![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষ হতে চেয়ে কি যে হচ্ছি তা নিজেও জানিনা
কর্নেল আকরাম হোসেন মারাত্নক বিরক্ত হয়ে ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। নিজের পাইপে ঘন ঘন টান দিয়ে ঘর ধোঁয়া করে ফেলছেন যেন নিজের কাছ থেকেই নিজেকে আড়ালে রাখতে চাইছেন। সময়ের সাথে সাথে তার মেজাজ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এই দিন দেখার জন্যই কি ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন? বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ছেলে যতো সব আধিভৌতিক আর অলৌকিক ধারনায় যে শুধু বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে তাই না আজকাল প্র্যাক্টিসও করছে।
ছেলের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য আজ সন্ধ্যার দিকে তিনি জাভেদের রুমে ঢুকেছিলেন। রুমে ঢুকে তিনি অবাক। গোটা রুমের বাতি নেভানো। জানালায় ভারি পর্দা ঝুলছে। এসি বন্ধ করা। কেমন একটা ভ্যাপসা গুমোট ভাব চারপাশে। ঘরের মেঝেতে দুইটা মোমবাতি জ্বলছে। যার মাঝখানে তার ছেলে ধ্যানে বসে আছে। তার সামনে একটা বিড়ালের বাচ্চা, যার হাত পা বেধে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ছেলে বিড়ালের বাচ্চার শরীরের উপর দিয়ে তার দুই হাত একবার এপাশে নিচ্ছে তারপর আরেকবার অপাশে নিচ্ছে।
আকরাম সাহেব কিছুক্ষন ছেলের কার্যকলাপ দেখলেন। তারপর অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
জাভেদ এটা কী হচ্ছে? কি করছো তুমি ?
-বাবা, শশশ চুপ করে থাকো, একদম ডিস্টার্ব করবেনা। আমি একটা পরীক্ষার মাঝখানে আছি।
-কিসের এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে? আর বিড়ালের বাচ্চা এখানে কেনো? এটাকে বেধেছে কে?
-তুমি কিন্তু বেশি কথা বলছো বাবা!
-আগে উত্তর দাও, তারপর যা খুশি হয় করো।
-বিড়ালের বাচ্চাটা ব্যথা পেয়েছে। আমি তার হিলিং করছি।
-ব্যথা পেয়েছে তাহলে পশু পাখির ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। তুমিতো আর পশু পাখির ডাক্তার না।
-বাবা বিরক্ত করো না তো ! এখন যাও। আমি কাজ শেষ করে দেখা করবো। আর কেউ যেনো আমার রুমে না ঢুকে। সবাইকে মানা করে দাও।
ছেলের দিকে বিষ দৃষ্টি দিয়ে তিনি রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
এ কোন প্রকারের হিলিং কার্যক্রম চালাচ্ছে তার ছেলে ? আকুপাংচার শুনেছেন, আরো অনেক থেরাপির নাম শুনেছেন দেখেছেন। কিন্তু স্পর্শ না করে হাত এপাশ ওপাশ করে কি হিলিং থেরাপি দিচ্ছে তার ছেলে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। যথেষ্ট পরিমানে পাগল আছে তার ছেলে। তিনি মাঝে মাঝেই বুঝে উঠতে পারেন না তার ছেলের মতো ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে কিভাবে হুজুগে ধরনের মানুষ হয়ে যায়। যে যাই বলে তাই বিশ্বাস করে বসে থাকে। আর্মি পরিবারে বেড়ে উঠেও তার মধ্যে সিভিলিয়ানদের সমস্ত পাগলামি আছে। তবে তিনি এটা নিশ্চিত যে এই উদ্ভট আইডিয়া সে নিজে খুঁজে পায়নি, তার সন্ধান তাকে অন্য কেউ দিয়েছে। আর এ রকম উদ্ভট সব জিনিস নিয়ে তার একটাই বনধু আছে যে নাড়াচাড়া করে। তার দৃঢ় বিশ্বাস সজীব তার ছেলের মাথায় এই আইডিয়ার বীজ বপন করেছে। হয়তো প্র্যাক্টিকেলি বলেনি শুধু থিয়োরি বলেছে আর তার ছেলে আরো একমাত্রা এগিয়ে গিয়ে সেই থিয়োরির বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে চলেছে।
আকরাম সাহেবের কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়লো। সজীবের সাথে জাভেদের যোগাযোগ দেখা যাচ্ছে বিচ্ছিন্ন করতে হবে যে কোন প্রকারে! তার ছেলে এক পাগল, আর তার বন্ধু অই ছেলেটা হচ্ছে আরেক পাগল। এক জন দুনিয়া তোলপাড় করে একটার পর একটা আজগুবে ধারনা খুড়ে নিয়ে আসে আরেক জন সেই ধারনার ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে বসে। এভাবে চলতে থাকলে ছেলে কিছুদিন পরে মারাত্নক কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসতে পারে।
ছেলে যেন হুমায়ূন আহমেদের হিমু না পড়তে পারে তাই এই বিখ্যাত লেখকের হিমু সমগ্র তিনি তার বইয়ের লাইব্রেরিতে রাখেননি। তার বিশ্বাস ছিল এই লেখকের লেখা পড়ার পরে তার ছেলে নিশ্চিত হিমু হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে।
কিন্তু তিনি না রাখলে কি হবে, সেই বই কোথা থেকে জোগাড় করে পড়ে জাভেদ এক উন্মাদ কার্যকলাপ ঘটিয়েছিলো এ লেভেলে থাকতে। যার অধিকাংশ কাজের সাথে ছিলো এই সজীব ছেলেটা। ছেলেটা মেধাবী, আচার ব্যবহার ভালো তাই মিশতে দিতেন। এতো দিনের সব কাজ গুলো তিনি শিশু সুলভ ভাবেই নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এই অকাল্ট বিদ্যার চর্চা তার কাছে সুবিধার ঠেকছে না
প্রায় দেড় ঘন্টা পর ছেলে চোখে মুখে, সারা শরীরে ঘাম নিয়ে নিজের রুমের দরজা খুলে বাইরে বের হলো। হাতে হাত পা বাধা বিড়ালের বাচ্চা। বাচ্চাটা মেউ মেউ করে চলেছে এক নাগাড়ে। যেনো কাতর স্বরে বলতে চাচ্ছে,
ছেড়ে দে বাপ কেদে বাঁচি। আর জীবনেও ব্যথা পাবো না, আর পেলেও তোর সামনে পড়বোনা। একে ব্যথায় জান বাচে না তার উপরে পাগলের তুক তাক। ছেড়ে দে ভাই!
ছেলের দিকে তাকিয়ে আকরাম সাহেব বললেন,
কি রকম হলো তোমার হিলিং?
মাথা চুলকে জাভেদ বললো, অজ্ঞান ছিল ! জ্ঞান ফিরে পেয়ে যে রকম চিল্লা পাল্লা শুরু করলো তাতে আর পরীক্ষাটা সম্পূর্ণ করতে পারলাম না।
-তোমাকে এই বিদ্যা কে শিখিয়েছে? তোমার বন্ধু সজীব?
-না! ও কেনো শেখাতে যাবে?
-তা তুমি কি এরকম হিলিং মাঝে মাঝেই করো নাকি?
-প্রয়োজন হলে করি।
-বিড়াল ছাড়া আর কোন কোন প্রাণীর উপরে করেছো?
