নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এ কে সরকার শাওন ১৯৬৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী ব্রাহ্মণবাড়িয়া নবীনগরের গোপালপুরে জন্মগ্রহন করেন। পিতা মো: আবদুল গনি সরকার একজন সরকারী কর্মকর্তা এবং মাতা মিসেস সালেহা গনি সরকার একজন আদর্শ গৃহিনী ছিলেন।\n\nশিক্ষা জীবনের শুরু ঝালকাঠির উদ্ধোধন হাই স্কুলে। ১৯৮৩ সা

এ কে সরকার শাওন

Writer, Organizer & Creative Director

এ কে সরকার শাওন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নির্বাসিত গোধূলী

১২ ই মার্চ, ২০২০ রাত ৮:৫২

জগলু ঢাকার বাহিরে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় তিনশ ফুট রাস্তা দিয়ে অফিসে যাতায়ত করে। যতবার আসা যাওয়া করে ততবারই তার মনে হয় পূর্বাচল একটি কৃত্তিম-শৌখিন শহর হতে যাচ্ছে। পাকিস্তানের মত হঠাৎ গজানো স্থান। স্বার্থপরতা ও ধনী-গরীব বিভাজন দোষে দুষ্ট! ভারতের কয়েকটি রাজ্য নিয়ে হঠাৎ পাকিস্তান গজিয়েছিল। ইংরেজদের শাসনের মূলনীতি ছিল, “Divide & Rule”। অবশ্য সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত যে ক্ষমতায় আসে সে ই এই কালো নীতি বেদবাক্যের মত অনুসরণ করে। অনেকটা যে যায় লন্কায় সে হয় রাবনের মত! স্যার শেরিল র‌্যাডক্লিফ এর নামে নামাঙ্কিত র‍্যাডক্লিফ রেখার ভিত্তিতে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় ৫টি প্রদেশকে ভাগ করে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক দেশ গঠন করা। ১৯৩১ সালের আগে কেহ পাকিস্থান শব্দটি শোনেনি। ইংরেজরা যখন দেখলো ওরা ভারতবর্ষকে আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না। তখনই তাদের ট্রাম্প কার্ড এই বিভাজনের নীতি প্রয়োগ করলো। যাবার আগে ভারতকে দুই টুকরা করে গেল। যাতে এদের ঝগড়া-বিবাদ মিটাতে দূর থেকেও মাতব্বরি করতে পারে। আজও তাই করছে।

১৯৩২ সালে চৌধুরী রহমত আলি ৩ হাম্বারস্টোন রোডের একটি বাড়িতে উঠেন। এই বাড়ির একটি কক্ষে তিনি সর্বপ্রথম ‘পাকিস্তান’ শব্দটি লেখেন বলে জনশ্রুতি আছে। ১৯৩৩ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি তার ধারণা “নাউ অর নেভার; আর উই টু লিভ অর পেরিশ ফরএভার?” পুস্তিকায় প্রকাশ করেন। এই বইটিই পাকিস্থান গঠনের নিউক্লিয়াস! ভারতের উত্তরের পাঁচটি প্রদেশের প্রথম ও শেষের দিকের অক্ষর নিয়ে গঠিত করা হয় নুতন দেশের নাম। যেমন প্রদেশ পান্জাব শব্দটির প্রথম অক্ষর পি (P), আফগান শব্দটির (সীমান্ত প্রদেশ) প্রথম অক্ষর এ (A), কাশ্মীর শব্দটির প্রথম অক্ষর কে (K), সিন্ধু শব্দটির প্রথম অক্ষর এস (S) ও বেলুচিস্তান শব্দটির শেষের তিনটি অক্ষর তান (TAN) নিয়ে গঠিত হয় পাকস্থান (PAKSTAN)। পরে উচ্চারণের সুবিধার্থে কে (K) অক্ষরের পর আই (I) যোগ করে ‘ই’ উচ্চারন দিয়ে করা হয় পাকিস্থান (PAKISTAN )।

