নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানবতার জয় হোক

শান্তির জন্য সংগ্রামী

রুমি আলম

মানবতার জয় হোক

রুমি আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবঃ জন্মদিনে তোমায় সশ্রদ্ধ সালাম

০৮ ই আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:৪০

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাত্রিতে জাতির জনকের হত্যাকারীদের নিষ্ঠুর, বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন। তিন বছর বয়সে পিতা ও পাঁচ বছর বয়সে মাতাকে হারানো রেণু নামের শিশুটি ১৯৩০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।



শিক্ষা, বিয়ে ও সংসার শুরুঃ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকে রেণুকে তার শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুর মাতা সাহেরা খাতুন নিজের সন্তানদের সঙ্গেই মাতৃস্নেহে লালন-পালন করে বড় করেছেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া এবং ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য মৌলভি এবং বাংলা, ইংরেজি ও অংক শিক্ষার জন্য গৃহশিক্ষক রাখার সেকালীন রেওয়াজ অনুযায়ী পড়ালেখা করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে এটুকু হলেও এই মহিয়সী নারী প্রমাণ করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ না করেও কিভাবে নিজে মহান হওয়া যায়, মানুষ গড়া যায় এবং সেই মানুষকে দিয়ে নতুন দেশ জন্ম দেওয়া যায়।



রাজনৈতিক ভুমিকায় স্বামীকে প্রেরণাঃ এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়, ১৯৪৬ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তিকালের দুটি ঘটনার। সদ্য প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে বেগম মুজিবের স্বামী শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘আব্বা, মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুসজল’ বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, “একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস।” এতেই বুঝা যায় স্বামী অন্তপ্রাণ স্ত্রীর অনুভূতি।

এর পরে ১৯৪৭ সালের বিভক্তির চূড়ান্ত সময়ের প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে যার শুরু মূলত জিন্নাহর ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’কে কেন্দ্র করে ১৯৪৬ সালে ১৬ আগষ্ট থেকেই। সেটার ধারাবাহিকতা ১৯৪৭ এর বিভক্তির পরেও চলছিল।

সেই দাঙ্গার সময়ে যুক্তবাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিবের প্রিয় নেতা মুজিবকে বললেন, ‘এই দাঙ্গার সময়ে শুধু সরকারি কর্মচারীদের উপরে ভরসা করতে পারছি না। তাই তুমি যদি ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের একটা ভলান্টিয়ার কোর গঠন করে বডারে গিয়ে শরর্ণার্থীদের আসা-যাওয়ার বিষয়টি তদারক কর তবে আমি নিশ্চিন্ত থাকি।’



একথা বলেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী দ্বিধাগ্রস্তভাবে শেখ মুজিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি জানি রেণুর শরীর ভালো নয়। তার উপর বাচ্চা হারিয়েছে (১৯৪৪ সালের ডিসেম্ভরে তাদের প্রথম ছেলে সন্তান জন্ম হয়ে মারা যায়)। তোমার উচিৎ তাকে সঙ্গ দেওয়া। অবশ্য আরো প্রায় দশ দিন সময় বাকি আছে কাজ শুরু হতে। তুমি ভেবে দেখো। আর তোমার পক্ষে সম্ভব না হলে অন্য কারো নাম সাজেষ্ট করতে পারো।’

শেখ মুজিব শুধু কয়েকদিন সময় নিয়ে চলে এলেন। তখন বেগম মুজিব অন্তসত্ত্বা ছিলেন। এর আগে সন্তান হারানোয় এবার ভেবেছিলেন হয়তো স্বামীকে কাছে পাবেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতার ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করে লিখলেন চিঠি। তার স্ত্রীও উত্তর দিলেন। সেই উত্তরে স্বামীকে নিশ্চিন্তে তার কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে লেখেন, “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে আপনার কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপরে আমার ভার ছেড়ে দিন।”



এরকম চিঠি অন্য কোনো পতিব্রতা নারী লিখেছে কি না ইতিহাসে তেমন পাওয়া যায় না আজও। অথচ গ্রামের অল্পবয়সী একজন নারী যার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই বললেই চলে তিনি লিখেছিলেন সেই ব্রিটিশ ভারত যুগে। এখানেই স্বামীকে দেশের জন্য উৎসর্গ করা একজন বিদূষী নারীর চরিত্র ফুটে ওঠে।



শেখ মুজিবুর রহমান এই চিঠি পাওয়ার পরেই তার নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নিকট গিয়ে শরণার্থীদের তদারকিতে যাওয়ার কথা ব্যক্ত করেন। শহীদ সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তুমি রেণুর সঙ্গে পরামর্শ করেছো?’

