নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সময়ের পরিবর্তনে মানুষ মৌলিক রেখা থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে। কেউ কেউ গমন করতে করতে এতো দূরে চলে গেছে যে্ন ওখানেই তার পরিশুদ্ধ জনম। আমার কামনা সকলে মৌলিক রেখায় প্রত্যাবর্তন করুক।

শাহজালাল হাওলাদার

শাহজালাল হাওলাদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

মোঘল আমলের মসজিদ

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:৩৯

[link||view this link]ডহরশঙ্কর হাওলাদার বাড়ি জামে মসজিদ
প্রকৌশলী মোঃ শাহজালাল

মসজিদ নির্মাণের পূর্ব কথাঃ মসজিদ নির্মাতার নাম সোনা উল্লা। কে এই সোনা উল্লা? পিতা, পিতামহ এমনি করে পর্যায় ক্রমিক শ্রুতি আছে সোনা উল্লা ছিলেন শেখ ফরিদ গঞ্জেশকর (রহঃ) এর বংশধর। তাঁর বাবার নাম ছিল মুরাদ। ১৯৪৮ সালে বরিশাল Subordinate Judge এর কার্যালয় থেকে প্রদত্ত একটা আপিল মামলার রায়ের কপিতে মুরাদ থেকে শুরু করে তাঁর ৪র্থ প্রজন্ম ইমানুদ্দি পর্যন্ত নিম্ন মুখি প্রজন্মের নাম উল্লেখ আছে। উল্লখ্য উক্ত আপিলটি দায়ের হয়েছিল ১৯১৯ সালের ৮ ই ডিসেম্বর। পরবর্তী পুরুষদের তাঁদের সাথে প্রমানিত সংযোগ সূত্র রয়েছে। সোনা উল্লা অনেক ধনবান ব্যক্তি ছিলেন বলে লোকেরা তাঁকে ধন ওয়ালা সোনা উল্লা বা ধনা উল্লা বলেও অভিহিত করতো। মসজিদ থেকে বিশ গজ পশ্চিম – দখিনে সোনা উল্লা ও তাঁর স্ত্রীর কবর বর্তমান রয়েছে।
লেখক সোনা উল্লাহর অধস্তন সপ্তম পুরুষ।
অনেক শাখা প্রশাখা থাকলেও নিম্নে আট প্রজন্মের একটি সংক্ষিপ্ত ছক প্রদত্ত হল।
সাতু
মুরাদ আজিতুল্লা
সোনা উল্লা লাল মাহমুদ ঈমানুদ্দি নেফাজ উদ্দিন হাওলাদার
সৈজদ্দিন হাওলাদার মোঃ বেলায়েত হোসেন হাওলাদার মোঃ শাহজালাল হাওলাদার।
মসজিদের অবস্থানঃ বরিশাল বিভাগের অন্তরগত ঝালকাঠি জেলাধীন রাজাপুর উপাজেলার ডহরশঙ্কর গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত। ডহরশঙ্কর গ্রামটি ছুরিচরা নামে বহুল পরিচিত ছিল। এখনও দূরবর্তী অনেক লোকেরা সেই ছুরিচরা ই বলে থাকে। গ্রামটি বিশখালী নদীর তীরে অবস্থিত, এক সময়কার নদীর চরটি ছুরি আকৃতির ছিল বলেই হয়ত গ্রামটিকে ছুরিচরা বলা হতো।

