![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………
১ম পর্ব
জিম্মি ঘটনার ছয়দিন পূর্বে।
দুলাল বিশ্বাস, নামটা বড় কেমন যেন। নাম দেখে বোঝবার উপায় নাই মুসলিম না হিন্দু। আপাতত তাকে একজন ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়া জ্যোতিষী বলা যেতে পারে। কিংবা বলা যেতে পারে তিনি আপনার যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন, আপনার হাত দেখে গণনা করে কিছু পাথরের আংটি আঙ্গুলে পরিয়ে দেবার মাধ্যমে। তার সামনে বসে থাকা জনা কয়েক লোকের উদ্দেশ্যে তিনি বলা শুরু করলেন, “যখন কোনো পাখি বেঁচে থাকে তখন পিঁপড়ে তার খাদ্য। সে পাখি মরে গেলে, পাখি পিঁপড়ের খাদ্য। একটা গাছ লাখ লাখ কাঠি তৈরি করতে পারে। আবার একটা ম্যাচের কাঠি লাখ লাখ গাছ পুড়িয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট। পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে যে কোনো সময়ে। কাউকে কখনও অবহেলা কোরো না। তুমি আজকে প্রচণ্ড ক্ষমতাশীল, কিন্তু মনে রেখো সময় তোমার চেয়েও ক্ষমতাবান।”
সবাই মুগ্ধ হয়ে কথা শুনে যায়। দুলাল বিশ্বাসের কোনো ফিস নেই। তিনি আপনার সমস্ত সমস্যা শুনবেন মনোযোগ দিয়ে। যদি তিনি সে সমস্যার সমাধান দিতে পারেন, তবে সমস্যার সমাধান দেবার পর ফিস। সমস্যা সমাধানে অপরাগ হলে, তিনি জানিয়ে দিবেন, কোনো ফিস দিতে হবে না। শুধু তিনি আংটি দিয়েই সমস্যার সমাধান করেন ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। মাঝে মধ্যে সমস্যার সমাধানে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে অদ্ভুত কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে তা ফলপ্রসূও হয়। এই তো মাস খানেক আগে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে নিয়ে হাজির হয়েছিল দুলাল বিশ্বাসের কাছে। স্ত্রীর সমস্যা অকারণে হতাশ হয়ে যাওয়া। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে প্রচণ্ড মন খারাপ করে ফেলা। মন ভাল থাকতে থাকতে, হুট করে অতীতের কোনো ঘটনা চিন্তা করে বিষণ্ন হয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝেই তার মরে যেতে ইচ্ছে করে। স্বামী বেচারা পড়েছে বিপদে, মন খারাপের সময়টায় শত চেষ্টা করেও সে স্ত্রীর মন ভালো করতে পারে না। নিজ থেকে সব ঠিকঠাক হওয়ার অপেক্ষা করতে হয়। এক দুই দিন ঠিক থাকার পর আবার সেই হতাশা ভাব চলে আসে। দুলাল বিশ্বাসের কাছে সব কিছু খুলে বলবার পর, দুলাল বিশ্বাস চিন্তিত মুখে খানিক বসে থাকেন। চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বলেন, “আমার জ্যোতিষ ও বাস্তু শাস্ত্রের গুরু ধীরেন্দ্র প্রধান সবসময় একটা কথা বলতেন, মানুষ যা তার পুরোটাই তার মন। মনের মাঝে অসুখ হলে, সে অসুখ কোনো ওষুধে সারবে না। মনের মাঝে বাসা বাঁধা অশুভ শক্তিকে তাড়াতে হলে, মনকে সুস্থ করতে হলে, অশুভ শক্তিকে ছড়িয়ে দিতে হবে।”
দুলাল বিশ্বাস বলে যান, সামনে বসা দুজন মানুষ তা শুনে যায়।
“আপনাদের ঘর অশুভ শক্তিমুক্ত করতে হবে, চারপাশের পরিবেশ অশুভ শক্তি মুক্ত করতে হবে। আজ বাড়ি ফেরার পথে একখানা ফুল গাছ কিনে নিয়ে যাবেন। আলো আসে এমন জায়গায় গাছটা রাখবেন। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে আপনি গাছটাকে ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করে মিনিট বিশেক বসে থাকবেন। ভাববেন মনে মনে, আপনার মনের সব অশুভ শক্তি গাছটা শুষে নিচ্ছে, তার ভিতরের সব শুভ শক্তি আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এক সপ্তাহ পর আমার কাছে ফিরে আসবেন উপকার পেলে। আপনার জানুয়ারির শেষে জন্মমতে, আপনি কুম্ভ রাশির কন্যা। আপনার বৃদ্ধাঙ্গুলিতে গোমেদ পাথর ব্যবহার করলে সব অশুভ শক্তির প্রভাব থেকে মুক্তি পাবেন, সকাল হতাশা ও বিষণ্নতা কেটে যাবে।”
