![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জীবনের খেরোখাতাঃ মনসুর আজিজের জীবন -ভাবনা ৷
রায়ান নূর
কবি মনসুর আজিজ সাম্প্রতিক কালে খুব সুন্দর কবিতা লেখেন ৷ তার কবিতার প্রধান অলঙ্কার উপমা ও চিত্রকল্প ৷ তার প্রথম কবিতাগ্রন্থের একটি কবিতা আমার নজর কেড়েছে হঠাৎ 'জীবনের খেরোখাতা'৷কবিতাটি পুরোপুরি উপমা আর চিত্রকল্পে শোভিত ৷
এই কবিতাটি "অতলান্ত নীল চোখ(2002)" শীর্ষক কবিতাগ্রন্থের প্রথম কবিতা ৷কবিতাটি আমার কাছে মনে হয়েছে জীবন-খেয়ায় বিশেষ থেকে সামান্যে প্রত্যাবর্তন ৷কবির জীবন ভাবনার সামষ্টিক চিত্র ও মানবীয় দ্বন্দ্ব প্রতীয়মান এই কবিতায় ৷ কবির ব্যক্তিজীবন কখনো স্বয়ং কখনো প্রতিনিধিত্বশীল এখানে;বিশেষ ভাবে নদীপারের জীবন চিত্রায়িত হয়েছে আলাদা প্রেক্ষিতে ৷
কবিতাটির বচন আধুনিক মননের কিন্তু হৃদয়গ্রাহী ৷ কতগুলো উপমা প্রয়োগ হয়েছে যেগুলো সাহিত্যে নতুন ভাবাপন্ন ৷ আধুনিক নাগরিক জীবনের অন্তর্দহন ও ব্যক্তির দ্বিধাদ্বন্দ্বের স্বরূপ 'জীবনের খেরোখাতা ' কবিতাটি পাঠকের কাছে হয়ত বাহ্যিক ভাবার্থ অন্যভাবে ধরা দিবে কিন্তু তার সমালোচনা করলে তাকে তুচ্ছ বলা হবে না বরং গুঢ়ার্থ নির্ণয় ও পাঠালোচনা সহজ হবে ৷
" অতলান্ত নীল চোখ" এর একটি চোখ অন্তত এখানে দাড়াতে বাধ্য ৷ কয়েকটি উপমা,প্রতীক লক্ষ্য করা যাক—
হিংস্র নখর,হৃদয় নহর,হিংসা বহর,শান্ত দুপুর,
ঘাসকুঁড়ি,নিঃশেষ ধোয়া, খেরোখাতা(দীনবন্ধু মিত্র কর্তৃক ব্যবহৃত শব্দ)
এই উপমাগুলো একবারে নতুন ৷ শব্দ ব্যবহারে কবির দক্ষতা রয়েছে স্বীকার করতে হয় ৷ কিন্তু তার প্রাসঙ্গিকতা আমাদের বিবেচ্য বিষয় ৷ সমালোচনার খাতিরে নয় নির্ঘাত আলোচনাই আমাদের লক্ষ্য কিন্তু সাহিত্যপ্রীতির গারদে কলম আর মনন বাধা ৷
আলোচনাই যেন চুড়ান্ত সমালোচনা ৷ যার সমালোচনা বেশি তার গ্রহণযোগ্যতাও বেশি;কথায় আছে পচামাছের চেয়ে টাটকা মাছের হাঁক বেশি যদিচ ইদানিং ফরমালিন যুক্ত হয়েছে ৷আলোচনা বাড়ানো আমাদের মূল কাজ নয় এর তত্ত্ব উদঘাটন উদ্দেশ্যপ্রথিত ৷ তত্ত্ব ছাড়া কোন সাহিত্যকর্ম হয় না অন্তত আমি স্বীকার করিনা তা নিয়ে আমি একবিংশে একাকিত্বে ভুগছি ৷ তবুও তত্ত্ব পাশ কেটে নজর ফাঁকি দেওয়া কারো সুলভ হয় নি ৷ এবার কবিতাটির শানে নুযুলে যাওয়া আবশ্যক মনে করি ৷
এই কবিতাটিকে শ্রেণিভেদে সাহিত্যে উঁচুদরের ৷কবি মনসুর আজিজ আমার বয়োজ্যেষ্ঠ তবু কলম কেন কাঁপছে না জানি না,হয়ত কবিতাটির জোরে ৷ এই কবিতায় কবির ব্যক্তিজীবনের ইতিবৃত্ত ও অন্তরালে সংসারধর্মের চিত্র খানিকটা ফুটে ওঠেছে ৷ তাছাড়া বিদেশী কতগুলো শব্দ কবিতায় আত্নগত করেছেন নিপূনভাবে যেমন— নহর;মনজিল;জানোয়ার;ফার্নেস ৷
