![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আকরাম হোসেন: আমি তখন যুক্তরাষ্ট্র রেডক্রসে কাজ করি, ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি আঘাত হানার পর সেখানে গেলাম ত্রাণ দিতে। গিয়ে একটা বিষয় দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম, নামে জেলেপল্লি হলেও এলাকার রাস্তাঘাট, বাড়ি—সবকিছু বেশ উন্নত। ত্রাণ দিতে গিয়ে আরও অবাক হলাম। দেখলাম স্থানীয় উপকূলবাসী বাড়িঘরের চেয়ে মাছের খামারের ক্ষতি নিয়ে বেশি চিন্তিত। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলাম, ওই উপকূলের বেশির ভাগ মানুষ গত এক যুগে মাছ চাষ করে নিজের ভাগ্যের পাশাপাশি এলাকার চেহারাই বদলে ফেলেছে। আমি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবা শুরু করলাম।
২০০৯ সালে দেশে ছুটি কাটাতে গাজীপুরের পৈতৃক বাড়িতে এসে ময়মনসিংহের ভালুকায় গেলাম। সেখানে গিয়ে তো আমি হতবাক, কী ভালুকা কী হয়ে গেছে। পুরো এলাকায় ফসলের মাঠ, বাড়ির উঠান—সবকিছুই মাছের খামার হয়ে গেছে। এত লোক মাছ চাষ করছে, তার মানে এখানে তা লাভজনক। এই চিন্তা থেকে আমি গাজীপুরের শ্রীপুরের দমদমা গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে গেলাম। সেখানে আমাদের ৬০ বিঘা জমি আছে। ওই জমি কিছুটা উঁচু স্থানে। সমতল না হওয়ায় তেমন ফসল হতো না। তখন মাথায় বুদ্ধি এল এখানে মাছের চাষ করলে কেমন হয়। দমদমের পৈতৃক ভিটার মাছ চাষ সম্ভব কি না, তা বোঝার জন্য সেখানকার মাটি নিয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন সংস্থায় পরীক্ষা করতে দিলাম। ফলাফল ইতিবাচক আসায় একটি কঠিন ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিলাম। দেশে ফিরে আসব। আর পেশা হিসেবে মাছ চাষকেই বেছে নেব।
শিকাগোতে ফিরে গিয়ে, সেখানে ছোটখাটো কিছু ব্যবসা ছিল, তা অন্যদের বুঝিয়ে দিয়ে এলাম। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরা জানতে চাইল, দেশে ফিরে কী করব। উত্তরে যখন মাছ চাষের কথা বললাম, তখন শুনে সবাই হাসাহাসি শুরু করল। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে শেষ পর্যন্ত মাছের চাষ? বন্ধুদের নিষেধ, উপহাস সব অগ্রাহ্য করে দেশে ফিরে এলাম। জমিতে পুকুর কেটে তিন বিঘা জমিতে মাছ চাষ শুরু করলাম। ভেতরে স্বপ্নটা অনেক বড় ছিল, কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করিনি।
পাঙাশ মাছের চাষ দিয়েই শুরু করলাম। সবাই বলল, পাঙাশ মাছে বাজে গন্ধ থাকে, এটা খেতে স্বাদের হয় না। আমি বললাম, পাঙাশ মাছের শরীরে জৈবিকভাবে কোনো বাজে গন্ধ নেই। চাষপদ্ধতির সমস্যা ও খাবারের মানের কারণে সমস্যা হতে পারে। দেশে একসময় নদীর পাঙাশ ছিল বড়লোকের খাবার। নব্বইয়ের দশকে দেশে বাণিজ্যিক পাঙাশের চাষ জনপ্রিয় হওয়ার পর দেশে এই মাছের উৎপাদন বাড়ে, দামও কমে। ফলে গরিব মানুষের কাছে এই মাছের জনপ্রিয়তা বাড়ে। কিন্তু এই মাছ দ্রুত বড় করতে গিয়ে অনেক চাষি নিম্নমানের খাবার দেন। আমি পরিকল্পনা নিলাম পাঙাশ মাছের মান এমন জায়গায় নিয়ে যাব যে শুধু ধনীরা নয়, দেশের বাইরেও পাঙাশ রপ্তানি করা যাবে।
মাছের স্বাদ বাড়াতে আমি এর খাবার নিজেই তৈরি করা শুরু করলাম। যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুদের কাছ থেকে পরামর্শ নিলাম। স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তারাও সহযোগিতা করলেন। ভুট্টা, চালকল থেকে আনা তুষ ও চালের কেটে ফেলা ওপরের অংশ, খইল দিয়ে নিজেই মাছের খাবার বানানো শুরু করলাম। কোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করব না, সেই পণ নিলাম। মাছ একটু বড় হওয়ার পর আরেক পুকুরে স্থানান্তর করে এর বৃদ্ধিতে সহায়তা করাসহ বেশকিছু প্রযুক্তি নিজে নিজেই বের করলাম। দেখলাম, এগুলো কাজে দিচ্ছে। মাছের স্বাদ ও উৎপাদন দুই-ই বাড়ছে।