রাজউকের পূর্বাচলও তেমনি হঠাৎ মানুষের সৃষ্টি করা। ১৯৯৪ এর আগে দেশের কেহ পূর্বাচল শব্দটি শোনেনি। আমাদের দেশের সব শক্তি এক ব্যাক্তি কেন্দ্রীক। পাপিয়া থেকে বাংলা ভাই সবাইকে ধরতে কেন্দ্রের নির্দেশ প্রয়োজন। তেমনি মানুষও সব কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করে। উপজেলা সদর, জেলা সদর এবং বিভাগীয় সদরে জনসংখ্যার ঘনত্ব গ্রামের তুলনায় অনেক বেশী। সবচেয়ে বেশী চাপ ঢাকার উপর। সেই কারনেই ডেপ (Details Area Plan), পূর্বাচল ইত্যাদির সৃষ্টি। রাজউকের পূর্বাচল ঘোষনার পর পরই সরকারী বেসরকারি সবার হিড়িক পড়ে গেল। নানান চটকদার নামে আবাসন ব্যবসার স্বর্ণযুগ শুরু হলো। জমির মালিকগণ ভুমিদস্যুদের কাছে জিম্মি। গুলিতে লোকও মারা গিয়েছিল। সর্ব ক্ষেত্রেই সাধারন লোক ও কৃষক চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের পাশে কেউ আন্তরিক অর্থে দাড়ায়নি। আসলে উন্নয়নশীল দেশে সবচেয়ে বড় কৌতুক যখন কোন চেয়ার বলে সে কৃষক বান্ধব। চেয়ারগুলি প্রচ্ছন্নভবে বান্ধব হয় মিলিটারির, পুলিশের, ধর্মীয় গোষ্ঠীর, আমেরিকা ইত্যাদির! যাই হোক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের ঢাকায় থাকার খায়েশের মিলনের ফসল এই আধুনিক হবু শহর। যার জন্য আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বিলীণ হলো ইউসুফগঞ্জ, ভোলানাথপুর, পর্শি, হারার বাড়ি, ধামচি, গুচ্ছগ্রাম, জিন্দা, গোবিন্দপুর, কালনী, খাইলসা, কুলাদী, ব্রাহ্মণখালী, শিমুলিয়া, রঘুরামপুর, মাঝিপাড়া, পাঁচভাগ, মাইজগাঁও, কামারপাড়া, কেন্দুয়া, বাড়িয়ারটেকসহ প্রায় ৩০ গ্রাম। একসময় এই গ্রামগুলির নাম গুগলে সার্চ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু, বংশী ইত্যাদি নদীগুলি ইতিমধ্যে পূর্ণ বা অর্ধ ড্রেন হয়ে গিয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী ডেন হলে আমরা চুনোপুটিরা ড্রেনে নাক ডুবিয়ে আরামে বসবাস করবো। রাঘব বোয়ালরা তো সুইস ব্যান্কে টাকা জমিয়ে রেখেছে। প্রায় সবাই বিশ্বের কোন না কোন দেশে বাড়ি-গাড়ি করে রেখেছে। দেশের দুসময়ে বিমানে চম্পট দেবে দুধের মাছিগুলো। ওরা তিন সময়ে দেশে আসবে প্রতিষ্ঠানের লাভের ঘি তুলে নিতে, নির্বাচনে নমিনেশনের টিকিট কনফার্ম হলে এম পি মন্ত্রী হবার খায়েশে ও করোনার মত মহামারীতে আক্রান্ত হলে! পূর্বাচল প্রকল্পে অনেক লোক এখন প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় রয়েছে। কেউ জমি দিয়ে, কেউ জমি না দিতে গিয়ে, কেউ প্লট কিনে, কেউ প্লট পেয়েও না বুঝে সস্তায় বিক্রি করে সর্বশান্ত। জগলু যতবার তিনশত ফুট রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করে ততবার তার কানে ধ্বনিত হয় নির্যাতিত গরীবের হাহাকার, আআর্তচিৎকার, আহাজারি ইত্যাদি! জগলু স্থির করলো একদিন অফিসের গাড়ী ছেড়ে নেমে পরবে পূর্বাচল দেখতে।

