নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আঁচলের ঘ্রাণে বিমোহিত হতে মনে প্রেম থাকা লাগে। চুলের গন্ধ নিতে দুহাত বাড়িয়ে দেয়া লাগে। হাহাকার থাকা লাগে। দুনিয়া ছারখার হওয়া লাগে। সবাই আত্মা স্পর্শ করতে পারে না।আমার সমস্ত হাহাকার ছারখারে তুমি মিশে আছো।

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার

এক জন নিভৃতচারী

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তীতে চীন ও চৈনিক পন্থীদের ভূমিকা

২৬ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ২:১৮

১৯৭১ সালে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির’র অঙ্গ সংগঠন ‘বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন বলে “মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের খুব একটা আশান্বিত করতে পারেনি, সেদিনই তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে এত বিপুল রক্তক্ষয়কে এড়ানো যেত।…. মাও সেতুঙের চিন্তাধারা আমাদের প্রেরণার অন্যতম উৎস হলেও যুদ্ধকালে গণচীনের ভূমিকার আমরা তীব্র সমালোচনা করেছিলাম। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ছিল আমাদের ঘোষিত শত্রু । সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিশেষ করে ভারতের সাহায্যকে আমরা স্বাগত জানালেও সে প্রশ্নে আমাদের সন্দেহ ছিল, সংশয় ছিল। আমরা কোনো পর্যায়েই চাইনি যে ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিক। ভারতের বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন-বিশেষ করে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতা আমাদের অনেক উপকারে এসেছে। “(১) একেবারে বিপরীত না হলেও, কিছুটা ভিন্ন মূল্যায়ন পাওয়া যাবে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মণি সিং এর ভাষ্যে। তিনি মনে করেন, “১লা মার্চের পর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেস কোর্সের জনসমাবেশ থেকে “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম” বলে ঘোষণা দিয়ে যে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন আমরা তার পুরোপুরি সমর্থক ছিলাম।… আমরা সচেতন ছিলাম যে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কতকগুলি দুর্বলতা থাকবে। মধ্যস্তরের জনগণের যে দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐ স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র ও তার বিরুদ্ধে আপষহীন সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চেতনার ঘাটতি ছিল। এবং শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষের সংগঠন শক্তি ছিল দুর্বল। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।… বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনিবার্য এবং তা সশস্ত্র সংগ্রাম হতে পারে এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের পার্টি ঐকমত্যে পৌঁছেছিল।… অন্যান্য দলের মধ্যে কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননদের দলের সঙ্গেও আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। এরা স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন দিলেও আওয়ামী লীগের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী, স্বাধীনতার শক্তিগুলোর ঐক্য এবং স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক শত্রু-মিত্র সম্পর্কে এঁদের নীতির সঙ্গে আমাদের প্রভূত পার্থক্য ছিল। (২) পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি মো-(লে) এর কেন্দ্রিয় কমিটির মূল্যায়ন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

“আওয়ামী লীগ, ভাসানী ও অন্যান্য বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া নেতাদের নেতৃত্বে উগ্র বুর্জোয়ার জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নিয়ে যে যুদ্ধ চলছে তা প্রতি বিপ্লবী যুদ্ধ, তা মুক্তিযুদ্ধ নয়। সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা-প্রশ্রতাশী দুই কুকুরের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে তা হচ্ছে প্রতি বিপ্লবী গৃহযুদ্ধ।”

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বামপন্থীদলগুলো মুজিবনগর সরকারের ওপর চাপসৃষ্টি করে তাদের দলীয় কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের সুযোগ দানের জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। আর এই সিদ্ধান্তের বৈধতা দিয়েছে সত্তর সনের নির্বাচনের রায়। এছাড়া প্রলস্বিত যুদ্ধে নেতৃত্ব বামদের হাতে চলে যাবার আশঙ্কা কম ছিল না।

সে মাসের শেষ দিকে দেবেন সিকদার (পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি), নাসিম আলী (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, হাতিয়ার), অমল সেন (কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র), ডাঃ সাইফ-উদ-দাহার (কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ) কাজী জাফর আহমদ (কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি) সদস্য আর মওলানা ভাসানীকে তাঁর অনুপস্থিতিতে সভাপতি করে “জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন করা হয়। এই কমিটির পক্ষ থেকে কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, এবং হায়দার আকবর খান রনো প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করেন, তাদের কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে সহযোগিতার জন্য। কাজী জাফর উল্লেখ করেছেন যে, “তিনি আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের মুক্তিবাহিনীতে আমাদের কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করেন। কারণ হিসেবে তিনি (তাজউদ্দিন) হক-তোয়াহার নেতৃত্বাধীনে কমিউনিস্টদের শ্রেণী সংগ্রামের এবং স্বাধীনতা বিরোধী তৎপরতার উল্লেখ করেন।

