![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(1)
14 ই জুন, 1214 ইং, শনিবার ভোরে রওনা দিলাম। রাস্তায় কোন রিকশা নেই। গতরাতে শবেবরাতের নামাজ পরে সবাই ঘুমাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ যে ধর্মপ্রাণ, এসব দিনগুলো দেখলেই বুঝা যায়। পিএইচডি থিসিসের প্রয়োজন নেই। কিন্তু একটি শ্রেণী এই সহজ কথাটা কেন যে বুঝতে চায় না সেটা বুঝার জন্য গবেষণা চালানো যেতে পারে বৈকি!
(2)
অগত্যা হাটা ধরলাম। বাসে উঠলাম, আমিই প্রথম যাত্রী। বেশকিছুক্ষণ বাস চলার পর হঠাৎ শুনি চেচামেচি। কি ব্যপার? উল্টো দিক থেকে আসা এক ট্রাকের সাথে ঝগড়া বাধিয়েছে ড্রাইভার। আমাদের একজন বাংলা টিচার ছিলেন যিনি জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়েছেন সৌদিতে, প্রায়ই বলতেন : সে দেশে দুই ড্রাইভার মুখোমুখি হলে পরস্পর চা বিনিময় করতো। এর জন্য ফ্লাস্ক ভরে চা নিয়ে আসতো ভোরেই। আমাদের দেশের ড্রাইভাররা দরিদ্র, চা বিনিময় করার মতো অত পয়সা নেই, কিন্তু তারাও পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বিনিময় করে - গালি!
(3)
এখন আমি গাউছিয়ায়। বাংলাদেশের মানুষ উৎসবপ্রিয়। বিভিন্ন উপলক্ষে মাতামাতি করার পুরোনো অভ্যাস। এখন চলছে ফুটবল জোয়ার। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সবাই আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পিছনে ছুটছে। পতাকা টানানো নিয়ে মারামারি করছে। উঠতি চেংরা ছাত্রনেতারা পতাকার স্পন্সর হয়ে "দেশসেবা" করছে। বাসাবোতে বেশ ক'বছর আগে পতাকার উপর-নিচ নিয়ে অভিমানে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। বেচারা বাড়িওয়ালা রীতিমতো নজর-নেওয়াজ করে সে ভূত তাড়াতে হয়েছে! তো,গাউছিয়াতে দেখলাম এক কারখানা মালিক তার পুরো ভবনটাকেই আর্জেন্টিনার পতাকা বানিয়ে ফেলেছে। ছাদ, চারপাশে টিনের দেয়াল। তিনি প্লাস্টিকের আকাশি-সাদা টিনে আর্জেন্টিনার পতাকা ফুটিয়ে তুলেছেন। এসব দেখতে দেখতে গাউছিয়া পার হলাম।
(4)
গুলিস্তানে পৌছেলাম। মোঘল আমলে এখানে ফুলবাগান ছিল বলে নাম দেয়া হয়েছে "গুলিস্তান"। গুল ফার্সি শব্দ, অর্থ হল ফুল। কিন্তু বর্তমানে নাম বহাল তবিয়তে থাকলেও অর্থ পাল্টে গেছে। গুল আর ফার্সি গুল নেই। বাংলা গুল হয়ে গেছে। যার অর্থ হচ্ছে -চাপাবাজি, ধাপ্পাবাজী। যথার্থ নামকরণ বটে! দুনিয়ার এমন কোন প্রতারণা নেই যা এখানে অহর্নিশ ঘটছে না। ফিরতি পথে লিচু কিনলাম একশ, বাড়ি গিয়ে গুনে দেখা গেল লিচু আছে আশিটি। এমন একটা জায়গায় ঘুরঘুর করতে বুকের পাটা লাগে। আমার সেটা নেই! তবে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে এবার সুযোগ হয়ে গেল। আমি রওনা দিয়েছি নরসিংদী থেকে তাই গুলিস্তান পৌঁছে গেছি সকাল সাড়ে আটটায়। বাকি পাঁচজন এসেছেন "ঢাকা" থেকে তাই সাড়ে নয়টা বাজিয়েছেন। এ সময়টুকু বায়তুল মোকাররম ও স্টেডিয়াম এর আশপাশে হেঁটেছি। জাতীয় স্টেডিয়ামের নাম ভাসানী থেকে পাল্টে বঙ্গবন্ধু রাখলেও বেচারা ভাসানীর একটি ম্যুরাল এখনো দেয়ালে রয়ে গেছে। ভাসানীর প্রতি এটা হয়তো আওয়ামী লীগের অনুগ্রহ । ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ তার কৃতজ্ঞতা ভালই আদায় করছে! নভোথিয়েটার থেকে তাড়িয়েছে। স্টেডিয়াম থেকেও বিদায় করেছে। সর্বশেষ পাঠ্যপুস্তক থেকেও এই আপদ দূর করেছে। কার এত বড় স্পর্ধা! মুজিবের আগে তার নাম থাকবে! ভাসানী যেহেতু আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা, ক্রমানুসারে তার নামটা আগে আসবে এটাই স্বাভাবিক! কিন্তু নাস্তিক্যতাবাদের ভূত আক্রান্ত নব্য আওয়ামী লীগের সেটা সহ্য হবে কেন? দে বেটাকে বিদেয় করে। আমার মনে হয় -আমাদের এই সোনালী দেশটার নাম বাংলাদেশ না হয়ে "মুজিবদেশ" হলেই বরং আজকের আওয়ামী লীগাররা অধিক প্রীত হত। পতাকায় লাল-সবুজের পরিবর্তে মুজিব-হাসিনার ফটোতেই তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।
