![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি খুব সাধারন একটা ছেলে বেড়ে উঠা গ্রামে, আর ভালোবাসি বাংলাদেশ। পড়তে খুব পছন্দ করি, মাঝে মাঝে লিখারও চেষ্টা করি।
কুষ্টিয়ার রাস্তাগুলো যেন অন্যরকম। শহর ছেড়ে গ্রাম্য প্রান্তর পেরিয়ে যখন আমরা আখড়ার কাছাকাছি পৌঁছালাম, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। চারপাশে ধুলো, বাতাস, গাছের পাতার নড়াচড়া—সবকিছুতেই এক ধরণের নির্লিপ্ত শান্তি। শহর থেকে বেরিয়ে আসা আমার মতো মানুষের কাছে এই নীরবতা শুরুতে অস্বস্তিকর লাগছিল, পরে বুঝলাম—এটা একটা ডাক, নিজের দিকে ফেরার।
লালন শাহ্র আখড়ার সামনে পৌঁছে আমরা পাটের বিছানা ও মাদুর পেলাম বসার জন্য। দূরে কেউ বাউল গান গাইছিল
—"মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, রে ভাই..."
সুরটা বুকের মধ্যে কেমন যেন কাঁপন ধরিয়ে দিলো। আমির ভাই চোখ বন্ধ করে শুনছিলেন। আমি গলায় একটা টান অনুভব করলাম—মনে হলো গানটা যেন ঠিক আমাকেই বলা হচ্ছে।
রাতে আমরা থাকলাম আখড়ার পাশেই একটা সাধারণ গেস্টহাউসে। আমি জানালার পাশে বসে ছিলাম। দূরে গান চলছিল। হঠাৎ করে মনে হলো, আমি আর আমি নেই। মনে হচ্ছিল, আমার ভেতর থেকে কেউ ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে—নতুন কেউ, যাকে আমি চিনতাম না।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শব্দগুলো স্তব্ধ হয়ে এলো। শুধু বাতাস আর কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছিল দূর থেকে। হঠাৎ করেই মনে হলো, শহরের সব ব্যস্ততা, প্রেম, না-পাওয়া, শূন্যতা—সবকিছু মুছে যাচ্ছে। আমি একটা অন্যরকম নিঃসঙ্গতার মধ্যে ঢুকে পড়ছি—যেটা কষ্টের না, বরং মুক্তির।
আমার মাথার মধ্যে তখনও অজান্তার মুখ ভাসছিল। কিন্তু সেই মুখ এখন আর যন্ত্রণার মতো নয়, বরং এক ধরণের আলো হয়ে উঠছে—যা হয়তো আমায় পথ দেখাবে। আমি জানি না, এটা কেবল মন খারাপের ফল, নাকি কোনো আত্মিক রূপান্তরের শুরু। কিন্তু মনে হলো, এই প্রথম আমি সত্যিকার অর্থে নিজের দিকে তাকাতে পারছি।
অজান্তার সাথে একবার বেশ ঝগড়া হয়েছিলো আমার। ঝগড়ার ইস্যু খুবই তুচ্ছ। মেয়েরা অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে বেশি। ঈদের সময় ওদের বাড়িতে প্রচুর ব্যস্ততা থাকে। ওর ভাইয়েরা, বোনেরা, চাচা চাচী, চাচাতো ভাইবোন মিলে অনেক মানুষ একসাথে হয়। যার কারনে আমাকে সময় দিতে পারেনা। ফোন দেয় হিসাব করে দিনে একবার আর রাতে অনেক কায়দা করে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এক দুই মিনিটের জন্য। রাতে আমার গলা না শুনলে সে ঘুমাতে পারেনা। এর মধ্যে এক রাতে আমি তার সেই কাঙ্খিত ফোন ধরতে পারিনি। টানা সতেরোবার ফোন দিয়েছিলো। আমি কোন কারনে বাসার বাইরে গিয়েছি, ফোন নেইনি। এই ব্যস্ততার সময়ে আবার আমার ফোন দেয়া নিষেধ ছিলো। ম্যাসেঞ্জারে নক দেয়া যাবেনা, ফোনও দেয়া যাবে না। যার ফলে আমি আর ফোন ব্যাক করিনি।
ব্যস, এরপর অজান্তা এত ক্ষেপে গিয়েছিলো যে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আমি ফোন কেন ধরতে পারিনি সেই নিয়ে তুমুল অভিমান। পরদিন আর আমার ফোনে কোন কল আসেনি। এদিকে আমি তো চিন্তায় অস্থির, এমনতো একদিনও হয়নি যে আমাকে ফোন না করে অজান্তা থেকেছে!
সেই ফোন দুই দিন পর এসেছে। আমি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে প্রচন্ড অভিমানী গলা;
- আমাকে ছাড়া তো খুব সুন্দর জীবন চলছে। অনেক আরামে আছো তাই না? আমি জ্বালাচ্ছি না এখন, বেশ শান্তি পাচ্ছো?
