![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাগ ক্ষোভ যন্ত্রণা আর যতসব গুরু দায়িত্ব; এসবে বিরক্ত না হয়ে জীবন উপভোগ করুন, দেখবেন শুধু আনন্দ আর আনন্দ।
৭ দিন হলো অফিসে যাওয়া হচ্ছেনা আনিস সাহেবের। কি যেন একটা অসুখ হয়েছে, ডাক্তাররা এখনো তা ধরতে পারেনি। ঘুমের অষুধ দিয়ে চলছে চিকিৎসা। মাথা ব্যাথা, অস্থির লাগা, কোনো কাজে মনস্থির করতে না পারা, মাঝে মাঝে এলো মেলো কথা বলা, এগুলো হচ্ছে আনিস সাহেবের রোগের প্রধান লক্ষন। মাঝে মাঝে ভয়ও পাচ্ছে ইদানিং। ডাক্তাররা বলছে ভয় পাওয়াটাই হচ্ছে এখন বড় সমস্যা। অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা করেও ডাক্তাররা আনিস সাহেবের অন্য কোনো সমস্যা পায়নি। আনিস সাহেবের প্রতি ডাক্তারের পরামর্শ হলো কোনো বিষয়ে চাপ নেয়া যাবেনা, কোনো অবস্থাতেই একা থাকা যাবেনা।কিন্তু আনিস সাহেব ডাক্তারের একটা পরামর্শও পালন করতে পারবেনা। তিনি ডাক্তারকে বলেছেন ও। শুনে ডাক্তার বলেছিল, পরামর্শ মেনে চলতে না পারলে যখন তখন যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে।
গত ১০ বছর যাবৎ আনিস সাহেব একা থাকছেন। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর অন্যান্য ভাই বোনেরা তাদের সংসার নিয়ে যে যার মত আলাদা থাকছে। সবার সাথেই যোগাযোগ আছে কিন্তু একসাথে থাকা হচ্ছেনা। বছরে দুই থেকে তিনবার গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয়, মা বাবার কবর জিয়ারত করার জন্য। বিয়েও করেননি তিনি। একা থাকতে থাকতে তিনি অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। অবসর সময়টা তিনি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এসব পড়ে ও লিখে সময় কাটান। ছোটকাল থেকেই তিনি লেখালিখি করেন শখের বসে। প্রচার কিংবা প্রকাশ বিমুখ হওয়াতে তিনি পাঠক মহলে অতটা পরিচিত হয়ে উঠেনি এখনো। লেখালিখি করার ফলে মাথায় চাপ পড়ে, তা ছাড়া তিনি একটা অনলাইন নিউজ চ্যানেলে নিউজ ইডিটর হিসেবে চাকুরিরত আছেন।কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিল একটা প্রাইভেট ব্যাংক এ ক্যাশিয়ার হিসেবে। দুইটা প্রমোশনও পেয়েছিলেন। হঠাৎ ওনার মনে হল ব্যাংক জবটা ওনার জন্যনা। তাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর টিউশনি করে কাটিয়েছেন ৫ বছর। হঠাৎ মনে হল জমানো টাকা গুলোশেষ করা দরকার, দেশটাও ঘুরে দেখা দরকার। জমানো টাকা শেষ না হলে দেহ অলস হয়ে যাবে, কাজ করতে চাইবেনা আর। তাইতো জমানো টাকা শেষ করা আর দেশ ঘুরে দেখার প্রয়াশে বেরিয়ে পড়লেন, ঘুরে দেখলেন সমগ্র বাংলাদেশ।
কখনো সিগারেটের নেশা ছিলনা আনিস সাহেবের। এখন ওনার বিছানায় বালিশের পাশে সবসময় এক প্যাকেট সিগারেট ও একটা লাইটার থাকে। মাঝ রাতে পরপর ৩টা সিগারেট পান করেন তিনি, সারাদিনে আর করেননা। মাঝ বয়সের দ্বারপ্রান্তে এসে সিগারেট পান এবং সিগারেটের প্যাকেট সাথে রাখার ব্যাপারে আনিস সাহেবের যুক্তি হল,-