মসজিদের ইতিহাসঃ কেউ বলে গায়েবী মসজিদ, কেউ বলে জীনেরা এক রাত্রে এসে মসজিদটি নির্মাণ করে গেছে, আবার কিছু লোকের ধারণা মসজিদটি মাটি ভেদ করে এমনিতে ই উঠে গেছে। এমনিভাবে মসজিদটি নিয়ে রয়েছে নানান জনের নানান মন্তব্য। পূর্ববর্তী প্রজন্ম কর্তৃক আজ পর্যন্ত লিখিত কোন ইতিহাস নেই। শুধু মুখে মুখে চলে আসছে এর ইতিহাস। প্রকৃত পক্ষে মসজিদটির নির্মাতা হলেন জনাব সোনা উল্লা। আজ থেকে প্রায় পৌনে তিনশত বছর আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে অর্থাৎ ১৭০০ সালের প্রথমার্ধের শেষার্ধ ছিল মসজিদের নির্মাণকাল। তখন ছিল মোঘল আমল। বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগে মোঘল আমলের যতগুলো পুরাকৃতি রয়েছে, ডহরশঙ্কর হওলাদার বাড়ি জামে মসসজিদ তার মধ্যে অন্যতম। মোঘল আমলে নির্মিত হলেও এটি মোঘল সম্রাটরা নির্মাণ করেননি। প্রচুর বিত্ত বৈভবের মালিক সোনা উল্লা নিজ অর্থেই নির্মাণ করেছিলেন মসজিদটি। এ ছাড়াও নির্মাণ করেছেন সমসাময়িক কালের আরও কিছু স্থাপনা। মসজিদের দক্ষিণ পাশে রয়েছে ছোট ছোট দুটি সৃতি সৌধ। এ দুটি নিয়ে প্রচলিত উক্তি হল, দুটির মধ্যে দক্ষিন দিকের ভবনটি নবী করীম (সঃ) দুহিতা ফাতিমা (রাঃ) ও দৌহিত্র হযরত হাসান (রাঃ) এবং হযরত হোসাইন (রাঃ) এর সৃতি স্তম্ভ সদৃশ। উত্তর দিকের অপক্ষাকৃত ছোট ভবনটি গাজী আর কালু নামের দুই ব্যক্তির সৃতি স্তম্ভ। তবে আমার কাছে এ মন্তব্যের বিশ্বাস যোগ্যতা নেই। তার পিছনের দিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে ছিল সোনা উল্লার বাস ভবন। অযত্ন অবহেলার কারণে কয়েক যুগ ধরে ভগ্ন দশায় ছিল ভবনটি। এ ভবনের ই দক্ষিণ ভাগে সমাহিত করা হয়েছে সোনা উল্লাকে। ২০০১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ভবনটি ধসে পড়ে যায়। আর্চ আকৃতির দরজা জানালার এই ভবনটির উত্তর - দক্ষিণ দৈর্ঘে ছিল ৪৬’-০” এবং পূর্ব – পশ্চিম প্রস্থে ছিল ২৩’-০”। মসজিদ সহ পুরো এলাকাটি একসময় বাউন্ডারি ওয়ালে বেষ্টিত ছিল। তথ্য অনুযায়ী কয়েক বছর আগে মাটি খনন করে তার নমুনা পাওয়া গিয়েছে। মসজিদের সামনে ও পিছনে কিছু দূরে রয়েছে দুটি বড় পুকুর, আয়তন যথাক্রমে চল্লিশ শতাংশ ও আটত্রিশ শতাংশ। বড় পুকুর বলে আগেকার লোকেরা এ দুটিকে দীঘি বলত। একটা হল সামনের দীঘি অপরটা হল পশ্চিমের দীঘি।