(5)
পদ্মা :
নবাবগঞ্জের গাড়িতে উঠলাম। ঢাকা ছেড়ে গাড়ি যতই ভিতরে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে বাংলাদেশে প্রবেশ করছি! সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ!! প্রায় দু'ঘন্টার জার্নি শেষে ঘাটে পৌছলাম, যায়গার নাম মৈনটঘাট। এখান থেকে ট্রলার বা স্পীডবোটে নদী পারাপার। আমাদের ফরিদপুর ট্যুরের অন্যতম কারণ হল এনামুল হাসানের দেখানো এডভেঞ্চারের লোভ! তার বর্ননায় মনে হতো -বোটে চড়ে মৃত্যুপুরিতে যাত্রা! সুতরাং বোটই সই। সাথে কিন্তু একজন আছে সাঁতার না জানা। সে ততক্ষণে খতমে ইউনুস শুরু করেছে কিনা আমার জানা নেই। লোকজনের সামনে তো আর বলা যায় না -সাঁতার জানে না, কারণ সে দেখতে শুনতে আমাদের সবার বড়।প্রেস্টিজ ইস্যু। তাই বলতাম -অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী সাঁতারু!!! দুখের কথা কাকে বলি, বোট পার হল। কিন্তু পদ্মা পার হলাম নাকি বাড়ির পাশের ডোবা পার হলাম টেরই পেলাম না।
পদ্মায় এখনো কিছুটা পানি আছে। "তিস্তাভাগ্য " বরন করেনি। বিজেপি সরকারের এই মেয়াদে হয়তো বরন করে নিতেও পারে। ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী হয়েছেন উমা ভারতী। কট্টরপন্থী হিসাবে পরিচিত। উদারপন্থী কংগ্রেস সরকার তিস্তা নদীকে তিস্তা "মরু" বানিয়েছে, কট্টরপন্থী বিজেপি হয়তো সেই মরুতে উটপালনের পরামর্শ দিতে পারে। অবশ্য "সু" প্রতিবেশী হিসাবে বাংলাদেশ ভারত থেকে উট আমদানির জন্য "সহজ" শর্তে ঋণ পাবে !সেই সাথে পাবে অগ্রাধিকার!!
(6)
ফরিদপুর :
এতক্ষণ সবাই নীরব ছিলো। পদ্মা পার হয়ে সরব হয়ে গেলো। আমার দায়িত্ব পড়লো ফরিদপুরের 101 টি দোষ বের করার। নাম্বার ওয়ান - ফরিদপুরের ছাগলগুলো বেশি কালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম ছাগলগুলো এখনো কেন লাক্সের ছোঁয়া পায়নি? পেলে তো তারা "গট ইউনিভার্স"(মিস ইউনিভার্স) বা "গট ওয়ার্ল্ড"(মিস ওয়ার্ল্ড) প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারতো। এনাম বলেছিলো বোট থেকে নেমে অটোরিক্সায় ওদের বাড়ি কুড়ি মিনিটের পথ। তিন কুড়ি পার হয়ে গেল মাগার বাড়ির খবর নাই। অবশেষে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম - ভাই, হাছা কইরা কনছে, আপ্নের বাড়ি কি ফরিদপুরেই?
অপেক্ষার পালা শেষ হলো! বাড়িতে ঢুকেই সম্মিলিতভাবে যে কাজটা করলাম, বাড়িটা নিজেদের বানিয়ে নিলাম। তারপর নজর দিলাম ডাব গাছে। অন্য বাড়ির ছেনি এনে বাঁকিয়ে ফেললাম। ডাব রয়ে গেল "বৃক্ষচূড়ায়"। এখানে অবশ্য দোষ নাম্বার টু বের হলো- ফরিদপুরের ডাবগুলো সব চোখা চোখা।
দ্বিতীয় দিন রোববার দিনচুক্তি অটোরিক্সা ভাড়া করলাম। আটরশি ও চন্দ্রপারার মাযার , পল্লীকবি জসিমউদ্দিন এর বাড়ি ও পদ্মার পাড় ঘুরিয়ে দেখাবে। আটশত টাকা। কপাল মন্দ, দুই মাযার ঘুরেই চার্জ শেষ। পরদিন আবার ফেরার পালা। জসিমউদ্দিন এর বাড়ি না দেখেই ফিরতে হবে, ভেবেই মন খারাপ।
(7)
ভয়ঙ্কর আটরশি:
বহুদিন ধরে নাম শুনছি, পোস্টার দেখছি আটরশির, জাকের পার্টির। এবার দেখার পালা। আগে থেকেই মনে মনে একটি চিত্র সাজিয়ে রেখেছি, কিন্তু বাস্তবতা যে এত ভয়ঙ্কর, কখনো ভাবিনি! গেটে নামতেই দারোয়ান বললো -জুতা খুলে!! জৈষ্ঠ্যর প্রচন্ড দাবদাহে উত্তপ্ত ইট-সুরকির রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে হবে ভেবে মনটা খিঁচড়ে গেল। রাসুলুল্লাহ সা. এর পবিত্র রওজা মোবারকে জুতা পরে গেলে তাঁর সম্মানহানি হয় না, কোথাকার কোন গাঁজাবাবার ইজ্জত চলে যায়। ইজ্জত যদি এতোই চলে যেতে চায় তবে তা টেনেটুনে রাখাবার দরকারটা কি শুনি?
