নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৮৬ তে আমি ন্যাদাগ্যাদা; কিন্তু পাকনাও। ততদিনে রেডিরও দাপট ক্রমাগত কমে আসছে। উপজেলা আর জেলা শহরগুলোতে সরকারী “অফিসার”-দের বাড়ীতে বিদেশ ফেরত অন্তত সাদাকালো ন্যাশনাল আর ফিলিপস দেখা যাচ্ছে। আর যাদের বাসায় ভিসিআর নামক অত্যাধুনিক যন্ত্রটা আছে তাদের ক্ষেত্রেও সহকর্মীদের ঈর্ষা সমেত গোপনে “ঘুষখোর” বলার রীতিটা বিরাজমান। আর হ্যা, তখনো ঘুষখোর একটা অপমানসূচক কথা। সবাই সবার বেতনের খবর রাখেন। ফুলবাড়ী উপজেলার “কাঁথাওড়া চেয়ারম্যানের” সততা এবং কর্মদক্ষতার দাপট এবং সম্মান সুস্পষ্ট। আরো স্পষ্ট শ্রেণী-বিভেদ। সবাই জানতো যে ২য় এবং ৩য় শ্রেণীর কম্পাউন্ডারের বাসায়, ক্লিনারের বাসায় টিভি থাকবে না। বাসার কাজের লোকেরা অধিক বিনয়ী হবেন এবং তারা আশেপাশের গ্রাম থেকে আসবেন। ফলে খোলা-হাটির বুয়ার সাথে বাসার কর্ত্রীর একটা মানবিক এবং বংশপরম্পরার যোগাযোগ থাকবে। এই কর্ত্রী বা কর্তারাও তাদের গ্রামীণ পরিবার কাঠামো এবং কৃষি অর্থনীতি থেকে খুব একটা দূরে নন। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি গড়ে উঠছে তবে সেগুলো যৌথ পরিবার কাঠামোর সাথে বিরোধীতায় যতটা নয় তারও বেশি আপসে। ফলে প্রত্যেকের বাড়ীতেই মামা খালা, চাচাদের নিয়মিত যোগাযোগ।
থান্ডার ক্যাটস, শুক্রবারের বাংলা সিনেমা, সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান বা ঘোষ্ট স্টোরিজ দেখতে কম্পাউন্ডের অনেকেই ভীড় করবেন। টিভিতে কোন অনুষ্ঠান দেখা তখনো একটা সামষ্টিক উৎসবের বিষয়। যেখানে বাসার কর্ত্রী, কর্তারা এবং তাদের ছানাপোনারা বস্তুগত অধিকারের কারণেই, বেশ সম্মান পাবেন। মানে টিভি থেকে সরাসরি মাঠে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, কর্ক, ফ্রিসবী, লন টেনিসের ব্যাট-এর সবই থাকবে অফিসারদের বাচ্চাদের কাছে। শ্রেণী-বিভেদের কথা যেমন বললাম, তেমনি বিভেদের সাম্যাবস্থার গল্পটাও বেশ সাবলীলও। যেটার উপর ভিত্তি করেই আস্তে আস্তে হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন-রা লেখক হয়ে উঠছেন আরকি। সাপ্তাহিক বিচিত্রা, আর্ট কালচার ষাটের দশকের তরুণদের (যারা এখন অফিসার এবং মুক্তিযুদ্ধে মারা যান নি) পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ আর বিপক্ষ নিয়ে তোলপাড়টাও তেমন চাগান দিচ্ছে না। অধিকাংশেরই বাম রাজনীতির একটা প্রাক্তণ ঘষাঘষি আছে। আধুনিকতা, ধর্ম, বাকশাল নিয়ে অভিমানও আছে। প্রথাগত ধর্ম চর্চার নানান ফাঁকফোকড় নিয়ে আলাপটা তখন ট্রেন্ডী হয়ে উঠছে। এরশাদ-এই বয়সগোষ্ঠীকে তখনো পাত্তা দিয়ে চলেন।