“মাঝ রাতে যখন ভয় পাই তখন খুব একটা বিচলিত হইনা,নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করি এবং একটা সিগারেট জ্বালাই, ২ থেকে ৩টানের মধ্যে সিগারেটটা শেষ করি। ভয় কিছুটা কমে। দ্বিতীয় সিগারেটটা একটু সময় নিয়ে শেষ করি। দ্বিতীয় সিগারেট শেষ হওয়ার সাথে সাথে ভয়টাও কেটে যায়। তৃতীয় সিগারেটটা জ্বালাই বাকী রাত যেন আর ভয় না পাই তার জন্য। তৃতীয় সিগারেটটা দ্রুতই শেষ করি। তৃতীয় সিগারেট শেষ হওয়ার সাথে সাথে মনে একটা সাহস আসে, আর তখন পুরো ঘরটায় কয়েক মিনিট হাঁটাহাঁটি করি। কোথায়ও ভয় পাওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাইনা। বুঝতে পারি যে ভয়টা মনের, আর তাই মনকে চাঙ্গা ও তাজা করতেই সিগারেট ধরলাম। তাছাড়া শুনেছি আগুন দেখলে নাকি ভূত বা প্রেতাত্মারা ভয়ে কাছে আসেনা। তাইতো আমি যখন ভয় পাই তখন ভূত বা প্রেতাত্মাদের পাল্টা ভয় দেখানোর জন্য সিগারেট ধরা।”
ইদানিং ভয়ের চিকিৎসা হিসেবে সিগারেট থেরাপি আর কাজ করছেনা। মাথা ব্যাথাটাও স্থায়ীভাবে জেঁকে বসেছে। উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পেইনকিলারও আর কাজ করছেনা। এক্সরে রিপোর্টেও কিছু ধরা পরেনি। ডাক্তার বলে দিয়েছে এ রোগের চিকিৎসা ডাক্তারদের জানা নেই। সাইকিআট্রিস্ট তার কাউন্সেলিং শেষে শেষবারের মত কিছু পরামর্শ দিয়ে যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন তা পালন করে চলতে বলেছেন।পরামর্শগুলো মধ্যে অন্যতম হলো কোনো বিষয়ে চাপ নেয়া যাবেনা, কোনো অবস্থাতেই একা থাকা যাবেনা।
#
“খুব ঝড় হচ্ছে বাহিরে, ঝড়ের প্রবল বেগে বৃষ্টির পানি জানালার ভাঙ্গা কাঁচ বেয়ে রুমে ঢুকছে। বিদ্যুৎ নেই। পুরো ঘরে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। হঠাৎ ঘরে অশুভ কিছুর অস্তিত্ব উপলব্ধি হল। বালিশের পাশে হাত বাড়িয়ে লাইটারটা পাচ্ছিনা, সিগারেটের প্যাকেটটাওনা। অন্ধকারের মাঝে পুরো বিছানা হাতিয়েও লাইটার এবং সিগারেট এর প্যাকেট পাচ্ছিনা। বাহিরে বাতাসের বেগ বেড়েই চলছে। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ হলো, মনে হচ্ছে জানালার ভালো কাঁচটা ভেঙ্গে কিছু একটা ভিতরে ঢুকলো। রুমের তাপমাত্রা কমে শূণ্যে নেমে এলো, মাত্রাতিরিক্ত শীত অনুভূত হচ্ছে। আলোর প্রয়োজন খুব অনুভব করছি। কিন্তু আলো নেই কোথায়ও। দম বন্ধ হয়ে আসছে ।
বিদ্যুৎ চমকালো হঠাৎ করে, বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় দেখছি মেঝেতে টাকনু সমান পানি জমে গেছে, সে পানিতে বিচ্ছুসহ অসংখ্য অদ্ভুত বড় বড় পোকা মাকড়, যা আগে কখনো দেখিনি। চোখের পলকে যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হচ্ছে খুবই বিষাক্ত হবে পোকা গুলো। আবারে বিদ্যুৎ চমকালো, এবার দেখছি পোকা গুলো আমার হাত পা বেয়ে আমার শরীরে উঠছে, আমি শক্তি পাচ্ছিনা পোকা গুলো থেকে নিজেকে বাঁচাতে। আমার অন্ডকোষে বিষাক্ত ছোবল দিল, সাথে সাথে মরণ যন্ত্রনায় হৃৎপিন্ড লাফিয়ে উঠলো, গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে আমি সমস্ত শক্তি ব্যায় করে শোয়া থেকে উঠে বসি।