-দারোয়ান চাচার উপরে একবার প্রয়োগ করেছি।
আকরাম সাহেব মহাশ্চর্য্য হয়ে বললেন, ইউনুস মিয়ার উপরেও করেছো? কই সে তো আমাকে কিছু বলেনি।
–এটা বলার কী আছে? তিনি পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলেন, আমি আমার ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তাকে সুস্থ করে দিয়েছি। তুমি শরীরের কোথাও ব্যথা পেলে আমাকে জানিও, আমি ঠিক করে দিবো।
আকরাম সাহেবর মনে হলো কড়া গলায় মিলিটারি এক ধমক দেন ছেলেকে। কিন্তু এটাও ভালো মতো জানেন এই ধমকে জাভেদের কোন প্রকারের হেল দোল হবে না। তিনি শুধু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তোমার ধারনা তোমার ভিতরে আধিভৌতিক ক্ষমতা আছে? এই উৎপাত নিয়েতো আগে কোন কথা শুনিনি!
-এই ক্ষমতা সবার মধ্যেই থাকে বাবা! কেউ চিনতে পারে কেউ পারে না।
-তোমার ধারনা তুমি তোমার ভেতরের সেই ক্ষমতাধর অস্তিত্বের সাক্ষাত পেয়ে গিয়েছো, তাকে চিনতে পেরেছো? সেই এখন তাহলে সবার সেবা প্রদান করছে?
–বিশ্বাস না হলে দারোয়ান চাচাকে জিজ্ঞাসা করে দেখো। আমি তার ব্যথা মুক্ত করেছি কিনা!
আকরাম সাহেব ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেলেন। তিনি কী বলে যে আকাশ পাতাল এক করে ছেলেকে ঝাড়ি দিবেন সেই সমুচিত বাক্য খুঁজে পেলেন না।
তিনি শুধু বললেন, তুমি কি জানো তুমি কত বড় একটা অপদার্থ? একটা শূন্য হিউম্যান সেন্সের মানুষ! তোমার বুদ্ধিবৃত্তির লেভেল পোনা মাছের থেকেও কম।তোমাকে নিজের ছেলে বলে ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে আমার। তুমি একটা গবেট। হাদারাম, তুমি যতো দ্রুত সম্ভব আমার সামনে থেকে বিদায় হও।
জাভেদ বললো, আজব, রাগারাগি করতেছো কেন? যেটা সত্য সেটাইতো বললাম!
-তুমি কী খেয়ে অনার্স পাশ করেছো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না! তুমি এখনো নিতান্ত শিশু। সত্য মিথ্যার প্রভেদ তোমার নিজের মাথায় নেওয়ার মতো সামর্থ্য এখনো হয়নি। রাবিশ একটা। এখন সামনের থেকে যাও। আর শোনো, যাওয়ার আগে সজীবের সাথে যোগাযোগের নাম্বারটা দিয়ে যাও।
-ওর নাম্বার দিয়ে কি করবে তুমি?
-প্রশ্ন করছ কেন আমাকে? যেটা করতে বলেছি সেইটা করো।
-ও কিন্তু এই ব্যাপারে কিছুই জানেনা বাবা !
–সে জানে কি জানে না তা আমি দেখবো, তোমাকে দিতে বলছি দিয়ে যাও।
জাভেদ সামনের টেবিলে রাখা প্যাডে সজীবের নাম্বার লিখে বিড়ালের বাচ্চা হাতে নিয়ে বাইরে চলে গেলো। তাকে দেখতে হবে তার শক্তি কাজে দিয়েছে কিনা। যদিও সে অনেকটা আশাবাদী। ব্যথা পেয়ে অজ্ঞান হওয়া বিড়াল এখন জ্ঞান ফিরে পেয়ে চারপাশ কাপিয়ে ডাকাডাকি করে চলেছে। তার মানে কিছুটা অবশ্যই কাজে দিয়েছে। এখন স্বাভাবিক ভাবে হাটাহাটি করতে পারছে কিনা সেইটা দেখতে হবে।
জাভেদ নিজের এপার্টমেন্ট এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে বিড়ালের বাচ্চাটার হাত পা খুলে দিলো। বাচ্চাটা সাথে সাথে এক লাফ দিয়ে তিন হাত দূরে গিয়ে বসে পড়লো। কিছুক্ষন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকলো জাভেদের দিকে। তারপর যেই জাভেদ আবার বাচ্চাটাকে ধরতে গেলো বাচ্চাটা এক বিকট ম্যাও ডাক দিয়েই ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে দৌড়াতে শুরু করে দিলো। তখনও সে ম্যাও ম্যাও করে চলেছে। খুব সম্ভবত এবার সে তার জাতের ভাই ব্রাদারদের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছে।
জাভেদ চিন্তিত ভংগিতে উঠে দাড়ালো। তার ঘন্টা ব্যাপি বিড়ালটার উপরে করা অকাল্ট চর্চা যে কোন কাজ করেনি তা বাচ্চাটার ল্যাংচানো দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তার বেশ মনে আছে এই বিদ্যা ইউনুস চাচার উপরে বেশ কাজ করেছিলো। চাচা নিজে বলে ছিলেন তিনি কোন ব্যথা বোধ করছেন না। তবে কি এই বিদ্যা শুধু মানুষের উপরে খাটে অন্য কোন প্রানীর উপরে না! এই আজব চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।
ইউনুস মিয়া গেইটের কাছ থেকে তার স্যারের ছেলের কার্যকলাপ দেখছিলো। এই ছেলে পাগল না কিন্তু মাঝে মধ্যে পাগলের মতো কাজ করে। সেদিন হাটতে গিয়ে বেকায়দা ভাবে পায়ে মোচড় খেয়েছিলো সে। ব্যথায় চোখ মুখ নীল করে পা হাতে নিয়ে বসেছিল। এই ছেলে জানার পর সে তার রুমে নিয়ে ঘর অন্ধকার করে এক ঘন্টা ধরে কি সব অদ্ভুত সব কাজ করলো। তারপর এক সময় জিজ্ঞাসা করলো, চাচা আপনার ব্যথা কমেছে?
ভ্যাপসা গরম আর ব্যথায় তার জান ওষ্ঠাগত হয়েছিল সেদিন কিন্তু ছেলেটা এতো আগ্রহ নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো যে সে না করতে পারেনি। সে শুধু মাথা নাড়িয়ে জাভেদকে খুশি করার জন্য বলেছিল,
জ্বি ছোট সাহেব। কমছে মানে, ব্যথা একদম নাই। আপনেতো জাদু জানেন!