বাংলাদেশে ফুটবল উন্মাদনার সাথে এরশাদের শাসনামলের যোগাযোগ মনে হয় আছে। এরশাদ নানাভাবে জাতিকে মুগ্ধ করতে চাইতেন, চমক দিতে চাইতেন বলেই আমার মনে হয়। ফলে কালার টেলিভিশন, বিশ্বকাপের খেলা দেখানো, আমেরিকান শো দিয়ে টেলিভিশনকে ভরিয়ে ফেলা উনার রাজনৈতিক পিআর এর একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্ট বলেই আমার মনে হয়। স্বীকার করি বা না করি সদ্য স্বাধীণ হওয়া একটা দেশে পুনঃজাগরণের একটা হাওয়া এবং সেটার নেতৃত্বদানের লোভ মনে হয়ে জিয়া এবং এরশাদ উভয়েরই ছিল।
সেসময় পৃথিবীটা এত গ্লোবাল ছিল না। ওয়ার্ল্ড ব্যান্ড রেডিওর মালিকেরা বিশেষত প্যানাসনিক আর ন্যাশনালের মালিকেরা তখনো রেডিও নিয়ে গর্ব করতেন এবং আশংকাও করতেন যে উনাদের যে সামাজিক ক্ষমতাটা টিভিওয়ালার কাছে হারতে বসেছে মনে হয়। বিশেষ উপলক্ষ্যে ভিসিআর ভাড়া করা আর হিন্দী সিনেমা দেখা তখন উৎসবের মত, বাংলা সিনেমার সুদিন আছে তখনো; তবে আরো ভিন্ন সংস্কৃতি দেখার সুযোগ বিদেশী লোকেশনে শুটিং, আর হিন্দী সিনেমার মাধ্যমেই এ অঞ্চলে হয়েছে আর রয়েছে টিভিতে আমেরিকা ও হলিউড। আর আছেন ডাক্তার হিসেবে কাজ করে ইরাক, কাতার, লিবিয়া ফেরত মানুষ, স্বস্তা শ্রমের বাজারে বাংলাদেশের মানুষজনের ক্রম উপস্থিতি এবং তাদের পাঠানো গল্প। বিদেশ থেকে ফেরার সময় একটা ডেকসেট আর টিভি না নিয়ে ফেরা তখন প্রায় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। তো এসবের মধ্যে প্রথম যে আর্ন্তজাতিক ও সামষ্টিক উন্মাদনা এই দেশের মানুষ দেখতে পেলেন তা হল ১৯৮৬ এর মেক্সিকোর বিশ্বকাপ ফুটবল। এবং সেখানে ফুটবলের এযাবৎ কালের ইতিহাসের মহাকাব্যিক ম্যারাডোনা।
ফলে মুনতাসির হক (দেখুন তার পোষ্ট) যখন বলেন, “ফুটবলে ব্রাজিল হচ্ছে, আর্জেন্টিনার ছোটভাইয়ের মতো” এই কথাটা ঠিক। বিশেষ করে এই দেশের মানুষের ফুটবল দেখার ক্ষেত্রে। কারণ পেলের খেলা মানুষ পড়েছে, ছবি দেখেছে, কথা শুনেছেন কিন্তু চাক্ষুষ করলেন ম্যারাডোনাকে। আবার এও ভুলে যাবেন না যে ঢাকায় তখন ফুটবল রমরমা। আবাহনী, মোহামেডান ছাড়াও অন্য অনেক দল নিয়ে মানুষের উত্তেজনা তুঙ্গে। রাজনৈতিক দল, নির্মিয়মান বাঙালী এবং বাংলাদেশী আত্ম-পরিচয় (সংকটের) সাথে এটাকে বিযুক্ত করে দেখার কোন উপায় নেই। এছাড়া আরো একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে পাকিস্তানী নির্মমতার স্মৃতি, ১৯৪৭ পরবর্তী স্বপ্নভঙ্গের স্মৃতি, ১৯৭৫ কোনকিছুই কিন্তু পাবলিক মেমরী বিচ্যুত নয়। শাসক হিসেবে ইংরেজ বিরোধীতা আবার আধুনিক হয়ে উঠতে বিজ্ঞান আধুনিকতা ও ইংরেজি প্রেম নিয়ে যখন মধ্যবিত্ত মশগুল তখনো ধনী, মধ্যবিত্ত ও গরীবের নায়ক খোঁজা বন্ধ হয়নি। আমি মনে করি এখনো হয়নি। ফলে এ.টি.এম গোলাম কিবরিয়া যখন লেখেন,
“আমি ম্যারাডোনাকে তখন থেকে ভালোবাসি যখন আমি বিশ্বাস করতাম যে Bruce Lee ঘুষি দিয়ে বিল্ডিং ফাটায়া ফেলতে পারে আর ছেলেরা মেয়েরা চুম্মা খাইলে মেয়েদের বাচ্চা হয়। ছোটবেলার নায়কদের মারা যাওয়া মানে আপনি কবরের কাছাকাছি যাচ্ছেন, এই রিমাইন্ডার। ম্যারাডোনা চিরকালীন মিসফিট ছিলো, Raw Genius আর poor social skill এর epitome ছিলো।….ম্যারাডোনা আন্ডারডগদের গড ছিলো, পাঁচফুট পাঁচ ইঞ্চির একটা বস্তির পোলা ইংল্যান্ডের বুক ফেড়ে ফেলেছিলো ছিয়াশিতে, উপমহাদেশের এক ব্রিটিশবিরোধী মিসকিনের জন্য এইটা বিশাল ব্যাপার।“
তখন উনি যথার্থই বলেন। সাম্রাজ্য বিরোধীতার এই প্রবল শক্তি ই কিন্তু আন্ডারডগদের নায়ক খুঁজতে তাড়িত করে। ফলে ১৯৮৬-র সেই নায়কের গল্প শুনতে শুনতেই ৯০’-র প্রজন্ম স্বচক্ষে দেখলো ম্যারাডোনাকে। টিভি ততদিনে আর ততটা দূরের নয়। ফাইনালে হেরে গেলেও এই যে পাগলপারা দুর্দমনীয় আর্জেন্টিনা আর ম্যারাডোনা সেটা ৯০’-র প্রজন্মের কাছে পরিষ্কার করে যে এতদিন যে গল্প তারা শুনে এসেছে, তা মিথ্যা নয়, মিথ নয়। আর তখন থেকেই ম্যারাডোনা জীবন্ত মিথ হয়ে উঠতে থাকলেন সকলের কাছে।
৯০-র দশকে বাংলাদেশ গণতন্ত্র নিয়ে যেমন মত্ত হল তেমনি স্যাটেলাইট টিভির বিপ্লবও ঘটলো। উত্তরের শহরগুলোতে একটা দুটো ভারতীয় চ্যানেল আগেই ঢুকে পড়েছিল, সেইসাথে ঘটলো ডিশ বিপ্লব, এম টিভি। এরপর ৫ চ্যানেল থেকে পঞ্চাশ চ্যানেল, আড়াইশো, চারশো। “গণতান্ত্রিক” সুখে বহুকিছু পাবার যে “সুযোগ” নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতি তলে তলে দিতে থাকলো তাতে সামষ্টিকভাবে একত্রবোধ করা থেকে আস্তে আস্তে সরে আসতে থাকলো দর্শকেরা। তখনো তাদের মধ্যে ফুটবল বলতে আর্জেন্টিনা, ম্যারাডোনাই তবে সাথে আছে ব্রাজিল, জার্মানী, ইতালি। ৯০’ এর শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলের মানুষ আর্জেন্টিনা ছেড়ে ব্রাজিলও করছে, খুব কমই অন্য দল। ৯৪’এ ম্যারাডোনা দুর্দমনীয় শুরু করলেও তাঁকে আর মাঠে রাখা হল না। ফুটবল ততদিনে গ্লোবাল নিয়মনীতি আর ভালো ছেলেদের খেলা হয়ে উঠেছে। বিপ্লবীদের জায়গা নয়। “সামষ্টিকভাবে একত্রবোধ করার” গুণগত পরিবর্তন হওয়া শুরু করল।
আমি মনে করি এটি নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতির সেই সূক্ষ চাল যেটা নিয়মের বেড়াজালে বিপ্লবকে খোঁজা করতে সদা-তৎপর। আপনারাও ভালো দর্শক হয়ে উঠলেন। শুধু নিয়মনীতি আর স্ট্যাটিসটিকস খোঁজেন। ফুটবল বাদ দিয়ে কত বিভিন্ন ভঙ্গিতে, এঙ্গেলে, স্লোমোশানে ফুটবল খেলা দেখানো হচ্ছে সেটার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেন। আর যে ফুটবল আপনাদের ভালো লাগতে শুরু করল তা খুব ছোট করে হলেও ইউরোপীয়। আপনারা ইউরো কায়দায় ফুটবলকে বোঝার চেষ্টা করতে শুরু করলেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বাঁক।
৯৮’এ আবারো ব্রাজিল; লাতিন; তাই গরীবের ফুটবলের দ্যুতিতে মুগ্ধ করলো। আমাদের রোনাল্ডো, কাফু, রোনালদিনহো, কাকা এরা ইতিহাসের সেরা খেলাগুলো উপহার দিলেন। ফাইনালে হারলেও মন জয় করে নিলেন। খেয়াল করেছেন, ঠিক এসময়ই কিন্তু এদেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় হতে শুরু করল আর ফুটবল মার খেতে থাকলো?
