ওর মা ব্যাপারটা টের পাওয়ার পর এলিনার বাবার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ভদ্রমহিলা অনেকদিন মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় বিয়ে-থা না করে ছিলেন, কিন্তু তাঁর নিজেরও তো একটা জীবন আছে। সম্ভবত সে কারণেই সেপারেশনের পাঁচ বছর পর আরেকজনের সাথে বিয়ে বসেন। আপন বাবার লালসা থেকেই যে মেয়ে পালিয়ে বাঁচতে পারে নি, সৎ বাবার থেকে সে কিভাবে বাঁচবে ! তাছাড়া তখন এলিনার শরীরে যৌবন কেবল আসতে শুরু করেছে। দ্বিতীয়বারের মত এলিনা তাঁর পিতৃস্থানীয় একজনের কাছ থেকে হয়রানির শিকার হলো...

বিদেশীরা কাঁদতে জানে না, এরপরো একদিন এলিনা চোখের পানি মুছে আমাকে বলেছিলো- "জীবনে সত্যি আমাকে ভালোবাসে, এমন পুরুষ একজনও পেলাম না, জানো সাখাওয়াত ! সবাই আসতো শুধু শরীর কিংবা রূপের লোভে। আচ্ছা, পুরুষ মানুষ মাত্রই কি এমন, নাকি আমিই আসলে মহৎ হৃদয় কারো দেখা পাই নি আজ পর্যন্ত? কি মনে হয় তোমার!"

আমি অত গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তারপরো কোনোমতে ওর প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলাম- "আমার জীবনে ভালোবাসার মানুষ একজন ছিলো। ওকে কিন্তু আমি কখনোই, শুধুমাত্র শরীরের জন্য ....."

এলিনা আমার কথা শুনে চুপ করে থাকে। আমিও। পদ্মা নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেকদূর চলে যেতাম একেকটা দিন। ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার পর কোন এক নির্জন জায়গা খুঁজে বসতাম। ওসব আলোচনার পর এলিনার মনে কি চলতো আমি জানি না, তবে পড়ন্ত বিকেলের কমলা-সোনালি-হলুদ আলো গোলা পানির দিকে তাকিয়ে আমার সেই পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পরে যেতো। আচ্ছা, রিক্তা কোথায় আছে এখন? কেমন আছে? ওর জীবনে কি অন্য কেউ এসেছে, যে আমার মত ওকে ভালোবাসতে পারবে?

এলিনা হয়তো কিছু অনুমান করতো আমাকে চোখ মুছতে দেখে। কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলতো- "রিক্তার কথা মনে পরছে?"

আমি কিছু না বলে পদ্মার দিকে তাকিয়ে থাকতাম অনুভূতিশূণ্য নয়নে। নদীর মাঝ দিয়ে দু'টো নৌকা ভেসে যেতো পরস্পর বিপরীতমুখী। ওদেরকে দেখে আমার মনে হতো- আমি আর রিক্তাও এরকম জীবনের স্রোতে দু'জন দুইদিকে ভেসে চলেছি। এলিনা ফিসফিস করে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় আমাকে বলতো তখন- "আমার কেন জানি মনে হয়- রিক্তা একদিন তোমার কাছেই আসবে আবার, দেখো !"

এ কথাটা মুখে মুখে বললেও এলিনার তাতে বিশ্বাস ছিলো না বোধহয়। বিশ্বাস থাকলে আর আমার প্রতি দুর্বল হয়ে যেতো না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম- মেয়েটা আমার ব্যাপারে অন্য কিছু ভাবতে শুরু করেছে। পদ্মাপাড়ের সেই জায়গাটা দিনদিন এলিনার খুব পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছিলো। প্রতি সপ্তাহেই আমরা বিকেলের সময়টুকু ওখানে কাটাতাম। সম্ভবত আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, অথবা পরোক্ষভাবে কিছু বোঝানোর জন্য এলিনা বাঙালি মেয়েদের অনেক কায়দাকানুন রপ্ত করা আরম্ভ করলো। খুব যত্ন করে শাড়ি পরা শিখেছিলো। বিদেশী মেয়েদের শাড়িতে খুব একটা মানায় না, কিন্তু এলিনাকে মানিয়ে গেলো। কালো ব্লাউজ আর বেগুনি-জমীন-হলুদ-পাড় শাড়িতে ওকে দেখাতো অপরাজিতা ফুলের মত। চুলগুলোও বাদামী রঙ করালো। তবে আমি সব থেকে অবাক হয়েছিলাম ওকে জীবনানন্দের কবিতা মুখস্থ করতে দেখে। এলিনা জানতো আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র এবং আমার প্রিয় কবি তিনি...

