নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

Shondhi Muhid

সন্ধি মুহিদ

ভেতরে বৈরাগ্য, বাইরে সংসারী মুখোশ!

সন্ধি মুহিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মন মেতেছে : গল্প

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:০১

১.

"বাবা তোমার মন খারাপ?", আমার ছোট্ট কন্যা সুপ্তির মিষ্টি কণ্ঠ শুনে মুখ ফেরালাম। সন্ধ্যাবেলার আধো-অন্ধকার বারান্দায় চুপচাপ বসে ছিলাম। হ্যাঁ, মনটা খারাপই ছিলো। ফারিয়ার কথা মনে পড়ছিল। সুপ্তির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে হাতে মাঝারি সাইজের একটা টেডি বিয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গতবছরই তো এটা কিনে এনেছিলাম ফারিয়াকে সাথে নিয়ে। বললাম, "মামণি, ঘুম শেষ?"

মেয়ে আমার কিছুই বললো না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার কাছে চলে এলো। আমার গলা জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। আহারে, আমার মেয়েটার কত কষ্টই না হচ্ছে। আমি ওর হাতদুটো ধরে রাখলাম। ওর চুলের মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি। স্ত্রীর চুলেও এমন গন্ধ ছিলো।



আমার গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি বোধয় সুপ্তিকে ব্যাথা দিচ্ছিলো। সে আমাকে টেনে বললো, "বাবা এসো, শেভ করবা চলো।"

আমি চললাম তার পিছু পিছু। শেভ তো করা দরকারই। ছন্নছাড়া হয়ে থেকে কী লাভ?

ভাবছি, কন্যাই কি আমাকে এখন দেখে রাখবে, নাকি আমি কন্যাকে দেখে রাখবো। ইশ, ফারিয়া যদি থাকতো…



আমার স্ত্রী ফারিয়া গত মঙ্গলবার একটা চিরকুট রেখে নিরুদ্দেশ হয়েছে। নিরুদ্দেশ বলা যায় না অবশ্য। আমি জানি সে কোথায় আছে। চিরকুটে লেখা ছিলো, "আমি আবীরের সাথে চললাম। তোমরা ভালো থেকো।"



আবীর ছিলো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফারিয়ার সাথেও বন্ধুত্ব ছিলো। কিন্তু সেটা যে বন্ধুত্বের সীমারেখা অতিক্রম করে অন্য কিছু হয়ে যাচ্ছিলো, আমি খানিকটা টের পেয়েছিলাম আগেই। কিন্তু তাদের কিছু বলিনি।

চিরকুটটা কন্যাকে দেখিয়ে বলেছিলাম, "তোমার মা তোমার আবীর আঙ্কেলের সাথে চলে গিয়েছে। আর আসবে না।"



সুপ্তির বয়স মাত্র সাত। সে কী বুঝলো কে জানে। তবে এই বিষয়ে সে আর কোনো কথা বলে নি।



২.

রাত দুটো। আমি আবার বারান্দায় বসে আছি। সুপ্তিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি। এখন বসে বসে আকাশ দেখছি। বারান্দায় ফারিয়ার পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা ফুলের গাছ মৃদু বাতাসে নড়ছে। আমার ফোন কেঁপে উঠলো। দেখলাম ফারিয়ার SMS এসেছে, "tomader kotha mone pore." আমি ওর নম্বরটা ব্লক করে দিলাম। "যে গেছে, তাকে আর সুযোগ দিয়ে লাভ নেই।" আমি এই নীতিতে বিশ্বাস করে চলি।



একটু পর কন্যা কানের কাছে এসে বললো, "বাবা, ঘুমাতে আসো।" ওর দিকে তাকাতেই ক্যানো জানি একটা শিহরণ অনুভব করলাম। বাপ বেটিতে মিলে ঘরে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে রাতদুপুরে হার্মোনিয়াম-তবলা বের করে বসলাম। প্রাণ খুলে গাইতে লাগলাম। আমি হার্মোনিয়াম বাজাই। কন্যা গান করে, আমিও গান করি।



"ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে।

তারে আজ থামায় কে রে।

সে যে আকাশ পানে হাত পেতেছে,

তারে আজ নামায় কে রে!"