জাপান, ২০০২ মানে ঠিক বিশ বছর আগের বিশ্বকাপ আমার মতে ছিল আর্ন্তজাতিকতাবাদে (খেয়াল করে দেখবেন, গ্লোবাল বলছি না কিন্তু) টইটুম্বুর শেষ বিশ্বকাপ। ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতল কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটা হয়ে গেল। অনেক পরে বুঝেছি এটা ছিল নব্যউদারনৈতিক অর্থনীতির খেলা। এর পরের ঘটনাগুলোতে একসময় দেখবেন লাতিন ফুটবল আর ইউরোপিয়ান ফুটবলকে যেন আলাদা করা যাচ্ছিল না। বেকহাম আর রুণী, জিদান প্রিয় তারকাদের খেলা দেখতে চার বছর ধরে অপেক্ষাও আর নেই। ২০০৭-৮ থেকে ঢাকা ইউরোপীয়ান আর স্প্যানিশ লীগের দর্শকদের ঘাঁটি হওয়া শুরু করলো। ততদিনে ঘরে ঘরে টিভি, হাতে হাতে মোবাইল। স্ট্যাটিসটিকস, ট্রান্সফার এমাউন্ট, ঢাকায় ম্যানইউ, চেলিসিয়া, রিয়েল মাদ্রীদের ফ্যান আর ছোট ছোট এফিলয়েশন পেয়ে আপনারা ভাবলেন যে খুব গ্লোবাল হয়ে উঠছেন। আসলে তো হচ্ছেন ইউরোপীয়ান নিওলিবারেল ফুটবলের গ্রাহক । এটা একটা গুণগত পরিবর্তন। ফুটবল আর বিপ্লব ততদিনে দুটো দুই গ্রহের বিষয় আপনাদের কাছে। এখানে সত্যিকারের কোন নায়ক নেই আছে মিহি মিহি নায়ক (প্লিজ মারতে আসবেন না)। ফলে যেই সময়টা থেকে আপনারা মেসি আর নেইমারের ফ্যান। সেই সময়টা হল নিওলিবারেল উত্থানের কাল। রোনাল্দো মেসি আর নেইমারকে আপনারা ক্লাব ফুটবলে যতটা নায়কোচিত দেখেন ততটা যেন অন্য কোথাও দেখেন না। কেন? মেসি আর রোনাল্দো আপনাদের দারুণ দারুণ সব খেলা উপহার দিলেন কিন্তু কই তাদের ম্যারাডোনা হয়ে ওঠা? পুরোনো দর্শকদের জিজ্ঞেস করে দেখেন কি নাই এঁদের যা ম্যারাডোনার ছিল?
ফলে এরশাদ পরবর্তী গণতন্ত্রের যে বাইপোলারিটি আপনারা যাপণ করলেন তা রাজনীতি বিচ্যুত তো নয়ই। এখনো যে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বাইপোলারিটি সেটাও। ফলে রাইসু যখন বলেন,
“রাজনীতি না থাকাটা, বা আগ্রাসনকামীদের সহযোগী হওয়াটা অধিকার বটে, তবে আমি বলতেছি তেমন লোকেদের, বা তরুণদের, আমরা তেমন অধিকার দিব কিনা, যা আমাদের অধিকার লোপাট কইরা বইসা আছে?”
