নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানবতার জয় হোক

শান্তির জন্য সংগ্রামী

রুমি আলম

মানবতার জয় হোক

রুমি আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছাগল(ছাগু) সমাচার

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ ভোর ৫:৪৪

আমি সম্ভবত ক্লাস টু বা থ্রি তে পড়ি। আমাদের বড় একটা ছাগলের ঘরে দুইটা ছাগলছানা জন্ম নিলো। সেই দুটো তাদের বয়সের একটা পর্যায় অতিক্রম করার পরে খাসি নাম ধারণ করল। তাই আজ শুধু ছাগল নিয়েই লিখব। খাসী দুইটা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। হঠাৎ বাড়ির সবাই খেয়াল করলাম এরা ‘পাগলে কী না কয়, ছাগলে কী না খায়’ তত্ব মোতাবেক সবকিছুই খাওয়া শুরু করছে। কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে এহেন বস্তু নেই যা তাদের ভক্ষনের অযোগ্য। আমার বছর তিনেকের বড় বোন, যাকে আমি কাজলা দিদি পড়ার পর থেকে দিদি ডাকতাম। এখন অবশ্য আপা ই ডাকি। কবে কখন কিভাবে কোন সভ্যতার(?) বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে আপা ডাকা শুরু করেছিলাম এখন আর মনে নেই। এই দিদিই খাসী দুটোর নামকরণও করলো। সাদা রঙেরটা একটু খাটো আর পেটমোটা ছিল নাম রাখা হলো ‘বুলু’ এবং কালো ষাঁড়ের মতো দেখতে লম্বা ও তামাটে মাংসপেশিদারীর নাম হলো ‘তুলু’। আজব ব্যপার ছিল, যেখানেই থাকুক আমরা অন্য কেউ নাম ধরে ডাক দিলে ধীরে সুস্থে হেলেদুলে এসে হাজির হতো, কিন্তু দিদি ডাক দিলে লাফাইতে লাফাইতে এসে দিদির দু’পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়তো। আমার সেই দিদি এই দুই খাসি কে ভীষণ আদর করতো। দিদি যখন স্কুলে যেত পিছন পিছন চলে যেত। তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য অন্যকাউকে বাড়ির গলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আমিও দিদির সাথে ঝগড়া/ অভিমান করে বলতাম তোরে ঐ খাসি দুইটাই দিদি ডাকুক আমি আর ডাকবো না! কারন দিদি বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে ঐ খাসি দুইটাকে নিয়েই পড়ে থাকতো। একসময় দেখা গেলো, বাড়িতে দুইজন মানুষের ভাত বেশী রান্না করতে হচ্ছে। নুন অ গরম ছাড়া পানিই খায়না। নির্দিষ্ট পাতিলে তাদেরকেও ভাত খেতে দিতে হতো। পুরনো কম্বল কেটে শীতকালে শীতের পোশাক বানানো লেগেছে, দিদি নিয়মিত স্নান করাতো, চিরুনী দিয়ে তাদের সারা শরীর আঁচড়িয়ে দিত । আমিও আদর করার অংশীদার হবার জন্য দিদির ফুটফরমায়েশ খাটতাম। হাস, মুরগী ও ছাগল রাখার নির্দিষ্ট ঘরে ওরা একসময় বর্জ্য ত্যাগ করার অভ্যাসও বদলে ফেলেছিল। এমনি সব অভ্যাস হলো যে সারা গ্রামের সবাই জানতো। কারো বাড়িতে ওরা গেলে প্রায় সবাই খাবার দিত। তিন বেলা ই যথাসময়ে রান্নাঘরের সামনে হাজির থাকতো। সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে বিকেলে