এক সপ্তাহ পর ঠিকই তারা ফিরে এসেছিল গোমেদ পাথর নিতে। উপকার পেয়েছিল নিশ্চিত বলে দেয়া যায়।
আজ দুলাল বিশ্বাসের তাড়া আছে। জমায়েত লোকদের সাথে যত দ্রুত সম্ভব কথাবার্তা শেষ করা প্রয়োজন। সবার সমস্যার বিস্তারিত সমাধান আজকে দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক দিন ধরে করা পরিকল্পনার আজ বাস্তবায়ন হতে পারে। হয়ত হয়েই যাবে। দুলাল বিশ্বাস ঘড়ির দিকে তাকালেন, ছয়টা বেজে বিশ মিনিট। ব্যাগটা হাতে নিয়ে রওয়ানা দিলেন বাসার দিকে। হাতে ঘণ্টা চারেক সময় আছে। গোসল করে হালকা খেয়ে বের হয়ে যাবেন। লোকটা আজ একবারের জন্যও ফোন দেয়নি। এ নিয়ে খানিকটা অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। একটা রিকশা করে বাড়ির দিকে যেতে লাগলেন। গত দিন দশেক ধরে এক অপরিচিত লোকের সাথে কথা হচ্ছে। এখন আর অপরিচিত বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। লোকটার নাম ফরিদুর। নিজেকে পরিচয় দিয়েছে একজন অনেক নামিদামি মানুষের সাথে পরিচিত লোক হিসাবে। দুলাল বিশ্বাসের মতন টুকটাক জ্যোতিষ ও বাস্তু শাস্ত্রের চর্চা করে। দুলাল বিশ্বাসকে নিয়ে ফরিদুর চাচ্ছে, কিছু নামিদামি খদ্দের ধরতে। একজনকে ঠিকভাবে ধরতে পারলে, সারা মাস আর চিন্তার কারণ নেই। ফরিদুরের হাত যে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত সে বিষয়ে ছোট একটা নমুনা পেয়েছে ঠিক গতকালই। এক বিশাল বড় ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছিল ফরিদুর। তার অতীত সম্পর্কে এক দুইখানা কথা বলতেই ব্যবসায়ী মুগ্ধ। প্রতিটা কথা দুলাল বিশ্বাসের অক্ষরে অক্ষরে সঠিক ছিল। অতটুকু কথা বলাতেই দুলাল বিশ্বাসের কাছে দশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে আজ সকালে। সবটাই হয়েছে ফরিদুরের কারণে। অনেক দিনের ভাবনা দুলাল বিশ্বাসের, তার ভিতর যা আছে তার সঠিক বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ কীভাবে করা যায়! এমন এক দুইজন মালদার মানুষ পেলে সে ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। আজ রাতে দেখা করবার কথা ফরিদুরের সাথে। ফরিদুর সাথে করে নিয়ে যাবে ঐ ব্যবসায়ীর বাসায়। তার কিছু সমস্যার সমাধান করে দিতে পারলে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যাবে। তার একটা ভাগ দিতে হবে ফরিদুরকে, তা কোনো সমস্যা নয়। চটজলদি গোসল করে খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়ে গেলেন দুলাল বিশ্বাস। ঘড়িতে বাজে নয়টা আট, শাহজাদপুর লেকের কাছে যেতে বলেছে ফরিদুর দশটার দিকে। মহাখালি থেকে শাহজাদপুর লেকে যেতে চল্লিশ মিনিটের বেশি লাগার কথা না। দুলাল বিশ্বাসের মাথার ভিতর অনেক ভাবনা ঘুরছে, কী হতে পারে সামনে? মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারলেও জ্যোতিষীরা নিজের ব্যাপারে কোনো ভবিষৎবাণী করতে পারে না। ব্যাপারটা অদ্ভুত।
দশটা বাজার মিনিট চারেক আগে শাহজাদপুর লেকের কাছে চলে আসলেন দুলাল বিশ্বাস। চারপাশে তাকালের প্রতীক্ষা নিয়ে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এক দুই জন মানুষ যা হেঁটে যাচ্ছে, তাদের কেউ ফরিদুর না। গতকাল রাতে ফরিদুর বলেছিল, নীল রঙের একটা শার্ট পরে আসবে। আজকে সকালে পাঠিয়ে দেয়া টাকার সাথে নিজের একটা ছবি পাঠিয়ে দিবে। পকেট থেকে ছবিটা বের করে আবার বার কয়েক পরখ করে নিলো, আশেপাশের গোটা কয়েক হেঁটে যাওয়া মানুষের কাউকে ফরিদুর বলে মনে হচ্ছে না। দশটা বাজার মিনিট সাতেক পরে একটা প্রাইভেট কার এসে থামল দুলাল বিশ্বাসের সামনে। গ্লাসটা একটু নামিয়ে গাড়ি চালক বলল, “পিছনে উঠুন, ফরিদুর আমি।” লেকের এদিকটাতে আধো আলোতে ফরিদুরের চেহারা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন না দুলাল বিশ্বাস। তবু গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ি ছুটতে শুরু করল। চুপ করে বসে রইলেন দুলাল বিশ্বাস পিছনে। ফরিদুর কোনো কথা বলছে না। দুলাল বিশ্বাস নিজেই বললেন, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
ফরিদুর থমথমে গলায় উত্তর দিলো, “আপনি যে কাজে এসেছেন সেখানে।”
দুলাল বিশ্বাস চুপ করে থাকেন। গাড়ি ছুটে চলে নতুনবাজার হয়ে ভাটারার রাস্তা ধরে বালু নদীর দিকে। দুলাল বিশ্বাসের মনের মাঝে হঠাৎ করে কেন যেন ভয় ঢুকে যায়। এদিকটা আরও অনেক নীরব, রাস্তার দুই পাশের বাতি বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে আছে। এক দুইটা বাইক শুধু সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে। দুইপাশে মানুষের জনবসতির কোনো দেখা সাক্ষাৎ নেই। এখানে কোথায় থাকে ব্যবসায়ী?
“ভাই আর কতদূর?”
“চলে এসেছি প্রায়। ব্যবসায়ী মানুষ বুঝতেই পারেন। নিজের বাংলোতে নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন।”
বলেই গাড়িটা কষে ব্রেক করল ফরিদুর। দুলাল বিশ্বাস আশেপাশে তাকাল। অন্ধকারে ওভাবে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ফরিদুর এই প্রথম মুখ ঘুরিয়ে তাকাল দুলাল বিশ্বাসের দিকে। কিছু বুঝে উঠবার আগেই মুখের উপর কিছু একটা স্প্রে করে দিলো। দুলাল বিশ্বাস “ও মা” বলে চিৎকার করে মাথা নীচু করে ফেলতেই টের পেলেন মাথার পিছনে সজোরে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। চারপাশটা কেমন ভনভন করে ঘুরছে দুলাল বিশ্বাসের। সব কেমন আরও গাঢ় অন্ধকার হয়ে আসছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে দুলাল বিশ্বাস শুধু একবার মনে করলেন, সময় খুব ক্ষমতাবান এক জিনিস। কেন ভাবলেন, তা ভাবার সময় টুকুও পেলেন না।
জিম্মি ঘটনার তিন দিন পূর্বে।
“আমি ফরিদুর, বয়স ত্রিশ, উচ্চতা পাঁচ ফুট আট, গায়ের রং শ্যামলা, ওজন আটষট্টি। ঝিগাতলার এক বাসায় সাবলেট থাকি। আমার মা থাকেন গ্রামে। ঢাকায় টুকটাক ব্যবসা করি, ইদানীং ব্যবসাতে ভাল লাভ হওয়ার একটা সম্ভাবনা পাওয়া দিয়েছে, লাভ হলেই একাই একটা বাসা নিয়ে নিব। আমার ঝিগাতলার বাসায় আমি কতদিন যাই না, ঠিক মনে করতে পারছি না। এখানে ঠিক কতদিন আমি আছি তাও জানি না। আমি অবিবাহিত, প্রেমিকাও নেই। দু একটা যে বান্ধবী আছে, তারা শুধু মাঝে মধ্যে লেকের পাড়ে আমার হাত ধরে বসে থাকে বন্ধের দিনগুলোতে। আর কিছুই নয়, কিছুই হয় না। এরা কেউ কখনও আমার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। আমিও ওভাবে আর তাই তাদের দিকে আগাইনি।”
