নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মন রে, কৃষিকাজ জানো না; এমন মানবজমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা! রামপ্রসাদ সেন ([email protected])
"....৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট আমি কোলকাতায় ছিলাম । এ কারণে ব্যক্তিগতভাবে ঢাকায় যে উন্মাদনাময় পরিবেশের মধ্যে পাকিস্তান জন্ম লাভ করে, তাতে আমি অংশ গ্রহণ করতে পারিনি । কিন্তু মিছিল, শোভাযাত্রা ইত্যাদির বিবরণ পড়ে কল্পনার নেত্রে সে দৃশ্য অবলোকন করতে অসুবিধা হয়নি । তার একটা বড় কারণ, আমি নিজেও এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । আমরা বিশ্বাস করতাম যে, ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সমস্যার একমাত্র নির্ভরযোগ্য সমাধান এই উপমহাদেশকে বিভক্ত করে হিন্দু ও মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা । ভাষা বা ভৌগোলিক বৈচিত্রের কোন গুরুত্ব নেই, এ কথা কখনো আমরা বলিনি । কিন্তু ভাষা এবং আঞ্চলিক কালচারের ভিত্তি মেনে নিলে ভারতবর্ষকে অন্ততঃ বিশটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রয়োজন হবে । কারণ 'ভারতীয়তা' বলে কোন বস্তুর অস্তিত্ব ছিল বলে আমরা বিশ্বাস করতাম না । যদি বলা হয় যে, পাঞ্জাবী মুসলিম বা পাঠান মুসলিমের সঙ্গে বাঙ্গালী মুসলিমের তফাত অনেক, এ কথা তো হিন্দু সম্প্রদায় সম্পর্কে আরো সত্য । মুসলমানের ধর্ম বিশ্বাস এবং ধর্মীয় আচার পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিশেষ কোন পার্থক্য লক্ষ্য করা যাবে না । কিন্তু ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু ধর্মের রূপ বিভিন্ন । যে সমস্ত দেবতা দক্ষিণ ভারতে বা পশ্চিম ভারতে অর্চিত হন, বাংলা বা আসামে তাদের কেউ পূজা করে না । রাম উত্তর ভারতে দেবতা বলে স্বীকৃত, বাংলায় তিনি রামায়ণের নায়ক মাত্র । এ রকমের আরো ভিন্নতার কথা উল্লেখ করা যায় । সে জন্য জওহরলাল নেহেরুর মতো যাঁরা সেকুলার ভারতীয়তার কথা বলতেন, তাঁরা প্রকারান্তরে বুঝাতে চাইতেন যে ভারতীয় কালচারের অর্থ হিন্দু ধর্মভিত্তিক কালচার ।
১৯৬২ সালে - '৪৭ সালের ১৫ বছর পর নেহেরুর এক বক্তৃতায় যে কথা স্বকর্ণে শুনেছিলাম, তাতে আমার ঐ উক্তির সমর্থনই ছিল । দিল্লীর এক সভায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন যে, ভারতীয় সংস্কৃতির সৌধ সম্পূর্ণভাবে সংস্কৃত ভাষার উপর প্রতিষ্ঠিত । অবশ্য এ কথাই ৪০-এর দশকে প্রকাশিত তাঁর 'ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া' বইটিতে তিনি আরো সবিস্তারে বিবৃত করেছেন । ভারতবর্ষের যে রূপ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বলে দাবী করেন, তার মধ্যে সাতশ' বছর ধরে ভারতের বুকেই মুসলমানেরা যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলো, তার কোন সন্ধান ছিলো না । এই সত্যের উপরই পাকিস্তান আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে । তাই তখন যে যাই বলুক, ধর্ম বিশ্বাসকে আমরা এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান পরিচয় রূপে স্বীকার করে নিয়েছিলাম এবং এই কারণেই উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের অনেক মুসলমান যেমন পশ্চিম পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলো, তেমনি বিহার-উড়িষ্যা এবং আসাম থেকে বহু মুসলমান বিতাড়িত হয়ে পাকিস্তানে নীড় বাঁধবার চেষ্টা করে । ৭০-৭১ সালে আমরা শুনলাম যে এই নবাগতরা সবই বিদেশী, তাদের না তাড়ালে এ অঞ্চলের আদিবাসীদের পরিত্রাণ নেই ।
আরো দুঃখ্য পেলাম এই ভেবে যে, ১৯৪৭ সালে যারা এক রকম জোর করে আমাদের বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করতে বাধ্য করে এবং যারা তাদের রাষ্ট্রের ঐক্য এবং সংহতির খাতিরে নির্দ্বিধায় হিন্দীকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে, তারাই সেদিন আমাদের শিখিয়েছিলো যে, পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেললেই আমরা সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে রক্ষা পাবো । অথচ দিল্লীর শাসন বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগ দেয়ার কথা কেউ বলেননি ।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ কোন সমস্যা ছিলো না, তা নয় । দুই অঞ্চলের মধ্যে বৃটিশ যুগের দুঃশাসনের কারণে একটা অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়, যার জের পাকিস্তানকে টানতে হয়েছে । ক্লাইভ ১৭৫৭ সালে এ অঞ্চলেই প্রথম বৃটিশ সাম্রাজ্যের পত্তন করেন । তারপরের দেড়শ' বছরের কাহিনী শুধু বঞ্চনা, লুণ্ঠন এবং প্রতারণার কাহিনী - যে কাহিনীর সত্যতা কোনো বৃটিশ বা হিন্দু ঐতিহাসিকও অস্বীকার করেননি । পূর্ব বঙ্গের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী কোলকাতা । সারা পূর্ববঙ্গে শহর বলে কোন কিছু ছিলো না । ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা প্রভৃতি শহরকে আধুনিক অর্থে কেউ শহর বলতো না । আমার বেশ পরিস্কার মনে আছে, পঞ্চাশের দশকে যখন গুলিস্তানের রাস্তা নির্মিত হয়েছে এবং দু' একটা বড় দালান-কোঠা আজিমপুর এবং মতিঝিলে গড়ে উঠেছে, তখন আমার এক আমেরিকান বন্ধুকে নারিন্দা অঞ্চলে নিয়ে গিয়েছিলাম । তিনি মন্তব্য করেছিলেন, আজ রুরাল বেঙ্গল সম্পর্কে একটা আইডিয়া করতে পারলাম । আমি চমকে উঠেছিলাম সত্য, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছিলো যে, ইউরোপ বা আমেরিকাবাসীর কাছে নারিন্দা অঞ্চলের সঙ্গে তাদের পল্লীর তফাৎ থাকতে পারে না । বরঞ্চ অনেক ইউরোপীয় বা আমেরিকান গ্রাম আরো সুন্দর ও সুঠাম । এই ঢাকাই হলো আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ।
অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা লাহোর এবং করাচীর মতো দু'টো বড় শহর পেলো । করাচী অপেক্ষাকৃতভাবে নতুন নগর কিন্তু লাহোরের বয়স পাঁচ ছ'শ বছরের । এ দু'টি শহরই ছিলো দু'টি প্রদেশের রাজধানী । কিন্তু হঠাৎ করে লাহোর এবং করাচীর সঙ্গে ঢাকার বৈষম্যের জন্য দায়ী করা হলো পাকিস্তানকে । আরো বলা হলো যে, পাটের টাকা দিয়ে করাচী এবং লাহোর স্ফীত হয়ে উঠেছে । ঢাকার ভাগ্যে কিছুই জোটেনি ।
১৯৫৬ সালে করাচীতে একদিন হঠাৎ করে একজন বিখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় । তাঁকে ৪৪ সাল থেকেই চিনতাম । আমি যখন ইসলামিয়া কলেজের লেকচারার, শেখ মুজিবুর রহমান তখন সেখানে ছাত্র এবং আমাদের মতো তিনিও এককালে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন । যখন তিনিই বললেন, স্যার দেখেছেন, এলফিন্টস্টোন রোডের সমস্ত চাকচিক্যের মূলে রয়েছে পূর্ব বঙ্গের পাট, আমি বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম, এ নতুন তথ্য তিনি আবিষ্কার করলেন কোথায়? এ রাস্তাটির বয়সও যেমন কমপক্ষে পঞ্চাশ-ষাট বছর, তেমনি দোকানগুলিও প্রাক-পাকিস্তান যুগের । কিন্তু তিনি তখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সবকিছুর মূলে রয়েছে বঞ্চিত, অবহেলিত, শোষিত পূর্ববঙ্গের দান । কিন্তু এই যুক্তি আমরা কীভাবে স্বীকার করি? অথচ ৭১ সালে যে বিস্ফোণ ঘটে, তখন লাখ লাখ তরুণ এই বিশ্বাস নিয়ে সংগ্রামে নেমেছিল যে, পাকিস্তান থেকে শোষণ ছাড়া তারা কিছু প্রত্যাশা করতে পারেনা ।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি আইয়ুব খানের আমলে এক সেমিনারে আঞ্চলিক বৈষম্যের কথা আমি নিজেও তুলেছিলাম । বলেছিলাম যে এ বৈষম্যের ঐতিহাসিক কারণ যাই হোক, বৈষম্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহাওয়া ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে; জনসাধারণের মনে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করা হয়েছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা এই বৈষম্যের হেতু । আমি আরো বলেছিলাম যে, বাস্তব রাজনীতিতে অনেক ক্ষেত্রে সত্যের চাইতে অনুভূতি প্রধান হয়ে ওঠে । পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের এক বিরাট অংশ যেখানে সত্য সত্যই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, বৈষম্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দায়ী, সেখানে অবিলম্বে জাতীয় সংহতির খাতিরে কতকগুলি পদক্ষেপ নেয়া অত্যাবশ্যক । সিনিয়রিটির দোহাই দিয়ে যদি প্রশাসনে এবং মিলিটারিতে কোনো পূর্ব পাকিস্তানীকে স্থান দেয়া না হয়, তবে তার পেছনে যত যুক্তিই দেখানো হোক, তার ফলে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে, পাকিস্তানের ভিত্তিমূল দূর্বল হয়ে উঠবে । কিন্তু বৈষম্যের কারণে পাকিস্তানকে টুকরো করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারতে হবে এই ধারণা বা অাশঙ্কা আমার মাথায় কখনো আসেনি। আমার সে বক্তৃতা পরদিন বড় হরফে ইত্তেফাকে বেরিয়েছিল । "
ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন (সাবেক ভিসি - ঢাবি) / একাত্তরের স্মৃতি [ নতুন সফর প্রকাশনী - নভেম্বর, ১৯৯২ ।
১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৪৬
রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: শুভেচ্ছা!
২| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৫
গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন: চমৎকার শেয়ার !!!
১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৪৭
রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: ধন্যবাদ ।
৩| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:৪৪
তপ্ত সীসা বলেছেন: বাজেটের বরাদ্ধ দরকার আছিলো জনগনের নাম্বার গুইনা। প্রাদেশিক বাজেটের কথা কইতাছি। আর ওরা ভাগ দিতো আয়তন মাইপা। ঘাপলা তো হইবোই ভায়া
১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৪২
রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: যথার্থই বলেছেন । মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৫৪
প্রামানিক বলেছেন: পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ।