![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষ হতে চেয়ে কি যে হচ্ছি তা নিজেও জানিনা
নাম নাইমুর রহমান নাঈম। বয়স ২৯। লম্বায় প্রায় পাচ ফুট দশ ইঞ্চি। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। দেশের বাড়ি বরিশালে। থাকে মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটিতে। ইংরেজীতে ব্ল্যাক ডায়মন্ড বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। আক্ষরিক অর্থেই নাঈম সেই ক্যাটাগরির। শুধু ধার দেওয়ার মানুষের অভাবে ঝলমল করতে পারছে না। তার বাবা একজন নেশানাল লেভেলের সাবেক বক্সার। তাই বোধ হয় তারও রক্তটা একটু বেশিই গরম। খুব সহজে রেগে যাওয়া তার একটা বদভ্যাস ছিল কিন্তু নানান রকমের যোগ বিয়োগ করে তা নিজের কন্ট্রোলে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে নিরন্তর। খুব ভালো একজন গীটারিস্ট। বিশ্ববিখ্যাত গিটারিস্ট স্টিভ ভাই এর এক অন্ধ ভক্ত। একরোখা, জেদি। নিজের মতামতের উপর তার আশা ভরসা মাত্রারিক্ত বেশি। যা মাঝে মাঝে তার জীবনে সমস্যার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
নাঈমকে আজ যেতে হবে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে। লাঞ্চের আগেই ব্যাংকে যেতে হবে তাকে কারন বিকালে তার ভার্সিটিতে একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান আছে। এখন ঠিক দুপুর বারোটা বাজে।
বাইরে লু হাওয়া বইছে। কয়েকদিন হলো মারাত্নক গরম পড়েছে তার রাজধানীতে। মেইন স্ট্রিম নিউজ বলছে আরোও কিছুদিন এই তীব্র দাবদাহ সহ্য করতে হবে গোটা বাংলাদেশকে।
নাঈমের কাছে মনে হচ্ছে কিসের কি? গোটা ঢাকা শহরের নিচে কেউ যেনো স্রেফ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। রাস্তা ঘাট বাড়ি ঘর সমস্ত কিছু থেকে সিদ্ধ হাওয়ার মতো গরম ভাপ বের হচ্ছে। যেনো উত্তপ্ত তাওয়ার উপরে স্রষ্টা রুটি না ভেজে মানুষকে ভাজছে।
সে চিন্তা করছে এখনি বাইরে গরমের এই রূপ, বেলা দেড়টা দুইটার দিকে কি অবস্থা হয়ে যেতে পারে গোটা শহরের! সব কিছু কি মোমের মতো গলতে শুরু করে দিবে? রাস্তার পিচ গলে যাবে? তার ছোট বোন নিতু অবশ্য তাকে অনেক আগেই সকাল সকাল বের হতে বলেছিলো। কিন্তু নিজের বিখ্যাত আলসেমির জন্য সে এতোক্ষন পাদেমকং না গচ্ছামি হয়ে ঘরে বসেছিলো। মাত্রই বাবার দোউরানি খেয়ে বাইরে বের হতে বাধ্য হচ্ছে। আর যাবার সময়ই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বোনের কথা না শোনার ফল।
এই রোদে পুড়ে বাইক চালিয়ে শ্যামলী যাওয়ার কথা চিন্তা করতেই মাথা চক্কর দেওয়া শুরু করলো নাঈমের। যদিও বাসা থেকে বেশি দূরে না ব্যাংক। হেলমেট পড়ে বের হবে নাকি রেখে বের হবে তা নিয়ে কিছুক্ষন চিন্তা ভাবনা করলো সে। হেলমেট ছাড়া বের হলেই সামনের মোড়ে থাকা হারামী ট্রাফিকটা নিশ্চিত তার চালান কাটবে। তার সাথে ট্রাফিক পুলিশের কি সমস্যা তা সে জানে না। কিন্তু বেছে বেছে তাকেই কেনো যেনো ধরে সবাই।