ফরিদুর কথা গুলো বলে সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে তাকাল। অন্ধকারে চেহারা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ফরিদুরের মাথার উপর মিটিমিটি করে জ্বলছে একটা বিশ ওয়াটের ফিলামেন্টের বাতি; সে আলোতে অস্পষ্ট করে হলেও সামনে থাকা কাগজের লেখা গুলো পড়তে পারছে। কাগজে স্পষ্ট নির্দেশনা, ফরিদুরকে নিজের ব্যাপারে আট মিনিট বলতে হবে। বেশি নয়, কম নয়। কাঁটায় কাঁটায় আট মিনিট। নির্দেশনা না মানলেই শাস্তি। ফরিদুর কথা বলার মতন আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। আট মিনিট কথা ফরিদুর বলেনি; মানে নিশ্চিত শাস্তি অপেক্ষা করছে। লোকটা একটা আস্তে করে নিঃশ্বাস ফেলল, ফরিদুর একটা দীর্ঘশ্বাসে সে নিঃশ্বাসের সাথে তাল মিলালো। মাথার উপরের মিটিমিটি বাতিটা ধপ করে গেল নিভে। ছোট একটা টর্চের আলোয় ফরিদুরের মুখটা বেঁধে দিলো। টর্চের আলোও এখন নেই। খানিক সময় পরে একটা চাপা আর্তনাদ শোনা গেল। আবার জ্বলে উঠেছে বাতি, লোকটা এখন উধাও ঘর থেকে। ফরিদুর চিৎকার করে যাচ্ছে, সে চিৎকার আটকে যাচ্ছে, দলা পাকিয়ে থেমে যাচ্ছে বেঁধে রাখা মুখের ভিতরেই। ফরিদুর ঝাপসা চোখে একবার তাকাল পায়ের দিকে। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে, সে রক্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে ফ্লোর জুড়ে। ধাতব কিছু একটা বিঁধিয়ে দিয়েছিল লোকটা ফরিদুরের বসে থাকা হাঁটুর উপর। এই চেয়ারে ঠিক কতদিন ধরে বেঁধে রাখা ফরিদুর ঠিক জানেনা। কখন দিন হয়, কখন রাত হয়, সে খবরও রাখা হয় না। শুধু ঝুল ধরা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কেটে যায় সারাক্ষণ। ঠিক কী কারণে, কোন অপরাধে বা কোন শত্রুতায় ফরিদুরকে এখানে ধরে আনা হয়েছে, সে ব্যাপারেও কোনো ধারণা করতে পারছে না। একা থাকার সারাটা দিন ভেবে বেড়ায়, কার সাথে কবে ছিল শত্রুতা, কার সাথে কবে হয়েছে কোন ঝামেলা, কে দেখতে পায় না, ঠিক সহ্য করতে পারে না ফরিদুরকে। এমন কারও নাম মাথায় আসে না। লোকটার স্বাস্থ্য, শরীরের গড়ন, উচ্চতা কিংবা নড়াচড়ার ধরণের সাথে মিলিয়েও ফরিপুর কাউকে পায় না। যে বান্ধবীগুলোর সাথে লেকের পাড়ে হাত ধরে বসে থাকে, তাদের কারও প্রেমিকও অতটুকু অপরাধে ফরিদুরকে এতো বড় শাস্তি দিবে তা বিশ্বাস হয় না। ব্যথায় ফরিদুরের পা অবশ হয়ে আসছে, সব ইন্দ্রিয় মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, লেগে আসছে চোখ। মনে হচ্ছে আশেপাশে কারও কথা শুনছে, শুনছে ধরে আসা কারও গলা।
আজ কয় তারিখ জানে না ফরিদুর। তবে ঘটনা ঘটেছে গত বিশ তারিখের দিকে। ফরিদুরের ব্যবসা টি-শার্টের হোম ডেলিভারির। অনলাইন বিজনেস। অনলাইনে মানুষের দেয়া ডিজাইনের উপর টি-শার্ট বানিয়ে তা হোম ডেলিভারি দেয়, ভালোই চলছিল সে ব্যবসা। এর পাশাপাশি রাতের বেলা একটা সাইড বিজনেসের ধান্ধা করছিলো। এই সাইড বিজনেসের ধারণা এসেছে রক্তিম নামের এক লোকের কাছ থেকে। ক্রেতার ডিজাইন করা টি-শার্ট বানানোর জন্য যে দোকানে যায়, সে দোকানের ঠিক দুই তিন দোকান পাশেই এক ফার্নিচারের দোকান। ও দোকানে কিছু নিষিদ্ধ নেশাদ্রব্য পাওয়া যায়। সবার কাছে তারা তা বিক্রি করে না। খুব বিশ্বাসযোগ্য না হলে ও দিকে আগায় না। ফরিদুর এ খবর পায় রক্তিমের কাছ থেকেই। এক ফেইক আইডি থেকে ফরিদুরকে টি-শার্টের অর্ডার দেওয়ার পাশাপাশি, হুট করে একদিন এই দোকানের খবর দেয়। একটু খোঁজ নিতে বলে ফরিদুরকে, যেহেতু ফরিদুরের নিয়মিত যাতায়াত ওদিকটায়। অগ্রিম কিছু টাকাও পাঠিয়ে দেয় রক্তিম। টাকার অঙ্ক খারাপ নয়। ফরিদুরকে টি