আমি মনে করি যে উনি যেই অধিকার লোপাট হবার কথা বলেন তা হল সেই অধিকার যা রাজনীতির দিকে ধাবিত করে না বা আসলে বিরাজনৈতিক করে তোলে। আর তরুণদের যে কথা বললেন তা হল সেই “জম্বি হওয়া” তরুণ গোষ্ঠী।
ফলে গণতন্ত্র এবং বহু মিডিয়ায় যুক্ত হয়ে বিনোদিত হবার ক্ষমতা আসলে বিনোদনের মাধ্যমে বেরাজনৈতিক করার কৌশল হয়ে উঠল বটে। আপনার মনোযোগ কত উপায়ে এনগেজ হইতে পারলেন আর শেয়ার করতে পারলেন সেটার দিকে। কিন্তু আপনারা যে ছোট ছোট বিশ্ব হইয়া উঠলেন আর আলাদা আলাদা হয়া গেলেন তা কিন্তু লক্ষ্য করলেন না। এই আলাদা আলাদা ক্ষমতাবান হওয়ার ছদ্ম বিশ্বাসের মধ্যে নিওলিবারেলের আসল ক্ষমতা।
বিশ্বকাপ ফুটবল কেন বিটিভি এখনো বিনামূল্য প্রচার করে এবং ফুটবল নিয়ে উন্মাদনায় জমায়েত হওয়াতে সরকারের কোন আপত্তি নাই কিন্তু অন্য জমায়েত এ আছে সেটা নিয়ে ভাবতে পারেন। অন্যদিকে ইন্টারনেটের প্রবল বিস্তারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনি যখন ভাবছেন আপনি আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছেন, দল তৈরি করতে পারছেন। কিন্তু আসলেই কি সেই শক্তি কোন মানে তৈরি করছে?
ফলে ফারুক ওয়াসিফ যখন বলেন,
“খেলার ফলে তিলমাত্র প্রভাব পড়বে না জেনেও যারা স্ট্যাটাস দিয়েই যাচ্ছে তাদের কী বলে?” এই বক্তব্যের মধ্যে তীব্র শ্লেষা থাকলেও আসলে বেরাজনৈতিক-করণের প্রক্রিয়ার দিকেই ইঙ্গিত করা হয় বলে আমি মনে করি।
তাহলে এই কাতার বিশ্বকাপ, ফুটবল ব্রাজিল আর্জেন্টিনা নিয়ে উন্মাদনা ঐক্য এবং শত্রুতা তার সবই কি মিনিংলেস? আমার তা মনে হয় না। সবই কি নিওলিবারেল ইকোনোমির দাস হওয়া? অথবা মিম নিয়ে সৈয়দ ফিয়াজ খুব দারুণ করেই যখন লেখেন, “A World Cup of memes, fake news and propaganda in the post truth world” সেটাকেও পুনঃপাঠের অবকাশ আছে।
প্রথমত
কাতারের বিশ্বকাপের ভেন্যু হয়ে ওঠা একটা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ। ৯/১১ পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে “ইসলাম ও মুসলিমের” ইমেজ পুনরুদ্ধারের একটা রাজনীতি তো বটেই। পেট্রো মানি যেমন এর একটা অনুঘটক তেমনি “মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপ” ঘোষণার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আরো ধনাঢ্য রাষ্ট্রগুলোকে একত্রে আনার কাজটিও কাতার করেছে। আপনারা খেয়াল করে দেখেছেন নিশ্চয়ই পশ্চিমের সাথে সব মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সম্পর্ক কিন্তু এক নয়। পশ্চিমের সৌদী কাতার প্রেম কিন্তু অটুট। ফলে ফিফা প্রেসিডেন্ট যখন বলেন, “Europe should apologise for next 3000 years: FIFA president Infantino's explosive remarks ahead of World Cup” সেটাকে আপাত দৃষ্টিতে বিরাট ইউরোপীয় রিয়েলাইজেশন মনে