![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বিশ্বাস করি শান্তিই শক্তি। আনন্দের স্বপ্নকে সৃষ্টি করতে চাই।
বই আলোচনা: বাংলাদেশের অর্থনীতি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ
সামিও শীশ, রাদিয়া তামিম
বাংলাদেশের অর্থনীতি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ
লেখক।। এম.এম.আকাশ
প্রকাশক।। প্যাপিরাস
প্রকাশকাল।। ফেব্র“য়ারি ২০০৪
মূল্য।। ২০০.০০টাকা
ISBN: 984-8065-32-6
‘বাংলাদেশের অর্থনীতি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ’ বইটি বাংলাদেশের অর্থনীতি বিষয়ক দশটি প্রবন্ধের সংকলন। বইটির নামকরণ থেকে এ ধারণাটি করা যায়, এ সংকলনটিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ভবিষ্যৎ দিক-নির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনার আগে এ সংকলনের লেখক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, সুবক্তা, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এম.এম.আকাশ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক ক’টি কথা বলে নেয়া প্রয়োজন। গ্রন্থের লেখক হচ্ছেন বাংলাদেশের সেই প্রজন্মের মানুষ যারা কিশোর বয়সে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই স্বপ্নের প্রতি নানা ঘাত-প্রতিঘাত পরেও তারা মুক্তির পথ অন্বেষণ করে চলেছেন সক্রিয়ভাবে। সেই মুক্তির পথ অন্বেষণকারী সহযাত্রীদের জন্যে এ সংকলন- ভূমিকায় লেখক সেই কথা ব্যক্ত করেছেন। এ সংকলনটি তথাকথিত নির্মোহ, নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ নয়, বরং লেখক স্পষ্ট করেই তাঁর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ভাবনার কথা প্রকাশ করেছেন এবং যুক্তি,তর্ক, তথ্য দিয়ে তা বিশ্লেষণ করেছেন।
বইটির প্রবন্ধগুলো তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায় ‘বাংলাদেশ: ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ’এ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে তিনটি প্রবন্ধে; ক. এশিয়াটিক উৎপাদন পদ্ধতি এবং বাংলায় পুঁজিবাদের উন্মেষ, খ. বাংলায় ঔপনিবেশিক শোষণ: অবরুদ্ধ বিকাশ, গ. আধা-ঔপনিবেশিক শোষণ: পাকিস্তান আমল। ‘স্বনির্ভর সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের’ পরিবর্তে বাংলাদেশে বর্তমানে কায়েম হচ্ছে একটি নিকৃষ্ট ধরনের পরনির্ভরশীল পুঁজিবাদ- সেই বিষয়টিই বইটির দ্বিতীয় অধ্যায় ‘পরনির্ভরশীল বাংলাদেশ’ এর তিনটি প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে; প্রবন্ধ তিনটি হচ্ছে, ক. স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্পায়ন কৌশল: সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা, খ. পরনির্ভরশীল পুঁজিবাদের মডেল ও বাংলাদেশ, গ. লুটেরা ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ডায়নামিক্স। বইটির প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের আলোচনা যেখানে শেষ, তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচনা সেখান থেকেই শুরু। যেখানে অতীতের ‘ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ’ বা বর্তমানের ‘পরনির্ভরশীল লুটেরা পুঁজিবাদ’ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমস্যার সমাধান দিতে পারছে না সেখানে অর্থনৈতিক মুক্তির সম্ভাব্য পথ হিসেবে ‘অপুঁজিবাদী পথের’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে তৃতীয় অধ্যায় ‘মুক্তির অন্বেষায় বাংলাদেশ’এর চারটি প্রবন্ধে; ক. অপুঁজিবাদী পথ ও তৃতীয় বিশ্ব, খ. বাংলাদেশের উন্নয়ন: পথ নির্ণয় সমস্যা ও প্রাসঙ্গিক বিতর্কসমূহ, গ. বাংলাদেশ: উন্নয়ন সমস্যা ও সম্ভাবনা, ঘ. বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন। বর্তমান রচনায় বইটির মূলতঃ প্রথম অধ্যায়টি নিয়ে বিস্তারিত, পরবর্তী দুই অধ্যায় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল।