শার্টের সাথে ওখান থেকে বাছাই করা কিছু নেশাদ্রব্য এনে দিতে হবে। ফরিদুরকে যে টাকা পাঠানো হয়েছে, তাতে কেনা হয়ে যাবে। মাল পৌঁছে দেবার পর, এই অঙ্কের দ্বিগুণ পাবে। প্রথম প্রথম ফরিদুরের মনে হয়, এ জিনিস ধোঁকা। হতেই পারে। টাকা পাওয়ার পর সে অনিশ্চয়তা কেটে যায়। ফরিদুর তোড়জোড় চালায় ফার্নিচারের দোকান থেকে নেশাদ্রব্য নিয়ে আসার। ফার্নিচারের দোকানের ম্যানেজার এ কথা কোনভাবেই স্বীকার করে না, তার কাছে নেশাদ্রব্য আছে। ফরিদুর বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলে, “আপনার ভয়ের কিছু নাই। আমি এই পাশের দোকানে টি শার্টের অর্ডার নিয়ে আসি, প্রতি সপ্তাহে পাঁচ ছয়দিন আসা হয়। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।”
ম্যানেজার তাও অস্বীকার করে। তবে ফরিদুর বুঝতে পারে, রাজী করানো যাবে, রাজি হয়েই যাবে লোকটা। কাজ হয়েও যায় দিন তিনেক পর। দুইটা টি শার্ট চায় দোকানের ম্যানেজার, সে টি শার্টে ভরেই দিয়ে দেয় ফরিদুরের জিনিস। দেখে বোঝার উপায় নেই ওখানে কী আছে।
ফরিদুর রক্তিমকে জানিয়ে দেয়, মাল রেডি। রক্তিম বলে দেয় সেদিন রাতেই মাল ডেলিভারি করতে। ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের পাশে, রাত সাড়ে এগারটায়। ফেসবুকে একটা ছবি পাঠিয়ে বলে রক্তিম, “আমাকে চিনবার জন্য। তবে ছবিটা ডিলিট করে দিবেন, দেখার সাথে সাথে।”
ফরিদুর ছবি ডিলিট করে না। রেখে দেয় মোবাইলে। সন্তর্পণে হেঁটে চলে টি শার্টের প্যাকেট নিয়ে। রাস্তায় একটু পর পর পুলিশ চেকপোস্ট। একটা দুইটা বাইক ছাড়া আর কিছুই আটকাচ্ছে না। দেশে জরুরি কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেনি বর্তমান সময়ে, তাই তাদের মধ্যে সবাইকে থামিয়ে থামিয়ে তল্লাশি করার ভাবনাও আসেনি। তবু ফরিদুরের ভয় করে। মনে হয় এই বুঝি পুলিশ ডাকবে। পুলিশের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় পা কেমন ধরে আসে, হাঁটার গতি যায় কমে। ফরিদুরের কপালে জমে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সে ঘাম হয়ত খেয়াল করেনি পুলিশ, করলে নিশ্চিত ডেকে এনে তল্লাশি, এরপর সোজা গারদে। আবাহনী মাঠের পাশের গলি ধরে হেঁটে যায় ফরিদুর। প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। এপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে আছে। এক দুইজন মানুষ দেখা যাচ্ছে শুধু রাস্তার ধার দিয়ে শুয়ে আছে। এদিকটায় ওভাবে কেউ আসছে না। রাস্তার পাশে ময়লার গাড়ি রাখা, সে গাড়ি থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। এই দুর্গন্ধে হয়ত এড়িয়ে চলছে সবাই এদিকটা। ল্যাম্পপোস্ট বাতি এক দুইটা যা জ্বলছে, তার আলো খুবই ক্ষীণ। একটু দূরে একটা প্রাইভেট কার দেখা যাচ্ছে। সামনে পিছনের সব বাতি নিভিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফরিদুর সাহস নিয়ে এগিয়ে যায়। মনে সাহস থাকা জরুরী। একবার ভেবেছিল টাকাটা মেরে দিবে, পরে সে চিন্তা ইস্তফা দিয়েছে। নেশার মাল পাতির ব্যবসা করা লোকরে ঠকানো ঠিক হবে না। এরা ভয়ংকর হয়, ধুপ করে খুন করে ফেলতে পারে। ফরিদুর এগিয়ে গিয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়ায়, এদিক ওদিক তাকায়। কাউকে দেখা যায় না। খানিক পরে গাড়ি থেকে নেমে আসে একজন। মাথায় ক্যাপ পরা, ক্যাপের ছায়ায় চেহারা ঠিক বোঝা যায় না। ফরিদুর আস্তে করে বলে, “আপনি রক্তিম সাহেব?”