শেষে দাতে দাত চেপে পায়ে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে সে রুমে এসেছিলো।
জাভেদকে হঠাৎ বিড়ালের বাচ্চা থেকে চোখ সরিয়ে ইউনুস তার নিজের দিকে তাকাতে দেখে সে দ্রুত গেইট টপকে বাইরে হাওয়া হয়ে গেলো। বলা যায় না ছোট সাহেব আবার তার সেবা কার্যক্রম চালু করে দিতে পারে তার উপরে।
এখন দুপুর বারোটা বাজে। সজীব তার বাসায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে থাকে মালিবাগের শান্তিবাগ এলাকায়। যদিও সেখানে শান্তির চেয়ে অশান্তিই বেশী। বাজার রোডের গলির শেষ মাথার এক এপার্টমেন্ট হাউজের টপ ফ্লোরে থাকে। তাদের এপার্টমেন্ট যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই শান্তিবাগের বস্তি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা সেখানে ঝগড়া চিৎকার চেচামেচি লেগেই থাকে। সকাল থেকে চক্রাক্রমিক হারে শব্দ বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তীব্র মাত্রায় বেড়ে গিয়ে রাতের দিকে সুনসান কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
গতকাল ভোর রাত পর্যন্ত সে শুয়ে বসে পশ্চিমবংগের নক্সাল আন্দোলন নিয়ে লেখা একটা বই পড়েছে। নক্সালবাড়ির বিভিন্ন ঘটনা পড়তে পড়তে বিদ্রোহী মন নিয়েই এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে।
ইতিমধ্যে সকাল থেকে অনেক বার তার মা তাকে ঢেকে গিয়েছে কিন্তু সে তার কুম্ভকর্ণ মার্কা ঘুমে অতিব্যস্ত হয়েই মরার মতো বিছানায় পরে আছে।
ঘুমের মধ্যেই সে শুনতে পেলো কোথায় যেনো থেকে থেকে প্রচন্ড গোলাগুলি হচ্ছে। তার মা তাকে ডাকছেন কিছু সময় পর পর। নক্সালবাড়ির বিদ্রোহ কি আবার শুরু হয়ে গেলো নাকি! মা কি অস্ত্র হাতে নেমে পড়েছে রাস্তায়! তাকেও গোলাগুলিতে যোগ দেওয়ার জন্য এতো ব্যাকুল হয়ে ডেকে চলেছেন!
সজীব অতল গহীন ঘুম থেকে নিজেকে জাগিয়ে তুলে চোখ খুলে দেখে তার মা রান্নার খুন্তি হাতে তার বিছানার পাশে অগ্নিমূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বালিশের পাশে রাখা মোবাইল থেকে, থেকে থেকে করা গুলির শব্দের রিংটোন বাজছে। সে মনে মনে ভাবলো ও, এই কাহিনী! দেশে তাহলে যুদ্ধ লাগেনি! তাহলে আবার ঘুমিয়ে পড়া যাক।
সে ঘুমানোর জন্য আবার উদ্যোগ নিতেই তার মা চেচিয়ে উঠলো,
নবাবের ঘুম ভাংছে! ঢেকে ঢেকে গলা ব্যথা হয়ে গেলো। আর এই হতচ্ছাড়া, কোন ভদ্র ঘরের ছেলে এ ধরনের রিংটোন লাগায় তার ফোনে? শুনলে মনে হয় কানের কাছে কেউ তোপ দাগাচ্ছে! এখনি চেইঞ্জ কর। আশেপাশের মানুষ কি বলবে!
সজীব বললো, তাদের যা ইচ্ছে হয় ভাবুক, বলুক। তাতে আমার কি? এমনিতেই নিচের থেকে মানুষের গলার যে সব শব্দ আসে তার থেকে গোলাগুলির শব্দ অনেক ভালো।
কথা বলতে বলতেই আবার মোবাইল বেজে উঠলো। সজীব ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে অপরিচিত নাম্বার। সে ফোন কেটে দিলো। সাইলেন্ট মুড অন করে মোবাইল বিছানায় রেখে জোরে সড়ে ঘুমানোর আয়োজন করতে বসলো। তা দেখে তার মা আবার বলে উঠলো,
কি রে আবার ঘুমাতে যাচ্ছিস? হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে পড়তে বস। এভাবে ঘুমালে কি চাকরি হবে এ জীবনে তোর? ফোন ধরলি না কেনো?
—অপরিচিত নাম্বার। এখন ধরতে ইচ্ছা করছে না। খাবার হয়ে গেছে? তাড়াতাড়ি তাহলে খেতে দাও।
–হাত মুখ ধুয়ে আয়। আর খাওয়ার পরেই আবার ঘুমাতে যাবি না কিন্তু। বিসিএস এর পড়া পরতে বসবি।
–হু ঠিক আছে। দেখা যাবে।
হাত মুখ ধুয়ে এসে সে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে তখনো মোবাইল নিভু নিভু আলোয় নিরবভাবে বেজে চলেছে। সে বিরক্ত হয়ে ফোন ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে বাজখাই গলায় কে যেনো বলে উঠলো,
এতোক্ষন লাগে ফোন ধরতে? মোবাইল ব্যবহার করো কেনো, অই বস্তু ফেলে দিলেইতো পারো!
–কে বলছেন? মোবাইল সাইলেন্ট মুডে ছিলো। খেয়াল করিনি।
—আমি জাভেদের বাবা বলছি! তুমি কোথায় এখন?
কর্নেলের পরিচয় পেয়ে সে থতমত খেয়ে গেলো। সজীব অবাক হয়ে ভাবলো আকরাম হোসেন ফোন দিয়েছেন কেনো তাকে! নিশ্চিত জাভেদ নিতুন কোন উৎপাত করেছে। নতুবা ফোন করে খোজ খবর নেওয়ার মতো মানুষ জাভেদের বাবা নন। সে বললো,
–গুড মর্নিং আংকেল! কেমন আছেন? আমিতো বাসায়!
–এখন বাজে প্রায় সারে বারোটা! সকাল কোথায় দেখছো! তুমি কি মাত্র ঘুম থেক উঠলে?
–না আংকেল কি যে বলেন! আমি সকালেই উঠেছি। তা আপনি হঠাৎ ফোন দিলেন আংকেল কোন সমস্যা!
–আমার অফিস চিনো তুমি?
–জ্বি আংকেল। গুলশানের এক নাম্বার সার্কেলে!
–বিকালের আগেই তুমি আমার সাথে দেখা করবে অতি জরুরিভিত্তিতে! কোন প্রকারের হাংকি পাংকি করবে না বুঝলে!
সজীব খুব ভালো বুঝতে পারছে কোথাও একটা বেশ একটা সমস্যা হয়েছে। কোন কারনে খুবই রেগে আছেন আকরাম সাহেব।
সে বললো,
আংকেল আমি এখনি রওনা দিচ্ছি।
অপর পাশ থেকে সাবেক কর্নেল ফোন কেটে দিলেন। সজীবের মনে হলো কাটার আগে দাত কিড়মিড় করে তিনি বললেন
–হ্যা আসো তুমি!
সে দ্রুত প্যান্ট শার্ট জুতা পরেই বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করলো। তার মা তাকে জিজ্ঞাসা করলো, কি রে এই ভর দুপুরে কোথায় যাচ্ছিস? খাবি না?