স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সা. এর সাথে সাহাবায়ে কেরাম জুতা পায়ে নামাজ পড়েছেন। যাহোক, জুতা খুলেই ঢুকলাম। ভেতরে শয়তানির এক মহা আখড়া! গো -শালা, ছাগল -শালা, মুরগি -শালা, ভেড়া -শালা, হরিণ -শালা, উট -শালাসহ আরও হুলস্থুল ব্যাপার স্যাপার।
আমরা ঢুকার সময়ই এক বেচারা মুরগি নিয়ে এলো। আমি বলেছিলাম - মুরগি মাজারে রেখে আসবে, সেই সাথে রেখে আসবে অমূল্য সম্পদ ঈমানটা। মান্নত হবে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য, কোন বাবার জন্য নয়। কেউ যদি এই বিশ্বাসে বাবার নামে মান্নত করে যে, সে তার বিপদ দূর করবে,তবে এটা সরাসরি শিরিক। এই লোক ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে যাবে।
আমাদের দেশের এলিটরা আবার এগুলোতে ভেরি ইন্টারেস্টেড। সারা জীবন নামাজ-রোজার ধার না ধরে, চুরি জোচ্চুরি করে যদি দুটা গরু দিয়ে পার পাওয়া যায়, তবে মন্দ কি? ইসলামের মূল্য চুকিয়ে দিচ্ছে দুখান গরু! আহ .... শত আফসোস এদের বিবেকের উপর।
মূল কবর দেখতে যাব,তাদের ভাষায় যেটা রওজা শরীফ, দেয়ালে লেখা -সেজদা করা নিষেধ! একটু শান্তি পেলাম। কিন্তু সেটা পরক্ষনেই উবে গেল যখন আখড়ার ভেতরে ঢুকলাম। বিশাল এরিয়া নিয়ে একটি মসজিদের মত, সামনে কবর, এর পাশে তিনটি টেবিল ফ্যান। অন্তত শ-দেড়েক লোক হাতজোড় করে, কোমর বাঁকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে সোনার গাঁ বা অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানের দেয়ালে খোদিত রাজা-বাদশাদের সামনে দাঁড়ানো চাটুকার, তোষামোদীদের মতো। এদের কাজই হলো সারাদিন এভাবে কাতার ধরে নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা। যেনো দর্শনার্থীদের ভড়কে দেয়া যায়।
আমরা ঢুকতেই বেশ ক'জন দৌড়ে এসে শিখিয়ে দিল হাতজোড় করে নমস্কারের ভংগিতে যেতে। মনটা দ্বিগুণ খারাপ হলো। কবরবাসী যদি সত্যিই মুসলিম হয়ে থাকে তবে কেন মুসলিম রীতিতে সম্মান তার পোষাবে না? হিন্দুয়ানী রীতি ধার এনে তাকে সম্মান জানাতে হবে?
তার কবরে কিচ্ছু পরিনি, বরং লানত দিতে ইচ্ছে করেছে। এই বেটা শিরিকের পথগুলোকে তার আদাবুল মুরীদ নামক গ্রন্থে লিখেছে। কিন্তু কাফের অবস্থায় মারা গেছে এটা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলে লানত করা নিষেধ বিধায় বিরত র্ইলাম। বের হবার সময় আবার উল্টো পায়ে বেরুতে হয়। বাবার কবরের পাশেই অনবরত গরু-ছাগল লেদাচ্ছে, এতে সম্মানহানি হয় না। হয় পিছন ফিরে বের হলে! এখানকার পূর্ব পীর ছিলো হাশমতুল্লাহ। বর্তমানে তার বড় পোলা মাহফুজুল হক আধ্যাত্মিক দিক দেখাশুনা করে আর পার্থিব দিক দেখাশোনা করে পরেরজন ফয়সাল।তারা দু জনই থাকে ঢাকায়। এখানে দেখাশোনার দায়িত্বে আছে জনাব কাবুল সাহেব। তার সাথে দেখা করতে গেলাম, চা পানে গিয়েছেন, দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে চলে এলাম। বহু চেষ্টা করেও মোবাইল নাম্বার নেয়া গেল না। জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা ছিলো - এখানকার হরিণগুলো বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন মেনে রাখা হয় কিনা?
(8)
চন্দ্রপাড়া:
তারপর গেলাম চন্দ্রপাড়ায়। উপরোক্ত সমস্ত ভন্ডামীসহ সেখানে আরও কিছু অতিরিক্ত আছে।সবার মাথায় লাল রুমাল, তার উপর ফিতা বাঁধা। যাতে লেখা -আনসার। হাতজোড় করে ঢুকতে হয় বিধায় এখানকার মাযারে ঢুকিনি। এ নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। জোহর নামাজের সময় হয়ে গেল, সাথিরা জানতে চাইলো নামাজ এখানে পড়ব কিনা? বললাম আমার মন সায় দেয় না এদের পিছনে নামাজ পড়তে। যার যার মতো দু রাকাত কছর(48 মাইলের বেশি ভ্রমণ করলে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ দু রাকাত পড়তে হয়) পড়ে বেরিয়ে এলাম। মৌমাছির মতো ঘিরে ধরলো, কেন নামাজ না পড়ে চলে যাচ্ছি? জবাব দিয়ে চলে এলাম। নামাজের পূর্বে সুন্নত পড়ার সময় দেখলাম এক বুড়া ব্যাংগের মতো চার -পাঁচটি লাফ দিলো। প্রতি লাফেই বলছিলো -বাবা! বাবা!!
সেজদায় গিয়ে অনবরত বলতে থাকলো সেই শয়তানী জপ। মনটা বিষিয়ে গেলো, দ্রুত বের হয়ে এলাম।
উভয় মাযারেই যে বিষয়টা পীড়া দিয়েছে - কবরটা খুব সুন্দর, ঝকঝকে। আর জুতা ছাড়া ঘুরাঘুরি করে মসজিদে ঢুকার ফলে মসজিদের অবস্থা খুবই করুন! সেজদা করা দায়। উরসের সময় রীতিমতো ভয়াবহ আকার ধারন করে। গুবরে মসজিদ ভরে যায়।
(9)
তৃতীয়দিন সোমবার ফেরার কথা। কিন্তু ফেরা হল না। এনামের আম্মুর অসাধারণ মেহমানদারীর ফলে আমাদের প্রায় সবার "পেট খারাপ"। পাঠক আবার ভাববেন না যে আমাদের মেশিন দুর্বল! কারণ আমাদের সাথে ছিলেন বিএমডব্লু মেশিনওয়ালা ফয়সাল ভাই! তিনিও একই পথের যাত্রী। অবশ্য তাকে কাত করতে সময় লেগেছে! এছাড়াও - আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সেরা মেজবান এনামের আব্বু-আম্মু। কারণ মানুষের শ্রমের পারিশ্রমিক আদায় করা যায়, খরচকৃত টাকা পয়সা ফেরত দেয়া যায়, কিন্তু স্নেহ-মায়ার মূল্য পরিশোধ করার মতো কোন বস্তু এখনও আবিষ্কৃত হয় নি, ভালবাসার বিনিময় দেয়ার মতো কোন টাকা পৃথিবীর কোন টাকশাল এখনো তৈরি করেনি। পাঁচ অজানা-অচেনা বাউন্ডুলেকে তারা যে পরম মমতায় আপ্যায়ন করেছেন সত্যিই তার কোনো তুলনা হয় না।শুধু বলি -জাযাকাল্লাহু খাইরান!!!
