![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আর কেবল ‘প্রিন্ট মিডিয়া’ বা কাগজে ছাপা সংবাদপত্রই গণযোগাযোগের মাধ্যম নয়। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট এমনকি কোটি কোটি মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহৃত হাতের সেলফোনটিও এখন গণযোগাযোগের মাধ্যম।
গণমাধ্যমের এই সম্প্রসারিত ব্যবস্থা একদিকে যেমন সবার জন্য তথ্যভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিয়েছে, অন্যদিকে সেই সুবাদে তথ্য জানাকে একটি মৌলিক অধিকারে পরিণত করেছে। উন্নত অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রণীত হয়েছে ‘তথ্য অধিকার আইন’ এবং আইনি অধিকার সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ। তথ্য অধিকার এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আরো একটি মৌলিক পরিবর্তনও কারো দৃষ্টি এড়ায় না। অতীতে প্রিন্ট মিডিয়া বা সংবাদপত্রের আদিযুগে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম শিল্প ছিল না। বর্তমানে তা শিল্প হয়ে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে চীনে। অবশ্যই তা ছিল হস্তলিখিত। তবে আধুনিক সংবাদপত্রের জন্ম, মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের সঙ্গে- ইউরোপে। উনিশ শতকে সংবাদপত্র হয়ে ওঠে ইউরোপ-আমেরিকার গণজাগরণের হাতিয়ার। একই সঙ্গে তা ছিল বিভিন্ন ভাবাদর্শ ও রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার বাহন। সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে উনিশ শতকেই ‘সেন্সরশিপ’ চালু করা হয়েছিল।
আমাদের মতো ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি কেবল মত প্রকাশের বা ব্যক্তি স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি হয়ে ওঠে পরাধীনতা থেকে মুক্তির দ্যোতনা। স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম যত জোরদার হয়, গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রও ততই এই সংগ্রামের বাহন হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও সংবাদপত্রগুলো স্ব-স্ব অবস্থান থেকে স্বাধীনতার পক্ষে মত প্রকাশ করতে থাকে। পরাধীন ভারতে, এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ‘সংবাদপত্র’ ঠিক শিল্প হয়ে ওঠেনি। সংবাদপত্র ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক হাতিয়ার। যার জন্য সরকারি মালিকানায়, ক্ষমতাসীনদের মতাদর্শ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে সংবাদপত্র প্রকাশ হতে দেখা যায়। আবার সরকারবিরোধী সংবাপত্রও ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হতো। সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে মুনাফার চেয়েও রাজনৈতিক অঙ্গীকারই বেশি কাজ করেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় সংবাদপত্র অনেক আগেই শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শিল্পের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ‘মুনাফা’। অধিক মুনাফার জন্য প্রয়োজন অধিক বিনিয়োগ। ‘সংবাদ’ বা ‘খবর’ পরিণত হয় পণ্যে। বেসরকারি মালিকানায় রেডিও এবং টেলিভিশন ছেড়ে দেয়ার পর, কেবল সংসদই নয়, নাচ-গান, সিনেমা, নাটক, খেলাধুলা প্রভৃতি সব কিছুই এক ধরনের পণ্যে পরিণত হয়। এসব পণ্য যতটা আকর্ষণীয় হবে, পণ্য পরিবেশনে যতটা বৈচিত্র্য আনা যাবে, পণ্যটির বাহক সংবাদপত্র, রেডিও টেলিভিশন ততটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পণ্য পরিবেশক সংবাদপত্র, রেডিও বা টিভি চ্যানেলটির টিকে থাকা নির্ভর করবে তার পরিবেশিত পণ্যের উৎকর্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং ভোক্তার নানামুখী চাহিদা পূরণ। আর এ জন্য প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগ। অতীতের মতো কোনো এক ব্যক্তি, একটি রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর পক্ষে তাই এখন আর এ ধরনের কর্পোরেট শিল্প (তা সে সাংবাদপত্র/টিভি যা-ই হোক) স্থাপন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বশেষ আবিষ্কার গণমাধ্যমের প্রচলিত সংজ্ঞা, পরিধি, ভূমিকা, দায়িত্বশীলতা এবং উপযোগিতাকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে।
