নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষের উদ্যোগ
আশার আলোয় উদ্ভাসিত দেশ
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
বাংলাদেশ! সেই তলাবিহীন ঝুড়ির দেশটা! সেই দেশটাকে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিদেশি সওদাগর-বণিকেরাই না বলত নিতল দেশ, এমন এক দেশ যার সোনা-রুপার খাঁই-খাকতির শেষ ছিল না। বিদেশি আমদানিকারক-সওদাগরেরা সোনা-রুপা পাওনায় পরিশোধ করতে হালাকান ছিলেন।
স্বাধীনতার পর সেই দেশে এক বড় দুর্ভিক্ষ ঘটেছে। চারটি ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত দেশটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগ-বিধ্বস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে বিদেশিরা। তিনটি সফল এবং প্রায় ৩০টি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে দেশটি অস্থির, জর্জরিত ও বিভ্রান্ত। দেশের দুজন রাষ্ট্রপতি অঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চারবার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়। সে ব্যাপারে ছয়টি হত্যা মামলা করা হলেও একটি মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি। দেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে যারা খুন করেছিল, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অপরাধের প্রথম এত্তেলা দিতে গেলে টাকাপয়সা না দিলে দারোগার কলম নড়ে না। আজ দেশে অজস্র চাঞ্চল্যকর খুনের কোনো হদিস পাচ্ছেন না দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিরা। আজ প্রতিটি অপরাধের তদন্তে একাধিকবার কর্মকর্তা বদল হন এবং নতুন করে তদন্তে-তদন্তে অভিযোগ খাস্তা হয়ে যায়। অদক্ষ সরকারি অভিযোক্তা এবং মিথ্যা সাক্ষ্যের ঘোরে আদালত চোখে আঁধি দেখে। বিচার-বিভ্রাটে মানুষ হয় হতবাক। মানবাধিকার ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা দুঃখ করেছেন তাঁদের সরকারপক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় বইপত্তর সরবরাহ করা হয়নি এবং সে ঘাটতি তাঁদের স্ব-উদ্যোগে পূরণ করতে হয়েছে। মামলা-মোকদ্দমায় কোর্ট-কাছারি এমনই ভারাক্রান্ত যে নতুন একটা মামলা হলে ৪০ বছরের অধিক কাল লাগে তা নিষ্পত্তি করতে।
বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে বাধা হচ্ছে এর দুর্বল কাঠামো, গ্যাস-বিদ্যুতের স্বল্পতার পাশাপাশি বেহাল যোগাযোগব্যবস্থার নেতিবাচক ভূমিকা। পরিস্থিতির উন্নয়নে একাধিক বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও শেষ হয়নি একটিও।
অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসন, ঈর্ষাপরায়ণ ও পরশ্রীকাতর দলাদলির কারণে ভালো কিছু দানা বাঁধতে পারছে না। দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকরভাবে শক্তিশালী করার জন্য একাধিক কমিটি তিন বছর ধরে যেসব সুপারিশ করেছে, তা বিল আকারে সংসদীয় কমিটিতে পড়ে আছে। বর্তমান সংসদে তা কি পাস হবে?
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থানীয় সরকার গড়ে ওঠেনি। এখানে স্থানীয় সরকারে কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত প্রশাসকেরা নায়েব-গোমস্তার কাজ করেন। এখানে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের একজন ৩১ বছর এবং অপরজন প্রায় ২৮ বছর ধরে প্রধান পদ আঁকড়ে রয়েছেন। সরকারি দলের নেতা এবং বিরোধী দলের নেতার মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। সংসদে একজন বক্তব্য দিলে আরেকজন অনুপস্থিত থাকেন। বিরোধী দল সংসদে নিয়মিত গরহাজির থাকলেও সদস্যের সুবিধাদি ঠিকই উপভোগ করে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বড়ই বিক্ষুব্ধ। গত ৪২ বছরে ক্যাম্পাসে খুন হয়েছে ১২৯ জন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪, রাজশাহীতে ২৫, চট্টগ্রামে ২৪ এবং জাহাঙ্গীরনগরে ছয় জন। ৫৪ জন ছাত্র হত্যার কোনো বিচার হয়নি। এই বিচার না হওয়া সম্পর্কে সাবেক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘নষ্ট রাজনীতির বলি হচ্ছে ছাত্ররা। কোনো সরকারই হত্যার বিচারের জন্য উদ্যোগ নেয়নি।’
বাংলাদেশের প্রধান বন্দর চট্টগ্রাম বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বন্দর। রাজধানী সেদিন পর্যন্ত ছিল সবচেয়ে অবাসযোগ্য শহর। এখন ঢাকার ওপরে উঠেছে দামেস্ক।
বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছে। ২০১২ সালে বিশ্বের ১৮৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম। আগের বছর অবস্থান ছিল ১৪৭তম। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ এখনো নিম্ন পর্যায়ভুক্ত হলেও দেশটির অগ্রগতি নিম্ন পর্যায়ের গড় প্রবণতার চেয়ে বেশি। ২০১২ সালে মানব উন্নয়নে নিম্ন পর্যায়ভুক্ত দেশগুলোর গড় এইচডিআই মান দশমিক ৪৬১, একই সময়ে বাংলাদেশের এইচডিআই মান ছিল দশমিক ৫১৫। তবে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক গড় মান দশমিক ৫৫৮ এবং বৈশ্বিক গড় মান দশমিক ৬৯৪ থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। ভারতের চেয়ে কম হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অর্ধেক মাথাপিছু আয় নিয়েও মানব উন্নয়নে বরং বাংলাদেশ সে দেশের তুলনায় ভালো করেছে। কোনো কোনো সূচকে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। ১৯৯০-২০১২ সময়ে মানব উন্নয়ন সূচকে ভারত ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঘাটতি কমাতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ কমিয়েছে ২৪ দশমিক ১০ শতাংশ। এই ঘাটতি কমানোর সূচকে ভারতের অবস্থান ৪৫তম, বাংলাদেশের ৪৭তম।
শিশুমৃত্যু রোধে বা শিশুদের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নাটকীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। বাংলাদেশ নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ করেছে, নারীর সামাজিক মর্যাদার উন্নতি ঘটিয়েছে, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে, স্বাস্থ্যসচেতনতা ও স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করেছে।
আয়ুষ্কাল, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি—মানব উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ এই তিন সূচকে বাংলাদেশের অর্জনের অবস্থান বেশ উল্লেখযোগ্য। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বড় অগ্রগতি সাধিত হলেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গুণগত মানব উন্নয়নের পথে আমাদের আরও এগোতে হবে। দেশের সব পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নে যেসব প্রতিবন্ধকতা এখনো রয়েছে, সেগুলোও নির্মূল করা দরকার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে আয়বৈষম্য বেড়ে চলেছে। সামাজিক নিরাপত্তাজালের পরিধিটা অন্তত বাড়ানোর জন্য বিশেষত কর-রাজস্ব আহরণে নিতে হবে যথাযথ উদ্যোগ। একই সঙ্গে সার্বিকভাবে মানব উন্নয়নে স্থানীয় বেসরকারি খাতের অধিক অংশগ্রহণ সম্ভব হলে বিদেশি সহায়তা-নির্ভরতাও কমবে।
সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে সামাজিক নিরীক্ষা করে অ্যাডাম শেভোরস্কি (Adam Przeworski)বলেছিলেন, ‘যেসব দেশে মাথাপিছু আয় এক হাজার ডলারের কম, সেখানে গণতন্ত্রের আয়ু পাঁচ বছরেরও কম এবং যেখানে মাথাপিছু আয় চার হাজার ৩৩৫, সেখানে কোনো গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটেনি।’