প্রথম অধ্যায়, বাংলাদেশ: ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ
এই অধ্যায়ের প্রবন্ধগুলোতে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে কী ভাবে তৎকালিন অবিভক্ত বাংলায় দেশীয় পুঁজিবাদী উন্নয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল আর কী করে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনের যাঁতাকলে নিষ্ঠুরভাবে সেই সম্ভাবনা হত্যা হয়ে একটি ঔপনিবেশিক ধারার পুঁজিবাদের জন্ম হল এবং ব্রিটিশ বিদায়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা দ্বিতীয় দফা ঔপনিবেশিক শাসনের চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশ: ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ’ প্রবন্ধটি মূলতঃ তিনটি প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রশ্নগুলো হচ্ছেঃ
“বাংলায় ব্রিটিশ প্রভুত্ব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বাংলার উৎপাদন পদ্ধতির স্বরূপ কী ছিল? এই উৎপাদন পদ্ধতি কি স্থির ছিল না সচল ছিল? সচলতা থাকলে তার স্বতঃস্ফূর্ত অভিমুখীনতা কোন দিকে ছিল? ব্রিটিশ বিজয়ের ফলে বাংলার বিরাজমান উৎপাদন পদ্ধতির ক্ষেত্রে কী ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল?”
এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে প্রথমেই ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে বাংলার অর্থনীতির উৎপাদন ব্যবস্থাকে এশিয়াটিক উৎপাদন পদ্ধতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল গ্রন্থের পাশাপাশি ভারত সম্পর্কিত লেখা ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ ও ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনে ভবিষ্যৎ ফলাফল’ এই দুইটি প্রবন্ধকে লেখক বিশেষ গুরুত্বের সাথে আলোচনার সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ব্রিটিশ ‘কমন্স সভার’ পুরানো দলিলের উদ্ধৃতি দিয়ে কার্ল মার্কস দেখিয়েছেন যে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারতের অসংখ্য বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর ভিতরে শ্রমবিভাজন ছিল খুবই আদিম এবং সরল ধরনের। তখন গ্রামের কুটির শিল্পী ও চাষীদের মধ্যে যে পণ্য বিনিময় করতে টাকার প্রয়োজন হত না, একটি অভ্যন্তরীণ স্বাভাবিক বিনিময়ই গ্রামগুলোকে স্বনির্ভর করে রেখেছিল। যদিও এর কালক্ষণ তিনি উল্লেখ করেননি। লেখক এম.এম.আকাশ এর পরেই যে প্রশ্নটি তুলেছেন তা হচ্ছে, “এশিয়াটিক সমাজ কি কোনো অটল-অনড় ব্যবস্থা এবং ব্রিটিশ আসার পূর্ব মুহূর্তে তা কি এই একই অবস্থায় ছিল?”- এ প্রশ্নের উত্তর তিনি পরবর্তীতে সন্ধান করেছেন।
তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণমূলক এ প্রবন্ধটিতে লেখক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে ১৬০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে বাংলাদেশে পুঁজিবাদের উন্মেষ হয়েছিল। এশিয়াটিক সমাজ একটি অনড়, অটল ব্যবস্থা নয়- বরং তার গর্ভেই পুঁজিবাদের জন্ম হচ্ছিল। তখন শহর- গ্রামের মাঝে পণ্য বিনিময়ের প্রচলন, বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার, বণিক পুঁজির উদ্ভব, কারিগর শ্রেণীর উপর পুঁজির প্রভাব বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে। সেই