ফারিয়া থাকলে সে হার্মোনিয়াম ধরতো, আমি তবলায় বসতাম। এই হার্মোনিয়াম, তবলাই যত নষ্টের গোড়া। আবীর আবার গান টান গাইতো। আর সেই টানেই মাঝে মাঝে আসতো।



তবু গানেই মুক্তি। গান গাইতে গাইতেই বাপ বেটিতে সব ভুলে গেলাম।

চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরছে। কিন্তু খুব একটা মন্দ লাগছে না তো। যে চলে গেছে, তাকে ভেবে কী লাভ। আমি ভাল আছি। আমরা ভাল আছি। আমরা ভাল থাকবো।



৩.

সুপ্তিকে আমার বোনের বাসায় রেখে অফিসে গিয়েছিলাম। বোনের বাসা আমার বাসার কাছেই। মোটে দশ মিনিটের হাঁটাপথ। সকালে যখন গিয়ে বললাম, "বুবু, মেয়েটারে আজকে রাখো। সন্ধ্যায় এসে নিয়া যাবো নে।" তখন বুবু আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "বিষয়টা কী? তোর বউ কই?"

তানিয়া বুবু বিরাট বুদ্ধিমতী। সে ইতোমধ্যেই বুঝে ফেলেছে ফারিয়া বাসায় নেই। আমি বললাম, "সে তার বাপের বাড়ি গ্যাছে।"

ওটা বলেই আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চলে এলাম। অফিস থেকে ফেরার পথে সুপ্তিকে আনতে গেলাম। সুপ্তিকে আমি কিছুই শিখিয়ে পড়িয়ে আনি নি। সে নিশ্চয়ই এতক্ষণে বলে দিয়েছে ফারিয়া আবীরের সাথে ভেগে গেছে। বলে ফেললে তো ভালোই। এক সময় না এক সময় তো বলা লাগতোই। আমি বলতে নাহয় বিব্রত হতাম, কিন্তু সুপ্তি বলে ফেললে তো বেঁচেই গেলাম।



কাঁচুমাচু মুখ করে এসে কলিংবেল চাপলাম। বোন দরজা খুলে দিলো। দরজার সামনে একজোড়া জুতোর দিকে নজর গেলো। ক্ষীণ সন্দেহ হলো, আচ্ছা ফারিয়া ফাজলামো করে এখানে লুকিয়ে নেই তো? জুতোজোড়া তো ওরই মনে হচ্ছে।



আমার জুতো খুলে বুবুর পেছন পেছন গেলাম। দেখি, আমার ভাগিনা তন্ময় আর আমার কন্যা ঘরময় গল্পের বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। আমার দুলাভাইয়ের বিরাট বইয়ের সংগ্রহ আছে। মাঝে মাঝে ওখান থেকে আমি বই নিয়ে পড়ি।



নাস্তা করতে করতে বুবুকে বললাম, "সুপ্তি কিছু বলেছে তোমাকে?"

বুবু ভ্রু কুঁচকে বললো, "কী বলবে সুপ্তি আমাকে?"

-"না কিছু না।"

-"ফারিয়া কোথায়?"

-"ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আরেক জনের সাথে, সম্ভবত ডিভোর্স পেপারও পেয়ে যাবো কিছুদিনের মধ্যে।"

হড়বড় করে বলে ফেললাম সব কিছু। বুবু চুপ করে আছে। আমি বুবুর বানানো পরোটা-ডাল গপাগপ খেয়ে যাচ্ছি।



৪.

সুপ্তিকে নিয়ে বাসায় ফিরেছি। তন্ময়কেও নিয়ে এসেছি। এক রাত থাকবে। কাল সকালে আবার চলে যাবে। তন্ময়ের বয়স আট। সুপ্তির চে এক বছরের বড়।

বুবুর বাড়ি থেকে রাতের খাবার খেয়েই ফিরেছি। তাই বাসায় ফিরে আর খাওয়ার জন্য ভাবতে হলো না। সবগুলো ঘরে আলো জ্বেলে দিলাম। তবু যেন একটা অন্ধকার ভাব রয়ে গেল!