জলখাবারের সময়েও উপস্থিত হতো। কখনো দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়নি। কারন ফসলি ক্ষেতের পাশদিয়ে গেলেও ফসল নষ্ট করতো না। এসব দেখে আমরাসহ প্রতিবেশীরা আশ্চর্য না হয়ে পারতাম না। দাদুর(দাদাকেই দাদু ডাকতাম)অনেক বয়স হয়েছিল, তাই যখনতখনই ক্ষুধা নিবারনের জন্য, দাদুর খাটের পাশে সবসময় বিস্কুট, ফলমূল, পাউরুটি ইত্যাদি রাখা থাকতো। দাদু যখনই কিছু বের করে খেতো তুলু ও বুলুও বাদ যেতো না। দাদুর মুখ ছিল একটু লম্বাটে এবং দাড়ি ছিল। তাই আমরা ভাইবোনরা ছাগইল্লা দাড়ি বলে ক্ষেপাতাম। তুলু ও বুলু কে দেখিয়ে দাদু বিজয়ের হাসি দিয়ে বলতো কোথায় এদেরতো দাড়িই নেই। তুলু ও বুলুও ছিল এমন, দাড়ি গোঁফহীন টানটান পেশিবহুল যেন চির যুবক। বাড়ির সবাইতো বটেই বেড়াতে এসে কেউ এক/দুইদিন থাকালে তারাও প্রথাহীনভাবে তুলু ও বুলুর প্রেমে পড়তো। এর মাঝে হঠাত হঠাত অসুস্থও হয়ে পড়তো, গ্রাম্য পশুচিকিতক চর্বি বেড়ে যাওয়ার রায় দিলে আচার বা ঋতুকালীন টক ফল বা টকজাতীয় পাতা খাওয়ানো হতো বা ওষুধ সেবন করানো হত। এভাবে একসময় খাসী দুইটা অনেক বড় হয়ে উঠল। মানুষের নজরেও পড়তে শুরু করলো। অনেকেই দেখতে আসতো আবার অনেকেই আমাদের স্বাধের তুলু ও বুলুর মাংস খাওয়ার জন্য কিনতেও আসতো। বাড়ির বড় কাউকে বিক্রির ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলে তারা হয়ত বেচাবিক্রির ব্যপারটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিতো কিন্তু দিদি, আমি বা আমাদের ছোট ভাই আমরা কেঁদেকেটে অস্থির হতাম। আম্মার সাথে অভিমান করতাম। দাদু এসব দেখে বলতো(তখন দাদু ইত্তেফাক/সংবাদ পত্রিকা পড়তো), তোদের এইসব আহ্লাদীপনা কোন সাংবাদিক দেখলে এই পত্রিকায় লিখতে পারতো! আসলে তখনো আমরা বুঝতাম না অথবা বুঝতে চাইতাম না যে, এদের কখনো জবাই বা বিক্রি করা সম্ভব বা হতে পারে। এমন সময়ে আমাদের বড় আপার বিয়ে ঠিক হলো ২৫ জানুয়ারী ১৯৯১। এখন পাড়া প্রতিবেশিসহ অনেকেই তুলু ও বুলুকে বিয়ে উপলক্ষে জবাই এর কথা বলল। আমাদের বড় আপা দাদুর ছেলেদের দিক দিয়ে বড় নাতনী এবং নানা-নানী বাড়ির দিক দিয়ে সবার বড় নাতনী। সবার খুব আদরের। আমাদের একমাত্র ফুপুর বিয়ে সম্ভবত পঞ্চাশের দশকে শুরুতেই আমাদের ছোট চাচারও জন্মের আগে হয়েছিল। অনেকদিন পরে আমাদের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হবে, ধুমধাম আয়োজন চলছে। আমরা ছোটরা বড়দের ব্যপার সেপার বুঝার অধিকারও নেই, চেষ্টাও করিনা। আত্বীয় স্বজন আসছে আনন্দের ছুটাছুটিতে আমাদের আর পায় কে! তুলু ও বুলুর বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট অন্যদের দেখাই, খেলাধুলা করি। হঠাত একদিন(বোধকরি ২৩ জানুয়ারী)ভোরে কিছু মানুষ এসে দেখি আব্বার সাথে কথাবার্তা বলছে। ওদের অনেককেই আমি দেখেছি আগেও আমাদের বাড়ি