সেদিন দুপুরে -হুমায়ূনের হিমুর আছে জল'র মতো ঘটনা ঘটলো। যেখানে একের পর এক নায়কের আভির্ভাব হয়। প্রথম নায়ক ফয়সাল ভাই! গুতিয়ে কুদিয়ে সবাইকে চারটায় ঘুম থেকে তুললেন, এখনই ঢাকা চলে যাবেন। এরপর আভির্ভূত হলেন এনামের আম্মু ও নানু। কিছুতেই এই অবেলায় যেতে দিবেন না। কিন্তু ফয়সাল ভাই বিজয়ী। আমরা বের হয়ে যাব এমন সময় উদয় হলেন এনামের আব্বু, হাতে রাতে রান্নার জন্য রুই মাছ, লতি ও অন্যান্য তরকারি। এমন মুহূর্তে যাওয়া যায় না। ফয়সাল ভাইকে হটিয়ে তিনিই বিজয়ী হলেন! সবশেষে আমি! কাপড় চোপড় পড়ে ফেলেছি যেহেতু একটা ট্যুর হয়ে যাক। গন্তব্য অবশ্যই সেই কাংখিত স্থান - পল্লীকবি জসিমুদ্দীনের বাড়ি।
(10)
জসিম উদ্দিন:
কবির বাড়ি পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। প্রথমে তাঁর কবর যিয়ারত করলাম।তারপর ফটাফট কিছু ফটো তুললাম।
ঘুরে দেখলাম। খুব ভালো লাগলো। মনে হচ্ছিলো -বাংলা গ্রামীণ সাহিত্যের কিংবদন্তীর ছোঁয়ার উষ্ণতা এখনো লেগে আছে এই বাড়ির সবখানে। সন্ধ্যার পর গেলাম বিখ্যাত সেই কুমার নদীর ধারে যার পাশে বসে কবি রচনা করতেন অমর সব কবিতা। সেই ডালিম গাছের স্থানটিও দেখলাম, যার ছায়ায় বসে আবিষ্কার করেছিলেন আসমানিকে। এই গাছটি এ পর্যন্ত তিন চারবার লাগানো হয়েছে! কুমার নদীর ধারে তার বসার স্থানটিকে পাকা করা হয়েছে। বহু কসরত করেও এর ফটো নেওয়া গেল না অন্ধকারের কারণে।
কবির বাড়ি ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে। অটো-রিকশা সবাই চেনে।
(11)
ফেরার পালা:
মঙ্গলবার! সাত সকালেই ফেরার প্রস্তুতি! সাড়ে সাতটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম, ফেরার পুরোটা পথ কেউই তেমন কথা বলেনি, অন্যদের কারণ বলতে পারবো না, আমার কারণ ছিলো বিষন্নতা। এই বাড়ি ও বাড়িওয়ালারা তিনদিনে আমাদেরকে যতটুকু আপন করে নিয়েছে অন্যখানে হয়তো তিনবছর লেগে যাবে। আসার পথে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। ঢাকা-নবাবগঞ্জের ড্রাইভাররা সবাই নবাব! বাপের পথে গাড়ি চালায়! এই রুটের নিয়ম হল কেউ কাউকে ওভারটেক করতে দিবে না। আসার পথে এর ফলে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়েছি।
(12)
যাতায়াত :
গুলিস্থান গোলাপ শাহ থেকে যমুনা ও এন মল্লিক নামে দুটি বাস নবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া 90 টাকা। তবে যমুনাতে গেলে ঘাট পর্যন্ত যাওয়া যাবে। মল্লিকে গেলে একটু আগে নেমে এক প্রকার বিশেষ যানবাহনে চড়িয়া ঘাটে যাইতে হইবে "। এগুলো শুধুমাত্র ফরিদপুরেই পাওয়া যায়। না রিকশা, না অটো, না নসিমন! বরং তিনটার সমন্বয়ে তৈরি। অবশ্য এই পথটুকু অসাধারন! আমরা যখন এই পথটুকু অতিক্রম করার সময় পথ শেষের উত্তেজনায় অনেকেই দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু অচিরেই আবার বসতে হল। আমি বললাম কি মারুফ ভাই! বসে যে! তিনি চমৎকার একটি জবাব দিলেন -রোলার কোস্টারে দাঁড়িয়ে থাকার নিয়ম নেই! ঘাট থেকে ট্রলারে 70 টাকা, বোটে 150 টাকা ওপার। সেখান থেকে মোটরসাইকেল, অটো বা একটু সামনে থেকে বাস ফরিদপুর শহরে। তারপর আনলিমিটেড ঘুরাঘুরি!!!এছাড়াও মাওয়া হয়ে ফরিদপুর যাওয়া যায় কিন্তু সে পথে টাকা ফুরিয়ে যাবে, জানও বেরিয়ে যাবে।
বাই বাই(1)
14 ই জুন, 1214 ইং, শনিবার ভোরে রওনা দিলাম। রাস্তায় কোন রিকশা নেই। গতরাতে শবেবরাতের নামাজ পরে সবাই ঘুমাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ যে ধর্মপ্রাণ, এসব দিনগুলো দেখলেই বুঝা যায়। পিএইচডি থিসিসের প্রয়োজন নেই। কিন্তু একটি শ্রেণী এই সহজ কথাটা কেন যে বুঝতে চায় না সেটা বুঝার জন্য গবেষণা চালানো যেতে পারে বৈকি!