সুপ্তি আর তন্ময় টিভিতে কার্টুন ছেড়ে বসে গেছে। ভাবছি মেয়েটা এত স্বাভাবিক থাকছে কীভাবে।



আমি ধীরপায়ে বারান্দায় চলে এলাম। পকেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বের করলাম। আমি এম্নিতে নিয়মিত না হলেও মাঝেমাঝে সিগারেট খেতাম। ফারিয়া সিগারেট ছাড়িয়েছিলো। অনেক দিন পর সিগারেটে একটা টান দিয়ে তেমন খারাপ লাগলো না। বাহ! এইতো বেশ! বুকের শুণ্যতাটা ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিলাম!



আরেকটা টান দিতে যাব, তখনই সুপ্তি আর তন্ময় এসে হাজির। আমি তাড়াতাড়ি সিগারেট দেয়ালে চেপে নিচে ফেলে দিলাম।

তন্ময় বললো, "মামা তুমি সিগারেট খাচ্ছো?"

আমি বললাম, "কই না তো। বোধয় বাইরে থেকে গন্ধ আসছে।"

সুপ্তি বললো, "বাবা, চলো তন্ময়কে গান শিখাই।"

অগত্যা যেতে হলো। ভাগিনার কণ্ঠে যথেষ্ট সুর আছে বোঝা গেলো! সে সা রে গা মা কে বলছে সে রে গে মা! শোনাচ্ছে যেমন 'ছেড়ে দে মা!"



এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে গেলো বাচ্চারা। আমি তখন ফোনের ফটোগ্যালারিতে স্ত্রীর ছবিগুলো দেখছি। ডিলিট করে ফেলবো?



থাক। ফেসবুকে লগ ইন করলাম। দেখলাম ফারিয়া নিজেই আমাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়ে গেছে। এখন তার প্রোফাইলে শোভা পাচ্ছে "ইন আ রিলেশনশিপ উইথ আবীর সোহান।"



মেয়েরা পারেও! এত তাড়াতাড়ি! কী যুগ পড়েছে রে বাবা। আবীরের সাথে ফারিয়ার ছবিটা দেখে খুব খারাপ লাগলো। লগ আউট করে ফেললাম। আমি তখনো জানতাম না তুতুল নামের এক জন আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছে ঠিক তখনই!



৫.

শুক্রবার। অফিস নেই। তাই ঘুমুচ্ছিলাম বেলা করে। ঘুম থেকে উঠে দেখি সুপ্তি গল্পের বই পড়ছে। আমি ফেসবুকে ঢুঁ মারলাম। দেখি Tutul Ahmed নামের এক জন ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। মিউচুয়ালে আমার বোন তানিয়া। এড করে নিলাম। বোনকে ফোন দিলাম।

"হ্যালো বুবু"

"বল"

"টুটুল আহমেদ কে? আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছে। মিউচুয়ালে তুই। তাই এক্সেপ্ট করে ফেললাম।"

"টুটুল না, তুতুল, আমার এক বান্ধবীর ছোট বোন, এখন আমার বাসায় আছে, ঢাকায় এসেছে ভার্সিটি এডমিশন কোচিং করতে।"

"তোর কোন বান্ধবী?"

"ঐ যে মুকুকে মনে আছে? আমাদের বাসায় তো খুব আসতো। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো।"

"ও! মুকু আপুর বোন। তাইলে তো তার মতই অনেক সুন্দরীই হবে!!"

"হ্যাঁ। সুন্দরীই! তারপর খাওয়া দাওয়ার কী ব্যবস্থা করলি?"

"এই- নিচের হোটেলে বলে এসেছি। খাবার দিয়ে যাবে। আমার অতটা সমস্যা নাই। কিন্তু সুপ্তি এখন থেকেই হোটেলের খাবার খাবে, এটা ভেবে ক্যামন জানি লাগছে। ব্যাচেলর লাইফে ফিরে গেছি মনে হচ্ছে।"

"ফারিয়ারে ভুলেই গেলি নাকি এত তাড়াতাড়ি?"

"হ্যাঁ, প্রায় ভুলে গেছি। আমাকে তো জানিসই। এখন পর্যন্ত চার জনকে ভুলতে হলো। বিয়ের আগে প্রেম জীবনে তিনজন আর এখন বিয়ের পরেও আরেকবার... অভ্যেস হয়ে গেছে!"

