![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি খুব সাধারন একটা ছেলে বেড়ে উঠা গ্রামে, আর ভালোবাসি বাংলাদেশ। পড়তে খুব পছন্দ করি, মাঝে মাঝে লিখারও চেষ্টা করি।
ঢাকায় ফিরেই প্রচন্ড জ্বরের কবলে পড়লাম। দুইদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি। লাগাতার জ্বর ১০২/১০৩ ডিগ্রি। নাওয়া খাওয়া সব ভুলে বিছানায় পড়ে রইলাম। এই জগতে নিজেকে খুব একা মানুষ হচ্ছে। মনে হয় আমার কোথাও কেউ নেই। কেউ আমার হতে পারেনি, আমি কাউকে আপন করে নিতে পারিনি। আমার একাকিত্ব আর এই যে বদলে যাওয়া সময়ে কাউকে পাশে পাইনি। প্রত্যেক মানুষের কষ্টগুলো একান্ত ব্যক্তিগত, এর ভাগ আসলে কেউ নেয়না। কাউকে নিজের বেদনার ভাগ দেয়া যায়না। একান্ত আপনজনও বেদনার ভাগ নিতে পারেনা।
নিজেকে খুব অসহায় লাগছে, মনে হচ্ছে আমার একটা আশ্রয় খুব দরকার। মায়ের বুকে জড়িয়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। সেই সাধ্য আমার নেই। মাকে হারিয়েছি সেই ছোটবেলায়, বয়স যখন ছয় বছর। মায়ের কোন স্মৃতি আমার কাছে নেই। আবছা করে শুধু মনে পড়ে মা আমাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন এরকম একটা দৃশ্যের কথা। সেটা হয়তো আমার কল্পনাও হতে পারে। মা হারা সংসারে অজান্তা হওয়ার কথা ছিলো আমার আশ্রয়ের জায়গা। আমি সেই আশ্রয়কেও হারিয়ে ফেলেছি।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে নড়ে উঠলাম। সকাল সকাল কে এলো বুঝতে পারছি না। বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠি। দুইদিনের জ্বর আর না খেয়ে শরীর বিচ্ছিরি রকমের ভেঙে গেছে। মুখভর্তি দাঁড়ি আর এলোমেলো চুলে নিজেকে নিজের চিনতে কষ্ট হচ্ছে। শেষ দাঁড়ি কেটেছি মাস খানেক আগে। এরপর ভুলেই গেছি নিজের দিকে তাকাতে। হাঁটতে গিয়ে বুঝলাম শরীরে শক্তি নেই, কাঁপছে দূর্বলতায়।
দরজা খুলতেই দেখি দরজার সামনে মাহি দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঝাপসা চোখে ওকে দেখছিলাম। কালো রঙের একটা কুর্তি পরা। কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো, কপালে কালো টিপ, চুল ছেড়ে দেয়া। আমাকে দেখেই মাহি অবাক চোখে প্রশ্ন করে;
কি হয়েছে স্যার? আপনার এই অবস্থা কেন?
আমি ওর কথার উত্তর দেইনি। ওকে দেখে অবাকও হইনি, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ওকে ভেতরে আসতে বলি। আমি জানতাম মাহি আমাকে খুঁজতে বাসায় আসবে। গতকাল রাতেই টের পাচ্ছিলাম সে আমাকে ভাবছে খুব।
মাহি ভেতরে আসে, আমি দরজা লাগাতে গিয়ে হাতের ব্যালেন্স রাখতে পারছিলাম না। মাহি আমার হাত ধরে ফেলে। নিজে দরজা লাগিয়ে দেয়। আমি রুমে ফিরি, মাহি আমাকে ধরে এনে বিছানায় রাখে। আমি দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছিলাম না। শুয়ে পড়লাম, মাহি কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বললো;
— আপনার তো প্রচন্ড জ্বর।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম;
— হুম, আজকে দুইদিন।
মাহি ভীষণ অস্থির হয়ে উঠলো, সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। জিজ্ঞেস করে;
— আজকে দুইদিন কিছুই খান নি? আপনার চেহারার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছেন? এখন সত্যিকার দেবদাসের মত লাগছে। ঔষধ খেয়েছেন সকালে?
