![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি খুব সাধারন একটা ছেলে বেড়ে উঠা গ্রামে, আর ভালোবাসি বাংলাদেশ। পড়তে খুব পছন্দ করি, মাঝে মাঝে লিখারও চেষ্টা করি।
গত কয়েকমাসে আমার মুখের দাঁড়ি অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। দাঁড়ি না কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চেহারায় ভিন্ন রকম একটা আমেজ ফুটে উঠেছে, চুল অল্প বাড়ছে পেছন দিকে। নিজের দিকে তাকানোর সময় পাচ্ছিনা। তবুও মাঝেমধ্যে আয়নায় নিজেকে দেখি। আমার আগের সেই হাসি মুখখানা বিমর্ষ হয়ে গেছে। না ঘুমিয়ে, ক্লান্তিতে চেহারা মলিন হয়ে থাকে সমসময়। এখন মুখভর্তি দাঁড়ি আর লম্বা চুলে নিজেকে লালন ফকিরের আদর্শ ভক্ত মনে হচ্ছে। নিজের চেহারার সাথে ফকির আবদুল হাই সাহেবের স্পষ্ট মিল দেখতে পাচ্ছি।
সময় অবিরত চলে যায়, থেমে থাকার সুযোগ নেই। ভালোবাসা আর সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হলো গতিতে। ভালোবাসা স্থির থাকেনা, কখনো বাড়ে কখনো কমে। সময়ও স্থির থাকেনা, কেবল সামনে এগিয়ে যায়। ফকির সাহেব ঢাকায় এসেছেন খবর পেয়েছি। গতকাল আমির ভাই ফোন দিয়ে খবরটা দিয়েছেন। এত দিনে আমার অপেক্ষার অবসান হয়েছে। কারো জন্য অপেক্ষা করার দৃশ্য সুন্দর। অপেক্ষায় মায়া থাকে, কল্পনা থাকে, আবেগ থাকে, ক্ষোভ অথবা ভালোবাসা থাকে, স্বপ্ন থাকে। অপেক্ষা শেষ হলে এসব থাকেনা। অপেক্ষার সাথে সাথে অনুভূতিরও সমাপ্তি ঘটে।
মাহির সাথে টিটোর প্রেম বেশ এগিয়ে গেছে। ওদেরকে ইদানীং নানান জায়গায় দেখা যায়। কখনো টিএসসি, কখনো শাহবাগ, কখনো রিক্সায় ঘুরছে, কখনো রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে, আমি এড়িয়ে যাই। থাকুক না সুখে, মাহির জীবনটা এগিয়ে যাক। তবে আমার ধারনা মাহি ভালো নেই। শুধুমাত্র আমার উপর রাগ আর জিদ করে সে টিটোকে নিজের জীবনে জড়িয়েছে। কিন্তু টিটো মাহির মত এত ভালো একটা মেয়ের মর্ম বুঝবে না। নেশাগ্রস্থ আর একাধিক নারী আসক্ত সে। তবে মাহির জেদ আর ভালোবাসার শক্তি প্রবল। সে টিটোকে ছাড়বে বলে মনে হয় না। আমার ধারনা মাহি টিটোকে বিয়েও করে ফেলবে।
টিটো ছেলেটা আমার ডিপার্টমেন্টেরই ছাত্র। ঢাকার বাসিন্দা, যাত্রাবাড়ী নিজস্ব বাড়ি। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। অত্যন্ত বদরাগী ও ক্ষুব্দ মেজাজের ছেলে, বন্ধুবান্ধব আর আড্ডাবাজি নিয়ে থাকে। নেশা করে, পয়সা উড়ায় আর মেয়েদের পেছনে ঘুরে, মাহি সবই জানে এসব।
সেদিন মাহি হঠাৎ আমার সামনে পড়েছিলো। আমি ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম একটা কাজে। বের হতেই মাহির মুখোমুখি। আমার সামনে পড়তেই কেমন যেন বিমর্ষ চেহারা ফুটে উঠেছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, নীচের দিকে তাকিয়ে পা ঘষছিলো মেঝেতে। চুলগুলো পেছনে বাঁধা। একটা মেরুন রঙের জামা পরেছে। আমি কিছুক্ষন দেখলাম তাকিয়ে। দুজনের কেউই কোন কথা বলতে পারছিলাম না।
"কেমন আছিস মাহি?" নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করলাম।
মাহি নীচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো; "ভালো আছি, খুব ভালো।"
মেয়েদের স্বল্পভাষায় 'ভালো আছি' বলাতে অনেক কিছু লুকানো থাকে। যেখানে অভিমান থাকে, ব্যথা থাকে আর থাকে খারাপ থাকার যন্ত্রণা। আমি বললাম;
"চেহারা এমন হয়েছে কেন? টিটোর সাথে ঝামেলা হয়েছে?"