"চোপ। থাপ্পর খাবি। আমার সাথে ভাব নিস না। আমি জানি তুই কষ্টে আছিস।"

"ইয়ে, আচ্ছা এখন রাখি। একটু পর তোর বাসায় আসব।"



সুপ্তিকে বল্লাম, "আম্মু চলো ফুপীর বাসায় যাই।"

বাপ বেটিতে আবার বের হলাম। হেঁটে হেঁটেই। শুক্রবার বেলা এগারোটা। রমরমে অবস্থা।

হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম তুতুল নামের মেয়েটা আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলো কী কারণে!



যেহেতু শুক্রবার, দুলাভাইও ছুটিতে! আমাকে দেখেই হেঁকে বসলেন, "এই যে সুপ্তির বাপ! কী অবস্থা তোমার? ফারিয়ার সাথে নাকি ঝগড়া করেছো?"

তানিয়া বুবু আড়চোখে দুলাভাইকে চুপ থাকতে বললেন। দুলাভাই তাই চুপ হয়ে গেলেন। সুপ্তি ভেতরে চলে গেলো। উঁকি দিয়ে ভেতরের দিকে দেখলাম। মনে হলো সুন্দরী একটা মেয়েকেই দেখলাম এক পলক! চোখাচোখি হলো। সেও আমাকে দেখে থমকে গেলো। দূর থেকেও যেন মনে হলো, এর চোখে মায়া আছে।

তখন বুবু চা নিয়ে এলো। দুলাভাইয়ের কাছ থেকে পত্রিকাটা টেনে নিলাম। ছোট্ট একটা খবরে চোখ আটকে গেলো।

"সড়ক দুর্ঘটনায় দম্পতীর মৃত্যু। পরিচয় অজ্ঞাত।"

পুরো খবরটা পড়লাম কী মনে করে। মনে হলো ফারিয়া আর আবীরের কিছু হয় নি তো।



দুলাভাইকে এড়িয়ে বারান্দায় আসলাম। ফারিয়ার নম্বরটা ফোনবুক থেকে ডিলিট করে দিয়েছি। কিন্তু মুখস্ত রয়ে গেছে। ডায়েল করলাম। বল্লো, "দুঃখিত, আপনার ডায়েল্কৃত নম্বরে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর আবার…" নাম্বার চেঞ্জ করে ফেলেছে নাকি?

আমি ভেবেছিলাম এই সাত দিনেই ফারিয়াকে ভুলে গেছি। মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। ওর সব কিছু এখন আমাকেই দেখতে হচ্ছে। কিন্তু ফারিয়ার কথা ভেবে হঠাৎ ক্যানো জানি বুক ধড়ফড় করছে।

আবীরকে একটা ফোন করবো? কী মনে করবে?

কল দিলাম। সেই... "দুঃখিত, আপনার…"



ওদের কিছু হয়নি তো?

ধুর! হলে হবে। আমার কী!



৬.

রাত একটা। কাল অফিস আছে। ঘুমানো প্রয়োজন। ঘুম আসছে না। সুপ্তি ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বুকের শূন্যতা নেভাতে একটা সিগারেট জ্বালিয়েছি।

ল্যাপ্টপে ফেসবুক খোলা। ফারিয়া আর আবীরের টাইমলাইন ঘুরে দেখলাম। গত দেড়দিনে কেউই লগ ইন করে নি। আচ্ছা, নাম্বার চেঞ্জ করলে নিশ্চয়ই ফেসবুকেও ব্লক করে ফেলতো। ধুর। চিন্তাটা মাথা থেকে যাচ্ছে না।

হঠাৎ সেই তুতুল নামের মেয়েটা নক করলো,

"hi"

"হেলো", অভ্র কীবোর্ডে বাংলা লিখে রিপ্লাই দিলাম। মেয়েটা মোবাইল থেকে চ্যাট অনলাইনে আছে। অবশ্য তার ফোনে বাংলা সাপোর্ট করে কী না কে জানে। নক করলো ক্যানো ভাবছিলাম, তখন সেও বাংলায় লিখে রিপ্লাই দিলো,

"কেমন আছেন?"