সে বললো, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ মা। আমি বাইরে খেয়ে নিবো।
এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সে ঝড়ের বেগে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।
সজীব বসে আছে গুলশানের এক বহুতল ভবনের এর টপ ফ্লোরে,এক বহুজাতিক কোম্পানীর আলিশান অফিসে আকরমা হোসেনের সামনে। তিনি সজীবকে বসতে বলে হাতের কাছে রাখা ফাইলে চাখ বুলাচ্ছেন। সজীব এর ফাকে ঘুরে ফিরে অফিস রুমটা দেখছে। এর আগেও সে অনেকবারই এখানে এসেছে তবে জাভেদের সাথে। এবারই প্রথম সে একা এসেছে। খুবই সুন্দর করে গোছানো একটা অফিস। দেয়ালে দেয়ালে নানা আকৃতি প্রকৃতির ছবি ঝুলছে। যেগুলো নিঃস্নদেহে দামী আর খুবই বিখ্যাত সব শিল্পীদের আকা। মেঝেতে নরম সবুজ কার্পেট, যেখানে পা রাখলে গোড়ালি পর্যন্ত দেবে যায়। মনে হয় কার্পেট না সবুজ ঘাসের উপর হাটা হচ্ছে। প্রকান্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার উপরে চার রং এর চারটা টেলিফোন। যেখানে আকরাম হোসেন বসেন তার পিছনের জানালার পর্দা সরালে সেখান থেকে গোটা গুলশান সার্কেলের একটা ওয়াইড এংগেল ভিউ দেখা যায়। জীবনে যদি কখনো সুযোগ হয় তবে এরকম একটা বিশাল জাক জমকপূর্ণ অফিস তার নিজেরও হবে এরকম ভাবনায় আকাশ পাতাল চিন্তা করতে বসলো সে।
পাইপ ধরিয়ে আকরাম সাহেব সজীবের দিকে ফিরলেন। সেই চিন্তায় এক রাশ ধোয়া ছেড়ে জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন,
লাঞ্চ করেছো?
–জ্বি আংকেল বাসা থেকে করে এসেছি।
–মিথ্যা কথা বলছো কেনো? তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি ঘুম থেকে উঠে এসেছো।
–ইয়ে মানে আংকেল। বাইরে থেকে চা নাস্তা করে এসেছি।
–তোমাকে আমি লাঞ্চের কথা জিজ্ঞাসা করেছি, নাস্তা পানির কথা না।
ইন্টারকমে দুই জনের লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে বললেন,
তা বাবা এখন একটু ঝেড়ে কাশোতো! কি কাহিনী করছো তোমরা?
সজীব বুঝলো তোমরা বলতে তিনি জাভেদ আর তাকে বুঝিয়েছেন। সমস্যা হলো জাভেদ এখন ঠিক কি নিয়ে আছে তা সজীব জানে না। আমতা আমতা করে বললো, আংকেল আমি জানি না ও কি নিয়ে আছে!
কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি সত্যিই জানো না ওর বর্তমান ঘটনা সম্পর্কে!
–সত্যি বলছি আংকেল আমি জানিনা। কেনো ও কি নতুন করে কিছু করেছে?
গভীর দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, কি করেনি তাই বলো! কি সব অকাল্ট বিদ্যা চর্চা করে চলেছে। প্রথমে বাড়ির দারোয়ানের উপর প্রয়োগ করেছে আর এখন অবলা প্রানীর হাত পা বেধে করা শুরু করেছে!
সজীব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ও কি করেছে আংকেল!
গত সন্ধ্যার ঘটনার বর্ননা দিয়ে তিনি বললেন, কে যে জাভেদের মাথায় এই ধারনা দিয়েছে তাকে পেলে হয়, জ্যান্ত পুতে ফেলবো।
ঘটনার বর্ননা শুনে সজীব চিন্তায় পড়ে গেলো। এই ধারনা যদিও সে জাভেদের মাথায় ঢুকায় নাই। কিন্তু এই ধারনা তার মাথায় ঢুকার পিছনে সেই মূলত দায়ী। সে মনে মনে অস্বস্তিবোধ করা শুরু করলো। ঠিক কিভাবে আকরাম সাহেবকে সে বুঝাবে তাই বুঝে উঠতে পারছে না।
লাঞ্চ চলে এসেছে। সাদা ভাত, পোলাও, খাসির রেজালা, ইলিশ মাছ, কয়েক প্রকারের ভাজি, সালাদ।
আকরাম সাহেব খেতে খেতে সম্পূর্ণ অন্য একটা প্রসংগ টানলেন, তোমার কি মনে হয় এ বছর কি বন্যা হবে?
হঠাৎ বন্যার প্রসংগ উঠায় সজীব অবাক হওয়ার সাথে সাথে কিছুটা যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো। সে বাইরে তাকিয়ে দেখলো বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। সে মনে মনে বললো, বৃষ্টি দেখে বন্যার কথা হচ্ছে তাহলে!
সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, আংকেল প্রতি বছরইতো বন্যা হয় তবে আপনি কোন ধরনের বন্যার কথা বলছেন বুঝলাম না!
–হুলস্থুল ধরনের বন্যা! ১৯৮৮ সালের বন্যা দেখেছো!
কিছুক্ষন থেমে চিন্তা করে আবার বললেন, আরে আমিও কি বলি! কিভাবে দেখবে, তখনতো তোমার জন্মই হয়নি।
খেতে খেতে আনমনে বলে চললেন ৮৭ আর ৮৮ পর পর দুই বছর খুবই ভয়াবহ ধরনের মারাত্নক বন্যা হয়েছিলো দেশে। ৮৭ তে দেশের প্রায় ৪০ ভাগ আর ৮৮ তে দেশের ৬০ ভাগের উপরে এলাকা প্লাবিত হয়েছিলো। প্রায় বিশ দিনের মতো গোটা দেশ পানির নিচে ডুব মেরে ছিলো।
তিনি আবার হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ১৯৯৮ সালে কতো বয়স ছিলো তোমার?
সজীব বললো, ছয় বছর। আংকেল তখন বোধ হয় ক্লাস ওয়ানে পড়ি।
–তাহলেতো সেই স্মৃতিও তোমার মাথায় নেই। অই বন্যায় দেশের প্রায় ৭৫ ভাগ অঞ্চল ৬০ দিনের মতো ডুবেছিলো। তার পরের বছরও ১৯৯৯ সালে ৬৫ দিনের জন্য ডুবিয়ে রেখেছিলো বন্যার পানি।
কিছু না বলে সজীব নীরবে আকরাম সাহেবের বন্যা কথন শুনে যেতে লাগলো।
–বুঝলে সজীব, প্রকৃতির একট প্যাটার্ন আছে। ব্যাপক বন্যা প্রতি সাত বছরে একবার আর প্রলয়ংকরী বন্যা প্রতি ৩০ থেকে ৫০ বছরে একবার এই জনপদে হানা দেয়।
সজীবের বলতে ইচ্ছা করছিলো, আংকেল বন্যা হতে বেশী কিছু লাগে না। প্রচুর বৃষ্টিপাত আর উজানের পাহাড়ি ঢলই যথেষ্ট। পাহাড়ি ঢলের সময় উজান বেয়ে এক ব্রক্ষ্মপুত্র নদ দিয়ে যে পরিমান পানি ঢুকে তা দিয়ে গোটা এ বাংলার ভাটি অঞ্চল কয়েকবার ভাসানো যাবে। তার সাথে তিস্তা আর পদ্মার পানিতো আছেই। পশ্চিমবংগের গংগায় পানির পরিমান বেড়ে গেলেই দাদারা ফারাক্কা খুলে ভাসিয়ে দেন আর সাথে গৃহ যুদ্ধের মতো প্রচুর বৃষ্টিপাতের সময় গৃহ নদী মেঘনার বাড়াবাড়িতো আছেই। কিন্তু এ সব না বলে সে শুধু বললো,
আংকেল সে সময়তো ঢাকাও ডুবে গিয়েছিলো তাই না।
–হ্যা তাতো ডুববেই। কয়েক সপ্তাহ নৌকায় করে চলা ফেরা করতে হয়েছে ঢাকার অনেক এলাকার মানুষকে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আকরাম সাহেব কফির অর্ডার দিলেন। পাইপটা আবার ধরিয়ে টানতে থাকলেন। চুপচাপ সময় পার হতে লাগলো। কিছু সময় পরে কফি নিয়ে এলো অফিস বয়। কফিতে চুমুক দিয়েছে সজীব এমন সময় আকরাম সাহেব আচমকা বলে বসলেন,
আমার বিশ্বাস জাভেদের এই কর্মকান্ডের পিছনে তোমার হাত আছে। তাই না?