এক আশ্বিনের নিভু নিভু বিকেলে, জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করতে করতেই এলিনা আমাকে প্রপোজ করলো। নরনারীর সম্পর্কের ধরণ খুব অদ্ভুত, হয়তো দীর্ঘদিন শারীরিক ঘনিষ্টতা, কিংবা পরস্পরের দুঃখ বেদনাগুলোর স্পর্শ অথবা এ দুয়েরই প্রভাবে এলিনা এ কাজ করে বসেছিলো। আমার অবশ্য ততদিনে আবেগ-অনুভূতি অনেক কমে গেছে। বাবার মৃত্যু, মাথার ওপর বিশাল দেনার বোঝা, একমাত্র ছোটবোনের ভবিষ্যত সব মিলে এসব নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিলো না। তাছাড়া রিক্তা চলে গেলেও ওর অস্তিত্ব রেখে গেছিলো আমার হৃদয়ে। তাই এলিনা যখন আমাকে ভালোবাসার আহবান জানালো, তখন চমকে উঠেছিলাম। ভাবছিলাম এ পংক্তিমালার জবাব কি দেবো ?!

"...তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্‌নায়—
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক
জোনাকির দেহ হ‌তে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে—
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে..."

খুব টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে কাটলো কয়েকটা দিন। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো! এলিনা চমৎকার মেয়ে, ওর প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ার কোনো কারণই থাকতে পারে না। তাছাড়া ব্যথা, ব্যর্থতা আর বেদনা আমাদের দু'জনের জীবনকে এক করেছিলো। কিন্তু ঐ যে বললাম- ধাক্কা খেতে খেতে আনন্দ, প্রেম কিংবা ভালোবাসার মত কোমল অনুভূতিগুলো ভুলতে বসেছিলাম আমি। কখনো কখনো স্রেফ বেঁচে থাকাটাও অর্থহীন মনে হতো। সব মিলে আসলেই বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। এলিনাকেও জানালাম সে কথা...

তবে শেষমেষ আমার মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি মিলেছিলো রিক্তার কারণেই। এলিনার অনুমান সত্য প্রমাণ করে রিক্তা আবার আমার জীবনে ফিরে এলো। ততদিনে ঈশ্বরদীতেই আমি আরেকটা ছোটখাট কোম্পানিতে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছি। এলিনাই ব্যবস্থা করেছিলো । ও জানতো রূপপুরের দেহব্যবসার পেশাটুকু একরকম বাধ্য হয়েই টেনে নিতে হচ্ছিলো আমাকে। তাই একটা বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিলো । সে অফিসেই রিক্তা কিভাবে কিভাবে আমার খোঁজ বের করে এসে হাজির হলো, তা আজও আমার কাছে এক রহস্য! ঐ মুহূর্তেই আমি বুঝলাম বাংলাদেশটা আসলে কত ছোট ! প্রায় ১৮ মাস পর আমাকে দেখে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছিলো সে প্রথমে, তারপর মুখ ঢেকে ওয়াশরুমে পালিয়ে গেলো। একটু পর আবার এলোমেলো পায়ে ফিরে এসে কাঁপা গলা বললো- "সব ভুলে কি আমরা আবার নতুন করে শুরু করতে পারি না সাখাওয়াত ! এই দেড়টা বছর যে আমার কি কষ্টে কষ্টে কেটেছে..."

ভেবেছিলাম জীবন আর আমাকে কখনো অবাক করতে পারবে না, কিন্তু রিক্তার সাথে সেদিন সারাটা বিকেল কাটানোর পর আমার আবার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে হলো। রিক্তা নিচু গলায় বলে চলছিলো- "তোমাকে আর আমার থেকে ভালো কে জানে! কতটা নিরুপায় আর দুঃসময়ক্লিষ্ট হলে তোমার মত একটা ছেলে এমন কাজ বেছে নিতে পারে। আর আমি সেই দুঃসময়টাতে তোমার পাশে থাকতে পারলাম না, আবার দাবী করতাম কি না ভালোবাসি ! ছিঃ! প্রেম কি এতো ঠুনকো হতে পারে, সাখাওয়াত? না হওয়া উচিত?..."