নানা রকম সীমাবদ্ধতা, আশঙ্কা সত্বেও বামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন অ্নুভুত হয়। বিশেষ করে ভারত সরকারের একটি অংশ বামদের অংশগ্রহণের বিষয়ে উৎসাহী ভূমিকা নেয়। এছাড়া পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন-চীনের সোচ্চার অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মুজিবনগর সরকারের জন্য অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এমনি প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মুজিবনগর সরকার সমমনা বাম দলগুলো নিয়ে “জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি’ গঠন করে। এই কমিটিতে ছিলেন পিকিং পন্থী ন্যাপের সভাপতি মওলানা ভাসানী, মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির মনি সিং, মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমদ এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি এই কমিটির আহবায়কের দায়িত্ব পান।

মুক্তিযুদ্ধের নীতি নির্ধারণে এই কমিটির কার্যকর ভূমিকা দৃশ্যমান না হলেও এর কূটনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তারপরও ভারত সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশ এবং আওয়ামী লীগের একাংশ বামপন্থীদের অন্তর্ভুক্তিকে ভালো চোখে দেখেনি। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি এই কমিটি গঠনের জন্য ভারতীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক সমর গুহ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ভি.পি. ধর এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব টি.এন. কলকে সম্পূর্ণ দায়ী করে বলেন যে, “সোভিয়েত সাহায্য ও সমর্থন লাভের নামে জোর করে এই দুই ভারতীয় কর্মকর্তা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।” এমনি নানা ধরণের বিতর্কের মধ্যে বামদলগুলো তাদের ক্যাডারদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর ছোট/বড় অনেক গ্রুপ গড়ে তোলে। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতির দাবী তারা ৬০০০ কর্মীকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা ১০,০০০ কর্মী নিয়ে “লাল গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। চীনপন্থী পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা দেবেন সিকদার, এম. এ. মতিন, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন– তাঁরা চারু মজুমদারের নক্সালবাড়ি নীতি গ্রহণ করেন। তাঁদের স্লোগান ছিল, “চেয়ারম্যান মাও আমাদের চেয়ারম্যান, চারু মজুমদার আমাদের নেতা।” এই দলের দাবী তারা ১৫,০০০ সদস্যের গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেছিল।

১৯৭১ চীনাপন্থী বামদের বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধকে “দুই কুকুরের লড়াই” বলতে কুন্ঠাবোধ করেনি। ষাটের দশকে চীন-রাশিয়া মেরু করণের সময়ে মওলানা ভাসানীকে কেন্দ্র করেই চীনাপন্থীরা একত্রিত হয়। আবার চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ভাসানী সক্রিয় হতে পারেন নি। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকায় চীনাপন্থীরা কখনোই আওয়ামী লীগকে আস্থায় নিতে পারে নি। তবে মস্কোপন্থীদের মূল্যায়ন ছিল ভিন্ন, দুর্বল জনভিত্তির কারণে রুশপন্থীরা আওয়ামী লীগের সহায়ক শক্তি হিসেবে থাকতে চেয়েছে। বিশিষ্ট বাম নেতা খোকা রায় তাঁর সংগ্রামের তিন দশক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “কমিউনিস্ট পার্টির উপলদ্ধি ছিল যে, বাস্তব অবস্থা স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুকূলে হলেও একার প্রচেষ্টায় তখন কোনো গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না এবং এই কারণেই ১৯৬১ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কয়েকটি সমঝোতার বৈঠক হয়।”

চীনাপন্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এমনি সমঝোতা বা আস্থা কখনও গড়ে ওঠেনি। চীনাপন্থীদের দৃষ্টিতে, আওয়ামী লীগ হচ্ছে ডানপন্থী সুবিধাবাদী দল। সুতরাং এর বিরোধিতা করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও চীনাপন্থীদের মনোভাব কম-বেশি অপরিবর্তিত ছিল এবং নানা দলে উপদলে বিভক্ত হবার কারণে চীনাপন্থীদের সংহত কোনো প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে অনুভূত হয় নি।