(2)
অগত্যা হাটা ধরলাম। বাসে উঠলাম, আমিই প্রথম যাত্রী। বেশকিছুক্ষণ বাস চলার পর হঠাৎ শুনি চেচামেচি। কি ব্যপার? উল্টো দিক থেকে আসা এক ট্রাকের সাথে ঝগড়া বাধিয়েছে ড্রাইভার। আমাদের একজন বাংলা টিচার ছিলেন যিনি জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়েছেন সৌদিতে, প্রায়ই বলতেন : সে দেশে দুই ড্রাইভার মুখোমুখি হলে পরস্পর চা বিনিময় করতো। এর জন্য ফ্লাস্ক ভরে চা নিয়ে আসতো ভোরেই। আমাদের দেশের ড্রাইভাররা দরিদ্র, চা বিনিময় করার মতো অত পয়সা নেই, কিন্তু তারাও পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বিনিময় করে - গালি!
(3)
এখন আমি গাউছিয়ায়। বাংলাদেশের মানুষ উৎসবপ্রিয়। বিভিন্ন উপলক্ষে মাতামাতি করার পুরোনো অভ্যাস। এখন চলছে ফুটবল জোয়ার। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সবাই আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পিছনে ছুটছে। পতাকা টানানো নিয়ে মারামারি করছে। উঠতি চেংরা ছাত্রনেতারা পতাকার স্পন্সর হয়ে "দেশসেবা" করছে। বাসাবোতে বেশ ক'বছর আগে পতাকার উপর-নিচ নিয়ে অভিমানে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। বেচারা বাড়িওয়ালা রীতিমতো নজর-নেওয়াজ করে সে ভূত তাড়াতে হয়েছে! তো,গাউছিয়াতে দেখলাম এক কারখানা মালিক তার পুরো ভবনটাকেই আর্জেন্টিনার পতাকা বানিয়ে ফেলেছে। ছাদ, চারপাশে টিনের দেয়াল। তিনি প্লাস্টিকের আকাশি-সাদা টিনে আর্জেন্টিনার পতাকা ফুটিয়ে তুলেছেন। এসব দেখতে দেখতে গাউছিয়া পার হলাম।
(4)
গুলিস্তানে পৌছেলাম। মোঘল আমলে এখানে ফুলবাগান ছিল বলে নাম দেয়া হয়েছে "গুলিস্তান"। গুল ফার্সি শব্দ, অর্থ হল ফুল। কিন্তু বর্তমানে নাম বহাল তবিয়তে থাকলেও অর্থ পাল্টে গেছে। গুল আর ফার্সি গুল নেই। বাংলা গুল হয়ে গেছে। যার অর্থ হচ্ছে -চাপাবাজি, ধাপ্পাবাজী। যথার্থ নামকরণ বটে! দুনিয়ার এমন কোন প্রতারণা নেই যা এখানে অহর্নিশ ঘটছে না। ফিরতি পথে লিচু কিনলাম একশ, বাড়ি গিয়ে গুনে দেখা গেল লিচু আছে আশিটি। এমন একটা জায়গায় ঘুরঘুর করতে বুকের পাটা লাগে। আমার সেটা নেই! তবে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে এবার সুযোগ হয়ে গেল। আমি রওনা দিয়েছি নরসিংদী থেকে তাই গুলিস্তান পৌঁছে গেছি সকাল সাড়ে আটটায়। বাকি পাঁচজন এসেছেন "ঢাকা" থেকে তাই সাড়ে নয়টা বাজিয়েছেন। এ সময়টুকু বায়তুল মোকাররম ও স্টেডিয়াম এর আশপাশে হেঁটেছি। জাতীয় স্টেডিয়ামের নাম ভাসানী থেকে পাল্টে বঙ্গবন্ধু রাখলেও বেচারা ভাসানীর একটি ম্যুরাল এখনো দেয়ালে রয়ে গেছে। ভাসানীর প্রতি এটা হয়তো আওয়ামী লীগের অনুগ্রহ । ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ তার কৃতজ্ঞতা ভালই আদায় করছে! নভোথিয়েটার থেকে তাড়িয়েছে। স্টেডিয়াম থেকেও বিদায় করেছে। সর্বশেষ পাঠ্যপুস্তক থেকেও এই আপদ দূর করেছে। কার এত বড় স্পর্ধা! মুজিবের আগে তার নাম থাকবে! ভাসানী যেহেতু আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা, ক্রমানুসারে তার নামটা আগে আসবে এটাই স্বাভাবিক! কিন্তু নাস্তিক্যতাবাদের ভূত আক্রান্ত নব্য আওয়ামী লীগের সেটা সহ্য হবে কেন? দে বেটাকে বিদেয় করে। আমার মনে হয় -আমাদের এই সোনালী দেশটার নাম বাংলাদেশ না হয়ে "মুজিবদেশ" হলেই বরং আজকের আওয়ামী লীগাররা অধিক প্রীত হত। পতাকায় লাল-সবুজের পরিবর্তে মুজিব-হাসিনার ফটোতেই তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।
(5)
পদ্মা :