সাথে সাথে ফসল খাজনার মুদ্রা খাজনায় রূপান্তরকরণের ফলে কৃষকদের নিঃস্বকরণ ও মহাজনী পুঁজির বিকাশ ঘটে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে ভূমি দখলদারিত্বের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ভূমিমালিকানা স্বত্বের উদ্ভব হয়। একই সঙ্গে গ্রামের স্বতঃস্ফূর্ত শ্রমবিভাজন প্রক্রিয়ার বিকাশের জন্যে কৃষির সাথে শিল্পের বিচ্ছেদ ঘটে। আর বিলাসী ভূস্বামী ও রাজধানীর শাসকশ্রেণীর বিলাস চাহিদা পূরণ করতে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের উদ্ভব হয়। উল্লেখিত লক্ষণগুলো অনেকটাই প্রমাণ করে যে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বেই এই অঞ্চলে পুঁজির বিকাশের সম্ভাবনা ছিল। আর ভারতের মাঝে অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের ক্ষেত্রে বাংলার ঈর্ষণীয় অবস্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক অনেক ঐতিহাসিক তথ্য উপস্থাপন করেছেন, উদাহরণ স্বরূপ মোগল সাম্রাজ্যের সায়াহ্নে আওরঙ্গজেবের চিকিৎসকের উদ্ধৃতি, “ফ্রান্সে বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বাংলাই সবচেয়ে সুপরিচিত। যে বিশাল ধন-রতœ এই দেশ থেকে ইউরোপে পরিবাহিত হয় সেটাই দেশের এক উর্বরতার প্রমাণ। আমরা হয়তো একথাও বলতে পারি যে এই দেশটি মিসরের চেয়ে কোনো অংশেই খাটো নয়, বরং এই দেশের সিল্ক তুলা, চিনি এবং নীল উৎপাদন মিসরকেও অতিক্রম করে যায়। সবকিছুই এখানে প্রচুর; এখানে আছে প্রচুর ফল, ডাল, খাদ্যশস্য, মসলিন, সোনালী বস্ত্র এবং সিল্ক।” প্রাচুর্যের সাথে সাথে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথাও এসেছে, লর্ড ক্লাইভ ১৭৫৭ সালে বিজয়গর্বে বাংলার পুরাতন রাজধানী মুর্শিদাবাদে প্রবেশের সময় লিখেছিলেন, “নগরটি (মুর্শিদাবাদ) লন্ডন নগরীর মতোই সমান সম্পদশালী এবং জনবহুল। তবে একটি পার্থক্য হচ্ছে নগরীটিতে (মুর্শিদাবাদে) এমন কয়েকজন ব্যক্তি আছে যারা শেষোক্ত নগরবাসীর (লন্ডনবাসীর) চেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশি সম্পত্তির অধিকারী।”
এমনি তথ্য, প্রমাণ, যুক্তি দিয়ে লেখক ব্রিটিশ পূর্ব প্রাচীন বাংলায় পুঁজিবাদের উত্তরণের একটি ঐতিহাসিক সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছেন। তবে ঐতিহাসিক সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি একথাও বলেছেন যে ইতিবাচক সম্ভাবনাকে অনিবার্য হিসেবে মেনে নেওয়াটাও ঠিক হবে না। যেমন, তখনকার বণিকদের প্রাচুর্য নির্ভর করত রাজন্যবর্গের বিলাসপণ্য চাহিদার উপর। তাই ক্ষয়িষ্ণু মুঘল সাম্রাজ্যের সময় রাজাদের মতো বণিকদেরও ভাগ্য অবনতিশীল হয়ে পড়ে। এছাড়া বাংলায় বা ভারতেও উন্নতি প্রযুক্তির অভাবে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম ছিল, আর তাই বিনিময়যোগ্য উদ্বৃত্তের অভাব পুঁজিবাদের উত্তরণের সম্ভাবনাকে হ্র্সা করে দেয়। সেই সাথে তৎকালিন ভারতীয় বণিকেরা মিউনিসিপ্যাল শহর গড়ে তুলে নিজেদের শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান গড়ে তুলতে না পারায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিরাপত্তাহীনতা ছিল যার কারণে বাংলার/ভারতের বণিকশ্রেণী পুঁজিবাদ গড়ে তোলার জন্যে খুব উৎসাহিত হয় না।