আবার আজ হেলমেট পড়লে আর দেখতে হবে না। কাধ থেকে মাথাটা গরমে যাস্ট স্যান্ডউইচ হয়ে যাবে। তবু বিরক্ত হয়ে হেলমেট পড়েই এপার্টমেন্ট হাউজের নিচে নেমে মাত্র বাইকে চাবি লাগিয়েছে এমন সময় তার মোবাইল বেজে উঠলো। কিন্তু ফোন রিসিভ করার কোন চেষ্টাই তার মধ্যে দেখা গেলো না। কারন ফোনে কথা বলতে গেলেই আবার হেলমেট খুলতে হবে, কানে লাগিয়ে কথা বলতে হবে তাকে। এতো কাজ করার ইচ্ছা তার এই মুহুর্তে করছে না। বাইকে স্টার্ট দিয়ে সে জাপান গার্ডেন সিটির গেইট পার করে মেইন রাস্তায় নামার সাথে আবার তার মোবাইল বেজে উঠলো। সে বুঝতে পারছে অপরপ্রান্তে যে খবিশই থাকুক সে তার ফোন রিসিভ করা না পর্যন্ত একটার পর একটা ফোন দিয়েই যাবে। বিশ্রি একটা আঞ্চলিক গালি দিয়ে সে রাস্তার ধারে বাইক থামিয়ে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলো।তাকিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার। মহাবিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করেই ধমকের সুরে প্রশ্ন করলো,
হ্যালো কে?
আসলামুয়ালাইকুম। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে রাসেল বলছি। আপনি কি নাঈমুর রহমান বলছেন?
মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে ভাবলো এ নিশ্চয়ই তার বন্ধু সার্কেলের কোন এক বদমাইশ। মাঝে মাঝেই এমন প্রংক কল দেওয়া এখন দেশে একটা ট্রেডিশান হয়ে গিয়েছে।
সালামের প্রতিউত্তর দিয়েই সে বললো, না আমি তোর দুলাভাই। দ্যাখ মেজাজ সপ্তমে আছে এখন। যেই হোস না কেনো এখন কোন প্রকারের ফাইজলামি করবি না কিন্তু।
অপরপ্রান্ত থেকে অপারেটর বললো,
স্যার আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে।আমি সত্যিই সুন্দরবন কুরিয়ার থেকে রাসেল মাহমুদ বলছি। আপনার একটা পার্সেল এসেছে আমাদের মোহাম্মদপুর ব্রাঞ্চে। আপনি কি দয়া করে নিয়ে যাবেন?
নাঈম ভাবতে শুরু করলো তাকে আবার কে কুরিয়ার পাঠাতে গেলো? এই ইহজন্মে কেউ চিঠি পাঠায় নি আর আজ একদম কুরিয়ারে পার্সেল এসে।হাজির!
সে বললো, আপনাদের না হোম ডেলিভারী সার্ভিস, তা কুরিয়ার আমার বাসায় পোউছে দিচ্ছেন না কেনো?
অপারেটর বললো,আসলে প্যাকেটের গায়ে শুধু আপনার নাম, নাম্বার আর ব্রাঞ্চের নাম লেখা। অন্য কোন ঠিকানা দেওয়া হয়নি।
নাঈম আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো,কোথা থেকে এসেছে পার্সেলটা?
অপারেটর বললো,কক্সবাজার থেকে। পাঠিয়েছেন নুসরাত আফিরিন নামের একজন ভদ্র মহিলা।
আফিরিন !আফিরির নাম শুনেই নাঈম মনের ভিতরে প্রচন্ড এক ঝটকা খেলো। গ্রীষ্মের তীব্র গরমের মাঝেও তার বুকের ভিতর হালকা শির শির করতে লাগলো। এরকম অসম্ভব ঘটনাও কি ঘটে? ঘটা সম্ভব! আফিরি তাকে পার্সেল পাঠিয়েছে?