নবাবগঞ্জের গাড়িতে উঠলাম। ঢাকা ছেড়ে গাড়ি যতই ভিতরে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে বাংলাদেশে প্রবেশ করছি! সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ!! প্রায় দু'ঘন্টার জার্নি শেষে ঘাটে পৌছলাম, যায়গার নাম মৈনটঘাট। এখান থেকে ট্রলার বা স্পীডবোটে নদী পারাপার। আমাদের ফরিদপুর ট্যুরের অন্যতম কারণ হল এনামুল হাসানের দেখানো এডভেঞ্চারের লোভ! তার বর্ননায় মনে হতো -বোটে চড়ে মৃত্যুপুরিতে যাত্রা! সুতরাং বোটই সই। সাথে কিন্তু একজন আছে সাঁতার না জানা। সে ততক্ষণে খতমে ইউনুস শুরু করেছে কিনা আমার জানা নেই। লোকজনের সামনে তো আর বলা যায় না -সাঁতার জানে না, কারণ সে দেখতে শুনতে আমাদের সবার বড়।প্রেস্টিজ ইস্যু। তাই বলতাম -অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী সাঁতারু!!! দুখের কথা কাকে বলি, বোট পার হল। কিন্তু পদ্মা পার হলাম নাকি বাড়ির পাশের ডোবা পার হলাম টেরই পেলাম না।
পদ্মায় এখনো কিছুটা পানি আছে। "তিস্তাভাগ্য " বরন করেনি। বিজেপি সরকারের এই মেয়াদে হয়তো বরন করে নিতেও পারে। ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী হয়েছেন উমা ভারতী। কট্টরপন্থী হিসাবে পরিচিত। উদারপন্থী কংগ্রেস সরকার তিস্তা নদীকে তিস্তা "মরু" বানিয়েছে, কট্টরপন্থী বিজেপি হয়তো সেই মরুতে উটপালনের পরামর্শ দিতে পারে। অবশ্য "সু" প্রতিবেশী হিসাবে বাংলাদেশ ভারত থেকে উট আমদানির জন্য "সহজ" শর্তে ঋণ পাবে !সেই সাথে পাবে অগ্রাধিকার!!
(6)
ফরিদপুর :
এতক্ষণ সবাই নীরব ছিলো। পদ্মা পার হয়ে সরব হয়ে গেলো। আমার দায়িত্ব পড়লো ফরিদপুরের 101 টি দোষ বের করার। নাম্বার ওয়ান - ফরিদপুরের ছাগলগুলো বেশি কালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম ছাগলগুলো এখনো কেন লাক্সের ছোঁয়া পায়নি? পেলে তো তারা "গট ইউনিভার্স"(মিস ইউনিভার্স) বা "গট ওয়ার্ল্ড"(মিস ওয়ার্ল্ড) প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারতো। এনাম বলেছিলো বোট থেকে নেমে অটোরিক্সায় ওদের বাড়ি কুড়ি মিনিটের পথ। তিন কুড়ি পার হয়ে গেল মাগার বাড়ির খবর নাই। অবশেষে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম - ভাই, হাছা কইরা কনছে, আপ্নের বাড়ি কি ফরিদপুরেই?
অপেক্ষার পালা শেষ হলো! বাড়িতে ঢুকেই সম্মিলিতভাবে যে কাজটা করলাম, বাড়িটা নিজেদের বানিয়ে নিলাম। তারপর নজর দিলাম ডাব গাছে। অন্য বাড়ির ছেনি এনে বাঁকিয়ে ফেললাম। ডাব রয়ে গেল "বৃক্ষচূড়ায়"। এখানে অবশ্য দোষ নাম্বার টু বের হলো- ফরিদপুরের ডাবগুলো সব চোখা চোখা।
দ্বিতীয় দিন রোববার দিনচুক্তি অটোরিক্সা ভাড়া করলাম। আটরশি ও চন্দ্রপারার মাযার , পল্লীকবি জসিমউদ্দিন এর বাড়ি ও পদ্মার পাড় ঘুরিয়ে দেখাবে। আটশত টাকা। কপাল মন্দ, দুই মাযার ঘুরেই চার্জ শেষ। পরদিন আবার ফেরার পালা। জসিমউদ্দিন এর বাড়ি না দেখেই ফিরতে হবে, ভেবেই মন খারাপ।
(7)
ভয়ঙ্কর আটরশি:
বহুদিন ধরে নাম শুনছি, পোস্টার দেখছি আটরশির, জাকের পার্টির। এবার দেখার পালা। আগে থেকেই মনে মনে একটি চিত্র সাজিয়ে রেখেছি, কিন্তু বাস্তবতা যে এত ভয়ঙ্কর, কখনো ভাবিনি! গেটে নামতেই দারোয়ান বললো -জুতা খুলে!! জৈষ্ঠ্যর প্রচন্ড দাবদাহে উত্তপ্ত ইট-সুরকির রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে হবে ভেবে মনটা খিঁচড়ে গেল। রাসুলুল্লাহ সা. এর পবিত্র রওজা মোবারকে জুতা পরে গেলে তাঁর সম্মানহানি হয় না, কোথাকার কোন গাঁজাবাবার ইজ্জত চলে যায়। ইজ্জত যদি এতোই চলে যেতে চায় তবে তা টেনেটুনে রাখাবার দরকারটা কি শুনি?