এবার আলোচনায় আসা যাক প্রথম চার পঙ্কতিঃ
①
এলোমেলো হল আজ জীবনের খেরোখাতা
ঢেউ ভাঙে তীর ভাঙে জীবনের স্মৃতি ভেঙে বহু ভাজ
নরম ঘাসের পরে হেটে যায় হিংস্র জানোয়ার
ঘাসকুঁড়ি কেঁপে ওঠে কেঁদে ওঠে কাঁপিয়ে ভুবন ৷
কবির অবসাদগ্রস্ততা আর মানসিক দৈন্যতার একটি দারুন চিত্রকল্প ৷ জীর্ণ পুথির খেরোপাতায় ফু দিলেও তার খেরোপাতা সহজে ওড়ে না ৷কিন্তু এলোমেলো যখন হয়েছে তখন বলতেই হয় নিশ্চয়ই কোন বড় ঝড় গিয়ে থাকবে ৷তার ফলে পুথির পাতা ভেঙে গিয়ে ভাজ হয়ে আছে ৷তার বাধনও কেটে গেছে ৷ তার সমস্ত লেখাগুলো আজ ছিন্নভিন্ন অমিল ৷
অন্যভাবে নদীতে ঝড় আসলে কিংবা জোয়ার আসলে চর বা নদীপারের মানুষের কুটিরের তথাপি সংসারের যেমন ভগ্নদশা হয় তেমন চিত্র ফুটে উঠেছে এই স্তবকে ৷
এটাকে রূপকভাবে নিলে খেরোখাতা হয় জীবন ৷ তাতে প্রকান্ড দৈন্যতা,অসারতা,দ্বিধা দানা বেধেছে ৷ ফলে স্মৃতি হয়েছে হালটানা অর্থাৎ কোন কর্দমাক্ত জমিতে লাঙল বইলে যেমন ভাজ হয় ৷ একটি ভাজ আর একটি ভাজের মাঝে বাতাসের প্রচন্ডতায় পানির অসম স্রোত ৷ পানির তীব্রতায় ভাজ ভেঙে যায়,ঢেউ ভেঙে মিলিয়ে যায় যেন সমস্ত মৃত্তিকা পানিতে একাকার ৷জীবনকে কবি এভাবেই দেখেছেন ৷ দৈন্যতার মোড়কে কবির স্মৃতিশক্তি মুষড়ে গেছে ৷দৈন্যতা মানে এখানে দারিদ্রতা নয় নিজের বিপর্যস্ত বেচেরাগ অবস্থা ৷
নরম ঘাস কবির স্বপ্নের জাগতিক ভাবনা আর তার উপর হেটে যায় হিংস্র জানোয়ার ৷ এটি একটি প্রতীকি অনুসঙ্গ ৷ সংসারে নানা ঘাতপ্রতিঘাত আসে ৷ সমাজে বসবাস করতে হলে নানা অভিযোগ আর এক শ্রেণীর সুযোগসন্ধানী মানুষ দৌরাত্ম্যের আশ্রয় নেয় ফলে জীবন হয় কষ্টসঙ্কুল ৷ আর সংসারের ভিতকে কেঁপে দিয়ে যায় তারা ৷ফলে জন্ম নেয় চরম মনোমালিন্য,অশান্তি আরও নানা অনুষঙ্গ ৷
আবার জানোয়ার এখানে ব্যক্তিজীবনে আঘাত হানা স্বপ্নে কষাঘাত করা দৈব কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে মূল্যায়িত হতে পারে ৷ কবিতাটি যেহেতু একদিকে নদীপারের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে তেমনি আধুনিক ব্যক্তিজীবনের স্বরূপকে নির্মিত করে ৷ জানোয়ার শব্দটির এমন প্রয়োগ আমাদের চিত্তকে আহত করে এবং শব্দচয়নে দূর্বলতম একটা লক্ষণ বটে ৷ তাছাড়া এই স্তবকে মানবজীবনের ক্রমপরিণতিশীল বহুমুখী প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে ৷
দ্বিতীয় স্তবকে
②
ঢেউ ভাঙে জল ভাঙে ভেঙে চলে জীবনের শান্তপুকুর
পাতা নড়ে পাতা ঝরে নড়ে ওঠে শান্তদুপুর
দেহ জুড়ে বয়ে যায় ঝড়ের কাঁপন
খেরোখাতা ছিড়ে যে ছিল আপন ৷