আসতে। আব্বা বাড়িতে গিয়ে আম্মার সাথে কীসব কথা বলার পরই দেখি আম্মা তুলু ও বুলুকে খোঁজাখুঁজি করছে। অসময়ে গরম পানি করছে। আম্মাও কাঁদছে(এখন যখন লিখছি কান্না ধরে রাখতে পারছিনা)। আমি দিদিকে ডেকে আনলাম ঘটনা কী বোঝার জন্য। দিদি ঠিক ঠিক বুঝেই কান্না জুড়ে দেওয়ায় আমিতো একেবারে বেহুশ কান্না, ছোটভাইয়েরও একই অবস্থা অনেকটা আমাদের দেখে, না বুঝেই । দাদু, বেড়াতে আসা ফুপুসহ অনেকেই এসে আমাদের বোঝাতে লাগলেন যে, তুলু ও বুলু অনেক বড় হয়েছে সারাজীবন কী আর রাখা যাবে, হয় জবাই করতে হবে না হয় দূরে কোথাও বিক্রি করে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরাও আমাদের মতোই কাঁদছি। এরমধ্যেই বুলু’কে নুন দিয়ে গরম পানি খাইয়ে, চিরুনী দিয়ে আঁচড়িয়ে, ছোট ছোট দুইটা শিঙে তেল মেখে, নতুন পাঁটের রশি পাকিয়ে বেঁধে সেই লোকদের হাতে তোলে দেওয়া হলো। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি সবাই, কাঁদছি কিন্তু কিছুই করার নেই। সবাই নির্বিকার। বুলুও আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, হয়ত চোখে জলও এসেছিল আমরা বুঝিনি। রইল কেবল তুলু। কিন্তু তারপর থেকে আমি বা দিদি কেউ ওদিকে নজর দেইনা। সবসময় মনপোড়া হয়ে থাকি। এভাবে পরপর দুইদিন যাওয়ার পরে ভাবলাম তুলু মনেহয় থাকবে সারাজীবন। এমনিতে সন্ধ্যারাত হলেই ঘুমিয়ে পড়ি, কিন্তু বিয়ের আগের রাতে সবাই মজা করছি। বড়আপার নিজের বিয়েতে কিছুটা আপত্তি ছিল, তাই সে গোপনে হয়ত চোখের জল ফেলছিল। সময়ে সময়ে আমাদের ছোট তিন ভাইবোনদের ডেকে কাছে নিয়ে আদর করছে। গভীর রাত থেকে বাবুর্চি ও কসাই রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আত্বীয়, প্রতিবেশিসমেত বাড়ির আঙিনা ভরা লোকজন। দিদি কিভাবে জেনেছিল জানিনা, সে আমাকে নিয়ে রান্নার আয়োজনের কাছে গেল। দুজনেই বড়দের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শীতের আগুনের উত্তাপ নিচ্ছি। এবার শুরু হলো মুরগী জবাইয়ের পালা। এগুলো শেষ হওয়ার পরে এলো গরু। একে একে দুইটা গরু জবাইয়ের পরে মনেহয় রক্ত দেখে কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। ভয়ার্ত চেহারা দেখে মেজো চাচা বাড়ি যেতে বলল। কিন্তু দিদি অনড়, তাই আমিও অনড়। আব্বা আমাদের হাবভাব দেখেই বুঝে ফেলেছে ঘটনার মর্মার্থ। আমি তখনো কিছুই বুঝিনি। আব্বা সম্ভবত বাড়িতে গিয়ে আম্মাকে বলেছিল, আম্মা এসে আমাদের টানাহেচড়া করেও নিতে পারেনি। কানেকানে চাচাকে আম্মা কী যেন বলল। চাচাও দেখি আমাদের দিকে করুনভাবে তাকিয়ে আছে। এরমধ্যেই কসাই বলে ফেলল, কই খাসী কই, নিয়ে আসেন, তাড়াতাড়ি আনেন। একথা শুনেই দিদি কান্না জুড়ে দিলো সাথে সাথে আমিও। চাচা বলছে না না খাসী জবাই হবেনা, আপনারা মাছ কাটতে থাকেন ইত্যাদি। কিন্তু আমরা যা বুঝার বুঝে ফেলেছি, কান্নায় লুটিয়ে