কিছুটা চমকে গিয়ে কাপের কফি সে দামী কার্পেটে ফেলে দিলো। এই চমকানোটা আকরাম সাহেবের দৃষ্টি এড়ালো না।
আমতা আমতা করে সজীব বললো, না মানে আসলে আংকেল আমার কোন হাত নেই। তবে ও কোথা থেকে আইডিয়া পেয়েছ তা হয়তো জানি।
–আম জানতাম! এ তুমি ছাড়া অন্য কেউ না। তা এই অপদার্থ আইডিয়া কোথা থেকে পেলে তোমরা?
–আংকেল রোহিংগা শরনার্থী শিবির থেকে।
–কোথা থেকে?
–কুতুপালং এর রোহিংগা রিফিউজি ক্যাম্প থেকে!
–এখানে আবার রোহিংগা এলো কোথা থেকে?
–আংকেল সেনাবাহিনীর আক্রমনের পর দলে দলে যখন রাখাইনরা এদেশে আসতে থাকলো.....
–অই ঘটনা আমি জানি। কিভাবে এর সাথে তোমরা পরিচিত হলে সেটা বলো।
–আমি ত্রান কর্মসূচির সাথে যুক্ত ছিলাম আংকেল। প্রতি সপ্তাহে একবার ঢাকা থেকে ত্রানের সাহায্য নিয়ে টেকনাফে যেতাম। এরকমই একবার আমার সাথে গিয়েছিলো জাভেদ স্বেচ্ছাসেবী হয়ে। তখনই কিছু মানুষের সাথে পরিচয় ঘটেছিলো আমাদের। যারা এই বিদ্যাটা চর্চা করেন।
–কি সব রাবিশ কথা বলো তুমি? আমাকে কি জাভেদ পেয়েছো?
একটা গভীর শ্বাস নিয়ে সকল দ্বিধা ঝেড়ে সজীব জিজ্ঞাসা করলো,
আংকেল আপনি রেইকি সম্পর্কে কতোটা জানেন?
–এটা কি?
–চাইনিজ নাম। এক প্রকারের অল্টারনেটিভ মেডিসিন।
মিকাও উসুই নামে জাপানিজ বুদ্ধ ১৯২২ সালে এর প্রভূত উন্নতি ঘটান বলে জানা যায়। তিনি তার মঠে এর প্র্যাক্টিস করতেন।
–তা দিয়ে আমি কি করবো? তার সাথে জাভেদের এই ঘটনার কি সম্পর্ক? আর তুমি যে অল্টারনেটিভ মেডিসিনের কথা বললে তাতো আর সায়েন্টিফিক কোন ওষুধ না।
–জ্বি আংকেল ঠিক ধরেছেন। এটা সুডোসায়েন্স এর বিষয়। এক প্রকারের থেরাপি টাইপ।
–তোমার কি মনে হচ্ছে আমার অথবা জাভেদের থেরাপির দরকার?
–না তা না আংকেল। আসলে বলতে চাচ্ছিলাম এর যে শক্তি তা হাতের তালু থেকে বের হয়।
–কি সব আজগুবি কথা বলো?
–আংকেল আপনি চি অথবা কি এর ব্যাপারে কিছু জানেন?
–না।
–আংকেল এটাও এক প্রকারের এনার্জি। মহাজাগতিক জীবনী শক্তি। রেইকি এর সাথে সম্পর্ক যুক্ত। যারা রেইকি চর্চা করে তারা বিশ্বাস করেন যে এই ইউনিভারসাল শক্তি তারা তাদের হাতের তালু থেকে বের করতে পারেন।
–তোমার বিজ্ঞান কি বলছে এই বিষয়ে?
–আংকেল বিজ্ঞানীরা যুক্তি আর প্রমানে বিশ্বাস করেন। তারা একে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। এর কোন ভিত্তি নেই বলছেন। আমেরিকানরাতো দুই চোক্ষে দেখতে পারে না এই বিষয়টা।
–তাহলে আমার সাথে এসব ভিত্তিহীন বিষয় নিয়ে কথা বলছো কেনো?
–কারন আংকেল আমি আর জাভেদ একটা দলের খোজ পেয়েছি যারা রেইকি প্র্যাক্টিস করে এবং যারা এখন আমাদের দেশেই অবস্থান করছেন। তারা এই ঘটনা চোখের সামনে ঘটাতে পারবে।
–কি বলছো তুমি? বুঝে কথা বলছো? এটা কত বড় একটা খবর হবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তার কোন ধারনা আছে তোমার? সায়েন্টিফিক ওয়ার্ল্ড এ টর্ণেডো হবে।
–সমস্যাটা আংকেল এই জায়গাতেই। যারা এটা চর্চা করেন তারা খবর হতে চান না। তাদের এটা এক প্রকারের অলিখিত নিয়ম।
–কোথায় আছেন তারা? দেখা করা যাবে কিভাবে? তাদেরকে ঢাকায় আনা যায় না?
–এখানে আংকেল আরো গোলমেলে ব্যাপার আছে। একটু আইনের উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের সাথে কথা বলতে হবে আপনার।
–কেন? তারা কি চোর বাটপার নাকি জেলখানার কয়েদী?
–কয়েদীই বলতে পারেন এক প্রকার।
আংকেল এদের আসল পরিচয় যাই হোক বর্তমানে এরা রোহিংা এবং আমাদের দেশের শরণার্থী শিবিরে আছে।
–মানে কি? কিছু রোহিংা কিভাবে রেইকি প্র্যাক্টিশনার হয়? তুমিইনা বললে এক জাপানিজের কথা!
–আংকেল আসলে তারা চাইনিজ মংক।তিব্বতে থাকেন। চিন আর মায়ানমার পাশাপাশি। মিয়ানমারে প্রতি বছর বুদ্ধদের অনেক বড় এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। তাতে যোগ দিতেই তারা চিন থেকে মায়ানমারে আসেন। আরাকান রাজ্যের এক মঠে তারা ছিলেন। হঠাত করে রোহিংা উচ্ছেদের কাহিনীতে তারা জড়িয়ে পড়েন। রোহিংাদের সাহায্য করতেই তারা তাদের সাথে বাংলাদেশে চলে আসেন। আর এসেই আটকা পড়েছেন।
–তুমি এতো তথ্য জানলে কিভাবে?
–আংকেল কিছুক্ষন আগেইতো বললাম রোহিংগাদের সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন ত্রনের সাথে কয়েক দফাই আমার সেখানে যাওয়া পড়েছে। আমাদের গ্রুপ যখন ত্রান বিতরন করছিলো তখন পাশেই কিছু রোহিঙ্গাদের দেখেছিলাম তারা ত্রাণ না নিয়ে তাদের ত্রাণও দান করছে। পরে প্রসংগে জানতে পারি তারা বৌদ্ধ ভিক্ষুক। আর মজার ব্যাপার তারা একটা অপ্রচলিত পদ্ধতিতে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিলো রোহিংাদের। যারা মানসিক এবং শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ তাদের এক অদ্ভুত উপায়ে সুস্থ করছেন তারা। যদিও কিছুটা সময় সাপেক্ষ তবু তারা সুস্থ হয়ে যাচ্ছিলো। বিষয়টাকে প্রথমে আকুপাংচার এর উন্নত কোন সংস্করন বলে ধারনা করছিলাম।
আকুপাংচার সম্পরকে জানেন তো স্যার?