১৯৭৩ সালে আমাদের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১১০ ডলার। ২০১০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭৫১ ডলার হয়। ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে আমাদের জানিয়েছেন, এখন আমাদের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৪৪ ডলার। সুসংবাদ সন্দেহ নেই। তবে সংখ্যাতত্ত্বের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমাদের এখনো এক দুরূহ পথ অতিক্রম করতে হবে। উল্লাসের কথা, বাংলাদেশ সীমান্ত অর্থনীতির প্রান্তিক অবস্থা পেরিয়ে এখন তিনটি ইংরেজি শব্দ ‘জি’র, গ্লোবাল গ্রোথ জেনারেটর, ভূমিকায় সামনে এগিয়ে আসছে।
নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ফালান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ পারকিনসন বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরীক্ষাগার বলে তাঁদের বাংলাদেশ টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট-এ তাঁরা লেখেন, ‘এ রকম পরিস্থিতিতে যদি বাংলাদেশের উন্নয়নের উদ্যোগ সফল হয়, তবে পৃথিবীর যেকোনো দেশেই এ ধরনের উদ্যোগ সফল করা যাবে।’ ২০০৭ সালে তাঁরা বললেন, ‘তিন দশক এবং তার বেশি সময়ের সীমিত ও বর্ণাঢ্য অগ্রগতির ভিত্তিতে মনে হয় বাংলাদেশে টেকসই অর্জন সম্ভব।’
২০০৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তো ‘দ্য পাজল অব বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রতিবেদন ছাপে। তার সারমর্ম ছিল, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন নেই, নেই সুশাসন, নেই সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব, নেই দূরদর্শী ও জনমুখী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের ছায়াসঙ্গী। তার পরও গত দেড় দশকে বাংলাদেশ গড় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপর ধরে রেখেছে। ২০০৬-০৭ সালে জিডিপি সাড়ে ৬-এ উঠেছিল। দারিদ্র্য প্রতিবছর ১ শতাংশ করে কমছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আত্মবিশ্বাসী করার মতো। জিডিপিতে বিদেশি সাহায্যের ভাগ ৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ।
সম্প্রতি গোল্ডম্যান স্যাক্স সমীক্ষা-পর্যালোচনা করে ব্রিক গোষ্ঠী, অর্থাৎ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন ছাড়া সম্ভাবনাময় পরবর্তী একাদশ ‘নেক্সট ইলেভেন’ নামের দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের পূর্বাভাসে বলেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ২০৫০ সালে প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বের নামকরা রেটিং-বিশেষজ্ঞ সংস্থা মুভিস ও স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশকে সন্তোষজনক অর্থনৈতিক রেটিং দিয়ে যাচ্ছে। ২০১২ সালে ব্রিটেনের দি ইকোনমিস্ট নিশ্চিত করল, ‘বাংলাদেশের অর্জনগুলো এতই ইতিবাচক যে, এ পরিবর্তন বা অর্জনগুলো ধরে রাখতে পারলে সত্যিই অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে পারবে দেশটি।’
অক্সফোর্ড পভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (ওপিএইচআই) পরিচালক সাবিনা আলকার পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ভারত যেখানে ফিবছর দারিদ্র্যের হার ১ দশমিক ২ শতাংশ কমিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ ৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং নেপাল ৪ দশমিক ১ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৯০ সালে প্রতি হাজারে ১৪৬ শিশুর মৃত্যু হলেও ২০০৯ সালে এসে প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যু ৫০-এ দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া মাতৃস্বাস্থ্যেও বাংলাদেশের উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য। এক লাখ প্রসূতির মধ্যে মৃত্যুর হার ৫৬৪ থেকে কমে ১৯৪-তে নেমে এসেছে। নোবেল-বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে।
বাংলাদেশের রয়েছে ১৬ কোটির এক বিশাল জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে কর্মক্ষম জনসংখ্যা আছে পাঁচ কোটি ৬০ লাখ। জনসংখ্যা বাড়ছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ হারে, কিন্তু কর্মক্ষম জনসংখ্যা বাড়ছে ২ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। সৌভাগ্যক্রমে মোট জনসংখ্যার বড় অংশই যুবক। বিশ্বব্যাংকের মতে, এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশকে কাজে লাগাতে হলে জনশক্তিকে আরও দক্ষ করতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রবৃদ্ধি হতে হবে কর্মসংস্থানমুখী। কারণ, এ দেশের মূল সম্পদই হলো জনশক্তি। একে কাজে লাগাতে হবে অধিকতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল অনেক বেশি কার্যকর হবে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে এবং প্রবৃদ্ধির সুফল বিরাট জনগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টিত হবে।
বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন-সচেতন। ইতিমধ্যে গ্রামে সবজি, হাঁসমুরগি, গবাদিপশুর খামার গড়ে উঠেছে। আমরা গো-মাংস, মাছ, কাঁকড়া, শুঁটকি, ফুল, সিমেন্ট, সিরামিক, ওষুধ রপ্তানি করছি। বাংলাদেশে তৈরি জাহাজ বিশ্বের বন্দরে বন্দরে যাতায়াত করছে। আমরা হালকা ইলেকট্রিক সামগ্রী—ফ্রিজ, ফ্যান ও বাইসাইকেল রপ্তানি করছি। তথ্যপ্রযুক্তিতে পারঙ্গম তরুণদের উদ্যোগে নানামুখী আউটসোর্সিং তথ্য বিজনেস প্রসেসিং শিল্পের প্রসার ঘটেছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয়ের সেরা ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তার স্থান করে নিয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার সাহায্য-সহযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে সাধ্যমতো নিজেদের অবস্থার উন্নতি করেছে। যদিও তুলনামূলকভাবে নিজেদের নাগরিক অধিকারের দাবিতে দেশের লোক সুসংগঠিত হতে পারেনি। মানবাধিকার রক্ষা, নারী নির্যাতন রোধ ও দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়নে নানা দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ও তৃণমূল সংগঠন গড়ে ওঠেনি।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এখনো মজুরির হার অনেক কম। ভিয়েতনামের হ্যানয়ে মাসে গড় মজুরি ১১১ ডলার, কম্পোডিয়ার নমপেনে ৮২ ডলার হলেও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তা মাত্র ৭৮ ডলার। নিম্ন মজুরির কারণে উৎপাদন খরচ কমাতে প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ভীষণভাবে তাদের বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এর প্রভাব স্বল্প মেয়াদে যেমন বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করবে, তেমনি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে।
বাংলাদেশের পরিবর্তনে বিভিন্ন নির্দেশক বা সূচকের প্রধান দিক হচ্ছে, খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত মানুষের হার ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫-এ নেমে আসে। ২০১৩ সালে এটি আরও কমছে বলে ধারণা। এটি ধরে রাখতে পারলে ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসংক্রান্ত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করতে পারবে বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৮ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলে বাংলাদেশ এমডিজি-সম্পর্কিত লক্ষ্য অর্জন করবে।
বাংলাদেশেই ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে উন্নয়ন-পদ্ধতি প্রথম শুরু হয়। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সফল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক উন্নয়নকর্মে বেশ সাফল্য লাভ করেছে।
এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভালো করছে এমন উন্নয়নশীল ২৫টি দেশের অন্যতম হিসেবেও বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে এ সাফল্য প্রশংসিত হলেও আরও দৃঢ়পদে জোরে এগোতে হবে। জিডিপিকে নিতে হবে ৮ শতাংশ উচ্চতায়। রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিও নিশ্চিত করতে হবে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নির্ধারিত বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে ব্যক্তি খাত উন্নয়নের জন্য নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াত নিষিদ্ধকরণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী ব্লগারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন—এই তিন ইস্যুতে জামায়াত-শিবির, গণজাগরণ মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ ২৫ সংগঠন এবং দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি হরতাল, অবরোধ, লংমার্চের মতো কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। এসব সমস্যার কারণে গত কয়েক মাসে সারা দেশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথম আলো ৭ নভেম্বর
©somewhere in net ltd.