মুজিব হ্যা সুচক জবাব দিয়ে বললেন, চিঠি পেয়েছি। সে নিশ্চিন্তে দেশের কাজে যেতে বলেছে।’ শহীদ সাহেব রাশভারী মানুষ ছিলেন। ভাবাবেগ প্রকাশ করতেন না। কিন্তু সেদিন শেখ মুজিবকে বললেন, ‘Mujib, She is a very precious gift to you from God. Don’t neglect her please.’ অথাৎ ‘মুজিব, সে তোমার জন্য খোদার দেওয়া অমূল্য দান। তাকে অবহেলা করো না।’ পরবর্তী ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথা কত সঠিক।



পাকিস্তান আমলে আন্দোলনঃ এর পরের ইতিহাস শুধুই কষ্টের শুধু ত্যাগের। যে পাকিস্তানের জন্য পরোক্ষভাবে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ভূমিকা রেখেছিলেন সেই পাকিস্তানেই শুরু হলো নতুন দেশ জন্মের আদিপাঠ। যে আন্দোলনের পুরোভাগে অধিনায়কত্ব করেছেন শেখ মুজিব আর অন্তরালে বেগম মুজিব।

কেননা বেগম মুজিব আর দশজন সংসারী নারীর মতো স্বামীকে শুধু ঘরে আটকে রাখেননি। অনুপ্রেরণা, শক্তি, সাহস, মনোবল ও প্রেরণা যুগিয়ে স্বামীকে সংগ্রামী হওয়ার জন্য নিজে সকল রকম ত্যাগ স্বীকার করেছেন এই মহিয়সী নারী।



'৭১ এ মুক্তির সংগ্রামের শুরু তথা অসহযোগ আন্দোলনঃ স্বামীর সংগ্রাম ও অধিনায়কত্বের ধারাবাহিকতায় বাঙালি মুক্তির স্বাধ পেতে বিপ্লবী ভূমিকায় আবিভূত হয়। অপরদিকে পাকিস্তানি হায়েনাদের হিংস্রতায় সমগ্র বাঙালির জীবনে নেমে আসে ‘৭১ এর দুযোগময় দিন।

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবাবের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে ভূবনখ্যাত ভাষণের রাতেই ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতে খাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার যা বলার ছিলো আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোন মুহূর্তে গ্রেফতার বা হত্যা করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দু’বেলা আমার সঙ্গে একত্রে খাবে’।

শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা, শেখ রাসেল, শেখ শহীদ, ড এম এ ওয়াজেদ মিয়া এবং বেগম মুজিবকে উদ্দেশ করে এমনটিই বলেছিলেন।



সেই থেকে ২৫শে মার্চ দুপুর পর্যন্ত একবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাঙালির জীবনে ঘটে যাওয়া সেই অমানিষার অন্ধকার রজনীতেই ঘটে কেবল ভিন্নতা। ঘটারই কথা। এই রাতেই বাঙালির বুকের তাজা রক্তের উপর দাঁড়িয়ে বাঙালির হাজার বছরের প্রিয় মানুষ শেখ মুজিব ২৬ তারিখ শুরুর প্রারম্ভেই স্বদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

সেই ৭ তারিখের পর থেকে একে একে ঘটতে থাকে সকল না দেখা ঘটনা। চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন। রাজনীতির আড়ালের রাজনীতির কূটকৌশল তথা আলোচনা পর্ব। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের ধৈর্যের সকল পরীক্ষা দিয়েই বিদ্রোহী সত্ত্বায় অবতীর্ণ হয়।



২৫ তারিখ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু নেতা কর্মীদের সঙ্গে গুরুত্বপুর্ণ আলোচনা ও নিরদেশদানে ব্যস্ত থাকায় সেই ৭ তারিখ থেকে মেনে চলা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। অন্যরা সকলেই রাতের খাবার শেষ করলেও বেগম মুজিব স্বামীর জন্য অপেক্ষায় থাকেন।