মাহি উত্তর দেয়না....পা বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়। আমিও পেছন পেছন আগালাম। মাহি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। আমিও তাকে অনুসরণ করছি। তার চলাফেরার ধরনও বদলে গেছে। চটপটে দ্রুত চলা মাহি এখন অনেক ধীর আর এলোমেলো হাঁটছে।
রাস্তায় এসে মাহি আমার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করে "কোথায় যাচ্ছেন?
আমি উত্তর দিলাম "বাসায় যাবো।"
মাহি একটা রিক্সা ঠিক করলো মগবাজার যাওয়ার, আমিও উঠলাম। সে রিক্সায় আমার পাশে চুপচাপ বসে রইলো। আমি অনেক প্রশ্ন করেছি কি হয়েছে? কি সমস্যা? কোন উত্তর দেয়নি। আমাদের রিক্সা শাহবাগ ছেড়ে পরীবাগ রোডে এগিয়ে যাচ্ছে। বিকেলের স্নিগ্ধ এক এলোমেলো বাতাসে মাহির সামনের কিছু চুল উড়ছে। সে আনমনে দূরে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে জগতের এক বিরাট বিষন্নতা তাকে ঘিরে ধরেছে।
রিক্সায় বসে আছি। চারপাশের কোলাহল, গাড়ির হর্ন, মানুষের ভিড়— সবই যেন দূরের কোনো শব্দ হয়ে গেছে। আমাদের মধ্যে নীরবতার এক অদ্ভুত সেতু টানানো। হঠাৎ আমি অনুভব করলাম— মাহির হাতটা আমার বাহুতে এসে জড়ালো। খুব আলতো, কিন্তু কাঁপা কাঁপা হাতে। মনে হলো, এই স্পর্শে কতশত অভিমান, কষ্ট, না বলা কথা জমে আছে।
আমি চমকে তাকালাম ওর দিকে। মাহির চোখে তখন অশ্রুর কুয়াশা। এক ফোঁটা টুপ করে গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। পরের ফোঁটাগুলো আর আটকাতে পারলো না। ও মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলো— নীরবে, কাঁপতে কাঁপতে। সেই কান্নায় ছিলো দুঃখ, অভিমান আর ভেতর ভেতর ভেঙে পড়ার অসহায় স্বীকারোক্তি।
রিক্সাওয়ালাকে ও হঠাৎ কাঁপা গলায় বললো,
“মামা, রমনা হয়ে কাকরাইলের দিকে যাবেন।”
ওর গলার স্বরটা ভাঙা, যেন ভেতর থেকে উঠে আসা বেদনা গিলে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা। রিক্সা দোল খেয়ে বাঁক নিলো রমনার সবুজ ছায়ার ভেতর দিয়ে। আমার বাহুতে এখনো মাহির হাত। ওর হাতের চাপ কখনো শক্ত হয়, কখনো আলগা। সেই স্পর্শে আমি টের পেলাম, কতখানি ভেঙে গেছে ও, কতখানি একা হয়ে গেছে।
কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পাই না আমি। শুধু অনুভব করি, রিক্সার চাকা যেমন ঘুরছে, তেমনি ঘুরছে সময়, স্মৃতি আর আমাদের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কিছু কথা। আমার বুকের ভেতর এক ধরনের অপরাধবোধ, কষ্ট আর অনাবিল মায়া একসাথে গুমরে ওঠে।
আমাদের নীরবতার ভেতরই ভেসে থাকে অনেক না বলা কথা, অনেক না ফেলা কান্না, আর একটুখানি বাকি থাকা ভালোবাসা।