"ভাল আছি তো। আপনি?", হাসিমুখের ছবি জুড়ে দিলাম।

"বেঁচে আছি। আপনি সত্যি ভালো আছেন?"

"খারাপ থাকবো কী জন্য?"

"কিছু মনে করবেন না। তানিয়া আপু আমাকে আপনার কথা বলেছে। আমি জানি আপনি কষ্টে আছেন।"



বুবু এরই মধ্যে একেও বলে ফেলেছে! আজব। মেয়েটার সাথে চ্যাট করতে লাগলাম। আর একের পর এক সিগারেট চলতে লাগলো। মাথা ঘুরাচ্ছিলো। লক্ষ্য করেছি সিগারেট টানলে আমার মাথা ঘুরায় ভনভন করে। ঘুম আসে নি। চ্যাট শেষ হলো রাত চারটায়। সে বিদায় নিলো,সকালে তার কোচিং আছে। বিদায় দিলাম।



বারান্দায় এসে বসলাম। নির্জন রাত। আকাশে নীলাভ আবছা আলো। হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাসে গা শিরশির করে উঠলো। চমকে উঠলাম। আচ্ছা, ফারিয়ার পারফিউমের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না?



৭.

কাল রাতে আমার কী যেন হয়েছিলো। বারান্দায় বসে মনে হলো ফারিয়ার পারফিউমের ঘ্রাণ পাচ্ছি। হঠাৎ খুব ভয় করতে লাগলো। গা শিরশির করতে লাগলো। মনে হলো ঘরের ভেতর ফারিয়া বসে হার্মোনিয়াম বাজাচ্ছে। চুপ করে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লাম বারান্দায়ই।

ঘুম ভাঙলো এগারোটায়! অফিস ছিলো নয়টা থেকে। থাক আজ আর যাবো না। সুপ্তি না খেয়ে বসেছিলো। হোটেল থেকে খাবার দিয়ে গেছে। বাপ বেটিতে নাস্তা সেরে নিলাম।

সুপ্তিকে দেখলাম নিজে থেকেই বারান্দায় ফারিয়ার লাগানো গাছগুলোতে জল দিচ্ছে।

আমি ফেইসবুকটা খুলে বসলাম। তুতুল মেয়েটা আবার ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। সে আমার ফোন নম্বর চায়। পড়াশুনোর ব্যাপারে কী সাহায্য নাকি লাগবে। নম্বর দিয়ে দিলাম।

সুপ্তিকে বললাম, "আম্মু সেদিন যে ফুপীর বাসায় গিয়েছিলি, সেখানে তুতুল নামের কোনো মেয়ে ছিলো?"

সে বল্লো, "ও তুতুল আপু! আমাকে অনেক আদর করেছে!"

আপু?! আপু ডেকে ফেললো! আশ্চর্য! বললাম, "আপু না। ইয়ে। আন্টি বলে ডাকবি। ঠিক আছে?"

সুপ্তি বল্লো, "আচ্ছা।"



কাল রাতে তুতুলের সাথে কথা বলে যা যা জেনেছি তা হলো ওর নিজের জীবনের সুপ্তির মত ঘটনা ঘটেছিল। ওর মাও ওর বাবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো ওর ছোটবেলায়। ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছিলেন। এ থেকেই বুঝেছিলাম আমার প্রতি তুতুলের আগ্রহের কারণ কী আর কী কারণেই সে আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলো।



অফিসে এক বার ফোন করে বল্লাম আজ আর যাবো না। তখনই একটা কল এলো। ওয়েইটিং দেখে কেটে দিলো।

কথা শেষ করে ব্যাক করলাম। ভেবেছিলাম তুতুল। কারণ মাত্রই তাকে ফোন নম্বর দিয়েছি ফেসবুকে। কিন্তু আমাকে ফোন করেছে তানিয়া বুবু। যেতে বললো। নতুন নাম্বার থেকে কল করেছে ক্যানো কে জানে।



অগত্যা কন্যাকে নিয়ে বের হলাম।



বোনের বাসায় ঢোকার মুখে আজ আবার সেই জুতোজোড়া চোখে পড়লো। ঠিক ফারিয়ার এক জোড়ার মত! এখন বুঝলাম, জুতোজোড়া তুতুল নামের মেয়েটার।



দেখলাম তুতুল আর তন্ময় ড্রয়ং রুমে বসে আছে। দুলাভাই বোধয় অফিসে। তুতুল আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমি বল্লাম, "আরে, ক্যামন আছো? সকালে কোচিংএ যেতে পেরেছিলে? ঘুম ভেঙেছিলো?"

