নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শারিয়া মোস্তাফিজ সিমি

কো-ফাউন্ডার, শারিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

শারিয়া মোস্তাফিজ সিমি › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার শরীর জুড়ে তোরই গায়ের গন্ধ মেখে আছে.....

১০ ই আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৪:০৪



অনেকেই আমার কাছে শারিকের ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। এই লেখাটা তাঁদের জন্য। প্রতিটি শব্দের সাথে মিশে আছে আমাদের হাহাকার, কান্না। এই লেখাটা শারিকের স্মরণে।

আমার ছেলেটা হয়েছে ৩৪ সপ্তাহে। আগস্টের ১৬ তারিখে ডাক্তার মারুফের সিজারের তারিখ দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু ও হয়ে যায় আগস্ট মাসের ৯ তারিখ, শনিবার, দুপুর ১ বেজে ৩০ মিনিটে।
কোন ধরনের সমস্যাই আমার ছিল না প্রেগন্যান্সিতে। থ্যালাসেমিয়ার রোগী হওয়া সত্ত্বেও ১ ব্যাগ রক্তও দেয়া লাগেনি আমাকে। পলিসিসটিক ওভারি থাকা সত্ত্বেও সহজ, স্বাভাবিক নিয়মে আমি আমার প্রেগন্যান্সি পিরিয়ড পার করেছি।

শেষ শপিং করতে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে আম্মুর বাসায় ঢোকার আধা ঘণ্টার মধ্যেই পেইন শুরু হয়। তারপর কোনমতে রাত ৩টা পর্যন্ত টিকেছি। রাত সাড়ে তিনটায় আনোয়ার খান মডার্নে ভর্তি হই।

অপারেশান থিয়েটারে আমি ডাক্তারদের সাথে গল্প করেছি। শান্তভাবে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করেছি। বাবুকে যখন টেনে পেট থেকে বের করছিল তাও টের পেয়েছি। এরপর রাজপুত্রটাকে যখন আমার চোখের সামনে আনে তখন খুশিতে চোখে পানি চলে আসে...।

৪ দিন হাসপাতালে ছিলাম। কোন সমস্যাই ছিলনা আমাদের মা-ছেলের। দিব্যি আমি হেঁটে বেরিয়েছি। রাত জেগে ওকে দেখাশোনা করেছি। স্বামীর সাথে গল্প করেছি। বাবুও চুকচুক করে তাঁর খাবার খেয়েছে আর রাজ্যের ঘুম ঘুমিয়েছে। মাঝে মাঝে আওয়াজ দিয়ে কোলে উঠে বসেছিল। পিটপিট করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।


১২ তারিখ রিলিজ দিলে প্রথম ওর নানু বাড়িতে যাই। উদ্দেশ্য ৩ দিন থেকে তারপর আমার বাসায় চলে আসবো। দুপুর নাগাদ আম্মুর বাসায় পৌছাই। সবার মাঝে খুশির আমেজ। ওর দাদা-দাদি, নানা-নানি মজা করছে। নাতি নিয়ে আদর সোহাগ করছে। আর আমরা দুই চোখ ভরে দেখছি। বিকালে রাজপুত্রকে কোলে নিয়ে আমি নিজেই সবার বাসার উদ্দেশ্যে মিষ্টির ডালা রেডি করে দিলাম। মিষ্টি পাঠানো শেষ করে রাজপুত্র তার দাদা-দাদি আর নানা-নানির জন্য কেনা উপহার তাঁদের হাতে তুলে দিলো।

বিপত্তি শুরু হল রাত সাড়ে ১১টার দিক থেকে। এত্ত ঘুম ওকে পেয়ে বসলো যে উঠেই না। টানা ১২ ঘণ্টা আমার ছেলেটা না খেয়ে থাকলো। শুধুই ঘুমায়। ভোর নাগাদ আমার আম্মু বলল বাবু নাকি হলুদ হয়ে গিয়েছে।

১৩ তারিখ সকাল হতেই ৯ টার ভেতর আনোয়ার খান মডার্নে চলে আসলাম। বাবুর ডাক্তার ছিল মুমতাহিনা সেতু। ওকে দেখে বললেন যে সামান্য জন্ডিস হয়েছে। একদিন ফটোথেরাপি দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। কেবিন নিতে চাইলে উনি বললেন ওয়ার্ডের ট্রিটমেন্ট নাকি বেশি ভালো। সবসময় ডাক্তার থাকে, একদিনের ব্যাপার।