রাত ন’টার দিকে অন্য সকলের খাওয়া শেষেই শেখ কামাল বিদায় নিয়ে চলে যান গোপন আস্তানায়। এরপরে রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যেই কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসে। বিভিন্নজনের কাছ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু স্বিদ্ধান্ত নেন তিনি বাড়ি ত্যাগ করবেন না বা পালিয়ে কোথাও যাবেন না।

অপরাপর সকল নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন নির্দেশ দিলেন। ওয়াজেদ মিয়াকে ডেকে বলেন, হাসিনা, রেহানা ও জেলীকে নিয়ে তার নতুন ভাড়া নেওয়া বাড়িতে চলে যেতে। শুরু হয় বিচ্ছেদের পর্ব। বাঙালির জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিষার কালো অধ্যায়।



স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরুঃ পৃথিবীর মানুষ অতীতে এমনটি দেখেছে সেই কথা ইতিহাসের কোথাও কেউ উল্লেখ করেনি আজো। কবি জীবনানন্দ দাশ বেচে থাকলে ‘এত রক্ত মধ্যযুগ দেখেছে কখনো?’ এই কবিতাটি হয়তো নতুনভাবে লিখতেন। হয়ত বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, সেজন্যই রক্তের খেলায় মেতেছিল উন্মাদ পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা।

গ্রেফতার, নির্যাতন ও আত্মগোপনের মধ্যদিয়ে ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়ির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিকে গোলাগুলি ও কামানের আওয়াজ শুরু। রাত আনুমানিক ১টার দিকে পাকিস্থানি আর্মি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেছে।



বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী গোলাম মোরশেদকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। অন্যান্য কাজে নিয়োজিত আজিজ, ফরিদ, বাবুচি নিয়াজ এবং শিশু রাসেলের দেখাশোনায় নিয়োজিত আজিজুন নেছা উরফে বুড়িকেও গ্রেফতার করেছে।



বেগম মুজিব, জামাল ও রাসেল শুধু গ্রেফতারের মধ্যে পড়েনি। বেগম মুজিব, ড এম এ ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জামাল ও ছোট্ট রাসেলের বিভীষিকাময় সেই রাতের পর থেকেই শুরু হয় ঠিকানাবিহীন পথচলা।

২৬ তারিখ থেকে দিনগুলো এমনভাবেই অতিবাহিত হচ্ছিল যে, আসলে কেউ কারো খোজ রাখতে পারছিল না। আওয়ামী লীগ নিষীদ্ধ হলে নেতা কর্মীরা দ্রুত ভারতে আশ্রয় নিচ্ছিল এবং এই সময়টা এমনই ছিল যে, কেউ তাদের সংসারের খবরও নিতে পারছিলেন না বা সম্ভব ছিল না।

নেতারা নিজেরা গোপনে দূরে যেতে পারলেও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পক্ষে সেটাও অসম্ভব ছিল। প্রাকৃত বাস্তবতায় নেতাদের পক্ষেও পরিবারের প্রতি নজর দেওয়ার সুযোগ বা দায়িত্বের চেয়ে দেশের জন্য প্রাণপনে কাজ করাই মুখ্য ছিল। হয়ত এজন্যই প্রায় সকল নেতার পরিবারই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই সময়টা পাড়ি দিয়েছে।



পলাতক জীবনঃ পালিয়ে থাকাও এমনি দুষ্কর যে, সেসময়ের ছোট ঢাকা শহরে প্রতিদিনই মানুষ শহর ছেড়ে অন্য স্থানে চলে যাচ্ছিল। নতুন বাসা ভাড়া নেওয়া হলে ২/১দিন পরেই বাড়িওয়ালি বেগম মুজিবকে ভাড়া ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আপনাদের পরিচয় জানাজানি হয়ে গেছে। আল্লাহর দোহাই, আপনারা দয়াকরে এই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যান। তা না হলে পাকিস্থানি আর্মি আমাদের বাড়িটি ডিনামাইট দিয়ে ধবংস করে দিবে।’



পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে আত্মগোপন করে থাকলেও পাকবাহিনী ক্ষিপ্ত হায়েনার মতো তাঁদের খুঁজে বেড়ায়।