–তুমি অপ্রয়োজনীয় কথা বেশী বলো। আমি জানি আকুপাংচার কি জিনিস। আগাছা বাদ দিয়ে মূল ঘটনা বলো।
–কিন্তু আংকেল এরা স্পর্শ না করেই ব্যথা উপশম করছে। তাই তাদেরকে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে এলে এক পৌড় ভিক্ষুক শুধু বলেছিলেন “উই আর রেইকি প্র্যাক্টিশনারস”।
–আংকেল বিষয়টা প্রথমে আমার মাথায় ঢুকেনি। আর তখন অনেক ব্যস্তও ছিলাম। বেশিক্ষন এক ক্যাম্পে থাকা যাচ্ছিলো না। বিজিবি পুলিশ এসে তাগাদা দিচ্ছিলো বারবার।
পরে যখন কক্সবাজার এসে হোটেলে উঠি রাতে ঘুমাতে যাবার সময় ব্যাপারটা মাথায় নাড়া দিয়ে উঠলো।
বন্ধু বান্ধব সিনিয়রদের জিজ্ঞাসা করলাম। কেউ কিছু বলতে পারলো না। আর আমার, জাভেদ, কারো মোবাইলেই চার্জ ছিলোনা।
ঢাকায় বাসায় এসেই গুগল করলাম। জাভেদকে জানালাম তারপর থেকেই বোধ হয় আংকেল এই অবস্থা। ও যে এই ব্যাপারটা তারপর থেকে প্র্যাক্টিস করে যাচ্ছে তা আমি জানতাম না আংকেল।
–তুমি বলতে চাচ্ছো অই ঘটনার পর থেকেই জাভেদ এই চি না রেইকি প্র্যাকটিস করে যাচ্ছে?
–সহজবোধ্য ব্যাখ্যা আপাতত এই একটাই আছে আংকেল।
আকরাম সাহেব গভীর চিন্তিত ভংগীতে পাইপ টেনে চলেছেন। তার গভীর চিন্তায় বাধা না দিয়ে সজীব বাইরে তাকালো। তখনও ঝুম বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। শেষ কবে গুরুতর বন্যা হয়েছিল দেশে তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। অনেক দিন হলো গ্রামে যাওয়া হয় না। দেশের প্রকৃতির মাথা আউলা হয়ে গেছে। এখন বন্যা এক যোগে দেশের সব জায়গায় হামলে পড়ে না। বেছে বেছে একেক অঞ্চলে বন্যা হয়। কোথাও বাধ ভাংগে কোথাও পানি বিপদসীমার উপরে চলে যায়। সজীব আশ্চর্য হলো এই ভেবে যে তার আসলেই মনে পড়ছেনা শেষ কবে সে ভয়াবহ বন্যার খবর শুনেছে। কিন্তু প্রতি বছরই দেশের কোথাও না কোথাও মারাত্নক বন্যা হয়। তার মনে আরেকটা প্রশ্ন খেলা করছে কিন্তু আকরাম সাহেবের দিজে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারছে না। প্রশ্নটা হলো দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টি শেষ কবে হয়েছিলো?
একসময় আকরাম সাহেবের পাইপের তামাক শেষ হয়ে গেলে। তিনি আবার রিফিল করে তামাকে আগুন ধরানোর চেষ্টা করলেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন যে তিনি ভয়াবহ সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। ছেলে আগে ছেলেমানুষি ধরনের পাগলামি করতো। কিছুদিন করে ছেড়ে আবার নতুন কিছু নিয়ে শুরু করতো। তার সারা জীবন আর্মির কড়া অনুশাসন আর ডিসিপ্লিনের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছেন। পাগলামির কোন প্রকারের সুযোগ সেখানে ছিলো না। তাই হয়তো ছেলের মধ্যকার এইসব উদ্ভট কার্যকলাপ দেখে তিনি মেনে নিতেন নীরবে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ ।প্রায় দুই বছর যাবত জাভেদ যে শুধু এই রেইকির পিছনে পড়ে আছে তাই না এই ব্যাপারে সে চরম গোপনীয়তার সাথে সে চর্চাও করেছে। আর বাসার কেউই জানে না। জানলে অবশ্যই তিনি জানতেন। এতোদিন মনে করতেন তিনি তার ছেলের নাড়ি নক্ষত্র জানেন। তিনি।নিশ্চিত এই বুজরুকি জাদু তার ছেলের মাথায় গেথে গিয়েছে ভালো ভাবে। সামনে বসা ছেলেটা নিজেও বোধ হয় জানে না সে কিসের মধ্যে জাভেদকে টেনে নিয়ে গিয়েছে। অবশ্য তাকেও দোষারোপ করা যাচ্ছে না। সে সাহায্য করতে গিয়েছিলো। কিন্তু কাধে করে বিপদ নিয়ে এসেছে। নিজে ঝেড়ে ফেলে দিলেও তার ছেলে ফেলে দেয়নি। এখন এক ভাবেই এর নিষ্পত্তি সম্ভব আর তা হলো ছেলেকে স্বচোক্ষে দেখানো যে এই রেইকি ফেইকি সম্পূর্ণ একটা বুজরুকি, মানুষ ঠকানো ধান্দা। এর সাথে সেবার কোন প্রকারের সম্পর্ক নেই। তার আগে তাকে এই বুজরুকি হাতে নাতে ধরতে হবে। অই বাটপারগুলো এখনো আছে কিনা তা আল্লাহই জানেন। তিনি সজীবের দিকে ফিরে দেখেন সে জানলা দিয়ে তাকিয়ে মুগ্ধ চোখে বাইরের বৃষ্টি দেখছে। গলা খাকাড়ি দিয়ে আকরাম সাহেব বললেন,
শেষ কবে তুমি রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়েছো?
–গত বছর গিয়েছিলাম। তাও প্রায় এক বছরের উপরে হয়ে গিয়েছে। কেনো আংকেল?
–অই ভিক্ষুকেরা কি তখনো ছিলেন?
–থাকতে পারে আংকেল। আমি খোজ খবর করেছিলাম কিন্তু কেউ কোন তথ্য দিতে পারেনি। বোধ হয় চলে গিয়েছেন!
–কেনো, রোহিংগা সমস্যারতো সমাধান হয়নি এখনো। এতো দ্রুতই কি চলে যাবে তারা?
–আমার জানা নেই আংকেল। আপনি কি তাদের সাথে দেখা করতে চান?
–তোমার কেনো মনে হচ্ছে আমি তাদের সাথে দেখা করতে চাই?
–আমি জানি আপনার পদার্থর আইনের বাইরে কোন ঘটনা ঘটলে সেই ঘটনার প্রতি ঝোক অনেক বেশি। আর এক্ষেত্রেতো আংকেল এটা কোন এম্পিরিক্যাল ল ই মানছে না।
আকরাম সাহেব আনমনে বললেন,তোমার অই ভিক্ষুকেরা কি ঘটা করে অন্যকে দেখাবে এই ব্যাপারটা? কোন সমস্যা হবে না?