সে আস্তে করে বল্লো, "হ্যাঁ।"

কী কোমল কণ্ঠ! মেয়েটা কি গান গাইতে পারে? চুপ করে বসে থাকাটা অস্বস্তিকর। তাই বলেই ফেললাম, "আচ্ছা তুমি গান গাইতে জানো? সুপ্তি কিন্তু গান গাইতে জানে।"

তুতুল আমার চোখের দিকে একবার তাকালো। কী গভীর দৃষ্টি! আবার মাথা নিচু করে বললো, "শেখার ইচ্ছে ছিলো।"

সুপ্তি এরই মধ্যে মাতব্বরী করে বল্লো, "বাবা তোমাকে গান শেখাবে, তুতুল আআআ...ন্টি!"

তন্ময় হিহিহি করে হাসতে শুরু করলো। তুতুলও অবাক হয়েছে হয়তো।



সেদিন রাতেই তুতুল আমার ফোনে SMS করলো, "ki korchhen?"

ফোনের ক্ষুদে কীপ্যাডে টাইপ করতে বিরক্ত লাগে। তাই সরাসরি ওকে কল দিলাম। ভোর চারটা পর্যন্ত কথা হলো। খুব তরতর করেই কথা এগিয়ে গেলো সে রাতে। ঠিক হলো তাকে আমি গান শেখাবো। আর সে আমাকে অফিসে যাবার জন্যে ঘুম থেকে তুলে দেবে!



৮.

তুতুল গান শিখতে এসেছে।

সুপ্তি আর তন্ময়ও সাথে আছে। তুতুলকে সরগম শিখিয়ে শুধু বলে দিলাম প্রতিদিন ভোর বেলা ছাদে যেয়ে দীর্ঘ দম নিয়ে সা রে গা মা পা ধা নি র্সা আবার র্সা নি ধা পা মা গা রে সা করে নিতে কয়েক বার। শর্ট কোর্সে আপাতত এটুকুতেই চলবে।

তবে সুখের কথা হচ্ছে, ওর কণ্ঠে সুর আছে!

প্রথম দিন গান শিখতে এসেছে, সরগম শিখিয়ে বল্লাম, "তুমি বসো, আমি একটু চা করে আনি।"

সে বল্লো, "না না, আপনি করতে যাবেন না। আমাকে দেখিয়ে দিন। আমি চা করে দিই।"

সাত পাঁচ ভেবে বল্লাম, "আচ্ছা চলো!"



সুপ্তি আর তন্ময়কে ওখানে বসিয়ে রেখে তুতুল আর আমি রান্নাঘরের দিকে এগুলাম।



রান্নাঘরটা ত্যামন বড়ো না। আমি আর তুতুল খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি। ওর শরীরের মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পাচ্ছি। ওকে সব দেখিয়ে যখন ফিরবো, পেছনে ঘোরার সময় দুজনের চোখাচোখি হলো। দুজনেই চুপ হয়ে থেমে গেলাম। ওর মায়াবী চোখ থেকে চোখ সরাতে পারছি না। আমার বুক ধুকপুক করছে। আমি কি এই মেয়ের প্রেমে পড়েছি?



তখন তন্ময়ের ভয়ার্ত গলার চিৎকার শোনা গেলো ,"মামা....."



আমি ছুটলাম। পেছন পেছন তুতুলও।



ঘটনা তেমন কিছু না। তন্ময়ের হাতে সুপ্তি কামড় বসিয়েছে। কারণ কী? তুতুল এবং আমার দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে জানা গেলো তন্ময় নাকি সুপ্তিকে বলেছে, "তোর আম্মু এত্ত গুলো পঁচা! তাই তোকে ছেড়ে চলে গেছে!"