— না রে, কিছুই খেতে পারিনি। ঔষধ টেবিলের উপর রাখা আছে। তুই বস আমি উঠছি, খাবো এখন।
আমি ওর এই অস্থিরতা শান্তভাবে অনুভব করছি। সে আশেপাশে তাকিয়ে সব একনজর দেখে নিলো। আমার এই অবস্থা দেখে মেয়েটার হাসিমুখ কালো হয়ে গেছে।
মাহি দ্রুত ব্যাগটা নামিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। আমি শুয়ে শুয়ে শুনি তার পায়ের শব্দ, কখনো গ্যাসের চুলার আওয়াজ, ফ্রিজ খোলার শব্দ, কখনো বাসনের। কিছুক্ষণ পর হাতে মগ ভরতি গরম চা নিয়ে আসে, সাথে দুটো ডিমসেদ্ধ। ফ্রিজে অবশ্য বাজার সবই করা আছে। মাহি এসব দেখেছে। আমার পাশে বসে বলে;
— ডিমসেদ্ধ খান আর একটু চা খেলে শরীরটা হালকা লাগবে।
আমি চোখ মেলে ওর মুখের দিকে তাকাই। কী এক অদ্ভুত শান্তি ঝরে পড়ছে ওর চোখ থেকে। একটা অদৃশ্য ভরসা যেন আমার শরীর আর মন ছুঁয়ে যায়। হাতে মগ তুলে দেয় ও, আমি চুমুক দিতেই বুঝি শরীরটা একটু সাড়া দিচ্ছে। মাহি আসায় আমি একটু শক্তিও পেলাম বোধহয়।
মাহি উঠে গিয়ে ওষুধ বের করে। বললো;
— এটা খেয়ে নেন। আমি ততক্ষণে কিছু রান্না করি। আপনার খাওয়া দরকার।
আমি কিছু বলতে পারি না। শুধু তাকিয়ে থাকি ওর প্রতি। এক অদ্ভুত মমতা কাজ করছে মেয়েটার মধ্যে। হয়তো স্নেহ, হয়তো ভালোবাসা, অথবা হয়তো এই শহরের একটুকরো সহানুভূতি। ওর ব্যস্ততা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি আবার। হালকা নিঃশ্বাসে ভেসে আসে রান্নার গন্ধ, চায়ের সুবাস, আর মাহির কণ্ঠস্বর—নিজের সাথেই কথা বলছে যেন নিচু গলায়।
কিছুক্ষণ পর জেগে দেখি মাহি পাশে বসে বই পড়ছে। আমার রুমভর্তি বই ছড়িয়ে থাকে, সেসব থেকেই কোন একটা পড়ছে। আমার জেগে ওঠা টের পেয়ে পাশে এসে বসে।
— আপনি না খেলে চলবে না। এই স্যুপটা খেয়ে নেন। তেমন কিছু না, শুধু একটু সবজি সেদ্ধ আর লবণ দিয়ে করেছি। জ্বরের সময় এগুলোই দরকার।
আমি ধীরে ধীরে উঠে বসি। মাহি নিজে হাতে চামচে করে আমাকে খাওয়াতে শুরু করে। মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে, তারপরও চামচে চামচে ওর আন্তরিকতায় একটু একটু করে শরীরটা গলে যেতে থাকে।
আমি হঠাৎ বলি—
— তুই জানিস, আমার মায়ের কোনো স্পষ্ট স্মৃতি নেই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে মা যদি বেঁচে থাকতেন, এমনই হতেন। আজকে সকাল থেকেই মাকে মিস করছিলাম।
মাহি থমকে যায়। চোখে জল টলমল করে ওঠে। কোনো কথা বলে না। শুধু মাথা নিচু করে চামচে করে আবার স্যুপ তুলে দেয়। আমার মনে হলো, বহুদিন পর আমি কারো সামনে ভেঙে পড়তে পারছি। এই ভেঙে পড়া কষ্টের না, বরং প্রশান্তির। আমার নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি যেন মাহির কানেও পৌঁছায়।
— তুই এসেছিস, ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ আছে আমার। এই শহরে, এই একাকিত্বে—তুই একফোঁটা আশ্রয়ের মতো।
আমি ধীরে ধীরে স্যুপ খাচ্ছি, মাহি চুপ করে বসে আছে। জানালার ফাঁক গলে দুপুর বেলার আলো ঘরে ঢুকছে। জানালার পাশে রাখা গাছগুলোর পাতায় রোদ ঝলমল করছে, যেন শব্দহীন এক শান্তি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