একপর্যায়ে গাজীপুর, উত্তরা, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আমার খামারের মাছের চাহিদা বেড়ে গেল। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকারেরা আমার খামারের মাছ নিতে আসতে শুরু করলেন। আমি প্রতিবছর খামারের আয়তন বাড়াতে থাকলাম। নিত্যনতুন মাছের চাষও করতে থাকলাম। একে একে মৃগেল, শিং, তেলাপিয়া, সরপুঁটি, কালিবাউশ, বিগ্রেড, রুই, সিলভার কার্প মাছের চাষ শুরু করলাম। খামারের মধ্যেই একটি ফিশমিল স্থাপন করলাম, যা এখন প্রতি ঘণ্টায় দুই টন উৎপাদন করতে পারে। খামারের আয়তনও বাড়তে বাড়তে এখন ৮০ বিঘায় গিয়ে ঠেকেছে, পুকুরের সংখ্যা হয়েছে ১৪টি। বেশির ভাগটাই পৈতৃক জমিতে।
খামারের নিরাপত্তা ও অন্যান্য কাজের জন্য ১০ জন কর্মচারী রাখলাম। এ ছাড়া মাছ ধরার জন্য ২০ জন অনিয়মিত জেলেও রাখলাম। খামারের নাম রাখলাম ‘এগ্রো ফার্মা ও ফিশারিজ’। এখন আমার খামারে প্রতি সপ্তাহে এক টন করে মাছ হয়। ওই মাছ কোথাও নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে হয় না। পাইকারেরা অগ্রিম টাকা দিয়ে নিয়ে যান আমার মাছ। দামও অন্যদের চেয়ে ভালো পাই।
শুধু মাছ চাষে আটকে থাকলাম না, এক হাজার হাঁস রয়েছে আমার খামারে। এগুলো থেকে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০ ডিম পাই। ৩০টি গরু রেখেছি খামারে, সেখান থেকে দিনে ৪০ লিটার দুধ আসে। খামারের খাবার খেয়ে গরুগুলো তিন-চার মাসে মোটাতাজা হলে তা বাজারে বিক্রি করে দিই। আবার নতুন করে ছোট গরু কিনি। পুকুরের পাড়ে সবজির বাগান ও ফলের গাছ লাগিয়েছি। সেখান থেকেও আয় মন্দ হয় না। কর্মচারীদের জন্য সবজি ও ফল ফ্রি, তাঁরা যত খুশি খান। এতে আমার খামারে অন্য কেউ চুরি করতে আসে না। কর্মচারীরা তা রোধ করেন।
আমাদের এলাকায় মাছ চাষ একসময় শুধু ভালুকাতেই হতো। এখন তা গাজীপুরেও ছড়িয়ে পড়েছে। এখানকার অনেক তরুণ আমার কাছ থেকে মাছ চাষের কৌশল জানতে আসেন। আমি যা জানি, তা তাঁদের শেখাই। শ্রীপুরের এখন প্রচুর নতুন নতুন মাছের খামার গড়ে উঠছে। অনেকে আমার খামার থেকে মাছের খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। আমি মনে করি, এতে আমার শক্তি আরও বাড়ছে। এলাকার নতুন মাছচাষিদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখছি। গত বছর থেকে আমার খামারে মাছের রেণু উৎপাদন শুরু করেছি। গাজীপুর শুধু নয়, ময়মনসিংহ থেকে অনেকেই আমার কাছ থেকে রেণু নিয়ে যাচ্ছে।
শুরুতে আমি লক্ষ্য স্থির করেছিলাম পাঙাশ মাছকে আরও উন্নত চাষপদ্ধতির মাধ্যমে এর বদনাম ঘোচাব। আমার কাজের স্বীকৃতি আমি পেয়েছি। এ বছর সরকার জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে আমাকে পাঙাশ মাছের জন্য সেরা চাষি হিসেবে পদক দিয়েছে। আমার পাঙাশ মাছের ব্যাপারে বিদেশ থেকে সাড়া পাচ্ছি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার একটি ব্যবসায়িক দল আমার খামার পরিদর্শন করে গেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) মান অনুসরণ করে মত দিয়েছে। আমার মাছের নমুনা তাদের দিয়েছি। তাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে প্রথমবারের মতো দেশ থেকে পাঙাশ মাছ রপ্তানি করব বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে উঠে এসেছে। কিন্তু মাছ রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখনো বড় জায়গা করে নিতে পারেনি। আমি মনে করি, বাংলাদেশে এখন যে পরিমাণ জমিতে মাছের চাষ হয়, তা আরও বাড়ানো সম্ভব। শুধু চিংড়ি মাছ নয়, অন্যান্য চাষের মাছ রপ্তানি করে বিশ্বের মাছের রপ্তানি বাজারেও বাংলাদেশ প্রথম শ্রেণির দেশে নাম লেখাবে। সেই স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছি। আশা করি, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারব।
আকরাম হোসেন, সফল মৎস চাষী, গাজীপুর
মূল লেখা: প্রথম অালো, নভেম্বর ০৪, ২০১৫
লিংক
২| ০১ লা নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৯
টিটু দাস বলেছেন: আকরাম ভাইয়ের নাম্বারটা দেওয়া যাবে। অনেক উপকার হবে
©somewhere in net ltd.
১|
০৯ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৫৭
নতুন বলেছেন: অনুপ্রেরনা পাওয়া যায় এই রকমের মানুষের কাজের কথা শুনলে।