চিন্তা করা শুরু করতেই ঘটনাপ্রবাহ ক্রমে তার মাথার উপর দিয়ে যেতে লাগলো। কিংকর্তব্যবিমুঢ়র মতো এক অবস্থায় সে শুধু ফোনে বললো,
আচ্ছা আপনাদের ঠিকানা বলুন, আমি এসে নিয়ে যাচ্ছি।
আপরপ্রান্তে অপারেটর ঠিকানা বলেই ফোন রেখে দিলো।
পকেটে মোবাইল রেখে সে বাইক ঘুরিয়ে ব্যাংকের দিকের রাস্তা না ধরে কুরিয়ার সার্ভিসের রাস্তা ধরলো।
আফিরির এর সম্পূর্ন নাম নুসরাত আফিরিন । বয়স ২৮। উচ্চতায় প্রায় পাচ ফুট ছয় ইঞ্চি। চোখের উপর সব সময় পিংক কালারের একটা চশমা পড়ে। নিসন্দেহে মেধাবী এবং ভীষন একরোখা টাইপের মেয়ে। তাকে দেখলেই মনে হয় সে ধ্রুপদি নৃত্য জানে। কিন্তু আদোতে ঘটনা পুরো উল্টো। কলার সাথে তার দূর দূর পর্যন্ত কোন প্রকারের সম্পৃক্ততা নেই।
আফিরির সাথে নাঈম এর পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেন্ড ইয়ারে। তাদের প্রেম ক্যাম্পাসে যেমন বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিলো তেমন তাদের সম্পর্কটা অনেক সিনিয়র থেকে বন্ধু বান্ধব শিক্ষক ভালো ভাবে নিতে পারেনি। জাতীয় ক্রাশ যদি একজনের প্রেমে পড়ে তবে সে আর তার ভালোলাগার মানুষ দুইজনই মহাবিপদের মধ্যে পড়ে যায়।
তাদের মধ্যে সম্পর্কটা হয়েছিলো তার প্রধান কারন প্রথমত আফিরিন দেখতে খুবই সুন্দরী ছিল তার উপর ছিল ক্যাম্পাসের জুনিয়র সিনিয়র থেকে বন্ধুবান্ধবদের নির্বিশেষে এক ক্রাশ। আর নাঈম ছিলো ক্যাম্পাসের ওয়ান অফ দ্য বেস্ট গিটারিস্ট। রকস্টার নাঈম আর রূপসী আফিরি এর সম্পর্ক যখন জমে ক্ষীর তখন হঠাৎই তাদের সম্পর্ক ভেংে যায়। এ নিয়ে অনেক হাংামাও হয় ক্যাম্পাসে। সেই সময়ে ক্যাম্পাসের মোস্ট টেবিল টকে পরিনত হয়েছিলো তাদের ব্রেকাপের ঘটনা। নাঈম অনেক নাটক করেছে আফিরি এর ডিপার্টমেন্ট এর সামনে গিয়ে। কিন্তু বরফ হয়ে যাওয়া উষ্ণ প্রেম ধারা আর ঝার্না হয়ে ঝরে পড়েনি নাঈমের উপর। ব্রেকাপের পর নাঈম অনেক মাস থেকে বছর পর্যন্ত মারাত্নক ডিপ্রেসড ছিলো। নেশাপাতি করা শুরু করে দিয়েছিলো। যার ফলে তার একাডেমিক লাইফে মারাত্নক প্রভাব পড়ে। শেষ পর্যন্ত তাকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তন করতে হয়। সময়ের সময় গিয়েছে, ঝামেলার উপর ঝমেলা হয়েছে। মাঝখানে রিহ্যাবে ছিল কয়েক মাস। বিগত কয়েক বছর ধরে সে সম্পূর্ন সুস্থ। নিজের মতো আবার পড়াশোনা শুরু করেছে। নতুন করে ইউ ল্যাব নামে ধানমন্ডির এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন নিয়েছে। পাশাপাশি হালকা পাতলা ফ্রিল্যান্স ব্যবসা করে হাত খরচ চালাচ্ছে।
যে মেয়ের জন্য এতো এতো কাহিনী সেই মেয়েই তাকে হঠাত পার্সেল পাঠাতে গেলো কেনো,নাঈম তা ঠিক বুঝে উঠে পারলো না। ঘটনার পর প্রায় ছয় বছর পার হয়ে গিয়েছে। এতোদিন আফিরি কোথায় ছিলো? শেষ পর্যন্ত জানাবধি এক কোটি পতি ব্যবসায়ীর সাথে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
নাঈম মনে মনে বললো, নাহ! আজ আর ব্যাংকে ফ্যাংকে গিয়ে কাজ নেই। সোজা বাসা।
বাইক চালিয়ে বাসায় ফেরার পথে নানান ধরনের শুভ অশুভ ভালো খারাপ চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। অতীত স্মৃতি বার বার ফিরে আসতে লাগলো। যে অতীত সে ভুলে যেতে চায়!