ষাটের দশকের শুরুতে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভাঙনের জের ধরে কমিউনিস্ট পার্টি মস্কো ও পিকিংপন্থী তে বিভক্ত হয়ে যায়। চীনের সাথে পাকিস্তানের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের কারণে চৈনিক পন্থী অংশটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে। ৬ দফা আন্দোলনের সময়ে কমরেড তোয়াহা একে সরাসরি সিআইএ প্রণীত দলিল বলে আখ্যায়িত করেন। চীনের প্রতি আনুগত্যের অবস্থান থেকে সরে এসে রাশেদ খান মেনন ,হায়দার আকবর খান রনো ,কাজী জাফর এর মতো কেউ কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। ক্র্যাক প্লাটুনের বীর যোদ্ধা রুমী ও তাদের একজন। কিন্তু সিংহভাগ অংশই পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকেন। সিরাজ সিকদার ,মানস ঘোষদের মতো কেউ কেউ আবার পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেই লড়াই করেন।
মস্কোপন্থী বাম দলগুলো সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং মুজিবনগর সরকারকে মেনে নিলেও পিকিংপন্থী বাম দলগুলো মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করে। ভাসানী ন্যাপ নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ভারতে গেলেও তার দলের নেতাকর্মীরা দেশের অভ্যন্তরেই আত্মগোপন করে থাকে। পিকিংপন্থী অন্য দলগুলো পাক বাহিনী ও আওয়ামী লীগ উভয়কেই শক্র হিসাবে চিহ্নিত করে। এমনকি মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আওয়ামী লীগের সমর্থক বিবেচনা করে তাদেরকেও তারা শক্র হিসাবে গণ্য করে। ফলে এসব বাম দলের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় একই সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনী, আওয়ামী লীগের সদস্য এবং মুক্তিবাহিনী। নক্সাল আন্দোলনের প্রভাবে কোনো কোনো দল এদেশের জোতদার শ্রেণীকে খতম করাও শুরু করে। এভাবে এ দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় ভুল লাইন অনুসরণ করে।
চীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ হওয়ায় পিকিংপন্থী দলগুলো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দা-কুমড়া সম্পর্ক থাকায় চীনা সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন দিতে ব্যর্থ হয়। চীনকে অনুসরণ করতে গিয়ে পিকিংপন্থী পার্টিগুলোও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করার লক্ষ্যে তারা পাক বাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ সদস্য ও জোতদার খতমের লড়াই চালিয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে বামপন্থী লেখক বদরুদ্দীন ওমর তার ‘একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের ভূমিকা’ নামে বইয়ের ১১ পৃষ্ঠায় লিখেছে, ‘পাকিস্তান সরকার আমাদের জনগণের উপর যে আক্রমণ শুরু করেছিল সে আক্রমণ প্রতিহত করে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করার ক্ষেত্রে ব্যাপকতম ঐক্য গঠনের পরিবর্তে তারা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগকেও ঐ পরিস্থিতিতে কুকুর হিসাবে আখ্যায়িত করে তাদের পারস্পরিক যুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলে আখ্যায়িত করে এবং তাদের উভয়েরই বিরোধিতা করার মতো এক নির্বোধ লাইন নিধার্রণ করে। এছাড়া এ কাজ করতে গিয়ে তারা আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে এক করে দেখে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকেই আওয়ামী লীগ মনে করে তাদের সকলের বিরোধিতায় নিয়োজিত হয়। অন্য কোনো বিকল্প না থাকায় আওয়ামী লীগের লোক নয় এমন অসংখ্য তরুণ ও বিভিন্ন পেশার লোক সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের পার্থক্য না বুঝার পরিণাম হয়েছিল কমিউনিস্টদের জন্য ভয়াবহ। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই শুধু পাকিস্তানি বাহিনী বা আওয়ামী লীগের নয়, সাধারণ জনগণের তাড়া খেয়ে অনেক ক্ষেত্রে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চীনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ১১ই জুলাই ইয়াহিয়ার প্রতি চৌ এন লাইয়ের চিঠির মাধ্যমে।পিপলস ডেইলীতে সোভিয়েত প্রক্রিয়ার সমালোচনা করা হয় বাংলাদেশকে সমর্থন দানের জন্য।চৌ এন লাই পাকিস্তানের ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ ও "রাস্ট্রীয় সারভৌমত্ব রক্ষায়" চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা জানান।
১৯৭১ সালের জুন মাস থেকে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে চীন প্রতিদিন ১০০ টি লরী ভর্তি সামরিক সরঞ্জাম পাঠায়।এছাড়া স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে গেরিলা যুদ্ধবিরোধী প্রশিক্ষণদেয়ার জন্য বিশেষজ্ঞও পাঠায় তারা।শুধু ৭১ সালেই চীন পাকিস্তানকে প্রদান করেছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক উপকরণ।যার বেশীরভাগ ব্যবহার করা হয়েছিল বাঙালি নিধনে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও চীনের বৈরীতা শেষ হলো না।স্বাধীনতার পরপরই ঢাকাস্থ চীনা কন্স্যুল অফিস তারা বন্ধ করে দেয়। ৭২ সালের ২১ শে আগষ্ট চীন বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গের সদস্যভুক্তির প্রশ্নে প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে। ৭১ সালের স্বাধীনতাকে চৌ এন লাই “এক অন্তহীন যুদ্ধের সুচনামাত্র ‘’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।তারি অংশ হিসেবে চীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ‘ক্রমাগত অস্থিতিশীল পরিস্থিতি’ বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরদিন ১৬ ই আগস্ট ১৯৭৫ চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
স্বাধীনতার পরপর সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি ‘স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ভারতের পদাবনত হয়েছে’উল্লেখ করে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কায়েমের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহবান জানায়।মাওলানা ভাসানী দেশে ফিরে আসার পরে ‘হক কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন,যার সম্পাদক ছিলেন একজন কলাবারেটর।
হক,তোহা,মতিন,আলাউদ্দিন,দেবেন সিকদার,শান্তি সেন,অমল সেন প্রমুখের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের নেতাগণ ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ শ্লোগান দিয়ে শ্রেণী শত্রু খতমের নামে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পথ বেছে নেন।মাওলানা ভাসানী এদের নেতা সেজে পল্টনের জনসভায় হুঙ্কার দিলেন, ‘আমি নতুন পতাকা ওড়াবো’।এই ঘোষণার পরপর জুলফিকার আলী ভুট্টো ভাসানীকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান।আমন্ত্রণপত্রে "মুসলিম বাংলা" প্রতিষ্টার জন্য তিনি ভাসানীর সহোযোগীতা কামনা করেন।