আমি একটু থমকে গেলাম। তারপর খুব আস্তে, ধীরে ওর কাঁপা হাতটা নিজের হাতে নিলাম। রিক্সার হালকা দোলায় আমাদের হাতের স্পর্শে এক ধরনের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়লো।
নরম গলায়, স্বান্তনার ভাষায় বললাম,
“কি হয়েছে মাহি? আমাকে খুলে বল…।”
আমার কণ্ঠের কম্পন ওর কানে পৌঁছাল কি না জানি না, কিন্তু আমি টের পেলাম, মাহির কাঁধটা হালকা কেঁপে উঠলো। ও চোখের জল মুছে নিতে চাইল, কিন্তু পারলো না— অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
রিক্সা তখন রমনার ছায়াঘেরা রাস্তা পেরোচ্ছে। চারপাশের কোলাহল, গাছের ফাঁক দিয়ে পড়া আলো-ছায়া— সবকিছু মিলিয়ে মনে হলো, সময় যেন কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে গেছে।
মাহি কিছুক্ষণ নীরব রইলো। শুধু হাতের চাপটা শক্ত করে ধরলো আমার বাহুতে— যেন নিজের সমস্ত কষ্ট আর ভেতরকার ঝড় আমার কাছে তুলে দিচ্ছে।
“আমি প্রচন্ড মানসিক চাপে আছি। না পারছি আপনাকে ভুলতে না পারছি টিটোর সাথে এডজাস্ট করতে। সকাল বিকাল রাত আপনার ছায়া আমাকে ঘিরে ধরে রাখে। আপনার মায়া আমি কাটাতে পারছি না। আমি আপনার থেকে বের হতে টিটোর সাথে সারাক্ষণ সময় কাটাই কিন্তু টিটোকে আমি এখনো ঠিকমতো বুঝতে পারিনা।
জানেন… টিটো আমাকে মাঝেমধ্যে অসম্মান করে… মাঝেমাঝে রাগে গালাগালি করে… কখনো হুট করে ফোন কেটে দেয়… আবার হঠাৎ গভীর রাতে ফোন করে বলে, ‘তুমি না থাকলে আমি বাঁচব না।’
মাঝেমধ্যে এমন পাগলের মতো আচরণ করে… হঠাৎ রিকশা থেকে নেমে চলে যায়… কিংবা রেস্টুরেন্টে বসে আমাকে একা ফেলে উঠে চলে যায়… তারপর রাতে এসে কান্নাকাটি করে, আমাকে বলে কত ভালোবাসে…
আপনি জানেন? একদিন আমার পরীক্ষার ঠিক আগের রাতে আমায় ভীষণ অপমান করলো… ভেবেছিলাম সব শেষ… কিন্তু পরের দিন সকালে দরজায় দাঁড়িয়ে… হাতে কিছু গিফট আর একগুচ্ছ গোলাপ… বলে,
‘তোমার মতো কাউকে আমি কখনো পাব না।’
আমি… আমি কিছুই বুঝতে পারি না স্যার… ও পাগলের মতো রাগ করে, আবার পাগলের মতোই ভালোবাসে… হুট করে চিৎকার করে উঠে… আবার হুট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরে…”
মাহি একনাগাড়ে বলে যায়। চোখের জল ফোঁটা ফোঁটা করে ঝরছে। কণ্ঠটা কাঁপছে, কিন্তু সে থামছে না।
“ও আমাকে সারপ্রাইজ দেয়… সিনেমা দেখতে নিয়ে যায়… হঠাৎ কোনো বই উপহার দেয়, যা আমি একবারই মুখে বলেছিলাম… আবার এমন কিছু কথাও বলে, যা শুনে বুকটা ছিঁড়ে যায়… আপনি জানেন? আমি ওকে ছেড়ে যেতে পারি না… আমি জানি ও আমার জন্য ঠিক না… কিন্তু তবু… তবু আমি পারি না…”