হ্যা সে রাজনীতি করতো। যেটা আফিরির ভালো লাগতো না। তার ফ্রেন্ড সার্কেল তার পছন্দের ছিলো না। যে লাইফ স্টাইল দেখে আফিরি নাঈমের প্রেমে পড়েছিলো, সুম্পর্কের পরে সেই জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন চেয়েছিলো। চেয়েছিলো নিজের মনের মতো করে নাঈমকে গড়ে নিতে। এই নিয়েই তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া হতো। এক সময় তিক্ত প্রণয়ের এক পর্যায়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটে যার ফলাফল ব্রেকাপ।
একটা সময় ছিলো যখন তার ঘরের দেয়ালে জুড়ে শুধু আফিরির ছবি শোভা পেতো। সম্পর্ক থাকাকালীন সময়ে সে অনেক প্রকারের ছেলেমানুষী করেছে। প্রায় প্রতি পূর্নিমার মধ্য রাতে ঘরের সব বাতি নিভিয়ে সে ঘর জূড়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতো। মাঝখানে বসে সে কবি মন নিয়ে চাদের দিকে মুখ করে গিটার বাজাতো আর মোবাইলে আফিরিকে নানান ধরনের গান শোনাতো। এখন সেই ভালোবাসার দেয়ালে জুড়ে শুধুই কিছু বিষন্ন চিত্রকর্ম আর প্রত্যেক পূর্নিমা রাতে চাদের জানালায় ভাড়ি পর্দা ঝুলে থাকে । সেই সময়ের আবেগের কোন মাথামুন্ডু ছিলো না। এর পর সে আর প্রেমে পড়েনি প্রেম করেওনি। বন্ধুবান্ধবের জোড়াজুড়িতে কয়েকবার জোড়াতালির সম্পর্ক করার চেষ্টা করেছে কিন্তু পুরানো সেই অনুভুতি আর ফিরে আসেনি তাই কোন প্রকারের সম্পর্কও গড়ে উঠেনি কারো সাথে। আপাতত নির্ঝঞ্ঝাট এক প্রেমিকাশূন্য জীবন কাটাচ্ছে সে। তার মতে জীবনের সবচাইতে ভেজালমুক্ত বেস্ট সময় কাটাচ্ছে সে। তাই অতীত ভুলে থাকার চেষ্টা করে বর্তমানে ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করছে।
মারাত্নক সব নেশা করার কারনে মাঝখানে তার চেহারা স্বাস্থ্য খুব ভেংে পড়েছিলো। রিহ্যাব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এখন সে অন্যরকম জীবনে আছে। ঠিক মুক্ত বল্গা হরিনের মতো, আপোষহীন এক শিকারী বাজ এর মতো। এখনো সে গীটারে ঝড় তুলে তবে তা আগের থেকে অনেক কমে গিয়েছে।
সুন্দরবন কুরিয়ার থেকে পার্সেল রিসিভ করেই সে সোজা বাসায় ফিরে এসে দরজার কলিংবেলে চাপ দিতেই তার বোন নিতু দরজা খুলে দিলো।
নিতু দেখলো তার ভাই গ্রীষ্মের দমবন্ধ গরমের কারনে দর দর করে ঘামছে। তার চোখেমুখে কোন অজানা কারনে এক চাপা উত্তেজনা খেলা করছে। সে পরপর অনেকগুলো প্রশ্ন করে বসলো নাঈমকে,
কি রে এতো তাড়াহুড়ো কিসের? ফিরে এলি যে? ব্যাংকের কাজ এমন তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো? আর হাতে অইটা কি, দেখি?