চোখ মেলে বুঝতে পারলাম সবটা স্বপ্ন ছিল। চঁদনী রাত ছিল। জানালার ভাঙ্গা কাঁচ দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকে ঘরটা হালকা আলোকিত করল। বালিশের পাশেই লাইটার এবং সিগারেট এর প্যাকেট পেলাম। লাইটার এবং সিগারেট এর প্যাকেট হাতে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে লাইট জালিয়ে ঘড়িতে দেখলাম রাত ৩টা ১৯ বাজে।“
আনিস সাহেব সিগারেট জ্বালালো, জানালার গ্রিলে হেলান দিয়ে বাহিরে আকাশ পানে তাকিয়ে অনেক্ষন পরপর সিগারেটে একটা করে টান দিচ্ছে। ধোঁয়া ছাড়ছেনা, গিলে ফেলছে। মাথাটা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গিজগিজ করছে। ডাক্তার বলেছে কোনো বিষয়ে মাথায় চাপ নেয়া যাবেনা, তাই মাথায় গিজগিজ করা বিভিন্ন বিষয়ের একটাও যাতে মাথায় চেপে না বসতে পারে তাই সিগারেটের ধোঁয়া গিলে ফেলছেন। আনিস সাহেব থিওরিটা মাত্রই আবিষ্কার করলো এবং ফলপ্রসূ হওয়ায় উচ্চস্বরে একমিনিট হাসলো।
#
৭ দিন পর আজ অফিসে আসলো আনিস সাহেব। খুব সকাল সকালই এসে পড়লো আজ। পিয়ন ছেলেটা এসে সালাম দিয়ে বললো,
“স্যার আজ এত সকালে আসছেন যে? চা দিব স্যার?”
আনিস সাহেব প্রথমে খেয়াল করেনি, তা দেখে পিয়ন ছেলেটা একটা কাশি দিল। আনিস সাহেব তার দিকে তাকিয়ে বললো, “কুদ্দুস কেমন আছো?
: জ্বি স্যার ভালো আছি। আপনার শরীরের কি অবস্থা এখন?
: যেমন দেখছো। শুনো, চিনি কম আর লেবু দিয়ে আমাকে একটা লাল চা দাও।”
: আচ্ছা।
কুদ্দুস ৪৫মিনিট পর মগ ভর্তি করে লাল চা নিয়ে এলো। কুদ্দুস ভেবেছিলো বকা খাবে, তাই কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, “স্যা...র... এ....ই.... যে আপনার চা।”
আনিস সাহেব কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে বললো,
: ধন্যবাদ। রেখে যাও।
আনিস সাহেব রাগ না করে কোমল স্বরে ধন্যবাদ বলায় কুদ্দুসের ভয় কেটে গেলো। এবার স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
: স্যার, এমডি স্যার আুপনাকে ডেকেছে।
: তুমি যাও। আমি যাচ্ছি।
এমডি আর আনিস সাহেব সামনা সামনি বসে আছে। এমডি আর আনিস সাহেব দু‘জনই সমবয়সী। এমডি অফিসের সবার সাথেই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে। এমডি হাসি মুখে বললো
: তারপর বলুন, আপনার শরীরের এখন কি অবস্থা?
: সুবিধের না স্যার।
: ডাক্তার কি বললো?
: ডাক্তার কোনো সমস্যা কিংবা কোনো রোগই ধরতে পারছেনা। এদিকে আমার ভয়ের সমস্যা আর মাথা ব্যাথা বেড়েই চলছে।
: সবশেষে ডাক্তার কি পরামর্শ দিল?
আনিস সাহেব সব খুলে বললো এমডিকে। শুনে এমডি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,
: এই অবস্থায় আপনার একজন সঙ্গীর খুবই প্রয়োজন। এ ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?