ওয়ার্ডেই ভর্তি হলাম। অনেকগুলো রোগীর সাথে আমরাও একই রুমে। ছেলেটাকে যখন চোখে পট্টি বেঁধে ফটোথেরাপির মেশিনে ঢোকাল, তখন তার কি কান্না! ডাক্তারের কড়া নিষেধ। কান্না করলেও কোলে নেয়া যাবেনা। টানা ৩ ঘণ্টা পর নেয়া যাবে। আমি একা একা ছেলেটার পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতাম। মনটাকে শক্ত করে রেখেছিলাম। দ্রুত বাবু সুস্থ হয়ে যাবে।

সেইদিন রাত ৮টার দিকে ডাঃ সেতু এসে চিন্তিত মুখে জানালেন ওর রক্তে নাকি একটু সমস্যা ধরা পড়েছে, একদিনের জন্য আইসিইউ-তে বাবুকে রাখা লাগবে। সেখানে আমিও যেতে পারবোনা। বাবুর ক্ষুধা লাগলে নার্সরা আমাকে ডেকে নিয়ে যাবে।কাঁদতে কাঁদতে ওকে আইসিইউ তে পাঠিয়ে দিলাম। জানতাম না, সেখান থেকে ও আর ফিরবে না।

১৩ থেকে ১৪ এই দুইটা দিন ডাক্তাররা ডাকলে আমি গিয়ে ওকে খায়িয়ে এসেছি। ছেলে আমার একটান- দুইটান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। ডাক্তাররা শুধু আশার বাণী শুনিয়ে বিদায় দিয়ে দিতো।


১৫ তারিখ রাত ১২টা থেকে আমার কানে যেন শুধু বাবুর কান্নার আওয়াজ আসছিল। অথচ আমি ৩ তলায় কেবিনে। আর ও ৫ তলায় আইসিইউতে। ওর বাবাকে অনেক বার বললাম যে আমাকে একটু নিয়ে যাও ওর কাছে, ও মনে হয় কাঁদছে। কিন্তু উনি মায়ের মনের আবেগ মনে করে নিষেধ করেছিলেন। রাত আড়াইটায় আমি বললাম তুমি না নিয়ে গেলে আমি নিজেই যাবো। আমার ছেলের কষ্ট হচ্ছে, ও আমাকে ডাকছে। অতঃপর উনি বাধ্য হয়ে আমাকে নিয়ে ৫ তলায় গেলেন।

লিফট থেকে নেমেই আমরা কান্নার আওয়াজ পেলাম। আইসিইউ-র সামনে গিয়ে দেখি লাইট বন্ধ। পাশের ডাক্তারদের ওয়েটিং রুম থেকে হাসাহাসির আর চিল্লাচিল্লির আওয়াজ স্পষ্ট। দুই/তিন বার নক করার পর অন্ধকার আইসিইউ থেকে চোখ ডলতে ডলতে নার্স বের হলেন। আমি বললাম আমার ছেলেটা মনে হয় কাঁদছে, একটু দেখেন। উনি বললেন ২৪ টা বাচ্চার মধ্যে কোন বাচ্চা না কোন বাচ্চা কাঁদছে, আর আপনি কিভাবে বলেন আপনার বাচ্চা কাঁদছে? লাইট জালানোর পর দেখা গেলো আমার রাজপুত্রই গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। যেই তুলা দিয়ে ওকে মুড়ানো ছিল টা পুরো প্রস্রাবে ভিজে গিয়েছে। ঠাণ্ডায় বাচ্চা কান্নাকাটি করছে। আমি দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাকে ঠিক করে দিয়ে আসলাম।

আমার স্বামী কিছুই বললেন না, শুধু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

সকাল হতে না হতেই আমি আবার গেলাম আইসিইউতে। ওকে দুধ খাওয়ানোর সময় খেয়াল করলাম ওর গলার নিচে মশার কামড়ের মত ছোট ছোট লালচে দাগ। উল্টে পাল্টে দেখলাম হাতেও আছে, মনে হচ্ছে যেন চামড়ার নিচে রক্ত জমে লালচে হয়ে আছে। নার্স ডেকে দেখালাম। সাথে সাথে ডাক্তার আসলেন। দেখেই উনি আমাকে আইসিইউ থেকে বের করে দিলেন। সেই যে বের হলাম আর ঢুকতে পারলাম না। এরপর থেকে মুখে দুধ দেয়াও বন্ধ করে দিলো, নলে করে খাবার দিতো।