গ্রেফতার ও নির্যাতনঃ আজ এখানে কাল ওখানে এভাবে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে কিছুদিন থাকলেও মে মাসের ১২ তারিখ বিকেলে পাকিস্থানি আর্মির মেজর হোসেন পরিচয়ে এসে গ্রেফতার করে কড়া পাহারায় ধানমন্ডির ৯/এ(পুরাতন ১৮) নম্বর রোডের ২৬ নম্বর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেদিন দুপুর ১টার দিকে তিনজন ছাত্রলীগ কর্মী তাদের নিয়ে যেতে আসলেও তাদের সঙ্গে এক্ষনই এত বিশাল মানুষের বহর নিয়ে বেগম মুজিব যেতে রাজি হননি। কিন্তু মাত্র কয়ক ঘণ্টার মধ্যেই মনে জেগে উঠা সন্দেহ বাস্তবে রুপ নিল। কোনরকম বিছানা, ফ্যান বা অন্য কোন আবাসনের ন্যুনতম সুবিধাটুকুও দেওয়া হয়নি। উপরন্তু ১৫/২০জন সশস্ত্র সৈন্য সবসময় পাহারায়। এই বাড়িতে নিয়ে আসার পরেই বেগম মুজিব অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।

আটক অবস্থার প্রতিটি দিনই পাহারারত সৈন্যরা নানাভাবে সকলকে হয়রানি ও মানসিক নির্যাতন করেছে। বাড়ির ছাদে উঠে লাফালাফি, প্রত্যেক ঘরের লাইট জ্বালিয়ে রেখে জানালায় রাইফেল তাক করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো।

এমনি নির্মম মানসিক ও শারিরীক নির্যাতনে বন্দী দিনগুলো কাটাতে হয়েছে। বন্দী অবস্থাতেই শেখ জামাল পালিয়ে ভারত চলে যান। অন্তসত্বা শেখ হাসিনা বন্দী অবস্থায়ই আজকের কম্পিউটার বিজ্ঞানী সজীব ওয়াজেদ জয়ের ‘মা’ হন।

ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের চোখের সামনে থেকে স্বামীকে মিলিটারী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, বড় ছেলে মুক্তিসংগ্রামে চলে যান, মেজো ছেলেও বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে চলে যান। স্বামীর বন্দিদশা এবং পাকিস্তানের কারাগারে তাকে হত্যার আশঙ্কা সর্বোপরি নিজেদের বন্দিত্ব ও নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি মুহূর্তের জন্যও ভেঙে পড়েননি, মাথানত করেননি।



অসীম মনোবল, সাহস ও ধৈর্য্য নিয়ে তিনি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় এবং পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর তাদের বন্দিদশার অবসান ঘটলেও বিজয়ের আনন্দ অনুভব করার সুযোগ হয়নি।







স্বাধীন বাংলাদেশঃ নিজেকে অপেক্ষা করতে হয়েছে স্বামীর জন্য এবং দেশবাসীকেও ধৈর্যধারণের জন্য পরামর্শ দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার পরেই কেবল অবসান ঘটে বেগম ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার।

বাঙালি জাতি ফিরে পায় তাদের অবিংসবাদিত প্রিয় নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জাতির সকল ক্রান্তিলগ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখায় ইতিহাসে তাই বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেবল একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিনীই নন। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম এক স্মরণীয় অনুপ্রেরণাদাত্রী।

স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা ও মঙ্গল কামনা করে নিজেকে রেখেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের সকল ক্ষমতার বাইরে। রাষ্ট্রনায়ক স্বামী ব্যস্ত থেকেছেন দেশগড়া ও রাজনীতি নিয়ে। অপরদিকে সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করা, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা, লেখাপড়ার সব দায়িত্বই একজন আদর্শ বাঙালি নারী হিসেবে স্বামীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সন্তানদের গড়ে তোলেন।

রাষ্ট্রনেতা স্বামী যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলে তাঁর পাশে থেকে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, সংসার গড়ার পাশাপাশি বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। বিশেষ করে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক লাঞ্ছিত মা-বোনকে সহযোগিতা ও তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ব্যক্তিগতভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়া; সামাজিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেন। ধীরে ধীরে তিনি অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবনদান করেন।



ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সময় বৈষয়িক কিছুই রেখে যান নি। অথচ ১৫ আগষ্টের পর থেকে দেশে বিদেশে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অশ্লীল কুৎসা রটানো হয়েছে। তেমন একটি বিষয়ের উল্লেখ করেই আজকের লেখা শেষ করবো।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার ১০০টাকার নোট অচল করেছিল। তখন

অর্থমন্ত্রী ছিলেন অধ্যাপক ড এ আর মল্লিক। মল্লিক সাহেবের নিজের কথাতেই এসেছে বিষয়টি। গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য কেবিনেটকেও জানানো হয়নি। রাষ্ট্রপতি ও অর্থমন্ত্রী এই দুজনেই শুধু জানতেন এবং এই কাজের শেষ নাগাদ সম্পন্ন করার বিষয়টিও ছিল খুবই মজার। সে বিষয়ে এখানে আলোচনা করবো না। যখন ১০০ টাকার নোট অচল ঘোষনা করা হয় তার কিছুদিন আগেই বঙ্গবন্ধুর পিতা পরলোকগত হয়েছিলেন। সেজন্য বেগম মুজিব গোপালগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করছিলেন। যথারীতি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলেও রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে কোনো কথা হতোনা।

এরই মধ্যে বেগম মুজিব তার দুই ছেলের বিয়ের জন্য জমানো কিছু টাকা এবং নিকটাত্মীয় ইলিয়াস চৌধুরী(বর্তমান সাংসদ নুর-ই-আলম চৌধুরী লিটন সাহেবের পিতা) এবং শেখ আবু নাসের কিছু টাকা সহযোগিতা হিসেবে দিয়েছিলেন যার মোট পরিমান ছিল ৬৫হাজার টাকা। যা বঙ্গবন্ধুও জানতেন না। এই টাকার পুরোটাই ছিল ১০০ টাকার নোট। বেগম মুজিব ঢাকা ফিরে হতাশ হয়ে পড়লেন এখন কী হবে?



স্বামীরাষ্ট্রপ্রধান সব শুনে বললেন এই টাকা তুমি পেলে কোথায়? প্রশ্নের উত্তরে বাংলার মুকুটহীন সম্রাটের স্ত্রী বললেন, ‘তুমি তো ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারবে না, যা হাতে থাকে তা মানুষকে দিয়ে দাও, দলের নেতা-কর্মীদের দিয়ে দাও, আর নিজে খরচ করে ফেলো। তাই ছেলেমেয়েদের বিয়ের জন্য আত্মীয়-স্বজনরা যে সাহায্য করেছে তাই জমিয়ে রেখেছিলাম।’ বঙ্গবন্ধুর মুখে এইসব কথা শুনে অর্থমন্ত্রী বেগম মুজিবকে ফোন করেন। অপর প্রান্ত থেকে বেগম মুজিব বলেন, ‘ভাই সর্বনাশ করেছেন আমার। এখন আমি ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবো কিভাবে?’ অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘টাকা আপনার গেছে সেটা আর ফেরত পাওয়া যাবেনা। যদিও ব্যাংকে জমা হওয়া টাকায় ৫হাজার টাকার বেশি হলে কৈফিয়ৎ দিয়ে ফেরৎ পাওয়ার ব্যবস্থা করেছি সকলের জন্যই। বিয়ের টাকা নিশ্চয়ই জোগাড় হবে আর জোগাড় না হলে বিনে পয়সাতেই হবে। আর আপনার তো মাত্র ৬৫হাজার গেছে তাও মানুষের সাহায্যের টাকা। অনেকের লক্ষ লক্ষ টাকা আছে কিন্তু ভয়ে জমাও দিতে পারেনি। আপনি রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। এটা উদাহরণ হিসেবে থাকুক যে আপনার টাকাও আমি ফেরৎ দেই নি। বরং টাকাটা বেধে রেখে দেন। পরবর্তী বাজেটের সময় আমি যদি মন্ত্রী থাকি তাহলে ঐ টাকা আমি টেবিলের উপর রেখে দেবো। সকলকে দেখাবো যে রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর টাকাও ফেরৎ দেওয়া হয়নি।’