: না।
: শুনুন, একটা পরামর্শ দেই, কিছু মনে করবেননা।
: সিউর স্যার, বলুন।
: আপনি বিয়ে করে ফেলুন।
: হা ...হা.... হা....
অনেকদিন পর আনিস সাহেব একটু হাসলো।
: আমি সিরিয়াসলি বলছি। একটু ভেবে দেখুন।
: এই বয়সে এই অধমকে কোন মেয়ে বিয়ে করতে চাইবে?
: আপনার বয়স কত?
: ৪০ কিংবা ৪১ হবে!
: আপনি বিয়ে করবেন কিনা তা বলুন?
: ভেবে দেখি।
: আমাকে খুব দ্রুত জানান। আপনার যা অবস্থা, এতে করে আপনি একা একা থাকলে যেকোনো মুহূর্তে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
: ওকে স্যার।
#
আনিস সাহেব নতুন বাসায় উঠেছে তিন দিন হলো। এক নাগাড়ে ১০ বছর কাটিয়ে দেয়া সেই চিলেকোঠার বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে শুধুমাত্র ভয়ের কারণে। আনিস সাহেব ভাবলো বাসা পরিবর্তন করলে হয়তো ভয় রোগটা ভালো হয়ে যাবে। নতুন বাসায় প্রথম ২দিন ভালোই কেটেছে। কিন্তু আজ সন্ধ্যা থেকে আনিস সাহেব লেখা বা পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছেনা। তার মনে হচ্ছে, তার চারপাশে কিছু লাশ ঘোরাঘুরি করছে। লাশ কয়টা তা অনুমান করতে পারছেনা আনিস সাহেব। তবে বুঝতে পারছে যে ৫টার বেশি হবে। লাশ গুলো দেখতে পাচ্ছেনা , তবে লাশের শরীর থেকে আসা এক ধরনের বিদঘুটে গন্ধে আনিস সাহেব লাশের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে। গন্ধটা যখনই নাকে এস লাগছে, তখনই কেমন যেনো ভয়ে পুরো শরীর কেঁপে উঠে, প্রচন্ড গরম আবহাওয়ায়ও খুব শীত অনুভূত হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে অদৃশ্য লাশ আর উৎসহীন লাশের বিদঘুটে গন্ধের সাথে নিরবে যুদ্ধ করে ক্লান্ত আনিস সাহেব বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো রাত এগারোটায়।
মোড়ের চায়ের দোকানে বসে বসে চা আর সিগারেট একের পর এক গিলছে। পাশে বসা ছিল অফিসের পিয়ন কুদ্দুস। চায়ের দোকানের পাশের টিন সেট বাসাটা কুদ্দুসদের। কুদ্দুস এই পাড়ার স্থানীয়। সে-ই আনিস সাহেবকে বাসাটা ঠিক করে দিয়েছিলো। অনেকক্ষন চুপচাপ বসে থাকার পর কুদ্দুস হালকা কাশি দিয়ে বলল,
: স্যার কিছু বলছেননা। একের পর এক সিগারেট টেনেই যাচ্ছেন। ক্ষতি হবেতো।
: কুদ্দুস কিছু বললে?
: স্যার বাসায় যাবেননা? দোকানতো বন্ধ হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আনিস সাহেব বললো,
: চলো।
: কোথায় স্যার?
: রাতে শহরটা হাটবো।
: কি বলেন স্যার? কয়টা বাজে দেখছেন?
: হুম দেখেছি, ১২টা বাজে।
: জ্বি স্যার।
কুদ্দুস চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছেনা যে, কি করবে।
: কুদ্দুস কোনো সমস্যা?
মুখে কৃত্রিম হাসি দিয়ে ,
: না স্যার। তয়.....
: তবে কি?
: এলাকার অবস্থা ভালোনা। রাতে গাঁন্জাখোরদের উৎপাত বাইড়া যায়। তারউপর পুলিশও টহল দেয়। তার চেয়ে ভালো স্যার আপনি বাসায় গিয়ে ঘুমান, আপনার শরীরের জন্য ভালো হবে। আপনিতো এমনিতেই অসুস্থ।
: যদি কিছু মনে না করো একটা অনুরোধ করি?