শুক্রবার ১৫ আগস্ট ডাক্তার জানালেন নবজাতকদের রক্তে অন্তত ৫০০০০ প্লাটিলেট থাকতে হয়। শারিকের এখন আছে ৪০০০০। ওকে প্লাটিলেট দেয়া লাগবে। দ্রুত ব্যবস্থা করতে বললেন। এটার পদ্ধতিও আলাদা। শুধুমাত্র বাংলাদেশ মেডিক্যাল এবং কোয়ান্টাম মেথডে এটা করা যায়। প্রথমে রক্ত সংগ্রহ করে তারপর প্লাটিলেট আলাদা করতে হয়। ৬ ঘণ্টার মতন সময় লাগে।


সেই সময়টা সারাদিন সারারাত ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। ওর বাবা এই বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে বাংলাদেশ মেডিক্যাল থেকে প্লাটিলেট রেডি করে যখন কেবিনে প্রবেশ করলো তখন প্রায় সন্ধ্যা ৬টা। আমি চুপচাপ বসে ছিলাম কটে। কেবিনে শুধু সে আর আমি। আমার চোখের সামনে যেন আমি স্পষ্ট শারিকের চেহারাটা দেখতে পেলাম। সাদা একটা কাপড়ে মোড়ানো আমার ছেলে। চোখ দুইটা বন্ধ। কার যেন কোলে। একজোড়া হাত আস্তে করে ওকে একটা অন্ধকার গর্তে শুইয়ে দিচ্ছে। আমি কেঁপে উঠলাম। কাঁদতে কাঁদতে ওর বাবাকে বললাম কোন খারাপ কিছু একটা হবে রাসেল, আমার মন বলছে। উনি আমাকে সান্ত্বনা দিলেন। বললেন আমি নাকি বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছি, কিচ্ছু হবেনা আমাদের ছেলের।

১৬ই আগস্ট ডাক্তার জানালেন আরও দুই ব্যাগ প্লাটিলেট লাগবে। আমাকে আজকেও ওর সাথে দেখা করতে দিলো না। সারাদিন চুপচাপ বসে ছিলাম। রাত ১১টার দিকে রাসেল প্লাটিলেট নিয়ে ফিরে এলো। কেবিনে ঢুকতে না ঢুকতেই ফোন আসলো। বাবুর বাবাকে আইসিইউতে ডেকেছে। ও চলে গেলো। সাড়ে ১২ টার দিকে ও ফিরে আসলো। নিজে হাতে খাবার রেডি করে আমাকে খাওয়ালো। অন্যান্য যারা ছিল সবাই মিলে গল্প করলো। আমি শুধুই বাবুর বাবাকে লক্ষ্য করছিলাম। একটার দিকে সবাই চলে গেলো। ও আমাকে বুকের ভেতর নিয়ে ঘুমাতে বলল। আরও জানালো সকালে নাকি বোর্ড মিটিং হবে, সেখানে আমাদের উপস্থিত থাকতে হবে, তাই বিশ্রাম নেয়া জরুরী।

আমার চোখে ঘুম নাই। ওকে দেখি একটু পর পর কাকে জানি মেসেজ পাঠায়। রাত ২টার সময় হটাত করেই আমার আব্বু কেবিনে আসেন। আমি অবাক। বললাম কেন এসেছ আব্বু? তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় জানালেন আমার জন্য নাকি খারাপ লাগছিল তাই দেখতে এসেছেন। সাথে সাথেই আবার চলে গেলেন। আমি সব কিছু আন্দাজ করতে পারছিলাম, কিন্তু কেন যেন মন বলছিল আমার আন্দাজ ভুল। এর মাঝেই রাসেল আরও দুই বার কেবিনের বাহিরে গিয়েছিল বিভিন্ন অজুহাতে। রাত ৪ টায় শেষ বার গেলো। সাড়ে চারটায় কেবিনে ফিরে ও আমাকে বুকের সাথে শক্ত করে ধরে শুয়ে পড়ল। বললো সকালে মিটিং ৭ টায় হবে।