রিকশা তখন রমনার ছায়াঘেরা রাস্তা পেরিয়ে কাকরাইলের দিকে এগোচ্ছে। চারপাশে মানুষ, আলো, সব কিছু চলাফেরা করছে নিজের মতো। আর আমার পাশে বসা মাহি তার সমস্ত ভাঙন, কষ্ট আর ভালোবাসা একসাথে ঢেলে দিচ্ছে আমার কাছে। মাহির কণ্ঠে তখন এক ধরনের হাহাকার… আর চোখে ছিলো এক ধরনের অবিশ্বাস্য ক্লান্তি, অভিমান আর অদ্ভুত রকমের প্রেম।
আমি পাশে বসে শুনছিলাম… কিন্তু কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, আমি নিজেই এই কষ্টের জন্য অনেকটা দায়ী। বুকের ভেতর এক অজানা অপরাধবোধ হাহাকার তুলছিলো।
‘আপনি জানেন? আমি পারি না… ওকে ছেড়ে যেতে পারি না…’ মাহির এই কথাগুলো আমার মনে বারবার ধাক্কা দিচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল, আমি যদি ওর জীবনে না আসতাম, হয়তো ও আজ এভাবে ভাঙতো না, এভাবে কাঁদতো না।
কিছু বলার চেষ্টা করলাম, ঠোঁট কাঁপলো… কিন্তু শব্দ বেরোল না। শুধু একরাশ নীরবতা আর আত্মগ্লানি গিলে ফেললো আমাকে।
রিকশা তখন কাকরাইল মোড়ে এসে দাঁড়ালো। মাহি কাঁদা চোখ মুছলো, চোখ না তুলে রিক্সাওয়ালাকে আবার বললো—
“মামা, মৌচাক যান।”
ওর কণ্ঠ তখনো কাঁপছে, তবু একরকম দৃঢ়তা মিশে আছে। আমার ভেতর তখনও চলছে প্রচণ্ড টানাপোড়েন— কী বলবো, কীভাবে বলবো… জানি না। শুধু মনে হচ্ছিল, রিকশার এই পথ যেন শেষ না হয়… এই যাত্রা যেন আরো দীর্ঘ হোক… কারণ এর শেষ মানেই হয়তো আবার সেই অজানা দূরত্ব, আরেকবার হারিয়ে যাওয়া।
রিকশা আবার চলতে শুরু করলো আর আমার মাথায় কেবলই ঘুরতে থাকলো—
“আমি তোকে কি উত্তর দিব, মাহি? আমি নিজেই তো হারিয়ে গেছি…”
রিকশা কাকরাইল থেকে মৌচাকের দিকে এগোতে থাকে। বাতাসে মাহির চুল উড়ে আসে আমার গায়ের উপর, হালকা গন্ধ পাই। আমার ভেতর তখনও অসমাপ্ত কিছু কথা, না বলা কিছু আবেগ তোলপাড় করছে।
হঠাৎ মাহি ভাঙা কণ্ঠে বলে ওঠে—
“চিন্তা করবেন না স্যার… যত কষ্টই হোক, আমি আপনার জীবনে কোন অসুবিধা তৈরি করবো না…”
আমার দিকে না তাকিয়েই বলে চলে
“আপনাকে কথা দিচ্ছি… আমি আপনাকে ভুলে যাবোই। টিটোর সাথে আমি এডজাস্ট করবোই… আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, টিটোকে বিয়ে করবো…”
মাহির গলা কেঁপে ওঠে, কিন্তু কথা থামে না—
“হয়তো বিয়ে করলে সব ঠিক হয়ে যাবে… হয়তো তখন আর এত কষ্ট লাগবে না… হয়তো তখন আর আপনার কথা মনে পড়বে না…”
ওর কণ্ঠে এক ধরনের জেদ, কিন্তু সেই জেদের আড়ালে অন্ধকার ব্যথা আর অসহায়ত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমি ওর মুখের দিকে তাকাই, দেখি ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরা… চোখে আবার ভিজে আলোর রেখা। আমার বুকের মধ্যে তখন প্রচণ্ড এক শূন্যতা। বলতে চাই— “তুই পারবি না মাহি, তুই নিজেকে এভাবে ভেঙে ফেলিস না…”