নাঈম বিরক্ত হয়ে বললো, তা দিয়ে তোর কাজ কি? ভাই এই ঠাডা পড়া রোদের মধ্যে বাইরে থেকে এসেছে। কোথায় তাকে শরবত অথবা পানির গ্লাস এগিয়ে দিবি, তা না করে হাজারটা প্রশ্ন করতেছিস! বাংলাদেশে তোর মতো আর একটা ভন্ড বোন আছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার। এখন যা ভাগ। আর ভাগার আগে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়ে যা আমার রুমে।
কিন্তু ভায়ের এই ঝাড়িতে কোন পাত্তাই দিলো না নিতু। সে তার ভাইয়ের কোন কথাই গায়ে মাখেনা। তা সিরিয়াস কথা হোক আর নরমাল কথা। নাঈম যেনো কিছুই বলেনি এমন ভাবে কোন প্রকারের ভ্রক্ষেপন না করেই নিতু আবার প্রশ্ন করলো, পার্সেলটা কার? আব্বার না আমার? দেখি দেখি কে পাঠিয়েছে!
এই বলে পার্সেলটা হাতে নিতেই নাঈম ছিনিয়ে নিয়ে বললো, কেন আমার কাছে কেউ পাঠাতে পারে না? খালি পাকনামি। যা নিজের কাজে যা।
কিন্তু নিতু এক ঘেয়ে গলায় বলেই চললো,বল না ভাইয়া,কে পাঠিয়েছে! এমন করিস কেন!
নাঈম বললো, তুই পানি দিয়া বিদায় হ।
কিন্তু নিতু আবার প্রশ্ন করলো,তুই ব্যাংকের কাজ করছিস?
না, ধুর! আজকে বাংলাদেশের সব ব্যাংক বন্ধ— এই বলে নিজের রুমে ঢুকেই নিতুর মুখের সামনে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। আর ভিতর থেকে শুধু বললো,
দরজার সামনে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে না থেকে পানি দিয়ে যা।
দরজা লাগিয়ে নাঈম তার ডেস্কের উপর পার্সেলটা নামিয়ে রাখলো। পিংক কালারের সেলোফেনে মোড়ানো একটা বাক্স। সে কিছুক্ষন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো বাক্সটার দিকে। যেনো সম্মোহন করেছে তাকে পার্সেলটা। হঠাৎ দরজায় বোনের নকের শব্দে সম্বিত ফিরে পেলো সে। দরজা খুলে বোনের এর কাছ থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক চুমুকে গ্লাসের সব পানি খেয়েই গ্লাসটা আবার ফেরত দিয়ে দিলো নিতুর হাতে। পুনরায় নতুন করে কোন একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল বোন কিন্তু মুখের সামনে আবার নাঈম দরজা লাগিয়ে দিলো।
পড়ার টেবিলের ডেস্ক থেকে পার্সেল্টা নিয়ে পাশে থাকা বিছানায় সে বসে পড়লো। অত্যন্ত আগ্রহের সাথে পার্সেলের মোড়ক খুলতে খুলতে নাঈম ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড নারভাস বোধ করা শুরু করলো । একবার ভাবলো থাক, প্যাকেট খুলবে না। বন্ধই থাকুক এক সময়ের প্রিয়তমা রহস্য। কিছুক্ষনের জন্য শার্লক হোমস হয়ে শত আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনা করেও সে কিছুই অনুমান করতে পারলো না যে কি থাকতে পারে ভিতরে। তাই ক্ষনিক পরেই ইতস্তত বোধে সে প্যাকেটটা খুলে ফেললো। মোড়ক খুলতেই দেখলো একটা খয়েরি রঙ এর টেডি বিয়ার আকা বাক্স। বাক্সটা দেখার সাথে সাথে তার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের কিছু বিক্ষিপ্ত স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। এই বক্সে করেই সে প্রথম গিফট দিয়েছিলো আফিরিকে। একটা ফোমের ছোট সাদা ভালুকের পুতুল। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ছিল। সেদিন খুব খুশি হয়েছিলো আফিরি। আনন্দে ঝলমল এক বাচ্চা খুকির মতো দেখতে লাগছিলো তাকে।