ঘটনা তেমন কিছু না হলেও সুপ্তিকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এত শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে তন্ময়কে কামড়ে দিলো? ঘরে তালা লাগিয়ে নিচে নেমে এসে চারজনে দুটো রিকশা নিলাম। একটাতে আমি আর সুপ্তি আরেকটাতে তুতুল আর তন্ময়। রিকশায় আসার সময় একটা কথাই ভাবছিলাম, মেয়েকে বোনের বাসায় রেখে আসবো। ওখানেই থাকবে সে কিছুদিন। আমার খারাপ লাগবেই। একদম একা হয়ে পড়বো এবার। আবার ব্যাচেলর লাইফে পুরোপুরি ফিরে যেতে পারবো, এটা ভেবেও মজা পাচ্ছিলাম।



৯.

এর পরের গল্প খুব দ্রুত এগিয়ে গেছে। সুপ্তিকে তারপর তানিয়া বুবুর বাসায়ই থাকার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তুতুলও বেশ ভালোভাবেই ওকে দেখে শুনে রাখছিল। তুতল গান শিখতে আসার সময় প্রতিদিন ওকে সাথে করে নিয়ে আসতো। আবার যাবার সময় নিয়ে যেত। তুতুলের সাথে আমার ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেছিল। ফোনে বেশ কথা হত। মাঝখানে যে কয়েকদিন সিগারেট টেনেছিলাম বুকের শূন্যতা ভুলতে, এখন আর সিগারেট খেতেও হয় না। সারাদিন অফিসে ব্যস্ত থাকি। বিকেলে তুতুল আর সুপ্তিকে গান শেখাই। তারপর ফেইসবুকে ঢুকে বসে থাকি। ফারিয়া আর আবীরের ফেসবুকে আর কোনো আপডেট খুঁজি। তাদের কোনো খোঁজ এখনো পাই নি। মরেই গেলো নাকি?



তুতুল আমার খুব টেক কেয়ার করে। এই যেমন ফোন করে জানতে চায় খেয়েছি কিনা। সকালে ঘুম থেকে তুলে দেয়। আমার ঘুম খুব গাঢ়। এলার্মে কাজ হয় না। কিন্তু তুতুল এক বার কল দিলেই উঠে পড়ি। তবু মাঝে মাঝে রাত বিরেতে একা একা ভূতের মত শূন্য ফ্ল্যাটে যখন ঘুরে বেড়াই, ফারিয়ার বারান্দায় লাগানো গাছ গুলো থেকে ফুলের গন্ধকে ফারিয়ার পারফিউমের গন্ধ ভেবে ভ্রম হয়। তবু দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ফারিয়া ক্যামন আছে? আমি এই যে তুতুলের সাথে কথা বলে ফারিয়াকে ভুলে থাকার অভিনয় করছি, আমি কি সত্যিই ওকে ভুলতে পেরেছি? ভুলতে পারবো?



১০.

তিন মাস পর।

তুতুলের সাথে আমার অঘোষিত একটা প্রেমের সম্পর্ক তৈরী হয়ে যাচ্ছিলো প্রায়। ফারিয়াকে এখন আর অতটা মনে পড়ে না। কিন্তু আমি তুতুলকে এড়িয়ে চলছি। আমার জন্যে তার জীবনে প্রভাব পড়ুক, এটা আমি চাই না।



তুতুলের ভার্সিটি এডমিশন শেষ। ভর্তিপরীক্ষার পর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আমার বোনের বাসা ছেড়ে সে উঠেছে হস্টেলে। আমি তাকে এভয়েড করতে শুরু করার পর লক্ষ্য করলাম সে নিজেই গান শিখতে আসা বন্ধ করে দিলো। সুপ্তিকে আমার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে এলাম। এক দিন তুতুলের সাথে পথে দেখা হয়েছিলো। তার পাশে আরেক জন যুবক। আরেক জন কীসের? এক জন যুবকই! সেদিন বাসায় এসে মনটা খুব খারাপ হলো। ক্যানো মন খারাপ হলো তা জানা নেই।



চুপচাপ বসেছিলাম, তখনই একটা অপরিচিত নম্বর থেকে SMS পেলাম, "I'm coming back." ফারিয়া নাকি? কল দিলাম। রিনরিনে কণ্ঠ। হ্যাঁ ফারিয়াই।



১১.