বৃহস্পতিবার জগলুর হাফ ছেড়ে বাঁচার দিন। কারন পরের দিন অফিসে যাবার চাপ নেই। স্ত্রী সন্তান নিয়ে আরামে আয়েশে কথাবার্তা বলা যায়। বেশী রাত করে ঘুমাতে গেলেও কোন সমস্যা নেই। জগলুর বউ কানিজ বাড়ি ও অফিসে কর্মব্যস্ত থাকলেও বৃহস্পতিবার রাতের ও শুক্রবারের দুপুরের খাবারের ব্যাঞ্জনা আনে!

আগামীকালের শুক্রবারটা ২১ ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। নানান প্রোগ্রামে ব্যাস্ততায় থাকবে সবাই। এখন রাত এগারটা বাজে। অন্যদিন হলে দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তো।
-: কি চোখে ঘুম নাই? শয়ন কক্ষের দরজা লাগাতে লাগাতে কানিজ প্রশ্ন করলো।
-:কাল সকালে তো তুমি তোমার স্কুলে যাবে? শহীদ মিনারে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। জগলু কানিজকে প্রশ্ন করলো।
-:হ্যা, যেতেই হবে। নানান অনুষ্ঠান আছে।
তুমি বের হবে না কিন্তু। সর্দি চৌধুরীর মত থান্ডা লেগে আছে। একদিন রেষ্ট করলে যদি কিছুটা ঠিক হয়।
-:না রেষ্ট নয়! একুশের দিনে রেষ্ট করলে নীজেকে অপদার্থ অপদার্থ মনে হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাব।
-: না। ওত দূরে যাবার দরকার নেই। আমার সাথে আমার স্কুলে চলো।
-:শর্ত সাপেক্ষে যেতে পারি।
-: কি সেই শর্তাবলি শুনি!
-: স্কুল চত্তরে যাবার পর আমি আমার মত করে ফুল দিব, চারপাশটা ঘুরবো, বৃদ্ধ ও শিশুদের সাথে কথা বলবো ছবি তুলবো ইত্যাদি!
-: ঠিক আছে! ঠিক আছে! এখন ঘুমাও।

সকালে ঘুম থেকে অন্যদিনের মতই ভোর সাড়ে পাচটায় উঠতে হলো। জগলুর কাছে মনে হলো যেন চাকরী করতে যাচ্ছে। একটা সিএনজি নিয়ে কানিজ ও জগলু কানিজের স্কুলে চলে এলো।
বিশাল মাঠ। ছাত্র-ছাত্রীগণ সবুজ-সাদা পোশাকে মাঠে ছুটাছুটি করছে! মাঠের পূর্বদিকে স্কুলের মূল ভবন দীর্ঘ একতলা বিল্ডিং। উপরে লিখা ৩২ নং শশীপূর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাঠের উত্তর পাশে সুদৃশ্য প্রাক-প্রাথমিক ভবন। উত্তর-পূর্ব দিকে দুই ভবনের মাঝে সুন্দর একটি শহীদ মিনার। অনেকগুলি ছাত্র-ছাত্রী শহীদ মিনারে জটলা পাকিয়েছে। মনে হচ্ছে ম্যাডাম স্কুলটাকে বেশ পরিপাটি করে রেখেছে। জগলু কানিজকে বললো, তুমি তোমার কাজ কর আমি একটু স্বাধীনভাবে উন্মুক্ত আকাশের নীচে ঘোরাফেরা করি!
-:শহীদ মিনারে ফুল দিবে না?
-: অবশ্যই দিব। তোমাদের স্কুলের অনুষ্ঠানাদি আগে শেষ হোক।