: কি যে বলেন স্যার! অনুরোধ কেন স্যার আদেশ করেন।
: তুমি আজ রাত আমার বাসায় আমার সাথে থাকতে পারবে?
: কেনো স্যার?
: একা একা কেনো যেনো খুব ভয় লাগছে। কালতো অফিস নেই। দুজন গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যাবো।
: তাহলে স্যার ২মিনিট দাঁড়ান, বাসায় বলে আসি।
কুদ্দুসকে নিয়ে বাসায় ঢুকতেই পঁচে গলে যাওয়া লাশের গন্ধ নাকে এসে লাগলো, রুমে ঢুকতে গিয়ে তাই আনিস সাহেব থমকে দাড়ালো। কুদ্দুস বিষয়টা খেয়াল করে বললো,
: স্যার কোনো সমস্যা?
: না।....... আচ্ছা, তুমি কি কোনো পঁচা গন্ধ পাচ্ছো?
নাক দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে কুদ্দুস বললো,
: কই নাতো স্যার, কোনো গন্ধ পাচ্ছিনা।
: ও আচ্ছা।
আনিস সাহেব বুঝতে পারছেনা যে, ভয় কেনো তার পিছু ছাড়ছেনা। এইযে, পঁচা মানুষ কিংবা লাশের গন্ধ, ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া। এসবের মানে কি হতে পারে? ভয় আর মাথা ব্যাথা আনিস সাহেবকে প্রায় পাগল বানিয়ে দিল।
আনিস সাহেব চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে কুদ্দুস জানতে চাইলো,
: স্যার কি অসুস্থ বোধ করছেন?
আনিস সাহেব কৃত্রিম একটা হাসি দিয়ে বললো ,
: না। তুমি বসো। চা খাবে?
: স্যার আপনি বসুন। চা তো গত এক ঘন্টায় আপনার সাথে তিন কাপ খেয়েছি।
: আমি ভালো চা বানাতে পারি। তুমি আমার সাথে আসো, আমি চা বানাবো তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে। পরে চা পান করতে করতে গল্প করবো।
: স্যার কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?
: বলো।
: আপনি একা থাকেন কেনো?
: নেশা।
: স্যার বিয়ে করেননি?
আনিস সাহেব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কুদ্দুসকে বললো,
: তোমার পেছনে চা পাতার কৌটা টা আছে। দাওতো।
কুদ্দুস চুপচাপ । আনিস সাহেব তাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো
: আমার গল্প পরে বলবো। আজ তোমার গল্প শুনবো। তোমার পড়াশুনা কতটুকু?
কুদ্দুস একটা হাসি দিয়ে,
: স্যার আমার আর গল্প! মেট্টিক ফেইল করেছি আর আব্বায় পড়াশুনা বন্ধ কইরা গ্যারেজে ভর্তি করাইয়া দিছিলো।
: গ্যারেজ?
: স্যার ওইযে গাড়ির কাম যেখানে শিখায় ওখানে ভর্তি করাইছিলো।
: এতদিনেতো তোমার ইঞ্জিনীয়ার হয়ে যাওয়ার কথা!
: হ স্যার। তবে, কাজটা আমার পছন্দের ছিলোনা। কারণ আমার ইচ্ছা ছিলো আমি অফিসার হবো। তাই আব্বা মারা যাওয়ার পর গ্যারেজ থেকে আইসা পড়ছিলাম, পরে আমার এক বন্ধু আমারে উন্মুক্ত স্কুলে ভর্তি করাইয়া দিছিলো। ওখান থেকে আমি এক চান্সে মেট্টিক পাশ করছিলাম। এরপর কলেজে ভর্তি হইছিলাম। কলেজে.................
: থামলে কেনো?
: না, মানে স্যার...।
: ইতস্ত করছো কেনো? বলো।
: বলতেছি স্যার। অনুরোধ, বেয়াদবি নিবেন না স্যার।
: ধরো তুমি তোমার বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছো। নিশ্চিন্তে বলো।
: স্যার যে কি বলেন!