কিন্তু মুখে কোন শব্দ আসে না।
রিকশা তখন মৌচাকের দিকে এগিয়ে চলেছে। আর আমাদের মাঝের সেই অদৃশ্য দূরত্ব যেন আরও গভীর আর চিরস্থায়ী হয়ে যাচ্ছে…
রিকশা মৌচাক মোড়ে এসে থামে। আমরা দু’জনেই নেমে পড়ি। চারপাশে মানুষের ভিড়, গাড়ির শব্দ, ব্যস্ততা— অথচ আমাদের দু’জনের চোখে-মুখে এক ধরনের শূন্যতা। মনে হচ্ছিল, আমাদের আসলে কোথাও কোনো গন্তব্য নেই। উদ্ভ্রান্তের মতো আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি রাস্তার ধুলো, কোলাহল আর সন্ধ্যার মৃদু বাতাসের ভেতর।
আমি একটু ঘুরে মাহির দিকে তাকাই। ওর চোখ তখন লাল আর ভিজে। আমি ধীরে ওর হাতটা ধরে ফেলি। গলার ভেতর কাঁপন নিয়েই বলি—
“জীবনের সব সিদ্ধান্ত জিদের বসে নিতে নেই মাহি… যাকে ভালোবাসে, তাকে সবসময় পেতে নেই। মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলেও ভালোবাসা যায়… ভুল করে জীবনটা এলোমেলো করে দিস না, প্লিজ… জিদ করে আমার মত ভুল করিস না। যা করিস, ভেবেচিন্তে করিস।”
মাহি আমার দিকে তাকায়, চোখে একরাশ অশ্রু আর অব্যক্ত কথা। আমি নিঃশ্বাস নিয়ে আরেকটু নরম গলায় বলি—
“আমি মানুষটা এই মুহূর্তে ভেঙে টুকরো হয়ে আছি, তোকে যদি নিজের জীবনে জড়াতে পারতাম, তাহলে হয়তো আমার জীবনটা অন্যরকম হতো… তোর মতো মানুষকে জীবনে পেলে আমি হয়তো হারাতাম না কখনো কিন্তু আমিও তো সিদ্ধান্ত নিয়েছি— আগুনে পোড়ার… তোকে পুড়িয়ে সাথে নিয়ে কি লাভ?”
আমাদের দু’জনের চোখে-মুখে তখন অদ্ভুত এক বেদনা আর মুক্তির ছায়া।
তারপর আর কোন কথা হয়নি। আমরা দু’জনেই বোবা নীরবতায় বিদায় নিলাম। ভিড়ের ভেতর দিয়ে দু’জন দু’দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
চারপাশে মানুষের হাঁটা-চলা, গাড়ির শব্দ, সবই চলতে থাকলো নিজের মতো।
একটা সিগারেট ধরিয়ে মৌচাক থেকে মগবাজারের দিকে হাঁটতে লাগলাম। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা আর কষ্ট অনুভব হচ্ছে। জীবনটা কত বৈচিত্র্যময়, এক হাতে লেগে থাকে ভালোবাসা আরেক হাতে না পাওয়ার ভীষণ শূন্যতা। রাস্তায় কত মানুষ, একেজনের একেক কষ্ট, আলাদা আলাদা অপ্রাপ্তি আর শূন্যতার গল্প।
আগামীকাল ফকির আবদুল হাই সাহেবের সাথে আমার দেখা হবে। আমাদের অনেক বছরের সেই কাঙ্খিত বৈঠক। অজান্তার খবর পাওয়া যাবে তার কাছে। আমি সেই অপেক্ষায় আজকের রাতটি পার করবো। জানিনা আমার জন্য নতুন করে কি রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছে। মানুষের জীবনটা কাটেই অপেক্ষা করতে করতে।
(অপেক্ষা-১০ম পর্ব ©শামীম মোহাম্মদ মাসুদ)
©somewhere in net ltd.