হইলেও এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা পিআর। মিশেল প্লাতিনি কাতারের ভেন্যু হবার বিপক্ষে ছিল তবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের কথা শুনে মত পাল্টান। ফলে বিশ্বকাপের ভেন্যু হয়ে উঠতে যে পরিমাণ টাকা ঢালা হয়েছে সেটা নিয়ে ইউরোপীয় গাইগুই থাকলেও কিন্তু সেটা মেনেই নিয়েছে অবশেষে। ইউরোপীয় মানবাধিকার, সমকামিতা, নারীর অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ক “লিবারেল” ভ্যালুসের সাথে আপসই করছে।
দ্বিতীয়ত
সাস্কৃতিক রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে বিশ্বকাপ ব্যবহৃত হবে সেটাও জানা কথাই। সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে সমকামিতার পক্ষে জার্মানী যখন মুখে হাত দিয়ে গ্রুপ ছবি তোলে কিংবা ইরানের টিম যখন জাতীয় সংগীত গাইতে অস্বীকার করে, বা মাসা আমিনির নাম লেখা ২২ নম্বর জার্সি নিয়ে চোখে রক্তাক্ত অশ্রু নিয়ে স্টেডিয়ামে হাজির হন ইরানী নারী, বা পুরো স্টেডিয়াম পরিষ্কার করতে রয়ে যান জাপানী দর্শক। সবখানেই কিন্তু বিশ্বমঞ্চে নিজেদের উপস্থাপণ করার এবং সাংস্কৃতির রাজনীতির প্রেক্ষাপট রয়েছে। সেটার ধাক্কাতেই যে মজার মিম বের হল লা-ইব কে নিয়ে কারো কারো উচ্ছাস এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে বিরক্তি সেটাও স্থানীয় এনগেজমেন্টকেই নির্দেশ করে। সৌদীর জয়ে আপনার উচ্ছাস তো উম্মাহ উচ্ছাস।
তৃতীয়ত
কাতারের এই মহাজজ্ঞে আপনার রাজনীতি কোথায় দাঁড়াইলো? সেই আশির দশকে শুরু হওয়া শ্রমিকের দল তো অনেক ভারী এখন; অর্থনীতিতো তাঁরাই দাঁড় করায়ে রাখছে। কিন্তু আপনি কই? জাতীয়তাবাদী টান থেকে বাফুফের প্রেসিডেন্টরে ট্রোল করেন তো ঠিকই কিন্তু দৌড় ঐ কাতারের মাঠে নিজেকে দেখানোর মধ্যে দিয়েই। এর মানে কি? এর মানে হইল আপনি বিশ্বমঞ্চে শ্রমিক বা অধিকতর ধনী মধ্যবিত্তই। আপনার না নায়ক আছে না আছে নিজের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা। এখানেই আপনি বেরাজনৈতিক হইতে শুরু করলেন। আপনি আরো বেরজানৈতিক যখন আপনি নাভীশ্বাস কাটাইতে ফুটবল নিয়া মাইতা থাকেন। মাইতা না থাকলে যে বাস্তবতা তারে আপনি চোখে চোখ রাইখা দেখতেও নারাজ আর বিশ্বাসও করেন না যে এটার কোন পরিবর্তন সম্ভব। ফলে ফিফা আপনাকে পাগলা দর্শকের আসনেই দিয়া রাখে। আর পাগলা দর্শক হবার মধ্য দিয়েই আপনার যাতায়তের সমাপ্তি।
ম্যারোডোনা থেকে পৃথিবী এগিয়ে গেছে বহুদিকে, নায়কের দরকার নাই বলেই আপনাকে শিখাইছে। কিন্তু নারী ফুটবলাররা যখন সত্যি সত্যি ট্রফী নিয়া আসে তখন তারে মানতে আপনার উচ্ছাস কম, তাইলে হবে? হবে না।
ফলে, নাসরিন সিরাজ, যখন বলেন,
“কিছু মানুষ আছে যারা মনে করে ফুটবল আফিম, ক্রিকেট আফিম, ফেসবুক আফিম, আউট বই আফিম, প্রেম করা আফিম....
