![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘এমন অভিনব, মর্মস্পর্শী ও মজার বক্তৃতা জীবনে শুনিনি।’ কাগজে অবশ্য তার স্থান হয়নি। খুনোখুনি, ধর্ষণ, দলীয় দ্বেষাদ্বেষি বা লম্বা লম্বা আত্মপ্রচার ছাপতেই তাদের সব পাতা খরচ হয়ে যায়।
জীবনে আমি অনেক বক্তৃতা শুনেছি, বেশ কিছু শুনতে বাধ্যও হয়েছি। কিন্তু এমন অভিনব, মর্মস্পর্শী ও মজার বক্তৃতা জীবনে শুনিনি। শোনার পর থেকেই সে অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য ছটফট করছি।
বক্তা এক জন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী। ভারতের যে কয়েক জন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি, ইনি তাঁদের মধ্যে এক জন। এবং একই সঙ্গে এক জন কবি, কবিতার বই আছে। এবং এ দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম।
দিল্লির সাহিত্য অকাদেমির সম্বৎসর বক্তৃতায় তিনিই একমাত্র বক্তা। মঞ্চের ওপর সেই পরিচিত মূর্তি। সাত জন্মে মাথার চুল আঁচড়ান না মনে হয়, পোশাকের পারিপাট্য নেই, কখনও টাই পরেন না। এমনই ভাবভঙ্গি যে, অ্যাবসেন্ট মাইণ্ডেড প্রফেসরের কথা মনে পড়ে। বক্তৃতা দেওয়ার আহ্বান জানাবার আগেই তিনি উঠে আসছেন পোডিয়ামের কাছে। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে এক জন যখন তাঁর পরিচয় জানাতে গিয়ে নানাবিধ গুণাবলির উল্লেখ করছেন, তখন মাঝে মাঝে হাততালি দিয়ে উঠছেন দর্শকরা, তিনিও এক বার হাততালি দিয়ে ফেলে বিহ্বল ভাবে তাকাচ্ছেন এ দিক ও দিক!
বক্তৃতার বিষয় হচ্ছে, জ্ঞানের বিশ্বে ভ্রমণ। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাহিত্য ও দর্শনের কী কী বই তাঁকে প্রভাবিত করেছে সারা জীবন, সেই কথা বলতে লাগলেন। তাঁর মতে, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিক্যাল কলেজেও ভাল ভাল সাহিত্যের বই রাখা উচিত। ছাত্রজীবনের একটা অভিজ্ঞতার কথাও বললেন। যখন তিনি চেন্নাইতে ম্যাড্রাস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, থাকেন হস্টেলে, তখন এক গ্রীষ্মে তাঁদের দেশের বাড়ি রামেশ্বরমে তুমুল ঝড়-বৃষ্টিতে অনেক বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়। তাঁর বাবা-মা আছেন সেখানে, তাঁদের কোনও বিপদ হয়েছে কি না সেই উদ্বেগে কালাম তখনই সেখানে যেতে চাইলেন। কিন্তু মাসের শেষ, হাতে একেবারে পয়সা নেই। গাড়িভাড়াই বা জোটাবেন কোথা থেকে? সোজা চলে এলেন মুর মার্কেটে। সেখানে একটা দোকানে নতুন ও পুরনো বই কেনাবেচা হয়। সে দোকানে এসে তিনি একখানা বই বিক্রি করার চেষ্টা করলেন, বইখানির নাম ‘দা থিয়োরি অব ইলাসটিসিটি’। সে বছরই এয়ারোডাইনামিক্স-এর পরীক্ষায় তিনি রেকর্ড নম্বর পেয়েছিলেন বলে এম আই টি-র অধ্যক্ষ তাঁকে বইটি উপহার দিয়েছেন। দামি বই। সেই পঞ্চাশের দশকেই চারশো টাকা। কালামের রামেশ্বরম যেতে ষাট টাকা লাগবে, তা পেলেই তিনি বইটি বিক্রি করে দিতে রাজি। দোকানের মালিক মাথায় টিকিওয়ালা এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ। তিনি বইটা নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, এ রকম পুরস্কার পাওয়া এত মূল্যবান বই তুমি বিক্রি করছ কেন? এ বই আমি কিনতে পারব না। তার পর কালামের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন, তোমার যখন এতই টাকার দরকার, আমি তোমাকে ষাট টাকা দিচ্ছি। পরে কোনও এক সময় টাকাটা জোগাড় করে আমাকে দিয়ে বইটা ফেরত নিয়ে যেও! কালাম বললেন, তিনি সারা জীবনেও সেই ব্যক্তিটির মুখ ভুলতে পারেন না।