আমি খাওয়া শেষ করতেই মাহি হাত থেকে বাটি নিয়ে চলে গেলো। কিচেনের দিক থেকে পানি পড়ার, বাসন মাজার হালকা শব্দ ভেসে আসছে। একটা অদ্ভুত ঘরোয়া আবহ তৈরি হয়েছে এই বাসায়, যেখানে আমি কখনোই সেভাবে বাস করতে পারিনি। এই প্রথম অনুভব করলাম—কেউ আছে, যে আমার জন্য কিছু করছে, নিঃস্বার্থভাবে, কোনোকিছুর প্রত্যাশা ছাড়া।
মাহি ফিরে এসে আবার পাশে বসে। আমি খাটে হেলান দিয়ে বসে আছি। অনেক কিছু মনে পড়ছে। দুনিয়া বড় অদ্ভুত জায়গা। মানুষ যাকে চাইবে তাকে পায়না, আর যাকে চাইবে না সে অতি আপনের মত পাশে থাকে।
আমি জিজ্ঞেস করি;
— তুই কীভাবে জানলি যে আমি অসুস্থ?
মাহি একটু থেমে বলে;
— গতকাল থেকে আপনার ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম। ক্লাসে আসেননি কয়েকদিন। কোনো খবর নেই। জানি আপনি এমন হঠাৎ গায়েব হয়ে যান, তবু এবার কেমন অস্থির লাগছিলো। রাতে ঘুম হয়নি। বারবার মনে হচ্ছিল আপনাকে খুঁজে বের করি।
— কিভাবে খুঁজে পেলি?
— ভার্সিটি গিয়েছি, তারপর রেজিস্ট্রার স্যারের থেকে আপনার বাসার ঠিকানা নিয়েছি। এরপর সোজা বাংলামোটর হয়ে মগবাজার মোড়, সেখান থেকে রিক্সায় আপনার বাসা।
আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার মুখে কোনো নাটকীয়তা নেই। বরং শান্ত, স্বাভাবিক গলায় কথাগুলো বলে যাচ্ছে। ভেতরে যেন জমানো যত্ন জমে আছে।
— আপনার মতো মানুষ খুব কম দেখি, স্যার। নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখেন কেন? সবাইকে দূরে ঠেলে দেন। অথচ আপনি খুব নরম একজন মানুষ, বুঝেন? ভীষণ সংবেদনশীল। কিন্তু আপনি কাউকে কাছে আসতে দেন না।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
— ভরসা করতে ভয় পাই, মাহি। যাকে আপন ভাবি, সে-ই একদিন কষ্ট দিয়ে চলে যায়। ভালোবাসা নামের শব্দটার মধ্যে এত ভাঙচুর, এত ঋণ-পাওনা লেগে আছে যে আমি ক্লান্ত। নিজের যত্ন নেয়ারও ইচ্ছে করে না।
মাহি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে হাত বাড়িয়ে আমার হাতের ওপর রাখে ওর হাত। ঠান্ডা, কোমল, দৃঢ় এক ছোঁয়া।
— আমি আপনার পাশে থাকতে চাই, স্যার। কিছু চাই না। শুধু চাই, আপনি নিজেকে একা ভাববেন না। এই জগতে সবাই একা হয়তো, কিন্তু কিছু কিছু মানুষ থাকে, যারা পাশে থাকবার জন্যই জন্মায়। আপনি যদি আমাকে সেই জায়গায় একটু জায়গা দেন... আমি থেকে যেতে পারি।
আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। চোখ ভিজে ওঠে অজান্তেই। হয়তো অনেকদিন পর কারও সামনে নিজেকে এমন খোলামেলা করে ফেলেছি। বুকটা ভারী হয়ে আসে।
ও পাশে বসে থাকেই। কোনো কথা বলে না আর। শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। আমি চোখ বন্ধ করি। ঘরের নিস্তব্ধতায় মাহির নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়।