–আংকেল এটাতো জন সম্মুখেই ঘটছে। শুধু জনতা জানেনা এর বিশেষ দিক সম্পরকে। তাদের সমস্যা শুধু এক জায়গায়। তারা এই বিষয়ে কোন নিউজ হতে চায় না। আর তাছাড়া অই জায়গারতো এখন স্যার নরক গুলজার অবস্থা। আমাদের উপস্থিতি কোন সমস্যার সৃষ্টি হবে না। এখন আপনি কি যেতে চান?
–তারা সেখানে এখনো আছে কিনা সে বিষয়েতো তুমি শিওর না তাই না!
–আংকেল আপনিতো আর্মিতে ছিলেন। টেকনাফের আর্মি ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ করলে তারাই জানাতে পারবে আমার মনে হয়। সাধারন জনগন যা না জানে তাই আর্মি জেনে বসে থাকে। তাদের কাছে নিশ্চিত এর একটা তথ্য আছে।
–এই ব্যাপারটা আমার মাথায় আগেই এসেছে। আমি আসলে চাচ্ছিনা তাদের কোন সাহায্য নিতে। এই সব রাবিশ বিষয়ে জানতে চাওয়াটা খুবই হাস্যকর হবে আমার মতো মানুষের জন্য।
–তাহলে সেখানকার পুলিশবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করলে হয়তো একটা ব্যবস্থা হবে আংকেল।
–তাহলে চলো। আমরা লেইট করছি কেনো? কাল সকালের দিকে রওনা দেওয়া যাক। আর উপর নিচের যার যার সাথে যোগাযোগ করতে হবে তা পথেই করে নেয়া যাবে।
এমন সময় সজীব হঠাত ভিন্ন একটা প্রশ্ন করে বসলো, আচ্ছা আংকেল আপনার দেখা সর্বোচ্চ বৃষ্টি কবে হয়েছিল দেশে?
আকরাম সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন, বন্যার সময় গুলোতেইতো প্রচুর বৃষ্টি হয়। কেনো?
–না আংকেল বাইরে সেই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তা থামার কোন নাম গন্ধ নেই। তাই জানতে চাচ্ছিলাম। বাইরে ঢাকার রাস্তায় নিশ্চিত সমুদ্র তৈরি হয়ে গিয়েছে।
–আচ্ছা। রাস্তায় পানি নিয়ে কথা বলায় একটা কথা মনে হলো। একবার একনাগাড়ে ৫২ ঘন্টা টান বৃষ্টি হয়েছিল। গোটা ঢাকা শহর ১২ ঘন্টা কোমড় সমান পানিতে নিমজ্জিত ছিলো।
–কবে আংকেল? ৮৮ না ৯৮ তে?
–১৯৬৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর।
পরদিন সজীব আর আকরাম সাহেব যখন টেকনাফ পৌছালো তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সকাল সকালই তারা যাত্রা শুরু করেছিলো। কিন্তু রাস্তায় দুই দুই বার আকরাম হোসেনের সাধের প্রাডো গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে যাওয়ায় এতো দেরী হয়ে গিয়েছে। আকরাম হোসেনের তথ্য অনুযায়ী ভিক্ষুকদের থাকার কথা ছিলো নয়াপাড়া রিফিউজি ক্যাম্পে কিন্তু সেখানে গিয়ে জানা গেলো তারা বর্তমানে কুতুপালং এ আছেন। কাগজপত্রের ঝামেলা মিটিয়ে তারা শরণার্থী শিবিরে প্রবেশ করলো। সাথে এক জন পুলিশ ইন্সপেক্টর। সেই একটা নির্দিষ্ট ছাপড়া চিনিয়ে দিলো তাদের। আকরাম সাহেব বুঝতে পারলেন যে ভিক্ষুকেরা বেশ পরিচিত এই এলাকায়। তারা দেখলো ভিতরে তখনো চিকিৎসা চালু আছে। চিকিৎসা না বলে রেইকি বলা ভালো। তিন জন ভিক্ষুক তাদের সামনে থাকা তিন জন রোগীর শরীরের উপর দিয়ে তাদের দুই হাতের তালু স্থির করে ক্রমাগত ধীরে ধীরে উপর থেকে নিচে করছেন। যেনো কোন কিছুকে প্রবল শক্তিতে বাধা দান করছেন।
যেমনটা গত পরশু সন্ধ্যায় দেখেছিলেন তার ছেলেকে করতে।
তাদের প্রত্যেকের মুখে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। এটা যে একটা কষ্ট সাধ্য প্রক্রিয়া তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। মিনিট পাচ এর পর এক অজ্ঞান ব্যক্তি নড়ে উঠলো। তার আরো কিছুক্ষন পর ব্যথায় ম ৃদু কাতরাতে থাকা দুই জনের গোংগানি আস্তে আস্তে থেমে গেলো।
আকরাম সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ঘটনা কি হলো?
সজীব বললো, বোধ হয় এদের ভিতরে মহাজাগতিক শক্তি ট্রান্সফার করেছেন তারা হাতের তালুর মধ্য দিয়ে।
আকরাম সাহেবের মনে হলো। এরা নিশ্চিত তাদের আশার খবর পেয়ে গিয়েছে আগে থেকে। খুব সম্ভব নয়াপাড়া থেকেই তাদের কোন রেইকি সংগী তাদের জানিয়েছে।এখন চোখের সামনে যেটা হলো তা হলো পূর্ব নির্ধারিত এক নাটকের মঞ্চায়ন। কিন্তু কিছু না বলে তিনি চুপচাপ শুধু দেখে যেতে লাগলেন।
চিকিৎসা শেষে উঠে এলেন সেই বয়স্ক ভিক্ষুক যার সাথে সজীবের কথা হয়েছিলো কয়েক বছর আগে। এমন ঘটনার সাক্ষী আগে সে হয়নি। তাই ভিক্ষুকের চেহারা তার মেমোরিতে বেশ ভালো ভাবেই গাথা হয়েছিলো।
সজীব ইংরেজীতে পরিচয় করিয়ে দিলো, ইনি আমার আংকেল। ঢাকায় থাকেন।
ভিক্ষুক নমস্কার করে বললেন, আমি মোরি কুঠান।
সজীব বললো, আংকেল আপনাদের এই রেইকি ব্যাপারে জানতে এবং দেখতে আগ্রহী । আপনি যদি কষ্ট করে আমাদের ব্যাপারটা বলতেন আমরা খুব উপকৃত হতাম।
কুঠান বেশি কিছু না বলে শুধু সংক্্ষেপে বললেন, এই জ্ঞান অনেক চর্চার ফসল। আমি দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে এর প্র্যাক্টিস করছি। আমার বয়েস যখন পনেরো তখন আমি এর প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করি আমাদের মাস্টারের কাছ থেকে। আমাদের গ্রুপের প্রত্যকেই বিভিন্ন গুরুর সান্নিধ্ থেকে এই জ্ঞান প্রাপ্ত করেছেন। সর্ব কনিষ্ঠ যিনি আছেন তিনি পনেরো বছর ধরে এর সাধনা করছেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর প্রয়োগিক শক্তিও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আকরাম সাহেব কিছুটা দ্বিধান্নত গলায় বাংলায় মৃদু স্বরে বললেন, প্রয়োগের নমুনাই কি মাত্র দেখলাম?