অলিখিত শত শত বছরের অতীত বলে কথা, রুপকথার গল্পের মত কিছু কথা রয়েছে পুকুর দুটি ঘিরে। যেমন, পশ্চিমের পুকুরে গলায় শিকল জড়ানো রুপার টাকা ভর্তি মটকি ছিল, কোন এক রমণী ঘাটে গোসল করতে নামলে মটকি ভেসে উঠে শিকল দিয়ে টেনে ধরত তার আঁচল। আজও এ পুকুরে নামতে অনেকে ভয় পায়। সামনের পুকুরে জেগে উঠত সোনার নৌকা ও রুপার বৈঠা। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে পিতলের থালা বাসন সহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র দিঘির ঘাটে জমা হয়ে যেত। লোকেরা প্রয়োজন সেরে আবার ওগুলো ফেরত দিত। অবশেষে আসবাবপত্র বোঝাই নৌকা ধীরে ধীরে পানিতে তলিয়ে যেত। একবার যথা নিয়মে অনুষ্ঠান সেরে মালপত্র ফেরত দেয়া হল কিন্তু কোন এক লোক একটা নিমক দানি অর্থাৎ লবনের বাটি লুকিয়ে রাখল। এতে করে সাত দিন ধরে নৌকা ভেসেই থাকল আর ডোবে না, অবস্থা বুঝতে পেরে লোকজন নিমক দানির জন্য চাপ সৃষ্টি করে সন্ধান পেল এবং ফেরত দেয়া হল সোনার নৌকায়। তৎক্ষণাৎ নৌকা তলিয়ে গেল, সেই যে তলিয়ে গেল আর জাগেনি কোনদিন।
ফিরে আসি মসজিদের ইতিহাসে, তখনও পৃথিবীতে সিমেন্ট আবিষ্কৃত হয়নি। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী জোসেফ এ্যস্পিদিম ১৮২৪ সালে সিমেন্ট আবিস্কার করেন। কিন্তু মসজিদ নির্মিত হয়েছিল তারও প্রায় একশত বৎসর আগে। পুরো নির্মাণ কাজটাই সম্পন্ন হয় টালির ইট এবং চুন সুরকির মসলা দিয়ে। ভিতরে ও বাহিরে সুদক্ষ শিল্পীর নিপুন কারুকাজ খচিত ছিল, এখনও কিছু কিছু কারুকাজ অস্পষ্ট অবস্থায় বর্তমান আছে। ছোট আয়তনের মসজিদটি আকারে মাত্র ১৭’-০”*১৭’-০”এবং উচ্চতা ২৭’-০”। আকারে ছোট হলেও এর ওয়ালের পুরুত্ব প্রায় তিন ফিট। চারদিকে চারটি গোলাকৃতির পিলার দিয়ে এক গম্বুজে সম্পন্ন করা হয়েছে পুরো ছাদ। সবগুলো দরজা জানালাই আর্চ আকৃতির। ছবিতে বিভিন্ন দিকের দৃশ্য প্রদর্শিত হয়েছে। ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে মসজিদের কিছু মেরামত কাজ এবং ২৬’-৬”*২২’-৬” একটা বারান্দা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বর্তমানে যেখানে বারান্দা স্থাপিত হয়েছে সেখানে ছিল একটা উম্মুক্ত বৈঠকখানা।
আজকের দিনের মত যখন আনাচে কানাচে মসজিদ গড়ে উঠেনি তখন বহু দূর দুরান্ত থেকে লোকজন এখানে নামাজ পড়তে আসত। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ও মাঝে মাঝে লোকজন আসে মসজিদটি দেখার জন্য। মিথ্যার আশ্রয় কিংবা ভুল বুঝাবুঝির কারণে মানুষ যখন কোন সালিশির দ্বারাও সমাধানে পৌঁছতে না পারে তখন তারা ডহরশঙ্কর হাওলাদার বাড়ি জামে মসজিদের আশ্রয় নেয়। মসজিদ সবই আল্লাহর ঘর তথাপিও বহু পুরাতন মসজিদ হিসেবে মানুষের রয়েছে আলাদা ধরনের ভক্তি। লোকেরা বৈধ প্রয়োজনে এখানে দান ও মান্নত করে থাকে।