১৭ তারিখ সকাল ৭ টায় আমি চুল আঁচড়িয়ে, কাপড় পড়ে রেডি। উদ্দেশ্য মিটিং এ অংশ নেয়া। রাসেল আমাকে এক পলক দেখে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমার মা আর শাশুড়ি কেবিনে ঢুকলেন একসাথে। আমার জা একপাশে বসলেন আরেকপাশে আমার ননাস। আম্মু বলল বাবুটাকে নাকি আমরা বাঁচাতে পারলাম না। আমি তখনো বিশ্বাস করিনি। স্পষ্ট বলেছি আম্মু এসব কথা বলতে এখানে আসলে কেবিন থেকে বের হয়ে যাও। কুফা কথা বলবা না। ঠিক তখনি আমার আব্বু এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জানালেন নানাভাইকে বাঁচাতে পারলাম নারে মা!

এরপর আমার কিছুই মনে নাই। আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর যখন রাসেলের গলার আওয়াজ পেয়েছি তখন তাকিয়ে দেখেছি ও আমাকে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করছে বাবুকে কোথায় শুইয়ে দিতে চাই! আমার ইচ্ছাতেই ওকে মাটি দেয়া হবে। আমি বলেছিলাম আমার শ্বশুরবাড়িতে যেন দেয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার আমার সিদ্ধান্ত মানতে দেন নাই। কারন আমাকে অত দূরে (বরিশাল) নেয়া যাবেনা।

আমি কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধুই বাবুকে খুঁজছিলাম। আমাকে যখন কেবিন থেকে হুইলচেয়ারে করে নিচে নামায় পুরোটা রাস্তাই আমি চুপচাপ আমার ছেলেকে খুঁজেছি। নিচে নেমে দেখি ওই সকালেও হাসপাতালের সামনে লোকে লোকারণ্য। সবাই এসেছে আমার ছেলের জন্য। কেউ কেউ বাবুকে আমার কোলে দিতে চান নাই, আমি পাগলের মতন চিৎকার শুরু করি। অতঃপর আমার ছেলেকে যখন আমার কোলে দেয়া হয় আমি শান্ত-স্থির হয়ে ওকে অপলক দেখতে থাকি। ও যেন ঘুমিয়ে আছে। ঠোঁটের কোনে মিষ্টি একটা হাসি। ওর সাথে আমি কথা বলতে থাকি। আলমারকাজুলের সামনে যখন গাড়ি থামল, রাসেল বলল আমাকে একটু দাও বাবুকে আদর করব। দেয়া মাত্র ও লাফ দিয়ে শারিককে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়। আর আমাকে শক্ত
করে ধরে রাখে আমার ভাগিনা মাহিন। গাড়ি টান দেয়। এরপর আর কিছু মনে নাই।


আবার জ্ঞান ফিরে পাই যখন ওকে গোসল শেষে কাফনের কাপড় পরিয়ে আমাকে দেখাতে আনা হয়। ছেলেটার চোখে সুরমা দেয়াতে আরও যেন জ্বলজ্বল করছিল মুখখানা। আমার ছোট্ট রাজপুত্র যেন নিশ্চিন্তে তার বাবার কোলে ঘুমিয়ে আছে! আমি আর কলে নেই নি। মাথায় তখন শুধুই কাজ করেছে ওর যাতে ভালো হয় তাই করব। আমার জানামতে, মুসলিম ধর্মে শেষ গোসলের পর সম্পর্ক যাই থাকুক ছেলেরা মেয়েদের স্পর্শ করেনা- মেয়েরা ছেলেদের না। তাই মেনেছি।