এই স্তবকের সারাংশ কিছুটা বিরোধপূর্ণ আবার বিশ্লেষণভেদে তত্ত্বনির্ভর ৷ এটি প্রথম স্তবকের কারণ ৷ হিংস্র জানোয়ার তার সাহচর্যের মধ্যেই ৷ অর্থাৎ আপন ভাবাপন্নরা কবির জীবনের স্থবিরতার মূল ৷ জল আর ঢেউ অনুষঙ্গে আশা অর্থাৎ ক্ষণিক আত্নতৃপ্তি,কিংবা ক্রমোন্নতি আর স্বপ্ন প্রকাশ পেয়েছে কবিতায় ৷ শান্ত পুকুর বা কবির ক্রমবিকাশমান জীবন বলয়ের আশাগুলো খন্ড খন্ড ভাঙনে যাত্রা শুরু করার পর মধ্যাহ্নে অর্থাৎ শান্ত দুপুরে তার স্বপ্নগুলো ঝরে পড়তে শুরু করে আর সেগুলো তার কোন আপনজনের চক্রান্তে ৷এই স্তবকে কবির মানসিক দ্বন্দ্ব গোচর হয় নিদারুনভাবে
অন্যভাবে নদীপারের পরিবেশ অত্যন্ত আপন কিন্তু কখনো সেই পরিবেশ তাদের কাছে বৈরি হয়ে ওঠে এবং চলিষ্ণু ও বিকাশমান জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে দেয় আর তখন ভবিষ্যৎ হয় অনিশ্চিত ৷
তৃতীয় স্তবকে
③
হিংস্র নখর কতো ছিঁড়ে ফেলে হৃদয় নহর
দুপুরের ঝলকানি ঢেলে দেয় হিংসা বহর
দয়িতার স্বপনের চূড়া ভেঙে মনজিল শেষ
পিদিমেরা কেঁদে ওঠে হায় ফার্নেস ৷
এই স্তবকের সারাংশ এই, জীবন মধ্যাহ্নে হিংসুক হিংস্র পশুর নখের আঘাতে অর্থাৎ আপন দুষ্কৃতির হাতে তার হৃদয়ের সুরাপূর্ণ বা নহরাশ্রিত স্বপ্নের মঞ্জিল ছিন্ন ভিন্ন আর তাই ছোট আশা গুলো পুনরুজ্জীবনের কাছে বিলাপ করে ৷দুপুরের ঝলকানি যৌবনও যেন বেয়ারা হয়ে ওঠে নিসঙ্কোচে শত্রুর মুখোমুখি ৷এখানে নারী কল্পনা স্পষ্টতঃ অন্য পাঠ নেওয়া চলে ৷
আবার অন্যভাবে নদীপারের মানবজীবনের করুন হাহাকার ও সাজানো জীবন তছনছের বিষয়টিও একীভূত ৷গৃহিণীর স্বপ্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে ৷প্রতিপত্তি ও সুখাভিলাষ যেন হিংসুটে রূপ ধারণ করে নিয়তির কাছে পদানত হয়েছে ৷ছোট আশা গুলো তাদের মূলে তাই বিলাপ করে হেন অবস্থার জন্য ৷ মানবজীবনের নিয়তিবাদের পরোক্ষ দৃষ্টান্ত প্রতিফলিত হয়েছে এই স্তবকে ৷
লক্ষ্যত্বঃ বাহ্যিকভাবে কবি নিজের একান্তে কবিতা শুরু করলেও এখানে এসে প্রয়োগ করেছেন বহুজনের কাছে অর্থাৎ ব্যক্তিসত্তার বিলোপ সাধন হয়েছে ৷ তার প্রথম প্রমাণ প্রথম লাইনে 'কতো' শব্দে পাঠকের কাছে তা উন্মোচিত হয়েছে ৷
আবার দুপুরের ঝলকানি বলতে পুনরুজ্জীবনকে নির্দেশ করেছেন কিন্তু এমনভাবে প্রয়োগ করছেন যেন কবি নিজেই অন্যকে হিংসা করছেন ৷ তার প্রমাণ তৃতীয় লাইনে দয়িতা(নারী) শব্দে উন্মোচিত হয়েছে ৷এখানে নারীর যৌনতাও প্রাসঙ্গিক ভাবে উপস্থাপন করেছেন কবি ৷ আগেই বলা হয়েছিল এই কবিতা বিশেষ থেকে সামান্যে প্রত্যাবর্তন ৷কবি প্রথমে নিজে আত্মপ্রকাশ করলেও আর নিজ থাকেননি বরং মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন ৷ এই স্তবকে তাই একজন নারী হিসেবেও কবি আত্নপ্রকাশ করেছেন আবার শত্রু হিসেবেও আত্নপ্রকাশ করেছেন যা আপাত বিরোধাভাস ৷ কবি এখানে ইঙ্গিত সূচক কোন বাক্য ব্যবহার করেন নি অস্পষ্টতা দুর করার জন্য ৷ দুপুরের ঝলকানিকে যদি ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করি তবে প্রথম লাইনটি অর্থহীন মনে হয় কিন্তু যৌবন হিসেবে গ্রহণ করলে চরিতার্থের নিকৃষ্টতম দিক দৃষ্টিগোচর হয় ৷