হঠাৎ মনে হলো—এই নীরবতা, এই মুহূর্ত—আমার জীবনে বহুদিন ধরে অনুপস্থিত ছিল। হয়তো এই মাহি, এই অসময়ে এসে দাঁড়ানো মেয়েটাই আমার ভাঙা ভেতরটায় একটুকরো আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আমি জানি না কী নাম দেব এই অনুভবকে—ভালোবাসা? নির্ভরতা? কৃতজ্ঞতা? হয়তো সব একসাথে।
শুধু এটুকু জানি, আজকের সকালটা অন্যরকম।
মাহিকে কি বলে ফিরিয়ে দিবো বুঝতে পারছি না। তবে আমি জানি মাহি খুব মেধাবী আর বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। আমার নীরবতা আর চোখের ভাষায় সে সবকিছু বুঝে নিবে। আমার এই ভাঙাচোরা জীবনে যে অজান্তা নামক বাঁধনে জড়িয়ে গেছি সেখানে কোন নারী প্রবেশ করার সাধ্য কই? আমি নিজেই আমার গন্তব্য জানিনা, কোথায় নিজের জীবনকে নিয়ে যাচ্ছি তা জানিনা। সেখানে নতুন কোন জীবন আসার সুযোগ কই? আমার সমস্ত অস্তিত্ব আর রক্তবিন্দুতে যে অজান্তার স্মৃতি আর ছায়া ঘিরে আছে সেটা মাহিকে কিভাবে বুঝাই?
আমি মাহির মাথায় আলতো করে হাত রাখি। মাহি আমার দিকে বুভুক্ষের মত চেয়ে আছে। তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কোন শব্দ নেই, মাহি খুব আত্মনিয়ন্ত্রিত মেয়ে। আমি মাহির মাথায় হাত বুলিয়ে দেই;
— তুই আমার জীবনের প্রিয় মানুষদের একজন। প্রিয় মানুষদের ক্ষতি জেনেশুনে করতে নেই। এই বিচ্ছিন্ন ছন্নছাড়া জীবনে জড়িয়ে তোর ক্ষতি আমি করতে চাইনা। আমার জীবনের একটা গল্প আছে, একদিন তোকে বলবো। তোর দেবদাস স্যারের গল্প।
— আমি দেবদাসের পার্বতী না হতে পারি অন্তত চন্দ্রমুখী হতে তো পারি?
আমি মাহির গাল টেনে দুষ্টুমির ছলে বলি;
— দেবদাস চন্দ্রমুখীকে জীবনের অংশ বানায়নি, আমি কি করে নিয়ম ভঙ্গ করি বল?
মাহি আমার অবস্থান বুঝতে পারে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর চোখ মুছে গ্লাস থেকে একটু পানি খেলো। আমিও উঠে দাঁড়ালাম।
মাহি আমার চোখের খুব কাছাকাছি এলো তারপর ভাঙা গলায় বলে;
— নিজের জীবনটা এভাবে শেষ করে দিবেন না প্লিজ। নিজের যত্ন নেন, বদলে যান। আপনার মত ভালো একজন মানুষ এভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে তা আমাকে ভীষণ কষ্ট দিবে।
একথা বলে মাহি ব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দেয়। আমি পিছনে চলি, মুখে কিছুই বলিনি। মাহি তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আমার চোখের ভাষা আর অব্যক্ত কথাগুলো বুঝে নিয়েছে।
মাহি চলে যায়, আমি পেছন থেকে তাকিয়ে থাকি। সে আর একবারও পেছনে ফিরে তাকায়নি। ভরদুপুরে দূর থেকে একটা গানের শব্দ ভেসে আসছে, আর্টসেলের সেই বিখ্যাত গান, দুঃখ বিলাস;
"তোমরা কেউ কি দিতে পারো প্রেমিকার ভালোবাসা,
দেবে কি কেউ জীবনে
উষ্ণতার সত্য আশা...."
(অপেক্ষা-৭ম পর্ব © শামীম মোহাম্মদ মাসুদ)
১২ ই জুন, ২০২৫ সকাল ১০:১৮
শামীম মোহাম্মাদ মাসুদ বলেছেন: ধন্যবাদ প্রিয় রাজীব ভাই।
©somewhere in net ltd.
১|
১২ ই জুন, ২০২৫ সকাল ১০:১৪
রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম। ভালো হয়েছে।