অজান্তার ঝনঝন অভিমানী শব্দে আমি কেঁপে কেঁপে উঠলাম। বললাম,
- তোমাকে ভীষণ মিস করছি পাগলী।
অজান্তা যেন আরো রেগে গেলো,
- তুমি মোটেই মিস করছো না। তুমি জানো আজকে দুইদিন আমি কিভাবে কাটাচ্ছি? আমার দুনিয়া স্বাভাবিক ছিলোনা। আমি ঘুমাতে পারিনি। তুমি আমার ফোন ধরোনি কেন?
- আমি বাসার বাইরে ছিলাম। ফোন সাথে নেইনি।
- কেন ফোন নিলেনা? তুমি জানতে না আমি ফোন দিবো?
- আমার মাথায় ছিলোনা, জরুরি কাজ ছিলো।
- হইছে, তুমি তোমার জরুরি কাজ নিয়ে থাকো। আগামী সতেরোদিন আমি আর ফোন দিবোনা। আমিও শক্ত হয়ে যাবো। তোমাকে ছাড়া থাকতে শিখে যাবো।
ফোনটা কেটে দিলো। আমি কল ব্যাক করছিলাম, ধরেনি। এরপর ফোন বন্ধ করে দিলো। একদিন, দুইদিন তিনদিন এভাবে ছয়দিন ফোন বন্ধ করে রাখলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে অনেক কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু ছয়দিন ফোন বন্ধ করে রাখা এটাও বাড়াবাড়ি ছিলো। অবশ্য অজান্তা আমাকে এত বেশি ভালোবাসতো যে ওর মাঝেমধ্যে এসব বাড়াবাড়িকে আমি আরো বেশি ভালোবাসতাম।
ছয়দিন পর ফোন দিয়েই বলে;
- অনেক কষ্ট হইছে মহারাজ? আমি আর থাকতে পারছি না, তাই ফোন দিলাম।
মাঝেমধ্যে রাগ করলে সে নিজেই অনুতপ্ত হতো। আমার কাছে ভেঙেচুরে এসে নিজেই আত্মসমর্পণ করতো। এটাই ছিলো আমার অজান্তার বড় সরলতা। আমি বললাম;
- তুমি তাহলে আমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছো?
- কই আর পারলাম, এক মুহুর্তের জন্যও তো সরাতে পারিনা।
আমি অভিমানের সুরে বললাম;
- ভালো তো, ছয়দিন যেহেতু পেরেছো সামনে আমি ছয়মাস ফোন বন্ধ করে রাখবো। তখন বুঝবে।
অজান্তা বলে;
- ছয়মাস পরে ফোন দিলে শুনবে আমি আর দুনিয়ায় নেই।
আমি ধমকের সুরে বলি;
- উলটা পালটা কথা বইলো না। তোমাকে অনেক মিস করেছি। আমি স্যরি যাও।
- আমিও স্যরি। এই কদিনে বুঝলাম, তুমি আমার সুস্থ থাকার ঔষধ।
অজান্তা রাগ করে বেশিক্ষন থাকতে পারতো না। আমি এটা সেটা বলে ম্যানেজ করে ফেলতাম। সে বলতো, আমি নাকি আমার মিষ্টি কথায় যে কাউকেই ম্যানেজ করে ফেলতে পারি। কিন্তু আমি জানি দুনিয়ার কাউকে ম্যানেজ করতে না পারলেও অজান্তাকে ম্যানেজ করতে পারি। কারন আমি ওকে বুঝতে পারি, ওর সমস্ত শিরা-উপশিরায় আমি মিশে গিয়েছিলাম। অজান্তা আমার অস্তিত্বের সবটুকু জুড়েই ছিলো। যার ফলে আমি জানতাম কোন পরিস্থিতিতে ওকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হতো। এটা ছিলো আমার জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ।
সকালবেলা ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে—not alarm clock, not horns, just pure silence with life in it. অনেকদিন পর কাল রাতে একটু ঘুম হলো। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, আলো মাটি ছুঁয়ে রয়েছে, সুন্দর নরম ঘাস যেন প্রার্থনায় বসেছে।
আমি ধীরে ধীরে উঠে আখড়ার ভেতর চলে যাই। সেখানে তখন কয়েকজন ফকির বসে আছেন, কেউ গান গাইছে, কেউ চোখ বন্ধ করে ধ্যান করছে। আমি চুপচাপ গিয়ে একটা কোণায় বসি। কারো নজরে না পড়ে যেন শুধু দেখেই যেতে পারি—এই ছিল ইচ্ছা।
কিন্তু একজন বৃদ্ধ ফকির আমার দিকে তাকালেন। চোখে অসম্ভব শান্তি, অথচ গভীরতা এমন যেন সেখান থেকে পালানো যায় না। তিনি হাসলেন। তারপর বললেন,
— "তুমি কি কারো অনুপস্থিতি নিয়ে এসেছো এখানে?"
আমি থমকে গেলাম। কিছু বলার আগে তিনি আবার বললেন,
— "তাকে খুঁজছো, নাকি নিজেকে?"
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তারপর বললাম,
— "দুটো কি আলাদা?"