পদ্মার পাড়ে একখানে বেড়িবাঁধ দেয়া। বিকেলের সময়টায় জায়গাটাতে খুব ভীড় হয়। চটপটি ফুচকার দোকান বসে ওখানে। অনেকদিন পর আমি আর রিক্তা আবার চটপটি খেলাম সেদিন। মনে হচ্ছিলো যেনো সেই বিশ্ববিদ্যালয়, সে--ই কার্জন হলের দিনগুলোতে ফেরত গেছি।

ইজিবাইকে করে শহরে আসার সময় রিক্তা ওর মাথা আমার কাঁধে এলিয়ে দিলো। আমি না দেখেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম- বেচারী কাঁদছে। তবে সেটা কি আমাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে, নাকি দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত বেদনার প্রকাশস্বরূপ- তা আর নিশ্চিত হতে পারি নি। ঈশ্বরদীতে বৃষ্টি হয়েছিলো সেদিন। বৃষ্টির ভেজা ভেজা বাতাসে আমার মধ্যেও হঠাৎ গভীর বেদনার জন্ম হলো। মানুষের জীবনটা এমন কেন- এ গভীরতর জটিল প্রশ্নের জবাব ভাবতে ভাবতে আমি বিষণ্ণ ভালোবাসায় রিক্তার শীর্ণ হাতটুকু স্পর্শ করেছিলাম। বাইরে বৃষ্টি তখনো পরছে...

(শেষ কথা)
========
ঈশ্বরদীর ঐ কোম্পানিতে আমি আরো বছর দুয়েকের মত ছিলাম। এরপর ঢাকা ফিরে আসি। বাংলাদেশে অভিজ্ঞতা থাকলে চাকরি পেতে খুব একটা অসুবিধা হয় না, তাই ঢাকাতে মোটামুটি খেয়েপরে বেঁচে থাকার মত একটা চাকরি জোগাড় হয়ে গেছিলো আমার। শহরে সেটেল্ড হওয়ার পরপরই আমি আর রিক্তা বিয়ে করি। ততদিনে আমার ক্যান্সার-আক্রান্ত মা'ও মারা গেছেন। আমাকে দায়িত্ব থেকে মুক্ত করার বিনিময়ে ভালোবাসার বাঁধনটুকুও ছিন্ন করে গেলেন, চিরদিনের মতই ! তবে এবার আর আমাকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অতটা সংগ্রাম করতে হলো না, কেননা এরই মধ্যে আমি পোড় খেতে খেতে ছাইয়ে পরিণত হয়েছি, আর ছাইকে যতই পোড়ানো হোক না কেন, সে ছাই-ই থাকে। তাছাড়া তখন আমার পাশে, আমাকে ভরসা দেয়ার জন্য রিক্তাও ছিলো। ফলে শুরু হলো আমার ছাই থেকে ফিনিক্স হয়ে ওঠার গল্প....

এলিনাও ততদিনে রাশিয়া ফেরত গেছে। আমি সব খুলে বলেছিলাম ওকে। রিক্তাকেও। এলিনা আমার কথা শুনে ভীষণ মন খারাপ করলো, তারপর আমি যেনো না দেখি এমনভাবে নিজের চোখের পানিটুকু মুছতে মুছতে ধরা গলায় বললো- "আমি রাশিয়া চলে যাচ্ছি, কখনো ও দেশে গেলে দেখা করো !" বিদেশীরা সম্ভবত নিজের দুর্বলতা প্রাণপণে আড়াল করতে চেষ্টা করে, এলিনাও কোনোদিক দিয়ে তার ব্যতিক্রম ছিলো না। আমি ভগ্ন হৃদয়ে দেখতে থাকি- আমার মতই কিংবা আমার চেয়েও বেশি আঘাতে আঘাতে বিক্ষত এক সহজ-সরল তরুণী মাথা নীচু করে হেঁটে যাচ্ছে দূরে। আমার ক্ষণিকের জন্য তীব্র ইচ্ছা হয়েছিলো এলিনাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি পেছন থেকে, চিৎকার করে বলি- প্লিজ, যেও না ! পরক্ষণেই আবার চমকে উঠলাম। আশ্চর্য ! এ আমি কি ভাবছি ! তবে কি আমিও এলিনাকে... ! আহ জীবন! সত্যিই, মানুষের জীবনটা এতো জটিল কেন !