পড়ছি। এহেন পরিস্থিতিতে পরে কী হয়েছিল মনে নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে তুলুকে না পেয়ে আরেকপ্রস্থ কান্না। খাওয়া দাওয়া আনন্দ ফুর্তি সব কান্নার রঙের সাথে মিলেমিশে একাকার। সেই তুলুর মাংস আত্বীয়স্বজন ও দাওয়াতী মেহমান ছাড়া বাড়ির কেউ স্পর্শ করতে পারেনি। পরে শুনেছি আব্বা, দাদুসহ বাড়ির সকলেই অনেক কষ্ট পেয়েছিল এবং আব্বা বুলুকেও বিক্রি করতে চায়নি, কিন্তু আব্বার ছোটবেলার স্কুলের সাথীদের আবদার ফিরিয়ে দিতে পারেনি। এত বড় ছিল যে সেইসময়েও ৩,২০০/ টাকা মুল্য নির্ধারিত হয়েছিল। এখনো কুরবানির ঈদে বাজারে যাই অথবা বাড়ির অন্য কেউ বা প্রতিবেশিরা বাজার থেকে ফিরে আলোচনা করে কোন কৃষকের ঘরে এত বড় দেশি খাসী আর হয়না। আমাদের বড়আপা, যে আমাদের ছয় ভাইবোনের চারজনকেই কোলে রেখেছে, ঘুম পাড়িয়েছে, স্নান করিয়েছে, পড়িয়েছে, সাথে করে স্কুলে নিয়ে গেছে আমাদের সেই আপাও চলে গেলেন শ্বশুর বাড়ি। এবং তারই সাথে তুলু ও বুলু যাদেরকে আমরা কোলে পিঠে করে বড় করেছি, স্নান করিয়েছি, খাইয়েছি, এমতাবস্থায় তাদের পৃথিবী পাড়ি দেওয়া তখনকার সেই বয়সে মেনে নেওয়া খুব কঠিন ছিল। আজ লিখতে বসে বুঝলাম কেনো, কোন মায়ায় কেঁদেছিলাম, ভিতরে সুপ্ত ছিল তাই আজো কিছু নির্বিকারভাবে ঝরে পড়লো। এখন যখন দেখি ফেসবুক বা ব্লগে পাকি হায়েনাদের এবং তাদের সহচরদের ছাগু বলে ডাকা হয় তখন ভিতরের শুকিয়ে যাওয়া দগদগে ক্ষত আবার তুলু ও বুলু নামী অতি আদরের ছাগলের কথা খুব খুউব মনে পড়ে। তাই আমি এই নরপশুদের ছাগু নামে ডাকতে পারিনা। এই কুলাঙ্গারদের জন্য বরং শব্দ ও বর্ণহীন কিন্তু গন্ধযুক্ত কিছুর কথা ভাবার দাবী জানাচ্ছি। এই লেখার সময় ও বয়সগত বিষয়ে কিছুটা অমিল থাকা স্বাভাবিক। ইচ্ছেকরেই বাড়ির কাউকে ফোন করে মনে করিয়ে চোখে জল আনতে চাইনি। আরও দুটি বিয়োগান্তক ঘটনা এই লেখার সাথে জড়িত। দাদু ১৯৯৬ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারী বার্ধক্যজনিত কারনে মৃত্যুবরণ করেন এবং আমার বড় দুলাভাই নন-হসকিন্স লিম্ফোমিয়া নামক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৭ সালের ১৫ জুন মৃত্যুবরন করায় বড়াআপা বিধবার বসনে সজ্জিত।



বি.দ্র. আমাদের পালিত কুকুর(কুত্তা) সমাচার লেখার ইচ্ছে রইল।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৪:০৭

বর্ণচোরা বলেছেন: চালিয়ে যান

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৪:৩১

রুমি আলম বলেছেন: আপনি পাশে থা্কলে চলবে অনুক্ষন

২| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:৩২

তীর্থযাত্রী বলেছেন: অসাধারন

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:৩৮

রুমি আলম বলেছেন: সাধারনভাবে আছি আপনাদের সাথে

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.