এ মসজিদকে ঘিরে রয়েছে বেশ কিছু আশ্চর্যজনক ঘটনাঃ
১) অনেক বছর আগে পাশের গ্রামের এক বখাটে যুবক ছাগল চুরির অপরাধী সাব্যস্ত হলেও সে জোর গলায় অস্বীকার করতে লাগলো। এক পর্যায় ছাগলের মালিক বলল তুমি যদি ডহরশঙ্কর হাওলাদার বাড়ি জামে মসজিদে উঠে বলতে পার তবে আমার ছাগলের দাবি থাকবে না। যুবক তার কথায় রাজি হল। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী তারা হাজির হল মসজিদ প্রাঙ্গনে। যুবক ভাবল হবে ই বা কি, সে অজু করে জোর পায়ে মসজিদে উঠে গেল। বলল, হে আল্লাহ আমি যদি ছাগল চুরি করে থাকি বা এ ব্যাপারে যদি কিছু জেনে থাকি তাহলে তুমি তার বিচার করিও। এ কথা বলে মসজিদ থেকে নেমে পূর্ব দিকে কিছুদুর গিয়েই একটা পুরাতন কবরের পাশে ধপাস করে পড়ে গেল। চোখ উল্টে বড় হয়ে গেল আর বলতে লাগলো আমি ছাগল চুরি করেছি, আমি ছাগল চুরি করেছি।
২) আরেকটি ঘটনা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। মসজিদের একটু সামনেই ছিল সরকারী প্রাইমারী স্কুল। দূরবর্তী গ্রামের অধিবাসী এক স্বামী তার স্ত্রীকে ১৭ টি রৌপ্য মুদ্রা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত করল। কিছুতেই স্ত্রী স্বীকার করছিলনা সে অভিযোগ, শেষমেশ কি আর করা চলো ডহরশঙ্কর হাওলাদার বাড়ি জামে মসজিদে। সেদিন স্কুল খোলা ছিল, আমরা দেখলাম এক মহিলাকে হাতে হাতে ধরে এনে লাইব্রেরীতে শোয়ায়ে মাথায় পানি দেয়া হচ্ছে। পরে জানতে পারলাম ঐ মহিলা মসজিদ থেকে কিড়া (স্থানীয় ভাষায় এ ধরনের অঙ্গীকারকে কিড়া বলে) করে যাওয়ার সময় স্কুলের পূর্ব পাশের রেইন ট্রির গোঁড়ায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিল। অনেক্ষন ধরে মাথায় পানি দেয়ার পর হুঁশ ফিরে পেল। অবশেষে স্বীকার করল রৌপ্য মুদ্রা আত্মসাতের কথা।
৩) বর্তমানে সরকারী প্রাইমারী স্কুলটি সামনের পুকুরের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। ১৯৯৫ সালে এ একতলা ভবনটি নতুন ভাবে নির্মিত হয়। কাজ চলাকালীন নিম্ন মানের কাজের টের পেয়ে স্কুলের তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি হেড মিস্ত্রিকে মসজিদের সামনে এনে শপথ করতে বলল যাতে স্কুলে আর নিম্ন মানের কাজ না হয়। ঠিকাদার নিম্ন মানের কাজ করতে চাইলেও যেন আমাদেরকে অবগত করান হয়। হেড মিস্ত্রি সভাপতির কথামতো মসজিদের সামনে দাঁড়িয়েই অঙ্গীকার করল। কিন্তু অঙ্গীকার করলে কি হবে সে ঠিকই কথার বিপরীতে কাজ করল। আল্লাহর কি মর্জি কয়েক মাসের মধ্যেই ঐ মিস্ত্রি পারালাইসড রোগী হয়ে গেল। এভাবে কিছুদিন রোগ ভোগের পর সে মারা গেল। এমনিভাবে আরও অনেক জানা অজানা বিষয় রয়েছে। কেউ কেউ এসব আশ্চর্য জনক ঘটনাকে পুঁজি করে এটাকে একটা ব্যবসা ক্ষেত্র বানাতে চাইলেও আজ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না ইনশা- আল্লাহ। আগেকার মুরব্বিরা বলতো গভীর রাতে কখনো কখনো মসজিদের ভিতর ধুম ধুম আওয়াজ শোনা যেত। ধারণা করা হতো ওটা ছিল এবাদত করতে আসা জীনদের যাতায়াত। এসব শ্রবণান্তে রাতের বেলায় মসজিদের পাশ দিয়ে একা একা চলতে গা ছম ছম করে।

উপসংহারঃ ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদ সহ অন্যান্য স্থাপনাগুলো বর্তমানে অনেকটা জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।। যথাযথ উদ্যোগের অভাবে সরকারি কিংবা বেসরকারি ভাবে এ পর্যন্ত লক্ষণীয় কোন সংস্কার বা সম্প্রসারণ হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত কয়েক বছরের মধ্যেই হারিয়ে যাবে শত শত বছরের এই ঐতিহ্য।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৫৯

জনম দাসী বলেছেন: ভালো লেগেছে, লেখাটি ... +++++++++

ভালো থাকুন, এগিয়ে চলুন।

০১ লা এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৫

শাহজালাল হাওলাদার বলেছেন: আদ্যোপান্ত পড়ার জন্য অভিনন্দন। দোয়া করুন এগিয়ে চলার।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.