ভিক্ষুক বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, সরি কিছু বললেন?
সজীব বললো, না আংকেল বলতে চাচ্ছেন এবস্ট্রাক্ট কিছুতে এই শক্তির প্রয়োগ আপনি দেখাতে পারবেন কিনা।
–উনি বোধ হয় কিছুটা অবিশ্বাসী ধরনের। আমাদের মঠে মাঝে মধ্যে দু এক জন এরকম আসেন। কিন্তু আমরাতো তাদের বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার জন্য এই রীতিটা প্র্যাক্টিস করি না। এটা আমাদের বিশ্বাস এবং প্রকৃত জ্ঞান চর্চার সৃষ্টি।
যদিও ভিক্ষুকের কথা বলার ভংগী দেখেই বেশ ভালো বোঝা যাচ্ছে তাদের উপস্থিতিতে তিনি বেশ কিছুটা বিরক্ত হয়েছেন কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করছেন না।
শুধু বললেন, আমাদের হাতে সময় কম। অনেকের চিকিৎসা এখনো বাকি। আপনারা এখন আসুন।
সজীব আর আকরাম সাহেব বুঝলো বেশি কিছু বলতে চাইছেন না ভিক্ষুক। তাই অল্প কিছু বলেই তাদের দ্রুত তাড়াতে চাইছেন।
সজীব মনে মনে ভাবলো তাদের এতো দূর কষ্ট করে আসাটাই না পন্ড হয়ে যায়। তার কারনেই আজকের এই বিদঘুটে পরিস্থিতি। না সে ত্রান কর্মসূচিতে জাভেদকে নিয়ে আসতো। আর না এরকম ঘটনার আবর্তন ঘটতো। এখন অতিপ্রাকৃত কিছু না হলে তার মান সম্মানে টান পড়বে। এমনিতে যদিও আংকেল তাকে স্নেহের চোখে দেখেন তারপরও তীব্র বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।
সজীব বললো, আমাদের একটু সময় দিন প্লিজ। আপনাদের এই শক্তি চাক্ষুস করার জন্য অনেক দূর থেকে আসছি। আমি আপনাদের এই রেইকি সম্পর্কে একটু গবেষনা করেও এসেছি।
সে বলে চললো, ইউটিউবে একটা ভিডিওতে দেখা গেলো একজন মংক রেইকি ব্যবহার করে আগুন জ্বালাচ্ছেন খড়ের স্তূপে কোন প্রকারের বারুদের সাহায্য ছাড়াই। অবশ্য এটা একটা বানানো ভিডিও হতে পারে। তবে একটা ব্যাপার ক্যাথলিক চার্চ আপনাদের এই প্র্যাক্টিসকে মোটেই পাত্তা দেয় না। মূলত পশ্চিমা বিশ্ব এই জ্ঞানকে ভিত্তিহীন প্রলাপ বলে থাকে। আর তাছাড়া একশ ডলার খরচ করলেই একজন রিকি মাস্টার এর সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছে মাত্র দুই সপ্তাহে অনলাইনে। সেখানে আপনি বলছেন প্রকৃত রেইকি মাস্টার হতে সময় লাগে অনেক।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে শেষ করলো সজীব। আকরাম হোসেন এবং ভিক্ষুক দুইজনই অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। আকরাম সাহেব বেশ চমত্কৃত হলেন এরকম জার্নালিস্ট এপ্রোচে। কাল রাতেই খুব সম্ভব সজীব নতুন করে একবার রিসার্চ চালিয়েছে রেইকির উপরে। কিন্তু আকরাম সাহেব প্রশংসাসূচক কিছু বলার আগেই ভিক্ষুক প্রথমে কথা বলে উঠলেন।
–তুমিতো দেখছি সম্পূর্ণ ইতিহাস মুখস্থ করে এসেছো বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা তোমরা কিছুক্ষন বসো আমি আসছি। এই বলে তিনি বাইরে চলে গেলেন।
নিচের মাটিতে বিছানো পাটিতে আসনে বসার পর আকরাম সাহেব বললেন, এত সব তথ্যতো তুমি আমাকে অফিসে থাকতে দেওনি। এমনকি এতো রাস্তায় আসতে আসতেও দাওনি। আর কি কি রেখেছো মাথার ভিতরে তুমি? দ্রুত বলে ফেলোতো!
সজীব বললো, স্যার আমেরিকান আর ইংরেজদের মতে এই রেইকি হলো ফ্রড লেভেলের এক প্র্যাক্টিস। তাদের মতে মেডিক্যাল বিজ্ঞানে এর কোন অবস্থান নাই। আবার জাপান, চিন, ভিয়েতনাম, কোরিয়াতে রেইকি কে ডিভাইন পাওয়ারের সাথে তুলনা করে। আসলে রেই আর কি দুইটা শব্দ এক হয়ে অর্থবোধক হয়েছে। রেই অর্থ আত্না আর কি মানে ভাইটাল শক্তি। অর্থাত্ নিজের অন্তঃস্থ শক্তি।
আকরাম সাহেব ভাবলেন, তাহলে তিনি ঠিকই চিন্তা করেছিলেন। এরা চূড়ান্ত পর্যায়ের ফ্রড। এখানে রোহিংগাদের মাঝে বুজরুকি দেখিয়ে ব্যবসা অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্যেই এসেছে এই ভিক্ষুকেরা।
কথার মাঝেই ভিক্ষুক চলে এলেন। এসেই ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। বললেন,দুঃখিত অপেক্ষা করানোর জন্য। তা যা বলছিলাম, রেইকি হচ্ছে সম্পূর্ণ বিশ্বাস। আমরা বিশ্বাস করি এর দ্বারা রোগের উপশম সম্ভব। যার বিশ্বাস যতো দৃড় তার অন্তঃস্থ শক্তি ততোটা প্রচন্ড। রেইকিকে ধ্বংসাত্নক কাজে ব্যবহার করা যায় না। যে চেষ্টা করে সে নিজে ধ্বংস হয়ে যায়। মনের মধ্যে ধ্বংসের ইচ্ছা পোষন করে মহাজাগতিক শক্তিতে প্রগাড় বিশ্বাস রাখা যায় না। অনেকে একে জাদু বিদ্যা বলে, ম্যাজিক বলে অপমান করে।
এই বলে পাশে রাখা কুপির আলো ফু দিয়ে নিভিয়ে দিলেন এবং তুড়ি দিয়ে আবার জ্বালিয়ে দিলেন।
এই ঘটনায় আকরাম সাহেব মারাত্নক স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না তার সামনেই মাত্র কি ঘটে গেলো!
ভিক্ষুক স্বাভাবিক গলায় বল চললেন ,বুজরুকি করতে আমরা জীবনের ঝুকি নিয়ে রোহিংাদের সাথে থাকছি না। আমাদের সম্প্রদায় রাজনৈতিক কারনে রোহিংগাদের উপর যে অত্যাচার করেছে তাতে আমরা রেইকি প্র্যাক্টিশনারসরা খুবই ব্যথিত। আর তাছাড়া আমরা মিয়ানমারের লোকও নই। আমরা এসেছি চিনের তিব্বত থেকে রোহিংাগাদের সাহায্যার্থে আপনাদের দেশে প্রবেশ করেছি। কাজ শেষে আমরা আবার চলে যাবো। সীমান্ত আমাদের বাধা দিয়ে রাখতে পারেনি আর পারবেও না।
©somewhere in net ltd.