এরপরো আমি কয়েকবারই পদ্মাপাড়ে গিয়েছি। তবে আর এলিনার সাথে দেখা হয় নি আমার। রিক্তার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেড়িবাঁধ, মানুষের জটলা, চটপটি-ফুচকার দোকান পার হয়ে আরো অনেক, অ-নে-কদূর চলে যেতাম দু'জনে। আমার স্ত্রী হাঁপিয়ে উঠতো একসময়, বড় করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলতো- "কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে? আর কতদূর?"

আমি রিক্তার কথার জবাব দিতাম না কোনো। হাঁটার গতি কমিয়ে নদীর পাশে বসতাম। দূ-রে পদ্মার বুকে তখন দু'টো নৌকা ভেসে যাচ্ছে পরস্পর বিপরীতমুখী। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার সোনালি চুল, সবুজ চোখের এক বিদেশিনীর কথা মনে হতো, নারকেল-শ্বাসের মত টলটলে সাদা যার দৃষ্টি এক অচিন দ্বীপদেশের কথা মনে করিয়ে দেয় মানুষকে। আমার মনে হতো- গভীর দুঃখবোধ আর তীব্র বেদনার গল্প দিয়ে যে নারী আমাকে জয় করেছিলো একদিন, বেগুনী-জমীন হলুদ-পাড়ের শাড়িতে যে কি না হয়ে উঠেছিলো চিরদুঃখী, চিরআপন অপরাজিতা ফুল !

আমাকে ঘন ঘন চোখ মুছতে দেখে রিক্তা গভীর ভালোবাসায় আমার কাঁধের ওপর হাত রাখলো। সে হাত স্পর্শ করে আমি গাঢ় গলায় আবৃত্তি করি-

"...নক্ষত্রের বেশি তুমি, - নক্ষত্রের আকাশের মতো !
আমরা ফুরায়ে যাই ,- প্রেম তুমি হও না আহত !
বিদ্যুতের মতো মোরা মেঘের গুহার পথ দিয়ে
চলে আসি ,- চলে যাই ,- আকাশের পারে ইতস্তত !-
ভেঙে যাই ,- নিভে যাই ,- আমরা চলিতে গিয়ে গিয়ে !
আকাশের মতো তুমি ,- আকাশে নক্ষত্র আছে যত ,-
তাদের সকল আলো একদিন নিভে গেলে পরে,-
তুমিও কি ডুবে যাবে, ওগো প্রেম, পশ্চিমসাগরে !

জীবনের মুখে চেয়ে সেইদিনো রবে জেগে ,- জানি
জীবনের বুকে এসে মৃত্যু যদি উড়ায় উড়ানি ,-
ঘুমন্ত ফুলের মতো নিবন্ত বাতির মতো ঢেলে
মৃত্যু যদি জীবনেরে রেখে যায় ,- তুমি তারে জ্বেলে
....
চোখের তারার ’পরে তুলে লবে সেই আলোখানি !
***

( সমাপ্ত )

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই মে, ২০২২ রাত ৮:৩৭

ইসিয়াক বলেছেন: জীবন কখনও কখনও জটিল সমীকরণে এসে দাঁড়ায়। বাস্তব জীবনে কত কিছু ই তো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে করতে হয়। সাখাওয়াতের হার না মানা লড়াইটা ভালো লেগেছে। একজীবনে মানুষের সব সাধ পূরণ হয় না। থাক এলিনা দুরে গিয়ে ভালো থাকুন নিজের মত করে। হয়তো একদিন তার দুঃখ কষ্ট দুর হবে।আশা নিয়েই তো বাঁচে মানুষ।
# পুলহ আপনার লেখাগুলো বরাবরই মায়ায় জড়ানো। যেখানে পাই আপনার লেখা গল্পগুলো পড়ি।জমিয়ে রাখি মনের ভিতর।গভীর জীবনবোধ না থাকলে এমন লেখা লেখা যায় না। যদিও আজকের লেখাটা আরও ভালো হতে পারতো।

ভালোবাসা জানবেন ভাই।
শুভকামনা রইল।

২| ১৪ ই মে, ২০২২ রাত ১০:০৪

খাঁজা বাবা বলেছেন: ভাল লিখেছেন, তবে প্লট ভাল লাগেনি। :(

৩| ১৪ ই মে, ২০২২ রাত ১১:০০

রাজীব নুর বলেছেন: অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।

তবে এক জাগায় লিখেছেন, বিদেশীরা কাঁদতে জানে না। ইহা ভুল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.