জামাতে ইসলাম,পিডিপি,নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগের নেপথ্য শক্তিকে আড়ালে রেখে ভাসানী গঠন করেন “ হুকমতে রব্বানী” যার উদ্দেশ্য ছিল চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা।এদের সমর্থনে বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রকাশ্যে হাত তুলে দোয়া করেন ‘মুসলিম বাংলা প্রতিষ্টার জন্য যারা কাজ করছেন তাদের আমি দোয়া করছি।আল্লাহ্র রহমতে তারা জয়যুক্ত হবেন’।এই মুসলিম বাংলার শ্লোগানটি ভুট্টো প্রদত্ত যা ঐ সময়ে রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত হতো।
জাতীয় চারনীতি গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র,ধর্মনিরেপেক্ষতার উপরে ভিত্তি করে রচিত সংবিধানের সমালোচনা করে তিনি ঘোষণা দেন , “এই সংবিধান. মানিনা।বাংলাদেশের সংবিধান কোরাণ হাদিসের উপর ভিত্তি করে রচিত হতে হবে”
শুধু তাই নয় ,পল্টনের জনসভায় তিনি হুংকার দিয়ে বলেন , “বাংলাদেশকে আমি ভিয়েতনামে পরিণত করে ছাড়বো” স্বাধীনতার পরে যখন যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ গঠনে সবার সহযোগীতায় যখন দেশ গড়ার সংগ্রামের প্রয়োজন ছিলো তখন তিনি বারবার বলতে লাগলেন “আমি এই দেশে প্রতিবিপ্লব ঘটাবো”
সারাজীবন নীপীড়িত মানুষের জন্য সংগ্রাম করা ভাসানী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এভাবে চরম সাম্প্রদায়িক ৭১ এর পরাজিত শক্তি ও উগ্র চৈনিকপন্থীদের ক্রীড়ানক হয়ে গেলেন।
দেশের মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের যেসব শক্তি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল চীন তাদের অন্যতম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে চীনের সরকারি অবস্থান ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। বাংলাদেশের সংকট নিয়ে চীনের প্রথম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি চৌ এন লাই এর চিঠির মাধ্যমে। ঐ চিঠিতে চৌ এন লাই পাকিস্তানের ঘটনাবলীকে সে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে জানান এবং জনগণ বিদেশি হস্তক্ষেপ ছাড়াই তা সামাধান করবে বলে উল্লেখ করেন। এমনকি পাকিস্তানের জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীনের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথাও তিনি জানিয়েছিলেন। অবশ্য চিঠিতে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধি কোনো বক্তব্য রাখেননি। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চীন বাঙালির সংগ্রাম ও নির্যাতনের প্রতি ও কোনো সহানুভূতি দেখায়নি। বরং পাক সামরিক চক্রের প্রতি জানিয়েছিল আকুণ্ঠ সমর্থন। এমনকি চীনপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত মওলানা ভাসানীর আকুল আবেদন সত্ত্বেও চীনা নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরুর পূর্ব পর্যন্ত চীন পাকিস্তানপন্থী থাকলেও মোটামুটিভাবে বাঙালির সংগ্রাম বিরোধি কোনো মন্তব্য করেনি। এমনকি এপ্রিল হতে অক্টোবর পর্যন্ত চীন প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে গোপনে যে পাকিস্তানের সামরিক চক্রকে নৈতিক শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল এবং সরাসরি সামরিক উপকরণ সরবরাহ করেছিল। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পর চীনের পাকিস্তানপন্থী নীতি আরো প্রকট হয়ে ওঠে। সেপ্টেম্বর মাসে চীন পাকিস্তানকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে, জাতীয় স্বার্থরক্ষায় চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করবে। তখনও পর্যন্ত চীনের বক্তব্যে বাঙালি বিরোধি তেমন বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। এজন্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার অনেক সময় আশা করতেন যে শেষ পর্যন্ত হয়তো চীন সংগ্রামী বাঙালির পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু সে আশা সফল হয়নি। ৫ নভেম্বর চীনাদের আস্থাভাজন ভুট্টোর নেতৃত্বে একটি পাক প্রতিনিধি দল চীন সফরে যায়। চীন থেকে অতিরিক্ত অঙ্গীকার বা সাহায্য পাওয়ার আশায়। কিন্তু চীনের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রী (ভারপ্রাপ্ত) বি পেঙ ফী পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধান খুঁজে বের করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। বাঙালি বিরোধি বক্তব্য না রাখলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত দিয়ে চীন নিয়মিতভাবে পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র পাঠাতো। এছাড়াও গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ দানের জন্য চীন অক্টোবর মাসে টাকায় ২০০ (দু’শ) সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর হতে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান মোট ২০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চীনা সামরিক উপকরণ সাহায্য হিসেবে পেয়েছে যার মধ্যে ১৯৭১ সালেই সরবরাহ করেছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। আর চীনের রাইফেল ও অন্যান্য উন্নত সমরাস্ত্র দিয়েই পাকবাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে বাঙালিকে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে পূর্বাঞ্চলে সামরিক হামলা চালালে শুরু হয় সরাসরি পাক-ভারত যুদ্ধ। এ সময় হতে চীন জাতিসংঘে সরাসরি বাঙালি বিরোধি ভূমিকা পালন করতে থাকে। পাক-ভারত যুদ্ধের জন্য চীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে দায়ি করে। যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং পাকবাহিনীর বর্বরতার ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করার লক্ষ্যে ৫ ও ৭ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে দুটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। কিন্তু প্রস্তাব দুটোর বিরুদ্ধে চীন প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে এবং চীনের নিজস্ব প্রস্তাবে ভারতকে আগ্রাসী পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, চীন জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের মাত্র ৪০ দিনের মাথায় নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন লাভের পর প্রথম প্রস্তাবেই ভেটো প্রয়োগ করেছিল। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলে চীন এক বিবৃতিতে ‘তথাকথিত’ বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের তীব্র সমালোচনা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ বলে অভিহিত করে চীন চরম অবহেলা করেছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।