: হুম! বলো।
: কলেজে একটা মেয়েকে খুব ভালো লাগতো। ওর নাম ছিলো সাবিনা। বন্ধুদের সহায়তায় ওর সাথে আমার প্রেম হয়। শুধু মাত্র ওর জন্যই প্রতিদিন কলেজে যেতাম। শহরের প্রায় সবগুলো রেস্টুরেন্টেই আমরা খেয়েছি। প্রতিমাসেই কোনো না কোনো উপলক্ষে ওকে আমার গিফট দিতে হয়েছে। ভালোই যাচ্ছিলো আমাদের। হঠাৎ একদিন ওর এক বান্ধবী আমাকে বললো যে, “ভাইয়া, সাবিনা আপনাকে ভালোবাসেনা। ও এতদিন আপনার সাথে শুধু বন্ধু হিসেবে মিশেছিলো। ও বলেছে, আপনি যাতে ওকে ভুলে যান। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে-ই ওর বিয়ে । কালই সাবিনা চিটাগাং ওদের গ্রামের বাড়ি চলে যাবে।”
এতটুকু বলে কুদ্দুস থামলো।
: তারপর তুমি কি করেছিলে?
: স্যার কথায় আছেনা যে, অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর! আমি কেমন যেন পথর হয়ে গিয়েছিলাম তখন। ওর বান্ধবীর সাথে কোনো কথা না বলে কলেজ থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর ওইদিনটি আমার কিভাবে কেটেছিলো আমার কিছুই মনে নেই। পরের দিন খুব সকালে আমি ওদের কলোনির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরুলাম। স্বভাবতই আমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠিনা, তাছাড়া আগের দিন বাসায় আসার পর হয়তো আমার অজান্তেই কোনো না কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলাম, যার কারণে আমার বড় বোন প্রিয়া আপু আমাকে ফলো করার জন্য আমার পিছু পিছু আসছিলো, আমি তা খেয়াল করিনি। আমি বাসা থেকে বের হয়ে যখন রাস্তা পার হলাম, ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা বিকট চিৎকারের শব্দ শুনলাম, যা নিমিষেই বিলীন হয়ে গিয়েছিলো। আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম পীচ্ ঢালা রাস্তায় একটা প্রাইভেট কার কেউ একজনকে পিশিয়ে দিয়ে দ্রুত গতিতেই হাওয়া হয়ে গেলো। রাস্তায় পড়ে আছে একটা নিথর মহিলার দেহ। আমি দ্রুত পায়ে কাছে গিয়ে যা দেখলাম স্যার .........
কুদ্দুস থেমে গেলো। ওর চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। চোখ থেকে গড়িয়ে জল পড়ছে। তা দেখে আনিস সাহেব ওকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। পানি পান করে কুদ্দুস আবারো বলতে লাগলো,
: স্যার ওই নিথর দেহটা ছিলো আমার বড় বোন প্রিয়া আপুর। আপু আমাকে অনেক আদর করতো। আপুর সাথে সব শেয়ার করতে পারতাম।
আনিস সাহেবের সাথে কুদ্দুসের জীবনের গল্পটা কিছুটা মিলে যাওয়ায় তিনিও কিছু সময়ের জন্য উদাসীন হয়ে গেলো। তা দেখে কুদ্দুস বললো,
: স্যার আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?
: না। সবার জীবনেই এমন কঠিন গল্প থাকে। এগুলো জীবনেরই অংশ। মন খারাপ কোরোনা। তুমি ধুমপান করো?
: স্যার বেয়াদবি নিবেননা। মাঝে মাঝে করি।
: ব্যাপারনা। এইযে নাও একটা ধরাও। শুনো, সিগারেটটা অনেক সময় নিয়ে শেষ করবে। ধোয়া ছাড়বেনা, গিলে ফেলবে। দেখবে মাথার যন্ত্রণা মনের যন্ত্রণা তাৎক্ষণিক সব অকেজো হয়ে যাবে।
(চলবে...)
©somewhere in net ltd.