ফারিয়া বাইরের ঘরে সোফায় বসেছিলো। সুপ্তিকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘসময় কান্নাকাটি করলো। আমি ফোন করে বুবুকে আসতে বলেছিলাম। বুবুও এসেছিল। তুতুলকে ফোন করলাম। ফোন ওয়েইটিং ছিলো। সে ফোন ধরেনি। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে গত কয়েক মাসে ফারিয়ার বাবা মা কোনো খোঁজ নেয় নি, কিন্তু সেদিন তারা ক্যানো জানি উপস্থিত হয়েছিল।



ফারিয়ার সাথে আমি একটা কথাও বলিনি। তাকে আমি আর ফেরার সুযোগও দেবো না। সে তার বাপের বাড়ি ফিরে যাক।



ফারিয়া নাকি সত্যিই রোড এক্সিডেন্ট করেছিলো। আবীর মারা গিয়েছিল। আর ফারিয়া নাকি অনেক দিন কোমায় ছিলো। আর এইতো নিজে নিজেই দীর্ঘদিন পর রুগ্ন দেহে ফিরে এলো। এরই মধ্যে মনে হলো, আচ্ছা, আমি যে ওর পারফিউমের ঘ্রাণ পেতাম, তার মানে কি কোমায় থাকা অবস্থায় ওর আত্মা আমার ঘরে ঘুরে বেড়াত?

ধুর! তাই বা হতে যাবে ক্যানো। ও তো আমাকে ভালোবাসেনি। ও ভালোবেসেছে আবীরকে।



আমাকে তুতুলও ভালোবাসেনি। মাস চারেক প্রেমিকার মত আচরণ করেছে শুধু হয়তো ফারিয়াকে ভোলানোর জন্যেই। ও যখন বুঝতে পেরেছে আমি ফারিয়াকে ভুলে গেছি, আবার আমি ওর প্রতি দুর্বল না হওয়ার জন্য ওকেও এড়িয়ে যেতে চাচ্ছি, সেও তো যোগাযোগ বন্ধই করে দিলো।



আমাকে ওরা কেউ ভালোবাসেনি। শুধু যখন একা একা বারান্দায় চুপ করে বসে থাকি , এখনও আমার ছোট্ট মেয়ে সুপ্তি এসে মিষ্টি কণ্ঠে বলে, "বাবা তোমার মন খারাপ?"



এখনও আমি রবি ঠাকুরের গান গাই।



"ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে,

তারে আজ থামায় কে রে।

সে যে আকাশ পানে হাত পেতেছে।

তারে আজ নামায় কে রে। "



আমি আমার কন্যা সুপ্তির মন সব সময় মাতিয়ে রাখি। তাকে যেন কোনোদিন ভাবতে না হয়, "আমাকে কেউ ভালোবাসে নি।'' আর আমি এটাও জানি, আমাকে আর কেউ ভালো না বাসলেও আমার মেয়ে আমাকে ভালোবাসে।



গল্প- 'মন মেতেছে'

সন্ধি মুহিদ

August 2013

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:০৫

বেলা শেষে বলেছেন: good writing, very beautiful.

০৮ ই মার্চ, ২০১৪ ভোর ৪:০২

সন্ধি মুহিদ বলেছেন: ধন্যবাদ

২| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১১:২০

অপু তানভীর বলেছেন: গল্পটা ফেসবুকে পড়েছি ! ভাল লেগেছে ! :)

০৮ ই মার্চ, ২০১৪ ভোর ৪:০১

সন্ধি মুহিদ বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৪:১১

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: গল্পটা বেশ ভালো লাগল। চমৎকার।

০৮ ই মার্চ, ২০১৪ ভোর ৪:০১

সন্ধি মুহিদ বলেছেন: ধন্যবাদ

৪| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:২৮

অরুদ্ধ সকাল বলেছেন:
লেখনিতে জাদু আছে। অনেকদুর যাবে

০৮ ই মার্চ, ২০১৪ ভোর ৪:০০

সন্ধি মুহিদ বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.