বঙ্গবন্ধুও অর্থমন্ত্রীকে বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি বলে আলাদা কোনো নিয়ম নাই। আইনে যা আছে সকলের মতো রাষ্ট্রপতির জন্যও তাই। কাজেই আপনি সঠিক কাজই করবেন।

অথচ ১৫ আগষ্টের পরে বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত বাড়িতে এই ৬৫ হাজার টাকাই পাওয়া গিয়েছিল এবং এটাকেই পত্র-পত্রিকায় লুটপাটের চিত্র হিসেবে উপস্থাপন করে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের চরিত্রে কালিমা লেপনের অপপ্রয়াস চলেছিল।

এভাবে এক সময় এ দেশের বুক থেকে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে কালিমালিপ্ত করে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস একদিন সত্যের স্বাক্ষ্য বহন করেই অন্ধকার গহবর থেকে আলোতে বেরিয়ে আসে।



এই মহীয়সী নারী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে গেছেন। জনগণের জন্য সমগ্র জীবন তিনি অকাতরে দুঃখবরণ করেছেন এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার সময় পরিবারের অপরাপর সদস্যদের সাথে বেগম মুজিবকেও মানবতার শত্রু, ঘৃণ্য ঘাতক, দুশমনের দল নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।

অবশ্য পরবর্তীতে প্রকাশিত বিভিন্ন কথায় জানা যায়, রাজা রামমোহন রায় ভারতবর্ষ থেকে সহমরনের প্রথা বাতিল করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বামীঅন্তপ্রাণ স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসের একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, শান্ত, অসীম ধৈর্য ও সাহসী নারী হিসেবে শত্রুর মুখে নিজেকে সপে দিয়ে নিজেই সহমরনের অধিকার আদায় করে নিয়েছিলেন। তাইতো ইতিহাসের বিচারে তিনি বঙ্গমাতা।



বঙ্গমাতার জন্মদিনে এই মহিয়সী নারীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালির আজীবন সুখ-দুঃখের সঙ্গী এই মহিয়সী নারীর একটি

পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচনার দাবি জানাই। যাতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নারীরা নিজেদের দেশপ্রেমিক নারী হিসেবে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের গড়তে পারে।

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:৪৫

শেয়ার পাগল বলেছেন: Click This Link

২| ০৮ ই আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:৫৯

মেনােশদাস বলেছেন: Thanks your post

০৮ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১২:৩২

রুমি আলম বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ অনেক।

৩| ০৮ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১২:০০

দা লর্ড বলেছেন: কোন কালে একা হইনি কো জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়ী লক্ষ্মী নারী।

এই মহিয়সী নারীর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

১০ ই আগস্ট, ২০১২ ভোর ৪:০৬

রুমি আলম বলেছেন: পৃথিবীর যা কিছু সৃষ্টি কল্যানকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

৪| ০৮ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১২:৫০

তীর্থযাত্রী বলেছেন: তিনি একজন মহিয়সী নারী। ত্য্যগই ছিল তার জীবনের ব্রত। তিনি যদি ত্যা স্বীকার না করতে চাইতেন তাহলে বঙ্গবন্ধু এদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিতে পারতেন কিনা সন্দেহ। বঙ্গবন্ধুর অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল বেগম মুজিবের।


জন্মদিনে এই মহিয়সী নারীকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরন করছি।

১০ ই আগস্ট, ২০১২ ভোর ৪:০৭

রুমি আলম বলেছেন: হুম। ইতিহাসও তাই বলে।

ধন্যবাদ আপনাকে।

৫| ০৮ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:৩৪

সাবু ছেেল বলেছেন: আল্লাহ এই মহীয়সী নারীকে জান্নাত নসীব দিনা করুন,আমীন।ইনশাল্লাহ উনি শহীদের মর্যাদা পাবেন।

১০ ই আগস্ট, ২০১২ ভোর ৪:০৯

রুমি আলম বলেছেন: আল্লাহ মহান। নিশ্চয়ই তিনি মঙ্গল করবেন। আমীন।

৬| ০৮ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:৩৭

মেঘনার মোহনা বলেছেন: জন্মদিনে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের প্রতি অনেক অনেক শ্রদ্ধা

১০ ই আগস্ট, ২০১২ ভোর ৪:০৯

রুমি আলম বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.