চতুর্থ লাইনে পিদিমেরা শব্দটি বহুবচন করে সংহত একটা ভাবকে আবারও বিতর্কিত করেছেন ৷চিত্রকল্পের খাতিরে পাঠকের কাছে এর সুক্ষ্ণ বিষয় অনুভূত হওয়ার কথা ন়য় বরং আবেগটাকে প্রাধান্য দিয়েছেন কবি ৷ এটা কবির নারীরূপ কল্পনা যা দয়িতা শব্দে দৃষ্টিগোচর হয়েছে ৷
চতুর্থ স্তবকেঃ
④
হুকা থেকে উড়ে আসে নিঃশেষ ধোঁয়া
হায় কেন সাধ হল খেরোখাতা ছোঁয়া ৷
দুই লাইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ হল হুকার ধোঁয়া নিঃশেষ হয়েছে অর্থাৎ জীবনে সায়াহ্নের আগমন আর কবির ভুল যে অন্যের খেরোখাতা ছুয়েঁ ফেলা ৷অন্যভাবে জীবনের অপ্রাপ্তির বেদনা ও রিক্ততা কবিকে অনুশোচনায় নিমজ্জিত করেছে সংসারে আবদ্ধ হওয়ার খাতিরে ৷
পাঠ বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় 'জীবনের খেরোখাতা' যে শুধু কবির একার খাতা নয় তার সাথে জড়িয়ে আছে মলাটবন্দী আরেক খাতা ৷
পরস্পর বিরোধের কারণে দুইজনই যে নিভু নিভু অর্থাৎ সংসারে আবদ্ধ তা পরস্পর বিরোধী ভাষ্যে উন্মোচিত হয়েছে ৷ একজন ছিঁড়ে ফেলে যন্ত্রনা দিয়েছে আর একজন ছুঁয়ে যন্ত্রনা পেয়েছে ৷ কবি হয়ত কল্পনা করতে পারেন নি যে তিনি নিজেই শত্রুবেশে সংসারধর্মে প্রতিনিধিত্বশীল নায়ক ৷
কবিতার ভাবগত দিকটা সম্পূর্ণ নতুন ও বিরোধভাবে ভরপুর ৷ এর আগে এ রকম কবিতা কমই লিখিত হয়েছে ৷ মানুবজীবনের অগ্রযাত্রায় সংসার যে উপযাচক তাই কবির ভাষ্য ছিল এই কবিতায় ৷
প্রতিকী ও রূপকে কবিতাটির অর্থগত ভাব সংহত ৷
কিন্তু বাহ্যিকভাবে পরস্পর বিরোধী একটা দ্বন্দ্বময় চিত্র ফুটে উঠেছে এ কবিতায় যা উপরে আলোচনায় এসেছে ৷এই কবিতায় যতিচিহ্ন প্রয়োগে কবি দক্ষতার পরিচয় ততটা দেননি বরং অনীহা ফুটে উঠেছে ৷প্রবাহমান মুক্তকছন্দে কবিতা লেখার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেলেও তার সফলতা কিঞ্চিত কেবল শেষ স্তবকের মাঝে দৃষ্টতঃ৷ বলা চলে এর অর্থগত ভাব কবির নিতান্ত কাকতালীয় ও সাধারণ ভাবটা কবির কল্পনাপ্রসূত নচেৎ বাহ্যিক বিরোধ আপাত কারও কাম্য ছিল না ৷যেহেতু কবিতাটি কবির প্রাথমিক জীবনের সে বিচারে কবিতাটিকে অনন্য বলতেই হয় ৷এ কবিতাগ্রন্থের সারাংশ এই কবিতাটি বহন করে ৷শিল্পগত ভাবে এই কবিতার ভাষাকে বলা চলে ঘাটবাধা সরল ৷
©somewhere in net ltd.