স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সা. এর সাথে সাহাবায়ে কেরাম জুতা পায়ে নামাজ পড়েছেন। যাহোক, জুতা খুলেই ঢুকলাম। ভেতরে শয়তানির এক মহা আখড়া! গো -শালা, ছাগল -শালা, মুরগি -শালা, ভেড়া -শালা, হরিণ -শালা, উট -শালাসহ আরও হুলস্থুল ব্যাপার স্যাপার। আমরা ঢুকার সময়ই এক বেচারা মুরগি নিয়ে এলো। আমি বলেছিলাম - মুরগি মাজারে রেখে আসবে, সেই সাথে রেখে আসবে অমূল্য সম্পদ ঈমানটা। মান্নত হবে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য, কোন বাবার জন্য নয়। কেউ যদি এই বিশ্বাসে বাবার নামে মান্নত করে যে, সে তার বিপদ দূর করবে,তবে এটা সরাসরি শিরিক। এই লোক ইসলামের গন্ডি থেকে বের হয়ে যাবে।
আমাদের দেশের এলিটরা আবার এগুলোতে ভেরি ইন্টারেস্টেড। সারা জীবন নামাজ-রোজার ধার না ধরে, চুরি জোচ্চুরি করে যদি দুটা গরু দিয়ে পার পাওয়া যায়, তবে মন্দ কি? ইসলামের মূল্য চুকিয়ে দিচ্ছে দুখান গরু! আহ .... শত আফসোস এদের বিবেকের উপর।
মূল কবর দেখতে যাব,তাদের ভাষায় যেটা রওজা শরীফ, দেয়ালে লেখা -সেজদা করা নিষেধ! একটু শান্তি পেলাম। কিন্তু সেটা পরক্ষনেই উবে গেল যখন আখড়ার ভেতরে ঢুকলাম। বিশাল এরিয়া নিয়ে একটি মসজিদের মত, সামনে কবর, এর পাশে তিনটি টেবিল ফ্যান। অন্তত শ-দেড়েক লোক হাতজোড় করে, কোমর বাঁকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে সোনার গাঁ বা অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানের দেয়ালে খোদিত রাজা-বাদশাদের সামনে দাঁড়ানো চাটুকার, তোষামোদীদের মতো। এদের কাজই হলো সারাদিন এভাবে কাতার ধরে নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা। যেনো দর্শনার্থীদের ভড়কে দেয়া যায়।
আমরা ঢুকতেই বেশ ক'জন দৌড়ে এসে শিখিয়ে দিল হাতজোড় করে নমস্কারের ভংগিতে যেতে। মনটা দ্বিগুণ খারাপ হলো। কবরবাসী যদি সত্যিই মুসলিম হয়ে থাকে তবে কেন মুসলিম রীতিতে সম্মান তার পোষাবে না? হিন্দুয়ানী রীতি ধার এনে তাকে সম্মান জানাতে হবে?
তার কবরে কিচ্ছু পরিনি, বরং লানত দিতে ইচ্ছে করেছে। এই বেটা শিরিকের পথগুলোকে তার আদাবুল মুরীদ নামক গ্রন্থে লিখেছে। কিন্তু কাফের অবস্থায় মারা গেছে এটা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলে লানত করা নিষেধ বিধায় বিরত র্ইলাম। বের হবার সময় আবার উল্টো পায়ে বেরুতে হয়। বাবার কবরের পাশেই অনবরত গরু-ছাগল লেদাচ্ছে, এতে সম্মানহানি হয় না। হয় পিছন ফিরে বের হলে! এখানকার পূর্ব পীর ছিলো হাশমতুল্লাহ। বর্তমানে তার বড় পোলা মাহফুজুল হক আধ্যাত্মিক দিক দেখাশুনা করে আর পার্থিব দিক দেখাশোনা করে পরেরজন ফয়সাল।তারা দু জনই থাকে ঢাকায়। এখানে দেখাশোনার দায়িত্বে আছে জনাব কাবুল সাহেব। তার সাথে দেখা করতে গেলাম, চা পানে গিয়েছেন, দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে চলে এলাম। বহু চেষ্টা করেও মোবাইল নাম্বার নেয়া গেল না। জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা ছিলো - এখানকার হরিণগুলো বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন মেনে রাখা হয় কিনা?
(8)
চন্দ্রপাড়া:
তারপর গেলাম চন্দ্রপাড়ায়। উপরোক্ত সমস্ত ভন্ডামীসহ সেখানে আরও কিছু অতিরিক্ত আছে।সবার মাথায় লাল রুমাল, তার উপর ফিতা বাঁধা। যাতে লেখা -আনসার। হাতজোড় করে ঢুকতে হয় বিধায় এখানকার মাযারে ঢুকিনি। এ নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। জোহর নামাজের সময় হয়ে গেল, সাথিরা জানতে চাইলো নামাজ এখানে পড়ব কিনা? বললাম আমার মন সায় দেয় না এদের পিছনে নামাজ পড়তে। যার যার মতো দু রাকাত কছর(48 মাইলের বেশি ভ্রমণ করলে চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজ দু রাকাত পড়তে হয়) পড়ে বেরিয়ে এলাম। মৌমাছির মতো ঘিরে ধরলো, কেন নামাজ না পড়ে চলে যাচ্ছি? জবাব দিয়ে চলে এলাম। নামাজের পূর্বে সুন্নত পড়ার সময় দেখলাম এক বুড়া ব্যাংগের মতো চার -পাঁচটি লাফ দিলো। প্রতি লাফেই বলছিলো -বাবা! বাবা!!
সেজদায় গিয়ে অনবরত বলতে থাকলো সেই শয়তানী জপ। মনটা বিষিয়ে গেলো, দ্রুত বের হয়ে এলাম।
উভয় মাযারেই যে বিষয়টা পীড়া দিয়েছে - কবরটা খুব সুন্দর, ঝকঝকে। আর জুতা ছাড়া ঘুরাঘুরি করে মসজিদে ঢুকার ফলে মসজিদের অবস্থা খুবই করুন! সেজদা করা দায়। উরসের সময় রীতিমতো ভয়াবহ আকার ধারন করে। গুবরে মসজিদ ভরে যায়।
(9)
তৃতীয়দিন সোমবার ফেরার কথা। কিন্তু ফেরা হল না। এনামের আম্মুর অসাধারণ মেহমানদারীর ফলে আমাদের প্রায় সবার "পেট খারাপ"। পাঠক আবার ভাববেন না যে আমাদের মেশিন দুর্বল! কারণ আমাদের সাথে ছিলেন বিএমডব্লু মেশিনওয়ালা ফয়সাল ভাই! তিনিও একই পথের যাত্রী। অবশ্য তাকে কাত করতে সময় লেগেছে! এছাড়াও - আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সেরা মেজবান এনামের আব্বু-আম্মু। কারণ মানুষের শ্রমের পারিশ্রমিক আদায় করা যায়, খরচকৃত টাকা পয়সা ফেরত দেয়া যায়, কিন্তু স্নেহ-মায়ার মূল্য পরিশোধ করার মতো কোন বস্তু এখনও আবিষ্কৃত হয় নি, ভালবাসার বিনিময় দেয়ার মতো কোন টাকা পৃথিবীর কোন টাকশাল এখনো তৈরি করেনি। পাঁচ অজানা-অচেনা বাউন্ডুলেকে তারা যে পরম মমতায় আপ্যায়ন করেছেন সত্যিই তার কোনো তুলনা হয় না।শুধু বলি -জাযাকাল্লাহু খাইরান!!!