সংকলনের দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘বাংলায় ঔপনিবেশিক শোষণ: অবরুদ্ধ বিকাশ’ এ লেখক দেখিয়েছেন যে কী করে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনের যাঁতাকল নির্মমভাবে বাংলায় পুঁজির বিকাশকে হত্যা করে একটি ঔপনিবেশিক ধাঁচের বিকৃত পুঁজিবাদের জন্ম দেয়। ১৭৫৭ সালে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ইংরেজরা অবাধ ও অন্যায্যভাবে পণ্য বাণিজ্যের সুযোগ দেশীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ প্রজাদের প্রচণ্ড ক্ষতি করে , উদাহরণস্বরূপ নওয়াব মীর কাশেমের উদ্ধৃতি: “প্রতিটি পরগণায়, প্রতিটি গ্রাম এবং প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে তারা (ইংরেজ) লবণ, সুপারি, ঘি, চাল, খড়, বাঁশ, মাছ, চট, রশুন, চিনি, তামাক, আফিম ও অনেক ধরনের জিনিস কিনছে ও বিক্রি করছে। তারা মাত্র সিকি ভাগ দাম দিয়ে রায়ত এবং ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে বলপূর্বক পণ্যদ্রব্য ছিনিয়ে নেয়। . . . তারা যে পণ্যের দাম মাত্র এক টাকা, সেই পণ্য রায়তকে পাঁচ টাকায় কিনতে বাধ্য করে . . . প্রায় ৪০০ নতুন ফ্যাক্টরি বসানো হয়েছে। . . . তারা প্রকাশ্যে সরকারকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। তারা আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক।” এখানে আরও উল্লেখ্য, মীর কাশেম কোম্পানিকে তার বাণিজ্যের জন্য ৯ শতাংশ কর আর দেশীয় বণিকদের জন্য ২৫ শতাংশ করের বিধি রাখলেও- এই সুবিধাতেও কোম্পানি সন্তুষ্ট হয় না। নবাবকে সান্ত্বনা দিতে শুধুমাত্র লবণের বিক্রয়মূল্যের উপর সর্বোচ্চ ২.৫ শতাংশ কর দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। সুচতুর মীর কাশেম এর প্রত্যুত্তরে দেশী ব্যবসায়ীদের উপর থেকে সকল কর প্রত্যাহারের নীতি ঘোষণা করলেও সামরিক ও সমর প্রযুক্তির কারণে তার উদ্দেশ্য সফল হয় না বরং ১৭৬৮ সালে বকসারের যুদ্ধে মীর কাশেম পরাজিত হন আর বাংলায় ব্রিটিশ কোম্পানির প্রশাসনিক ক্ষমতা আর বেড়ে যায়। আবার, ১৭০০-১৮১৩ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নেতৃত্বে যে ভয়ংকর লুণ্ঠন চলে তা বাংলার মসলিন ও সিল্ক শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়। তার সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে রাজস্বের বোঝা কৃষকদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এই সময় ১৭৭০ সালের দিকে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
তবে মার্কস ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকে ধ্বংসাত্মক ও সৃজনশীল এই দুই বৈপরিত্যের কথাই বলেছেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে প্রাথমিক লুণ্ঠনের পরে উন্নত প্রযুক্তি ও পুঁজির কারণে কিছু ইতিবাচক লক্ষণ সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয়। প্রায় সাড়ে সাত কোটি পাউন্ড পুঁজি নিয়োগ করা হয় সারা ভারতে রেললাইন গড়ে তোলার জন্যে। রেললাইন গড়ে ওঠার তাৎপর্য বলতে গিয়ে মার্কস বলেছিলেন যে রেল যোগাযোগকে কেন্দ্র করে ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য দৃঢ়তর হবে, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে, আধুনিক কলকারখানা গড়ে উঠবে, স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ ব্যবস্থার সমাপ্তি হবে, প্রাচীন বর্ণপ্রথা, সংস্কারের অবসান হবে, আধুনিক শিক্ষিত জনবল গড়ে উঠবে ইত্যাদি। এসময় কিছু কিছু উচ্চশিক্ষিত বাঙালি স্বদেশপ্রেমিক অভিজাত বিত্তশালী পরিবারের লোকেরা শিল্পস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যেমন কিশোরী লাল মুখার্জির ‘আয়রন ওয়ার্কস’, জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতা আনন্দমোহন বসুর ব্যাংক, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানি,বঙ্গলক্ষী কটন মিল, ডাঃ নীল রতন সরকারের ন্যাশনাল ট্যানারি ও সাবান কারখানা, মোহিনী বাবুর বিখ্যাত মোহিনী মিল। তবে এরা কেউই জাত ব্যবসায়ী ছিলেন না এবং এই শিল্প কারখানাগুলো খুব দীর্ঘস্থায়ী ছিল না।