পরে ওর বাবার কাছ থেকে জেনেছি ১৬ তারিখ রাত ১১টার দিকেই শারিককে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে দেয়া হয়। আমাকে ডাক্তাররা জানাতে না করেছিলেন। শুধু ওই জানতো। আর আত্মীয় স্বজনদের জানানো হয়েছিলো। বাবাটার শরীরে লাগানো মেশিনগুলো একটা একটা করে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছিল আর আইসিইউ থেকে মেসেজ দিয়ে ওর পারসোনাল নাম্বারে জানাচ্ছিল। তখন ও আইসিইউতে গিয়ে মেশিন খোলার অনুমতি দিয়ে এসেছে। ছেলেটার ছোট্ট বুকটা নাকি জোরে জোরে উঠানামা করছিল। শেষ মেশিন খোলা হয় রাত ৪ টা বেজে ২০ মিনিটে। ওর বাবা ও জীবিত থাকতেই দুজনের পক্ষ থেকে ছেলের কাছে মাফ চেয়ে নিয়েছিল। ওর বাবা ওকে নিজে হাতে গোসল দিয়েছেন, ডাভ শ্যাম্পু আর কেয়া সাবান দিয়ে গোসল দিয়েছেন। ওইদিনের পর থেকে এই দুইটা জিনিষ কোনদিন আমার বাসায় আসেনি। কবরে শুইয়ে দিয়ে তবে ফিরেছেন।

ওকে আইসিইউ থেকে ফেরত দেয়ার সময় ওর মৃত্যুর কারন জানানোর জন্য ডাঃ মুমতাহিনা সেতুর চেহারা একবারও দেখি নাই। এমনকি সান্ত্বনা দেয়ার জন্য একবার দেখাও করেন নাই। নার্সরা আমার ছেলেটাকে এসে দিয়ে চলে যায়। পরে ডেথ সার্টিফিকেট এ দেখেছি কারণ লেখা সেপটিসেমিয়া। মৃত্যুর সময় ওর প্লাটিলেট ১০০০০ এ নেমে এসেছিল।

আমরা নিয়ম মোতাবেক ৭ দিন পর্যন্ত আমাদের ঘরে চুলা ধরাই নি। কুলখানি সম্পন্ন করেছি। আকিকাও দিয়েছি। চল্লিশ দিনের চল্লিশা সম্পন্ন করেছি। ও হয়ত সবার কাছে নবজাতক শিশু ছিল। আমাদের কাছে ও সারাজীবনের স্বপ্ন, আমাদের দুইজনের ভালবাসার কষ্টের ফসল। ওর পৃথিবীতে থাকার ৯ টা দিন আমাদের কাছে অনেক কিছু। আমাদের পুত্র। আমাদের পৃথিবী।

এত কষ্ট করে এই লম্বা ইতিহাস পরার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। এই ২ বছর অসংখ্য বার ইনবক্সে অনেকেই জানতে চেয়েছেন ওর কি হয়েছিলো। সামনা সামনি অনেকেই প্রশ্ন করেছেন। আমি কাউকেই কখনো উত্তর দেই নাই। আজ একেবারে সব কিছু জানালাম। অনেক কষ্ট হয়েছে লিখতে, চোখ ভিজে যাচ্ছিল, শুধুই কাঁদছিলাম। তবু লিখলাম।

আমার প্রেগ্ন্যান্সির পুরো সময়টা জুড়ে আমি ওর জন্য ডায়রি লিখেছিলাম। বড় হয়ে ও পড়বে। এখন ডায়রিটা সেভাবেই আছে। শুধু পড়ার লোক নাই। এমনকি ওর ব্যবহার করা শেষ ডায়পার আর ওকে মুড়ানো শেষ তোয়ালে আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি। যেই কাপড় জুতো পরে ও প্রথম নানু বাড়িতে গিয়েছিল তাও আমি জমিয়ে রেখেছি। ওর টেডিবিয়ারটাও আছে সযত্নে। আর আছে ওর ছোট্ট বুকটার এক্সরে কপি। মাঝে মাঝেই ওই ছোট্ট বুকটাতে আমি হাত বুলাই, মাথা রাখি।

শুধু ওই নাই। ঘুমিয়ে আছে মিরপুরের জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানে, মাটিতে। আমার বুকের ধন মাটিতে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে।
একটাই আফসোস, তোকে ঠিক মত আদর করতে পারি নাই মা।
আমার শরীর জুড়ে তোরই গায়ের গন্ধ মেখে আছে!

"কষ্টের কথা কি বলিব, কষ্ট কাকে বলে?
কষ্ট হল মনের আগুণ, বুকের ভেতর জ্বলে।"

কষ্ট গুলো আমাদের থাক। শুধু তুই ভালো থাকো সোনা, অনেক অনেক ভালো।

দোয়া করবেন আপনারা, শারিক মোস্তাফিজ রাজিতের জন্য।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.