সেদিন দুপুরে -হুমায়ূনের হিমুর আছে জল'র মতো ঘটনা ঘটলো। যেখানে একের পর এক নায়কের আভির্ভাব হয়। প্রথম নায়ক ফয়সাল ভাই! গুতিয়ে কুদিয়ে সবাইকে চারটায় ঘুম থেকে তুললেন, এখনই ঢাকা চলে যাবেন। এরপর আভির্ভূত হলেন এনামের আম্মু ও নানু। কিছুতেই এই অবেলায় যেতে দিবেন না। কিন্তু ফয়সাল ভাই বিজয়ী। আমরা বের হয়ে যাব এমন সময় উদয় হলেন এনামের আব্বু, হাতে রাতে রান্নার জন্য রুই মাছ, লতি ও অন্যান্য তরকারি। এমন মুহূর্তে যাওয়া যায় না। ফয়সাল ভাইকে হটিয়ে তিনিই বিজয়ী হলেন! সবশেষে আমি! কাপড় চোপড় পড়ে ফেলেছি যেহেতু একটা ট্যুর হয়ে যাক। গন্তব্য অবশ্যই সেই কাংখিত স্থান - পল্লীকবি জসিমুদ্দীনের বাড়ি।
(10)
জসিম উদ্দিন:
কবির বাড়ি পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। প্রথমে তাঁর কবর যিয়ারত করলাম।তারপর ফটাফট কিছু ফটো তুললাম। ঘুরে দেখলাম। খুব ভালো লাগলো। মনে হচ্ছিলো -বাংলা গ্রামীণ সাহিত্যের কিংবদন্তীর ছোঁয়ার উষ্ণতা এখনো লেগে আছে এই বাড়ির সবখানে। সন্ধ্যার পর গেলাম বিখ্যাত সেই কুমার নদীর ধারে যার পাশে বসে কবি রচনা করতেন অমর সব কবিতা। সেই ডালিম গাছের স্থানটিও দেখলাম, যার ছায়ায় বসে আবিষ্কার করেছিলেন আসমানিকে। এই গাছটি এ পর্যন্ত তিন চারবার লাগানো হয়েছে! কুমার নদীর ধারে তার বসার স্থানটিকে পাকা করা হয়েছে। বহু কসরত করেও এর ফটো নেওয়া গেল না অন্ধকারের কারণে।
কবির বাড়ি ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে। অটো-রিকশা সবাই চেনে।
(11)
ফেরার পালা:
মঙ্গলবার! সাত সকালেই ফেরার প্রস্তুতি! সাড়ে সাতটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম, ফেরার পুরোটা পথ কেউই তেমন কথা বলেনি, অন্যদের কারণ বলতে পারবো না, আমার কারণ ছিলো বিষন্নতা। এই বাড়ি ও বাড়িওয়ালারা তিনদিনে আমাদেরকে যতটুকু আপন করে নিয়েছে অন্যখানে হয়তো তিনবছর লেগে যাবে। আসার পথে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। ঢাকা-নবাবগঞ্জের ড্রাইভাররা সবাই নবাব! বাপের পথে গাড়ি চালায়! এই রুটের নিয়ম হল কেউ কাউকে ওভারটেক করতে দিবে না। আসার পথে এর ফলে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়েছি।
(12)
যাতায়াত :
গুলিস্থান গোলাপ শাহ থেকে যমুনা ও এন মল্লিক নামে দুটি বাস নবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া 90 টাকা। তবে যমুনাতে গেলে ঘাট পর্যন্ত যাওয়া যাবে। মল্লিকে গেলে একটু আগে নেমে এক প্রকার বিশেষ যানবাহনে চড়িয়া ঘাটে যাইতে হইবে "। এগুলো শুধুমাত্র ফরিদপুরেই পাওয়া যায়। না রিকশা, না অটো, না নসিমন! বরং তিনটার সমন্বয়ে তৈরি।
অবশ্য এই পথটুকু অসাধারন! আমরা যখন এই পথটুকু অতিক্রম করার সময় পথ শেষের উত্তেজনায় অনেকেই দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু অচিরেই আবার বসতে হল। আমি বললাম কি মারুফ ভাই! বসে যে! তিনি চমৎকার একটি জবাব দিলেন -রোলার কোস্টারে দাঁড়িয়ে থাকার নিয়ম নেই! ঘাট থেকে ট্রলারে 70 টাকা, বোটে 150 টাকা ওপার। সেখান থেকে মোটরসাইকেল, অটো বা একটু সামনে থেকে বাস ফরিদপুর শহরে। তারপর আনলিমিটেড ঘুরাঘুরি!!!এছাড়াও মাওয়া হয়ে ফরিদপুর যাওয়া যায় কিন্তু সে পথে টাকা ফুরিয়ে যাবে, জানও বেরিয়ে যাবে।
বাই বাই
©somewhere in net ltd.