সৃজন ও ধ্বংসের দ্বৈত প্রক্রিয়ার আলোচনার উপসংসাহের লেখকের বক্তব্য রাখেন, “ বৃহত্তর বাংলা তথা পূর্ব বাংলা ছিল ব্রিটিশ সিংহের প্রথম শিকার। ফলে বাংলার সংহার পর্বটি রচিত হয়েছিল তীব্র নিষ্ঠুরতার সাথে। কিন্তু সৃজন পর্বটি রয়ে গিয়েছিল অর্ধসমাপ্ত। আজও এই বেদনার উত্তরাধিকার আমরা কম বেশি বহন করে চলেছি।”
ব্রিটিশ শাসনের পরে পাকিস্তান আমলের অর্থনৈতিক নিষ্পেশনের বর্ণনা করেছেন ‘আধা-ঔপনিবেশিক শোষণ: পাকিস্তান আমল’ প্রবন্ধে। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের তুলনা করেছেন যা পূর্ব বাংলার শোষণের চিত্র স্পষ্ট করে তোলে। যেমন, কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য অতি প্রয়োজনীয় জলসেচ ব্যবস্থা এবং কৃষি উপকরণ কেনার জন্য পর্যাপ্ত ঋণ ব্যবস্থা। বাস্তবে এই দুইদিক থেকেই পূর্ব বাংলার কৃষি কতটা অবহেলিত ছিল লেখক তথ্য, উপাত্ত দিয়ে তা ব্যাখ্যা করেছেন। আর শিল্পের ক্ষেত্রে বলা যায়, দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিল্প-উত্তরাধিকারটি ছিল খুবই দুর্বল। এখানে লেখক উল্লেখ করেছেন, “পাকিস্তান সৃষ্টির পর সমগ্র পাকিস্তানের ভাগে পড়ে মাত্র ২.৮ হাজার প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ভারতের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মাত্র শতকরা ১১ ভাগ। তবে এই শতকরা ১১ ভাগ প্রতিষ্ঠানের আদায়কৃত মূলধনের পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট মূলধনের শতকরা মাত্র ২.৫ ভাগ। আবার পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বাংলার অবস্থা ছিল আরো করুণ। পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১.৩ হাজার অর্থাৎ মোট প্রতিষ্ঠানের ৪৬ শতাংশ এবং আদায়কৃত মূলধনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি টাকা অর্থাৎ পাকিস্তানের মোট মূলধনের মাত্র শতকরা ৫ ভাগ। স্মরণ করা যেতে পারে যে, এই সময় পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৫ভাগ পূর্ব বাংলায় বসবাস করতো।” (পৃ. ৬৯) একে দুর্বল উত্তরাধিকার সেই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণে তৎকালিন পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের কৃষি শিল্পসহ পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কতটা ও কী করে করুণ পরিণতি বরণ করে তা লেখক বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে। উপসংহারে লেখক মন্তব্য করেছেন যে পূর্ব বাংলার থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পাচার হওয়া সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩১২কোটি টাকা যা গড়ে প্রতিবছর পূর্ব বাংলার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ১০ শতাংশ।
দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘পরনির্ভরশীল বাংলাদেশ’
বইটির লেখকের রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা সকলেরই জানা আছে। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল ‘স্বনির্ভর সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে ওঠার আশা নিয়ে। কিন্তু সে আশা ভঙ্গ করে কী করে একটি নিকৃষ্ট ধরনের পরনির্ভরশীল পুঁজিবাদ স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে গড়ে ওঠে সে চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭১-১৯৭৫ কালপর্বের শিল্পায়ন কৌশলের অসংগতি ও দুর্বলতা তুলে ধরা হয়েছে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্পায়ন কৌশল: সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা’ প্রবন্ধে। জাতীয়করণ নীতি ও প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়া এবং একটি অবাধ ধনবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণ অনুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এই লেখাটিতে। পরবর্তী প্রবন্ধ ‘পরনির্ভরশীল পুঁজিবাদের মডেল ও বাংলাদেশ’ এ লেখক ১৯৮০-৯০ সামরিক শাসনকালে পরনির্ভরশীল পুঁজিবাদের আগ্রাসন এবং এখানে জনপ্রিয় নমুনা হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিংগাপুর, হংকংকে অনুসরণ করার বিষয়ে সে ব্যাপক প্রচারণা করা হয়- তার অসারতা অত্যন্ত সাবলীলভাবে লেখক তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষ প্রবন্ধ ‘লুটেরা ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ডায়নামিক্স’ লেখক বর্তমানে যে পরনির্ভরশীল পুঁজিবাদের জন্ম হয়েছে তার অনিবার্য সংকটসমূহের কথা বলা হয়েছে। এখানে মন্তব্যও করা হয়েছে যে বৈদেশিক সাহায্য প্রবাহ কমার ফলে এই লুটেরা পুঁজিবাদ এর আয়ুও ফুরিয়ে যেতে বাধ্য।
তৃতীয় অধ্যায় ‘মুক্তির অন্বেষায় বাংলাদেশ’
প্রথম দুইটি অধ্যায়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির ঐতিহাসিক পটভূমি এবং বর্তমান পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে বক্তব্য যেখানে শেষ করা হয়েছে, তৃতীয় অধ্যায়টির আলোচনা শুরু করা হয়েছে সেখান থেকেই। এ অধ্যায়ের প্রবন্ধগুলোতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে ‘ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ’ বা ‘পরনির্ভরশীল লুটেরা পুঁজিবাদ’ কোনটিই বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যার সমাধান পারবে না, একই সাথে পুঁজিবাদীপথের সম্ভাব্য বিপদকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে, ‘অপুঁজিবাদী পথ’ই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ হতে পারে সেই সম্ভাব্যতা সম্বন্ধে লেখক লিখেছেন ‘অপুঁজিবাদী পথ ও তৃতীয় বিশ্ব’ প্রবন্ধে। পরবর্তী প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন: পথ নির্ণয় সমস্যা ও প্রাসঙ্গিক বিতর্কসমূহ’ একটি বিতর্কমূলক (বিতর্কিত নয়) প্রবন্ধ। নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের পর ‘বাংলাদেশে উৎপাদনশীল ধনতন্ত্র নির্মাণ সম্ভব কি অসম্ভব’ শীর্ষক একটি প্রাণবন্ত এবং সমৃদ্ধ বিতর্ক হয়েছিল অধ্যাপক আনিসুর রহমান এবং ড. আবু আব্দুল্লাহ্র মধ্যে। সেই বিতর্কের একটি চমৎকার বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরিখে একটি ইতিবাচক উন্নয়ন কৌশলের সম্ভাব্য রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে এ অধ্যায়ের তৃতীয় প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশ: উন্নয়ন সমস্যা ও সম্ভাবনা’তে । আর বইটির শেষ প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন’ প্রবন্ধে মানব-উন্নয়নের আলোকে প্রকৃত উন্নয়নের স্বরূপ তুলে ধরেছেন লেখক। ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয়েরই ইতিবাচক একটি সংযোগের দিক নির্দেশনা মিলবে এ প্রবন্ধটিতে। প্রচলিত ভুল ধারণাসমূহ যেমন, ধনতন্ত্র ও বাজার অথবা রাষ্ট্রীয় হুকুম ভিত্তিক পরিকল্পনা ও সমাজতন্ত্র সমার্থক বিষয়ে পাঠককে একটি নতুন দৃষ্টি দিতে পারে এই প্রবন্ধ। এ প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন, “বিপ্লবী শক্তি ক্ষমতাগ্রহণের পরেও অনেক দিন পর্যন্ত বাজার ও রাষ্ট্রের পরস্পর পরিপূরক ও দ্বান্দ্বিক ভূমিকার মাঝে সঠিক ভারসাম্য বজায় রেখে চক্রানুক্রমিক উন্নতির পথানুসন্ধানই হচ্ছে একবিংশ শতকের প্রধান শিক্ষা।”