কানিজ স্কুলের ভিতরে চলে গেল। জগলু চলে গেলো দক্ষিণ দিকে চা-ষ্টলের দিকো। দোকানীর নাম রহমত। সকাল বিকাল তার চায়ের দোকানে বহু খদ্দের আসে। বেকারত্বের অভিশাপে ভুক্তভোগীরা চায়ের কাপের ধোয়ায় নিস্ফল আড্ডায় মাতে। শীত শীত ভাবটা আছে। জগলু চা খোর না তারপরও দোকানীকে বললো এক কাপ দুধ চা দিতে। দুধ চায়ে ব্যবসা কম তাই হবে না। এক কাপ রং চা নিলো। সেখানে আরও পাঁচ ছয় জন টিভি দেখছে। দুই একজন চলে যাচ্ছে বটে আবার নূতন করে কেউ এসে জড় হচ্ছে। জগলু চা পান করতে করতে ওদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। ওরা সবাই পূর্ণ বেকার। সারাক্ষণ সমালোচনা, পরনিন্দা ও পরচর্চাই করছে। মশার দাপটে দিনেও মশারী টানাতে হয়, ওয়াশার পানি মুখে দেবার জো নাই, ভোটাভোটি তে পাবলিকের আগ্রহ নাই ইত্যাদি কথাও আলাপে উঠে আসছে! প্রায় সময়ই জগলু ভাবে এদের যদি ফ্রি ল্যান্সারের মত কাজে লাগানো যেতো! জগলুর টাকা হলে বিষয়টি নিয়ে বিষদভাবে ভাববে।