আসলে সংবাদপত্র অথবা টেলিভিশন- যাই বলুন, তার টিকে থাকা এবং মুনাফা নির্ভর করে বিজ্ঞাপনের ওপর। সংবাদ এখনো পণ্য- তবে সবচেয়ে কম দামি পণ্য। অতীতে গণমাধ্যম ‘সংবাদ’কে পণ্যে পরিণত করে তারই বিপণন করত সংবাদপত্রের (টেলিভিশনেরও) মাধ্যমে। এখন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং কর্পোরেট অর্থনীতির বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করেই বিশাল মুনাফা শিকারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ আমেরিকায় তাই, অনেক জনপ্রিয় সংবাদপত্র এখন বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। বাংলাদেশেও এটা সম্ভব। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন ভারাক্রান্ত পত্রিকাগুলো (আমার ধারণা, প্রথম আলো, ইত্তেফাক, ডেইলি স্টার, বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রভৃতি) যদি বিনামূল্যে বিতরণ করে, তারপরও ওইসব সংবাদপত্র যথেষ্ট মুনাফা করবে। একথা সত্য, সংবাদপত্র বা টিভির মালিক/কর্পোরেট হাউসগুলোর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবাদর্শগত অবস্থান এবং নিজস্ব এজেন্ডা থাকা স্বাভাবিক। বিশেষ মতাদর্শ বা রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য বা সহানুভূতি থাকাও বিচিত্র নয়। তবে শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞাপনের উৎস ও পরিমাণের ওপর নির্ভর করে সংবাদপত্রটির স্বাধীনতার এবং সামাজিক অঙ্গীকারের সীমা। বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমের ‘স্বাধীনতা’কে নতুন ডাইমেনশন দিয়েছে। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো ‘সংবাদ’ পরিবশেন বা বিজ্ঞাপন পাওয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে এমন কোনো কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র/টিভি চ্যানেলটি কদাচ করবে। আমাদের দেশের অনেক পত্রিকাই ‘লুটেরা ধনীকদের’ বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভীষণ সোচ্চার। কিন্তু বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়ে কোনো কোনো ভূমিদস্যু, কর্পোরেট হাউস এবং দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের সোচ্চার হতে দেখি না। অতএব, গণমাধ্যমের চিরায়ত নৈতিকতা, সৎ সাংবাদিকতা অথবা বস্তুনিষ্ঠতা এখন প্রায়শই গণমাধ্যমটির অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রকৃতির নির্ভর করছে। একটি সংবাদপত্র জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিধ্বনি অবশ্যই করতে পারে এবং গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ যদি তার পদচ্যুতি দাবি করে, তাহলে সংবাদপত্রটি তা নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারে। স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে জেনারেল এরশাদের পতনের দাবি ছিল, সর্বজনীন। অবশ্যই দায়িত্বশীল পত্রিকা এই সর্বজনীন দাবিটির পক্ষে অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এজেন্ডাটি কার? আপনার না জনগণের। সত্য বটে জনগণের নামে আপনিও সে এজেন্ডা উত্থাপন বা প্রচার করতে পারেন। যদি তা করেন, গণমাধ্যম বা সংবাদপত্র হিসেবে আপনি কি আপনার দায়িত্বের সীমা লঙ্ঘন করলেন না? রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এবং রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সংবাদপত্রের ও সম্পাদক/সাংবাদিকদের ভূমিকার তো তারতম্য থাকবে। নিঃসন্দেহে দায়িত্বশীল সংবাদপত্র রাজনৈতিক দলের বা রাজনীতিবিদদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। গণমাধ্যমকে অবশ্যই কতগুলো সর্বজনীন বা বিশ্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য নৈতিক মানদণ্ড, স্বাধীনতার সীমা এবং দায়িত্বশীলতার পরিধি মেনে চলতে হবে।
©somewhere in net ltd.