নানা যুক্তি,তর্কের সাথে সাথে বোধগম্য ভাষায় রচিত এ অধ্যায়টি চিন্তাশীল পাঠকদের জন্যে চিন্তার খোরাক যোগাতে সক্ষম। বিশেষ করে ইতিহাসের নিরিখে যারা বাংলাদেশের সাধারণ জনসাধারণের প্রতি যে অর্থনৈতিক শোষণ হয়েছে সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পেতে চান, তাদের জন্যে বইটির প্রথম অধ্যায়টির তিনটি প্রবন্ধ অত্যন্ত সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে বর্তমানের স্বাধীন বাংলাদেশ - এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে আমাদের অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চণার কৌশল ও স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা পেতে এবং সেই সাথে বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বইটির প্রথম দুইটি অধ্যায় অনেক সাহায্য করতে পারে। সেই সাথে প্রচলিত উন্নয়ন চিন্তা-ভাবনার বাইরে নতুন করে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক নির্দেশনা পেতে পারেন তৃতীয় অধ্যায়ে। বইটির প্রতিটি প্রবন্ধ অত্যন্ত সুলিখিত। অর্থনীতির জটিল বিষয়সমূহকে অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জলভাষায় লেখক ব্যাখ্যা করেছেন। চিন্তা ও মননশীল পাঠকদের জন্যে প্রবন্ধগুলো অত্যন্ত জরুরী পাঠ্য হিসেবে বিবেচনা করি।
২| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৯:৫৬
হানিফ রাশেদীন বলেছেন: অনেক ভাল লাগলো, সামিও ভাই।
২৬ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১০:৫৮
সামিও শীশ বলেছেন: ধন্যবাদ।
৩| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ৯:১৯
রায়হান মাহমুদ বলেছেন: অনেক ভাল লাগল। সত্যিকারার্থে একটি গঠনমূলক বই
২৭ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১০:৫৯
সামিও শীশ বলেছেন: ধন্যবাদ।
৪| ২৮ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১১:৪৯
অডং চাকমা বলেছেন: ধন্যবাদ।
পড়লাম বই আলোচনা। আশা করছি বইটা কিনে নেবো এবং পড়বো। কেবল বই আলোচনা না করে সমালোচনা করলে আরো ধারনা পেতাম। হ্যাঁ, লেখকের সাথে একমত, "
ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদ’ বা ‘পরনির্ভরশীল লুটেরা পুঁজিবাদ’ কোনটিই বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যার সমাধান পারবে না, ... অপুঁজিবাদী পথ’ই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ হতে পারে'' ।
বিতর্কমূলক উন্নয়ন উপায়গুলোর উপর বিতর্ক চলতে পারে। সেই অপুঁজিবাদী পথটাই কি বিতর্ক করা যেতে পারে। সেই বিতর্কের সাথে এটাও আলোচনায় আনা যায়, কেন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে 'পরনির্ভরশীল লুটেরা মানসিকতা' প্রবলভাবে বিদ্যমান? যদিও সরাসরি অর্থনীতির সাথে জড়িত নয়, তবে এ মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টির অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর অনেক গুরুত্ব রয়েছে।
২৯ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৮:৫৩
সামিও শীশ বলেছেন: আপনার প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব পুঁজিবাদ আমাদের যে সব জায়গায় আঘাত করেছে তার মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে চিন্তার ও মানসিকতার ক্ষেত্রে আমাদের দৈন্য করে দেয়া।
©somewhere in net ltd.
১|
২৬ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৯:২৬
গৌতম রায় বলেছেন: চমৎকার আলোচনা সামিও ভাই। এরকম আরও আলোচনা পাবার আশা রাখছি।