অন্য রকম। একটি অনুষ্ঠানে ছোটদের সঙ্গে আভুল পাকির জয়নুলাবদিন আবদুল কালাম।
বইয়ের কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনি বলতে শুরু করলেন একটা অর্জুন গাছের কথা। তাঁর দিল্লির বাড়ির বাগানে দণ্ডায়মান এই গাছটির বয়েস একশো বছরেরও বেশি, কালামের বাবাও একশো তিন বছর বেঁচেছিলেন। শত শত ডালপালা ছড়ানো সেই বিশাল অর্জুন গাছটির সঙ্গে মাঝে মাঝেই তাঁর নানান কথাবার্তা হয় বন্ধুর মতন। গাছ তাঁর অনেক প্রশ্নের উত্তর দেন।
এ সব তো আছেই, তাঁর বক্তৃতার আসল মজা অন্য। তাঁর বক্তব্য শুনতে শুনতে শ্রোতারা এক-এক জায়গায় যেই হাততালি দিচ্ছে, অমনি তিনি বলছেন, কী, এটা ভাল লেগেছে? তা হলে আমি যা বলছি, আমার সঙ্গে সঙ্গে গলা মিলিয়ে সবাই শপথ নাও। বলো, ‘আজ থেকে আমি’...। শ্রোতারা সমস্বরে বলল, আজ থেকে আমি...। ‘এই শপথ করছি যে’, শ্রোতারাও, এই শপথ করছি যে...। ঠিক বাচ্চাদের নামতা পড়াবার মতন।
শেষ শপথটির কথা না বললেই নয়। সেটা এ রকম:
১) আজ থেকে আমার বাড়িতে অন্তত ২০টি বই নিয়ে একটা লাইব্রেরি চালু করব, যার মধ্যে দশটি বই থাকবে বাচ্চাদের জন্য।
২) আমার মেয়ে আর ছেলে বাড়ির সেই লাইব্রেরির বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলবে অন্তত ২০০টি।
৩) আমার নাতি-নাতনিরা সেই বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলবে অন্তত দু’হাজারে।
৪) আমাদের বাড়ির লাইব্রেরিটিই হবে আমাদের পরিবারের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি।
৫) আমরা পরিবারের সবাই মিলে সেই লাইব্রেরিতে প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা সময় কাটাব!
কালাম আরও জানালেন যে, তামিলনাড়ুর এক বইমেলায় তিনি প্রায় দু’লক্ষ মানুষের এক সমাবেশে শ্রোতাদের এই শপথ পাঠ করিয়েছিলেন। তার পর অনেকেই তক্ষুনি একসঙ্গে কুড়িখানা বই কেনার জন্য ছুটে যায়। বইমেলার অনেক দোকানই খালি হয়ে গেল এর ফলে।
পর দিন দিল্লির বড় বড় সংবাদপত্রের, যাদের বলা হয় ন্যাশনাল নিউজপেপার, কোনওটিতেই এই বক্তৃতার একটি লাইনেরও উল্লেখ আমি দেখিনি। খুনোখুনি, ধর্ষণ, ঘুষ-কেলেঙ্কারি, রাজনৈতিক দলগুলির দ্বেষাদ্বেষি বা লম্বা-লম্বা আত্মপ্রচার, এই সব দরকারি খবরেই সংবাদপত্রগুলির সব পৃষ্ঠা খরচ হয়ে যায়। যে-কোনও প্রাক্তন, এমনকী রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত, তাঁদের বক্তব্য নিয়ে সংবাদমাধ্যম মোটেই মাথা ঘামাতে রাজি নয়।
২| ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৫৪
খেয়া ঘাট বলেছেন: কপোতাক্ষের তীরে এক অসামাজিক বলেছেন: বড় মানুষের চিন্তা চেতনাই অন্যরকম।
দারুন একটা লিখা ভাই। পড়ে মনটাই ভালো হয়ে গেলো।
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৫
কপোতাক্ষের তীরে এক অসামাজিক বলেছেন: বড় মানুষের চিন্তা চেতনাই অন্যরকম।