সেই অতীত স্মৃতি রমন্থন রেখে নাঈম বক্সের ভিতরে আস্তে আস্তে উকি দিতেই দেখলো তাদের সম্পর্কের সময় তার দেওয়া বিভিন্ন উপহারের প্রত্যেকটা আফিরি ফিরিয়ে দিয়েছে। সাথে হলুদাভ কাগজে গোটা গোটা পরিষ্কার হাতে লেখা বেশ নাতিদীর্ঘ এক চিঠি। চিঠিটা দেখেই নাঈম সাথে সাথে বক্সটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সেই চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলো।
নাঈম,
কেমন আছো? নিশচয়ই আল্লাহ তোমাকে ভালোই রেখেছেন। জানি বহুদিন পর আমার চিঠি পেয়ে তুমি খুব অবাক হচ্ছো। মনে হয়তো অনেক প্রশ্ন। এতো বছর পর কেনো হঠাৎ আমি। আমাকে বোধ হয় ভুলেই ছিলে। মনে করিয়ে দিতে এলাম তার জন্য আন্তরিকভবে দুখিত। জেনে থাকবে আজ পাচ বছর হলো আমার বিয়ে হয়েছে। একটা মেয়ে আছে । নাম স্বর্না। চার বছরের এক ফুটফুটে দেব শিশু। তোমার সব খবরই আমার কাছে ছিল আছে। ক্যাম্পাসের যে কোন রিনউন ছাত্রের খোজ এক নিমেষেই বের করা যায়। তোমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনেছিলাম। কিন্তু সহানুভূতি জানাতে পারিনি তার জন্য দুখিত। শুনলাম রিহ্যাব থেকে ফিরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছো। জেনে ভালো লাগলো। তুমিও জানো আর আমিও জানি আমাদের সম্পর্কের অবনতির মূল যে কারনটা ছিলো তা ছিল তোমার রাজনীতি করা আর অকর্মন্য বন্ধু বান্ধবদের সাথে করা নানান প্রকারের এক্সপেরিমেন্টাল নেশা। নিজেকে তুমি কোথায় ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিলে তা তুমি দেখতে পাচ্ছিলে না। আমি পাচ্ছিলাম। তাই তোমাকে একটা সুন্দর স্বাভাবিক জীবন দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে ভুল বুঝলে উলটো পথে চললে। সম্পর্ক শেষে আরো হার্ড ড্রাগের দিকে চলে গেলে। একাডেমিক্যালি ফল করলে। সেই অবস্থায় তোমার কাছে ফিরে যাওয়া অথবা সম্পর্ক গড়ার কোন অর্থ ছিলো না। আর তুমি ভালো মতোই জানতে যে কলেজ জীবন থেকেই আমার পিছনে বিয়ের জন্য পাত্র পক্ষর ফ্যামিলি লাইন ধরে থাকতো। ফ্যাকাল্টির সামনে তোমার হাংগামার খবর আমার বাসা পর্যন্ত চলে যায়। বাসা থেকে চাপ আসে বিয়ে করার। তাই হুট করেই এক ব্যবসায়ীর আমার বিয়ে হয়ে যায়।
হয়তো বিরক্ত হচ্ছো এই পুরাতন আর আমার পারিবারিক কথা শুনে। প্রশ্ন জাগছে এতো বছর পর কেনো ব্যাখা দিতে এলাম। খুব আশ্চর্যও হচ্ছো। আসলে আমার সাজানো সংসার ভেংে তছনছ হয়ে গিয়েছে। গত বছর রোড এক্সিডেন্টে স্বর্নার বাবা মারা গিয়েছে। তার মৃত্যুর পর এক বিশাল শূন্যতা গ্রাস করেছে আমাকে। খুব শুন্য লাগছে। প্রিয় মানুষ হারানোর ব্যথা কি রকম দুসহ হয় তা খুব ভালো বুঝতে পারছি। তখন বুঝতে পারিনি তোমার অনুভুতি কিন্তু এখন বেশ বুঝতে পারছি।