তিনি মাথা নেড়ে বললেন,
— "যার অভাব বুকে বাজে, তার মাঝেই তো নিজেকে লুকিয়ে রাখি আমরা। কিন্তু জানো, ভালোবাসা যার ছিল, সে হারায় না—সে রূপ বদলায়। তুমিও বদলাবে, যদি নিজেকে ভাঙতে দাও।"
এই কথাগুলো শুনে আমি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম। যেন বুকের ভেতর কোনো একটা তালা ধীরে ধীরে খুলে গেল। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল।
আখড়ার একটা তরুণ ফকির তখন একটি
দোতারায় গাইতে শুরু করল—
"সাইঁ যে আমার রূপেরও মধ্যে,
তারে খুঁজি বাহিরে..."
সেই সুর আমাকে একেবারে অন্য জগতে নিয়ে গেল। অজান্তার মুখ, মাহির চোখ, শহরের ব্যস্ততা—সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত শূন্যতায় রূপ নিলো। আর সেই শূন্যতার মাঝখানেই আমি নিজের ভেতর প্রথমবার শুনতে পেলাম—একটা নিঃশব্দ ডাক।
আখড়ায় দুপুরের রোদ নরম হয়ে এসেছে। গাছের ছায়া মাটির ওপর পড়ে শীতল হয়ে আছে। আমি একা বসে ছিলাম এক কোণে। সবাই ধীরে ধীরে চলে গেছে বিশ্রামে। শুধু আমি আর নিরবতা।
তখনই তিনি এলেন। একজন মধ্যবয়সী ফকির, ধবধবে সাদা চাদর পেঁচানো শরীরে, চোখে গাঢ় গভীরতা। মুখে চুল, চোখে বিস্ময়ের চেয়ে বেশি বোঝাপড়া। তাঁর আসা যেন কাউকে চমকে দিতে নয়, বরং কারো অপেক্ষার জবাব দিতে।
তিনি এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। আমি উঠে দাঁড়াতে গিয়েও পারলাম না—পায়ের তলা কেমন জমে গেছে। তিনি বসে পড়লেন আমার পাশে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
— “তোমার নাম অমিত?”
আমি জবাব না দিয়েই তাকিয়ে থাকলাম। তিনি যেন উত্তর চাইলেন না।
— “তোমার চোখে অনেক কথা। কিন্তু ভাষা নেই। তুমি আসছো, কারণ তোমার ভিতরে একটা ভাঙনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।”
আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। প্রশ্ন করলাম না, পালালামও না। তিনি ধীরে বললেন,
— “এই যে তুমি নিজেকে খুঁজছো, ভালোবাসা, অনুপস্থিতি, শূন্যতা... এগুলোর মধ্য দিয়ে চললে, এক সময় দেখবে—তুমি নিজেই আর তুমি নেই।”
— “তাহলে আমি কে হবো?” আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “যা ছিলে না, কিন্তু যার জন্য তোমাকে জন্ম নিতে হয়েছিল।”
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। তিনি এক টুকরো কাগজ আমার হাতে দিলেন। তাতে একটা লাইন লেখা:
"তোমাকে হারিয়ে যদি তুমি নিজেকে ফিরে পাও—তবে সে হারানো নয়।"
আমি কাগজটা ধরেই তাকিয়ে থাকি। মাথা তুলে দেখি, লোকটা উঠে চলে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে, নিরবতায়, যেমন এসেছিলেন।
আমার ভেতরে তখন এক ধরণের ভাঙন আর নির্মাণ একসাথে চলতে থাকে। মনে হলো, আমি একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
আমি কি তাহলে ধীরে ধীরে অমিত থেকে অন্য কেউ হয়ে উঠছি? অথবা আমি ধীরে ধীরে হয়ে উঠছি সেই 'আমি', যাকে এতদিন চিনি না? আমি নিজের মধ্যে ফকির আবদুল হাই সাহেবকে দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমি অবিকল তার মত দেখতে কেউ একজন! পাশেই গানের আসর বসেছে, গান বাজছে;
"খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারিনে তাকে আমি জাল ফেলে আর পাঁয়।
সে কোন দেশের কোন জনমে কোথায় ছিল বাসা
কেমনে আসে কেমনে যায় বুলতে নারে ভাষা।
আছে কি তার পাখা ডানা আছে কি তার খোঁপা
তারে ধরি ভাবতে গেলেই হয় মন উদ্ভ্রান্ত।
লালন বলে এমন পাখি আর পাই কোথায়
ধরতে পারিনে তাকে আমি জাল ফেলে আর পাঁয়।"
(অপেক্ষা-৫ম পর্ব © শামীম মোহাম্মদ মাসুদ)
১৬ ই মে, ২০২৫ দুপুর ২:৫৭
শামীম মোহাম্মাদ মাসুদ বলেছেন: রাজীব ভাই আখড়ায় গিয়েছিলেন কখনো?
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই মে, ২০২৫ সকাল ১০:৩১
রাজীব নুর বলেছেন: কুষ্টিয়া খুব সুন্দর।
মানুষ গুলোও ভালো।