চা পানের পর স্কুলের পিছনে গেল। একটু এগুতেই দেখলে একটি এক চালা ঘর। সেখান থেকে একটু দূরে এক লোক গরুর দুধ দোহন করছে। লোকটি জগলুকে দেখে সালাম দিলো। জগলু উত্তর দিয়ে সহজেই তার সাথে বসে কথা বলতে লাগলে। জগলু পারেও অকপটে সবার সাথে মিশে যেতে। এইজন্য বন্ধুরা এই ব্যাপারটি নিয়ে বাঁকা চোখে দেখে জগলুকে বলতো সমস্বত্ব দ্রবণ। সেই লোকটির নাম কামাল মিয়াঁ। দুধ নিয়ে এসে সে তার উঠানের দিকে যাচ্ছিলো। জগলু থমকে দাঁড়িয়ে জিগেস করলো, “আমি কি আপনার বাড়ির ভিতরে আসতে পারি?”
সে হেসে বললো,
” হ আয়েন আয়েন। ” যেতে যেতে কামাল মিয়া জিগেস করলো, “স্কুলের একুশে ফেব্রুআরিতে আইছেন?” জগলু ইচ্ছে করেই উত্তরটা চেপে গেলো। জগলু বড় ম্যাডামের হাবী শুনলে ওরা আপ্যায়ণে মেতে উঠবে। গরীব হলো আসল বড়লোক। তাদের কলিজা বিশাল হয়। ১৯৯৮ সালে চাটগায়ে জগলু, তার চাপাইয়ের দুই সহকর্মী গোলাম মোহাম্মদ ও গোলাম মোস্তফা দেড় লাখ টাকায় তিনটি কম্পিউটার কেনার পর কম্পিউটারের বনেদী প্রতিষ্ঠান তাদেরকে মাত্র তিন কাপ রং চা অফার করেছিল। গত ১০ ডিসেম্বর জগলু গিয়েছিল একটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সাথে দেখা করতে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর ব্যাস্ত ছিলেন। জগলু একজন কর্মকর্তার ফাঁকা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিল। এমন সময় অফিস সহকারী সবাইকে প্যাকেটে শুকনা নাস্তা দিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিজেদের প্রোডাক্ট। নীজেদের অনেকে নাকও সিটকালো। জগলু বহিরাগত বিধায় কেউ তাকে কার্টেসি রক্ষার্থেও অফার করে নি। আগন্তকের সামনে বসে কটর মটর করে খাচ্ছে সুট টাই পরা অফিসার। এই ধরনের খাবার জগলুর খুবই অপছন্দ। কিন্ত তাদের সৌজন্যতাবোধটা সে বুজতে পেরেছে।
চলেন স্যার! কামাল মিয়া বললো
হুম চলেন ভাই! জগলু পিছে পিছে চললো। উঠোনে ঢুকতেই জগলুর চোখে পড়লো, পনেরো ষোল বছরের এক বালক ঘরের সামনে বসে দুটি সুন্দর ছাগল ছানাকে দুধ খাওয়াচ্ছ। জগলু বললো, ” ছাগলছানা দুটোকে দুধ খাওয়াচ্ছেন কেনো, এদের মা কোথায়?” কামাল মিয়া জবাব দিলো, ” টাকা পয়সার সমস্যা আছিলো তো, তাই বেইচ্চা দিছি। ”
জগলু বিস্মিত হয়ে বললো, ” কি সাংঘাতিক, দুধের বাচ্চা রেখে ছাগল টাকে বিক্রি করে দিলেন! আপনি যখন দুধের বাচ্চা ছিলেন, তখন আপনার মা’কে দূরে বিক্রি করে দিলে কেমন লাগতো?” “হ কাজটা অন্যায় হইছে তয় টাকার দরকার আছিল। ” কামাল মিয়ার সহজ সরল স্বীকারক্তি। ” জগলু বললো, আপনারা তো বড়লোক, এখানে প্লট পাইছেন নিশ্চয়ই।
“হ একটা পাইছলাম, এই যায়গা যে এতো উন্নত হইবো বুঝবার পারি নাইক্যা, অনেক আগেই না বুইজ্জা বেইচ্চ্যা দিছি। টাহার দরকার আছিল।
-:তাহলে এটা কার বাড়ী?
:এটা, ঐটা এবং মাঠটা স্কুলের প্লট।
কবে যে উঠিয়ে দেয়! বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো কামাল মিয়া।
জগলু জিজ্ঞেস করলো নোটিশ দিয়েছে?
এখনো দেয় নাই। নোটিশ দিবে শীঘ্রই! কোথায় যে যাই। ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কামাল মিয়া।
জগলু বললো, ” ব্যাপার টা খুবই দুঃখজনক! জগলু দুঃখের কথা শুনতে পারে না। মনে বড্ড কষ্ট লাগে! ধনী লোকের মন থাকে না। জগলু গরীব হলেও তার মনটা সজীব ও আকাশের মত বিশাল। সে প্রার্থনায় বলে, “হে প্রভু ধন চাই না। মনটা চিরদিন সতেজ ও অনুভুতিশীল রেখো। ” জগলু দেখলো একটু উত্তরদিকে একটি একচালা। তার নীচে তেল চিটচিটে কাথায় একজন বৃদ্ধা। কামাল মিয়া তাকে আশ্রয় দিয়েছে। সেই বৃদ্ধার একটি ভাই আছে। ওরাও ২টি প্লট পেয়েছিল। আপন ভাই সেই প্লটগুলো বিক্রি করে বোনকে ঠকিয়ে রাজধানীর বুকে মমিন সেজে আছে। পিতার সম্পত্তিতে ভাই বোনের দ্বিগুন পায়। এটা ফরায়েজী আইন। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনেও উল্লেখ আছে। অথচ আপন ভাই বোনকে ঠকায়। এই এক জায়গায় মমিন, কমিন, শিক্ষিত, মুর্খ, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সবাই এক। ইনিয়ে বিনিয়ে রিনরিনিয়ে বোনকে বঞ্চিত করবেই। যত ভদ্রই হোক কাউকে ঠকাতে না পারলেও বেশীরভাগ লোক আপন বোনকে ঠকাবেই ঠকাবে। জগলুর ছেলে নাই তার জন্য দুঃখবোধতো নাইই। বরং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে তিনি জগলুকে তিন তিনটি রাজকন্যা দান করেছেন। তাদের নিয়ে জগলু গানও বাঁধছে, “আমার তিনটি মা যেন সোনার প্রতিমা!” একটি হারামজাদা ছেলে থাকলেই তার মেয়েদের ঠকিয়ে বাড়ীছাড়া করতো। বিয়ের পর তার মেয়েরা নীজের বাড়িকে নীজের বাড়ি বলতে পারতো না। যেখানে বোনের সম্পদ ভাই অবলীলায় মেরে খায় সেখানে অন্যদের কাছে কি আশা করা যায়!