এভাবেই বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে থেকে চীনপন্থী কমিউনিষ্ট পার্টি গুলোর এদেশের রাজনীতিতে ক্রমশঃ বিলুপ্তির পথে।


তথ্যসূত্রঃ
১.বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ফ্যাক্টস এণ্ড ডকুমেন্টস –অধ্যাপক আবু সায়ীদ
২.মূলধারা ৭১: মইদুল হাসান
৩. শতাব্দী পেরিয়ে : হায়দার আকবর খান রনো
৪. আমি বিজয় দেখেছি : এম আর আখতার মুকুল
৫. একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের ভূমিকা : বদরুদ্দিন ওমর
৬. তালুকদার মনিরুজ্জামান, The Bangladesh Revolution and its Aftermath. UPL, 2003
৭. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫ খন্ড।
৮. অজিত কুমার দাস, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সাথে কতিপয় নির্বাচিত বামপন্থী দলসমূহের সম্পর্ক, অপ্রকাশিত গবেষনা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, মে ২০০৪।

-বিশেষ কৃতজ্ঞতা-লিখেছেন: রাজেশ পাল

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ২:৩৩

চাঁদগাজী বলেছেন:


মোটামুটি ম্যাঁও প্যাঁও।
ভাসানী জানতেন, দেশ হয়েছে, মানুষ কিছু পাবে না।

২৭ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:৩৯

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার বলেছেন: চৈনিক রা খালি অস্ত্র ধরতে জানে,ডাকাতি আর বিপ্লব এক না ওরা বুঝে না

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.