ক্যাপ পরা লোক উত্তর দেয়, “হুম। জিনিস এনেছেন?”
“হ্যাঁ,” বলে জিনিস এগিয়ে দেয় ফরিদুর। “যা যা বলছিলেন, সব আছে।”
রক্তিম প্যাকেট দুটো রেখে দেয় গাড়িতে দরজা খুলে।
রক্তিম বলে, “চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। আপনি তো ঝিগাতলা থাকেন, তাই না?”
ফরিদুরের বুকের ভিতর ধক করে ওঠে। এই লোক ফরিদুরের যাবতীয় সব তথ্য জানে।
“না না সমস্যা নেই। আমি একাই চলে যেতে পারব। এইটুকু রাস্তা।”
“আরে উঠুন না। গাড়ির পিছনের সিটে টাকা আছে, আপনার টাকা পয়সাও তো নিতে হবে, তাই না?”
ফরিদুর বিনা প্রতিবাদে উঠে যায় গাড়িতে। খোলা দরজা ধরে তাকিয়ে থাকে রক্তিম। ফরিদুর ছোট ছোট চোখ করে রক্তিমকে দেখে। ছবির চেহারার সাথে পুরোপুরি মিল কি আছে চেহারার? চেহারা ঠিক বোঝা যায় না, তবে মিল খুঁজে পায় ফরিদুর। রক্তিম আস্তে করে জানতে চায়, “ভালো আছেন তাহলে?”
ফরিদুর বলে, “জি।”
রক্তিম হালকা শব্দ করে হেসে ওঠে। ফরিদুর বুঝতে পারে না কেনো হাসছে লোকটা। রক্তিম পকেটে হাত দিয়ে, কিছু একটা বের করে। কিছু বুঝে উঠবার আগেই ফরিদুরের মুখের উপর চেপে ধরে শক্ত করে। হঠাৎ করে সব কেমন অন্ধকার হয়ে আসে ফরিদুরের। জ্ঞান হারাচ্ছে বুঝতে পারে। জ্ঞান হারাবার আগে একবার চিৎকার করতে যায়। সে চিৎকার হয়ত আর করতে পারেনি ফরিদুর। এরপর আবিষ্কার করে নিজেকে এই ঘরটায়, চেয়ারের সাথে বেঁধে থাকা অবস্থায়।
০৫ ই জুন, ২০২৫ রাত ১২:১১
রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: আচ্ছা ঠিক আছে
২| ০৫ ই জুন, ২০২৫ রাত ১২:৩৮
জ্যাক স্মিথ বলেছেন: আপনি একজন ফিল্ম মেকার হতে পারবেন, আপনার লেখার হাত ভালো।
০৫ ই জুন, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৩
রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ) বলেছেন: ধন্যবাদ, চেষ্টা করি লেখার।
আর ফিল্মমেকিং যথেষ্ট জটিল বিষয়, তবে স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করা হয়েছে দুটি, আর ব্যাসিক ফিল্মমেকিং-এর বিষয়াদিগুলো নিয়ে ইদানীং ঘাটাঘাটি করছি। লেখাটা নিয়েই যদিও আপাতত আছি।
৩| ০৫ ই জুন, ২০২৫ সকাল ৯:৩১
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর গল্প।
©somewhere in net ltd.
১|
০৫ ই জুন, ২০২৫ রাত ১২:০৮
আধুনিক চিন্তাবিদ বলেছেন: সব পর্ব দেওয়া শেষ হলে তখন হয়তো পরবো।