কামাল মিয়ার বাড়ী থেকে বের হয়ে জগলু মনমরা। ধীরে ধীরে হাটছে আর ভাবছে…
এই জনপদে একদা দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মাঠ ছিল। যা অগ্রহায়ণে সোনালী চাদর হয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফোটাতো। কবি এ কে সরকার শাওনের ভাষায়,
“ধানে ধনে যশ জৌলুশে
কৃষাণের চোখে রোশনাই ঝরে!
ঠোটের কোনে হাসি ফুটিয়ে
সোনালী ক্ষেতে চায় ফিরে ফিরে!”

ঘাস ফড়িং, প্রজাপতি, পাখ পাখালী পরিবেষ্টিত সবুজ সোনার গ্রামগুলি ছিল নানান পদভারে মুখরিত। বাবার শাসনে, মায়ের ছায়াতলে, বোনের আদরে ছিল পরিবারগুলি। বক, ডাহুক, কোকিল, ঝিঁঝিঁ পোকার পিছনে ছুটে দূরে হারিয়ে যেত দুরন্ত কিশোর। নদীতে জেলেরা রাত জেগে মাছ ধরতো। খেয়ার মাঝি গলা ছেড়ে গান ধরতো, “আমি কেমন করে পত্র লিখিরে বন্ধু… ” আজ সবই স্মৃতি! পূর্বাচলে গেলেই মাইকেল জ্যাকসনের আর্থ সং টি ভেসে ওঠে জগলুর মানসপটে। আজ পূর্বাচল স্বকীয়তা ছেড়ে আধুনিক মেকী শহরের মেডেলধারী।
গ্রাম হঠাৎ করে শহর।

সেই যশবান কৃষকেদের অনেকেই আজ উদ্ভাস্ত! জগলু মনে মনে অনুধাবন করলো এই কামাল মিয়াঁর মতো অনেকেই আজ প্লট হারা। না বুঝে পেটের দায়ে বিক্রি করে দিয়েছে প্যান্ট টাই পরা ধনী লোকদের কাছে। আজ তারা নিজ ভূমে পরবাসী। কামাল মিয়া যেই বাড়িটিতে থাকছে তা স্কুলের সম্পত্তি। যে কোদিন তাকে বসতবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে অজানা ও অনিশ্চয়তার পথে। তাদের দুঃখ, বিরহ ব্যাথা হারিয়ে যাবে রঙ্গীন আলোর ঝলকানিতে। এদের কথা কোথাও লিখা থাকবে না। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে যাচ্ছে! একটি ট্রাক দ্রুতগতিতে জগলুর পাশ দিয়ে ধুলোর সাগর ছড়িয়ে চলে গেল। গোধূলীর পরিবর্তে দানব ট্রাকের ছড়ানো ধূলিতে জগলু হারিয়ে গেল ধূলোর রাজ্যে পূর্বাচলের গ্রামগুলির মত!
গল্পঃ নির্বাসিত গোধূলী

গ্রন্থঃ কালো আকাশের নীচে
বৃহঃস্পতিবার, ১২ মার্চ ২০২০
shaonaz, Dhaka.

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.