কিছুদিন আগে বাসা পরিবর্তনের সময় অনেক পুরাতন জিনিসের ভেতর থেকে তোমার দেওয়া উপহারগুলো খুজে পেলাম। এক সময় আমাদের এক সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো মনে রাখার জন্য যে উপহারগুলো দিতে আমাকে। এগুলোর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। খুজে পাওয়ার সাথে সাথে যতোবার এগুলোর কথা মনে পড়ছে ততোবার অতীতের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার বর্তমান অতীত সম্পূর্ন বিষাদে মাখা। সেই অতীত আমি ভুলতে চাচ্ছি, ভুলে থাকতে চাচ্ছি। তাই তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম তোমার দেওয়া উপহারগুলো। তোমাকে অপমান করা অথবা দুখ দেওয়ার জন্য নয়। আগামী সপ্তাহে আমি আর স্বর্না আমেরিকা চলে যাচ্ছি বড় ফুপুর কাছে। ভালো থেকো। আর বিয়ে করে সংসারী হও এভাবে আর কতো দিন বিবাগী থাকবে?
ইতি
নুসরাত আফিরিন
নাঈম কয়েক বার চিঠিটা পড়লো। আফিরির স্বামী মারা গিয়েছে এই খবর সে পায়নি। এই তথ্য তাকে তার পরিচিত কেউই দেয়নি। হয়তো যখন রিহ্যাবে ছিলো তখন এই দুর্ঘটনা ঘটেছিলো। তাই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি কেউ। প্রায় ছয় মাস সে এক পরিবারের সদস্য ছাড়া কারো সাথেই যোগা্যোগ রাখতে অথবা করতে পারনি।
নাঈমের কাছে মনে হলো হঠাৎ এতো বছর পর এমন বিড়ম্বনার কোন অর্থ হয়? যাকে প্রায় ভুলে ছিলো সে,সেই আচমকা নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে আবার মিলিয়ে গেলো!
একটা কি মনে হতেই নাঈম দ্রুত পার্সেলের ঠিকানা চেক করলো। দেখলো প্রেরকের ঠিকানার জায়গায় শুধু আফিরি এর নাম, ব্রাঞ্চের ঠিকানা আর একটা ফোন নাম্বার দেওয়া। নাঈম নাম্বারটা মোবাইলে তুলে ফোন দিলো। অনেকবার চেষ্ট করলো। কিন্তু বার বার নট রিচেবল আসতে লাগলো। বিছানার উপরে রাখা ল্যাপটপ অন করে সে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম সাইটে আফিরিকে খুজতে লাগলো কিন্তু সে যে ফেইসবুকে নেই তা খুব ভালো মতো জানে নাঈম। থাকলেও অন্য কোন ছদ্মনামে আছে। তারপরও আবার সার্চে খুজে না পেয়ে শেষে নিজের বন্ধু বান্ধবদের কাছে খোজ নেওয়া শুরু করলো। কারো না কারো কাছেতো থাকবে আফিরির সাথে যোগাযোগের কোন ঠিকানা অথবা নাম্বার!
আমেরিকা যাওয়ার আগেই নাঈমকে একবার যে করেই হোক আফিরি এর সাথে একবার দেখা করতেই হবে। শেষ একবার চেষ্টা করবে তাকে ফেরানোর। যে তার পুরানো আবেগকে মাত্র কবর খুড়ে বের করে এনেছে। যার চিঠি তার মৃত অনুভুতিতে প্রানের সঞ্চার করে দিয়েছে। যে চিঠি সে যতো বেশি করে পড়ছে ততো বেশী আবেগতাড়িত হয়ে চলেছে। তার অক্ষত পুরাতন ক্ষততে বহু যুগ পড়ে, আফিরি যেনো মাত্রই ভালোবাসার আলতো পরশ বুলিয়ে দিয়েছে।
©somewhere in net ltd.