শুধু রাষ্ট্র নিয়ে ভাববেন। না হয় মরণ নিয়ে ভাববেন। আল্লা কে ভয় পাবেন। নয় রাষ্ট্রকে। গরীব-শ্রমিক নিয়ে ভাববেন। ভাববেন আর গলা দিয়ে ভাত নামবে না….. রাষ্ট্র, ইলেকশান, বিয়া এইগুলা আফিম না। খুব একটা না-আফিম।“
যথার্থই বলেন। আফিম সবসময়ই ছিল থাকবে এবং আফিমকে পরিবর্তনে রূপান্তর করতে হবে।
আমি তো দেখতে পাই মানুষ গ্লোবাল ঐক্য-র জন্য একত্র বোধ করার জন্য আকূল হয়ে রয়েছেন। এখনো ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা নিয়ে ভীষণ যূথবদ্ধতা ফিল করেন। তবে সেটা জম্বী বানাতে যেমন হেল্প করবে তেমনি নেশা কাটাতেও হেল্প করতে পারে। নায়কের গুরুত্ব কমবে না, সেটা যেই জেন্ডারই হোক। সামনের সময়টা নেশা কাটানোর কাল। যে যতদ্রুত নেশা কাটাবেন ততদ্রুত ক্ষমতাবান হয়ে উঠবেন। বাংলাদেশের তরুণ জনসংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি এখনি সময় নেশা কাটানোর। আর এখনি সকল রকমের নেশার চাপ বাড়তে থাকবে। ফলে খুব খেয়াল করে জনগণ।
সূত্র:
https://www.facebook.com/Babu.Ahmd/posts/pfbid02Hwcv3eYHnEQD199hn2TCnx3cV9p6auwv1PYbo9BK7a4Bbf5BvxogGgRQbzpdJQ5El
https://www.facebook.com/aritro/posts/pfbid0pFghuRAQ6ykzpU5muToCzt23zVzZoe48xxaj4Eoz3ev8kwCJTChkNoGR5xPQcLoJl
https://www.facebook.com/nasrin.siraj
https://www.facebook.com/raisu.page/posts/pfbid02JQNmQ4oyPgHzGYDioqmQTjbcG53ykfp4JbVjjFcLaSTzLrNK3ehJawg1axX1wUhrl
https://en.prothomalo.com/sports/football/btso1618ne
https://www.facebook.com/ESPNFC/videos/651207836714147
https://www.facebook.com/kawser.shakil.3/posts/pfbid0jknJx1TiPjYuz9NmqJRfR5wT52qMpPYPThEpGbnBwWRLVj5q3jpMXeDCD6HKAbhql
https://www.indiatoday.in/sports/football/story/fifa-president-gianni-infantinos-explosive-remarks-ahead-of-football-world-cup-qatar-2299227-2022-11-19
https://www.facebook.com/rudrarothi/posts/pfbid037VHTFDMQ3CDjCDMVvFmogtAsJYHYGUBRJNseezFn2gvdG8kQ7M27uuYCURMbxWkol
০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:৩৪
শরৎ চৌধুরী বলেছেন: সৌরভ, সরি উত্তর দিতে দেরী হল। আপনি যে চট করে শৈল্পিকতা আর রাজনৈতিক অর্থনীতিটা ধরতে পারলেন এরজন্য শুভেচ্ছা অশেষ।
২| ৩০ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:০৮
রাজীব নুর বলেছেন: আপনি যে বয়সে পাকনা ছিলেন, তখন আমার জন্মও হয়নি।
যাইহোক, খুব সুন্দর করে লিখেছেন। পড়তে গিয়ে বিরক্ত লাগেনি। এক পোষ্টে অনেক কিছু উঠে এসেছে।
০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:৩৫
শরৎ চৌধুরী বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ রাজীব। শুভেচ্ছা জানবেন। সরি উত্তর দিতে দেরী হল।
©somewhere in net ltd.
১| ২৯ শে নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:১৬
স্বপ্নবাজ সৌরভ বলেছেন: চমৎকার লেখা।
৯০তে ম্যারাডোনায় ছিলাম , যদিও ব্রাজিলের সাপোর্টার । আব্বা একটা পোস্টের এনে দিলেন। আব্বা ব্রাজিলের সাপোর্টার। আমি বললাম , ম্যারাডোনা তো আর্জেন্টিনার। আব্বা বললেন , তাতে কি।
১৯৯৪ তে বিশ্বকাপ জিতলাম।
ল্যাটিন শৈল্পিকতা শেষ হয়ে গেছে ২০০২ তে। সেটা আর ফিরবেন না।